০৭.

কেমন লোক তুমি? অভিযোগের সুরে বলল মুসা। ছুটে পালালে কেন অমন করে?

কালো লম্বা চুল, চকচকে কালো চোখ, ঠোঁট সামান্য কুঁচকানো, সব মিলিয়ে ইনডিয়ান ছেলেটার চেহারা দেখলে ভয় লাগে। মুসাকে চিনতে পেরে চোখ বড় বড় হয়ে গেল তার। নরম হয়ে এল মুখের ভাব। ঝকঝকে দাঁত বের করে হাসল।

এখানে এলে কি করে? ছেলেটা জিজ্ঞেস করল। আমার পিছু নিয়ে?…না না, তা হতে পারে না।…যা-ই হোক পেয়ে তো গেছ। অবশ্য আবার ফিরে যেতাম তোমাদের কাছে, যত তাড়াতাড়ি সম্ভব। তোমাদেরকে ওভাবে ফেলে রেখে আসতে হলো। সরি।

এবার অবাক হওয়ার পালা মুসার। আসতে হলো মানে?

বলছি। গায়ের ফতুয়া টেনে সোজা করল সে। পুরানো হয়ে রঙ চটে গেছে জিনসের। কোমরের বেল্টের বাকলসটা খুব সুন্দর, সচরাচর দেখা যায় না ওরকম। রূপা দিয়ে তৈরি, ডিম্বাকৃতি, মাঝখানে বসানো একটা নীলকান্তমণি। বাকলসটায় হাত বোলাতে বোলাতে বলল, আমি গিয়েছিলাম ভিশন কোয়েস্টে…

এই সময় সেখানে এসে হাজির হলো রবিন আর কিশোর।

আমার নাম নরম্যান জনজুনস, ভদ্র গলায় নিজের নাম জানাল ইনডিয়ান ছেলেটা। আমি…

তোমাদের এখানে টেলিফোন আছে? বাধা দিয়ে বলল রবিন, ফরেস্ট সার্ভিসকে খবর দিতে হবে। পাহাড়ের ভেতরে ভেঙে পড়েছে আমাদের প্লেন। আমার বাবা হারিয়ে গেছে। অনেক খুঁজেছি, পাইনি।

মাথা নেড়ে জন বলল, সরি, টেলিফোন নেই। এমনকি রেডিওও নেই। কোন জিনিসের প্রয়োজন হলে গাড়ি নিয়ে চলে যাই আমরা।

সবচে কাছের রেঞ্জার স্টেশনটায় নিয়ে যেতে পারবে?

এখন কারও বেরোনো চলবে না, পেছন থেকে বলে উঠল ভারি, খসখসে একটা কণ্ঠ। জন, ছেলেগুলো কে?

ফিরে তাকাল তিন গোয়েন্দা। মাঝারি উচ্চতার একজন মানুষ। বিশাল চওড়া কাঁধ, পেশীবহুল শরীর। চোখের মণি ঘিরে রক্ত জমে লাল একটা রিং তৈরি করেছে। মনে হয় মণিতে পানি টসটস করছে, নাড়া লাগলেই গড়িয়ে পড়বে।

চাচা, এদের কথাই তোমাকে বলেছিলাম, জন বলল।

ওদের সঙ্গে কথা বলেছ?

জঙ্গলে বলিনি।

ভাল। জনের দিকে তাকিয়ে হাসলেন তার চাচা। তিন গোয়েন্দার দিকে ফিরতেই আবার গম্ভীর হয়ে গেল মুখ, হাসিটা মিলিয়ে গেছে।

নিজেদের পরিচয় দিল কিশোর, রবিন আর মুসা।

গাঁয়ের মোড়ল আর সর্দার শিকারি তার চাচা ডুম সবলের পরিচয় দিল জন।

আমার বাবা হারিয়ে গেছে। কি হয়েছে অল্প কথায় জানাল রবিন। তাড়াতাড়ি খুঁজতে বেরোনর জন্যে অস্থির হয়ে উঠেছে সে।

চাচা, ডুমকে জিজ্ঞেস করল জন, ওদের কি সাহায্য করতে পারি আমরা?

উদ্বিগ্ন হয়ে মোড়লের দিকে তাকিয়ে রয়েছে রবিন।

সমস্যাই! বললেন মোড়ল। বুঝতে পারছি না কি করা উচিত। কথা বলতে হবে।

যেমন নিঃশব্দে আচমকা এসেছিলেন ডুম, তেমনি করেই চলে গেলেন। আবার। হতাশায় কালো হয়ে গেল রবিনের মুখ।

জোর করে কিছুই করার উপায় নেই আমাদের। সান্ত্বনা দিয়ে জন বলল, গাঁয়ে পঞ্চায়েত আছে। শামান আছে। চুপ করে থাকো। আশা করি ভাল খবরই আসবে।

মাথা ঝাঁকাল রবিন। খুব একটা সান্ত্বনা পেয়েছে বলে মনে হলো না।

হ্যাঁ, তখন মুসার সঙ্গে কি যেন বলছিলে? আগের কথার খেই ধরল। কিশোর। ভিশন কোয়েস্টে গিয়েছিলে… জনের দিকে তাকাল সে। কি দেখতে? মোচড় দিয়ে উঠল ওর পেট। রান্না হচ্ছে কোথাও, সুগন্ধ এসে নাকে লেগেছে।

বলব, সবই বলব, জন বলল। আগে কিছু খেয়ে নাও।

নিশ্চয়ই! অধৈর্য কণ্ঠে বলে উঠল কিশোর, মুসার আগেই।

আসছি, বলে চলে গেল জন। খোলা জায়গাটার দিকে, যেখানে ঢাক বাজছে।

বাপরে বাপ! ভুরু কুঁচকে ইনডিয়ান ছেলেটার দিকে তাকিয়ে রয়েছে মুসা, চলে কি! হাঁটে না তো, মনে হয় পিছলে চলে যায়!

রবিন ওসব কিছু দেখছে না। তার একটাই ভাবনা। সাহায্য করবে তো ওরা?

তা করবে, যতটা জোর দিয়ে বলল কিশোর, ততটা আশা অবশ্য করতে পারল না। এদিক ওদিক তাকিয়ে বোঝার চেষ্টা করল, ঢাক বাজছে কেন।

তাড়াতাড়িই ফিরে এল জন। এসো। খাবার দেয়া হয়েছে। প্রথমে নাচব। আমরা, তারপর খাওয়া। সব শেষে অনুষ্ঠান। তোমরা আমাদের অতিথি, কাজেই তোমাদের আগেই খেয়ে ফেলতে হবে।

তোমরা পরে খাবে? রবিন বলল, সেটা উচিত না।

আমরাও অপেক্ষা করি, মুসা বলল। তোমাদের ফেলে রেখে একলা খাব, তা হয় না।

ঢোক গিলল কিশোর। এত খিদে পেয়েছে তার, অপেক্ষা করাটা কঠিন। তবু মুসার টিটকারি শুনতে চায় না বলে কোনমতে বলল, ঠিক। পরেই খাব।

জন হাসল। অত ভদ্রতার দরকার নেই। খাবার তৈরি। তোমাদেরও খুব। খিদে পেয়েছে, আমি জানি। আগে খেয়ে নিলেই বরং সম্মান দেখানো হবে। এটাই নিয়ম।

পরস্পরের দিকে তাকাতে লাগল তিন গোয়েন্দা।

ওদের অপমান করা উচিত হবে না আমাদের, কিশোর বলল, কি বলো?

তাই তো মনে হচ্ছে, একমত হলো মুসা।

থ্যাংকস, জন, ভদ্রতা দেখাল রবিন। সে ভাবছে বাবার কথা। কোথায় কি ভাবে পড়ে আছেন কে জানে! খাওয়া নিশ্চয় হয়নি। ইস্, তাঁকেও যদি কেউ এখন। খাবার দিত!

