০৬.

ওদের মনে হলো, সবে শুয়েছে এই সময় দরজায় থাবা দিয়ে জাগিয়ে দেয়া। হয়েছে। চোখ মেলে দেখলো, বাইরে অন্ধকার কেটে গেছে। খোলা জানালা দিয়ে দেখা যাচ্ছে ভোরের ধূসর আকাশ।

দরজা খুলে ঘরে ঢুকলেন টমসন। সকালের পেট্রলে যেতে চাও? জানোয়ার দেখার এটাই সবচেয়ে ভালো সময়।

ওয়ারডেনকে দেখে অবাক হলো তিন গোয়েন্দা। অসামান্য ক্ষমতা তাঁর শরীরের। এতো বড় একটা ধকলের পর এতো তাড়াতাড়ি সামলে নিলেন!

আপনার হাত কেমন? ব্যাণ্ডেজ বাঁধা হাতের দিকে চেয়ে জিজ্ঞেস করলো কিশোর।

ভালোই। এই যে, নাড়তে পারছি। কপাল ভালো, মাংসে গেঁথে ছিলো। তীরটা, হাড়-টাড়ে লাগেনি। কদিনেই ভালো হয়ে যাবে। ওঠো, উঠে কাপড় পরে নাও। আমি কফির কথা বলছি।

হাতমুখ ধুয়ে কাপড় পরে বারান্দায় এসে দেখলো ওরা, টেবিলে বড় এক পাত্র কফি আর কয়েকটা কাপ সাজানো। বাইরে এখনও কুয়াশা। কিলিমানজারোর নিচের অংশটা দেখা যাচ্ছে না, কিন্তু রোদ পড়ে চকচক করছে চূড়া। কাঁচা রোদে এখন হয়ে গেছে সোনালি। ভাসছে যেন কুয়াশার ওপর। দেখে মুগ্ধ হয়ে গেল। তিন গোয়েন্দা।

 মুসাকে ঘন ঘন রান্নাঘরের দিকে তাকাতে দেখে হেসে ফেললেন টমসন। এখানে অন্যরকম নিয়ম আমাদের। ভোর বেলা অলস হয়ে থাকে জানোয়ারের: দল, বেশির ভাগই বাইরে থাকে। টুরিস্টদেরকে তাই এই সময়ই দেখানোর জন্যে নিয়ে যাওয়া হয়। শুধু কফি খেয়েই চলে যাই। নটার দিকে ফিরে এসে নাস্তা।

টুরিস্ট কই? রবিন জিজ্ঞেস করলো। আর কাউকে তো দেখছি না। ওই ব্যাণ্ডাগুলো সব খালি নাকি?

হ্যাঁ, জানালেন ওয়ারডেন। এখন টুরিস্ট সীজন নয়। তবে আগে এসময়ও কিছু কিছু আসতো। এখন সীজনের সময়ও আসে না, পোচারদের জ্বালায়। শয়তানগুলোকে দমাতে না পারলে কেনিয়া সরকারের একটা বড় ইনকাম নষ্ট হয়ে যাবে।

কফি খেয়ে এসে ওয়ারডেনের ল্যাণ্ড রোভারে উঠলো সবাই। আধ মাইল এগোতেই দেখা গেল, সামনে পথ রুদ্ধ। এক পাল মোষ দাঁড়িয়ে আছে। শখানেকের কম হবে না। বিশাল কালো শরীর, মস্ত শিং।

গাড়ি থামিয়ে দিলেন টমসন। ভেতর দিয়ে যাওয়া যাবে না।

দলের সব চেয়ে বড় মোষটা শিং বাগিয়ে তেড়ে এলো, থেমে গেল গাড়ির বিশ ফুট দূরে। ভয়ানক ভঙ্গিতে শিং নেড়ে হুমকি দিলো।

ব্যাটা দলের সর্দার, নিচু কণ্ঠে বললেন টসমন। বিপদ বুঝলেই হামলা চালাবে। চোখের পলকে সব কটা এসে ঝাঁপিয়ে পড়বে আমাদের ওপর।

খাইছে! তাহলে? কুঁকড়ে গেল মুসা।  

বসে থাকতে হবে আমাদের। ওরা চলে গেলে তারপর এগোবো।

মাটিতে পা ঠুকে কিছুক্ষণ ফোঁস ফোঁস করলো মোষটা। প্রতিপক্ষকে লড়াই ঘোষণা করতে না দেখে যেন নিরাশ হয়েই ফিরে চললল। কয়েক কদম গিয়ে ফিরে চেয়ে বিচিত্র একটা শব্দ করলো, যেন ভীতুর ডিম বলে ব্যঙ্গ করলো। তারপর গিয়ে ঢুকলো পালের মধ্যে। উত্তেজিত হয়ে সর্দারের হাবভাব লক্ষ্য করছিলো দলটা, ভাটা পড়লো উত্তেজনায়। কেউ মুখ নামিয়ে ঘাস ছিঁড়তে শুরু করলো, কেউ বা বাচ্চার পরিচর্যায় মন দিলো। কয়েক মিনিট ওভাবেই কাটানোর পর রওনা হলো দলটা। হারিয়ে গেল বনের ভেতরে।

আবার চললল ল্যাণ্ডরোভার। পোচারস লুকআউটে চলে যাবো, বললেন ওয়ারডেন।

খোলা জায়গা পেরিয়ে বনে এসে ঢুকলো গাড়ি। জঙ্গল এখানে পাতলা, ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে গাছপালা। অ্যাকেইশাঁই বেশি। কাঁটা ঝোপঝাড় রয়েছে। অনেক। ওগুলোর ফাঁকে ফাঁকে দেখা যাচ্ছে হাটবীস্ট, ওয়াটারবাক, জেরিনুক, আর হাই-জাম্প লং-জাম্প দুটোতেই ওস্তাদ সুন্দর ইমপালা হরিণ। ঘোৎ ঘোঁৎ করে পথের ওপর এসে পড়ছে বনের ভাড় নামে পরিচিত শুয়োর, ওয়ার্টহগ। গাড়ি দেখে চমকে উঠে হাস্যকর ভঙ্গিতে শরীর মাথা নাচিয়ে গিয়ে আবার ঢুকে পড়ছে। বড় একটা গাছের মাথায় বসে থাকতে দেখা গেল এক ঝাঁক বেবুনকে। গাড়িটা নিচ দিয়ে যাওয়ার সময় কুকুরের মতো দাঁত ভেঙচে অনেকটা কুকুরের মতোই ঘেউ ঘেউ করে উঠলো।

এক জায়গায় দেখা গেল, গাছের ডাল-পাতা ভেঙে ভেঙে খাচ্ছে ডজনখানেক ছোট-বড় হাতি। একেবারে পাশ দিয়ে গেল গাড়িটা, ফিরেও তাকালো না ওরা। নিজের কাজে ব্যস্ত।

নানারকম জানোয়ার আর পাখি দেখতে দেখতে চলেছে ওরা। শটাশট ক্যামেরার শাটার টিপছে মুসা, যা দেখছে তারই ছবি তুলছে। কিশোরও তুলছে, তবে বেছে বেছে।

বন থেকে বেরিয়ে, উপত্যকা পেরিয়ে পাহাড়ের গোড়ায় পৌঁছলো ল্যাণ্ডরোভার। পাহাড়ী পথ বেয়ে উঠে এলো ওপরে, পোচারস লুকআউটে। টেলিস্কোপ চোখে লাগিয়ে যন্ত্রটার মতোই স্থির হয়ে আছে একজন রেঞ্জার। টমসন ডাকতে ফিরে চেয়ে স্যালুট করলো।

কিছু দেখা যাচ্ছে? জিজ্ঞেস করলেন ওয়ারডেন।

তেমন কিছু না। শুধু শকুন।

টেলিস্কোপে চোখ রেখে দেখলেন টমসন। সরে জায়গা করে দিলেন, ছেলেদের জন্যে। ওরাও একে একে দেখলো। বনের কিনারে আকাশে চক্কর মারছে কয়েকটা শকুন। মরা দেখতে পেলে যেমন করে।

পোচার আছে? কিশোর জিজ্ঞেস করলো।

মনে হয় না। আমাদের লজ থেকে জায়গাটা মাত্র দুমাইল। এতো কাছে আসার সাহস করবে না ব্যাটারা। তবু চলো, গিয়ে দেখি।

গাড়ি চলে গেল ওখানে। ছোট ছোট কয়েকটা গাছের গোড়ায় পড়ে আছে বিরাট একটা দেহ। ধারেকাছে পোচারদের ছায়াও নেই। ওরা গাড়ি থেকে নেমে এগোতেই ডানা জাপটে উড়ে গেল কয়েকটা শকুন।

গণ্ডার, বললেন টমসন।

মৃত জানোয়ারটার পাশে গিয়ে দাঁড়ালো ওরা। পেটে পিপার মুখের সমান বড় এক ফোকর। ভেতরে নাড়িভুড়ি কিছু নেই, সব সাফ করে খেয়ে ফেলেছে। দুর্গন্ধে পাক দিয়ে ওঠে পেটের ভেতর। সইতে না পেরে নাকে রুমাল চাপা দিলো মুসা। রবিন তো ওয়াক থু করে বমিই করতে বসে গেল।

উঁকি দিয়ে গর্তের ভেতরে দেখলো কিশোর। বিড় বিড় করলো, বেচারা! কি করে মরলো? অসুখে?

