দিন যায়। প্রতিদিন সকাল বিকাল মিছিল যায় সামনের রাস্তা দিয়ে। বিশাল বিশাল ব্যানার হাতে মিছিল, তসলিমার ফাঁসি চাই। স্লোগানে কাঁপছে এলাকা, তসলিমার ফাঁসি চাই, দিতে হবে। পঞ্চাশ হাজার, সত্তর হাজার লোকের মিছিল প্রতিদিন। মিছিলের শব্দ শুনলেই বাড়ির মানুষগুলো, জানালার পর্দা সরিয়ে উঁকি দেয় রাস্তায়। মা বলেন, এরা তো সত্যিকার ধার্মিক না। ধার্মিকরা কাউরে মাইরা ফেলতে চায় না। টুপি পিনলে আর দাড়ি রাখলেই ধার্মিক হওয়া যায় না।
আমি হাসতে হাসতে বলি, এরা তাইলে কি?
এরা খারাপ লোক। খারাপ লোকেরা রাস্তায় নামছে খারাপ উদ্দেশ্য নিয়া। সব ঠিক হইয়া যাইব, তুমি শুধু বইলা দিবা যে ধর্ম নিয়া আর কিছু লিখবা না।
ঘড়ির কাঁটা এগোয়। খুব দ্রুত। সমস্ত শক্তি দিয়ে কাঁটাটিকে আমার থামাতে ইচ্ছে করে। দিন লাফিয়ে লাফিয়ে রাতের দিকে যেতে থাকে। রাতগুলো বিকট দৈত্যের মত অন্ধকারকে ছিঁড়ে টুকরো করে সূর্যের আগুনের দিকে ছুঁড়ে দেয়। আমি থামাতে পারি না কিছুই। ক আসেন হঠাৎ এক রাতে। সোজা আমার লেখার ঘরটিতে ঢুকে দরজা বন্ধ করে আমার মুখোমুখি বসেন। হাতে গুঁজে দেন আমার পাসপোর্টটি আর একটি টিকিট। পাসপোর্টে নরওয়ের আর সুইডেনের ভিসা। টিকিট সুইডেন যাওয়ার। সুইডিশ সরকারের পাঠানো। গভীর রাতের বিমান, ব্যাংকক হয়ে, আমস্টারডাম হয়ে স্টকহোম। ক বললেন এ ছাড়া আর কোনও পথ নেই। এটিই একমাত্র বাঁচার পথ। এটিই সরকারি সিদ্ধান্ত। জামিনের অলিখিত শর্ত। বিদেশের পরামর্শ। সে রাতে, যে রাতে আমাকে যেতে হবে, আমার বাড়িতে গভীর রাতে পুলিশের একটি বিশেষ বাহিনী এসে থামবে, কড়া নিরাপত্তা দিয়ে আমাকে নিয়ে যাবে বন্দরে। বন্দরে সুইডেনের রাষ্ট্রদূত থাকবেন, দেখা হতেও পারে, নাও হতে পারে। বিমান বন্দরে আমি ঙকে দেখতে পাবো, ঙও যাচ্ছেন আমার সঙ্গে পুরো পথ। ব্যাংকক বন্দরে আমার জন্য অপেক্ষা করতে থাকবেন সুইডিশ পররাষ্ট্রমন্ত্রণালয়ের লোক। আমি পৌঁছোতেই সুইডিশ নিরাপত্তা বাহিনীর প্রধান আমাকে তাঁর দায়িত্বে নিয়ে নেবেন। হাতে পাসপোর্ট আর টিকিট নিয়ে বিমূঢ় বসে থাকি। ক বললেন, দেশে এক মুহূর্তের নিরাপত্তা নেই। যত শীঘ্র সম্ভব দেশ ত্যাগ করতে হবে, দিনের বেলায় ত্যাগ করা সম্ভব নয়, বিমান বন্দর ঘেরাও করে রেখেছে মৌলবাদীরা। এক আগামিকালই পাওয়া গেছে গভীর রাতের যাত্রা। সে সুযোগটিই নিতে হবে।
কবে ফিরব? ককে জিজ্ঞেস করি।
ক আমার প্রশ্ন শুনে চুপ হয়ে যান। করুণ চোখে আমার দিকে তাকিয়ে বলেন, আপাতত তো যান। তারপর গিয়ে ভাবুন কবে ফিরবেন। সবই নির্ভর করছে দেশের অবস্থার ওপর। এখন যে অবস্থা এই সময় আপনার অন্য কিছু না চিন্তা করে সোজা দেশ ছাড়া উচিত। আপনার ভাগ্য ভাল যে আপনার এই সুযোগ হয়েছে।
যেতেই হবে? ভাঙা কণ্ঠ আমার।
হ্যাঁ, যেতেই হবে।
না গেলে কী হবে?
সরকার এই শর্তেই জামিন দিয়েছে।
সে জানি, কিন্তু শর্ত যদি না মানি!
শর্ত না মানলে কি হবে একটু আন্দাজ করতে পারছেন না কি? আশ্চর্য। মৌলাবাদীদের হাতে খুন হবেন। সরকার নিরাপত্তা দেবে না। জেলে পাঠাবে। জেলে কোনও নিরাপত্তা নেই আপনার। বাঁচতে চাইলে দেশ ছাড়ুন।
ভাঙা গলা আবার, এই যে মৌলবাদ বিরোধী আন্দোলন হচ্ছে, এতে কি কোনও লাভ হবে না! এই আন্দোলনে হয়ত মৌলবাদী দল হেরে যাবে। হয়ত তারা আর..