জনের পেছন পেছন এগোল তিন গোয়েন্দা। কৌতূহলী চোখে ওদের দিকে তাকাচ্ছে গাঁয়ের লোক, বিশেষ করে বাচ্চারা। খোলা জায়গায় জমায়েত হয়েছে নারী-পুরুষ-শিশু। পুরুষদের খালি গা, মাথায় পাখির পালকের মুকুট, গলায় পাখির পালক আর পাথরে তৈরি মালা। মেয়েদের গলায় পুঁতির মালা। পুঁতি আর ছোট পাথর খচিত জামা পরেছে। ঢাকের সঙ্গে তাল রেখে দুটো করে কাঠি বাজাচ্ছে কয়েকজন লোক।

ওগুলোকে বলে ক্ল্যাপ স্টিক, জন বলল। বাজনার এখনও কিছুই না। জোর অনেক বাড়বে। এদিকে এসো। বাসন নিয়ে যার যার খাবার নিজেরাই তুলে নাও। খেতে খেতে দেখ। যেটা না বুঝবে, আমি বলে দেব।

বড় বড় কাঠের পাত্রে খাবার রাখা। বাঁশের তৈরি ঢাকনা দিয়ে ঢাকা। সরিয়ে নিল মেয়েরা। কয়েক পদের ভাজা মাংস, আলু, সীম আর রুটি। খাবার দেখে এতটাই খুশি হল কিশোর, ভাবনাচিন্তা আর করল না, তুলে নিতে লাগল প্লেটে।

 মুসা অতটা অস্থির হয়নি, খাবার দেখলে যে সব চেয়ে বেশি হয় সাধারণত। মাংসের একটা পাত্র দেখিয়ে জিজ্ঞেস করল, শুয়োর?

মাথা ঝাঁকাল জন। হ্যাঁ।

থমকে গেল কিশোর। একবার চিন্তাও করেনি, মাংসটা সুন্দর দেখে ওটার দিকেই হাত বাড়িয়েছিল নেয়ার জন্যে। আর কিছু নেই? হতাশ হয়েছে সে।

থাকবে না কেন? জন বলল, শুয়োর খাও না নাকি?

মাথা নাড়ল মুসা, কিশোর দুজনেই।

অসুবিধে নেই, জন আরেকটা পাত্র দেখিয়ে বলল, ওটা খরগোশ। আর ওটা কাঠবোলি। এগুলোও পছন্দ না হলে, একটা পাত্রের ঢাকনা তুলতে তুলতে বলল সে, মাছ নাও। অনেক আছে। টুয়ক থেকে ধরেছি। আমাদের ভাষায় টুয়ক বলে নদীকে।

হাসি ফুটল আবার মুসা আর কিশোরের মুখে। মাংস নিয়ে রবিনের কোন অসুবিধে নেই। সে শুয়োরও খায়।

বিশাল এক রেডউড গাছের নিচে নিচু বেঞ্চিতে বসেছে ওরা। টেবিল হল বড় বড় কাঠের বাক্স। গায়ে লেখা রয়েছেঃ ইঞ্জিন পার্টস, জোনস ট্রাকিং কোম্পানি। কাছেই দাঁড়িয়ে আছে একটা শেভ্রলে ট্রাক, বনেট তোলা। ইঞ্জিন খুলে ছড়িয়ে রাখা হয়েছে কয়েকটা বাক্সের ওপর। তার ওপাশে, বেশ কিছুটা দূরে টুয়ক, যেটাকে নদী না বলে বরং চওড়া বড় ধরনের নালা বললেই ঠিক হয়। গাঁয়ের পাশ দিয়ে বয়ে চলেছে কুলকুল করে। টলটলে পানি। গভীরও বেশ।

উত্তরের বিশাল উপত্যকা থেকেই কি এসেছে ওই নদী? জিজ্ঞেস করল রবিন।

চেনো নাকি তুমি উপত্যকাটা? জনের কণ্ঠে সন্দেহ।

 চিনি, মানে, সতর্ক হয়ে গেল রবিন। একটুকরো মাংস চিবিয়ে গিলল। দূর থেকে দেখেছি আরকি।

বাইরের কেউ যেতে পারে না ওখানে। ওটা পবিত্র জায়গা। আমরা ওর নাম দিয়েছি পূর্বপুরুষের উপত্যকা। জায়গাটা সংরক্ষিত করে রেখেছি আমরা। ইনডিয়ানদের গোরস্থান। মাঝে মাঝে ওখানে গিয়ে অনুষ্ঠানও করি।

আমি যাইনি, জনকে নিশ্চিন্ত করল রবিন। আরেক টুকরো মাংস মুখে পুরল। তোমরা নিশ্চয় অনেক কাল ধরে আছ এখানে?

কি করে জানলে?

পাহাড়ে সিঁড়ি, দেখেছি আমি। বেয়ে ওঠার জন্যে পাথর কেটে তৈরি করা হয়েছে। ওখান দিয়ে উঠতে গিয়ে আরেকটু হলেই ধসের কবলে পড়েছিলাম। ধস না নামলে অবশ্য সিঁড়িটা দেখতে পেতাম না। অনেক কাল আগে কাটা হয়েছে।

হ্যাঁ, অনেক অনেক আগে এখানে এসেছিল আমাদের পূর্বপুরুষেরা, স্রষ্টা ওদের সৃষ্টি করার পর পরই। অজ্ঞান লোকেরা পাহাড়ে চড়তে চেষ্টা করলে ঈশ্বরই ধস নামিয়ে ওদের সরিয়ে দেন, কিংবা মেরে ফেলেন। তিনিই উইলো গাছ তৈরি করেছেন, যাতে আমরা বুড়ি বানাতে পারি, সেই ঝুড়িতে করে লাশ নিয়ে যেতে পারি উপত্যকায়। সব কিছুই সৃষ্টি করেছেন ঈশ্বর। হাসল জন। ওহহো, ভুলে গিয়েছিলাম, তুমি তোমার বাবাকে খুঁজছ। ভেব না। গাঁয়ের বুড়ো জ্ঞানী লোকেরা সেটা বুঝবেন।

কিন্তু বাইরের মানুষের সমস্যা তারা বুঝতে চান না।

 চান না, তার কারণ টুরিস্টদের পছন্দ করেন না তো। বড় বিরক্ত করে।

একটা কথাও বলেনি এতক্ষণ কিশোর। চুপচাপ খেয়েছে। পেট কিছুটা শান্ত হলে বলল, কিছু একটা ঘটছে নিশ্চয় এখন তোমাদের গায়ে।

ঘটছে। অসুস্থ হয়ে পড়ছে লোকে, জন জানাল। চোখ লাল হয়ে যায়, কাশি হয়, বুক ব্যথা করে। কারও কারও পেটে যেন আগুন জ্বালানো শয়তান ঢুকেছে। ভীষণ জ্বালাপোড়া করে পেটে। তাই জ্ঞানীরা ভেবেচিন্তে ঠিক করেছে, ভয়াবহ ওই রোগ তাড়ানর জন্যে একটা উৎসব করা দরকার। গ্রাম থেকে বেরোনো নিষিদ্ধ। করে দেয়া হয়েছে। কাল দুপুরের আগে কেউ বেরোতে পারবে না।

ডাক্তারের কাছে যাও না কেন তোমরা? মুসার প্রশ্ন। রোগ হলে ডাক্তারই তো-..

মুসার পায়ে লাথি মারল কিশোর।

 আউ করে উঠে থেমে গেল মুসা। ইঙ্গিতটা বুঝতে পারল।

একটা মুহূর্ত অবাক হয়ে মুসার দিকে তাকিয়ে রইল জন। মুসাকে হাসতে দেখে আরও অবাক হলো। তবে ব্যাপারটা নিয়ে বেশি মাথা ঘামাল না। বলতে লাগল, তোমাদের ডাক্তারের কাছে যাওয়ার প্রয়োজন নেই, আমাদেরও তেমন ডাক্তার আছে। গান গাওয়া ডাক্তার, শামান। এখনকার যে শামান, আমার জন্মের। আগে থেকেই আছে, চিকিৎসা করছে বহু বছর ধরে। অনেক জানে, অনেক জ্ঞানী। মাঝে মাঝে অবশ্য বেকারসফিল্ডের ক্লিনিকে পাঠায় আমাদের, তবে সব সময় না। স্বাস্থ্যটাস্থ্য ভালই থাকে আমাদের, রোগ বালাই তেমন হয় না, আর হলেও অল্পতেই সেরে যায়। মানে যেত আরকি। এবারের অসুখটা আর সারতে চাইছে না। কয়েক মাস ধরে চলছে।

গা থেকে যে বোরোনো যাবে না বললে, শঙ্কিত হয়ে উঠেছে রবিন, সেটা কি আমাদের বেলায়ও? জরুরী অবস্থায়ও কি বেরোনো যাবে না?