তাই হবে হয়তো, মুসা বললো।

তীক্ষ দৃষ্টিতে গণ্ডারটার মাথার দিকে তাকিয়ে আছেন টমসন। ভুল করেছি আমি, বললেন তিনি। ভেবেছিলাম, পোচাররা এতো কাছে আসার সাহস পাবে না, ভুল বলেছি। দেখো, শিং নেই। কেটে নিয়ে গেছে। গণ্ডারের শিং খায় না। কোনো জানোয়ার। তার মানে পোচাররা নিয়ে গেছে। ওরাই মেরেছে এটাকে, গলার কাছে একটা ক্ষত দেখালেন। দেখো, বল্লম দিয়ে মেরেছে।

ইস, পিশাচ নাকি ওরা! গণ্ডারটার ক্ষতবিক্ষত লাশের দিকে তাকাতে পারছে না রবিন।

এটা আর এমন কি? ওদের নিষ্ঠুরতা তো দেখোইনি। চলো, দেখাবো।

কয়েক মিনিট গাড়ি চালিয়ে একটা জায়গায় এসে থামলেন টমসন। এই যে, টিসাভো নদী।

কোনো নদী চোখে পড়লো না ছেলেদের। শুধু কালো রুক্ষ একটা ছোট পাহাড়।

কই, নদী কোথায়? জিজ্ঞেস করলো মুসা।

নদীর ওপর দিয়ে হেঁটেছে কখনও? মুসার প্রশ্নের জবাব না দিয়ে বললেন ওয়ারডেন, হাসছেন মিটিমিটি। না হাঁটলে এটাই সুযোগ। হেঁটে নাও।

কালো পাথরে উপত্যকার ওপর দিয়ে ছেলেদের নিয়ে চললেন তিনি। একখানে থেমে জোরে লাথি দিলেন মাটিতে। ফাপা আওয়াজ হলো।

লাভার স্তর মনে হচ্ছে? কিশোর বললো।

লাভ-ই। আদিমকালে কোনো সময় কিলিমানজারো থেকে নেমে এসে ঢেকে দিয়েছে নদীটা। আমাদের পায়ের নিচেই বইছে ওটা। ভাটির দিকে যাচ্ছি আমরা।

যতোই এগোচ্ছে, কানে আসছে একটা ঝিরঝির শব্দ। বাড়ছে শব্দটা। শেষে, একটা টিলা ঘুরে এসে দেখতে পেলো, টিলার গোড়ার বিশাল ফোকর থেকে সগর্জনে ছিটকে বেরোচ্ছে তীব্রস্রোতা পাহাড়ী নদীর পানি। অতিকায় এক ড্রেনের মুখ দিয়ে বেরোচ্ছে যেন। নিচে যেখানে পড়ছে, বড় একটা দীঘি তৈরি করেছে। সেখানে, কিংবা বলা যায় ছোট হ্রদ। হ্রদ থেকে বেরিয়ে উপত্যকা ধরে একেবেকে বয়ে গেছে সরু নদী।

এর নাম মিজিমা স্প্রিং। স্ফটিকের মতো স্বচ্ছ থাকে পানি, ওয়ারডেন বললেন।

কিন্তু এখন পানি পরিষ্কার নয়। লালচে বাদামী, দুর্গন্ধ হয়ে আছে।

এতোক্ষণ নদীর ওপর দিয়ে এসেছো, বললেন তিনি। এবার তলায় নিয়ে যাবো।

ছেলেদের নিয়ে একটা ঝোপের ভেতরে ঢুকলেন টমসন। মাটিতে একটা গর্ত দেখা গেল। ওটা দিয়ে ঢুকে, ঢালু সুড়ঙ্গ বেয়ে একটা প্রাকৃতিক গুহায় এসে ঢুকলো। ওরা। গুহাটাকে কেটে ঘরের মতো বানিয়ে নেয়া হয়েছে। আণ্ডারওয়াটার। অভজারভেটরি, নদীর তলার দৃশ্য দেখার জন্যে। জানালার ভেতর দিয়ে নদীর। নিচটা দেখা গেল পরিষ্কার। পানির ওপরে রোদ ঝলমল করছে, নিচেও আসছে। আলো।

জানালার কাছে নাক ঠেকালো তিন গোয়েন্দা। বাইরের দৃশ্য দেখে গা গুলিয়ে। উঠলো। অসংখ্য জলহস্তী, নদীর তলায় চরে বেড়াচ্ছে না আর ওগুলো, জলজ ঘাস ছিঁড়ে খাচ্ছে না, মরে ফুলে ঢোল হয়ে আছে। মরা লাশের স্তূপ, কোনো কোনোটা বেশি ফুলে গিয়ে ভেসে উঠেছে ওপরে। মারাত্মক ক্ষতগুলো থেকে এখনও রক্ত চুঁইয়ে বেরিয়ে মিশে যাচ্ছে পানির সঙ্গে। লেজ কাটা। জায়গায় জায়গায় চামড়া ছিলে নেয়া হয়েছে। বড় বড় শ্বদন্তগুলো সব উপড়ে তুলে নিয়ে গেছে পোচাররা। কিছু জানোয়ারের মাথা কেটে নিয়ে গেছে, বিশেষ করে মাদীগুলোর।

 কয়েকটা শিশু জলহস্তী এখনও জীবিত, ক্ষুধায় কাহিল হয়ে বার বার গিয়ে নাক ঘষছে মৃত মায়ের গায়ে। অবোধ শিশুগুলো বুঝতে পারছে না, আর কোনোদিন জাগবে না মা, আদর করে গা চেটে দিয়ে দুধ খাওয়াবে না।

বড় বড় কুমির দল বেঁধে এসে মহানন্দে জলহস্তীর মাংস ছিঁড়ে খাচ্ছে। বুড়ো মাংসে অরুচি ধরে যাওয়াতেই বোধহয় কোনো কোনোটা মরা হাতি বাদ দিয়ে শিশু হাতির নধর কচি মাংস দিয়ে নাস্তা সারছে। বিরাট হাঁ একেকটার, আর ইয়া বড় বড় দাঁত। দেখলে গায়ে কাঁটা দেয়। মাঝে মাঝে লড়াই লেগে যাচ্ছে পছন্দসই মাংসের মালিকানা নিয়ে, শক্তিশালী লেজের জোরালো ঝাপটায় আলোড়িত হচ্ছে পানি। শুধু কুমিরই না, শয়ে শয়ে মাংসাশী মাছও গপ গপ করে গিলছে জলহস্তীর মাংস।

 বেশিক্ষণ এই দৃশ্য দেখা যায় না। জানালার কাছ থেকে সরে এলো ছেলেরা। নীরবে ফিরে চললো ওয়ারডেনের পিছু পিছু। রবিন নীরব। কিশোরের চেহারা থমথমে। মুসার চোখে পানি। পোচার ধরতে টমসনকে সাহায্য করবে কথা দিয়েছিলো ওরা। মনে মনে প্রতিজ্ঞা করলো এখন, দলের, সবকটার হাতে হাতকড়া না পরিয়ে টিসাভো থেকে যাবে না।

নটার মধ্যেই লজে ফিরে এলো। নাস্তা করতে বসলো, কিন্তু রুচি নষ্ট হয়ে গেছে। মুসাও তেমন গিলতে পারছে না। বার বার চোখের সামনে ভাসছে অসহায় বাচ্চাগুলোর চেহারা।

.

০৭.

