হঠাৎ এই ধোঁয়া দেখে ভয়ে চিৎকার করে উঠল কিছু কমিক ক্রেতা। কিন্তু এই চিৎকার কিছুই না, আসল হট্টগোল শুরু হল ধোঁয়া সরে যাওয়ার পরে।

হায় হায়রে! গলা ফাটিয়ে চিৎকার করতে লাগলেন ম্যাড ডিকসন, আমার সর্বনাশ করে দিয়েছে! ডাকাতি! মাথা ঝাঁকাচ্ছেন বার বার, তাতে এলোমেলো চুল আরও ছড়িয়ে যাচ্ছে। বড় বড় গোঁফ কেমন যেন ফাঁক ফাঁক হয়ে বিকট করে তুলেছে মুখটাকে। গেল কোথায় ব্যাটা! লাল আলখেলা! ক্রিমসন ফ্যান্টম কস্টিউম! খুন করব আমি ওকে।

উধাও হয়েছে লাল পোশাক পরা লোকটা।

কিশোর বলল, ধোঁয়া দিয়ে ঢেকে ফেলেছিল, যাতে কেউ না দেখে ওকে। টেবিল টপকে গিয়ে দামি কমিকগুলো নিয়ে চলে গেছে।

পেছনের কাঠের ডিসপ্লে বোর্ডটার দিকে তাকিয়ে রয়েছে সে। সাজানো কমিক বইয়ের মাঝে বড় একটা ফোকর হয়ে আছে। ডিকসনও তাকিয়ে রয়েছেন সেদিকে। ফ্যান ফান নাম্বার ওয়ানের কপিটা নিয়ে গেছে…

সেই কমিকটাই, যেটার জন্যে চাপাচাপি করছিল টেকো লোকটা, নিতে পারেনি, ভাবছে কিশোর।

…আরও নিয়েছে, বলছেন ম্যাড। একগাদা! বিশ থেকে তিরিশ ডলার দাম ওগুলোর। হঠাৎ বদলে গেল বিক্রেতার কণ্ঠস্বর। কেন, দেখতে পেল কিশোর। একটা বই দেখা গেল, তাতে দামের ট্যাগ লাগানো রয়েছেঃ ৪,৫০০ ডলার।

ধোঁয়াটা তেমন স্মার্ট আইডিয়া নয়, কিশোর বলল। এগুলো পুরানো পদ্ধতি। এতে অসুবিধে হলো, চোর নিজেও কিছু দেখতে পায় না। অনেক সময় যেটা নিতে আসে সেটাই ফেলে যেতে হয়। ফেলে গেছে দেখতে পায়নি বলেই।

যা নিয়েছে তা-ই যথেষ্ট, ম্যাড বললেন। আমারগুলো যা পেয়েছে তা তো নিয়েছেই, তোমার যেগুলো আমার হাতে ছিল, সেগুলোও নিয়েছে।

পরস্পরের দিকে তাকাতে লাগল তিন গোয়েন্দা। ক্রিমসন ফ্যান্টম বা লাল ভূত ওদের কমিকগুলোও নিয়ে গেছে, সব চেয়ে দামিগুলো, যেগুলোর প্রাথমিক দামই উঠে গিয়েছিল তিনশো ডলার।

তার মানে সমাধান করার জন্যে একটা কেস পেয়ে গেলাম, বিড়বিড় করল মুসা।

কেস? সমাধান? ভুরু কুঁচকে তার দিকে তাকালেন ম্যাড।

হ্যাঁ, মাথা ঝাকাল কিশোর। পকেট থেকে কার্ড বের করে বাড়িয়ে দিয়ে বলল, এটা দেখলেই এসব কথার মানে বুঝবেন।

তিন গোয়েন্দা!…দাড়াও, দাঁড়াও! টেবিলের নিচে হাত ঢুকিয়ে দিয়ে বের করলেন একটা ছোট বাক্স। তার ভেতর থেকে বের করলেন একটা ময়লা প্রায় দোমড়ানো কার্ড। কোণগুলো নষ্ট হয়ে গেছে।

আরি! এ কি কাণ্ড! রবিন বলল, আমাদের কার্ড!

