শারিকে নিয়ে ভাবনা হচ্ছে আমার, পরদিন সকালে নাস্তার টেবিলে বললেন ডজ।
ডিম ভাজা মুখে পুরে দিয়ে মুসা বলল, কি হয়েছে? মন খারাপ? মুখ গোমড়া? আকাশের তারা দেখে খালি?
টেবিলের নিচ দিয়ে ওর পায়ে লাথি মারল কিশোর।
মুসার কথা যেন কানেই যায়নি ডজের। আবার নার্ভাস লাগছে তাঁকে। খাবার প্রায় খেলেনই না। মাঠে থাকলে বিপদে পড়ে যাবে বারোটা।
সকালে ওটাকে মাঠে দেখেছে মুসা। তার মনে হয়েছে আরামেই আছে জানোয়ারটা। তাজা চেহারা। ঘাস খাচ্ছিল। চোখ চকচকে, চামড়া উজ্জ্বল, মসৃণ। ছাউনির বাইরে ছিল, কিশোরকে দেখেই ছুটে এসেছে। গাধার তুলনায় জোরেই ছোটে।
সেসব বলল না কিশোর। বলা যায় না, চুপ করে থাকলে রহস্যের আরেকটা সূত্র ধরিয়ে দিতে পারেন ডজ। নিরীহ ভঙ্গিতে বলল, শারি কি খাচ্ছে না?
ওর খুর নিয়ে ভাবনা হচ্ছে আমার। কফির কাপে চুমুক দেয়ার আগে ভ্রূকুটি করলেন ডজ। জানো হয়তো, বারোদের আদি নিবাস ছিল উত্তর আফ্রিকায়। যা শক্ত, পাথুরে মাটিতে হেঁটে আস্ত মানুষের নখের মতই ওদের খুরও দ্রুত বাড়ে। শক্ত মাটিতে ঘষা লেগে ক্ষয়ে গিয়ে স্বাভাবিক থাকে। কিন্তু এখানকার মত নরম মাটিতে থাকলে বেড়ে দ্বিগুণ হয়ে গেলেও অবাক হব না। কাপটা নামিয়ে রাখলেন তিনি। আর এ হারে বাড়তে থাকলে খোঁড়া হতে সময় লাগবে না।
ছেটে ফেলা যায় না? জানতে চাইল মুসা। একবার একজনকে ক্ষুর দিয়ে গাধার খুর চেঁচে দিতে দেখেছিল সে।
নাহ! ভুরু কুঁচকেই রেখেছেন ডজ। ওর মত একটা বুনো বারো কাছেই ঘেষতে দেবে না আমাকে। ওর পা ছোঁয়ার চেষ্টা করলেই লাথি মেরে ঘিলু বের করে দেবে আমার।
কিশোর ভাবল, শারি হয়তো তাকে পা ছুঁতে দেবে। চুপ করে রইল সে। ওর মনে হলো কিছু একটা বলতে যাচ্ছেন ডজ। শারির খুরের ব্যাপার নয়, অন্য কিছু।
মনে হচ্ছে, ডজ বললেন, শেষ পর্যন্ত ছেড়েই দিতে হবে ওকে। যেখান থেকে এসেছে সেই পর্বতেই ফিরে যাক। কিশোরের দিকে তাকাল সে। কিন্তু, গোলমালটা হলো, ও এখন যেতে চাইবে না। কারণ তুমি রয়েছ এখানে।
কিশোরের মনে হলো, বহুদিন ধরেই তো আছে শারি, তার খুরও বেড়েছে, তাহলে এতদিন ওকে ছেড়ে দেয়ার কথা ভাবেননি কেন ডজ? তবে জিজ্ঞেস করল না। আপনা-আপনিই সে কথায় যাবেন। আর ওটা একটা জরুরি সূত্র। তিন গোয়েন্দাকে রহস্য সমাধানে এগিয়ে দেবে একধাপ।
কিশোর, ওকে ছেড়ে আসতে হলে তোমাকে সঙ্গে যেতে হবে, চিন্তিত ভঙ্গিতে বললেন ডজ। আসলে, যেতে হবে আমাদের সবাইকেই। ভাবছি, পর্বতের ওদিকটায় ক্যাম্পিং করতে গেলে কেমন হয়? এক এক করে তিন গোয়েন্দার দিকে তাকালেন তিনি। কি বলো?