সেদিনই বেলা বারোটার দিকে এলো তিরিশ জন লোক, লরিতে করে। তাদের স্বাগত জানালেন টমসন। দমে গেলেন মনে মনে। ট্রেইনড রেঞ্জার নয় একজনও। কুলিকামিন গোছের লোক। একজন ট্র্যাকার, আর দুতিন জন পেশাদার শিকারী আছে, এককালে শ্বেতাঙ্গ শিকারীর সহকারী ছিলো ওরা, পয়সার বিনিময়ে টুরিস্টদের নিয়ে সাফারিতে যেতো। কি আর করা? নেই মামার চেয়ে কানা মামা ভালো, ভেবে নিজেকে প্রবোধ দিলেন ওয়ারডেন।

ব্যাণ্ডার পেছনে তাবু খাঁটিয়ে তিরিশ জন লোকের থাকার ব্যবস্থা হলো। খাবার এনে দিলো লজের বাবুর্চিরা।

খেতে খেতে ওদের সঙ্গে আলোচনা চললো। কাজটা কি, জেনেশুনেই এসেছে ওরা। মাসাই উপজাতির লোক, নেহায়েত মাংসের দরকার না হলে কখনও শিকার করে না। পোচারদের ঘৃণা করে। টিসাভোতে ওদের নিষ্ঠুর অত্যাচারের কাহিনী শুনে জ্বলে উঠলো সবাই। চেঁচাতে শুরু করলো, এক্ষুণি চলুন! কল্লা আলাদা করে ফেলবো ব্যাটাদের! খুন করে ফেলবো!

বুঝিয়ে শুনিয়ে ওদের শান্ত করলেন ওয়ারডেন। বললেন, ব্যাটাদের খুন। করতে পারলে আমিও খুশি হতাম। কিন্তু করা যাবে না। মানুষ খুনের অপরাধে আমাদেরকেই জেলে যেতে হবে তাহলে।

 তো কি করবো? এমনি এমনি ছেড়ে দেবো শয়তানগুলোকে? রেগে উঠলো বিশালদেহী এক মাসাই, যেন একটা দৈত্য। ট্র্যাকারের কাজ করেছে অনেক দিন। নাম মুগামবি।

ছাড়বো কেন? ধরে নিয়ে যাবো কোর্টে। ব্যস, আমাদের কাজ শেষ। এরপর ওদেরকে জেলে পাঠানোর দায়িত্ব জজ সাহেবের।

কিন্তু ধরবোটা কিভাবে? পায়ে গুলি করে?

না, বন্দুক নেয়া যাবে না সঙ্গে। উত্তেজনার সময় মাথা ঠিক থাকবে না। পায়ে না করে যদি মাথায় কিংবা বুকে গুলি করে বসে কেউ?

বুঝতে পারছেন না, ওদের সঙ্গে বিষাক্ত তীর আছে, বল্লম আছে। আমরা না মারলেও আমাদেরকে ছাড়বে না ওরা। ঠিক খুন করবে।

তা করবে, স্বীকার করলেন ওয়ারডেন। সেজন্যেই ওদেরকে ধরা খুব বিপজ্জনক হবে। জানোয়ারেরও অধম ওরা।

 হাসি মুছে গেছে মাসাইদের মুখ থেকে। খালি হাতে সিংহ ধরতে রাজি আছে ওরা, কিন্তু পোচার নয়।

দেখ, ওদের মনের কথা বুঝতে পেরে বললেন টমসন। নিজেদের ইচ্ছেয়। এসেছে তোমরা, কাজ করলে পয়সা পাবে, এই শর্তে। যার পয়সার দরকার, যাবে আমার সঙ্গে, যার দরকার নেই, যাবে না। জোর করবো না কাউকে। ধরতে পারলে ধরবো, না পারলে ফিরে আসবো। পুলিশকে জানাবো। যা করার করবে। ওরা। আমি বন্দুক সাথে নিয়ে গিয়ে খুনের আসামী হতে রাজি নই।

নিচের ঠোঁটে চিমটি কাটছিলো কিশোর। হাত তুললো, স্যার, তীর-ধনুক আর বল্লমও কি নেয়া যাবে না?

না। কারণ ওসব দিয়েও মানুষ খুন করা যায়। মারাত্মক অস্ত্র।

তাহলে, এমন কোনো অস্ত্র যদি নেয়া হয় সঙ্গে, যেটা অবশ্যই মারাত্মক, কিন্তু ব্যবহারের ওপর নির্ভর করে কততখানি মারাত্মক হবে?

ভুরু কোঁচকালেন ওয়ারডেন। কি বলতে চাইছো?

হাসলো কিশোর। জানোয়ার ধরার অস্ত্র।

খুলে বলো। মনে হচ্ছে কোনো একটা প্ল্যান করেছো তুমি।

খুলে বললো কিশোর।

.

০৮.

কয়েক মিনিট পর যখন রওনা হলো দলটা, দেখা গেল একজন মাসাইও বাদ পড়েনি। সবাই এসেছে। আর এসেছে টমসনের পাঁচজন রেঞ্জার। অন্য পাঁচজন। ক্যাম্পে নেই, ডিউটিতে গেছে পার্কের বিভিন্ন জায়গায়, পোচার খোঁজার জন্যে।

তবে পাঁচজন রেঞ্জারের জায়গা দখল করার মতো পোচার-শিকারী, একটা আছে দলে। মানুষ নয়, কুকুর। মিশ্র রক্ত ওর ধমনীতে। মা, এক শ্বেতাঙ্গ শিকারীর অ্যালসেশিয়ান; বাবা, আফ্রিকার জঙ্গলের ভয়ঙ্করতম শিকারী হিংস্র বুনো কুকুর। বনের মধ্যে অসহায় অবস্থায় বাচ্চাটা কুড়িয়ে পেয়েছিলো সাফারিম্যান কালিমবো, নিয়ে এসে যত্ন করে বড় করে তুলেছে, নাম রেখেছে সিমবা, অর্থাৎ সিংহ। গায়ে গতরে সিংহের সমান না হলেও হিংস্রতায় যে পশুরাজকে ছাড়িয়ে যাবে, তাতে কোনো সন্দেহ নেই মুসার। দেখেই সিমবাকে ভালোবেসে ফেলেছে সে, মনে মনে। আফসোস করছে, ইস, ওরকম একটা কুকুর যদি থাকতো তার!

পশ্চিমে এগিয়ে চলেছে জীপ, ভ্যান,ট্রাক আর লরির লম্বা মিছিলটা।

একেবারে সামনের ল্যাণ্ড-রোভারে রয়েছেন ওয়ারডেন, গাড়ি চালাচ্ছেন, পাশে কিশোর। মুসা আর রবিন বসেছে পেছনে।

এমনও হতে পারে, টমসন বললেন। লাগতেই আসবে না ওরা। এতোগুলো গাড়ি দেখলেই ভয়ে পালাবে।

ওরা পালাক, এটা নিশ্চয় চান না আপনি? কিশোর বললো। ওদের ধরতে চান।

চাইলেই তো আর হবে না। ওদেরকেও এগিয়ে আসতে হবে।

আপনার কি মনে হয়, সত্যি পালাবে?

নির্ভর করে। নেতা না থাকলে পালাবে। আর, সিলভার যদি সাথে থাকে, উত্তেজিত করে ওদেরকে, সাহস দেয়, তাহলে আক্রমণ করবে।

আরে, তাই তো! কিশোর ভুলেই গিয়েছিলো সিলভারের কথা।

ওই পালের গোদাটাকে ধরতে না পারলে হাজার পোঠর ধরেও লাভ হবে না, আবার বললেন টমসন। এক জায়গা থেকে তাড়ালে আরেক জায়গায় গিয়ে। পোচিং শুরু করবে।

হুঁ! মাতা দোলালো কিশোর।

আরও কয়েক মিনিট চলার পর গাড়ি থামাতে বললো সে। রবিন আর মুসাকে নিয়ে নেমে গিয়ে উঠলো সাপ্লাই ভ্যানে। আবার চললো মিছিল।

ক্যাম্প থেকে কয়েক ডজন ডার্ট নিয়ে আসা হয়েছে, ওগুলোতে ওষুধ ভরতে হবে। ডার্টগুলো দেখে মনেই হয় না, হাতিকে ঘুম পাড়িয়ে দিতে পারে নিমেষে। আট ইঞ্চি লম্বা, কড়ে আঙুলের মতো মোটা। এক মাথায় ইঞ্জেকশনের সুচের মতো, সুচ, তবে আরও খাটো। আরেক মাথায় হালকা এক গুচ্ছ পালক বাধা, ভারসাম্য বজায় রেখে যাতে নিশানা মতো গিয়ে আঘাত হানতে পারে ডার্ট সেজন্যে।

বার বার এপাশে ওপাশে মোড় নিচ্ছে গাড়ি, ভীষণ ঝাঁকুনি। জানালা দিয়ে মুখ বের করে দেখলো কিশোর। পথ ছেড়ে বিপথে নেমেছে ভ্যান, কিংবা বলা ভালো উঠেছে। চাকার নিচে ছোট ছোট টিলা-টক্কর। আশেপাশের কোনো কোনোটা বেশ বড়,পনেরো-বিশ ফুট উঁচু। উইয়ের ঢিবি। ছোটগুলোর ওপর দিয়ে চলেছে গাড়ি, বড়গুলোর পাশ কাটাচ্ছে।

