০৪.

গতি বাড়ছে ধসের। পিছানর উপায় নেই, আতঙ্ক চেপে ধরল যেন রবিনকে। ধসের পথেই রয়েছে। জলদি সরে যেতে না পারলে নিশ্চিত মৃত্যু। ভাবনারও সময় নেই।

 থাবা দিয়ে বায়ের একটা খাঁজ আকড়ে ধরল সে। সরে যেতে শুরু করল। কপালে ঘাম। চোখ জ্বালা করছে। নাকে ঢুকছে বালি।

মরিয়া হয়ে উঠেছে রবিন। যত দ্রুত সম্ভব সরে যাওয়ার চেষ্টা করছে।

 বাড়ছে গুমগুম শব্দ।

অনেকটা সরে এসেছে সে। এই সময় পাশ দিয়ে ভারি গর্জন করতে করতে নেমে যেতে লাগল ধস। পাথরের খুদে কণা। তীব্র গতিতে এসে সুচের মত বিধছে চামড়ায়।

ধসটা নেমে গিয়ে জমা হল নিচের পাথরের স্তূপের সঙ্গে। তার মানে মাঝে মাঝেই ধস নামে ওই জায়গাটায়, স্থপটা ওভাবেই হয়েছে। পাহাড়ের চূড়াটা ওখানে নড়বড়ে, যে কোন ধরনের চমক ধসিয়ে দিতে পারে ওটাকে–একটা, পার্বত্য সিংহ লাফিয়ে উঠলে, একটুখানি ভূকম্পন হলে, কিংবা রোদ-বাতাস বৃষ্টিতে ক্ষয়ে যাওয়া একটা পাথর, চূড়ার নিচ থেকে খসে গেলেই টলে উঠবে চূড়াটা। ওখানে চড়তে যাওয়াটা মোটেও নিরাপদ নয়।

ধড়াস ধড়াস করছে রবিনের বুক। চোখ মুদল সে। একটু আগের আতঙ্কের রেশ পুরোপুরি কাটেনি এখনও।

কিন্তু চিরকাল তো আর এখানে এভাবে থাকা যাবে না।

চোখ মেলল সে। আশপাশে তাকাল। কি করবে? ওপরে উঠবে? নিচে নামবে?

এই সময় অদ্ভুত একটা দৃশ্য চোখে পড়ল তার। হাত রাখার জায়গা, না পা রাখার জায়গা? দুটোই মনে হচ্ছে। পাথর কুঁদে তৈরি প্রাকৃতিক নয়। প্রাকৃতিক কারণে ওভাবে তাক তৈরি। হতে পারে না। ঠিক তাকও বলা যাবে না। পাথরের দেয়ালে এমন ভাবে তৈরি হয়েছে ওগুলো, যাতে হাত দিয়ে চেপে ধরে পা রেখে বেয়ে ওঠা যায়।

এখনও কাঁপুনি থামেনি রবিনের। হাত বাড়ালেই তাক ধরতে পারে সে। তা ই করল। যেখানে ছিল, সেখান থেকে সরে চলে এল তাকের সারিতে। সুন্দর ভাবে ওপরের একটা খাজ ধরে নিচের একটায় পা রাখতে পারল। দেয়ালে ওঠার এক ধরনের সিঁড়ি। আরও ভালমত দেখতে পাচ্ছে এখন। বিপজ্জনক জায়গা ধরে। বহুদূর পর্যন্ত উঠে গেছে, বাঁয়ের খাড়া চুড়ার কাছাকাছি। গ্যানিট কেটে যে ইনডিয়ানরা বাদাম গুড়ো করার গর্ত করেছে তারাই হয়ত পাহাড়ে চড়ার জন্যে তৈরি করেছিল এই সিঁড়ি।

ঘড়ি দেখল রবিন। দেরি হয়ে যাচ্ছে। অন্যেরা নিশ্চয় তার ফেরার অপেক্ষায় আছে।

দেয়ালে পেট ঠেকিয়ে সিঁড়ি বেয়ে উঠতে লাগল সে। পৌঁছে গেল জলপ্রপাতের সামান্য ওপরের একটা জায়গায়। বাতাসে পানির কণা এখানে অনেক বেশি, প্রপাত থেকে উঠছে। মনে হয় হালকা বাষ্প ভাসছে বাতাসে।