কিশোরের কাছে ব্যাপারটা একেবারেই হাস্যকর আর ছেলেমানুষী মনে হলো। একটা গাধাকে ছাড়তে সবাই মিলে যাওয়া! রবিনের দিকে তাকিয়ে দেখল সে-ও ওরই দিকে তাকিয়ে আছে। চোখ টিপল কিশোর।
সাথে সাথে বুঝতে পারল রবিন। তিনজনে মিলে একান্তে আলোচনা না করা পর্যন্ত ব্যাপারটা নিয়ে কথা বলতে মানা করছে গোয়েন্দাপ্রধান।
ডজের দিকে তাকাল রবিন। ঠিক আছে। আমরা জানাব আপনাকে।
কখন? উদ্বিগ্ন হয়ে জানতে চাইলেন ডজ। কত তাড়াতাড়ি…
যত তাড়াতাড়ি আমরা মনস্থির করতে পারব, জবাব দিল মুসা। উঠে দরজার দিকে রওনা হলো সে। দরজার কাছে গিয়ে ঘুরে দাঁড়িয়ে বলল, কিশোর, চলো ঘুরে আসি।
ইঙ্গিতটা বুঝতে পারলেন কিনা ডজ, কে জানে। চুপ করে রইলেন।
কিশোর আর রবিনও উঠে মুসার পেছনে চলল। বারান্দা থেকে নেমে মাঠের দিকে এগোল তিনজনে। ঘর থেকে যাতে না শোনা যায় এতটা দূরে এসে থামল।
মনে হয় আসল সময় এসে গেছে, ঘাসের ওপর বসে বলল রবিন। পর্বতে যাওয়ার অন্য কোন উদ্দেশ্য আছে। কিশোর, তোমার কি মনে হয়?
আছে, মাথা কঁকাল কিশোর। আর সেটার জন্যেই আমাকে প্রয়োজন ডজের। আমার কণ্ঠ তার প্রয়োজন। যাতে শারি পালিয়ে না যায়। কোথাও আমাদেরকে নিয়ে যাবে গাধাটা। পর্বতের কোন জায়গায়, যেখান থেকে এসেছে।
কোনখান থেকে এল? দূরের উঁচু পাহাড় চূড়ার দিকে তাকিয়ে আছে মুসা। কি আছে ওখানে? স্বর্ণ?
কিংবা সিয়েরা মাদ্রের গুপ্তধন, কিছুটা ব্যঙ্গের সুরেই বলল রবিন। একটা ঘাসের ডগা ছিড়ে নিয়ে দাঁতে কাটতে লাগল। তো, কি ভাবছ, কিশোর? যাবে?
আমি তো যাবই, কিশোরের আগেই বলে উঠল মুসা। ক্যাম্পিং ওর ভীষণ ভাল লাগে। রাতে আগুনের ধারে বসে মাংস ঝলসে খাওয়া, খোলা আকাশের নিচে স্লীপিং ব্যাগের ভেতরে ঘুমানো আহ, কি মজা! তোমরা যাবে না? পথ নিশ্চয় খুব খারাপ হবে।
খারাপ মানে? রবিন বলল। খারাপের চেয়ে খারাপ। পাথর আর বালির ছড়াছড়ি। কিশোরের দিকে তাকাল। তুমি কি বলো?