ঢিবিগুলো পেরিয়ে এসে গাড়ি থামলো। সামনে পাঁচশো গজ মতো দূরে পোচারদের বেড়া। বেড়া থেকে দূরে গাড়ি থামানোর কারণ আছে। পোচাররা থাকলে তীর ছুঁড়তে পারে। বেশি কাছে গেলে গায়ে লাগবে তীর, ঝুঁকি নেয়ার। মানে হয় না। তাই দূরেই রেখেছেন ওয়ারডেন।

এসো, জলদি হাত লাগাও, দুই সহকারীকে বললো গোয়েন্দপ্রধান। প্রাস্টিকের ব্যাগ খুলে ভ্যানের মেঝেতে ঢাললো ডার্টগুলো। বড় একটা শিশি বের করলো, তার মধ্যে পানির মতো পাতলা সাদাটে ওষুধ।

জিনিসটা কি? মুসা জিজ্ঞেস করলো। অ্যাকোর রঙ তো কালো—

এটা সেরনিল, মাসকিউলার অ্যানাসথেটিক। জানোয়ার ধরার জন্যে ব্যবহার হয়। রক্তে ঢুকলেই ঘুমিয়ে যায়।

দ্রুত ডার্টে ওষুধ ভরে নিতে লাগলো ওরা। ভরা শেষ করে তিনটে চামড়ার বাকেটে ডাটগুলো নিয়ে, নামলো ভ্যান থেকে। চলে এলো ল্যাণ্ড-রোভারের পাশে।

পোচারদের দেখা নেই। বেড়ার ওপাশে ওদের কুঁড়েগুলো আছে। আর আছে। বেড়ার ফাঁকে ফাঁদে আটকা পড়া অসহায় জানোয়ারের দল। যন্ত্রণা আর আতঙ্কে চিৎকার করছে।

মাসাইরা সবাই নেমে এসেছে। তাদের মাঝে ডার্ট বিলি করে দিলেন ওয়ারডেন আর তিন গোয়েন্দা। বেড়ার দিকে মুখ করে পাশাপাশি এক সারিতে রাখা হয়েছে গাড়িগুলো। ওগুলোর সামনে লাইন দিয়ে দাঁড়ালো ঘুম-যোদ্ধারা। ডার্ট ছোঁড়ার জন্যে নিশপিশ করছে হাত। কিন্তু শত্রু কই? অধৈর্য হয়ে আগে বাড়লো কয়েকজন মাসাই।

এই, থামো! চেঁচিয়ে বললেন ওয়ারডেন। কোথায় যাচ্ছো? পিছাও।

আরে, দেখো দেখো, হাত তুললো মুসা। এহহে, সরে গেল! বেড়ার ফাঁক দিয়ে মাথা বের করেছিলো। কালো চাপদাড়ি।

কাউকে দেখলো না রবিন। কিশোরও না। সিলভার না তো?–ভাবলো সে। মুসা যখন বলছে দেখেছে, নিশ্চয় দেখেছে। তার কান আর চোখের ওপর পুরোপুরি। ভরসা করা যায়।

দাঁড়িয়ে থাকতে থাকতে বিরক্ত হয়ে উঠেছে সবাই, কিন্তু কাউকে এগোতে দিলেন না ওয়ারডেন। কে জানে বেড়ার ওপাশে ঘাপটি মেরে আছে কিনা পোচাররা।

হঠাৎ তারস্বরে ঘেউ ঘেউ শুরু করলো সিমবা। ঝাড়া দিয়ে কালিমবোর হাত থেকে গলার বেল্ট ছাড়িয়ে ছুটে যাওয়ার জন্যে জোরাজুরি করতে লাগলো। ফাঁদে পড়ার ভয় আছে, ছাড়লো না তাকে তার মালিক।

অবশেষে, এক ফাঁকে দেখা দিলো একটা কালো মাথা। আরেক ফাঁকে আরেকটা। তারপর আরেকটা।

ব্যাটারা দেখছিলো আমাদের, রবিন বললো। বোঝার চেষ্টা করছিলো আমারদের উদ্দেশ্য।

হ্যাঁ, মাথা ঝাঁকালো কিশোর। নিরাপদ বুঝে এখন বেরিয়ে এসেছে।

ঠিকই বলেছে দুজনে। লুকিয়ে থেকে দেখছিলো পোচাররা। রাইফেল নেই। দেখে সাহস পেয়ে বেরিয়ে এসেছে এখন। মুমূর্ষ জানোয়ারগুলোর আশপাশ দিয়ে পা টিপে টিপে বেরোলো ওরা। হাতে তীর-ধনুক, পিঠে বাঁধা বল্লম। ফলায় বিষ মাখানো, সন্দেহ নেই। বেড়ার এপাশে, এসে সারি দিয়ে দাঁড়ালো ওরাও। জনা পঞ্চাশের কম না।

এমনভাবে চেয়ে আছে পোচাররা, যেন বিশ্বাস করতে পারছে না। গাধা। নাকি! ক্যাম্প থেকে এসেছে শত্রু এলাকায়, অথচ সঙ্গে রাইফেল-বন্দুক কিচ্ছু নেই, শুধু ছোট ছোট কয়েকটা লাঠির মতো জিনিস। উপজাতীয় আধা-জঙলী ওরা, এ ধরনের আধুনিক ডার্টগান দেখেনি জীবনে, অস্ত্রগুলোর মাহাত্ম জানে না। একজন তো হেসেই ফেললো। ব্যস, সংক্রামিত হয়ে গেল হাসিটা। হাসতে শুরু করলো সবাই। আর সে-কি হাসি! হাসতে হাসতে বাঁকা হয়ে গেল সবাই, উরুতে চাপড় মারছে ঠাস ঠাস করে। শেষে উলুকের মতো নাচতে আরম্ভ করলো। তীর ছুঁড়লো। কয়েকজন। পাঁচশো গজ অনেক দূর, নিশানায় পৌঁছার বহু আগেই মাটিতে পড়ে গেল সেগুলো।

তীর-ধনুক আর বল্লম তুলে, শরীর সামান্য কুঁজো করে, এক পা এক পা করে এগোতে শুরু করলো পোচাররা। দেখে দেখে সাবধানে পা ফেলছে। নইলে নিজেদের পাতা ফাঁদে নিজেরাই আটকাবে। লম্বা ঘাসের ভেতরে পেতে রাখা হয়েছে ওসব ফাঁদ।

রেডি থাকো, বললেন ওয়ারডেন। আমি না বললে ফায়ার করবে না কেউ।

মাসাইদের অনেকে, ইংরেজি বোঝে না। দেশীয় ভাষায় সেটা অনুবাদ করে বললো মুগামবি।

বেড়ার ওপাশ থেকে আদেশ শোনা গেল। এগোতে বলছে পোচারদের। আড়াল থেকে বেরিয়ে একটা ফাঁকে এসে দাঁড়ালো সে। দলের আর সবার মতো শুধু নেংটি পরা আধা-উলঙ্গ নয়। গায়ে বুশ জ্যাকেট, পরনে সাফারি ট্রাউজারস। দাড়িতে ঢাকা মুখ, চামড়ার রঙেই বোঝা যায় আফ্রিকান নয় লোকটা।

ওই যে, চেঁচিয়ে উঠলো মুসা। বলেছিলাম না। নিশ্চয় সিলভার।

আস্ত হারামী, রবিন বললো। নিজে পেছনে থেকে দলের লোক পাঠিয়েছে। মরলে ওরা মরবে, তার কি?

আবার আদেশ দিলো লোকটা। যাদের হাতে ধনুক ছিলো, তাড়াতাড়ি কাঁধে ঝুলিয়ে খুলে নিলো পিঠে বাঁধা বল্লম।

বল্লম নিচ্ছে কেন? রবিনের প্রশ্ন।

তীর দিয়ে লঙ রেঞ্জে লড়াই করে, ওয়ারডেন জবাব দিলেন। কাছে থেকে বলুম বেশি মারাত্মক। ওরা মনে করেছে আমরা নিরস্ত্র, তাই কাছে এসে খুঁচিয়ে মারতে চাইছে। জানোয়ার মেরে সাহস এত বেড়েছে, মানুষ মারতেও আর দ্বিধা নেই এখন। হুঁশিয়ার থাকবে। বল্লমের মাথায়ও বিষ লাগায়।

টমসনের দিকে তাকিয়ে আছে মাসাইরা। কখন তিনি আদেশ দেন। কিন্তু চুপ করে রইলেন তিনি। বিশ ফুটের মধ্যে চলে এলো পোচাররা।

রেডি! চেঁচিয়ে বললেন ওয়ারডেন।

ডার্ট তুললো সবাই। নিজেদের কাছেই হাস্যকর লাগছে তাদের এই অস্ত্র, পোচাররা তো হাসবেই। আট ফুট লম্বা বিষাক্ত বল্লমের বিরুদ্ধে কয়েক ইঞ্চি লম্বা কতগুলো খাটো লাঠি! তবে, উগাণ্ডা কিংবা কঙ্গোর লোক হলে হাসতো না ওরা, ঠিকই বুঝতে বল্লমের চেয়ে কতো বেশি মারাত্মক লাঠিগুলো। কেনিয়ায় এই অস্ত্র এখনও সাধারণ মানুষের কাছে অপরিচিত।

ভাবতে অবাক লাগছে কিশোরের, ডার্টগান কি সিলভারও চেনে না? নাকি দূর থেকে বুঝতে পারছে না?