সেটাই শামানের কাছে জানতে গেছেন চাচা।

হঠাৎ ঢাকের আওয়াজ বেড়ে গেল। সেই সঙ্গে বাড়ল ক্ল্যাপ স্টিকের খটাখট। সম্মিলিত বিকট চিৎকার উঠল, মানুষের গলা থেকে যে ওরকম শব্দ বেরোতে পারে না শুনলে বিশ্বাস করা কঠিন, ছড়িয়ে গেল গাঁয়ের এক প্রান্ত থেকে আরেক প্রান্তে। তাকিয়ে রয়েছে তিন গোয়েন্দা।

নাচ আরম্ভ হয়েছে। অনেক বড় চক্র তৈরি করে নাচছে নর্তকেরা। কাঁচা চামড়ায় তৈরি মোকাসিন পায়ে থাকায় পায়ের শব্দ তেমন হচ্ছে না। আরেকটা ব্যাপার অবাক করল গোয়েন্দাদেরকে। চক্রের এক প্রান্তের লোকেরা যখন নাচছে, আরেক প্রান্ত চুপ থাকছে। কারণটা জিজ্ঞেস করল জনকে।

ও, জান না। বুঝিয়ে দিল জন, পৃথিবীটা হলো একটা নৌকার মত। পানিতে ভাসার সময় নৌকার এক পাশে যদি ভার বেশি হয়ে যায়, তাহলে কাত হয়ে যায়। আর সবাই একসাথে একপাশে চলে গেলে তো উল্টেই যাবে। সে জন্যে দুই দিকেই সমান ভার রাখতে হবে। নাচের বেলায়ও তাই। সবাই একধারে গিয়ে একসাথে নাচলে চলবে না।

তাহলে কাত হয়ে যাবে নাকি পৃথিবীটা? ফস করে জিজ্ঞেস করে বসল। মুসা। আরও কিছু বলতে যাচ্ছিল, আবার লাথি খেল পায়ে। চোখের ইশারায়। বুঝিয়ে দিল কিশোর, যা বলছে চুপচাপ শুনে যাও না, এত কথা বলার দরকার কি?

ঘুরতে ঘুরতে কয়েকজন নর্তক এসে ঢুকে পড়ল চক্রের মাঝখানে। যতটা জোরে সম্ভব লাফাতে লাগল। যেন কার চেয়ে কে কত বেশি উঁচুতে উঠতে পারবে সেই প্রতিযোগিতা চলছে।

এরও কারণ ব্যাখ্যা করে দিল জন, আগে একবার ধ্বংস হয়ে গিয়েছিল পৃথিবী। তারপর আবার সৃষ্টি করলেন ঈশ্বর। কাঠঠোকরার ওপর ভার দিলেন, কোথায় কেমন চলছে, সেই খবর নিয়মিত দিয়ে আসার। কাজেই আমাদের মধ্যে যাদের অন্তর খুব ভাল, ঈশ্বরের ভক্ত, তাদের রাখা হয়েছে কাঠঠোকরার অনুকরণ করার জন্যে। দেখছ না, মাথা আগেপিছে করছে কেমন ভাবে? কাঠঠোকরা ওরকম করেই গাছ ঠোকরায়, নিশ্চয় দেখেছ। কাঠঠোকরা যেভাবে ডানা ছড়িয়ে দিয়ে গান গায়, ওরাও তেমন করেই গাইছে। এর কারণ জানো? কাঠঠোকরারা এই গান শুনতে পেয়ে ঈশ্বরকে গিয়ে খবর দেবে, এখানে কিছু মানুষের বড় দুর্ভোগ, অসুখ করেছে তাদের। ঈশ্বর শুনলে একটা ব্যবস্থা করবেনই। যাদের তৈরি করেছেন, তাদের তো আর কষ্টে রাখতে পারেন না। হয় রোগ সারিয়ে দেবেন, নয় তো শামানের ওপর ভার দিয়ে দেবেন, তাকে শক্তিশালী করে দেবেন যাতে মানুষের এই রোগ সারিয়ে দিতে পারে।  

নাচ চলছে। দরদর করে ঘামছে নাচিয়েরা। মেয়েরা আর বাচ্চারা নাচে অংশ। নিচ্ছে না, তারা বসে বসে দেখছে, মাঝে মাঝে হাততালি দিচ্ছে, গানের সঙ্গে গলা মেলাচ্ছে। এর বেশি আর কিছু করণীয় নেই তাদের। বেশি অসুস্থ রোগীদেরকে মাদুরে শুইয়ে রাখা হয়েছে। কম্বল পাকিয়ে তাদের মাথার নিচে দিয়ে দেয়া হয়েছে, যাতে আরাম করে শুতে পারে, আর মাথাটা কিছুটা উঁচু হয়ে থাকায় নাচ দেখতে সুবিধে হয়। বেশ জমজমাট উৎসব, আন্তরিকতার অভাব নেই।

একসময় শেষ হলো নাচ।

ঢাক বাজানো বন্ধ হলো। নর্তক এবং দর্শকেরা খাবারের দিকে এগিয়ে এল। তাড়াতাড়ি এসে খাবারের পাত্রের ওপর থেকে ঢাকনা সরিয়ে দিল মেয়েরা। কিশোর লক্ষ করল, নর্তকদের অনেকেরই চোখ লাল, কেউ কেউ কাশছে।

জনের চাচা মোড়ল আরেকজন বুড়ো মানুষকে নিয়ে হাজির হলেন। দুজনেরই পরনে উৎসবের পোশাক। লোকে যেভাবে ভক্তিতে গদগদ হয়ে সরে। জায়গা করে দিচ্ছে বুড়ো মানুষটাকে, শ্রদ্ধার চোখে তাকাচ্ছে, তাতে বুঝতে অসুবিধে হয় না এ লোকই গাঁয়ের শামান, গান গাওয়া ডাক্তার।

কথা বলতে বলতে তিন গোয়েন্দার দিকে এগিয়ে এল দুজনে।

কাছে এসে থামল।

মোড়ল ডুম সবল ঘোষণা করলেন, তোমাদেরকে সাহায্য করতে পারছি না। আমরা। একাই যেতে হবে তোমাদের। এটাই আমাদের সিদ্ধান্ত।

.

০৮.

বেরোলে ঝুঁকিটা বেশি হয়ে যাবে, গান গাওয়া ডাক্তার বলল। অনুষ্ঠানটা নির্ভেজাল রাখতে হবে। অনেক মানুষ অসুস্থ হয়ে পড়েছে আমাদের এখানে।

বুড়ো হতে হতে কুঁচকে গেছে শামানের মুখের চামড়া। যেতে পারছে না বলে সত্যিই দুঃখিত, এটা বুঝতে অসুবিধে হচ্ছে না তিন গোয়েন্দার। কিন্তু তার এই দুঃখিত হওয়ায় মিস্টার মিলফোর্ডের কোন উপকার হচ্ছে না।

তোমরা এখানে থেকে গেলেই ভাল করবে, পরামর্শ দিলেন মোড়ল ডুম সবল। কাল গাড়িতে করে দিয়ে আসা যাবে তোমাদের।

আজই যেতে হবে আমাদের, রবিন বলল। আমার বাবা নিশ্চয় ভীষণ বিপদে পড়েছে।

বিশাল এলাকা এটা, মোড়ল বলল। কল্পনাও করতে পারবে না কতটা বড়। ডায়মণ্ড লেক কি করে খুঁজে বের করবে?