নিশ্চয়, ডিকসন বললেন। অনেক পুরানো। তোমাদের এখনকারটার সঙ্গে মেলে না। এটা বোধহয় প্রথম দিককার ছাপা কার্ডগুলোর একটা। পঁচাত্তর ডলারে বিক্রি করতে পারব।

চোখ মিটমিট করল কিশোর। তার মানে আপনি এটা বিক্রি করবে?

শ্রাগ করলেন ডিকসন। কেন করব না? কিছু কিছু লোক যা পায় তা ই সংগ্রহে রাখে। দীর্ঘ একটা মুহূর্ত ওদের দিকে তাকিয়ে রইলেন তিনি। তাহলে তোমরাই সেই লোক, যারা যে-কোন রহস্যের সমাধান করে বলে ঘোষণা দাও। বেশ, তোমাদেরকেই আমার এখন সব চেয়ে বেশি প্রয়োজন কেন, বলছি আমার কমিকগুলো খুঁজে বের করে দাও। সেই সাথে তোমাদেরগুলোও করো। ওভারস্ট্রীট যা বলেছে, তখন আমি সেই দাম দিয়েই তোমাদের কমিকগুলো কিনব, যাও, কথা দিলাম।

আবার একে অন্যের দিকে তাকাতে লাগল তিন গোয়েন্দা। অবশেষে কিশোর বলন ডিকসনের দিকে তাকিয়ে, বেশ, আমরা রাজি। যে বইগুলো আছে এখনও সেগুলোসহ বাক্সটা তুলে এক হাতে নিয়ে আরেকটা হাত বাড়িয়ে দিল কমিক বিক্রেতার দিকে।

আমার নাম আসলে জেমস ডিকসন, হাসলেন বিক্রেতা। গোঁফের জন্যে হাসিটা অনেকখানিই ঢাকা পড়ে গেল। ওরকম একটা হাস্যকর নাম নিয়েছি স্রেফ প্রচারের জন্যে।

সেটা বুঝতে পেরেছি আমরা। কিশোরও হাসল। আমি কিশোর পাশা। ও মুসা আমান। আর ও রবিন মিলফোর্ড। তাহলে কাজ শুরু করা যাক। প্রথম প্রশ্ন, মিস্টার ডিকসন, বিশেষ কাউকে কি সন্দেহ হয় আপনার?

কাউকে? এখন তো মনে হচ্ছে সবাইকেই সন্দেহ করি। স্টলের আশপাশে ভিড় জমানো জনতাকে দেখালেন তিনি হাত তুলে। তারপর দেখালেন পুরো হলঘর। তুমি জানো না, কারা এসেছে। ক্যালিফোর্নিয়ার সব চেয়ে বড় পাগলগুলোই এখানে ভিড় জমায়। হাসলেন তিনি আবার। তোমাকে অবশ্য পাগল বলছি না, কারণ তুমি কিনতে আসোনি।

তার মানে, আপনি বলতে চাইছেন, এরা সবাই পাগল?

হাত ওল্টালেন ডিকসন। একটা কথা বলতে পারি, সংগ্রহের নেশায় যখন পেয়ে বসে মানুষকে, হিতাহিত জ্ঞান লোপ পায় অনেকের। বিগড়ে গিয়ে অন্য মানুষ হয়ে যায়। কি সংগ্রহ করল, কিভাবে করল, সেটা নিয়ে বিন্দুমাত্র মাথাব্যথা থাকে না। আমার বিশ্বাস, অসুস্থই হয়ে পড়ে তখন ওরা।

চুরিও করে বলতে চাইছেন, কিশোর বলল। চোরটা কি বইগুলো বেচবে? কি মনে হয় আপনার?

