হঠাৎ করেই নামল রাত। সূর্য ডোবার পর অন্ধকার আর সময়ই দেয়নি সাঁঝকে। কাল মেঘ জমেছে আকাশে।

এ কি কাণ্ড দেখো, গম্ভীর হয়ে বলল মুসা। দিনটা কি ভাল গেল। বোঝাই যায়নি বৃষ্টি আসবে।

তাড়াতাড়ি চলো, বলল রবিন। ভিজে চুপচুপে হয়ে যাব। মাথা বাঁচানোরও জায়গা নেই।

মোড় নিয়ে কয়েক কদম এগিয়েই থমকে গেল দুজনে। খুব সরু পথ, পাতাবাহারের ঝোপের সুড়ঙ্গ। সকালে এমন একটা পথে হেঁটে এসেছে। দিনের বেলায়ই আবছা অন্ধকার ছিল ওটাতে। এটাতে এখন গাঢ় অন্ধকার।

ঠিক পথেই যাচ্ছি তো? মুসার কণ্ঠে সন্দেহ।

কি জানি। রবিনও বুঝতে পারছে না।

যা থাকে কপালে, ভেবে রবিনের হাত ধরে হাঁটতে শুরু করল মুসা। কয়বার মোড় নিয়েছে পথ, কতখানি এঁকেবেঁকে গেছে, কিছুই বোঝা গেল না। অন্ধের মত এগিয়ে চলেছে দুজনে। জুতোর তলায় ছপছপ করছে কাদা-পানি।

নর্দমায় নামলাম না তো? মুসা বলল। জুতোর ভেতর পানি ঢুকছে।

আমারও সুবিধে লাগছে না, মুসা। যতই এগোচ্ছি, পানি কিন্তু বাড়ছে। শেষে গিয়ে কুয়া-টুয়ায় না পড়ে মরি।

টর্চটা কোথায় রাখলাম? ব্যাগের ভেতরে খুঁজছে মুসা। ফেলে এলাম, না কি? রবিন, তোমারটা বের করো তো।

টর্চ বের করে দিল রবিন।

জ্বালল মুসা। আলোর চারপাশ ঘিরে যেন আরও ঘন হলো অন্ধকার। ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে দেখল সে। সামনে একটু দূরে, এক জায়গায় কাঠের বেড়া শুরু হয়েছে রাস্তার এক পাশ থেকে, ওখানে খানিকটা জায়গায় পাতাবাহার নেই, কেটে সাফ করা হয়েছে বোধহয়। পথটা সরু খালের মত, দু-ধারে উঁচু পাড়।

বেড়াটা নিশ্চয় কোন ফার্মে গিয়ে শেষ হয়েছে, বলল মুসা। আস্তাবল কিংবা গরুর খোঁয়াড় পেলেও মাথা বাঁচাতে পারি, ভিজতে হবে না। চলো, দেখি।

পাড়ে উঠে বেড়া ধরে ধরে এগোল ওরা। ফসলের খেতের মাঝখান দিয়ে সরু পথ।

মনে হচ্ছে এটা শর্টকাট, আন্দাজ করল মুসা। ফার্ম হাউসটা বোধহয় আর বেশি দূরে না।

একটা দুটো করে ফোঁটা পড়তে শুরু করল, যে কোন মুহূর্তে ঝুপঝুপ করে নামবে বৃষ্টি।

মুসার কথায় আশ্বস্ত হতে পারল না রবিন। সত্যিই পাবে তো ফার্মটা?

জোরে নামল বৃষ্টি। বর্ষাতি বের করা দরকার। দ্রুত এদিক ওদিক তাকাল ওরা। কোথায় ঢুকে বের করা যায়? ব্যাগের মধ্যে পানি ঢুকলে সব ভিজে যাবে, দুর্ভোগ পোহাতে হবে তখন।

মাঠের মধ্যেই দুটো আলের মিলনস্থলে ঘন একটা পাতাবাহারের ঝোপ চোখে পড়ল। দৌড়ে এসে তার ভেতরে ঢুকল দুজনে। ব্যাগ খুলে বর্ষাতি বের করল।

বৃষ্টি নামায় আরও ঘন হলো অন্ধকার। টর্চের আলো বেশি দূর যাচ্ছে না।

আলো তো দেখছি না, বলল রবিন। কই ফার্মটা?

কি জানি। বুঝতে পারছি না। ফিরে গিয়ে আবার সুড়ঙ্গে নামব? নাহ, তা-ও বোধহয় ঠিক হবে না।

পথ যখন রয়েছে, নিশ্চয় কোথাও গিয়ে শেষ হয়েছে। কিন্তু কোথায়?

