কীর্তন

কেন প্রাণ ওঠে কাঁদিয়া
কাঁদিয়া কাঁদিয়া কাঁদিয়া গো॥
আমি যত ভুলি ভুলি করি
তত আঁকড়িয়া ধরি
তত মরি সাধিয়া
সাধিয়া সাধিয়া সাধিয়া গো।
শ্যামের সে রূপ ভোলা কি যায়
নিখিল শ্যামল যার শোভায়।
আকাশ সাগরে বনে কান্তারে
লতায় পাতায় সে রূপ ভায়।
আমারবঁধূর রূপের ছায়া বুকে ধরি
আকাশ-আরশি নীল গো,
বহে ভুবন প্লাবিয়া কালারে ভাবিয়া
কালো সাগর-সলিল গো।
আমার শ্যামেরে কাজল পরাইতে মেঘ
ঝুরে ঝুরে ঘুরে গগনে।
আমার শ্যামের মুকুট-চূড়া হয়ে শিখী
নেচে ফেরে বন-ভবনে
সখী গো –
সখী নিখিল তারে ধেয়ায় গো।
এই রাধিকার পারা কোটি শশী তারা
তার নীল বুকে লুটায় গো।
যদি ফুল হয়ে ফুটি তরু-শাখেসে
যে পল্লব হয়ে ঘিরে থাকে।
যদি একাকিনী চলি বনতলেসে
যে ছায়া হয়ে পিছে পিছে চলে।
যদি একা ঘরে মোর দীপ জ্বালি
আসে আঁধারের রূপে বনমালী। –
সখী গো –
আমার কলঙ্কী চাঁদ।
তার কলঙ্ক চেয়ে জ্যোৎস্না বেশি,
কলঙ্ক তার দেখে কে।
লোকে আমার চাঁদে কলঙ্কী কয়
জ্যোৎস্না তাহারই মেখে।
আমি তারই-র লাগি
অ কুমুদিনী হয়ে জলে ডুবে রই তারই-র লাগি
আমি চকোরিণী হয়ে নিশীথ জাগি তারই-র লাগি।
আমার প্রাণের সাগরে জোয়ার জাগে চাঁদের লাগি।
রাতে রবির কিরণ শরণ মাগে চাঁদের লাগি।
আমার কলঙ্কী চাঁদ।
আমি যেদিকে তাকাই হেরি ও-রূপ কেবল,
সে যে আমারই মাঝারে রহে করি নানা ছল।
সে যে বেণি হয়ে দুলে পিঠে চপল চতুর।
সে যে আঁখির তারায় হাসে কপট নিঠুর।
সখী গো –
সখী আঁখি মোর বিবাদী হল
সেও কালার রূপে গলে।
আমার বুকের কথা চোখে এল
চোখের জল সই সেও কালো।
সখী লো মোর মরণ ভালো!

সে যে আঁখিপাতা হয়ে থাকে ঘিরিয়া আঁখি
বনে বনে ডাকে তারই আঁখি কোয়েলা পাখি।
কাঁদে ফাল্গুনে গুণ গুণ ফুল-ভোমরা,
বন-হরিণীর চোখে তারই কাজল পরা।
তারে কেমনে ভুলিব।
বলো সখী তারে কেমনে ভুলিব।
আমার অঙ্গ জড়ায়ে দুলে সে রঙ্গে
শাড়ি সে নীলাম্বরী গো।
আমি কুল ছাড়িয়াছি, আজ দেখি সখী
দুকুল লইয়া মরি গো,
আমি বসন-ভূষণ তারই-র সখা
কেমনে তায় ভুলিব।
থাকে কবরী-বন্ধে কালো ডোর হয়ে
কাল ফণী কালো কেশে গো।
থাকে কপালের টিপে, চোখের কাজলে,
কপোলের তিলে মিশে গো।
আমার একুল ওকুল দুকুল গেল।
আমার কুলে সই পড়িল কালি
সেও কালার রূপে এল।
আমার কপালের কলঙ্ক-তিলক
সেও কালার রূপে এল।
রাখি কী দিয়া মন বাঁধিয়া,
আমার সকলই ভাসিল সখী
কালো যমুনারই জলে
সকলই ভাসিল –
রাখিকী দিয়া মন বাঁধিয়া
বাঁধিয়া বাঁধিয়া বাঁধিয়া গো ॥

<

Kazi Nazrul Islam ।। কাজী নজরুল ইসলাম