০৬.

থামুন! থামুন আপনারা! দোহাই আপনাদের! শান্ত হোন! পাগলের মত চিৎকার শুরু করল কিশোর। সিসি ডাইনী নয়! তাকে আমি চিনি। তার মত ভাল মেয়ে কম দেখেছি আমি।

কিশোর ভাই, ওরা আমাকে যা-তা বলছে, কেঁদে ফেলল। সিসি। আমি খারাপ কিছু নই। মোটেও ঠিক নয় ওদের কথা।

সিসির দিকে তাকাল কিশোর। ওর সবুজ চোখের তারা পানিতে ঢাকা পড়েছে।

ঠিক তো নয়ই, আমি কি জানি না সেটা, সিসির কাঁধে হাত রেখে তাকে আশ্বস্ত করতে চাইল কিশোর। ভয়ে কাঁপছে সিসি।

কিশোরের প্যান্ট খামচে ধরে পায়ের সঙ্গে সেঁটে রয়েছে। হেনরি। ওর মাথায়ও আলতো চাপড় দিয়ে অভয় দেয়ার চেষ্টা করল কিশোর।

কি করে ভাবছে ওরা সিসির মত একটা মেয়ে ডাইনী হতে পারে? রাগ ফুঁসে উঠতে লাগল কিশোরের মনের মধ্যে।

ওকে খারাপ ভাবছেন কেন আপনারা? লোকগুলোকে বোঝাতে গেল সে। লং হার্ট জন্তু-জানোয়ারদের বশ করতে জানতেন, তাঁর সঙ্গে থেকে থেকে ওদের সামলাতে শিখেছে সিসি। জানোয়ারেরা তাকে বিশ্বাস করে। যেমন আমি করি।

দুই হাতে জনতাকে ঠেলে সরিয়ে এসে কিশোরের মুখোমুখি দাঁড়াল মার্ক ফ্রেঞ্চ। জোরে জোরে হাঁপাচ্ছে। চিৎকার করে উঠল, ওই ইনডিয়ান হারামজাদাটাই ছিল যত নষ্টের গোড়া। ওর ভয়ে গাঁয়ের কেউ কথা বলতে পারত না। সবাই ভেবেছিল, মরেছে, গ-সুদ্ধ বেঁচেছে। কিন্তু এখন তো দেখা যাচ্ছে শয়তান কখনও মরে না। বংশধর রেখে যায়। সমস্ত তুকতাক শিখিয়ে দিয়ে গেছে এই ডাইনীটাকে। সিসির দিকে আঙুল তুলল সে। ডাইনীদের চেহারা ভালই হয়। নইলে মানুষের মন ভোলাবে কি করে?

সবাই মার্কের কথায় সায় দিয়ে মাথা ঝাঁকাতে লাগল। জোরাল গুঞ্জন উঠল তাদের মাঝে।

আপনারা যা-ই বলুন, জনতার দিকে তাকিয়ে বোঝানোর চেষ্টা করল কিশোর, ঘোড়াগুলোর খেপে ওঠার পেছনে সিসির কোন হাত ছিল না। আপনারা নিজের চোখে দেখেছেন লাগাম টেনে ধরে সিসির ঘোড়াটাকে ফেলে দিতে চেয়েছিল জন। পড়ে গেলে ঘোড়াটা সহ মারা পড়ত সিসি। পরের বার যখন আবার একই কাজ করতে গিয়েছিল, বেসামাল হয়ে পড়ে ওদের ঘোড়া দুটো। এটা কি সিসির দোষ?

কিশোরের দিক থেকে জ্বলন্ত চোখের দৃষ্টি জনতার দিকে ফেরাল মার্ক। অস্বস্তিতে পায়ের ওপর ভার বল করল কেউ কেউ। সবাই চোখ নামিয়ে নিল। মার্কের বিরুদ্ধে সত্যি কথাটা বলতেও ভয় পাচ্ছে ওরা। ওর আক্রোশের শিকার হয়ে পরিবার পরিজন নিয়ে ধনে-প্রাণে মারা পড়তে চায় না। গলা শুকিয়ে গেল কিশোরের।

তুমি কি বলতে চাও আমার ভাই অন্যায় কিছু করেছে? কিশোরের দিকে এক পা এগিয়ে গেল মার্ক।

কি করেছে সেটা সবাই দেখেছে। আমি কেবল সত্যি কথাটা বললাম।

চোখের পাতা সরু সরু হয়ে এল মার্কের। ওই বাড়ির সবগুলো মানুষ শয়তান। ফকির-ফোকরা যেগুলো বাইরে থেকে আসে সেগুলোও শয়তান।

আমার তো ধারণা, ফকির-ফোকরাগুলো আসে বলেই এই শয়তানের গায়ে মানুষ এখনও বেঁচে আছে, নইলে বহু আগেই জমিদার-ফমিদারদের অত্যাচারে খতম হয়ে যেত। আর ফমিদারগুলোও তো বাইরে থেকেই ঘটি-কম্বল নিয়ে আসা। এখানকার নিরীহ মানুষের ঘাড় মটকে রক্ত চুষে বড়লোক হয়েছে।

কি বললি! ফকিরের বাচ্চার এত্ত বড় সাহস! চড় মারার ও ভঙ্গিতে হাত উঠে গেল মার্কের।

দুই ধাক্কায় সিসি আর হেনরিকে দুই পাশে সরিয়ে দিল কিশোর। চোখের পলকে ডান পাটা চলে এল সামনে। সামনের দিকে সামান্য কুঁজো হয়ে গেছে দেহ। কারাতে মারের কায়দায় দুই হাত উঠে গেছে, একটা সামনে, একটা পেছনে। এর চীনা মারের এই ভঙ্গিটা মার্কের একেবারে অপরিচিত নয়। কিশোরের ক্ষিপ্রতা আর চোখের ভয়ঙ্কর দৃষ্টি দমিয়ে দিল তাকে।

ভুরু নাচাল কিশোর, কি হলো, মারছ না কেন? মারো! দেখি তোমার তাকত! মেয়েমানুষের সঙ্গে হেরে ভূত হও, চালাকি করেও জিততে পারো না, আবার বড় বড় কথা বলতে এসেছ!

খবরদার! মুখ সামলে কথা বলবে! গর্জে উঠল মার্ক।

তাই তো করছিলাম এতক্ষণ! দুর্বল পেলে মারতে খুব মজা লাগে, না? তোমার ভাইয়ের ভেঙেছে হাত, আমি তোমার ঘাড়টা মটকে দেব। এসো! মারো!