আরেকটু পাশে সরে একটা নালার কাছে চলে এল সে। পানির ঘষায় সৃষ্টি হয়েছে ওটা। উঠে গেছে ওপর দিকে। ওখানে আসতেই চোখে পড়ল উপত্যকাটা। বিমান থেকে যেটা দেখেছিল সেটাই। ঘন গাছের জঙ্গল। কিছু কিছু জায়গায় অনেক চওড়া, কোথায় গিয়ে শেষ হয়েছে এখান থেকে দেখতে পাচ্ছে না সে। মাথার ওপরে গ্র্যানিটের গায়ে রোদ চমকাচ্ছে। উপত্যকার বুক চিরে চলে গেছে পাহাড়ী নদী। কিন্তু ওটার পাড়ে ক্যাম্পগ্রাউণ্ড চোখে পড়ল না তার, যেটা আশায় এসেছিল।

উত্তর থেকে বাতাস বইছে। বয়ে আনছে গন্ধকের কটু গন্ধ, যার অর্থ, পর্বতের ভেতরে গরম পানির ঝর্না আছে কোথাও। চোখ জ্বালা করছে এখনও ওর, বোধহয় গন্ধকের জন্যেই। হাত দিয়ে ডলে মুছে নিয়ে আবার তাকাল উপত্যকার দিকে।

মনে হচ্ছে, যেন বহুকাল আগে বিমান থেকে দেখেছিল জায়গাটা। তার পর কত ঘটনা ঘটে গেছে। কপালজোরে বেঁচে রয়েছে এখনও।

 আর দেখার কিছু নেই আপাতত। সিঁড়ি বেয়ে আবার নামতে শুরু করল সে। যেখানে আরেকটু হলেই ধসের আঘাতে মরতে চলেছিল সেই জায়গাটা পেরিয়ে। এল। তারপর পেরোল সরু একটা শৈলশিরা, ঘন ঝোপঝাড় জন্মে রয়েছে ওখানে।

সিঁড়িটার কথা ভাবছে সে। নিচে থেকে চোখে পড়ে না। কোন্ রহস্যময় কারণে লোকচক্ষুর আড়ালে রাখার মত করে তৈরি করেছিল ইনডিয়ানরা কে জানে! প্রপাতের আশপাশের খোলা অঞ্চলে দাঁড়ালে সামনে বাধা হয়ে থাকে পাইন বন, ওই বনের জন্যেই ওখান থেকে দেখা যায় না সিঁড়িটা।

কয়েক ফুট ওপর থেকে লাফিয়ে বনতলে নামল রবিন। আবার ঘড়ি দেখল। এবার সত্যি অনেক দেরি হয়ে গেছে।

দৌড়ে এল পানির বোতলটা যেখানে রেখেছিল সেখানে। তুলে নিয়ে আবার দৌড়ে চলল বনের ভেতর দিয়ে। চিহ্ন ভুল করল না।

অবশেষে চোখে পড়ল তৃণভূমিটা, যেখানে নামতে বাধ্য করা হয়েছে সেসনা। সূর্য ডুবতে আর ঘণ্টাখানেক বাকি। ক্লান্তি লাগছে রবিনের। উত্তেজিত। কি দেখেছে, কি ভাবে ধস থেকে বেঁচে এসেছে সবাইকে বলার জন্য অস্থির।

.

রবিনের কাছ থেকে আলাদা হয়ে গিয়ে সরু পথটা ধরে এগোল মুসা। যা অনুমান। করেছিল, তা-ই। দক্ষিণ-পুবের ঘন বনের ভেতরে ঢুকে গেছে পথটা।

উঁচু গাছের ডালপালার ভেতর দিয়ে চুঁইয়ে নামছে সূর্যালোক, বনতলে উষ্ণ আলো আর শীতল ছায়া সৃষ্টি করেছে। বিচিত্র এক আলোআঁধারির খেলা চলছে। ওপরে গাছের মাথা, কোথাও এত গায়ে গায়ে লেগে গেছে যে আকাশই চোখে পড়ে না। মাটি আর পাইনের তাজা সুগন্ধে ভুরভুর করছে বাতাস।

