গরগর করে উঠলো রাফি আর ডবি। পাই করে ঘুরলো সবাই। ডাইনীর মতো দেখতে মহিলাটা দাঁড়িয়ে আছে। মুখের ওপর এসে পড়েছে তার পাটের আঁশের মতো ফিনফিনে চুল।

কি ব্যাপার, মিসেস ডেনভার? দ্রকণ্ঠে বললো কিশোর। আমরা খামার দেখতে এসেছি। কিছু নষ্ট করব না।

করো আর না করো, সেটা ব্যাপার না, দাঁত নেই বলে সমস্ত কথা জড়িয়ে যাচ্ছে মহিলার, স্পষ্ট বোঝা যায় না। বাইরের কেউ আসুক এটা আমার ছেলে পছন্দ করে না।

কিন্তু এটা নিশ্চয় আপনার ছেলের জায়গা নয়, অবাক হয়েছে মুসা। মিস্টার ডাউসন আর তার বন্ধু…

তোমাদেরকে চলে যেতে বলা হয়েছে, চলে যাও, ব্যস, ওদের দিকে মুঠো তুলে ঝাঁকালো বৃদ্ধা। আমার ছেলে পছন্দ করে না।

এভাবে কথা বলা রাফিরও পছন্দ হলো না। বৃদ্ধার দিকে তাকিয়ে বেঁকিয়ে উঠলো সে। তার দিকে আঙুল তুলে গড়গড় করে কি সব বললো মহিলা, প্রায় কিছুই বোঝা গেল না। জিনার মনে হলো, মন্ত্র পড়লো বুড়ি! তাকে আরও অবাক করে দিয়ে ফাটা বেলুনের মতো চুপসে গেল রাফি, বসে পড়লো তার পায়ের কাছে।

রেগে উঠতে যাচ্ছিলো জিনা, তার হাত ধরে ইশারায় কথা বলতে নিষেধ করলো জনি। বৃদ্ধার দিকে ফিরে নরম গলায় বললো, আপনার ছেলেই তো থাকে না এখানে। কে এলো, না এলো, তাতে তার কি? আপনাকে এভাবে লোক তাড়াতে বলে গিয়েছে কেন?

চোখে পানি টলমল করতে লাগলো মহিলার। হাড়সব এক হাতের আঙুল আরেক হাতের আঙুলের খাঁজে ঢুকিয়ে চুপ করে রইলো এক মুহূর্ত। ধরা গলায় বললো, ওর কথা না শুনলে ও যে আমাকে মারে! হাত মুচড়ে দেয়! আমার ছেলে লোক ভালো না, খুব খারাপ। চলে যাও। তোমাদেরকে দেখলে রেগে যাবে। তোমাদেরও মারবে।

মহিলার কাছ থেকে সরে এলো ওরা।

জনি বললো, বুড়িটা পাগল। আমাদের রাধুনী বলে ওর ছেলে খারাপ নয়, অথচ বুড়ি বলে বেড়ায় খারাপ। মেরামতের কাজ খুব ভালো পারে তার ছেলে। মাঝে মাঝে আমাদের বাড়িতে আসে তো, দেখি। হাত আর বাড়িঘরের অন্যান্য মেরামতি কাজে ওস্তাদ। আমার মনে হয় বুড়ি বাড়িয়ে বলছে, তবে তার ছেলে খুব একটা ভালো লোকও নয়।

মিস্টার ডাউসনের বন্ধুটি কেমন? জিজ্ঞেস করলো কিশোর। ডরি, যাকে দেখলাম না।

জানি না। কখনও দেখিনি। বেশির ভাগ সময়ই বাইরে বাইরে থাকে। ব্যবসার দিকটা বোধহয় ও দেখে। এই ডিম, ভঁয়াপোকা, প্রজাপতি বিক্রির ব্যাপারটা।

খামারটা আরেকবার দেখতে ইচ্ছে করছে আমার, মুসা বললো। কিন্তু মিস্টার ডাউসন যেরকম করে তাকান, বুকের মধ্যে কাপ ধরে যায়। এতো কড়া চোখে চশমার কি দরকার? এমনিই তো দেখতে পারার কথা।

মাঝে মাঝে তুমি যে কি ছেলেমানুষের মতো কথা বলো না, হেসে বললো রবিন। চোখের কড়া দৃষ্টির সঙ্গে পাওয়ারের কি সম্পর্ক?

না, নেই। এমনি বললাম আরকি।

আমি আর যেতে চাই না ওখানে, জিনা বললো। বুড়িটা আস্ত ডাইনী। রাফিকে কিভাবে বশ করে ফেললো দেখলে?…তো এখন কোথায় যাবো?

ক্যাম্পে, কিশোর বললো। খিদে লেগেছে। জনি, তুমি আমাদের সাথে যাবে, না বাড়িতে কাজ আছে?

না, সব সেরে এসেছি। চলো যাই। তোমাদের সঙ্গে বসে খেতে ভালোই লাগবে।

ভাইয়া, আমিও যাবো, বায়না ধরলো ল্যারি। তার কোলে এখন চুপচাপ রয়েছে ভেড়ার বাচ্চাটা।

না, জনি বললো। মা চিন্তা করবে। তুমি বাড়ি ফিরে যাবে। চলো, আরেকটু এগিয়ে রাস্তা চিনিয়ে দেবো।

হ্যাঁ-না আর কিছু বললো না ল্যারি। মুখ গোমড়া করে রাখলো।

যাওয়ার সময় যতোটা সময় লেগেছিলো, ফিরতে লাগলো তার চেয়ে অনেক কম। জিনিসপত্র যেখানে যা রেখে গিয়েছিলো, ঠিক তেমনি রয়েছে। ভাঁড়ারের খাবারেও কেউ হাত দেয়নি।

হাসি-ঠাট্টার মাঝে খাওয়া শেষ করলো ওরা।

হাত-পা ছড়িয়ে চিত হয়ে শুয়ে পড়লো মুসা। বললো, সারাটা বিকেলই তো পড়ে আছে। এরপর কি করবো?