রাস্তা ধরে যাব, মুসা জবাব দিল।

চল্লিশ মাইল হাঁটতে হবে তাহলে।

 চল্লিশ মাইল! ঢোক গিলল মুসা।

নিচের ঠোঁটে চিমটি কাটছে কিশোর। স্থির দৃষ্টিতে মোড়লের দিকে তাকিয়ে রইল এক মুহূর্ত। বলল, আপনাদের একটা পিকআপ ভাড়া নিতে পারি আমরা।

গাঁয়ে আসার পর এই প্রথম উজ্জ্বল হলো রবিনের মুখ। এই না হলে কিশোর পাশা! আসল কথাটা ঠিক তার মাথায় এসে যায়। অথচ এই সহজ কথাটাই মনে। পড়েনি রবিন কিংবা মুসার।

তাড়াতাড়ি রবিন বলল, আমাদের ড্রাইভিং লাইসেন্স আছে।

টাকাও আছে, বলতে বলতে পকেট থেকে টাকা বের করে ফেলল রবিন। ডায়মণ্ড লেকে গিয়ে খরচ করার জন্যে রেখেছিল। ভাড়া দিতে পারব।

আপনি যেখানে রেখে যেতে বলবেন, আমাদের কাজ শেষ হয়ে গেলে সেখানেই রেখে যাব গাড়িটা, কিশোর বলল। খুব যত্ন করে চালাব, কিচ্ছু নষ্ট করব না। এই যে নিন, আমাদের কার্ড। লোকে আমাদের বিশ্বাস করে রকি বীচে। একটা উপকার চাইছি, করবেন না?

একটা করে তিন গোয়েন্দার কার্ড মোড়ল আর শামানের হাতে গুঁজে দিল কিশোর।

কার্ডটার দিকে তাকিয়ে রইলেন মোড়ল। শামান তাকালেনও না, তুলে দিলেন জনের হাতে। জোরে জোরে পড়ল জন।

মাথা নেড়ে মোড়ল বললেন, প্রস্তাবটা ভাল মনে হচ্ছে না।

ভ্রূকুটি করল গান গাওয়া ডাক্তার। তা ঠিক। তবে তাতে কোন ক্ষতি হবে না। প্রশংসার দৃষ্টিতে ছেলেদের দিকে তাকাল শামান। ঘোলা হয়ে আসা চোখে বুদ্ধির ঝিলিক। এই তিনজন এমনিতেই চলে যাচ্ছে, থাকছে না, যা নিতে চায়। দিয়ে দিতে পারি আমরা।

ঠোঁট গোল করলেন মোড়ল। ব্যাপারটা তার পছন্দ হচ্ছে না। কিন্তু শামানের সিদ্ধান্তের ওপর কথাও বলতে পারেন না। বললেন, বেশ, ব্যবস্থা করছি। বলে খাবার খেতে বসা লোকগুলোর দিকে চলে গেলেন তিনি।

থ্যাংক ইউ, শামানের দিকে তাকিয়ে কৃতজ্ঞ গলায় বলল রবিন।

বুড়ো মানুষটাও হাসল। একটা মুহূর্তের জন্যে নেচে উঠল তার চোখের তারা। আজকালকার ছেলেছোকরাগুলোকে নিয়ে এই এক অসুবিধে। সব সময় একটা না একটা গণ্ডগোল বাধাবেই, বিড়বিড় করে বলল সে। জনের দিকে তাকিয়ে বলল, তাই না?

আপনার কথা অমান্য করি না আমি, জন জবাব দিল।

 কি করে এসেছ বলো ওদের, আদেশ দিল গান গাওয়া ডাক্তার। শোনাও।

তিন গোয়েন্দার দিকে ফিরে বলল জন, দৈব আদেশ পাওয়ার জন্যে বেরিয়েছিলাম আমি। ভিশন কোয়েস্টে। চব্বিশ ঘণ্টা বনের ভেতরে ছুটে বেড়িয়েছি। কেবল প্রার্থনার জন্যে থেমেছি। রাতে ঘুমিয়েছি ঈশ্বরের নির্দেশ পাওয়ার জন্যে।

কি স্বপ্নে দেখলে, নাতি? জিজ্ঞেস করল শামান।

 নাতি? সবাই তোমার আত্মীয় নাকি এখানে, জন? মুসার প্রশ্ন।

 হেসে উঠল জন আর শামান।

আমরা এভাবেই বড়দের সম্মান জানাই, জন জবাব দিল। মাথা ঝাঁকিয়ে তার কথায় সায় দিল শামান।

তার মানে মোড়ল তোমার চাচা নন, রবিন বলল।

না। আর শামানেরও আমি নাতি নই। তবে তিনি এখানে আমার বয়েসী সবার কাছেই দাদার মত।

মাথা ঝাঁকাল তিন গোয়েন্দা। বুঝেছে।

 অদ্ভুত স্বপ্ন দেখেছি আমি, দাদা, শামানের প্রশ্নের জবাবে বলল জন। শুরু হলো হ্রদ দিয়ে। দেখি, সবুজ একটা হৃদের ধারে গিয়ে পড়েছি আমি। ঝাঁপিয়ে পড়লাম তাতে। দাপাদাপি করতে লাগলাম। একটা মাছ আপনাআপনি এসে হাতে ধরা দিল। ভাগ্যবান মনে হলো নিজেকে। মাছটা দিয়ে চমৎকার খাবার হবে। ঈশ্বরকে ধন্যবাদ দিলাম। আরও অনেক মাছ এসে পড়তে লাগল আমার হাতের কাছে, এত বেশি, ধরলে হাতে রাখার জায়গা পাব না। ওরা কেবলই আমার গায়ে এসে পড়তে লাগল, আমার পিঠে, আমার বুকে, আমার মুখে লাফিয়ে পড়তে লাগল। আরও এল, আরও, আরও জোরে জোরে গুতো মারতে লাগল আমাকে। ঠোকর মারতে লাগল।

কি মনে হলো তোমার? শামান জিজ্ঞেস করল, তোমাকে মেরে ফেলতে চেয়েছে?

মাথা ঝাঁকাল জন। হাতের মাছগুলো ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে তাড়াতাড়ি উঠে এলাম পানি থেকে।

ঠিক কাজটাই করেছ। কি শিখলে?

শিখলাম, বিনা কষ্টে যা হাতে আসবে তার কোন মূল্য নেই। মাঝে মাঝে ক্ষতিকর হয়ে ওঠে ওসব জিনিস।

খুশি হয়ে মাথা ঝাঁকাল গান গাওয়া ডাক্তার। ঈশ্বর তোমাকে কি নির্দেশ দিলেন?

ঠিক জায়গায়, কিন্তু আর্শীবাদ ছাড়া!

মানে বুঝেছ?

না।

কৌতূহলী হয়ে জনের দিকে তাকিয়ে রয়েছে তিন গোয়েন্দা।

কিছুই তো বুঝলাম না, বিষণ্ণ ভঙ্গিতে মাথা নাড়ল জন। তার দেখাই পাইনি।

যা-ই হোক, ঈশ্বর তোমার প্রশ্নের জবাব দিয়েছেন, শামান বলল। সেটাকে কাজে লাগাবে।

চোখ নামিয়ে ফেলল জুন। লাগাব, দাদা।

 পরের অনুষ্ঠানে অবশ্যই উৎসবের পোশাক পরবে তুমি।

পরব, দাদা। তিন গোয়েন্দার দিকে ফিরে হাসল জন। ঝকঝকে উজ্জ্বল হাসি। গুড লাক। বলেই রওনা হয়ে গেল সে। দৌড়ে চলে গেল, দমকা হাওয়ার মত।

গুড বাই, তরুণ যোদ্ধারা, তিন গোয়েন্দাকে বলল শামান। পৃথিবীতে। কেবল নিজেকে বিশ্বাস করবে, আর কাউকে না।

ভিড়ের দিকে চলে গেল সে। হাসিমুখে কথা বলতে লাগল তার ভক্তদের।

ওই দেখো, মোড়ল, পঞ্চাশ গজ দূরের একটা টিনের কুঁড়ে দেখাল মুসা।

ঘরের সামনে দাঁড়িয়ে হালকা-পাতলা এক ইনডিয়ানের সঙ্গে কথা বলছেন, ডুম। জিনসের সামনের দিকে হাত মুছছে লোকটা। মাথা ঝাঁকাচ্ছে। তারপর মোড়ল চলে এলেন খাবার টেবিলের দিকে, লোকটা চলে গেল ঘরের ভেতরে।

জোনস ট্রাকিং কোম্পানি লেখা বাক্সগুলোর সামনে থেকে সরেনি এখনও কিশোর। তার সামনের বাক্সটায় প্লেট রাখা। তাতে কিছু আলুভাজি রয়ে গেছে। শেষ করে ফেলার জন্যে চামচ দিয়ে তুলতে যাবে এই সময় চোখে পড়ল। সিগারেটের গোড়াটা। একটা বাক্সের কাছে পড়ে আছে। মাটিতে।

ঝুঁকে গোড়াটা তুলে নিল সে। হলদে হয়ে গেছে কাগজ, দোমড়ানো। একই রকমের সবুজ রঙের বন্ধনী লাগানো ফিল্টারের জোড়ার কাছে, সকালে যেটা পেয়েছিল সেরকম।

কিশোর, মুসা জিজ্ঞেস করল, কি ওটা?