অত সহজ হবে না। বিশেষ করে ফ্যান ফানের মত জিনিস। ভ্রূকুটি করলেন ডিকসন। যেখানেই বেচতে যাবে, প্রশ্নের মুখোমুখি হতে হবে। দোকানদার জানতে চাইবেই, কোথেকে জোগাড় করা হয়েছে ওগুলো।

চোরটা তা বলতে চাইবে না, মুসা বলল।

মাথা  ঝাঁকালেন ডিকসন। মুশকিলটা হলো কি, সংগ্রাহকের ব্যাপারে তদন্ত করছ তোমরা। কি যে করবে লোকটা, বলা কঠিন। হয়তো সারাটা জীবনই মাটির তলার ঘরে লুকিয়ে রাখবে কমিকগুলো। বেরই করবে না।

ব্যাপারটা নিয়ে আলোচনা করছে তিন গোয়েন্দা। কৌতূহলী দর্শক এসে ভিড় জমিয়েছে স্টলের কাছে, তাদেরকে সরিয়ে দিল হোটেলের কর্মচারীরা। আবার নিয়মিত বেচাকেনা শুরু হলো ঘরে। বারো বছরের একটা ছেলে এগিয়ে এল। হাতে একটা সাদা-কালো ছবি। ছবিটা মলাটে সাটা। একজন বন্ধুকে দেখিয়ে বেশ গর্বের সঙ্গে বলল, দেখ দেখ, কি পেয়েছি। পুরো পাতাটাতেই আইজাক হুফারের আর্ট। ক্রিমসন ক্রিস্টমাস থেকে এঁকেছে। মাত্র সত্তর ডলার দিয়ে নিয়ে ফেললাম।

লম্বা, পাতলা, ধূসর চুলওয়ালা একজন লোক এগিয়ে এল। চামড়ার রঙ বেশি ফ্যাকাসে। কোন সময়েই যেন বাইরে বেরোয় না, খালি ঘরে বসে থাকে। বলল, এই খোকা, আমার কাছে বেচে দাও ওটা। পঁচাত্তর দেব।

না, জবাব দিল ছেলেটা।

একটানে ছেলেটার হাত থেকে ছবিটা নিয়ে নিল লোকটা। ওর হাতে গুঁজে দিল কতগুলো নোট। নাও, একশোই দিলাম। অনেক কিছু কিনতে পারবে।

হাঁ করে তাকিয়ে রয়েছে ছেলেটা। ফড়াৎ ফড়াৎ করে টেনে ছবিটা ছিড়ে ফেলল লোকটা। বড় একটা অ্যাশট্রেতে গুঁজে লাইটার বের করে আগুন ধরিয়ে দিল টুকরোগুলোতে।

কে আপনি? চিৎকার করে উঠল ছেলেটা। আমার জিনিস কেন ছিড়লেন?

বেঁটে, মোটা, কালো চুল, কালো দাড়ি এক লোক এগিয়ে এল। ঠিকই করেছে ছিড়ে। ওর নাম আইজাক হুফার। ওটা তারই আঁকা ছিল।

চোয়াল স্কুলে পড়ল ছেলেটার। আপনিই আইজাক হুফার! একটা অটোগ্রাফ দেবেন?

ছেলেটার বাড়িয়ে ধরা নোটবুকে হেসে সই দিয়ে দিল পাতলা লোকটা।

ইস! দুঃখ করে বলল ছেলেটা, যদি ওই ছবিটাতে আপনার-সই নিতে পারতাম!

হুফারের মুখ থেকে হাসি চলে গেল। ক্রিমসন ফ্যান্টমে জীবনে সই দেব না আমি!