কিশোরের মারমুখো ভঙ্গি দেখে আর এগোতে সাহস করল না মার্ক। এক পা পিছিয়ে গেল। দুই হাত ঝাড়তে ঝাড়তে বলল, আজকে ছেড়ে দিলাম। আরেকদিন এ রকম বেয়াদবি করতে দেখলে…

আমরা কিচ্ছু করিনি, জবাব দিল কিশোর। শয়তানিটা তোমরা শুরু করেছ। সিসিকে রেসে অংশ নিতে দেয়ার ইচ্ছে ছিল না তোমাদের।

হ্যাঁ, সত্যিই নিতে চাইনি, মাথা ঝাঁকাল মার্ক। কেন জানো? কাচু-পিকচুতে তোমাদের চাই না আমরা। বাপ-মা দুটো উধাও হয়েছে। শয়তানের চেলা ছিল বোধহয়, শয়তানেই ধরে নিয়ে গেছে দোজখের মানুষকে জ্বালানোর জন্যে। বাকি দুটো চেলা ওয়্যাগন উল্টে মরেছে। বাকি আছ তোমরা। মাটিতে থুথু ফেলল মার্ক। সাহস করে কিশোরের চোখে আর ফেলতে পারল না। এতিমদের মিছিলের সঙ্গে বিদেয় হয়ে গেলেই পারো। শুনলাম, কয়েক দিনের মধ্যেই এখান দিয়ে যাবে একটা কাফেলা। যাওয়ার জন্যে সাহায্য চাইলে বরং সাহায্য করতে পারি। চাইকি, কিছু পয়সাও ভিক্ষে দিয়ে দেব।

কিশোর কোন জবাব দেবার আগেই ঝটকা দিয়ে ঘুরে গটমট করে চলে গেল মার্ক।  চারপাশে ঘিরে থাকা জনতার দিকে তাকাল কিশোর। কারও চোখে ভয়। কারও রাগ। মিস্টার রনসনকে দেখল চোখে। সহানুভূতি নিয়ে তাকিয়ে আছেন ওদের দিকে। কিশোরের চোখে চোখ পড়তেই মনে হলো কথা বলবেন। কিন্তু ওই মুহূর্তে পাশে এসে দাঁড়ালেন মিসেস রনসন। স্বামীর হাত ধরে টেনে সরিয়ে নিয়ে গেলেন তাকে।

কেউ আসবে না সাহায্য করতে, বুঝে গেল কিশোর। ফ্রেঞ্চ জিততে পারেনি, জনতার উদ্দেশ্যে বলল সে, আপনারা সবাই দেখেছেন। সিসি জিতেছে। প্রথম পুরস্কারটা তার পাওনা এখন।

সামনে এগিয়ে এল গ্যারিবাল্ড। এ খেলার বিচারক হিসেবে আমার রায়, চালাকি করে জিতেছে সিসি। তার জেতা নিয়ে প্রশ্ন তোলা যায়। এমতাবস্থায় তাকে পুরস্কারের টাকা দেয়া উচিত হবে না। জনতার দিকে তাকিয়ে হাত নাড়ল সে। আমার রায়ে কারও কোন আপত্তি আছে?

একটা লোকও জবাব দিল না। সবাই নীরব।

সিসি জিতেছে, দৃঢ়কণ্ঠে ঘোষণা করে দিল কিশোর, আপনি তাকে টাকাটা দেন বা না দেন।

দি ইয়াং ম্যান, যথেষ্ট বলে ফেলেছ। আর একটা বাক্যও না। যদি ভাল চাও, ছেলে-মেয়ে দুটোকে নিয়ে এখন বিদেয় হও এখান থেকে, কর্কশ কণ্ঠে বলল গ্যারিবাল্ড।

লোকটার ফোলা ভুঁড়িতে ঘুসি মারার প্রবল ইচ্ছেটা অনেক কষ্টে রাৈধ করল কিশোর। এত রাগ তার কমই হয়েছে। আঙুলগুলো মুঠোবদ্ধ হয়ে গেছে।

ব্যাপারটা লক্ষ করল সিসি। তাড়াতাড়ি কিশোরের হাত ধরে টান দিল, এসো, কিশোরভাই। চলো, বাড়ি চলো।…তোমরা এগোও, আমি গোস্টকে নিয়ে আসি।

ঘুরে দাঁড়াল কিশোর। গ্যারিবাল্ড বা অন্য কারও দিকে একটিবারের জন্যে ফিরে তাকাল না আর। ওদের প্রতি তীব্র ঘৃণাটা বুঝিয়ে দিয়ে হেনরিকে বলল, চলো, হেনরি।

শহর থেকে বেরোনোর রাস্তা ধরে দ্রুত এগিয়ে চলল সে।

মগজে ওগুলোর একটারও ঘিলু নেই, আনমনে বিড়বিড় করতে লাগল কিশোর। কুসংস্কারে ভরা। নইলে কি আর সিসিকে ডাইনী বলে।

হেনরির দিকে তাকাল সে। নিষ্পাপ চোখ মেলে তার দিকে তাকাল হেনরি। বড় মিষ্টি লাগল মুখটা। রাগ অনেক কমে গেল কিশোরের। ভয় নেই, হেনরি। তোমাদের কিশোরভাই বেঁচে থাকতে তোমাদের একটা চুলও কেউ খসাতে পারবে না। গাঁয়ের লোককে নিয়েও চিন্তা নেই। সিসিকে টাকা দিতে হয়নি, চুকে গেছে। ঘটনাটা নিয়ে আর বিশেষ মাথা ঘামাবে না কেউ।

হেনরিকে বলল বটে, কিন্তু কথাটা নিজেই বিশ্বাস করতে পারল না কিশোর। ফ্রেঞ্চদের কোন বিশ্বাস নেই। তাদের সঙ্গে জুটেছে আবার গ্যারিবান্ডের মত একটা ভয়ানক কুটিল পা-চাটা লোক।

শহরের বাইরে চৌরাস্তাটায় এসে সিসির অপেক্ষা করল ওরা। খানিক পরেই গোস্টের লাগাম ধরে টেনে নিয়ে আসতে দেখা গেল সিসিকে। ঘোড়াটা কাছে এলে হেনরিকে ওটার পিঠে বসিয়ে দিল কিশোর।

কিশোরভাই, সত্যি তুমি আমাদেরকে এতিম আর অসহায়দের মিছিলে দিয়ে দেবে? হাঁটতে হাঁটতে জিজ্ঞেস করল সিসি। গলা কেঁপে উঠল ওর।

ফিরে তাকাল কিশোর। না। ফার্মটা আছে এখনও। মাথার ওপর চালা আছে আমাদের, চাষের খেত আছে; আমরা তো বাস্তুহারা নই।

আশ্বস্ত হলো সিসি। কিন্তু কিশোর হতে পারল না। আর কতদিন ওদের থাকতে দেবে গ্যারিবাল্ডং আজকের ঘটনার পর যে কোনদিন এসে হাজির হবে সে। টাকা দিতে না পারলে ঘাড় ধরে বের করে দেবে। কিছুই করার থাকবে না তখন।

দমিয়ে দেয়া ভাবনাগুলো মন থেকে ঝেড়ে ফেলল কিশোর। সিসির দিকে তাকাল। হাসল সিসি। দুশ্চিন্তার ছাপ নেই আর। মুখে। হেনরির মুখেও ভয় নেই। এদেরকে অসহায় অবস্থায় বিপদের মধ্যে ফেলে কোথাও চলে যাওয়া এখন অসম্ভব-ভাবছে কিশোর। এমন এক বেকায়দা অবস্থায় পড়েছে, নিজের কথাও ভাবতে পারছে না। নিজে যে কি করে এখানে এল, কে তাকে ফেলে গেল, সেই রহস্যের সমাধান করারও সুযোগ নেই। ছেলে মেয়ে দুটোর একটা কিনারা না করে বাড়ি ফিরে যাওয়ারও চেষ্টা করতে পারছে না। সিসি আর হেনরির একটা গতি না করে এই পরিস্থিতিতে ওদের ফেলে যেতে পারবে না সে।

সিসি, বাড়ির দিকে হাঁটতে হাঁটতে বলল সে, কোন চিন্তা, কোরো না। তোমাদের ব্যবস্থা না করে আমি কোথাও যাব না।

তারমানে ব্যবস্থা হলেই তুমি আমাদের ফেলে চলে যাবে! চোখ ছলছল করে উঠল সিসির।

আরি, আবার কাঁদবে নাকি!…থাক থাক, যাব না কোথাও! কেঁদো না! যদি কোথাও যাই, মানে যেতে হয়, তোমাদের সঙ্গে নিয়েই যাব।.. নাও, এখন চোখ মোছো। বোকা মেয়ে কোথাকার।

চোখ মুছল সিসি। কিন্তু হাসি ফুটল না মুখে। কিশোরভাই, তুমিও কি আমাকে ডাইনী মনে করো? লোকগুলো যা বলেছে, বিশ্বাস করো?

