তোমাদের কার্ডটা পেয়ে মনে হলো হাতে চাঁদ পেয়েছি, বললেন মিস কারমাইকেল। ওই মুহূর্তে তোমাদের মতই কারও কথা ভাবছিলাম। গোয়েন্দা।

মেসেজ পাওয়ার পরই সাইকেল নিয়ে মিউজিক নেস্ট-এ চলে এসেছে তিন গোয়েন্দা। মিস কারমাইকেলের সাউণ্ডপ্রুফ ঘরে বসে কথা বলছে।

পুলিশকে জানাইনি, কাঁধে বসা তোতাটাকে আদর করলেন মিস কারমাইকেল। ইতিমধ্যেই বার কয়েক ঝামেলা করে গেছে। নালিশ জানিয়েছে, প্রতিবেশীরা নাকি আমার পাখিদের জ্বালায় অস্থির। ভেবেই পাই না, ওদের কি এমন জুালাচ্ছে পাখিগুলো।

আমি আপনার প্রতিবেশী হলে নালিশ জানাতাম না, বহু আগেই তল্লাট ছেড়ে পালাতাম, মনে মনে বলল মুসা।

মহিলার কথা কিশোরের কানে ঢুকছে বলে মনে হলো না। গভীর মনোযোগে লাশ পরীক্ষা করছে। টেবিলে বিছানো সাদা কাপড়ের ওপর রাখা হয়েছে মৃত পাখি দুটোকে। দোয়েলের মাথা থেঁতলে দেয়া হয়েছে, বোধহয় লাঠি দিয়ে বাড়ি মেরে। বাজটার গায়ে কোন ক্ষত নেই। বিষ খাইয়ে মেরেছে, মনে হয়।

বাজটাকে কি খাওয়ান? ফিরে জিজ্ঞেস করল কিশোর।

মাংস, বললেন মিস কারমাইকেল। জানো নিশ্চয়, ওরা মাংসাশী। সাংঘাতিক ধূর্ত শিকারী। ইদুর, খরগোশ, ছোট ছোট পাখি, যা পায় ধরে খায়। খাওয়ার জন্যেই শিকার করে তো, দোষ দিতে পারি না। তবু একেক সময় মনে হয় বড় বেশি নিষ্ঠুর ওরা।

নিষ্ঠুর প্রতিধ্বনি করল কাঁধে বসা তোতা, নিষ্ঠুর নিষ্ঠুর! এই একটা শব্দই শিখেছে নাকি, ভাবল মুসা।

মাথা নেড়ে লাশ দুটো দেখিয়ে প্রশ্ন করল কিশোর, পেয়েছেন কোথায়, মানে, কোথায় পড়েছিল?

হীরা পড়ে ছিল লনের ধারে। বেচারাকে তোলার কথা ভাবছি, এই সময় চোখ পড়ল… রুমাল বের করে চোখ মুছলেন মিস কারমাইকেল। দেখলাম, টীল পড়ে আছে গাছের তলায়। কুঁপিয়ে উঠলেন তিনি। কোনমতে বললেন, ওর খাওয়া…যেমন ছিল তেমনি পড়ে আছে। খায়নি। পাথর হয়ে ও পড়ে আছে গাছতলায়…আর কোন দিন উড়বে না… শব্দ করে কেঁদে ফেললেন তিনি।

সহানুভূতি দেখিয়ে মাথা নাড়ল কিশোর। মহিলার উচ্ছাস থামার সময় দিল। তারপর জিজ্ঞেস করল, জায়গাটা দেখাবেন?