মোটা লোকটা ছেলেদের দিকে তাকিয়ে মাথা নাড়ল। কেন রাগল জানো? তুমি নিশ্চয় জানেন না, ওই সিরিজ থেকে বের করে দেয়া হয়েছে হুফারকে। ঠকিয়েছে। হিরোয়িক কমিকস তার সমস্ত শিল্পকর্ম বিক্রি করে দিয়েছে, অথচ একটা পয়সা দেয়নি ওকে। তাই যেখানে যা পাচ্ছে নষ্ট করে ফেলছে সে, যাতে আরও দামি না হয়ে ওঠে, আরও বেশি রোজগার করতে না পারে হিরোয়িক কমিক।

হুফার! ডাক দিলেন ডিকসন। আপনাকেই আমার দরকার ছিল। একটা জিনিস দেখাতাম। সংগ্রহে রাখার মত। মুখ বাঁকালেন তিনি। কিন্তু এখন আর পারব না। চুরি হয়ে গেছে।

তাই! স্টলের কাছে এগিয়ে এল মোটা লোকটা। চোর বলছে তার দোকানে ডাকাতি হয়েছে। চমৎকার!

জ্বলন্ত চোখে লোকটার দিকে তাকালেন ডিকসন। দেখ এডগার, আমার ব্যাপারে নাক গলাতে এসো না!

তুমি চোর নও বলতে চাও? লোকে পছন্দ করে কিনতে আসে বলে তাদের গলা কাট তুমি। তোমাদের মত লোকেরাই এই কালেকটিং ব্যবসাটাকে মাটি করল! সুযোগ পেয়ে ছিলে ফেল মানুষকে।

স্টলের টেবিল, ঘুরে এডগারের দিকে এগোতে গেলেন ডিকসন। তাঁর হাত চেপে ধরল হুফার। তার হাতের উল্টো পিঠে কনভেনশন স্ট্যাম্প মারা দেখতে পেল কিশোর। ওখানেই থাকুন। এডগার ঠিকই বলেছে। ডাকাতিই চলছে এখানে। কমিক থেকে সবাই লাভবান হয়, কেবল আর্টিস্ট বাদে।

এই যে, ডিকসন! তাড়াহুড়ো করে এগিয়ে এলেন কনভেনশন চীফ ই মরগান। এইমাত্র পেলাম খবরটা। কি যে কাণ্ড! কারও কোন দায়-দায়িত্ব নেই। আমি এখান থেকে সরেও সরতে পারলাম না, ঘটে গেল…! দুঃখজনক। কি নিয়েছে চোর?

বেশি কিছু না। সব চেয়ে দামি যেটা নিয়েছে সেটা ফ্যান ফানের একটা কপি। তাতে হুফারের কিছু কাজ করা ছিল। হুফারের হাত থেকে হাত ছাড়িয়ে নিলেন ডিকসন। থাকলে এখন ওকে দেখাতে পারতাম।

কমিক বিক্রির ব্যাপারে নানা জনের নানা মত থাকতে পারে, বললেন মরগান। তবে চুরিদারিটা মানা যায় না। এর একটা ব্যবস্থা করতেই হবে।

তা তো হবেই। চোখ খোলা রাখব আমরা, এডগার বলল। হুফার, চলো, যাই। রক অ্যাস্টারয়েড বোধহয় শুরু হয়ে গেল। এখনও গেলে ধরা যায়।

রওনা হয়ে গেল দুজনে।

কয়েকজন ডিটেকটিভকে কাজে লাগিয়ে দিয়েছি আমি, ডিকসন বললেন। তিন গোয়েন্দার পরিচয় করিয়ে দিলেন মরগানের সঙ্গে।

কার্ডে চোখ বোলালেন মরগান। গোয়েন্দা, না? বেশ বেশ। সাহায্যের দরকার হলে জানিও। আমার এখন কাজ আছে, যেতে হবে। আরেক সমস্যা। গোল্ড রুমে রক অ্যাস্টারয়েডের সিরিয়াল দেখানো হবে, সব কটা, ষাট ঘণ্টা ধরে চলবে। অথচ চালানোর মানুষই এখনও আসেনি। প্রোজেকশনিস্ট। এডগারকে অপেক্ষা করতেই হচ্ছে।

জোরে নিঃশ্বাস ফেললেন তিনি। প্রোজেকটর সেট করেই রেখেছি। চালানোর একজন মানুষ পেলেই এখন হয়ে যেত। কস্টিউম প্রতিযোগিতাও শুরু হওয়ার সময় হয়েছে।

