শুনলে! থরথর করে কাঁপছে মুসা। ফিসফিস করতেও ভয় পাচ্ছে। ভুতটা আমাদের সঙ্গে যাবে বলছে চল, পালাই।

থাম! সঙ্গীর হাত খামচে ধরল কিশোর।

থা-মো! আবার শোনা গেল। কাঁপা কাঁপা কথা।

হুঁ, বুঝেছি, বলল কিশোর। প্ৰতিধ্বনি, আর কিছু না। খেয়াল করেছ। কতবড় ঘর? দেয়ালের কোন কোণ নেই, ড্রামের দেয়ালের মত গোল। এতে শব্দ প্ৰতিধ্বনিত হয় খুব বেশি। ইচ্ছে করেই হয়ত এমন ঘর তৈরি করিয়েছে জন ফিলবি, কোন বিশেষ উদ্দেশ্যে। নামও রেখেছে। মিলিয়ে, ইকো রুম।

ড়ু-ম! কানের কাছে ফিসফিসিয়ে উঠল আবার কাঁপা প্ৰতিধ্বনি।

কিশোরের কথা ঠিক, বুঝতে পারল মুসা। ভয় কেটে যাচ্ছে। সাধারণ একটা ব্যাপার তাকে কি রকম ভয় পাইয়ে দিয়েছিল ভেবে লজা পেল মনে মনে। ফিরে গিয়ে রবিনকে নিশ্চয় কথাটা বলবে কিশোর। তাকে নিয়ে হাসাহাসি করবে। তাই বলল, আসলে, আগেই বুঝতে পেরেছি। আমি। ভয় পাওয়ার ভান করছিলাম। শুধু। এবং কথাটা প্রমাণ করার জন্যেই জোরে হা-হা করে হেসে উঠল।

সঙ্গে সঙ্গে উঠল প্রতিধ্বনিঃ হাঃ হাঃ হাঃ হাঃ হাঃ হাঃ আ-আ-আ! ধীরে ধীরে অনেক দূরে কোথাও মিলিয়ে গেল যেন শব্দের রেশ।

ঢোক গিলল মুসা। কাণ্ডটা আমি করলাম জোরে কথা বলতে ভয় পাচ্ছে, ফিসফিসিয়ে বলল।

তো কে করল? নিচু গলায় বলল কিশোর। যা করেছি, করেছি, আর কোরো না।

পগলা ফিসফিস করে বলল মুসা। কথাই বলব না জোরে!

কথা বলবে না কেন? এস, টেনে সঙ্গীকে এক পাশে নিয়ে গেল কিশোর। ঘরের ঠিক মাঝামাঝি দাঁড়িয়ে কথা বললে প্ৰতিধ্বনি হবে। এখানে বলতে পার নিশ্চিন্তে।

তাহলে আগে আমাকে বলে নিলেই পারতো ক্ষুন্ন মনে হল মুসাকে।

আমি তো জানি প্রতিধ্বনির নিয়ম-কানুন সব তোমারও জানা আছে বলল কিশোর। পড়নি?

পড়েছি, স্বীকার করল মুসা। কিন্তু ভুলে গিয়েছিলাম। আচ্ছা, পুবের কোন অঞ্চল থেকে এসেছিল একটা পরিবার, একটা রাতও কাটাতে পারেনি। এখানে, ভেগেছে। কেন, বুঝেছ কিছু?

পশ্চিমে সুবিধে করতে পারবে না ভেবে হয়ত আবার পুবেই ফিরে গেছে, নির্লিপ্ত গলা কিশোরের। তবে এটা ঠিক, বিশ বছরে কেউ পুরো একটা রাত কাটাতে পারেনি। এখানে। আমাদের জানতে হবে, কি কারণে এত ভয় পেল ওরা!