দূর থেকে প্রথমে চিনতে পারেনি, বোঝা গেল। হঠাৎ চেঁচিয়ে কি বলতে শুরু করলো সে। সোয়াহিলি ভাষা। মুগামবি অনুবাদ করে বললো, চিনে ফেলেছে। ওদের ফিরে যেতে বলছে সে।

চিনতে অনেক দেরি করে ফেলেছে সিলভার। লড়াইয়ের উন্মাদনা রক্তে নাচন তুলেছে তখন পোচারদের, নেতার কথা শুনলো না। বিজয় তো অনিবার্য, কেন ফিরে যাবে? ফিরেও তাকালো না ওরা। বল্লম বাগিয়ে হুল্লোড় করে ছুটে এলো।

ফায়ার! আদেশ দিলেন ওয়ারডেন।

চোখের পলকে ছুটে গেল একঝাঁক খুদে-বর্শা। কালো দেহগুলোতে বিধে গেল ইঞ্জেকশনের সুচ, চোখের পলকে স্বয়ংক্রিয়ভাবে ওষুধ ঢুকিয়ে দিলো শরীরে।

চমকে গেল পোচাররা। ওরা ভাবলো, অ্যাকো। টান দিয়ে দিয়ে শরীর থেকে খুলে ফেলতে লাগলো ডার্টগুলো। সুচের মাথা থেকে টপটপ করে ঝরছে সাদা তরল। অ্যাকোর রঙ কালচে বাদামী, এটার রঙ সাদা, তারমানে অ্যাকো নয়। আতঙ্ক দূর তো হলোই না, আরও বাড়লো ওদের। ভাবলো, অ্যাকোর চেয়েও খারাপ কোনো বিষ। ভয়েই পড়ে গেল কয়েকজন, মাটিতে পড়ে হাত-পা ছুঁড়তে শুরু করলো।

অ্যাকোর চেয়ে অনেক দ্রুত কাজ করলো সেরনিল। অবশ করে দিলো। মাংসপেশী। ক্ষণিক আগের শক্তিশালী পাগুলো গেল দুর্বল হয়ে, শরীরের ভার রাখতে পারছে না আর। ভয়ে যারা পড়েছিলো, তারা বেহুশ হলো। যারা দাঁড়িয়ে ছিলো, টলে উঠে ধড়াস ধড়াস করে পড়তে লাগলো কাটা কলা গাছের মতো। আর যারা ডার্ট খেয়ে দৌড় দিয়েছিলো, তারাও বাঁচতে পাড়লো না, হুমড়ি খেয়ে পড়লো এক এক করে। কয়েকজন পড়লো সত্যিকার বিপদে। এলোপাতাড়ি দিশেহারা হয়ে ছোটার সময় মনেই রইলো না, ফাঁদ পাতা আছে। ধরা পড়লো ওই ফাঁদে। ভীষণ দুঃসাহসী কয়েকজন ভাবলো এমনিতেওঁ মরেছি, ওমনিতেও, এগিয়ে এসে বল্লম দিয়ে খোঁচা মেরে তিনজন মাসাইকে আহত করে দিলো বেহুশ হওয়ার আগে।

যেমন শুরু হয়েছিলো তেমনি প্রায় হঠাৎ করেই শেষ হয়ে গেল লড়াই। ঘাসের ওপর লুটিয়ে আছে অসংখ্য কালো দেহ। ফাঁদে আটকা পড়েছে যারা, তারাও গোঙাচ্ছে না ব্যথায়, গভীর ঘুমে অচেতন।

তোলো সব কটাকে, ওয়ারডেন আদেশ দিলেন। খাঁচায় ভরো।

 পার্কের এক জায়গা থেকে অনেক সময় আরেক জায়গায় জানোয়ার স্থানান্তরের প্রয়োজন পড়ে, তখন ওসব খাঁচা ব্যবহার হয়। এতো বড় খাঁচা আছে, জিরাফকেও ভরে রাখা যায়। পাওয়ারওয়াগনে করে বয়ে নেয়া হয় সেসব খাঁচা। কিশোরের বুদ্ধিতেই কয়েকটা ওয়াগন নিয়ে আসা হয়েছে সঙ্গে করে, একটাতে হাতির খাঁচা। খুশি হয়েই অচেতন দেহগুলোকে বয়ে এনে খাঁচায় ভরতে লাগলো। মাসাইরা।

ছোট জানোয়ারের ফাঁদে যারা ধরা পড়েছে তাদেরকে ছাড়ানো কঠিন হলো না, মুশকিল হলো হাতি আর সিংহের ফাঁদে যারা আটকেছে। পায়ে কেটে বসেছে। ইস্পাতের দাঁত।

ওরকম একটা ফাঁদের কাছে গিয়ে হাত নেড়ে ডাকলেন ওয়ারডেন তিন গোয়েন্দাকে।

কাছে গিয়ে দাঁড়ালো ওরা।

আমাদের দুজন রেঞ্জার এরকম ফাঁদেই আটকে মরেছে? ওয়ারডেন। বললেন। বোঝো এখন কারণটা। নিশ্চয় ভেবে অবাক হয়েছে, কেন ওরা নিজেদের ছাড়াতে পারেনি। মানুষের শরীরে দুটো চমৎকার টুলস আছে, হাত।

জানোয়ারের নেই। দেখি তো, ফাঁদ থেকে খোলো তো লোকটাকে।

কিশোর চেষ্টা করে বিফল হলো। রবিন গেলই না। শার্টের হাতা গুটিয়ে ব্যায়াম পুষ্ট পেশল বাহু বের করে বীর-বীক্রমে এগোলো মুসা আমান, ভাবখানা– এটা একটা কাজ হলো নাকি? ফাঁদের দুটো চোয়াল দুই হাতে ধরে টান দিলো। নড়লোও না ওগুলো। জোর বাড়ালো সে, কপালে ঘাম জমলো, চামড়া ফেটে বেরিয়ে আসবে যেন হাতের পেশী। শেষে হাল ছেড়ে দিয়ে ফোঁস করে মুখ দিয়ে বাতাস ছাড়লো। খাইছে! সাঙ্ঘাতিক শক্ত!

 হ্যাঁ, মাথা দোলালেন টমসন। হাতিও পা ছাড়াতে পারে না। খালি হাতে খোলা যাবে না, যন্ত্র লাগবে।

 কিশোর তাকিয়ে আছে ফাঁদ বাঁধার শেকলটার দিকে। দশ ফুট লম্বা লোহার শেকল, এক মাথা ফাঁদের সঙ্গে আটকানো, আরেক মাথা লোহার গজালের সঙ্গে। গজালটা মাটিতে পুঁতে দেয়া হয়েছে।

কি ভাবছো বুঝতে পারছি, হেসে বললেন ওয়ারডেন। রেঞ্জাররা ওই খুটি টেনে তুললো না কেন, এই তো? তাহলে ফাঁদ নিয়েই খোঁড়াতে খোঁড়াতে গিয়ে গাড়িতে উঠতে পারতো। তোমার তো দুটো পা-ই ভালো। যাও, দেখো ওপড়াতে পারো কিনা।

টানতে টানতে নীল হয়ে গেল কিশোরের মুখ। তার সঙ্গে গিয়ে মুসাও হাত লাগালো। দুজনে মিলে টেনেও নাড়তে পারলো না গজালটা। পোঁতা হয়েছে উইয়ের ঢিবিতে। গোলমাল শুনে বিরক্ত হয়েই যেন কি হচ্ছে দেখতে বেরোলো উইয়েরা।

পারবে না, মাথা নাড়লেন টমসন। খামোকা কষ্ট করছে। তিন ফুট লম্বা একেকটা। বড় হাতুড়ি দিয়ে পিটিয়ে বসানো হয়েছে। উইয়ের ঢিবিগুলো দেখতে দেখা যাচ্ছে মাটি, আসলে সিমেন্টের মতো শক্ত। হাতির পায়ে শেকল বেঁধে দিয়ে দেখো, তারও টেনে তুলতে কষ্ট হবে। আর ফাঁদে আটকা থাকলে তো পারেই না, ভীষণ ব্যথা লাগে পায়ে। যাও, সাপ্লাই ভ্যান থেকে শাবল নিয়ে এসো। চাড় মেরে খুলতে হবে।

গিয়ে শাবল আনলো মুসা।

 দাঁতের ফাঁকে শাবল ঢুকিয়ে চাড় দিয়ে চোয়াল দুটো ফাঁক করলেন টমসন। বেচারা লোকটার রক্তাক্ত পা-টা বের করে আনা হলো। মাংস কেটে হাড়ে গিয়ে বসেছিলো দাঁত। তাড়াতাড়ি অ্যানটিসেপটিক আর ব্যাণ্ডেজ এনে, ক্ষত পরিষ্কার করে বেঁধে দিতে লাগলো কিশোর।

.