কিছুটা উদ্বিগ্ন হয়েই তাড়াহুড়া করে চলে গেলেন তিনি।

রক অ্যাস্টারয়েড? ঠিক বুঝতে পারছে না রবিন।

চল্লিশ দশকের শেষ দিকে একটা বেশ চালু সায়েন্স ফিকশন সিরিজ ছিল, বোধহয় সেটার কথাই বলছে, কিশোর বলল। হাতের বাক্সটা আবার টেবিলে নামিয়ে রেখে প্রায় দৌড় দিল লুই মরগানের পেছনে। রবিন আর মুসাও পিছু নিল।

মরগানকে ধরল কিশোর, স্যার, এক সেকেন্ড। একটা সাহায্য করবেন দয়া করে? ওই লোক দুটো কে, বলতে পারেন, একটু আগে যারা মিস্টার ডিকসনের স্টল থেকে গেল?

পাতলা, লম্বা লোকটার নাম আইজাক হুফার। ছবি আকিয়ে এবং লেখক। মোটা লোকটার নাম এডগার ডুফার। হুফারের হাতের লেখা ভাল না, তাই তার কামিকের কথাগুলো লিখে দিতে হয় ডুফারকে। চমৎকার মিলেছে দুজন হুফার এবং ডুফার। হাসলেন মরগান। ডুফারটা পাজি। নিজের সম্পর্কে অনেক উঁচু ধারণা। সবাইকে বলে বেড়ায়, তার অনেক বড় কিছু হওয়া উচিত ছিল, কিন্তু কমিক প্রকাশকদের জন্যে সেটা হতে পারেনি। খালি গোলমাল করার তালে থাকে এই লোক।

হুফারের সঙ্গে ভাবসাব তো বেশ ভালই দেখলাম, কিশোর বলল।

তা তো থাকবেই। বললাম না দুজনে একসাথে কাজ করে। মাসখানেক আগে হুফার থাকত ওহায়ওতে। আমার বিশ্বাস, লস অ্যাঞ্জেলেসে এসেছে এখানে তার কমিক কেমন চলে দেখতে। ভাল চললে থেকে যাবে। কিন্তু আসার পর থেকে কোন কমিক আঁকতে দেখিনি।

এক মুহূর্ত চুপ থেকে জোরে একটা নিঃশ্বাস ফেললেন তিনি। তারপর বললেন, আমি তাকে কনভেনশনে দাওয়াত করেছি। সম্মান দেখিয়ে একটা ঘরও দিয়েছি থাকার জন্যে। মনে হয় ভুলই করে ফেলেছি।

ঘড়ি দেখলেন মরগান। দেরি হয়ে যাচ্ছে। যেতে হবে।

তাড়াহুড়া করে তাকে চলে যেতে দেখল তিন গোয়েন্দা।

ভালই একটা কেস মিলল মনে হচ্ছে, মুসা বলল।

সন্দেহ করার মত একজনকে পেয়েও গেলাম, রবিন বলল।

কার কথা বলছ? জিজ্ঞেস করল কিশোর, ডুফার, না হুফার?

আইজাক হুফার। চুরিটাই সন্দেহজনক। হয়তো সে-ই করিয়েছে, ওই কমিকগুলো তার পছন্দ নয় বলে। ছেলেটার হাত থেকে নিয়ে কিভাবে নষ্ট করে ফেলল দেখলে না। ফ্যান ফানের ছবিগুলোও নিশ্চয় তার পছন্দ ছিল না।

কিন্তু কমিকগুলো চুরি হওয়ার পর পরই এসে উদয় হয়েছিল সে, মনে করিয়ে দিল মুসা। ধোঁয়াও সরে সারেনি তখনও।

হুঁ, মাথা দোলাল কিশোর। লোকটা কোথায় উঠেছে, জানি আমরা। তার ঘরে গিয়ে দেখলেই তো পারি কমিকগুলো আছে কি-না?