দেখো। সকালের পাওয়া গোড়াটা পকেট থেকে বের করে ফেলেছে। কিশোর। পরে যেটা পেয়েছে সেটাও একই সাথে হাতের তালুতে রেখে বাড়িয়ে ধরল।

খাইছে!

এর মানে কি? রবিনের প্রশ্ন।

জানি না, জবাব দিল কিশোর। রেখে দিই। কাজে লেগেও যেতে পারে। কখন যে কোন জিনিসটা দরকার হয়ে পড়ে, আগে থেকে বলা যায় না।

ভিড় থেকে বেরিয়ে কিশোরদের দিকে এগিয়ে এল এক কিশোরী। আমি মালটি জনজুনস। জনের বোন। হেসে একটা চাবি বের করে ফেলে দিল রবিনের হাতে, মোড়ল বললেন পিকআপটা পাবে। চালানোর জন্যে তৈরি করা হচ্ছে। খেয়েছ তো ভালমত?

খেয়েছি, জবাব দিল রবিন। মেয়েটাকে দেখছে। চেহারাটা খুব সুন্দর। লম্বা। চুল। ঢিলাঢালা সাদা পোশাক পরেছে। গলায় নীলকান্তমণির মালা। তার চোখও লাল। আসলেই কি তুমি জনের বোন? না এটাও সম্মান দেখানোর জন্যে বলা?

একটা মুহূর্ত অবাক হয়ে রবিনের দিকে তাকিয়ে রইল মালটি। তারপর বুঝতে পেরে হাসল। না না, আমি সত্যিই তার বোন।

আর কোন অনুষ্ঠান হবে তোমাদের?

এবার শামান গান গাইবে আর নাচবে। তারপর প্রার্থনা করবে। ঈশ্বরের সঙ্গে কথা বলার জন্যে তৈরি হচ্ছে। ঈশ্বরকে জিজ্ঞেস করবে, কি কারণে অসুখ হয়েছে আমাদের। কি করলে সারবে। সেই মত কাজ করে আমাদের সারিয়ে তুলবে তখন।

আবার নিশ্চয় নাচ-গান?

হ্যাঁ। ওষুধের ব্যবস্থাও আছে।

কিশোর জানতে চাইল, ভিশন কোয়েস্টটা কি জিনিস?

মনোযোগী হলো মালটি। জনের কোয়েস্টের কথা শুনেছ তাহলে? কি মেসেজ দিলেন ঈশ্বর?

ভাবল কিশোর। বলল, ঠিক জাগায়, কিন্তু আশীর্বাদ ছাড়া। এ কথাগুলোর মানে বুঝতে না পেরে মাথা নাড়ল মালটি। ঈশ্বরই জানেন কি বলেছেন। জন বুঝতে পেরেছে?

 না। গান গাওয়া ডাক্তার তাকে এটা নিয়ে ভাবতে বলেছে, রবিন বলল। কেন, এমন কি জরুরী, এটা?

কারণ… চুপ হয়ে গেল মালটি। চোখ মুদল। খুলল। আমাদের চাচা, আমাদের সত্যিকারের চাচা হারিয়ে গেছে। বাবা চলে যাওয়ার পর আমাকে আর জনকে বড় করেছে এই চাচাই। বাবা হারিয়ে গেছে বহু বছর আগে। এখন হারাল আমাদের চাচা। এক মাস হয়েছে। সমস্ত জঙ্গলে খোঁজাখুঁজি করেও তাকে বের করতে পারেনি জন।

 অদ্ভুত কিছু একটা ঘটছে এই এলাকায়, রবিন বলল। আমার বাবাও হারিয়ে গেছে।

মাথা ঝাঁকাল মালটি। চোখে বিষণ্ণতা। জনতার দিকে চোখ পড়তে তাকিয়ে রইল সেদিকে। হালকাপাতলা সেই লোকটা, যার সঙ্গে কথা বলেছিলেন মোড়ল, হাত নেড়ে মালটিকে ইশারা করছে।

তোমাদের পিকআপ রেডি, লাল চোখ ডলতে ডলতে বলল মালটি।

পথ দেখিয়ে গায়ের আরেক প্রান্তে তিন গোয়েন্দাকে নিয়ে এল সে। পথে। কয়েকটা বেঁধে রাখা কুকুর দেখতে পেল ওরা, আর উঁচু উঁচু মাটির দেয়ালে একটা জায়গা ঘেরা। ওটা হলো শোধনাগার। দেহকে ওখান থেকে পবিত্র করে আনে লোকে।

একটা কথা বলতে পারবে? পকেট থেকে সিগারেটের গোড়া দুটো, বের। করে মালটিকে দেখিয়ে জিজ্ঞেস করল কিশোর, এই জিনিস এখানে কে খায়?

না, অবাক হয়েছে মেয়েটা।

হতাশ হয়ে আবার ওগুলো পকেটে রেখে দিল গোয়েন্দাপ্রধান।

পুরানো ট্রাক আর জীপের মাঝে ঝকঝকে নতুন লাল একটা পিকআপ দেখে ওটা কার জিজ্ঞেস করল মুসা।

মোড়ল চাচার, মালটি বলল। খুব ভাল মানুষ। রাইফেলে দারুণ নিশানা। নতুন কাপড়, কাজের যন্ত্রপাতি আর গাড়ির পার্টস ভেঙে গেলে এনে দেন। আমাদের।

টাকা পান কোথায়? কিশোরের প্রশ্ন।

ত্যাগ করল মালটি। জানি না। ডায়মণ্ড লেকে পার্ট-টাইম কোন কাজ করেন বোধহয়। ওসব আমার ব্যাপার নয়, মাথাও ঘামাই না। রঙচটা, মরচে পরা একটা পুরানো ফোর্ড ফ-১০০ গাড়ির ফেণ্ডারে চাপড় দিল সে। এটাই তোমাদের দেয়া হয়েছে। যত্ন করবে। কাজ শেষে ডায়মণ্ড লেকে রেঞ্জার স্টেশনে রেখে যেও, তাহলেই হবে।

 জিনিসপত্র যা সঙ্গে আনতে পেরেছে সেগুলো গাড়ির পেছনে রেখে সামনের সীটে উঠে বসল তিনজনে। সীটবেল্ট নেই। স্টিয়ারিঙে বসল মুসা। তিনজনের মাঝে সব চেয়ে ভাল ড্রাইভার সে।

উত্তর দিকে যাবে, বলে দিল মালটি। কিছু দূর গেলে একটা দোরাস্তা দেখতে পাবে, কাঠ ব্যবসায়ীরা তৈরি করেছে। পশ্চিমের কাঁচা রাস্তাটা ধরবে, তাহলেই পৌঁছে যাবে হাইওয়েতে। ডানে যাবে, ডায়মণ্ড লেকে চলে যেতে পারবে।

মালটিকে ধন্যবাদ দিল ওরা। ইঞ্জিন স্টার্ট দিল মুসা। হেসে, হাত নেড়ে ওদেরকে বিদায় জানাল মেয়েটা। রওনা হয়ে গেল ওরা। ব্যাকফায়ার করছে। পুরানো ইঞ্জিন। তবে চলছে। চাকার পেছনে ধুলো উড়ছে। ঘেউ ঘেউ করছে কুকুর।