না বুঝে আর এগোনোর কোন মানে হয় না। দাঁড়িয়ে ভিজতে ভিজতে ভাবছে। ওরা, কোন দিকে যাবে? কিছু একটা বলার জন্যে মুখ খুলতে গিয়েও থেমে গেল রবিন।

হঠাৎ করে এমনভাবে শুরু হলো শব্দটা, চমকে উঠল দুজনে। একে অন্যের হাত চেপে ধরল। নির্জন মাঠে, অন্ধকার রাতে এই দুর্যোগের মাঝে অদ্ভুত শোনাচ্ছে।

ঘণ্টার শব্দ।

বেজেই চলেছে। প্রলয়ের সঙ্কেত যেন। অন্তরাত্মা কাঁপিয়ে দিল দুই কিশোরের।

কোথায় বাজছে? এভাবে? ফিসফিস করল রবিন, জোরে বলার সাহস নেই।

কোথায় বাজছে মুসা জানবে কি করে? সে-ও রবিনের মতই চমকে গেছে। কাছাকাছি নয়, দূরে কোথাও বাজছে। কখনও জোরে, কখনও আস্তে। এলোমেলো বাতাস বইছে, একবার এদিক থেকে, একবার ওদিক। বাতাস সরে গেলে শব্দও কমে যাচ্ছে, যে-ই বাড়ছে, অমনি যেন তাদেরকে ঘিরে ধরছে বিচিত্র ঘণ্টা-ধ্বনি।

ইস, থামে না কেন? দুরুদুরু করছে মুসার বুক। গির্জার ঘণ্টা নয়।

না, তা-তো নয়ই, কেঁপে উঠল রবিনের গলা। কোন ধরনের সঙ্কেত হতে পারে…আমি শিওর না। অস্বস্তিতে হাত নাড়ল সে। বিড়বিড় করল, যুদ্ধ?.. বীকন কই?

কি বিড়বিড় করছ?

অ্যাঁ?…বীকন। পুরানো আমলে যুদ্ধ লাগলে ওভাবে ঘণ্টা বাজিয়ে হুঁশিয়ার করা হত গাঁয়ের লোককে। সেই সঙ্গে আলোর সঙ্কেত-বীকন বলা হত।

এখন তো পুরানো আমল নয়… চমকে থেমে গেল মুসা।

রবিনের কথার মানে বুঝে ফেলেছে। কি বলতে চাইছ?

বুঝেছ তুমিও। এখন পুরানো আমল নয়, তাহলে অন্ধকারে ঝড়-বৃষ্টির মাঝে ওই ঘণ্টা…

চুপ চুপ ! আর বোলো না, ভয়ে ভয়ে চারদিকে তাকাল মুসা। অন্ধকারে কিছুই চোখে পড়ল না। টর্চের রশ্মির সামনে শুধু অগুনতি বৃষ্টির ফোঁটা।

যেমন শুরু হয়েছিল তেমনি হঠাৎ করেই থেমে গেল শব্দ।

এরপরও কান পেতে রইল দুজনে। কিন্তু আর শোনা গেল না।

চলো, হাঁটি, বলল মুসা। ফার্মটা খুঁজে বের করা দরকার। আবার কখন শুরু হয়ে যায়…

বেড়ার ধার ধরে আবার এগিয়ে চলল ওরা।

কতক্ষণ পর বলতে পারবে না, আঙুল তুলে চেঁচিয়ে উঠল রবিন, ওই যে।

মুসাও দেখল। আলো। না, বীকন নয়, জ্বলছে-নিভছে না। একভাবে জ্বলছে টিমটিম করে।

পাওয়া গেল বাড়িটা, জোরে নিঃ বাস ফেলল মুসা।

কাঠের বেড়া শেষ। একটা পাথরের দেয়ালের কাছে চলে এল ওরা। ওটার পাশ দিয়ে এল ভাঙাচোরা একটা গেটের কাছে।

ভেতরে পা রেখেই লাফিয়ে সরে এল রবিন।

কি হলো? জিজ্ঞেস করল মুসা।

আলো ফেলো তো। ডোবায় না পড়ি।

দেখা গেল, ডোবায়,পা ডোবেনি রবিনের, বৃষ্টির পানি জমেছে ছোট একটা গর্তে। গর্তটার পাশ কাটিয়ে এল দুজনে।

কাদা প্যাঁচপ্যাঁচ করছে সরু পথে। পথের শেষ মাথায় বাড়ির সাদা দেয়াল, ছোট একটা দরজা। পেছনের দরজা হবে, ভাবল মুসা। পাশের জানালা দিয়ে আলো আসছে।

জানালার কাছে এসে ভেতরে উঁকি দিল ওরা। মাথা নিচু করে সেলাই করছে এক বৃদ্ধা।

দরজার পাশে ঘণ্টার দড়ি-টুড়ি কিছু দেখতে পেল না মুসা। জোরে ধাক্কা দিল। সাড়া নেই। বন্ধ রইল দরজা। উঁকি দিল আবার জানালা দিয়ে। তেমনি ভাবে সেলাই করছে মহিলা, নড়েওনি।

কানে শোনে না নাকি? বলতে বলতেই দরজায় কিল মারল মুসা। সাড়া মিলল না এবারও। খবরই নেই যেন মহিলার।