কারণ আর কি? ভূতা বলল মুসা। ঘরের চারদিকে টর্চের আলো ফেলছে সে। হলের এক প্ৰান্ত থেকে একটা সিঁড়ি উঠে গেছে দোতলায়! কিন্তু ওই সিড়ি বেয়ে ওপরে যাবার কোন ইচ্ছেই। তার নেই। কোন কোন জায়গার দেয়াল বিচিত্র রঙিন কাপড়ে ঢাকা, নষ্ট হয়ে গেছে কাপড়গুলো। তার নিচে কারুকাজ করা কাঠের বেঞ্চ পাতা। দেয়ালের গায়ে মাঝে মাঝেই ছোট ছোট চৌকোেনা তাক। ওগুলোতে দাঁড় করিয়ে রাখা রয়েছে প্রাচীন বর্মপোশাক।

কয়েকটা বড় বড় ছবি বুলিছে দেয়ালে। আলো ফেলে ফেলে। প্রতিটি ছবি দেখছে মুসা। বিভিন্ন পোশাকে বিভিন্ন ভঙ্গিতে সব একজন লোকের ছবি। একটা ছবিতে সম্রান্ত এক ইংরেজের পোশাকে দেখা যাচ্ছে তাকে। পাশেই আরেকটাতে হয়ে গেছে কুজো অদ্ভুত পোশাক পরা একচোখা এক জলদস্যু।

অনুমান করল মুসা, ছবিগুলো দুর্গের মালিক, জন ফিলবির। সেই নির্বাক সিনেমার যুগের নাম করা কিছু ছবি দৃশ্য বড় করে এঁকে দেয়ালে সাজিয়ে রেখেছে। অভিনেতা।

চুপ করে থেকে এতক্ষণ বোঝার চেষ্টা করলাম, হঠাৎ বলল কিশোর। কই, মুহূর্তের জন্যেও তো ভয় টের পেলাম না! তবে একটু কেমন কেমন যে করছে না, তা নয়!

আমারও, জানোল মুসা। তবে ভয় ঠিক পাচ্ছি না। অনেক পুরানো একটা বাড়িতে দাঁড়িয়ে থাকলে যেমন হয়, তেমন অনুভূতি হচ্ছে।

নোট পড়ে জেনেছি, চিন্তিত দেখাচ্ছে কিশোরকে, লোকের ওপর প্রতিক্রিয়া ঘটাতে সময় নেয় টেরর ক্যাসল। শুরুতে হালকা এক ধরনের অস্বস্তিবোধ জন্মে। আস্তে আস্তে বাড়ে। প্ৰচণ্ড আতঙ্কে রূপ নেয় এক সময়।

কিশোরের শেষ কথাটা পুরোপুরি কানে ঢুকল না। মুসার। দেয়ালে টাঙানো একটা ছবির ওপর আটকে গেছে তার দৃষ্টি। হঠাৎ এক ধরনের অস্বস্তিবোধ চেপে ধরছে তাকে। ক্রমেই বাড়ছে সেটা।

মুসার দিকে চেয়ে আছে একচোখা জলদুস্যা নষ্ট চোখটা গোল করে কাটা কালো কাপড়ে ঢাকা। কিন্তু ভাল চোখটা জ্যান্ত চোখের মতই চেয়ে আছে যেন তার দিকে। জ্বলছে। হালকা লালচে একটা আভা বিকিরণ করছে যেন! কিন্তু ও-কি দ্রুত একবার চোখের পাতা পড়ল না!

কিশোর, গলা দিয়ে কোলা ব্যাঙের ঘড়ঘড়ে আওয়াজ বেরোল মুসার। ছবিটা! …আমাদের দিকেই চেয়ে আছে।

কোন ছবি!

ওই যে, ওটা। টর্চের আলোর রশ্মি নাচিয়ে ছবিটা নির্দেশ করল। মুসা। আমাদের দিকেই চেয়ে আছে।

দৃষ্টি বিভ্রম, জবাব দিল কিশোর। ইচ্ছে করেই এমনভাবে আকে শিল্পী, মনে হয় দর্শকের দিকেই চেয়ে আছে চোখ। যেদিক থেকেই দেখ না কেন, তোমার দিকেই চেয়ে আছে মনে হবে।

কিন্তু…কিন্তু ওটা রঙে আঁকা চোখ নয়!। প্রতিবাদ করল মুসা। ওটা.ওটা সত্যিকারের চোখ..জ্যান্ত চোখ!