নিশ্চই, জানালা দিয়ে তাকালেন মিস কারমাইকেল। অন্ধকার হয়ে গেছে। দাঁড়াও, একটা টর্চ বের করি।

লাগবে না, বলল কিশোর। আমাদের সাইকেলে লাইট আছে, খুলে নেব। চলুন।

সূর্য ডোবার পর নীরব হয়ে গেছে পাখির দল। মিস কারমাইকেলের পেছনে আলো হাতে হাঁটছে তিন গোয়েন্দা। মাঝেসাঝে পেঁচার কর্কশ ডাক কানে আসছে। তার জবাবেই যেন অন্ধকার ডাল থেকে হেসে উঠছে কোন কাকাতুয়া, বুড়ো মানুষের খসখসে হাসির মত।

ওই যে ওখানে পড়েছিল হীরা, ভাঙা গলায় বললেন মিস কারমাইকেল।

জায়গাটায় আলো ফেলল কিশোর। নিচু হয়ে একটা রক্তাক্ত পালক তুলল।

কেঁপে উঠলেন মিস কারমাইকেল। বাজপাখিটা পড়ে ছিল ওই গাছতলায়।…কিছু যদি মনে করো, আমি যাই। একটু শোব। ভাল লাগছে না।

বুকের ওপর দুই হাত আড়াআড়ি চেপে ধরে দ্রুত বাড়ির দিকে রওনা হলেন মিস কারমাইকেল।

মহিলার অবস্থা দেখে দুঃখই হলো কিশোরের, একই সঙ্গে দুই সন্তান মারা গেছে যেন তার। তবে তিনি চলে যাওয়ায় খুশিও হয়েছে, কাজ করতে অস্বস্তি বোধ করছিল।

বাজটা যেখানে পড়েছিল সেখানে এসে দাঁড়াল কিশোর। একটা পালকও নেই। মাংসের টুকরোও না। বিষ খেয়েই যদি মারা গিয়ে থাকে বাজটা, হয় অন্য কোথাও থেকে খেয়ে এসেছে, কিংবা ওটার খাওয়া শেষ হওয়ার পর এসে সব কিছু পরিষ্কার করে দিয়ে গেছে যে খাইয়েছে।

আশেপাশের অনেকখানি জায়গায় ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে আলো ফেলে দেখল কিশোর। খুব খারাপ, নিচের ঠোঁটে চিমটি কাটা শুরু হলো তার।

কি খারাপ? জিজ্ঞেস করল রবিন।

শক্ত মাটি, এর চেয়ে বেশি কিছু বলার দরকার মনে করল না আপাতত কিশোর, সময়ও নেই, কাজ রয়েছে। রবিন, তুমি ওদিকের বনে ঢোকো। মুসা, তুমি এদিকে। মাঝের জায়গাটায় আমি ঢুকছি। ঠিক আছে?

তা আছে, মাথা কাত করল মুসা। কিন্তু কিশোর, একটা কথা বলবে?

কি?

খুঁজছ কি তুমি?

পায়ের ছাপ, আরার মাটিতে আলো ফেলল কিশোর। পড়েনি, বেশ শক্ত মাটি। তবে দিন দুই আগে বৃষ্টি হয়েছে, বনের কোথাও কোথাও নরম মাটি আছেই। ভিজে নরম হয়ে আছে। মিস কারমাইকেলের প্রতিবেশীদের কথা যা শুনলাম, মনে হয় না কেউ তার সঙ্গে আলাপ করতে আসে। তাই, যদি কারও পায়ের ছাপ পাওয়া যায়, ধরে নিতে হবে সেটা খুনীর।

চমৎকার, অনেকটা টিটকারির সুরে বলল মুসা। যদি পেয়ে যাই, তো কি করবে? প্লাসটার কাস্ট করে ল্যাবোরেটরিতে পাঠাব?

হতাশ ভঙ্গিতে মাথা নাড়ল কিশোর। এই সহজ কথাটাও বুঝছ না। রিংকির কথা ভুলে গেছ? ওর জুতো দেখোনি? কত বড়? তাছাড়া চোখা মাথা। এবার বুঝেছ?

চোখা হলে তো বুঝলাম ব্লিংকির, কথা কল রবিন, আর যদি তা না হয়? কি বুঝব?

