টমই, মুসা বলল, কোন সন্দেহ নেই। এই যে লেজের সাদা ফুটকি, কয়েক বছর পর দেখলেও ঠিক চিনতে পারতাম। আমাদেরকেও চিনতে পেরেছে। পারিনি, টম?

হেডকোয়ার্টারে আলোচনায় বসেছে তিন গোয়েন্দা। আবার আগের জাগায়, বড়চায় ফিরে গেছে মৈ। দানা ঠুকরে খাচ্ছে, মাঝে মাঝে চোখ ফিরিয়ে তাকাচ্ছে এদিকে।

রিচার্ড হ্যারিস ছিনিয়ে নিল ওকে আমার কাছ থেকে নিচের ঠোঁটে জোরে জোরে চিমটি কাটছে কিশোর, কাউকে উদ্দেশ্য করে বলল না কথাগুলো। কয়েক ঘন্টা পর ছেড়ে দিল কবুতরটাকে ফিরে এল ওটা আবার আমাদের কাছে। কেন?

আমাদের কাছে ফিরে আসবে হয়তো ভাবেনি হ্যারিস, বলল রবিন।

মানে? ভুরু কোঁচকাল মুসা।

বইতে পড়লাম, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় মেসেজ বহন করত রেসিং হোমার। মিলিটারি যখন অ্যাডভান্স করত, কবুতরগুলোকে খাঁচাশুদ্ধ করে নিত, নতুন জায়গায় আটকে রাখত কয়েকদিন, তারপর ছাড়ত। সঙ্গে সঙ্গে ছাড়লে আগের জায়গায় ফিরে যেত পাখিগুলো। এই কবুতরের স্বভাব হলো, পুরানো আশ্রয়ের কথা তাড়: তড়ি ভুলে যায়, দুতিন দিন অন্য কোথাও থাকলে সেটার কথাই মনে রাখে। সেখান থেকে সরিয়ে আরেক জায়গায় নিয়ে দু-তিন দিন রাখলে, এর আগেরটার কথা আবার ভুলে যায়। হয় তোলে, কিংবা যেতে চায় না, যেটাই হোক…

হুঁ, এজন্যেই তাহলে ফিরে এসেছে টম, মাথা দোলাল কিশোর। বলে ভালই করেছ, রবিন। পাখিটার মালিক বোধহয় রিচার্ড হ্যারিস নয়। আমাদের কাছ থেকে নিয়ে গিয়ে ছেড়ে দিয়েছে। তার ধারণা ছিল, বাড়ি ফিরে যাবে টম। তা না গিয়ে চলে এসেছে এখানে, স্বভাবের কারণে।

এটাই এখন তোর বাড়ি, না টম? খাঁচার ফাক দিয়ে আঙুল ঢুকিয়ে-পায়রাটার, মাথায় ছোঁয়াল মুসা, আদর করল। তাই ফিরে এসেছিস। খুব খুশি হয়েছি।

কথায় বাধা পড়ল। লাউডস্পীকারে বেজে উঠল মেরিচাচীর কণ্ঠ। কিশোর। কিশোর।

কিশোরের এটা আরেকটা নতুন সংযোজন। ওরা হেডকোয়ার্টারে থাকলে দরকার পড়লে ডাকেন চাচী। অনেক কারণে সব সময় সে ডাক স্কাইলাইটের ভেতর দিয়ে শোনা যায় না। তাই ওয়ার্কশপে একটা মাইক্রোফোন লাগিয়ে দিয়েছে সে হেডকোয়ার্টারে স্পীকারের সঙ্গে যোগ করে দিয়েছে।

এই কিশোর, শুনছিস? আবার ডাক শোনা গেল। ডাকের ধরন বিশেষ সুবিধের মনে হলো না মুসার কাছে। বলেই ফেলল, আল্লাহরে। কি জানি নিয়ে এসেছে রাদেশ-চাচা! এবার হয়তো বেঁকাবঁকা ইলেকট্রিকের খাম্বা, দেড় টন করে ওজন একেকটার… বলতে বলতে দুই সুড়ঙ্গের ঢাকনার দিকে এগোল সে।

ওদিকে না, বাধা দিল কিশোর। স্কাইলাইট দিয়ে বেরিয়ে ওয়ার্কশপের পেছনে গিয়ে নামব, মিটিমিটি হাসছে সে।

জঞ্জালের ওপর দিয়ে নেমে এল ওরা। মেরিচাচী ওদের দিকে পেছন করে দাঁড়িয়ে আছেন ওয়ার্কশপে।

আস্তে গিয়ে চাচীর কাঁধে হাত রাখল কিশোর।

চমকে উঠলেন চাচী। ফিরে তাকালেন। এই দেখে শয়তান ছেলের কাণ্ড। এই বেরোলি কোখকেতোরা? ওদিকে তো সব জায়গা খুঁজে এলাম…।

জঞ্জালেতে বাসা আমার, আকাশ দিয়ে পথ,হেঁড়ে গলায় গান ধরল কিশোর, বলো শুনি,লক্ষ্মী চাম, তোমার কি বিপদ।

অবাক হয়ে কিশোরের দিকে চেয়ে রইলেন চাচী। চোখে শঙ্কা, ছেলেটার মাথা-টাতা খারাপ হয়ে যায়নি তো!