যাক, স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে বলল মুসা, একটা গাড়ি পেলাম শেষ পর্যন্ত। পায়ে না হেঁটে চাকার ওপর গড়ানো।

হ্যাঁ, রবিন বলল। ধন্যবাদটা কিশোরেরই পাওনা। ও কথাটা মনে করেছিল। বলেই পেলাম।

সীটে হেলান দিয়ে আছে কিশোর। চুপচাপ।

 পথের দিকে নজর দিল মুসা। সরু রাস্তা। উঁচু-নিচু। যেখানে-সেখানে মোড়। একটু অসতর্ক হলেই বিপদে পড়তে হবে। রেডউডের জঙ্গল থেকে বেরিয়ে পাইনের বনে ঢুকল গাড়ি। পাহাড়ী উপত্যকায় ঢেউ খেলে যেন এগিয়ে গেছে পথ, একবার উঠছে একবার নামছে, একবার উঠছে একবার নামছে।

মোড়ল আমাদের পছন্দ করেনি, একসময় মুসা বলল।

শামান করেছে, বলল কিশোর। ও রাজি হওয়াতেই গাড়িটা পেলাম আমরা। ওর চেহারা দেখেছ, ভাবসাব, যখন দৈব নির্দেশ পাওয়ার কথা বলল জন? মেসেজের মানে বুঝতে পেরেছে, এবং বুঝে খুশি হতে পারেনি।

মালটির চাচার কি হয়েছে, বলো তো?

এক মাস অনেক সময়। রহস্য বলা চলে। আরেকটা রহস্য হলো ওই মানুষগুলোর আজব অসুখ। ভাইরাসের আক্রমণ হতে পারে, কিন্তু ভাবছি… আচমকা নীরব হয়ে গেল কিশোর। চিমটি কাটতে লাগল নিচের ঠোঁটে। কোন কিছু ভাবিয়ে তুলেছে ওকে।

যেখান থেকে রওনা হয়েছে, তার মাইল দুয়েক আসার পর চড়াই বাড়তে লাগল। অনেক খাড়া হয়ে এখানে উঠে গেছে পথ। সুগন্ধী পাইনের বনে ঝলমল করছে বিকেলের রোদ।

পাহাড়ের ওপরে উঠে জোরে জোরে ব্যাকফায়ার করতে লাগল ইঞ্জিন। থামল না। ঢাল বেয়ে নামতে শুরু করল গাড়ি। চড়াইটা যেমন খাড়া ছিল উতরাইটা তেমনি ঢালু। দ্রুত গতি বাড়ছে গাড়ির।

ব্রেক চাপল মুসা। গতি কমল গাড়ির। ব্রেক ছেড়ে দিতেই আবার বাড়তে লাগল, দ্রুত, আরও দ্রুত। পাশ দিয়ে সাঁ সাঁ করে সরে যাচ্ছে গাছপালা ঝোপঝাড়।

ব্রেক চাপল আবার মুসা। গতি কমল গাড়ির। হঠাৎ মেঝেতে গিয়ে লেগে গেল ফুট পেডাল। নিচের দিকে ছুটতে লাগল আবার গাড়ি। অকেজো হয়ে গেছে। ব্রেক।

খাইছে! চিৎকার করে উঠল মুসা, ব্রেকটা গেল?

.

০৯.

ক্রমেই গতি বাড়ছে পিকআপের। মাটিতে গভীর খাঁজ, অনেকটা রেল লাইনের মত কাজ করছে। তাতে ঢুকে গেছে চাকা। ফলে খাজ যেভাবে এগিয়েছে সেভাবেই চলতে হচ্ছে গাড়িটাকে, আর কোন দিকে ঘোরানোর উপায় নেই।

শক্ত করে স্টিয়ারিং ধরে রেখেছে মুসা। প্রচণ্ড ঝাঁকুনিতে ঝাঁকি খাচ্ছে পাশে বসা কিশোর। তার পাশে বসা রবিন আঁকড়ে ধরে রেখেছে প্যাসেঞ্জার ডোরের আর্মরেস্ট। মাঝে মাঝেই লাফিয়ে উঠছে তিনজনের শরীর, ছাতে মাথা বুকে যাওয়ার অবস্থা।

ইমারজেন্সি ব্রেক! চেঁচিয়ে বলল কিশোর।

 সাংঘাতিক জোরে চলছে, জবাব দিল মুসা। কোন কাজই করবে না এখন!

তাহলে? রবিনও চিৎকার করেই বলল।

সামনে রাস্তা হয়তো ভাল, আশা করল কিশোর। ঝকির চোটে দাঁতে দাতে বাড়ি লাগছে তার।

গিয়ার নামানোর চেষ্টা করে দেখি, মুসা বলল।

ঘাম ফুটেছে মুসার কপালে। শক্ত করে চেপে ধরল স্টিকটা। দ্বিধা করল। পরক্ষণেই একটানে তৃতীয় গিয়ার থেকে নামিয়ে নিয়ে এল দ্বিতীয় গিয়ারে।

হঠাৎ এই পরিবর্তনে চাপ পড়ল ইঞ্জিনে, বিকট আর্তনাদ করে প্রতিবাদ জানাল। জোরে একবার দুলে উঠল গাড়ি, গতি কমে গেল।

খবরদার! চিৎকার করে উঠল রবিন, বাঁক! সামনে ডানে মোড় নিয়ে। পাহাড়ের ভেতর অদৃশ্য হয়ে গেছে পথটা।

 তীব্র গতিতে মোড় নেয়ার সময় গলা ফাটিয়ে চিৎকার করে উঠল তিনজনেই। বৃষ্টিতে ধুয়ে মাটি ক্ষয়ে গিয়ে গাছের শেকড় বেরিয়ে আছে পাহাড়ের গা থেকে, লম্বা আঙুল বাড়িয়ে দিয়ে যেন চাকা আটকে গতি রোধ করতে চাইছে গাড়ির।

ডানে কাটল মুসা, পাহাড়ের দিকে।

কি করো! আঁতকে উঠে বলল রবিন।

পাহাড়ের গায়ে লাগিয়ে দিই! দেখি থামে কি না! জবাব দিল মুসা।

 ঝটকা দিয়ে খাজ থেকে উঠে এল চাকা।

দেখো, আস্তে আস্তে! কিশোর বলল।

পথের কিনারে স্তূপ হয়ে আছে ধসে পড়া মাটি, ছোট ছোট পাথর। ঘ্যাঁচ করে ওগুলোর মধ্যেই ঢুকে গেল গাড়ি।

স্টিয়ারিং নিয়ে পাগল হয়ে গেছে যেন মুসা। হাত থেকে ছুটে যেতে চাইছে। বার বার। লাফাচ্ছে, ঝাঁকি খাচ্ছে, থরথর করে কাঁপছে পিকআপ।

আবার পাহাড়ের দেয়ালের দিকে গাড়ির নাক ঘোরানোর চেষ্টা করল মুসা। দেরি করে ফেলল। আলগা পাথরে পিছলে গিয়ে আবার খাজের মধ্যে পড়ল চাকা।

মরলাম আবার! মুসা বলল।

খাঁজ ধরে ছুটতে ছুটতে পরের বাকটার কাছে চলে এল গাড়ি, উড়ে পেরিয়ে এল যেন।

আরি! বলে উঠল রবিন, ওড়াল দেবে নাকি!