পাগল নাকি! আমি কি ওগুলোর মত ছাগল? জন্তু জানোয়ারকে কথা শোনানোর ক্ষমতা আছে তোমার, গর্ব করার মত বিদ্যে এটা। এখন তো আমার রীতিমত দুঃখ হচ্ছে, আমিও শিখলাম না কেন?

শেখোনি ভাল করেছ। তাহলে তোমাকেও শয়তান বলত লোকগুলো।

তা তো বলতই।

তবে তোমার কিছু করতে পারত না। যা সাহস দেখলাম আজ তোমার। এতগুলো লোকের বিরুদ্ধে যেভাবে রুখে দাঁড়ালে। মার্কের মত খেপা শুয়োরও তোমার ধমকে কুঁকড়ে গেল।…যা-ই বলো, ওর ভাইটার হাত ভাঙাতে আমি খুশিই হয়েছি। ঘাড় মটকে মরলে আরও খুশি হতাম।

খিলখিল করে হাসতে লাগল সিসি। বোনকে হাসতে দেখেই যেন হেনরিও হাসল।

কিন্তু কিশোর হাসতে পারল না। সিসির কথা আর হাসি চমকে দিয়েছে তাকে। মেরুদণ্ড বেয়ে নেমে গেল শীতল শিহরণ।

০৭.

দিন কয়েক পর। কুড়াল দিয়ে লাকড়ি ফাড়তে ফাড়তে ভাবছে কিশোর-এই একটি কাজ অন্তত জানোয়ারের সাহায্য ছাড়া করা যায়। মাথার ওপর কুড়াল তুলে ঘুরিয়ে কোপ মারল আবার লাকড়ির গায়ে। কাঠের টুকরো ছড়িয়ে পড়তে লাগল চারদিকে। একপাশে জমে উঠছে লাকড়ির স্তূপ। লক্ষই নেই সেদিকে। তার মন জুড়ে রয়েছে অচষা জমিটা।

পর পর কয়েকদিন খচ্চরটাকে দিয়ে হাল টানানোর চেষ্টা করে ব্যর্থ হয়েছে সে। গ্যাট হয়ে থাকে। কোনমতেই ওটাকে দিয়ে কাজ করাতে পারে না। এগোতেই চায় না। প্রতিরাতে যখন বিছানায় এসে গড়িয়ে পড়ে কিশোর, সারা গায়ে ব্যথা, ক্লান্তিতে ভেঙে আসে, তখনও ঘুম আসতে চায় না তার। গ্যারিবান্ডের মুখটা কুৎসিত, বিকৃত হয়ে চোখের সামনে ভাসতে থাকে। সেই যে পেটের মধ্যে খামচি দিয়ে ধরে, আর যেতে চায় না।

আজ আসেনি গ্যারিবাল্ড। কাল আসবে। কিংবা পরশু দিন। আসবেই সে, জানে কিশোর। সামান্য যে কটা টাকা আছে আর, তা দিয়ে গ্যারিবান্ডের ঋণ শোধ হবে না। বাড়িটা কেড়ে নেবে গ্যারিবাল্ড।

ছেলেমেয়ে দুটোকে নিয়ে তখন কোথায় যাবে? কি করবে?

কাফেলার কথাটা প্রথমে পছন্দ হয়নি তার। কিন্তু এখন যতই ভাবছে, ততই মনে হচ্ছে সে-ই ভাল। চলেই যাবে। আর কোন উপায়ও নেই। এ শহরে কেউ কাজ দেবে না তাকে। খাবার দেবে না! তার চেয়ে মিছিলে যোগ দিয়ে বেরিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করাই উচিত। কি করে এল সে, সেই রহস্যের সমাধানের চেয়ে বেঁচে থাকার চিন্তা করা দরকার আগে।

কুপিয়েই চলেছে কিশোর। কুপিয়েই চলেছে। তার আশঙ্কাটা কোনমতেই প্রকাশ করতে পারে না সিসি আর হেনরির কাছে। মুখ ফুটে বলতে পারে না যে কোন সময় এসে ওদেরকে বাড়ি থেকে বের করে দেবে গ্যারিবাল্ড। এতিমের মিছিলে ছাড়া তখন আর কোথাও ঠাই হবে না ওদের…

ঘোড়ার খুরের শব্দে ভাবনার সুতোটা ছিঁড়ে গেল তার। কুড়ালটা মাটিতে ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে ফিরে তাকাল। ওদের পড়শী। আরনি হুফ। খোলা মাঠের ওপর দিয়ে ঘোড়া ছুটিয়ে আসছে। পাশাপাশিই থাকে, কিন্তু দেখা-সাক্ষাৎ খুব একটা হয় না।

আরনির ছুটে আসার ভঙ্গিতে অশনি-সঙ্কেত দেখতে পেল কিশোর। পেটের মধ্যে মোচড় দিয়ে উঠল। ইদানীং দুঃসংবাদের আশঙ্কা দেখলেই এমন হয় তার। হেঁটে গেল সামনের বারান্দার দিকে।

সিঁড়িতে বসে আছে হেনরি। কাঠের একটা খেলনা, ঘোড়ার পা ছুটে গেছে, কোনমতেই লাগাতে পারছে না। লাগিয়ে দিল কিশোর। মুখ তুলে তার দিকে তাকিয়ে হাসল হেনরি।

 কি হয়েছিল ঘোড়াটার? জিজ্ঞেস করল কিশোর।

হাসিটা মুছে গেল হেনরির মুখ থেকে। কথা বলে জবাব দিতে না পারার দুঃখেই যেন জোরে জোরে মাথা ঝাঁকাতে লাগল।

ওর চুলে আঙুল বুলিয়ে দিল কিশোর। থাক, হেনরি। একদিন তুমি আবার কথা বলতে পারবে।

লাগাম টেনে ঘোড়া থামাল আরনি। মুখ তুলে তাকাল কিশোর। মাটিতে পা ঠুকতে ঠুকতে মৃদু ডাক ছাড়ল ঘোড়াটা।

হাল্লো, আরনি, স্বাগত জানাল কিশোর। কেমন আছেন?

ভাল না, কিশোর। তোমাকে সাবধান করতে এলাম। কি হয়েছে? বুকের মধ্যে কাপুনি উঠে গেল কিশোরের।

অদ্ভুত এক রোগ। গরুর। পাগল করে দিচ্ছে। জানোয়ারগুলোকে। গতকাল ফ্রেঞ্চরা ওদের ছয়টা গরুকে গুলি করে মারতে বাধ্য হয়েছে। আমরা মেরেছি আজকে তিনটাকে।

বলেন কি!

 হ্যাঁ, তাই।

কিন্তু আমাদেরগুলোর তো এখনও কিছু হতে দেখলাম না, বলে বারান্দা থেকে নামল কিশোর। অসুস্থ যে সেটা কিভাবে বোঝা যাবে?