পথটা ধরে প্রায় আধ ঘণ্টা চলল মুসা। বালুতে মানুষের পায়ের ছাপ খুঁজল। হরিণ, ব্ল্যাকুন আর কুগারের ছাপ দেখতে পেল। পথের ওপরে আর পথের ধারে হরিণ ও ভালুকের নাদা পড়ে আছে। হতাশ হল হাইকিং বুট কিংবা টেনিস–এর ছাপ না দেখে। ক্যাম্পফায়ারের ধোয়ার গন্ধ আশা করেছিল, পেল না। কান খাড়া রেখেছে জীপের ইঞ্জিনের শব্দ শোনার জন্যে, শুনল না। টেলিফোনের থাম দেখল না। মানুষের অস্তিত্ব ঘোষণা করে এরকম কিছুই নেই।

হঠাৎ কি যেন নড়ে উঠল। টের পেল সে। পেছন থেকে দ্রুত এগিয়ে আসছে। ওর দিকে। মানুষ, না জানোয়ার?

খসখস শব্দ কানে এল।

থমকে দাঁড়াল সে। কান পেতে রইল আরও শব্দের আশায়। সতর্ক হয়ে উঠেছে। আস্তে করে সরে চলে এল পথ থেকে, একটা গাছের আড়ালে লুকিয়ে তাকিয়ে রইল পথের দিকে।

এগিয়ে আসছে শব্দটা।

চলেও গেল এক সময়।

কিছুই দেখতে পেল না মুসা। ঘাড়ের রোম দাঁড়িয়ে গেল তার। কি…কি ওটা!

অ্যাই! আর থাকতে না পেরে চিৎকার করে ডাকল সে। জানোয়ার হলে ডাক: শুনে ছুটে পালাবে। মানুষ হলে থামবে, দেখতে আসবে কে ডাকছে। অ্যাই, শুনছেন?

জবাবের আশায় রইল মুসা। কেউ দৌড় দিল না। ঝোপঝাড় ভেঙে ছুটে পালাল না কোন জানোয়ার। সেই একই ভাবে খসখস শব্দ হয়েই চলেছে, মুসার ডাক যেন কানেই যায়নি।

শব্দের দিকে দৌড় দিল সে। কিছুদূর এগিয়ে গতি কমিয়ে কান পাতল শোনার জন্যে। আছে শব্দটা। থামেনি।

রাস্তা থেকে নেমে গাছপালার ভেতরে ঢুকে পড়ল সে। মুখে লাগছে পাইন নীডল। কেয়ারই করল না মুসা।

আরেকটু এগিয়েই দেখতে পেল মূর্তিটাকে। মানুষ। গাছপালার ভেতর দিয়ে ঘন ছায়ায় থেকে হাঁটছে, ফলে ভাল করে না তাকালে চোখেই পড়ে না।

অ্যাই, শুনুন! জোরে চিৎকার করে ডাকল মুসা, দৌড় বন্ধ করেনি। শুনুন, কথা আছে! সাহায্য দরকার আমাদের!

দ্বিধা করল লোকটা। গতিও কমাল ক্ষণিকের জন্যে। পর মুহূর্তেই আরও বাড়িয়ে দিয়ে প্রায় ছুটতে শুরু করল। হারিয়ে যেতে চাইছে গভীর বনের ভেতরে।

মুসাও গতি বাড়িয়ে দিল। কি ধরনের লোক? সাহায্যের কথা শুনেও থামেনি, বরং পালিয়ে যেতে চাইছে?

কয়েকটা গাছের ওপাশে অদৃশ্য হয়ে গেল লোকটা।

ছুটতে ছুটতে গাছগুলোর কাছে পৌঁছে গেল মুসা। ঘুরে অন্য পাশে এসে তাকিয়েই থমকে গেল। নেই! উধাও হয়ে গেছে ভূতুড়ে মূর্তিটা। মানুষ? নাকি ভূতপ্রেত! গায়ে কাঁটা দিল তার।

চুপ করে দাঁড়িয়ে আছে মুসা। কান খাড়া। চোখের দৃষ্টিতে তীক্ষ্ণ। না শুনল আর কোন শব্দ, না দেখতে পেল লোকটাকে। গেল কোথায়? শুয়ে পড়ল না তো মাটিতে? ঘন ঝোপের ভেতরে ঢুকে গেল?