সামনে একটা ছোট পাহাড় দেখা গেল। ঢালটা খুব ধীরে ধীরে ওপরে উঠেছে, খাড়াই কম।

এইবার আরও মরলাম! ঘামে চকচক করছে কিশোরের মুখ।

গর্জন করতে করতে তীব্র গতিতে পাহাড়ের গোড়ার দিকে ধেয়ে গেল গাড়ি। উঠতে শুরু করল ঢাল বেয়ে। যেন সাগরের উথাল পাথাল ঢেউয়ে পড়েছে, দোল খেতে লাগল। ভয়াবহ গতিবেগ অব্যাহত রেখেছে।

স্টিয়ারিং ছাড়ছে না মুসা। চেপে ধরে রেখেছে প্রাণপণে। খোলা জানালার কিনার খামচে ধরেছে রবিন, যেন সারা জীবনের জন্যে ধরেছে, ছাড়ার ইচ্ছে নেই। দুজনের মাঝে বসে দরদর করে ঘামছে কিশোর। এক হাতে ড্যাশবোর্ডে, আরেক হাত ছাতে ঠেকিয়ে চাপ দিয়ে আটকে রাখার চেষ্টা করছে নিজেকে।

অনেক পেছনে সরে গেছে আগের পাহাড়টা। সামনে পথের দুধারে ঘন হয়ে জন্মেছে ঝোপঝাড়। ওপরে উঠতে গিয়ে ধীরে ধীরে গতি কমে আসছে পিকআপের।

 কিছুটা স্বস্তি বোধ করল তিন গোয়েন্দা। চূড়াটা.মালভূমির মত সমতল হয়ে। থাকলে হয়তো থেমে যাবে গাড়ি…

সর্বনাশ! গাড়ি চূড়ায় পৌঁছতেই চিৎকার করে উঠল কিশোর।

গতি অনেকটা কমেছে, কিন্তু তারপরেও যা রয়েছে, অনেক। চূড়াটা সমতল নয়। লাফ দিয়ে চূড়া পেরোল গাড়ি, আঁকুনিতে হাড়গোড় সব আলাদা হয়ে যাবে বলে মনে হলো অভিযাত্রীদের, ওপাশের ঢাল বেয়ে নামতে শুরু করল। গতি বেড়ে গেছে আবার। সাট সাট করে পাশ দিয়ে উড়ে চলে যাচ্ছে যেন গাছপালা।

গাড়িটাকে বাগে রাখার আপ্রাণ চেষ্টা করছে মুসা। এরই মাঝে চিৎকার করে সঙ্গীদেরকে হুঁশিয়ার করল, শক্ত হয়ে বসে থাকার জন্যে।

কিন্তু থাকাটা মোটেও সহজ নয়। সীটবেল্ট নেই। ঝটকা দিয়ে দিয়ে এদিকে কাত হয়ে পড়ছে, ওদিকে কাত হয়ে পড়ছে, লাফ দিয়ে ওপরে উঠে যাচ্ছে। গাড়িটার যেন ম্যালেরিয়া হয়েছে, এমনই কাঁপুনি। সেই সঙ্গে নাচানাচি তো আছেই। আবার খাজের মধ্যে পড়ে গেছে চাকা।

 নাহ, আর বাঁচোয়া নেই! কিশোর বলল, খুলে টুকরো টুকরো হয়ে যাবে। বডি!

তাই তো মনে হচ্ছে! জানালার ধার থেকে হাত সরায়নি রবিন।

হঠাৎ রাস্তার ডানপাশটা অদৃশ্য হয়ে গেল। গাছের মাথা চোখে পড়ছে, বেরিয়ে আছে নিচে থেকে, পথের ওপরে এসে পড়েছে ডাল পাতা। খানিক পরে আর তা-ও থাকল না। একশো ফুট নিচে খাড়া নেমে গেছে ওখানে পাহাড়ের দেয়াল, ঢাল নেই যে গাছ জন্মাবে। নিচে জন্মে রয়েছে পাইন, কাঁটাঝোপ। মাঝে মাঝে বেরিয়ে আছে পাথরের চাঙড়। ওগুলোর কোনটায় গিয়ে যদি আছড়ে পড়ে গাড়ি, ছাতু হয়ে যাবে।

যে খাজকে এতক্ষণ গালাগাল করছিল মুসা, সেটাকেই এখন আশীর্বাদ বলে। মনে হচ্ছে। বের করার তো এখন প্রশ্নই ওঠে না, ভেতরে রাখার জন্যেই যেন যত চিন্তা।

এই দেখো দেখো! উত্তেজিত হয়ে চিৎকার করল মুসা।

সামনেই দেখা গেল ওটা, ওদের এই দুঃস্বপ্ন-যাত্রার অবসান ঘটাতেই যেন। মাথা তুলে দাঁড়িয়ে আছে গ্র্যানিটের উঁচু দেয়াল। পুব থেকে পশ্চিমে বিস্তৃত। ডানে মোড় নিয়ে ওটার পাশ দিয়ে চলে গেছে পথ। যে গতিতে চলছে, যদি নাক ঘোরাতে না পারে, যদি সোজাসুজি গিয়ে…আর ভাবতে চাইল না মুসা। বলল, গাড়ির পাশটায় ঘষা লাগালে কেমন হয়? থেমেও যেতে পারে।

পাগলামি! স্রেফ পাগলামি! বিড়বিড় করে বলল কিশোর। গাড়ির পাশ ছিঁড়ে খুলে রয়ে যাবে!

আর ঘষা লাগলেই আগুনের স্ফুলিঙ্গ ছুটবে, বলল রবিন। একটা কণা যদি গিয়ে লাগে ট্যাঙ্কে, ব্যস, ভ্রম!

আর কোন ভাল বুদ্ধি দিতে পার? রেগে গিয়েই বলল মুসা।

 চুপ হয়ে গেল রবিন আর কিশোর। গাড়িটাকে রোখার আর কোন উপায়ই বলতে পারল না। পথের বাঁয়ে যেন আকাশে মাথা তুলে দাঁড়িয়ে আছে গ্র্যানিটের দেয়াল, চোখ বড় বড় করে সেদিকে তাকিয়ে রয়েছে দুজনে।

খেপা জানোয়ারের মত গর্জন করতে করতে ছুটছে ফোর্ড। জোরাজুরি করে আরও একবার খাজ থেকে চাকা তুলে আনল মুসা।

ঘাঅ্যাস করে দেয়ালে ঘষা লাগল পিকআপের এক পাশ। ঝনঝন করে উঠল। শরীর। আগুনের ফুলকি ছিটাল একরাশ।

 চেঁচিয়ে উঠল রবিন।

আর কোন দিকে নজর নেই মুসার, দৃষ্টি স্থির হয়ে আছে ধূসর দেয়ালের দিকে। আবার সামান্য বাঁয়ে স্টিয়ারিং কাটল সে। এ্যানিটে ঘষা খেল পিকাপের নাক। আবার ফুলকি ছুটল। আবার লাগাল। আবার ফুলকি।

 গাড়ির ভেতরে টানটান উত্তেজনা।

যা করছ করে যাও, কিশোরও বুঝতে পারছে এছাড়া আর কোন উপায় নেই।

পারবে! আশা বাড়ছে রবিনের। মনে হচ্ছে পারবে এভাবেই। চালিয়ে যাও।

সাহস পেল মুসা। আবার কাটল স্টিয়ারিং। দেয়ালে তো লাগাল পিকআপ, এ্যানিটে ঘষা লেগে ছেড়ে যাওয়ার সময় তীক্ষ্ণ আর্তনাদ তুলল গাড়ির ধাতব শরীর, নাগাড়ে ফুলকি ছিটিয়ে চলেছে।

দরদর করে ঘামছে তিন গোয়েন্দা।

গতি কমে এল পিকআপের। এগোনর চেষ্টা করেও পারছে না। প্রচণ্ড চাপে গুঙিয়ে উঠছে বডি।

অবশেষে থামতে বাধ্য হলো গাড়ি। ইঞ্জিন চলছে। বন্ধ করে দিল মুসা। বা দিকের সামনের ফেণ্ডার ঠেকে রয়েছে দেয়ালে।

সীটে হেলান দিয়ে জোরে জোরে দম নিচ্ছে তিন গোয়েন্দা। হঠাৎ যেন বড় বেশি নীরব হয়ে গেছে সব কিছু। বাতাসে ধুলোর ঘূর্ণি। কেউ নড়ছে না, কোন, কথা বলছে না।

শেষে ফোঁস করে একটা নিঃশ্বাস ফেলে কিশোর বলল, মুসা, গাড়িটা তো গেল!