০৯.

আরি! বেড়ার দিকে তাকিয়ে আছে রবিন। দাড়িওয়ালা কোথায়?,

প্রচণ্ড উত্তেজনায় সিলভারের কথা ভুলে গিয়েছিলো সবাই।

হাঁটু গেড়ে বসে কিশোরের ব্যাণ্ডেজ বাঁধা দেখছিলো মুসা, লাফ দিয়ে উঠে। দাঁড়ালো। চেঁচিয়ে ডাকলো, মুগামবি, কালিমবো, জলদি এসো। সিমবাকে নিয়ে এসো।

আগে আগে ছুটলো ট্র্যাকার মুগামবি, লম্বা ঘাস এড়িয়ে থাকছে যতোটা সম্ভব, যাতে ফাঁদে পা না পড়ে। তার পেছনে রইলো অন্যেরা।

বেড়ার একটা ফাঁক দিয়ে আরেক পাশে চলে এলো। কেউ নেই।

কুঁড়েগুলোতে দেখো, বলেই একটা কুঁড়ের দিকে দৌড় দিলো মুসা।

সব কটা কুঁড়েতে খুঁজে এলো সে আর কালিমবো। ফিরে এসে দেখলো, এক জায়গায় মাটিতে ঝুঁকে কি যেন দেখছে মুগামবি।

মাটিতে পায়ের ছাপের ছড়াছড়ি, পোচারদের নগ্ন পা। পাঁচটা করে আঙুলের ছাপ স্পষ্ট। ওগুলোর মাঝে এক সারি ছাপ আছে, যেগুলোর আঙুল নেই।

বুট, মুগামবি বললো। দাড়িওয়ালাটা। বুট পরেছিলো। ধরে ফেলা যাবে।

বুটের ছাপ অনুসরণ করে চললো ট্র্যাকার। বারো-তেরো কদম এগিয়েই দাঁড়িয়ে গেল। চোখে বিস্ময়। ছাপ নেই আর। আচমকা যেন বাতাসে মিলিয়ে গেছে বুটধারী। গাছে চড়লো নাকি?

ওপরে তাকালো মুগামবি। নেই। একটা নিচু ডালও নেই, যেটাতে উঠতে পারবে বুট পরা লোকটা।

মহা শয়তান, বাতাসে থাবা মারলো মুগামবি। বুট খুলে নিয়েছে। কেউ যাতে পিছু নিতে না পারে।

এখানেও পায়ের ছাপ অনেক আছে, বুট পরা একটাও নেই, সব নগ্ন। সিলভারের ছাপ কোনটা এখন আর বোঝার উপায় নেই।

 সিমবা! তুড়ি বাজালো মুসা। কুকুরটাকে দিয়ে চেষ্টা করালে কেমন হয়?

ডেকে সিমবাকে সেই জায়গাটায় নিয়ে গেল কালিমবো, বুটের ছাপ যেখান থেকে শুরু হয়েছে। শুকতে বললো। কথা বুঝলো বুদ্ধিমান কুকুরটা। নাক নিচু করে বুটের ছাপ শুকলো কয়েকবার, ওপরে মাথা তুলে গন্ধ নিলো বাতাসে। ছাপ অনুসরণ করে চলে এলো যেখানে বুটের চিহ্ন শেষ হয়েছে। থেমে ওপরের দিকে নাক তুলে আবার গন্ধ শুকলো। মৃদু ঘড়ঘড় আওয়াজ বেরোচ্ছে গলা থেকে।

 টমসনও এসে দাঁড়িয়েছেন। বললেন, কুকুরটা চালাক বটে। কিন্তু বুট আর। খালি পায়ের ছাপ আলাদা করে চিনতে পারবে না।

দেখুন না কি করে? হেসে বললো কালিমবো।

ফিরে গিয়ে আবার শুরুর জায়গায় বুটের ছাপ শুকলো সিমবা। তারপর আশপাশের অন্য ছাপগুলো.। আশা-নিরাশায় দুলছে মুসার মন। সবই নির্ভর করছে এখন ছাপগুলো নতুন না পুরনো তার ওপর। নতুন হলে চামড়ার গন্ধে ঢাকা পড়ে যাবে লোকটার ঘামের গন্ধ। কিন্তু যদি পুরনো হয়, এই গরমে ঘামে ভিজে গন্ধ হয়ে যাবে জুতোর চামড়া, তীব্র সেই গন্ধ কিছুতেই ফাঁকি দিতে পারবে না কুকুরের প্রখর ঘ্রাণশক্তিকে।

হলোও তাই। খেঁকিয়ে উঠলো সিমবা। আবার নাক নামিয়ে বুটের ছাপ। শুকলো। তারপর জোরে ঘেউ করে উঠে দৌড়ে এলো বুটের ছাপ যেখানে শেষ হয়েছে তার কাছে। কয়েকটা নগ্ন পায়ের ছাপ শুকলো। একটার কাছে এসে আরেকবার চেঁচিয়ে উঠে দিলো দৌড়। কয়েক পা গিয়ে আবার শুকলো। চললো আবার।

পেয়েছে! বাচ্চা ছেলের মতো হাততালি দিয়ে উঠলো মুসা। পেয়ে গেছে। সে-ও ছুটলো কুকুরটার পেছনে।

 কিন্তু লোকটা বোকা নয়। মাসাইদের সঙ্গে কুকুর আছে, নিশ্চয় দেখেছে। কিছু দূর গিয়ে আরেক ফন্দি করেছে ধোকা দেয়ার জন্যে। নিজের রক্তের ওপর পড়ে রয়েছে একটা মরা মোষ। সোজা গিয়ে সেই রক্তে পা ভিজিয়েছে সিলভার। পচা রক্তের গন্ধে ঢাকতে চেয়েছে নিজের গায়ের গন্ধ। মোষটার চারপাশে ঘুরেছে কয়েকবার, যততক্ষণ না পা থেকে রক্ত মুছে গেছে, বালি লেগেছে পায়ে। তারপর অন্য আরও অনেক চাপের সঙ্গে পা মিলিয়ে চলে গেছে। এখন বের করবে কি করে সিমবা?

নিরাশ ভঙ্গিতে মাথা নাড়লেন ওয়ারডেন।

কিন্তু কালিমবোর বিশ্বাস আছে তার কুকুরের ওপর?

ছাপ চিনতে বেশ দেরি হলো সিমবার। বিচিত্র ভঙ্গিতে মাথা ঝাড়ছে, যেন শিওর নয় সে।

তবে এখন তাকে সাহায্য করতে পারলো আরেক ওস্তাদ। পিছিয়ে গিয়ে সিলভারের খালি পায়ের ছাপ ভালো মতো দেখলো মুগামবি। মাপ নিলো। এগিয়ে এসে রক্তে ভেজা ছাপ মাপলো। বেরিয়ে যাওয়া ছাপগুলো থেকে ঠিক বের করে ফেললো, কোনটা দাড়িওয়ালার ছাপ। সিমবা যে জোড়া বেছে নিয়েছে, ওগুলোই।

গুড, বললো মুগামবি। আঙুলগুলো একটার সঙ্গে আরেকটা চেপে রয়েছে…বুট…যা সিমবা, এগো।

চেয়ে রয়েছে…বুট বলে কি বোঝালো? জিজ্ঞেস করলো মুসা।

বুটের জন্যে ওরকম হয়েছে বললো, হাঁটতে হাঁটতে জবাব দিলেন টমসন। সব সময় কেউ শক্ত বুট পরে থাকলে পায়ের আঙুল পাশাপাশি চেপে মাঝের ফাঁক কমে যায়। আর যারা সব সময় খালি পায়ে হাঁটে তাদের আঙুল ছড়িয়ে যায়, বড় হয়ে যায় ফাঁক।