ঘোড়া থেকে নামল আরনি। চলো, তোমাকে দেখিয়ে দিচ্ছি।

বাড়ির পেছনে আরনিকে নিয়ে এল কিশোর। পায়ের শব্দে মুখ। ফিরিয়ে দেখল হেনরিও এসেছে পেছন পেছন। তার দিকে তাকিয়ে হাসল কিশোর।

আমাদের তো আছেই মাত্র কটা গরু, কিশোর বলল। ওখানটায় ছেড়ে রেখেছি চরে খাবার জন্যে। গোয়ালে আর নিই না।

নিচু হয়ে একটা গরুর শিং চেপে ধরল আরনি। মাথা ঝাড়া দিয়ে ছাড়ানোর চেষ্টা করতে লাগল গরুটা। ডাকতে শুরু করল। কিন্তু শক্ত করে ধরে রাখল আরনি। একবার এপাশে, একবার ওপাশে কাত করে গরুর মুখটা দেখল।

কি দেখছেন? জানতে চাইল কিশোর। হাঁটু মুড়ে বসেছে গরুটার মুখের কাছে। তার পাশে বসে হেনরিও তাকিয়ে আছে কৌতূহলী চোখে।

 অসুস্থ হলে নাক দিয়ে সবুজ গাজলা বেরোয়, আরনি বলল। তারপর লাল হয়ে যায়। যন্ত্রণায় পাগল হয়ে ওঠে গরুগুলো।

খুব খারাপ লোগ মনে হচ্ছে, কিশোর বলল।

 খারাপ না হলে কি আর নিজের গরু গুলি করে মারতে হয়। এ রকম রোগের কথা কেউ কখনও শোনেনি। গায়ের লোকে ভাবছে, অশুভ কোন কিছুর ছায়া পড়েছে গাঁয়ে। কিশোরের দিকে তাকাল আরনি, তোমাদের গরুগুলো তো ভালই আছে দেখছি।

এখনও আছে। হতে কতক্ষণ। ভালমত খেয়াল রাখতে হবে। একটা গরু খোয়ালেও মস্ত ক্ষতি হয়ে যাবে আমাদের।

ফিরে যাওয়ার জন্যে ঘুরতে গিয়েই বরফের মত জমে গেল যেন আরনি। আতঙ্কে ঠিকরে বেরিয়ে আসতে চাইছে চোখ।

কি দেখে এমন হলো আরনির দেখার জন্যে তাকাল কিশোর। পেছনের আঙিনায় একটা নেকড়েকে মুখে তুলে মাংস খাইয়ে দিচ্ছে সিসি।

অস্ফুট একটা শব্দ করে পিছিয়ে গেল আরনি। সিসি, সাবধান! ওটা নেকড়ে! কুকুর নয়! হেনরিকে দেখিয়ে কিশোরকে বলল, বাচ্চাটাকে ঘরে ঢোকাও। বন্দুক নিয়ে এসো।

ও কিছু না। ভয় পাবেন না, আরনিকে আশ্বস্ত করতে চাইল কিশোর। জন্তু-জানোয়ারের সঙ্গে সহজেই খাতির করে ফেলতে পারে সিসি। নেকড়েটা ওর কিছু করবে না।

কিন্তু শঙ্কামুক্ত হতে পারল না আরনি। কিন্তু ওটা নেকড়ে। গত বছর আমাদের অনেকগুলো গরু-ছাগল মেরে ফেলেছিল নেকড়েতে…আমি…আমি যাই…

দৌড়ে আঙিনা পার হয়ে গেল আরনি। মিনিটখানেক পরেই ওর ঘোড়ার ছুটন্ত পদশব্দ কানে এল কিশোরের। গরুগুলো বাবা করে হাঁক ছাড়ল কয়েকটা। তারপর নাক ঝাড়তে লাগল।

উঠে এসে একটা গরুর কপালে হাত রাখল সিসি। লম্বা জিভ বের করে ওর কনুই চেটে দিল গরুটা।

আরনি এসেছিল কেন? জিজ্ঞেস করল সিসি।

গরুর নাকি কি এক আজব রোগ হচ্ছে, কিশোর বলল।

মুখটা উঁচু করে ধরল সিসি। বাধা দিল না গরুটা। আরনি ধরাতে যেমন করেছিল, তার কিছুই করল না, চুপচাপ দেখতে দিল সিসিকে।

নাহ, আমাদেরটা সুস্থই আছে, স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে বলল সিসি। জন্তু-জানোয়ারের দুঃখ-যন্ত্রণা ওদের মত করেই বুঝতে পারে।

আরনিও বলছিল ভালই আছে, কিশোর বলল। কিন্তু নিশ্চিন্ত হতে পারছিলাম না। তুমি যখন বলছ কিছু হয়নি, তারমানে সত্যি হয়নি, এতক্ষণে নিশ্চিন্ত হলাম।

ও ভাল থাকবে, গরুটার মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে লাগল সিসি। আমাদের একটা গরুরও কিছু হবে না।

না হলেই ভাল। এখন একটা গরু খোয়ানো মানে আমাদের বিরাট ক্ষতি। পাড়া-পড়শীদের গরুগুলোকে যে ভাবে গুলি করে মারতে হচ্ছে…

তার জন্যে কি দুঃখ হচ্ছে তোমার? প্রচণ্ড রাগ ঝিলিক দিয়ে উঠল সিসির চোখে। মরুক না! সব মরে সাফ হোক। শয়তানদের!

কি বলছ তুমি, সিসি!

ঠিকই বলছি। যেমন পাজী, ওদের শাস্তি হওয়াই উচিত। ওরা বলে আমি নাকি ডাইনী!

০৮.

সেই শনিবারে হেনরি আর সিসিকে নিয়ে শহরে গেল কিশোর, দোকান থেকে জিনিস কিনে আনতে। সপ্তাহের এ দিনটিতে এলাকার সমস্ত চাষী বাজার করতে আসে। লোকে গমগম করে শহরটা।

কিন্তু সে দিন লোকের ভিড় দেখা গেল না মোটেও। কাঠের সাইডওয়াক ধরে হাতে গোণা কয়েকজন লোক হেঁটে যাচ্ছে। কেমন ভুতুড়ে নিস্তব্ধতা। পুরো শহরই যেন শোক পালনে রত।

রনসনস জেনারেল স্টোরের দরজা ঠেলে খুলল কিশোর। পাল্লার ওপরে লাগানো ঘণ্টা বেজে উঠে জানান দিল দোকানে খরিদ্দার ঢুকেছে। শব্দটা অনেক বেশি জোরাল মনে হলো কিশোরের কাছে। কারণ ভেতরে খরিদ্দারের ভিড় নেই, কোলাহল নেই। জুতোর শব্দ তুলে লোহাকাঠের পাটাতনের ওপর দিয়ে হেঁটে গেল কিশোর। তাকে অনুসরণ করল সিসি আর হেনরি।

স্টোররুমের পর্দা সরিয়ে দোকানে ঢুকলেন মিস্টার রনসন। হাসলেন। গুড ডে, কিশোর। তারপর, কেমন আছ তোমরা?

আছি ভালই, জবাব দিল কিশোর। শহরটা এমন নীরব কেন?

সারা হপ্তা ধরেই নীরব, রনসন জানালেন। গরুর রোগ নিয়ে মহা দুশ্চিন্তায় আছে লোকে। রোগ সারানোর সব রকম চেষ্টা করছে। কোন লাভ হচ্ছে না। তুমি কটাকে গুলি করলে?

একটাও না।

চোখ বড় বড় হয়ে গেল মিস্টার রনসনের। বলো কি! কি খাইয়ে রোগ সারালে?

আমাদের গরুর রোগই হয়নি।

সন্দেহ জাগল মিস্টার রনসনের চোখে। কেন হচ্ছে না বুঝতে পারছ কিছু?

কেন আবার! আমাদের ভাগ্য ভাল।

সিসির দিকে দৃষ্টি সরে গেল মিস্টার রনসনের। হবে হয়তো।…ভাগ্য ভাল, নাকি অন্য কিছু?

অন্য আর কি হবে?