আবার ডাক দিল সে, এই যে ভাই, শুনছেন! বিপদে পড়েছি আমরা! আপনার সঙ্গে একটু কথা বলতে চাই! শুনছেন?

সাড়া নেই।

ও ভাই! আমি কিছু করব না আপনাকে…!

নীরবতা! খুঁজে বের করতেই হবে লোকটাকে, ভাবল মুসা।

খুঁজতে আরম্ভ করল সে। গাছপালার আড়ালে, ছায়ায়, ঝোপের ভেতরে।

মনে পড়ল সময়ের কথা। ঘড়ি দেখল। আরি, অনেক দেরি হয়ে গেছে! তাড়াতাড়ি ফেরা দরকার। কিন্তু কোনদিকে ফিরবে!

হায় হায়, কি গাধা আমি! নিজেকেই বকা দিল সে। পথটা যে কোথায়, কোন দিকে আছে, তা-ও বলতে পারবে না। উত্তেজিত হয়ে ছুটে আসার সময় নিশানা রাখতেও ভুলে গিয়েছিল।

পেটের মধ্যে মোচড় দিয়ে উঠল ওর। ভয়ে। কি বোকামিটা করেছে বুঝতে পারছে।

পথ হারিয়েছে সে!

.

০৫.

আস্তে আস্তে শ্বাস নিচ্ছে মুসা। শান্ত হও, বোঝাল নিজেকে। মাথা ঠাণ্ডা করো। নইলে বিপদ থেকে মুক্তি পাবে না। আসতে যখন পেরেছ এখানে, যেতেও পারবে। কি করে যাবে কেবল সেইটাই ভেবে বের কর এখন।

আবার ঘড়ি দেখল সে। সরে চলে এল এমন একটা জায়গায়, যেখানে বন মোটামুটি পাতলা, গাছের মাথার ফাঁক দিয়ে আকাশ চোখে পড়ে। এদিকে সরে ওদিকে সরে, এপাশে মাথা কাত করে ওপাশে মাথা কাত করে সূর্যটা দেখল সে। তারপর হিসেব শুরু করল।

তৃণভূমি থেকে রাস্তায় উঠে এসে দক্ষিণ পুবে রওনা হয়েছিল। রোদ পড়ছিল। তখন তার ডান কাঁধে। এখন নেমে গেছে সূর্য। উত্তর-পশ্চিমে যাওয়ার সময় তার বাঁ কাঁধের নিচের দিকে, প্রায় বুকে রোদ পড়ার কথা।

ঘন গাছপালায় ছাওয়া এই তরাই থেকে বেরিয়ে তৃণভূমিটা খুঁজে বের করা খুব মুশকিল। তবু, চেষ্টা তো করতে হবে।

সাবধানে হাঁটতে শুরু করল সে। বার বার মুখ তুলে তাকাচ্ছে সূর্যের দিকে। পাখি ডাকছে, গাছের পাতায় শিরশির কাঁপন তুলে বইছে বাতাস, ঝোপের ভেতর, হুটোপুটি করছে ছোট ছোট জীব। পায়ের কাছ থেকে সড়াৎ করে সরে যাচ্ছে। কাঠবেড়ালি, ইঁদুর, লাফিয়ে উঠে ছুটে পালাচ্ছে খরগোশ।

এক ঘণ্টা ধরে হাঁটল সে। কোন কিছুই তো চিনতে পারছি না, নিরাশ হয়ে নিজেকে বলল। একটা চিহ্ন, একটা নিশানা দেখছি না যেটা দেখে বোঝা যায় ঠিক পথেই চলেছি।

আরও নেমেছে সূর্য। বড় জোর আর এক ঘণ্টা, তার পরেই ডুবে যাবে। এই সময় বনের ভেতরে আবার শব্দ শুনতে পেল সে। ডেকে উঠতে যাচ্ছিল আবার, সময় মত সামলে নিয়ে চুপ হয়ে গেল। আগের বারও ডাকাডাকি করতে গিয়ে হুঁশিয়ার করেছে লোকটাকে, পালিয়েছে সে।