গোসল করতে পারলে ভালো হতো, জিনা বললো। যা গরম। বাড়িতে হলে তো এতোক্ষণে সাগরে থাকতাম।

গোসল করতে চাইলে অবশ্য এক জায়গায় নিয়ে যেতে পারি, জনি বললো। বড় একটা পুকুর আছে।

পুকুর? আগ্রহে লাফিয়ে উঠে বসলো মুসা। কোথায়?

ওই যে এয়ারফী দেখছো, হাত তুলে দেখালো জনি, ওখানে। এই ঝর্নার পানি কোথায় গিয়ে পড়েছে ভেবেছো একবারও? পাহাড়ের মোড় ঘুরে, উপত্যকা ধরে এগিয়ে গেছে, পথে ঘোট ঘোট খাড়ি তৈরি করেছে কয়েকটা। শেষে গিয়ে পড়েছে ওই পুকুরে। পুকুরটা প্রাকৃতিক, এই ঝর্নার পানি পড়ে পড়েই সৃষ্টি হয়েছে। কিনা কে জানে! খুব ঠাণ্ডা পানি। প্রায়ই গিয়ে ওখানে গোসল করি আমি।

শুনে তো ভালোই মনে হচ্ছে, কিশোর বললো। চলো না এখনই যাই।

এখন? রবিন বললো। এখন তো কাজই সারিনি। খাবারের বাক্স, টিন গোছাচ্ছে সে আর জিনা। ঠিকঠাক মতো নিয়ে গিয়ে আবার ভাঁড়ারে ভরে রাখছে।

অসুবিধে কি? আমরা যাই। তোমরা কাজ সেরে এসো।

ঠিক আছে, জিনা বললো, যাও।

 

এয়ারফীন্ডের দিকে রওনা হলো কিশোর, মুসা আর জনি। সকালে একটা বিমান দেখেছিলো, তারপর আর একটাও দেখা যায়নি। খুব নীরব এয়ারফীল্ড, ভাবলো কিশোর। সেকথা বললো জনিকে।

নীরব বলছো তো, জনি বললো হেসে। দাঁড়াও, আগে নতুন ফাইটারগুলোর পরীক্ষা শুরু হোক, তারপর বুঝবে। শব্দের জ্বালায় টেকা যাবে না। আমার খালাতো ভাই বলেছে শীঘ্রি পরীক্ষা শুরু হবে।

ফাইটার এনে পরীক্ষা করবে? মুসা বললো। তাহলে তো কাম সারা। কান ঝালাপালা করে দেবে। যা আওয়াজ।

তোমার খালাতো ভাই আছে যখন, কিশোর বললো, তাকে ধরে একদিন গিয়ে এয়ারফীন্ডটাও দেখে আসতে পারবো। পুরানো বিমান ঘাঁটি দেখার খুব শখ আমার।

আমারও, পেছন থেকে বলে উঠলো জিনা। কাজ সেরে চলে এসেছে।

এক জায়গায় এসে জনি বললো, এখান থেকে আমাদের বাড়ি বেশি দূরে না। গিয়ে সুইমস্যুট নিয়ে আসি। যাবো আর আসবো। এই ডবি, দৌড় দে।

আমরা কোন পথে যাবো? মুসা জিজ্ঞেস করলো।

সোজা চলে যাও। ওই যে দূরে বড় পাইন গাছটা দেখছে, জনি বললো, ওটার দিকে হাঁটো। আমি এই এলাম বলে।

ডবিকে নিয়ে দৌড় দিলো জনি। অন্যেরা ধীরে ধীরে এগিয়ে চললো পাইন গাছটার কাছে। বেশ ভালোই দৌড়ায় জনি, তাড়াতাড়িই ফিরে এলো কাঁধে সুইমস্যুট নিয়ে। জোরে জোরে হাঁপাচ্ছে।

পাইন গাছটার কাছে পৌঁছলো ওরা।

ওই যে দেখো, জনি বললো, পুকুর।

পানির রঙ দেখেই বোঝা গেল পুকুরটা গভীর। ঘন নীল, ঠাণ্ডা, কাঁচের মতো মসৃণ পানির উপরিভাগ। একপাড়ে ঘন গাছের সারি। একেবারে পানির কিনারে নেমে গেছে একধরনের ছোট জাতের উদ্ভিদ।

এগিয়ে গেল দলটা। হঠাৎ থমকে দাঁড়ালো গাছের গায়ে লাগানো একটা নোটিশ দেখে। লেখা রয়েছেঃ

কীপ আউট
ডেনজার
গভার্নমেন্ট প্রোপার্টি

সরে থাকতে বলছে। বিপদ! সরকারি জায়গা! অবাক হয়ে বললো মুসা। এর মানে কি?

দূর, হাত নাড়লো জনি। ওই নোটিশকে পাত্তা দিও না। ও কিছু না।

<

Super User