দামটা দিয়ে দিতে হবে! বলল রবিন।

ভাল ড্রাইভার বলে তোমার সুনাম আর থাকবে না!

কোন কথারই জবাব দিল না মুসা। কেবল ঘুরে তাকাল দুই বন্ধুর দিকে।

তবে যত যা-ই হোক, হেসে মুসার কাঁধ চাপড়ে দিয়ে বলল কিশোর, তোমাকে ধন্যবাদ দেয়ার ভাষা আমাদের নেই।

দেখালে বটে! রবিনও হাসল। চাপড় দিল মুসার বাহুতে।

হাসতে আরম্ভ করল মুসা। বাচলাম তো, কিন্তু বাঁচার আনন্দে সারাদিন বসে থাকলে চলবে না। কতটা ক্ষতি হয়েছে দেখা দরকার।

নেমে পড়ল ওরা।

বডির বাঁ পাশে রঙ বলতে আর কিছু নেই, ঘষা খেয়ে উঠে গেছে। মরচেও নেই। চকচক করছে ইস্পাত। লম্বা কাটা রয়েছে অনেকগুলো। ধারাল পাথরে লেগে ওই অবস্থা হয়েছে। দরজার হাতলটা গায়েব। সামনের ফেণ্ডারের একটা মাথা বেঁকে গেছে।

চমৎকার! ফিরে এসে আবার গাড়িতে উঠল মুসা।

 তার পেছনে এল কিশোর।

মেঝেতে প্রায় লম্বা হয়ে শুয়ে পড়ল মুসা। মাথা চলে গেছে স্টিয়ারিং হুইলের নিচে। ফুট পেড়ালের রডটা পরীক্ষা করল। একটা বোল্ট তুলে নিল মেঝে থেকে।

কি ব্যাপার? অধৈর্য কণ্ঠে জিজ্ঞেস করল কিশোর।

স্টিয়ারিঙের নিচ থেকে বেরিয়ে এসে মাথা তুলল মুসা। নীরবে বোল্টটা তুলে দিল কিশোরের হাতে।

কিশোরও ভাল করে দেখল জিনিসটা। লোহাকাটা করাতের দাগ দেখতে পেল ওতে। অনেকটাই কেটেছে। দেখে তুলে দিল রবিনের হাতে। ব্রেক কেন কাজ করছিল না, বোঝা গেল এতক্ষণে।

ঠিক, আঙুল তুলল মুসা। ব্রেক পেডাল একটা শ্যাফটের সঙ্গে লাগানো থাকে, যেটার সঙ্গে মাস্টার সিলিণ্ডারের যোগাযোগ। পেডালে চাপ দিলেই সিলিণ্ডারের পিস্টন ব্রেক লাইনের ব্রেক ফ্লুইডের ওপর চাপ বাড়ায়…

আসল কথা বলো, বাধা দিয়ে বলল রবিন, কি বলতে চাও?

বলছি, বলছি। শ্যাফটের সাথে পেডালটাকে আটকে রাখতে এই বোল্টটা দরকার।

এবং কেউ এটাকে এমন ভাবে কেটে রেখেছে, যোগ করল কিশোর, যাতে বেশি জোরে চাপ পড়লেই ভেঙে যায়।

তা-ই করেছে, মাথা দোলাল মুসা।

 গুঙিয়ে উঠল রবিন। ওর বাবাকে খুঁজতে যাওয়ার পথে আবার বিরাট বাধা এসে হাজির।

একে অন্যের দিকে তাকাতে লাগল তিনজনে।

কে করল কাজটা? রবিনের প্রশ্ন।

ইনডিয়ানদেরই কেউ হবে, জবাব দিল কিশোর।

মোড়ল? নিজেকেই যেন প্রশ্ন করল মুসা। আমাদের পছন্দ করেনি, এটা বোঝা গেছে তখনই। কিন্তু এতটাই অপছন্দ যে খুন করার চেষ্টা করল?

জন করেনি তো? ভুরু কোঁচকাল রবিন।

 কিংবা মালটি? বলল কিশোর।

নাহ, ও করবে বলে মনে হয় না, মুসা বলল।

 যে-ই করে থাকুক, রবিন বলল, সাহায্যের জন্যে আর ওখানে যাওয়া যাবে না।

প্রশ্নই ওঠে না, বলল কিশোর। খুন করতে চেয়েছিল আমাদের, আবার যাব? যেতে হবে ডায়মণ্ড লেকে, যে করেই হোক। ব্রেকটা ঠিক করতে পারবে?

নতুন একটা বোল্ট পেতে পারি। কিন্তু পাব কোথায়?

ট্রাকের ভেতরে খুঁজে এল সে আর রবিন। কিছুই পেল না। একটা জ্যাকও না, সাধারণত যে টুলসটা সব গাড়িতেই রাখা হয়।

সেসনাতে পাওয়া যাবে না তো? মুসার দিকে তাকিয়ে বলল কিশোর, পেছনের জিনিসপত্রের মাঝে টুলস দেখেছি বলে মনে পড়ে। বলেই আর দাঁড়াল না। পাহাড়ের দিকে রওনা হয়ে গেল।

হাঁ করে ওর দিকে তাকিয়ে রইল মুসা আর রবিন।

আরি, ওই পাহাড়টাই তো! অবাক হয়ে প্রায় চিৎকার করে বলল মুসা।

মনে তো হচ্ছে, ওর দিকে না তাকিয়েই বলল কিশোর। ওটা ধরে তৃণভূমিতে যেতে পারব আমরা, বোল্ট নিয়ে ফিরে এসে ব্রেক মেরামত করে চলে যৗব ডায়মণ্ড লেকে, সাহায্য নিয়ে খুঁজতে বেরোব আঙ্কেলকে। খুব সহজ ভাবেই কথাগুলো বলল বটে কিশোর, কিন্তু আবার পাহাড় ডিঙিয়ে যাওয়ার কথা ভাবতেই সিটিয়ে গেল মন। আরেকবার ওই ভয়ানক পরিশ্রম করতে মন চাইছে না।

ট্রাকের পেছন থেকে পানির বোতলটা নামিয়ে আনল রবিন। যার যার জ্যাকেট কোমরে জড়িয়ে নিল, ঠাণ্ডা পরলে গায়ে দেবে। এগিয়ে গেছে কিশোর। তার পেছনে চলল দুজনে। যে পথে এসেছে ওই পথ ধরেই পাহাড় বেয়ে উঠতে হবে। পিকআপের ঘষায় গ্র্যানিটের দেয়ালের গভীর আঁচড়গুলো দেখতে পেল ওরা। এক জায়গায় পড়ে থাকতে দেখল দরজার হাতলটা। এক লাথিতে রাস্তার পাশের এক ঝোপে পাঠিয়ে দিল ওটাকে রবিন।

কিছুদূর এগোনোর পর যেখানে রাস্তাটা দক্ষিণে ইনডিয়ানদের গায়ের দিকে চলে গেছে, সেখানে এসে পশ্চিমে মোড় নিয়ে বনের ভেতরে ঢুকে পড়ল ওরা।

খানিক পরেই ঘন হয়ে এল পাইন, উঁচু মাথাগুলোর ওপরটা বাঁকা হয়ে আছে। ধনুকের মত। পাখি ডাকছে প্রচুর। হালকা বাতাস দোলা দিয়ে গেল ডালে ডালে। বাইরে বিকেলের রোদ, অথচ বনের ভেতরে এখানে বেশ ছায়া, ঠাণ্ডাও।

হঠাৎ গুলির শব্দ হলো।

 মুসার কানের পাশ দিয়ে চলে গেল বুলেট। থ্যাক করে বিধল একটা গাছে। কলরব করে উড়ে গেল একঝাঁক পাখি।

গুলির পর পরই ঝাঁপ দিয়েছে তিনজনে। উপুড় হয়ে শুয়ে পড়েছে মাটিতে।

আবার গুলি হলো। মাথার ওপর দিয়ে বাতাস কাটার শব্দ তুলে বেরিয়ে গেল বুলেট। শুয়ে শুয়েই তাকাল ওরা পরস্পরের দিকে।

কেউ গুলি করছে ওদের লক্ষ করে!

Super User