ক চাপা গলায় ধমক দেন, আপনার এইসব রোমান্টিকতা ছাড়ুন তো। মৌলবাদ বিরোধী আন্দোলন কিছুই করতে পারছে না। সব দল মিলে রাস্তায় নামলেও মৌলবাদীদের ঠেকানো এখন সম্ভব নয়।
তাহলে কি কোনও আশা নেই?
জানি না আদৌ কোনও আশা আছে কি না।
দেশের কী হবে?
দেশের কি হবে, আপাতত সে কথা নিরাপদ দূরত্বে গিয়ে ভাবুন।
ক চলে যান আমাকে বিদায়ের আলিঙ্গন করে। পাথরের গালে দুটো শুষ্ক চুম্বন পড়ে।
বাবা এগিয়ে এলেন পাথরের কাছে। টোকা দিলেন। টোকায় পাথরে কোনও শব্দ হয় না। অনেকক্ষণ পর পাথুরে কণ্ঠ থেকে বেরোয়, কালকেই চইলা যাইতে হইব।
কালকেই! বাবা থ হয়ে গেলেন। বাড়ির সবাই খবরটি শুনে চুপ হয়ে গেলেন। কোলাহলে মুখর বাড়িটি মুহূর্তের মধ্যে স্তব্ধ হয়ে যায়। যেন কেউ মারা গেছে আজ। খুব আপন কেউ হঠাৎ মারা গেছে।
ফরিদ হোসেন দুদিন ধরে চেষ্টা করছেন বাড়িতে ঢুকতে। পারেননি। আজ ঢুকে আমার লিখে রাখা উত্তরপত্রটি নিয়ে যান। তাঁর অনেকগুলো প্রশ্নের মধ্যে একটি প্রশ্ন ছিল, এখন কি দেশ ছাড়ার কথা ভাবছেন নাকি দেশেই থাকবেন? আমার উত্তর ছিল, দেশে থাকব। যা কিছুই ঘটুক, কখনও দেশ ছাড়ব না। এ দেশ আমার। আমার দেশটিকে আমি খুব ভালবাসি। ফরিদ হোসেন উত্তরপত্রটি হাতে নিয়ে খুব খুশি হয়ে যখন বেরিয়ে যাচ্ছেন, জানেন না ভেতরের ঘরে তখন একটি সবুজ সুটকেসে আমার কাপড় চোপড় ভরা হচ্ছে। সুটকেসটি বাড়ির প্রায় সবাই গুছিয়ে দিচ্ছে। আমার কোনও আগ্রহ নেই সুটকেসে, মারও নেই। সুটকেসের দিকে তাকিয়ে মা থেকে থেকে বিনিয়ে বিনিয়ে নয়, হাউমাউ করে কাঁদেন। কোথায় যাচ্ছে তাঁর মেয়ে, কবে ফিরবে মেয়ে, মা তার কিছুই জানেন না। আশঙ্কায় কাঁদেন তিনি।
পাথর হয়ে বসে থাকলে চলবে না। দ্রুত কিছু কাজ সারতে হবে। আমার অনুপস্থিতিতে মামলা চলতে হলে কিছু কাগজে আমার সইএর দরকার আছে। সারা হোসেন নিজে এসে পাওয়ার অব এটর্নির অনেকগুলো কাগজে আমার সই নিয়ে গেছেন। নিয়মিত সারার সঙ্গে যোগাযোগ রাখতে দাদাদের বলি। টাকা পয়সা যা দরকার হয়, সব যেন দেওয়া হয়। ছোটদা আমার ব্যাংক থেকে তুলতে পারবেন আমার টাকা পয়সা।
ছোটদা হেসে বলেন, কামাল হোসেন তো তর কেইসের জন্য কোনও টাকা নেয় নাই। দলিলপত্র টাইপ করা আর ফটোকপি করার জন্য যা লাগছে খালি। এমনিতে কামাল হোসেনের সাথে শুধু কথা কওয়ার ফিই হইল এক লাখ টাকা।
ছোটদা বউ বাচ্চা নিয়ে আমেরিকা পাড়ি দেবার স্বপ্ন দেখছেন। তাঁকে অনুরোধ করি যেন তিনি না যান, যেন দেশে থাকেন। আমি ফিরে আসব। সবাই আমরা একসঙ্গে থাকব। যেন আমাদের সংসারটিকে তিনি চলে গিয়ে ভেঙে না দেন। ইয়াসমিনের কোনও চাকরি নেই। বলি ব্যাংকে যে টাকা রেখে গিয়েছি, তা দিয়ে যেন চালাতে থাকে। আমি ফিরে এসে তার জন্য ভাল একটি চাকরি যোগাড় করে দেব। মিলনের আদমজির কাজটি পোষাচ্ছে না, তাকেও বলি অপেক্ষা করতে আমার জন্য। কিছু একটা নিশ্চয়ই করব আমি। রাতে ভাই বোনের সঙ্গে গায়ে গা লাগিয়ে শুয়ে থাকি। ইচ্ছে করে হাজার বছর এভাবেই কেটে যাক, এভাবেই পরস্পরের প্রতি পরম মমতায়, এভাবেই গভীর ভালবাসায় পাশাপাশি,এভাবেই আনন্দে, এভাবেই মায়া মমতায়। কতদিন আমরা এরকম এক বাড়িতে সবাই এক হইনি। ঈদের দিনের মত লাগে। ইচ্ছে করে ঈদ লেগে থাকুক জীবনে প্রতিদিনই। হা ঈদ। সারারাত মা কাঁদেন। সারারাত জেগে জেগে মার কান্না শুনি।