ভয় নেই, চাল, হেসে আশ্বস্ত করল রবিন। ওটা দা হাইমন অভ দ্য ব্যাটলের সুর। মিস কারমাইকেলের কাছ থেকে শিখে এসেছে।

কিন্তু শঙ্কা গেল না মেরিচাচীর। তাঁর মনে হতে লাগল, কোথাও কিছু একটা গোলমাল হয়েছে। সকালে বেশি খেয়ে ফেলায় কিশোরের পেটে পাঁচক রসের ক্ষণে বিঘ্ন ঘটেছে হয়তো, সেটা প্রতিক্রিয়া করেছে মাথায়। বললেন, কিসের সুর বললি?

ব্যাটল অভ দা হাইমস, আবার কাল রবিন।

এই কিশোর, খবরদার, আর কক্ষনো গাইবি না। যার গলায় যেটা মানায় না…।

বেশ গাইব না,শান্ত কণ্ঠে বলল কিশোর। তবে কথা দিতে হবে, আর কক্ষনো তুমিও খাওয়ার জন্যে চাপাচাপি করবে না।

ওহহো, ভুলেই গিয়েছি, এড়িয়ে যাওয়ার জন্যে তাড়াতাড়ি বললেন মেরিচাচী, দুজন লোক দেখা করতে এসেছে তোর সঙ্গে। গেটের কাছে দাঁড়িয়ে আছে, বলেই আর এক মুহূর্ত দাঁড়ালেন না। থাকলেই আবার কোন ফাঁদে ফেলে দেয় কিশোর। দ্রুত আগলেন।

সেদিকে চেয়ে মুচকি হাসল কিশোর। চলো, হাত নাড়ল দুই সহকারীর দিকে চেয়ে।

গেটের বাইরে রাস্তায় পার্ক করা একটা ভ্যানের কাছে দাঁড়িয়ে আছে লোকগুলো। দুজনেরই বয়েস তিরিশের কাছাকাছি, গায়ে চী-শার্ট, পরনে নী জিনসের প্যান্ট। দুজনেই জাপানী।

তোমরা তিন গোয়েন্দা? এগিয়ে এসে জিজ্ঞেস করল একজন। কিশোর, মুসা আর রবিন?

হ্যাঁ, মাথা আঁকাল কিশোর।

মিস্টার মিটসুশিতাকে চেনো?

চিনি, জবাব দিল রবিন। ওই ভদ্রলোকের কাছেই মেসেজ অনুবাদ করাতে নিয়ে গিয়েছিল।

ফিরে সঙ্গীকে কি বলল লোকটা। জাপানী ভাষা, অনুমান করুল কিশোর। একই ভাষায় জবাব দিল সঙ্গী।

ও আমার বন্ধু, দ্বিতীয় লোকটাকে দেখিয়ে বলল প্রথমজন, নাম হ্যারিকিরি। ওর কয়েকটা প্রশ্ন আছে, জবাব দিলে খুব খুশি হবে। ইংরেজী জানে না। ওর হয়ে আমিই প্রশ্ন করছি, কেমন?

সম্মতি জানাল কিশোর।

শুড, বলে লোকটা। জাপানীতে লেখা একটা মেসেজ নিয়ে গিয়েছিলে মিস্টার মিটসশিয়ার কাছে। উনি হ্যারিকিরিকে বলেছেন সেকথা। তার হাতের লেখা চিনতে পেরেছেন।

প্রশ্ন নয়, কাজেই চুপ করে রইল কিশোর।

মেসেজটা কোথায় পেয়েছ? এবার প্রশ্ন।

ভাবছে কিশোর, জবাব না দিলেও পারে সে, তবে দিলে হয়তো তার কয়েকটা প্রশ্নের জবাবও মিলতে পারে। বলল, একটা মরা কবুতরের পায়ে আটকানো ছিল।

হাসল লোকটা। হ্যারিকিরির কাছে গিয়ে তার হাত ধরে টেনে নিয়ে গেল ভ্যান থেকে খানিক দূরে।

চেয়ে আছে রবিন, জাপানী ভাষায় কথা বলছে লোকগুলো। তার মনে হলো, দুজনেরই এক চেহারা, একই রকম কালো চুল, ঠেলে বেরোনো চোয়াল, হালকা বাদামী চামড়া। রাস্তায় হঠাৎ আরেকদিন দেখলে বলতে পারবে না, কে হ্যারিকিরি আর কে অন্য লোকটা!