কিছু দূর গিয়ে আবার নতুন কায়দা করেছে সিলভার। মোড় নিয়ে এগিয়ে সোজা নেমে গেছে টিসাভো নদীতে।

হতাশ হয়ে গর্জে উঠলো সিমবা। অ্যালসেশিয়ানের ডাকের সঙ্গে মিল নেই, একেবারে বুনো কুকুরের চিৎকার। আফ্রিকার তৃণভূমিতে, জঙ্গলে ওই ডাক অহরহ শোনা যায়।

আর হবে না, মুগামবিও হাল ছেড়ে দিলো। সরাসরি ওপারে গিয়ে নিশ্চয় ওঠেনি। হয় উজানে গেছে, নয়ত ভাটিতে। সাঁতরে ভাটিতে যাওয়ারই বেশি সুবিধে। অনেক দূর গিয়ে ওপারে কোনো ঝোপের ভেতর দিয়ে উঠে গেছে। হাজার খুঁজলেও পাওয়া যাবে না আর। আমি শিওর, ঘাসের ওপর উঠেছে সে। আর যা গরম। ঘাসের ওপর পড়ার সঙ্গে সঙ্গে শুকিয়ে গেছে পানি। ব্যাটা গেছে। অনেকক্ষণ হয়েছে। আমরা যেতে যেতে ছাপের কোনো চিহ্নই থাকবে না।

.

১০.

সাতচল্লিশ জন. ঘুমন্ত পোচারকে মরা মাছের মতো গাদাগাদি করে ভরা হলো। হাতির খাঁচার মধ্যে। অন্তত আরও ঘন্টা চারেক ঘুমিয়ে থাকবে ওরা, একশো তিরিশ মাইল পেরিয়ে মোমবাসা যাওয়ার জন্যে যথেষ্ট সময়। ওখানে জেলখানায় ঘুম ভাঙবে ওদের।

জেল-ওয়ারডেনের কাছে একটা নোট লিখে দিলেন টমসনঃ পোচিঙের অপরাধে সাতচল্লিশ জন পোচারকে ধরে পাঠালাম, বিচারের জন্যে। একজন রেঞ্জারের হাতে নোটটা দিয়ে ওয়াগনের সঙ্গে যেতে বললেন।

অন্যদের থাকতে হবে, অনেক কাজ পড়ে আছে। শখানেকের বেশি। জানোয়ার আটকা পড়ে আছে ফাঁদে, যেগুলো এখনও মরেনি, ছাড়াতে হবে।

মরা কিংবা মুমূর্ষ জানোয়ারগুলোকে মাছির মতো হেঁকে ধরেছে শকুনের দল। মানুষ কাছে যেতেই উড়ে গেল। হায়েনা আর শেয়ালের পালও সরে গেল, একেবারে গেল না অবশ্য, মানুষ চলে গেলেই আবার আসবে।

 ছাড়া পাওয়ার জন্যে ছটফট করছে কিছু কিছু জানোয়ার। তাতে গলায় আরও চেপে বসছে তারের ফাঁস, ধারালো ছুরির মতো চামড়া কেটে ঢুকে যাচ্ছে মাংসের গভীরে। রক্ত ঝরছে। এভাবে বেশিক্ষণ টানাটানি করতে থাকলে আপনা-আপনি। জবাই হয়ে যাবে।

বাঁচার সম্ভাবনা আছে এমন কিছু জীবকে মারাত্মক ঝুঁকি নিয়ে ফাঁস-মুক্ত করলো মাসাইরা। যেগুলোর জখম কম, ছাড়া পেয়েই ছুটে পালালো। বেশি জখমিগুলোকে লরিতে তুলে নেয়া হলো, হাসপাতালে নিয়ে যাবে।

প্রতিটি ফাঁস কেটে দেয়া হলো, নষ্ট করা হলো মাটিতে পেতে রাখা ফাঁদ।

কুঁড়েগুলোর কি হবে? কিশোর জিজ্ঞেস.করলো।

বেড়া, কুঁড়ে, সব পুড়িয়ে দেবো, বললেন ওয়ারডেন। এ আগুন লাগানো হলো বেড়ায়। দাউ দাউ করে জ্বলে উঠলো এক মাইল লম্বা শুকনো কাঁটালতা। জিনিসপত্র সব বের করে এরপর কুঁড়েগুলোতেও আগুন, লাগানো হলো। মনে হচ্ছে যেন দাবানল লেগেছে।

জিনিসগুলো আলাদা আলাদা জায়গায় জড়ো করা হয়েছে।

জীবনে দেখিনি এরকম কাণ্ড! আনমনে বিড়বিড় করতে করতে মাথা নাড়লো। রবিন। চোখ বড় বড় করে তাকিয়ে রয়েছে প্রায় তিনশো হাতির পায়ের দিকে। ফুটখানেক ওপর থেকে কেটে নেয়া হয়েছে, মাঝের হাড়মাংস সব ফেলে দিয়ে ওয়েইস্ট-পেপার বাস্কেট বানানো হবে।

আরেক জায়গায় স্তূপ করে রাখা হয়েছে অসংখ্য চিতাবাঘের মাথা। প্রতিটি মাথা কয়েক হাজার ডলারে বিকোবে। ইউরোপ-আমেরিকা থেকে সাফারিতে আসে। লোকে। তাদের মাঝে অনেক ধনী মানুষ থাকে, যার চিতাবাঘ শিকার করে মাথা। নিয়ে গিয়ে নিজের বাড়ির ড্রইংরুমে সাজাতে চায়। চিতাবাঘ নিশাচর জীব, অসাধারণ ধূর্ত, দক্ষ শিকারীর পক্ষেও শিকার করা কঠিন। আনাড়ি টুরিস্ট সেটা পারে না। কয়েক রাত গাছের ডালে কিংবা মাচায় কাটিয়েই বিরক্ত হয়ে যায়। শেষে সহজ কাজটাই করে। সোজা গিয়ে নাইরোবি থেকে একটা মাথা কিনে নিয়ে বাড়ি ফেরে, হয়তো বাহাদুরি দেখিয়ে বলে আমি মেরেছি। কে দেখতে আসছে, সে সত্যি কথা বলছে না মিথ্যে?

চিতাবাঘের মাথার পাশে জমানো হয়েছে চিতার চামড়া। সোফার কাভার হবে হয়তো ওগুলো দিয়ে, কিংবা ডিভানের পায়ের কাছের কার্পেট। শান্ত, ন্দ্র, মিষ্টি যে মহিলাটি ঘর সাজাবেন ওগুলো দিয়ে, এয়ারগান দিয়ে শিকার করা চড়ুই পাখি ছেলের হাতে দেখলে শিউরে ওঠেন যিনি, মুহূর্তের জন্যেও ভাববেন না, শুধু তাঁর ড্রইংরুমের শোভা বাড়ানোর জন্যেই অকালে প্রাণ দিতে হয়েছে কতগুলো অপূর্ব সুন্দর জানোয়ারকে।

ওগুলো কি? কয়েকটা কাঠের পাত্রে রাখা অদ্ভুত কিছু বাঁকা বাঁকা চুল দেখিয়ে জিজ্ঞেস করলো মুসা।

মনে হয় হাতির চোখের পাপড়ি, জবাব দিলো রবিন।

দূর, কি বলো? ওসব দিয়ে কি করবে?

করবে বলেই তো নিয়েছে।

কি হয়?

আসলে হয়তো হয় না কিছুই, সুযোগ পেয়ে বিদ্যে ঝাড়তে শুরু করলো। বইয়ের পোকা শ্রীমান রবিন মিলফোর্ড, ওরফে চলমান জ্ঞানকোষ। সব কুসংস্কার। কিন্তু সিঙ্গাপুরে এর দারুণ চাহিদা। কুসংস্কারে বিশ্বাসী লোকেরা মনে করে, যার কাছে যতোটা হাতির চোখে পাপড়ি থাকবে, সে ততোটা ছেলেপুলের বাপ হবে। নানারকম অলৌকিক ক্ষমতার অধিকারীও নাকি ওই চুল। বইয়ে পড়েছি, একজন পিগমী রাজা নাকি বায়ান্ন শো পাউণ্ড দামের হাতির দাঁত দিয়ে ফেলেছিলো শুধু একটি মাত্র পাপড়ি জোগাড়ের জন্যে। অ্যারাবিয়ানদের অনেকের কাছেও এর যথেষ্ট কদর। তাদের বিশ্বাস, ওই পাপড়ি দিয়ে মালা বানিয়ে গলায় ঝোলালে রাইফেলের গুলি লাগে না শরীরে, কাছে এসেও পাশ কাটিয়ে আরেক দিকে চলে যায়।

বাহ, দারুণ বর্ম তো!