রাজি হয়ে গেল অন্য দুজন।

রিসিপশন ডেস্ক থেকে হুফারের রুম নম্বর নিল কিশোর। তিন মিনিট পরেই ৩১৮ নাম্বার ঘরের দরজার সামনে এসে দাঁড়াল তিন গোয়েন্দা।

একবার দেখেই মাথা নাড়ল কিশোর, এই তালা খুলে ঢোকা সহজ হবে না। বিশেষ যন্ত্রপাতি দরকার।

ভুরু কুঁচকে তালাটার দিকে তাকিয়ে রইল সে। পাশের ৩২০ নম্বর ঘরের খোলা দরজার ওপর চোখ পড়তেই উজ্জ্বল হলো চেহারা। ছোট একটা ঠেলাগাড়ি রাখা দরজার পাশে। তার মানে ঘর যে পরিষ্কার করে সে ওটা নিয়ে এসেছে।

দরজায় জোরে জোরে দুবার থাবা দিল কিশোর। ডাক দিয়ে জিজ্ঞেস করল, ভেতরে কেউ আছেন? এপাশ ওপাশ একবার তাকিয়েই ঢুকে পড়ল শূন্য ঘরের ভেতরে। পেছনে ঢুকল দুই সহকারী গোয়েন্দা।

এবার? জানতে চাইল মুসা, ওঘরে যাব কি করে? দেয়াল ফুটো করে?

তার দরকার হবে না, বলতে বলতে স্লাইডিং-গ্লাস ডোরের কাছে এসে দাঁড়াল কিশোর। বেরিয়ে এল ব্যালকনিতে। এখান থেকে হোটেলের ভেতর দিকে চত্বর আর সুইমিং পুল চোখে পড়ে। বাঁয়ে তাকাল সে। ৩১৮ নম্বর ঘরের ব্যালকনির দরজা রয়েছে চার ফুট দূরে। ছোট্ট একটা লাফ দিলেই পৌঁছে যাওয়া যায়, আনমনে বলল। তবে সেই লাফটা দেয়ার মত লোক প্রয়োজন, খেলাধুলায় যে পারদর্শী। বিশেষ করে ফুটবল প্লেয়ার।

না না, তাড়াতাড়ি হাত নাড়ল মুসা। আমি পারব না!

তাকে রাজি করাতে কয়েক সেকেন্ডের বেশি লাগল না কিশোরের। ২২০ নম্বর ঘরের ব্যালকনির রেলিডে চড়ে বসল মুসা। বিড়বিড় করে বলছে, জ্বালিয়ে মারল! কিছু বলতেও পারি না! গাধার মত রাজি হয়ে যাই! কিশোরের দিকে তাকাল না। জানে, কি দেখতে পাবে। দেখবে, মুচকি হাসছে গোয়েন্দাপ্রধান। চোখে চোখ পড়লে হা হা করে হেসে ফেলবে। ওকে সেই সুযোগটা দিতে চাইল না।

কিন্তু রবিনকে ঠেকানো গেল না। হেসে বলল, দেরি করছ কেন? লাফ দাও। মাত্র তো চার ফুট।

তা তো বটেই, গজগজ করল মুসা। মাত্র চার ফুটই যদি কোনভাবে মিস করি, পড়ব গিয়ে তিরিশ ফুট নিচে।

শক্ত করে রেলিঙ চেপে ধরে আছে সে। বুড়ো আঙুলের ওপর ভর রেখে আচমকা হাত ছেড়ে দিল। চোখ সামনের ব্যালকনির দিকে। নিচে তাকাচ্ছে না। লাফ দিল অনেকটা ব্যাঙের মত করে।

অন্য ব্যালকনিটা যেন উড়ে চলে এল তার কাছে। ডান পা-টা রেলিঙে জায়গামতই বসল, কিন্তু পিছলে গেল বা পা। দম বন্ধ করা ভয়াবহ একটা মুহূর্ত, উল্টে পড়ছে সে। দুহাতে থাবা দিয়ে ধরে ফেলেছে রেলিং। চেপে ধরার ফলে সাদা হয়ে গেছে হাতের পেছনটা। ধীরে ধীরে টেনে তুলতে লাগল শরীরটাকে।