সেটা তখন ভাবা যাবে।

ছাপ দেখতে পেলে কি করব? মুসার প্রশ্ন।

আলোর সঙ্কেত দেবে। জালবে-নেভাবে জালবে-নেভাবে, তিন বার করে, খানিক বিরতি দিয়ে আবার তিন বার। যতক্ষণ জবাব না পাবে, দিয়েই যাবে।

তিনজন তিন দিকে রওনা হয়ে গেল।

সামান্য ঝুঁকে পা পা করে এগোচ্ছে কিশোর, বার বার লাইট ঘুরিয়ে দেখছে সামনে আর আশেপাশে। তার মনে হচ্ছে, মাঝের দিকটা বেছে নিয়ে ঠিক করেনি, এদিকে সুবিধে হবে না। ছাপ পাওয়ার আশা নেই। ঘন ঝোপঝাড়, নুড়ি আর বালিতে ঢাকা সরু পথ। এখানে পায়ের ছাপ বসবে না।

মুসা আর রবিনও নিশ্চয় কিছু দেখতে পায়নি, পেলে সঙ্কেত দিত। ফিরে যাবে। কিনা ভাবছে কিশোর, এই সময় চোখে পড়ল ডানের ঝোপে কালোমত কি যেন। থমকে গেল সে।

স্থির দাঁড়িয়ে রইল এক মুহূর্ত। হঠাৎ করেই নড়ে উঠল, প্রায় দৌড়ে এসে বসে পড়ল এটার কাছে।

অন্ধকারে কাছেই কোথাও কর্কশ চিৎকারে নীরবতা ভাঙল একটা পেঁচা। কিশোরের মনোযোগ ছিন্ন করতে পারল না বটে, কিন্তু পেছনে নড়াচড়ার শব্দটা ঢেকে দিল পাখির ডাক।

হালকা খসখস শব্দটা বড় বেশি দেরিতে কানে এল কিশোরের। গোড়ালিতে ভর করে বসা অবস্থায়ই পাই করে ঘুরল। সরে যাওয়ার চেষ্টা করল, পারল না, তবে মাথাটা বাচল। শক্ত লাঠির আঘাত কান দুয়ে শিস কেটে এসে লাগল কাঁধে।

তীব্র বেদনার পর পরই মনে হলো অবশ হয়ে গেছে ডান হাত। আঙুলগুলো কোনমতে ধরে রইল লাইটটা। এক পাশে কাত হয়ে পড়ল সে, গড়ান দিয়েই চিত হলো, লাইটটা বুকের ওপর ধরে লেসটা ফেরাল কোণাকুণি ওপর দিকে।

কালো অয়েলফিন পরা একজন মানুষের মুখে পড়ল আলো।

মুখ না বলে বলা যায় দাড়ির জঙ্গল। নাক দেখা যাচ্ছে, ঠোঁট অস্পষ্ট। চোখ দুটোও এখন দেখা যায় না, কালো চশমায় ঢাকা।

চোখে আলো পড়ায় স্থির হয়ে গেল লোকটা, পরক্ষণেই ঘুরে এক দৌড়ে ঢুকে গেল পাশের ঘন জঙ্গলে। পিছু নেয়ার চেষ্টা করল না কিশোর। উঠে দাঁড়াল। শরীর কাঁপছে। বাঁ হাতে ডলতে শুরু করল কাপ। শুরু হলো তীব্র ব্যথা; অবশ ভাবটা কেটে যাচ্ছে ধীরে ধীরে। লাইটের লেন্স একটা বিশেষ দিকে ফিরিয়ে হাত দিয়ে ঢাকল, সরাল, আবার ঢাকল, আবার সরাল,পর পর তিনবার করল এরকম। সাড়া এল না। আবার একই রকম করল। থামল। আবার সঙ্কেত দিল।

সঙ্কেতের জবাব দিল মুসা। ছুটে আসতে শুরু করল।

কিশোর?