বেড়াতে খারাপ লাগে না কিশোরের। যেতে কষ্ট হবে। কি আর করা। রহস্যের সমাধান করতে গেলে খাটুনি তো একটু লাগবেই। যত কষ্টই হোক, ভাবল সে, এই রহস্যের কিনারা করেই ছাড়বে।
যাব, রবিনের কথার জবাবে বলল কিশোর। চলো, ডজকে গিয়ে জানাই।
ডজের জন্যে এটা সুখবর। মুসা বলতেই চওড়া হাসি হাসলেন। তাহলে কালই রওনা হওয়া যাক, কি বলো? রাজি হলো তিন গোয়েন্দা।
হাসিমুখে বেরিয়ে গেলেন ডজ। গাড়ি নিয়ে চলে গেলেন লারেটোতে, প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র কেনার জন্যে। তিন গোয়েন্দা চলে গেল একেক জন একেক কাজে। মুসা গেল লেকে মাছ ধরতে। রবিন বারান্দায় বসল ওর মেকসিকোর ইতিহাস নিয়ে। কিশোর চলল পিরেটোর খোঁজে।
রান্নাঘরে পাওয়া গেল ওকে। একটা ওয়াকি-টকি মেরামত করছে। সব যন্ত্রপাতি খুলে ছড়িয়ে ফেলেছে, কিন্তু জোড়া লাগাতে পারছে না আর।
নাহ, আমাকে দিয়ে এসব হবে না! আনমনেই বিড়বিড় করল লোকটা। আমি রেডিওর কি বুঝি? গাধার মত খুলতে গেছি! আমি হলাম গিয়ে ঘোড়ার রাখাল। ইলেক্ট্রনিক্সের কি বুঝি?
দেখি, আমার কাছে দিন, হাত বাড়াল কিশোর। এসব মেরামত করতে পারি। কি হয়েছিল?
বোবা হয়ে গিয়েছিল। একেবারে চুপ।
ঠিক করে কি করবেন?
ওয়াকি-টকি দিয়ে কি করে? কথা বলব।
এখানে এই জিনিস আর কারও কাছে আছে নাকি? কার সঙ্গে কথা বলতে চায় পিরেটো, ভেবে অবাক হলো কিশোর। লেকের অন্য পাড়ের টাওয়ারটা ছাড়া আশপাশে আর কোন বাড়িই চোখে পড়েনি তার। র্যাঞ্চের কয়েক মাইলের মধ্যে নেই।
জানি না, জবাব দিল পিরেটো।
তাহলে ঠিক করতে চাইছেন কেন?
আরে! নষ্ট হলে ঠিক করব না?
তার জবাবে সন্তুষ্ট হতে পারল না কিশোর। আর প্রশ্ন না করে জিনিসটা নিয়ে বসল। গোলমালটা কোথায় খুঁজে বের করার চেষ্টা করল। মেরামত করতে সাধারণত যে ধরনের তার ব্যবহার হয়, সেটা পেল না। তাই ইলেকট্রিকের তারের ভেতরের সরু তার বের করে নিয়ে কাজ চালানোর চেষ্টা করতে লাগল।
অনেক আমেরিকানের সঙ্গেই আপনার পরিচয় আছে মনে হয়, কাজ করতে করতে বলল কিশোর। অল্প বয়েসী কজনের সঙ্গে জানাশোনা আছে?
নেই, গভীর আগ্রহে কিশোরের কাজ দেখছে পিরেটো। দারুণ হাত তো তোমার! আমেরিকার সবাই পারে নাকি?
সবাই পারে না। কেউ কেউ পারে। তথ্য জোগাড়ের জন্যে আবার প্রশ্ন করল কিশোর, অল্প বয়েসী কোন আমেরিকান এই র্যাঞ্চে ছিল নাকি? বেড়াতে-টেড়াতে এসেছিল?
কবে?
তিন-চার মাসের মধ্যে? শারি যখন এল তখন?
হাত ওল্টাল পিরেটো। কত লোকই তো যায় এপথে। মাঝেসাঝে থামে।
ওদের কারও গলার স্বর কি আমার মত ছিল? মনে আছে?