অনেক কষ্টে পতন রোধ করে আবার শক্ত হয়ে বসল রেলিঙে। লাফিয়ে নামল ব্যালকনিতে। ফিরে তাকাল বন্ধুদের দিকে।

অধৈর্য ভঙ্গিতে হাত তুলে কাচ লাগানো দরজাটা দেখাল কিশোর। ঢোকার ইঙ্গিত করল।

বাহ্, চমৎকার, তিক্ত কণ্ঠে বলল মুসা, আমার জন্যে খুব তো চিন্তা করো দেখছি!

দরজার কাছে গিয়ে কাচের ভেতর দিয়ে উঁকি দিল সে। কাউকে দেখতে পেল। দরজা খোলার জন্যে নব ধরে টানতেই নিঃশব্দে খুলে গেল পাল্লা।

ভেতরে ঢুকল মুসা। ভাল মত দেখে নিল হুফার আছে কি-না ঘরে। নেই। অসংখ্য বোর্ডে আঁকা রয়েছে নানা রকম ড্রইং, সম্মেলনে বিক্রির জন্যেই নিশ্চয় একে রেখেছে হুফার। কিছু পত্রপত্রিকাও চোখে পড়ল। বেশির ভাগই কমিক ম্যাগাজিন। ওগুলোতে ফ্যান ফানের কপিটা দেখতে পেল না সে।

আলমারির দরজা খুলে দেখল ভেতরে আলখেল্লাটা আছে কি-না। তা-ও নেই। তারপর ড্রেসারে খুঁজতে এল মুসা। প্রথম ড্রয়ারটা সবে টান দিয়ে খুলেছে, এই সময় নড়াচড়া লক্ষ্য করল পেছনে।

ঝট করে সোজা হয়ে চরকির মত পাক খেয়ে ঘুরল সে। জমে গেল যেন বরফ হয়ে। বাথরুম থেকে লাফিয়ে বেরিয়ে এসেছে একটা কুৎসিত মূর্তি। শরীরটা মানুষের মত, বিশাল চওড়া বুকের হাতি, পরনে কালো জিনসের প্যান্ট। মুখটা ভয়ঙ্কর। সবুজ রঙের একটা গিরগিটির মুখকে যেন বিকৃত করে দেয়া-হয়েছে। কমিকের ফ্রগ মিউট্যান্ট।

জীবটা যে মানুষ, সেটা বুঝতে সময় বেশি লাগল না মুসার। তবে যতটুকুই লাগল, তাতেই দেরি হয়ে গেল। মানুষটা লাফ দিয়ে সরে এল তার কাছে, ধা করে চোয়ালে ঘুসি মেরে বসল।

টলে উঠল মুসা। ঝটকা দিয়ে পেছনে সরে গেল মাথাটা, বাড়ি লাগল ব্যালকনিতে বেরোনর দরজার ফ্রেমে।

প্রচন্ড ব্যথায় যেন অন্ধ হয়ে গেল মুসা। ওই অবস্থায়ই কারাতের কোপ বসানর চেষ্টা করল লোকটার ঘাড়ে। লাগাতে পারল না। মারটা সহজেই ঠেকিয়ে ফেলল ফ্রগ মিউট্যান্ট, আবার ঘুসি মারল। পেছনে যেন উড়ে গেল মুসার শরীরটা, বেরিয়ে গেল দরজার বাইরে।

ব্যালকনির রেলিঙে ধাক্কা খেল সে, তারপর উল্টে পড়তে শুরু করল। পাগলের মত হাত বাড়িয়ে রেলিং ধরার চেষ্টা করল, কিছুই ঠেকল না হাতে। চারিদিকে সব ফাঁকা, শুধুই শূন্যতা।

<

Super User