হয় এ-রকম। এক দেশের লোক অন্য দেশের লোকের চেহারায় বিশেষ তফাৎ দেখতে পায় না—সব ক্ষেত্রে হয় না এটা। তবে সব চেয়ে বেশি হয় আফ্রিকান ও ককেশিয়ানদের, রবিনের তাই ধারণা।

কিশোরও স্থির দৃষ্টিতে চেয়ে আছে জনের দিকে। ফিসফিস করে বলল, সেই সবুজ ভ্যানটা, স্ন্যাকস রেস্টুরেন্টে যেটা দেখেছিলাম। এটাকে অনুসরণ করতে পারলে… জাপানী দুজন এখনও আলাপরত, সেদিকে চেয়ে থেকেই বলল সে, রবিন বীপারটা আনতে পারবে? ওরা যাতে সন্দেহ করতে না পারে।

দেখি চেষ্টা করে, ফিসফিসিয়ে জবাব দিল রবিন। কিশোরের কাছ থেকে সরে দাঁড়াল। পেছনে চেয়ে কান পেতে কি যেন শোনার ভঙ্গি করল, তারপর নোক দুজনকে শুনিয়ে জোরে জোরে বলল, কিশোর, মনে হচ্ছে ডাকছেন। যাই, শুনে আসি।

অপেক্ষা করল না রবিন, ঘুরে রওনা হয়ে গেল।

আবার ফিরে এল দুই জাপানী। হ্যারিকিরির সঙ্গী কিশোরকে বলল, আরেকটা প্রশ্ন, কোথায় পেয়েছ কবুতরটা?

এটাও ভেবে দেখল কিশোর। মিথ্যা বলতে বাধে তার, কিন্তু গোয়েন্দাগিরি এমনই একটা কাজ, সময়ে না বলেও পারা যায় না। এক্ষেত্রে মিছে কথা বলার দরকার আছে কিনা, ভাবল। সেটা কি অন্যায় হবে? বোধহয় না। কারণ, তার মক্কেলের সপক্ষে বলতেই হবে তাকে, আর মিস কারমাইকেল তার মক্কেল।

পথের ওপর পেয়েছি, মিছে বলল না কিশোর, কিন্তু খোলাসাও করল না।

কোন পথে?

শহরের পুব ধারের একটা পথ।

আবার হাসল লোকটা। তৃতীয় প্রশ্ন, কি করে মারা গেছে কবুতরটা, জানো?

না, সত্যই জানে না কিশোর। তবে জানতে পারলে ভাল হত।

দেখে কি মনে হয়েছে? গুলি-টুলি করে মেরেছে?

না, মাথা নাড়ল কিশোর। পেছনে পায়ের আওয়াজ শুনে বুঝল, রবিন আসছে। আর যেভাবেই মারা হোক, গুলি নয়, এটা ঠিক।

গুড। থ্যাংক ইউ, বলে হ্যারিকিরিকে নিয়ে গাড়ির দিকে রওনা হলো লোকটা।

পৌঁছে গেল রবিন।

দুই লাফে এগিয়ে গিয়ে প্রথম লোকটার বাহুতে হাত রাখল কিশোর। আমি তো আপনার কথার জবাব দিলাম, এবার আমার কয়েকটা প্রশ্নের জবাব দেবেন, প্লীজ?

এইবার লোকটার ভাবনার পালা। ডেকে নিয়ে বলল, কি প্রশ্ন?

মেসেজে লেখা ছিল : আজ মুক্তো নেই। মিস্টার টিসুশিতা অনুবাদ করে তো তাই বললেন।

হ্যাঁ।

আড়চোখে রবিনের হাতের দিকে তাকাল কিশোর, ছোট্ট যন্ত্রটা আছে। লোকটার দিকে ফিরে বলল, এর মানে কি? বোকার অভিনয় খুব ভাল করতে পারে কিশোর, এ-মুহূর্তে তাকে দেখলে মনে হবে তার মত হাঁদারাম, মাথামোটা ছেলে দুনিয়ায় আর দ্বিতীয়টি নেই। কথাটার মাথামুণ্ডু কিছুই বুঝলাম না। কিসের মুক্তো, কিসের আজ? বোকার মতই হাত নাড়ল সে।

হ্যারিকিরির দিকে তাকাল লোকটা, এই সুযোগে পাশে দাঁড়ানো রবিনের গায়ে খোচা দিয়ে ইঙ্গিত করল কিশোর।