হুঁ! আনমনে মাথা ঝাঁকালেন মিস্টার রনসন। অবস্থাটা এমনই এখানকার, কারোরই মন-মেজাজ ভাল নেই। তা কি লাগবে তোমাদের?

কিছু চিনি আর ময়দা, কিশোর বলল। আর সামান্য টিনের খাবার।

পকেট থেকে তার শেষ সম্বল নোটের তাড়াটা বের করে আনল কিশোর। এক হাজার পেসো কাউন্টারে রেখে ঠেলে দিয়ে বলল, এতে যা হয়, দিন।

দাঁড়াও, বাক্সে ভরে দিচ্ছি।

কাউন্টারের ওপাশে নিচু হয়েই স্থির হয়ে গেলেন তিনি। কণ্ঠস্বর খাদে নামিয়ে বললেন, এই, তোমরা সরে যাও ওখান থেকে!

কাউন্টারের ওপর দিয়ে গলা বাড়িয়ে দিল সিসি। দেখল, একটা বাক্স উঁচু করে ধরে রেখেছেন মিস্টার রনসন।

কি হয়েছে, মিস্টার রনসন? জিজ্ঞেস করল সে।

সাপ, ফিসফিস করে জবাব দিলেন মিস্টার রনসন। এত বড় সাপ জীবনে দেখিনি। জলদি গিয়ে দেখো বাইরে কার কাছে বন্দুক আছে।

কিশোর বাধা দেয়ার আগেই কাউন্টার ঘুরে অন্যপাশে চলে গেল সিসি। হাঁটু গেড়ে বসে পড়ল সাপটার কাছে। ঘাবড়াবেন না, মিস্টার রনসন। ও আপনাকে কিছু করবে না।

আস্তে হাতটা বাড়িয়ে দিল সিসি। ভয়ে কাঠ হয়ে গিয়ে কিশোর দেখল, বিশাল সবুজ সাপটা ধীরে ধীরে সিসির হাত বেয়ে উঠে আসছে কাঁধের দিকে। ওর গলায় পেঁচিয়ে গেল মালার মত। শয়তানি ভরা কালো চোখের চাহনি সিসির ওপর স্থির। চেরা মাথাওয়ালা লাল জিভটা ঘন ঘন বেরিয়ে আসছে মুখের ভেতর থেকে।

হ্যাচকা টানে হেনরিকে নিজের পেছনে নিয়ে গিয়ে আড়াল করে রাখল কিশোর। সাপটার বাকা বড় বড় বিষদাঁতের দিকে তাকিয়ে শুকিয়ে গেল গলা। ঢোক গিলল বড় করে।

সাপটার মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে লাগল সিসি। ফোঁস ফোঁস করছে ওটা। কিশোরের চোখে চোখ রাখল সিসি। ভয় নেই, কিশোরভাই, ওটা আমাকে কিছু করবে না। বাড়ির কাছে গিয়ে বনে ছেড়ে দেব।

কাউন্টারের ওপাশ থেকে বেরিয়ে এল সিসি। সাপের লম্বা লেজটা ঝুলে আছে ওর পিঠের ওপর। হাত বাড়িয়ে লেজের ডগাটা ছুঁয়ে দেখল হেনরি। কিশোর ওসব কিছুই করতে পারল না। ভয়ে কেঁপে উঠল সে। জানে, বনের জানোয়ারের সঙ্গে ভাব করতে এক মুহূর্তও লাগে না সিসির। কিন্তু তাই বলে এতবড় একটা বিষাক্ত সাপকে গলায় পেঁচিয়ে রাখা!

পাথরের মূর্তি হয়ে দাঁড়িয়ে আছেন মিস্টার রনসন। কাঁপছেন থরথর করে। দোকান বন্ধ করে দিচ্ছি আমি, কম্পিত স্বরে বললেন।

আমাদের জিনিসগুলো? কিশোর বলল।

আরেক দিন এসে নিও।

কাউন্টারে রাখা মুদ্রাটা হাত দিয়ে টেনে সরিয়ে আনল কিশোর। তুলে নিয়ে পকেটে ভরল। হতাশ কণ্ঠে বলল, সিসি। হেনরি। চলো, যাই।

দোকান থেকে বেরিয়ে এল ওরা। দড়াম করে মিস্টার রনসনকে পাল্লা লাগাতে শুনল। তালা আটকে দিলেন তিনি।

রাস্তা ধরে হেঁটে যাওয়ার সময়, পথচারীদেরকে ওদের দিকে তাকিয়ে থাকতে দেখল কিশোর। সবার চোখ সিসির গলার সাপটার দিকে। একটা বাড়ির জানালা দিয়ে তাকিয়ে ছিল এক মহিলা। ঝট করে পর্দা টেনে দিল। দেখেও দেখল না সিসি। আপনমনে হেঁটে চলল।

হাঁটার গতি বাড়িয়ে দিল কিশোর। যত তাড়াতাড়ি বনের কাছে পৌঁছানো যাবে, সাপটাকে ছেড়ে দিয়ে নিশ্চিন্ত হতে পারবে।

*

সেদিন রাতে। লাফ দিয়ে বিছানায় উঠে বসল কিশোর। দ্বিধায় পড়ে গেছে। ঘুম ভাঙাল কিসে?

শব্দটা কানে এল আবার। একজন মানুষের কণ্ঠ,। খসখসে। ক্রুদ্ধ।

একজন নয়। আরও মানুষের কথা বলার শব্দ কানে আসতে লাগল।

ঘোড়ার খুরের ভোঁতা শব্দ শোনা গেল। বুকের মধ্যে হাতুড়ির বাড়ি পড়া শুরু হলো যেন তার।

জোরাল হতে লাগল খুরের শব্দ।

 এগিয়ে আসছে।

তাড়াতাড়ি বিছানা থেকে নেমে শার্টটা গায়ে দিল। ওপরে চাপাল ওভারঅল।

কারা আসছে? কি চায়?

জানালার কাছে দৌড়ে এল সে। বাইরে ঘন কালো রাতের অন্ধকার। ঘোড়ার তীক্ষ্ণ ডাক কানে এল। সেই সঙ্গে মানুষের রাগত চিৎকার।

দেখতে পেল লোকগুলোকে। বাড়ি ঘিরে চক্কর দিচ্ছে। শিকার কোণঠাসা করা নেকড়ের পালের মত।

জিভ শুকিয়ে সিরিশ কাগজের মত হয়ে গেল কিশোরের। চাদিটা দপদপ করতে লাগল। নিচে নামার সিঁড়ির দিকে দৌড় দিল সে।

সামনের পারলারের একধারে দেয়ালে ঝোলানো লং হার্টের রাইফেলটা হুক থেকে খুলে নিল। ধাক্কা দিয়ে খুলে ফেলল দরজা।

সিঁড়ি বেয়ে ছুটে নেমে এল নিচের বারান্দায়। দৃষ্টি তীক্ষ্ণ করে দেখার চেষ্টা করল অন্ধকারে। অস্পষ্ট দেখতে পেল রাস্তা দিয়ে ছুটে চলে যাচ্ছে কয়েকটা বড় বড় ছায়া। ছুটন্ত ঘোড়ার খুরের শব্দটা কেবল স্পষ্ট।

বারান্দা থেকে নেমে এল কিশোর। চাঁদের ওপর থেকে সরে গেল কালো মেঘের ঢাকনা। বড় একটা জিনিসকে পড়ে থাকতে দেখল আঙিনায়।

দৌড়ে এল কাছে। প্রচুর রক্তের মাঝখানে বেকায়দা ভঙ্গিতে পড়ে আছে একটা গরু। একরাশ অভিযোগ নিয়ে যেন কিশোরের দিকে স্থির তাকিয়ে রয়েছে নিষ্প্রাণ চোখ দুটো।

০৯.