এভাবে কিলাকিলি করে কিছু হবে না, দরজার নব ধরে মোচড় দিল মুসা।

ঘুরে গেল নব। ঠেলা দিতেই পাল্লাও খুলল।

পা মোছার জন্যে হেঁড়া একটা মাদুর বিছানো রয়েছে পাল্লার ওপাশে। তারপরে সরু প্যাসেজ। প্যাসেজের মাথায় পাথরের সিঁড়ি। সদর দরজার কাছেই ডানে আরেকটা দরজা, পান্না সামান্য ফাঁক। হারিকেনের স্নান আলো আসছে।

ঠেলে পাল্লা পুরো খুলে ভেতরে পা রাখল মুসা। তার পেছনে রবিন।

তবু তাকাল না মহিলা। সেলাই করেই চলেছে।

একেবারে তার সামনে এসে দাঁড়াল মুসা।

এইবার দেখতে পেল বৃদ্ধা। চমকে এত জোরে লাফিয়ে উঠল, ঠেলা লেগে উল্টে পড়ে গেল তার চেয়ার।

সরি, এভাবে চমকে যাবে বৃদ্ধা, ভাবেনি মুসা। দরজায় ধাক্কা দিয়েছিলাম। শোনেননি।

বুকে হাত চেপে ধরে আছে মহিলা। ইস্, কি ভয়ই না দেখালে!…কে তোমরা? এই অন্ধকারে কোত্থেকে?

চেয়ারটা তুলে আবার জায়গামত সোজা করে রাখল মুসা। হাঁপাচ্ছে অল্প অল্প। এটা কি ইয়েলো পণ্ড ফার্ম? এর খোজেই এসেছি আমরা। রাতটা কাটানো যাবে? আরও দুজন আসছে।

তর্জনীর মাথা দিয়ে বার দুই কানে টোকা দিল মহিলা, মাথা নাড়ল। শুনি না। ইশারায় বলো। পথ হারিয়েছ?

মাথা ঝাঁকাল মুসা।

এখানে তো থাকতে পারবে না, আমার ছেলে পছন্দ করে না এসব। ও এল বলে। সাংঘাতিক বদরাগী। চলে যাও।

মাথা নাড়ল মুসা। জানালা দিয়ে বাইরের বৃষ্টিভেজা রাত দেখল। তার আর

রবিনের ভেজা জুতো আর কাপড় দেখাল।

হুঁ, পথ হারিয়েছ তোমরা। ভিজেছ। ক্লান্ত। যেতে চাও না, এই তো? আমার ছেলেকে নিয়ে যে বিপদ। অচেনা কাউকে সহ্য করতে পারে না।

রবিনকে দেখাল মুসা, তারপর হাত তুলে কোণের একটা সোফা দেখাল। নিজের বুকে হাত রেখে সরিয়ে এনে নির্দেশ করল দরজার দিকে।

বুঝল মহিলা। তোমার বন্ধু সোফায় থাকবে বলছ। তুমি বাইরে কোন ছাউনি কিংবা গোলাঘরে কাটিয়ে দিতে পারবে।

আবার মাথা ঝাঁকাল মুসা।

কিন্তু সেই একই ব্যাপার, আমার ছেলে পছন্দ করে না… রবিন আর মুসার ভেজা মুখের দিকে চেয়ে অবশেষে বোধহয় করুণা হলো মহিলার। হতাশ ভঙ্গিতে হাত নেড়ে এগোল একটা দেয়াল-আলমারির দিকে।

দরজা খুলল। আলমারি মনে করেছে দুই গোয়েন্দা, আসলে ওটা ঘরের আরেকটা দরজা। ওপাশ থেকে খুব সরু কাঠের সিঁড়ি উঠে গেছে।

রবিনকে বলল মহিলা, তুমি ওপরে চলে যাও। কাল সকালে আমি না ডাকলে আর নামবে না। আহ, যাও দেরি কোরো না।

মুসার দিকে চেয়ে দ্বিধা করছে রবিন। তুমি?

তুমি যাও তো, রবিনের হাত ধরে ঠেলে দিল মুসা। আমি গোলাঘরে গিয়ে থাকি। গিয়ে দেখো জানালা-টানালা আছে কিনা। রাতে বেকায়দা দেখলে ডেকো। নিচেই থাকতে হবে আমাকে।

ঠিক আছে, গলা কাঁপছে রবিনের, অনিচ্ছাসত্ত্বেও পা বাড়াল সিঁড়ির দিকে।

নোংরা পুরানো সিঁড়ি বেয়ে উঠে এল খুদে একটা চিলেকোঠায়। একটা মাদুর আছে, পরিষ্কারই, আর একটা চেয়ার। একটা কম্বল ভঁজ করা রয়েছে চেয়ারের হেলানে, বসার জায়গায় এক জগ পানি।

ছোট জানালাও আছে একটা। ওটা দিয়ে গলা বাড়িয়ে ডাকল রবিন, মুসা? মুসা?

হ্যাঁ, শুনছি, নিচ থেকে সাড়া দিল মুসা। চুপচাপ শুয়ে থাকো। অসুবিধে না হলে আর ডেকো না।

<

Super User