ফিরল লোকটা, হাসল। খুব সহজ। আমার বন্ধু হ্যারিকিরি তরকারির চাষ করে। খেত আছে। জাপানী পাড়ায় বাজারে বিক্রি করে সেই তরকারি। খেতগুলো বাজার থেকে দূরে, উপকূলের কাছে। দোকানদাররা জানতে চায়, কি তরকারি আছে তার কাছে…

হাঁ করে আছে কিশোর, বোকা বোকা দৃষ্টিতে সামান্যতম পরিবর্তন নেই। চোখের কোণ দিয়ে দেখছে, ভ্যানের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে রবিন।

পৌঁছল রবিন। পেছনের বাম্পারের কাছে দাঁড়িয়ে চট করে একবার নিচু হয়েই সোজা হলো।

…কাজেই খবর জানাতে হয় হ্যারিকিরিকে, বলে যাচ্ছে লোকটা। কবুতর দিয়ে মেসেজ পাঠাতে পয়সা লাগে না, তাছাড়া তাড়াতাড়িও হয়, তাই পুরানো পদ্ধতিই বেছে নিয়েছে আমার বন্ধু। লিখে দেয়? আজ শালগম আসছে, আজ বাঁধাকপি কিংবা গাজর।

হাত নাড়ল রবিন। দু-হাতের মুঠোই খোলা, তারমানে কাজ হয়ে গেছে।

তাই নাকি? খুব অবাক হয়েছে কিশোর। আপনার বন্ধু কি মুক্তোও কলায় নাকি? ওগুলো সজি না ফল?

জোরে হেসে উঠল লোকটা। মনে মনে আস্ত গর্দভ ভারছে কিশোরকে, বুঝল কিশোর। মুক্তো সব্জিও না, ফলও না। সাগরে হয়, বিনিকের পেটে, একধরনের মুল্যবান পাথর। আমার বন্ধু যে মুক্তোর কথা লিখেছে, সেটা পেঁয়াজ। মুক্তোপেঁয়াজ বলে।

অ। থ্যাংক ইউ, বলল কিশোর। আপনার কাছে অনেক কিছু জানা গেল।

কিশোরকে আরেকবার ধন্যবাদ জানিয়ে গাড়িতে গিয়ে উঠল লোকটা। তার পাশে কল হ্যারিকিরি। স্টার্ট নিল এঞ্জিন।

গাড়িটা মোড়ের কাছে পৌঁছতেই লাফিয়ে উঠল কিশোর। রবিন, জলদি, ট্র্যাকারটা।

বুদ্ধি করে নিয়েই এসেছে রবিন, গেটের ভেতরে এক জায়গায় রেখে এসেছে। এক ছুটে গিয়ে নিয়ে এল। ছোট একটা বাক্স মত, তাতে অ্যান্টেনা লাগানো। পুরানো আমলের একটা রেডিওকে পরিবর্তন করে বীপারের সিগন্যাল ধরার যন্ত্র বানিয়েছে কিশোর। সুইচ টিপে ডায়াল ঘেরাল সে।

বীপ। বীপ। বীপ।

সম্পষ্ট শব্দ ভেসে এল যন্ত্রটার স্পীকারে। কাজ করছে ভ্যানের বাম্পারে লাগানো বীপার, চুম্বকের সাহায্যে ওটাকে আটকে দিয়েছে রবিন।

অ্যান্টেনাটা দক্ষিণে ঘোরাল কিশোর।

আরও স্পষ্ট হলো বীপ-বীপ।

উপকূলের দিকে যাচ্ছে, বলল কিশোর। চলো, আমরাও যাই।

বলতে হয়নি, ইতিমধ্যেই এক এক করে তিনটে সাইকেল গেটের বাইরে নিয়ে এসেছে মুসা।

দ্রুত প্যাডাল ঘুরিয়ে চলেছে ওরা। নিজের সাইকেলের হ্যাণ্ডেলে ট্র্যাকারটা বেঁধে নিয়েছে কিশোর। এক হাতে হ্যাণ্ডেল ধরেছে, আরেক হাতে অ্যান্টেনার মাথা ঘোরাচ্ছে এদিক ওদিক। শব্দের কম-বেশি শুনে অনুমান করছে, কোনদিকে গেছে। ভ্যান।

গাড়ির খুব বেশি কাছে যাওয়ার দরকার নেই, এক মাইল দূর থেকেও সঙ্কেত দেবে বীপারটা। সহজেই অনুসরণ করতে পারছে কিশোর। গাড়ি এখন স্যান ফ্রানসিসকোর দিকে না গেলেই বাচি-মনে মনে বলল সে।

<

Super User