চিৎকার করে উঠল কিশোর। রাগ যেন টগবগ করে ফুটতে লাগল মগজে। খুনীকে এখন সামনে পেলে নির্দ্বিধায় গুলি করে বসত। গরুটার লম্বা লাল জিভ বেরিয়ে এসেছে মুখের ভেতর থেকে। গলা থেকে চুঁইয়ে পড়ছে এখনও রক্ত।

মর্মান্তিক দৃশ্যটা সইতে না পেরে যাওয়ার জন্যে ঘুরে দাঁড়াতে গেল কিশোর। গরুর মুখের মধ্যে একটা জিনিস দৃষ্টি আকর্ষণ করল তার। একটা কাগজ দলা পাকিয়ে ঢুকিয়ে দেয়া হয়েছে। মুখের ফাঁকে।

গরুর মুখে কাগজ কেন? হাত বাড়াল কিশোর। লালা আর রক্ত মাখা জিভটায় আঙুল লাগতেই ঝটকা দিয়ে সরিয়ে আনল। অনুভূতিটা ভয়ঙ্কর। সাবধানে আবার হাত বাড়িয়ে খুলে আনল কাগজটা। চাঁদের আলোয় খুলে দেখল লেখা রয়েছে:

আমাদের গরু মেরেছ, তোমাদের গরু মারলাম।
মেয়েটাকে ঠেকাও।
তুমি না পারলে আমরা ঠেকাব।

 বোকা হয়ে লেখাটার দিকে তাকিয়ে রইল কিশোর। ওরা ভাবছে, গরুর মড়ক লাগার পেছনে সিসির হাত আছে। কি অসম্ভব ভাবনা!

মরা গরুটার দিকে তাকাল সে। গরুটাকে জবাই করে রেখে গেছে ওরা। সিসিকেও কি খুন করতে আসবে!

দ্রুত ঘরের দিকে ফিরল কিশোর। সিসির কিছু হয়েছে কিনা দেখার জন্যে। সামনের বারান্দায় দাঁড়িয়ে আছে সে। সাদা লম্বা নাইটগাউনের ঝুল উড়ছে বাতাসে। বেণী খুলে ফেলায় কালো চুলের বোঝা এলোমেলো ভাবে ছড়িয়ে পড়েছে সারা কাঁধে। সুন্দরী, তাতে কোন সন্দেহ নেই।

স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে গিয়ে ওর দিকে তাকিয়ে রইল কিশোর। চাঁদের আলোয় বাতাসে দুলন্ত গাউনটাকে অদ্ভুত লাগছে। মুখের ভঙ্গিটাও যেন কেমন।

বোনের পাশে দাঁড়ানো হেনরি। দুই হাত আড়াআড়ি রাখা বুকের ওপর। হেনরির সবুজ চোখ বিস্ফারিত। ঠোঁট কাঁপছে। ভাইয়ের কাঁধে একটা হাত রেখে তাকে সাহস জোগানোর চেষ্টা করছে সিসি।

আর কোন ভয় নেই, অন্যদিকে তাকিয়ে বলল কিশোর। ওরা চলে গেছে। সিঁড়ি বেয়ে বারান্দায় উঠল সে। বন্দুকটায় হাত বোলাল। আবার এলে সোজা গুলি মেরে দেব।

কাগজটায় কি লেখা? জানতে চাইল সিসি।

ও কিছু না… দেখলে ঘাবড়ে যাবে ভেবে দেখাতে চাইল না। কিশোর। তাড়াতাড়ি কাগজটা পকেটে রেখে দিতে গেল।

কিন্তু কাগজটা কেড়ে নিল সিসি। পড়তে পড়তে চোয়াল শক্ত হয়ে গেল।

কি করে ভাবতে পারছে ওরা! কেঁদে ফেলল সিসি। কাগজটা দলা পাকিয়ে ছুঁড়ে ফেলে দিল উঠানে।  

কিশোরের দিকে মুখ তুলে তাকাল সে। চাঁদের আলোতেও ওর চোখের রাগ স্পষ্ট দেখতে পেল কিশোর।

ওরা ভাবছে আমি অশুভ কিছু! চিৎকার করে উঠল সিসি। জাহান্নামে যাক সব! মরুক! আমি ওদের ঘৃণা করি!

*

দুদিন পর। অনিচ্ছুক খচ্চরটার পেছন পেছন ভারী হাল ঠেলে নিয়ে এগোচ্ছে কিশোর, এই সময় দেখতে পেল গ্যারিবাল্ডকে। মুখটাকে আষাঢ়ের মেঘের মত গোমড়া বানিয়ে ভারী পায়ে ইটে আসছে খেতের ওপর দিয়ে।

খচ্চরটাকে থামাল কিশোর। পকেট থেকে রুমাল বের করে। ভুরুর ওপরের ঘাম মুছল।

কাছে এসে দাঁড়াল গ্যারিবাল্ড। পেছনে ঠেলে দিল হ্যাটটা। ভূমিকার মধ্যে না গিয়ে সরাসরি বলল, কিশোর, আগেই সাবধান করা হয়েছিল তোমাকে। সাফ কথা বলো, আজকের মধ্যে টাকা দিতে পারবে কিনা?

ঢোক গিলল কিশোর। আমার কাছে মাত্র বিশ হাজার পেসো আছে। ফসল না উঠলে কোনমতেই আর একটা পয়সাও জোগাড় করতে পারব না।

কাশি দিয়ে গলা পরিষ্কার করল গ্যারিবাল্ড। চোখ নামিয়ে বলল, বেশ, ওটা আমি নিয়ে যাচ্ছি। আপাতত বাড়ি থেকে আর বিদেয় করলাম না তোমাদের।

পকেট থেকে নোটগুলো বের করল কিশোর। ফেলে দিল। গ্যারিবাল্ডের ছড়ানো তালুতে। ভারী চাপ অনুভব করছে বুকের মধ্যে। কিছুই রইল না আর তার কাছে। তিনজন মানুষের কি করে চলবে! ভয়ানক দুর্ভাবনাটা জোর করে তাড়াল মাথা থেকে।

নোটগুলোর ওপর শকুনের নখের মত বাঁকা হয়ে চেপে বসল গ্যারিবাল্ডের আঙুল। হাতটা ঢুকে গেল কোটের পকেটে। ভঙ্গি দেখে প্রচণ্ড রাগ যেন দলা বেঁধে উঠে আসতে শুরু করল কিশোরের গলা বেয়ে।

তোমাদের জানোয়ারগুলো সব সুস্থ আছে? জিজ্ঞেস করল গ্যারিবাল্ড।

আছে।

ফ্রেঞ্চদের ভাগ্য অতটা ভাল নয়। গাঁয়ের সবাই অবাক। সবার গরু মরছে, তোমাদের মরে না কেন?

জানি। রাতের বেলা চোরের মত এসেছিল ওরা। সিসিকে খুন করার হুমকি দিয়ে গেছে।

এ ভাবে গরু যদি মরতেই থাকে, সিসিকে সত্যিই খুন করবে। ওরা; কেউ ঠেকাতে পারবে না।

কিন্তু সিসি কি ওদের গরু মারছে নাকি? রাগটা দমন করা কঠিন হয়ে যাচ্ছে কিশোরের পক্ষে। গরু মরছে রোগে। দোষটা অন্যের ঘাড়ে চাপিয়ে দিয়ে সান্ত্বনা পেতে চাইছে হদ্দ বোকাগুলো।

হ্যাটটা টেনে সোজা করে বসাল গ্যারিবাল্ড। তোমার কথা আমি বিশ্বাস করলেও, কিশোর, গায়ের অন্য কেউ করবে না।

১০.