মালমশলা তো হাতের কাছেই আছে, হেসে বললেন ওয়ারডেন। বানিয়ে ঝুলিয়ে ফেলো না একটা। তীর লাগবে না আর শরীরে।

ওদের মতো বলদ নাকি আমি? মুখ বাঁকালো মুসা।

তার কথার ধরনে হা-হা করে হেসে ফেললেন টমসন।

কতগুলো গণ্ডারের শিং দেখিয়ে জিজ্ঞেস করলো মুসা, রবিন, এগুলো দিয়ে কি হয়? পুড়িয়ে গুঁড়ো করে ফেলে গণ্ডারের মতো শিং গজায় নাকি ব্যাটাদের মাথায়? শত্রুকে গুঁতোতে পারে?

ওর কথায় ওয়ারডেন তো হাসছেনই, কিশোর আর রবিনও হাসতে শুরু করলো। হাসতে হাসতেই রবিন বললো, এগুলোর বেশি ভক্ত চীনারা। গুড়ো করে। চায়ের সঙ্গে মিশিয়ে খায়।

কেন, পাগলামি সারানোর জন্যে?

না, শক্তিশালী হওয়ার জন্যে। গায়ে নাকি গণ্ডারের জোর আসে, বুকে সিংহের সাহস।

হয়?

মনের জোর বাড়ে হয়তো। মানসিক ব্যাপার। কিন্তু ওদের ওই বিশ্বাসের কারণে সর্বনাশ হয়ে যাচ্ছে গণ্ডারের। ইনডিয়ান গণ্ডার তো শেষই করে দিয়েছে। চীনারা, এ-হারে মারা পড়তে থাকলে আফ্রিকান গণ্ডারও শীঘ্রি খতম হয়ে যাবে। শেষে চিড়িয়াখানা ছাড়া আর কোথাও দেখা যাবে না ওদের।

পুড়ে ছাই হলো বেড়া আর ঘাসের কুঁড়েগুলো।

ট্রাকে তোলা হলো সস্ত হাতির দাঁত, লেজ, চোখের পাপড়ি, পায়ের পাতা, জলহস্তীর দাঁত আর চর্বি, জিরাফের লেজ, পেছনের পায়ের শিরা, সিংহের মাথা আর চর্বি, চিতাবাঘের মাথা, চিতার চামড়া, অ্যানটিলোপ আর গ্যাজেল হরিণের শিং, কুমির আর অজগরের চামড়া, ইগ্রেট, ফ্ল্যামিংগো, উটপাখি আর লম্বা-গলা। ধবল-বকের পালক; আরও নানা রকম জানোয়ারের শরীরের বিভিন্ন অংশ। তারের ফাঁস আর নষ্ট ফাঁদগুলোও তুলে নেয়া হলো। নইলে অন্য পোচাররা এসে ওগুলো আবার কাজে লাগাবে।

কি হবে ওসব দিয়ে? কিশোর জিজ্ঞেস করলো। বিক্রি করবেন?

না, বললেন ওয়ারডেন। নিরীহ পশুর রক্তে ভেজা ওই টাকা আমাদের চাই না। তার চেয়ে নিয়ে গিয়ে কোনো মিউজিয়মে রাখার ব্যবস্থা করবো। লোকে দেখবে। পোচারদের ওপর রাগ হবে তাদের, পোচিঙের বিরুদ্ধে তৈরি হবে শক্তিশালী জনমত। প্রতিবাদের ঝড় উঠবে।

লজে ফিরে এলো গাড়ির মিছিল। ওয়ারডেনের ব্যাণ্ডায় ঢুকলেন টমসন, সাথে তিন গোয়েন্দা। হাসিমুখে তাদের স্বাগত জানালেন জজ নির্মল পাণ্ডা। মুখে। মোলায়েম হাসি।

তুমি! চেঁচিয়ে উঠলেন টমসন। দেখা হয়ে ভালোই হলো। নাইরোবিতে ঠিকঠাক মতো গিয়েছিলে তো?

হ্যাঁ। মোমবাসায় ফিরে যাচ্ছি। ভাবলাম, দেখেই যাই পোচারদের বিরুদ্ধে সংগ্রামে কতোটা লাভ হলো।

লাভ মানে! বললে বিশ্বাস করবে না, সাতচল্লিশ জনকে ধরে পাঠিয়েছি মোমবাসা জেলে। কাল সকালে হাজির করবে তোমার কোর্টে।

তাই নাকি, তাই নাকি? ভারি আনন্দের কথা, জজের কণ্ঠ শুনে রবিনের মনে হলো, আনন্দে ঘড়ঘড় করছে যেন বেড়াল। হাতে পেয়ে নিই আগে, উচিত শিক্ষা। দেবব ব্যাটাদের। পোচিঙের নাম ভুলিয়ে ছাড়বো। সর্দারটাকে ধরেছো?

সিলভার? নাহ। পালিয়ে গেল।

হায় হায়, করলে কি? আসল বদমাশটাকেই ধরতে পারলে না। গিয়ে তো। আরেক জায়গায় দল বানাবে, আর জানোয়ার মারা শুরু করবে। পালালো। কিভাবে?

ভীষণ চালাক, ব্যাটা। দলের লোকদের আগে বাড়তে বলে নিজে রইলো। পেছনে। দলের লোক যখন হেরে গেল, আমরা ওদেরকে ধরায় ব্যস্ত, সেই সুযোগে পালালো। কুকুর নিয়ে অনেক খুঁজলাম। পেলাম না। নদীতে নেমে গায়েব হয়ে গেছে।

 কুকুরটার দিকে তাকালেন জজ। বাহু, ভারি সুন্দর কুকুর। একেবারে বাঘের বাচ্চা। এটাকে ফাঁকি দিয়েছে সিলভার? হাত বাড়িয়ে মাথায় চাপড় দিতে গেলেন তিনি।

অপরিচিত লোককে পছন্দ করতে পারলো না সিমবা। মৃদু ঘড়ঘড় করে। পিছিয়ে গেল। দাঁড়িয়ে গেল ঘাড়ের রোম। চোখ দেখে মনে হলো এখুনি ঝাঁপিয়ে পড়বে। তাড়াতাড়ি ওর কলার চেপে ধরলো মুসা। কি জানি কেন, শুরু থেকেই তাকে পছন্দ করে ফেলেছে সিমবা। কালিমবোর মতোই মুসার কথাও শোনে।

আরও দুচারটে কথা বলে বিদায় নিয়ে বেরোলেন জজ। তাকে এগিয়ে দিতে চললেন ওয়ারডেন, পিছু নিলো তিন গোয়েন্দা।

 তীক্ষ্ণ চোখে জজ সাহেবের গাড়িটা দেখছে কিশোর। নিচের ঠোঁটে চিমটি কাটছে। আকাশ থেকেই দেখেছে নাইরোবি যাওয়ার কাঁচা সড়কটা লাল মাটিতে ঢাকা। গাড়ি চললেই লাল ধুলো ওড়ে। জমার কথা লাল ধুলো, অথচ তার গাড়িটাতে পড়ে আছে সাদা ধুলোর হালকা আস্তরণ। বলেই ফেললো,গাড়িটা পরিষ্কার পরিষ্কার লাগছে? লাল ধুলোয় ঢেকে থাকার কথা।

অবাক হলেন জজ। সামান্য ওপরে উঠে গেল একটা ভুরু। তারপর হেসে ফেললেন। ও, হ্যাঁ হ্যাঁ, ভুলেই গিয়েছিলাম তোমরা গোয়েন্দা। তা বলেছো ঠিকই, ওই রাস্তায় একবার গেলেই লালে লাল। ফেরার সময় এতো ময়লা হয়ে গেল, শেষে পরিষ্কার না করিয়ে আর পারলাম না। পার্কে ঢোকার মুখেই পেট্রোল স্টেশনটা, ওখানে ওয়াশ করিয়েছি, আবার হাসলেন। আর কোনো প্রশ্ন?

না, লজ্জিত মনে হলো গোয়েন্দাপ্রধানকে। অভিনয় কিনা বোঝা গেল না।

জজ সাহেবও মাইও করেননি তার কথায়, অন্তত তার চেহারা দেখে তা-ই মনে হলো। ওয়ারডেনকে বললেন, চলি, ডেভিড। সাবধানে থাকবে, ওই পোচার হারামজাদাগুলোর কথা কিছুই বলা যায় না। কখন আবার লুকিয়ে-চুরিয়ে তীর মেরে বসে, তিন কিশোরকে বললেন। গোয়েন্দারা, আশা করি সিলভারকে ধরে ফেলতে পারবে। চলি, গুড বাই।

<

Super User