চেহারার কোন ভাবান্তর হলো না মেকসিকান লোকটার। তবে তার কালো চোখজোড়া হাসছে। উত্তর আমেরিকার সমস্ত মানুষকে একরকম লাগে আমার।
আমি গলার স্বরের কথা জিজ্ঞেস করেছি। যাই হোক, আপনার কাছে একরকম লাগলেও শারির কাছে নিশ্চয় তা লাগে না।
মানুষের চেয়ে বারোর কানের ক্ষমতা অনেক বেশি।
নাহ, সুবিধে হচ্ছে না। কিশোর তথ্য জোগাড় করতে চাইছে এটা বুঝে ফেলেছে পিরেটো। কাজেই মুখ খুলছে না। চাপাচাপি করে লাভ নেই।
যন্ত্রটা মেরামত করে জোড়া লাগিয়ে ফেলল কিশোর। সুইচ অন করল। কল সাইন দিয়ে কোন সাড়া মিলল না। অনেক ভাবে অ্যান্টেনা ঘুরিয়ে দেখল, জবাব এল না। তবে ওয়াকি-টকিটা যে কাজ করছে তাতে সন্দেহ নেই। সাড়া যেহেতু মিলছে না, তার মানে আর কারও কাছে ওয়াকি-টকি নেই। কিংবা হয়তো অন করা নেই।
হয়ে গেছে, বলল সে।
তোমরা আমেরিকানরা বড় চালাক।
কিছু কিছু ব্যাপারে আমেরিকানরা চালাক বটে, তবে কিছু ব্যাপারে আবার বোকাও, ভাবল কিশোর। যাই হোক, সে শুধু আমেরিকান নয়, বাঙালীও। আগামী দিন সকালে ওই মেকসিকান লোকটার চালাকি ধরতে চাইলে ওর আগেই ঘুম থেকে উঠতে হবে তাকে।
ওয়াকি-টকিটা তুলে নিয়ে কিশোরকে ধন্যবাদ জানাল পিরেটো। তারপর কিশোরের হাতটা ধরে আন্তরিক ভঙ্গিতে ঝাঁকিয়ে দিল। সময় করে একদিন অনেক কথা বলব তোমার সঙ্গে। একদিন, যখন… ফোন বেজে ওঠায় বাধা পড়ল তার কথায়। জবাব দেয়ার জন্যে অফিসে চলে গেল। ফিরে এল মুহূর্ত পরেই। তোমার ফোন।
নিশ্চয় ভিকটর সাইমন, ভাবল কিশোর। এখানে আর কারও তাকে ফোন করার কথা নয়।
কিন্তু মিস্টার সাইমন নন। সাড়া দিল একটা মহিলা কণ্ঠ। আমেরিকান। কিশোর পাশা?
হ্যাঁ, কে বলছেন?
তা না জানলেও চলবে। বললেও চিনবে না। তোমাকে একটা জিনিস দেখানো দরকার। তোমার জন্যে খুব জরুরি।
উত্তেজিত হয়ে উঠল কিশোর। কোন কেস হঠাৎ করে নতুন মোড় নিলে এরকম হয় তার। এখানে, র্যাঞ্চে চলে এলেই পারেন।
না! র্যাঞ্চের ব্যাপারে ভীত মনে হলো মহিলাকে। ডজ মরগানের র্যাঞ্চে যাওয়া উচিত হবে না আমার। বিপদে পড়ে যাব।
ডজ বাড়িতে নেই। ল্যারেটোতে গেছেন।
না, তবু যেতে পারব না, ভয় কাটাতে পারছে না মেয়েটা। অন্য কেউ দেখে বলে দিতে পারে ডজকে। আমি তোমার সঙ্গে দেখা করতে চাই। লেকের অন্য পাড়ে চলে এসো।
কি করে যেতে হবে বলে দিল মহিলা। র্যাঞ্চ ছাড়িয়ে কয়েক শো গজ গেলে লেকের পাড়ে একটা নৌকা দেখতে পাবে কিশোর। দাঁড় বেয়ে অন্য পাড়ে গিয়ে উঠে পড়বে ওপরে। বনের ভেতর দিয়ে গির্জার টাওয়ারের কাছে গেলে ছোট একটা গ্রাম দেখতে পাবে। গ্রামের প্রধান চত্বরে অপেক্ষা করবে মহিলা।
একা আসবে, বলে দিল মহিলা। কেউ যদি তোমার সঙ্গে থাকে, কিংবা আসার সময় কেউ তোমাকে দেখে ফেলেছে বলে মনে হয় আমার, লুকিয়ে পড়ব। আর আমাকে দেখতে পাবে না।
কি দেখাতে চাইছেন? জবাব নেই।
কেটে দিয়েছে লাইন।
<