সে তোমার মনে হচ্ছে। ওটা রঙে আঁকা চোখই। চল, কাছ থেকে দেখি।

ছবিটার কাছে এগিয়ে গেল কিশোর। একমুহূর্ত দ্বিধা করে শেষে তাকে অনুসরণ করল মুসা। দুজনেই আলো ফেলল। ছবির ওপর ঠিক, কিশোরের কথাই ঠিক। রঙে আঁকা চোখ ওটা। তবে আঁকা হয়েছে দক্ষ হাতে। একেবারে জ্যান্ত মনে হচ্ছে।

হ্যাঁ রঙে আঁকা। চিন্তিত ভঙ্গিতে মাথা ঝোঁকাল মুসা। কিন্তু মেনে নিতে পারছি না! চোখের পাতা পলক ফেলতে দেখছি..আরে। হঠাৎ যেন কথা আটকে গেল তার। কিছু টের পাচ্ছি।

ঠাণ্ডা, অবাক শোনাল কিশোরের গলা। ঠাণ্ডা একটা অঞ্চলে এসে ঢুকেছি। আমরা। এরকম ঠাণ্ডা আবহাওয়া সব পোড়ো বাড়িতেই কিছু কিছু জায়গায় থাকে।

তাহলে স্বীকার করছি এটা পোড়ো বাড়িা রীতিমত কাঁপছে মুসা। দাঁতে দাঁতে বাড়ি খাওয়া শুরু হয়েছে। ভীষণ শীত করছে। মেরু অঞ্চলে এসে ঢুকলাম নাকিরে বাবা। ভূত, সব ভুত এসে ঝাঁপিয়ে পড়ছে আমার ওপর। কিশোর, ভয় পাচ্ছি আমি।

নিজেকে স্থির রাখার জোর চেষ্টা চালাচ্ছে মুসা। কিন্তু দাঁতে দাঁতে বাড়ি খাওয়া রোধ করতে পারছে না। কোথা থেকে গায়ে এসে লাগছে। তীব্র ঠাণ্ডা হাওয়ার স্রোত। তারপরই চোখে পড়ল, বাতাসে। হালকা ধোঁয়া। সূক্ষ্ম, অতি হালকা ধোঁয়ার ভেতর থেকে ধীরে ধীরে রূপ নিচ্ছে যেন একটা শরীর। মুহূর্তে ভয় প্রচণ্ড আতঙ্কে পরিণত হল। পাই করে ঘুরল মুসা। কথা শুনল না পা। তাড়িয়ে বের করে নিয়ে এল তাকে ঠাণ্ডা অঞ্চল থেকে। হল পার করে এনে বারান্দায় ফেলল। সেখান থেকে প্ৰায় উড়িয়ে নামিয়ে আনল সিঁড়ির নিচে, প্রাঙ্গনে, পথে। পেছনে তাড়া করে আসছে পায়ের শব্দ। আরও জোরে ছুটল মুসা।

ক্রমেই কাছে এসে যাচ্ছে পায়ের শব্দ। দেখতে দেখতে পাশে এসে গেল। হাল ছেড়ে দিল মুসা। পাশে চাইল। আরো কিশোর

অবাকই হল মুসা। তিন গোয়েন্দার নেতাকে কোন কারণে এত ভয় পেতে এর আগে কখনও দেখেনি সে।

কি হল? তোমার পা-ও হুকুম মানছে না? ছুটতে ছুটতেই জিজ্ঞেস করল মুসা।

মানছে তো। ওদেরকে ছোেটার হুকুম দিয়েছি। আমি, চেঁচিয়ে জবাব দিল কিশোর।

থামল না। ওরা। ছুটেই চলল। হাতে ধরা টর্চে ঝাঁকুনি লাগছে অনবরত, পথের ওপর অদ্ভূত ভঙ্গিতে নাচছে আলোর রশ্মি। টেরর ক্যাসলের কাছ থেকে দ্রুত সরে যাচ্ছে ওরা।

<

Super User