কিশোরের যখন এই দুর্গতি, রিটার তখন অন্য ঘটনা। রবিনদের লিভিং-রুমে ডায়েরী পড়ে সেই ঘটনার কথাই জানছে রবিন। গভীর আগ্রহে শুনছে মুসা আর জিনা।

পোশাকের দোকানটাতে নিয়ে যাওয়া হলো আমাকে-রিটা লিখেছে।

জুলন্ত চোখে আমার দিকে তাকাল ক্লডিয়া। চুরি করে পালাচ্ছিলে, তাই না? মজা টের পাবে। চোরের জন্যে কঠিন শাস্তির ব্যবস্থা আছে আমাদের।

কি বলছেন? চমকে গেলাম। চোর হতে যাব কেন আমি?

চোর নও তো কি? আঙুল তুলল ক্লডিয়া। তোমার গায়ে। এখনও পরাই আছে ব্লাউজটা। নিয়ে পালাচ্ছিলে, আবার বলছ চোর নও!

ব্লাউজটার দিকে তাকালাম। ধীরে ধীরে মাথায় ঢুকল ঘটনাটা কি ঘটেছে। ব্লাউজ সহ দোকানের বাইরে ধরেছে আমাকে ওরা। না বলে জিনিস নিয়ে বেরিয়েছি। চুরিই তো। কিন্তু আসলে তো আমি চুরি করিনি। বোঝাতে গেলাম, দেখুন… বলেই চুপ হয়ে গেলাম। কি বলব? সময় পেরিয়ে অন্য সময়ে চলে গিয়েছিলাম! বিশ্বাস করবে?

চুপ হয়ে গেলে কেন? ধমকে উঠল ক্লডিয়া।

দেখুন, জিনিসটা কিনতেই তো চেয়েছিলাম আমি, জবাব দিলাম। নাহয় বাইরে থেকেই ধরে আনা হয়েছে আমাকে। তাতে কি হয়েছে? দাম দিয়ে দিচ্ছি। জিনিসটা আমার হয়ে গেল। ব্যস, ঝামেলা খতম।

উঁহু, তা হবে না, মাথা নাড়ল ক্লডিয়া! সবাই সুযোগ পেয়ে যাবে তাহলে। পকেটে টাকা নিয়ে এসে জিনিস চুরি করবে। ধরা পড়লে বলবে, দাম দিয়ে দিচ্ছি। একটা উদাহরণ তৈরি করে রাখা দরকার। দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি। চুরি করার আগে যাতে দশবার ভাবে কেউ…

 ভাল করে তাকিয়ে দেখুন তো, আমাকে কি চোর বলে মনে হচ্ছে?

ভদ্র চেহারার আড়ালেই চুরি করা সহজ, কঠোর জবাব দিল ক্লডিয়া। প্রহরীদের বলল, এই, সিকিউরিটি অফিসে নিয়ে যাও একে।

*

জঘন্য কথা বলল আমাকে সিকিউরিটি-ইন-চার্জ। বার বার চোর বলে অপমান করল। বাবাকে খবর দিল।

আমার বাবা একজন সম্মানিত লোক, ভাল মানুষ, যে কেউ পছন্দ করবে তাকে। জন হপকিনস ইউনিভার্সিটি থেকে সাইকোলজিতে ডিগ্রি নিয়ে এখন মানসিক রোগের চিকিৎসা করেন। টাকার সমস্যা নেই। তার মেয়ে হয়ে আমি এ ধরনের অপরাধ করতেই পারি না। এ সব বলে অনেক বোঝানোর চেষ্টা করলাম ইন-চার্জকে। বুঝল তো না-ই, বরং ধমক দিল। আমার বাবার নাম নিয়ে ব্যঙ্গ করে বলল, মানুষের রোগ সারাতে যাওয়ার। আগে নিজের মেয়ের চিকিৎসা দরকার ছিল।

এত রাগ লাগল, কোন কথাই বলতে গেলাম না আর। একেবারে চুপ মেরে গেলাম। এদের সঙ্গে কথা বলে লাভ নেই। বাবার আসার অপেক্ষায় রইলাম।

বাবা এল। নির্বিকার ভঙ্গিতে সিকিউরিটি-ইন-চার্জের সব কথা শুনল। কোন প্রতিবাদ করল না। আমার পক্ষে কোন সাফাই গাইতে গেল না। ইন-চার্জের কথা শেষ হলে শান্ত ভঙ্গিতে জিজ্ঞেস করল, কি করতে চান এখন? ওর বিরুদ্ধে কেস করবেন? আমার উকিলকে ফোন করব?

না, এতটা নিচে নামব না আমরা, ইন-চার্জ বলল। অনেক কিছুই করতে পারতাম, কিন্তু আপনি সম্মানী লোক বলে ছেড়ে দিচ্ছি। পুলিশকে আর ডাকাডাকি করলাম না। বাবার দিকে চেয়ে কঠিন হাসি হাসল লোকটা। তবে, এ ধরনের কাজ করতে যাতে আর কেউ সাহস না পায়, সে-জন্যে একটা ব্যবস্থা করে রাখা দরকার।

*

আমার কয়েকটা ক্লোজআপ ছবি তুলে রেখে, বেশ কিছু সারগর্ভ উপদেশ দিয়ে বাবা সহ আমাকে বিদায় দিল সিকিউরিটি-ইন চার্জ।

ছবি তোলায় আতঙ্কিত বোধ করলাম। কি করবে? পোস্টারে আমার ছবি ছেপে চোর আখ্যায়িত করে লাগিয়ে দেবে মলের দেয়ালে দেয়ালে? অন্য দোকানদারদের সাবধান করে দেবে?

সর্বনাশ হবে! এই মলে ঢোকার এখানেই ইতি। রকি বীচেও টিকতে পারব কিনা সন্দেহ। স্কুলের সব ছেলেমেয়েরা জেনে যাবে, শিক্ষকরা জানবে, পাড়া-পড়শীরা জানবে; হাত তুলে দেখাবে আর হাসাহাসি করবে-ওই যে চোরনি রিটা যায়! কোনমতেই সহ্য করতে পারব না। এতক্ষণ এত গালাগাল অপমানেও যা হয়নি, তা-ই হলো, চোখ ফেটে পানি এল আমার। যে অপরাধটা আমি করিনি তার জন্যে এতবড় শাস্তি আমাকে না দিলেও পারত ওরা।

আমার হাত ধরে নিয়ে বাইরে বেরিয়ে এল বাবা। আকাশ কালো মেঘে ঢেকে গেছে। পার্কিং লটের চত্বর ধরে গাড়ির দিকে। এগোলাম। কিছুদূর যেতে না যেতেই বিকট শব্দে বাজ পড়ল। গাড়িতে পৌঁছতে পৌঁছতে ভিজে চুপচুপে হয়ে গেলাম।

গাড়ি স্টার্ট দিচ্ছে বাবা। এতক্ষণে কথা বলার সুযোগ পেলাম, বাবা, ব্লাউজটা আমি চুরি করিনি।

থাক, ও নিয়ে আর আলোচনার দরকার নেই। দোষটা আমারই। বাবার দায়িত্ব ঠিকমত পালন করিনি আমি।

বাবা, সত্যি বলছি, ওটা আমি চুরি করিনি! বিশ্বাস করো!