এই যে, এখানে আমি।

ঝোপের ওপাশ থেকে ঘুরে এসে দাঁড়াল মুসা। একটু পরেই উল্টো দিক থেকে এসে পৌছুল রবিন।

কাঁধ ডলেই চলেছে কিশোর। ব্যথা একটু কমছে মনে হচ্ছে।

কি হয়েছে, কিশোর উদ্বিগ্ন হয়ে প্রশ্ন করল রবিন।

রিচার্ড হ্যারিস, বলল কিশোর। ব্যাটা আমাকে লাঠি দিয়ে বাড়ি মেরেছে। কপাল ভাল মাথায় লাগেনি, তাহলে গেছিলাম।-মুখে আলো পড়তেই চমকে গেল, ছুটে পালাল। ওই যে ওদিকে, হাত তুলে দেখাল। কোন শব্দ শোনোনি? দেখেছ ওকে?

নাহ্। ঝোপঝাড় খুব বেশি। আর গেটের দিকে গিয়ে থাকলে আমার কাছ দিয়ে যাওয়ার কথা না।

পিছু নেব নাকি? বলল বটে মুস্য, কিন্তু অন্ধকারে একটা বাজে লোককে অনুসরণের কথা ভাবতেই জানি কেমন লাগছে, তাছাড়া লোকটার হাতে রয়েছে। মোটা লাঠি, অন্যের মাথায় বাড়ি মারার প্রবণতাও আছে।

না, মুসার মত একই কথা ভাবছে কিশোরও। একটা কিছু আছে এখানে, ওব্যাটার জন্যে দেখতে পারিনি ভালমত। আলো ফোল ঝোপের কিনারে। কালোমত বস্তুটার কাছে এসে বলল আবার, তার পাশে বসল রবিন আর মুসা।

খাইছে! মুসা চেঁচিয়ে উঠল এ-যে দেখছি, এ-যে দেখছি…

হ্যাঁ, কাল কিশোর, ঠিকই দেখছ। মরা কবুতর।

কবুতর না বলে বলা উচিত কবুতরের অবশিষ্ট। মাথাসহ শরীরের ওপরের অংশ নেই, টেনে ছিড়ে ফেলা হয়েছে, বাকি রয়েছে লেজের কাছের অতি সামান্য চামড়া আর মাংস, পালকগুলো গেঁথে রয়েছে তাতে। একটা ডানার খানিকটা আর পা দুটোও আছে।

হাত বাড়িয়ে একটা পা তুলে নিল কিশোর। গোড়ালিতে অ্যালুমিনিয়মের পাতলা আংটা পরানো। নিজের লাইট মাটিতে রেখে রবিনের লাইটের আলোয় পা থেকে জিনিসটা খুলল সে, পাতলা মোড়কের ভেতর ছোট একটা উজ করা কাগজ। সাবধানে মোড়কের জোড়া দুটিয়ে সোজা করল, ভেতরের কাগজ বের করে মেলল। সমান করল হাত দিয়ে ডলে।

বুকের মত গলা বাড়িয়ে দুপাশ থেকে কাগজটার ওপর ঝুঁকে এল অন্য দুজন।

হায় হায়, এটা কি ভাষা? বলে উঠল মুসা। চীনা নাকি?

ছাপার অক্ষর হলে হয়তো বোঝা যেত, কিন্তু হাতে লেখা, তাই প্রথমে রবিনও চিনতে পারল না। চীনাই বোধহয়, বিড়বিড় করল সে। না না, জাপানী পাঠকও আছে, বই নিতে আসে। চিনি কয়েকজনকে।

চিন্তিত জিতে মাথা নাড়ল কিশোর, কাগজটা বহ করে রেখে দিল পকেটে। তারপর বুকে আবারদেখতে লাগল কবুতরের দেহাবশেষগুলো।

দেখো দেখো, উত্তেজিত কণ্ঠে বলল সে, বা পা-টা দেখো!

মুসা আর রবিনও দেখল।

যে-ই মেরেছে পাখিটাকে, কোন কারণে পা-দুটো নষ্ট করেনি, নিচের অংশ অক্ষত রয়েছে। বাঁ পায়ে তিনটের জায়গায় রয়েছে দুটো আঙুল।

<

Super User