যা হবার হয়ে গেছে। এখন থেকে আরও বেশি সময় দেব তোমাকে। আমার হাতে চাপ দিল বাবা।

বাবা, তুমি আমার কথা শুনছ না। আমি বলছি, আমি চুরি করিনি। সব দেখেশুনে চুরিই মনে হতে পারে, কিন্তু যা ঘটেছে সেটা সাংঘাতিক।

পার্কিং লট থেকে বেরিয়ে নীরবে কয়েক মিনিট গাড়ি চালাল বাবা। ভীষণ অস্বস্তিতে ভুগতে থাকলাম আমি। অবশেষে বাবা বলল, বেশ, বলো, কি ঘটেছে। আমি শুনছি।

ভেজা চুলে হাত বোলালাম। ঠোঁট কামড়ালাম। বাবাকে সব কথা বলি আমি, কোন কিছু গোপন করি না। বাবা আমার সবচেয়ে বড় বন্ধু। আমাকে বিশ্বাস করে। কিন্তু আজকের ঘটনাটা। কি করবে?

বাবা, যে কথাটা আমি বলব এখন, কথা দিতে হবে চুপ করে। শুনবে। কথার মাঝখানে কোন মন্তব্য করবে না। কোন পরামর্শ দেবে না।

ঠিক আছে, কথা দিলাম।

ঘটনাটা হলো.. ঢোক গিলোম। দ্বিধা যাচ্ছে না আমার। শেষমেষ বলেই ফেললাম, বাবা, আমি সময় পেরিয়ে চলে গিয়েছিলাম।

মাথা ঝাঁকাল বাবা, বলো, আমি শুনছি।

বাবা, ব্লাউজটা পরে দেখার জন্যে চেঞ্জিং রুমে ঢুকেছিলাম। হঠাৎ আলোগুলো মিটমিট শুরু করল। বিচিত্র শব্দ হতে লাগল। আবার আলো জ্বললে যখন বেরিয়ে এলাম, আমি এক ভিন্ন জগতে চলে গিয়েছি। বাবা, সেটা উনিশশো সাতাশি সাল।

বাবাকে বিশ্বাস করতে বলছি, অথচ তখনও আমার নিজেরই বিশ্বাস হচ্ছে না; সত্যি সত্যি আমি অন্য সময়ে চলে গিয়েছিলাম।

উনিশশো সাতাশি? তেরো বছর আগে?

হ্যাঁ, বাবা। আমার কথা বিশ্বাস করছে কিনা বুঝতে পারলাম না। রাস্তার মোড়ের বিখ্যাত সেই অ্যামোজ কুকিস স্ট্যান্ডটা, যেটাতে প্রায়ই আমরা কুকিস কিনতে যেতাম…

এক সেকেন্ড, রাস্তা থেকে মুহূর্তের জন্যেও নজর সরাচ্ছে না। বাবা। মুষলধারে বৃষ্টি হচ্ছে। বাতাসে শুকনো-শ্যাওলা-ভেজা গন্ধের মত গন্ধ, গরমকালে বৃষ্টির সময় যা হয়। বেশি স্পীড়ে চালানোর সময় কথা বললে অ্যাক্সিডেন্ট করতে পারে, তাই গতি কমাল বাবা। হ্যাঁ, এবার বোঝার চেষ্টা করে দেখা যাক, এ ধরনের কল্পনা কেন করতে গেলে তুমি।

দমে গেলাম। অ, তারমানে তুমি আমার কথা বিশ্বাস করছ না! তুমি ভাবছ, মিথ্যে কথা বলছি!

আমি কি বলেছি, মিথ্যে বলছ? সত্যি কথাই বলছ তুমি, ডাক্তারী-কণ্ঠে বলল বাবা, ফোনে রোগীদের সঙ্গে এ ভঙ্গিতে কথা বলতে বহুবার শুনেছি। অনেক সময় কিছু কিছু ঘটনা একেবারে বাস্তব মনে হয়, কিন্তু আসলে সেগুলো বাস্তব নয়। মন আমাদের সঙ্গে চাতুরি করে। কল্পনা বাস্তবতাকে দাবিয়ে দেয়।

হা কপাল! বিড়বিড় করলাম। কেউ আমার কথা বুঝছে না, বিশ্বাস করছে না, এমনকি আমার সবচেয়ে বড় বন্ধুটিও নয়। কেউ না! কেউ না!

রিটা, বাবা জবাব দিল, সত্যিই বলেছ, আমি তোমার এত ঘনিষ্ঠ, এত কাছের মানুষ হয়েও পুরোপুরি বুঝতে পারিনি তোমাকে। কি করে বুঝব? আমি তো আর তোমার বয়েসী কিশোরী ছিলাম না কখনও। সেটা তোমার মা হলে পারত।…উনিশশো সাতাশি বললে না? এই সালটাই আমাকে ভাবিয়ে তুলেছে। তোমার মা মারা গিয়েছিল ওই বছর। আজকে তোমার জন্মদিন। এই দিনে মাকে তোমার খুব দেখতে ইচ্ছে করবে, এটাই স্বাভাবিক।

তারমানে, ধীরে ধীরে বললাম, তুমি বলতে চাও, মাকে দেখার ইচ্ছে আমার এতটাই বেড়ে গিয়েছিল, কোনভাবে সময়কে ডিঙিয়ে পেছনে চলে গিয়েছিলাম?

না, ঠিক তা নয়। তবে মাকে দেখতে এতই ইচ্ছে করছিল, তোমার মনে হয়েছে তোমার মায়ের বেঁচে থাকার সময়টায় চলে গেছ।

তারমানে এখনও তুমি আমার কথা বিশ্বাস করছ না! কান্না এসে যাচ্ছিল আমার, জোর করে ঠেকালাম। বাবার দিক থেকে চোখ ফিরিয়ে বাইরের দিকে তাকালাম। বড় বড় ফোঁটা ক্রমাগত আঘাত হানছে জানালার কাঁচে।

আমি বিশ্বাস করি বা না করি, রিটা, বাবা বলল, সত্যিই যদি তুমি পিছিয়ে চলে গিয়ে থাকো, সাংঘাতিক ভাগ্য বলতে হবে তোমার। কতবার আমি পিছিয়ে যেতে চেয়েছি সেই সময়টাতে…কিন্তু কখনও পারিনি।

হঠাৎ করেই বাবার জন্যে বড় মায়া লাগল। বেচারা! মাকে অসম্ভব ভালবাসত। মার কথা মনে হলে ভীষণ কষ্ট পায়। আস্তে করে হাত বাড়িয়ে তার কাঁধে রাখলাম। পাশে কাত হয়ে আমার মাথায় চুমু খেল বাবা।

ঘুরে পেছনে তাকালাম। পেছনের সীটে রাখা লাল কাগজে মোড়া একটা বড় বাক্স। ওটা আমার জন্মদিনের কেক, তাই না?

হ্যাঁ, জবাব দিল বাবা। মল থেকে যখন ফোন পেলাম, তখনই বুঝতে পারলাম তোমার মনের অবস্থা কি হবে। তোমাকে খুশি করার জন্যে কেকটা কিনে নিয়েছিলাম।

বললাম না, পৃথিবীতে আমার বাবা আমার সবচেয়ে বড় বন্ধু!

বলে যে তোমাকে ধন্যবাদ দেব, বাবা, নাক টানলাম। ঠাণ্ডাটা ধরতে আরম্ভ করেছে মনে হয়। আমি সত্যিই এখন। খুশি।

বুনো অঞ্চলের ভেতর দিয়ে যাচ্ছি তখন। গাড়ির ছাতে তবলা বাজাচ্ছে বৃষ্টির ফোঁটা। কুয়াশা এত ঘন হয়ে গেছে, সামনে পনেরো ফুট দূরেও দৃষ্টি চলে না।

আর ঠিক এই সময় ঘটল অঘটনটা।

<

Super User