পা টিপে টিপে শব্দের দিকে এগোল এবার।

উত্তরে এগোচ্ছে সে। বাড়ছে শব্দ। লোকটা প্রথমবার যে রকম শব্দ করেছিল, তার চেয়ে বেশি লাগছে এখন।

থেমে গেল শব্দটা।

পাগল হয়ে গেলে নাকি! নিজেকে ধমক লাগাল মুসা। কোথায় তৃণভূমিটা খুঁজে বের করে নিরাপদ হবে, তা না, আবার এগিয়ে চলেছে শব্দ লক্ষ্য করে আরেকবার পথ হারানর জন্যে।

দ্বিধা করল সে। তবে একটা মুহূর্ত। তারপর আবার এগোল শব্দের দিকে।

 হঠাৎ করেই থেমে গেল, যেন ব্রেক কষে।

 খাইছে! রবিন! চিৎকার করে উঠল সে।

 ফিরে তাকাল রবিন। সে-ও চমকে গিয়েছিল। স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে বলল, ও, মুসা!

হাসতে লাগল মুসা। হো হো করে। পরিচিত একটা মানুষকে সামনে দেখে খুশি আর ধরে রাখতে পারছে না।

কি হয়েছে, মুসা? ওরকম করছ কেন?

জবাবে আরও জোরে হাসতে লাগল মুসা।

আরে কি হলো! পাগল হয়ে গেলে নাকি! ভুরু কুঁচকে বলল রবিন।

না! মাথা নাড়তে লাগল মুসা। আরও কিছু হো-হো-হো। না, পাগল হইনি। তোমাকে দেখে কি যে ভাল লাগছে!

কেন, আমাকে কি নতুন দেখলে নাকি?

নতুন না হলেও পরিচিত তো। ভূত নও যে গায়েব হয়ে যাবে।

 এখানে আবার ভুত এল কোত্থেকে? আরও অবাক হয়েছে রবিন।

চলো, যেতে যেতে বলছি। তুমিও যখন এদিকেই আছ, তার মানে পথ ভুল করিনি। ঠিকই এগোচ্ছি। চলো।

হাঁটতে হাঁটতে সব কথা বলল মুসা।

 ভূত? ভুল দেখনি তো? রবিন বলল।

না। ঠিকই দেখেছি।

হু! বনের ভূতে পেল শেষ পর্যন্ত তোমাকে, চিন্তিত ভঙ্গিকে বলল রবিন।

 তোমার কথা বললে না? তুমি কি করে এলে? বলল রবিন।

ধস! বলো কি? বিশ্বাস করতে পারছে না মুসা। পাহাড়ে যেখানে সেখানে। তো এভাবে ধস নামে না! ভাগ্যিস সরে যেতে পেরেছিলে! নইলে ভর্তা হয়ে যেতে!

আলোচনা করতে করতে চলল দুজনে। হঠাৎ হাত তুলে রবিন বলল, দেখো দেখো, কিশোর আমাদের চেয়ে আরামে আছে। কোন রকম বিপদে পড়তে হয়নি। তো। যা ধোয়া করছে, কাছাকাছি কেউ থেকে থাকলে চোখে পড়বেই।

মুসাও দেখতে পাচ্ছে। কালো ধোয়া কুণ্ডলী পাকিয়ে উঠে যাচ্ছে ওপরে।

আগুনের কাছ থেকে কিছু দূরে বসে রয়েছে কিশোর। সূর্য ঢলে যেতেই শীত পড়তে আরম্ভ করেছে। জ্যাকেট গায়ে দিয়েছে সে। চেন টেনে দিয়েছে একেবারে গলা পর্যন্ত। ধোয়া করেই শুধু ক্ষান্ত হয়নি। রাতে শোয়ার ব্যবস্থাও করে ফেলেছে। আগুনের কুণ্ড ঘিরে ছয় ফুট জায়গার পচা পাতা, ঘাস আর পড়ে থাকা অন্যান্য জিনিস সাফ করেছে। লতাপাতা জোগাড় করে এনে রেখেছে বিছানা পাতার জন্যে।

কি ব্যাপার? মুসা আর রবিনের দিকে তাকাতে লাগল কিশোর। হাটুরে। কিল খেয়ে এসেছ মনে হয়? মুখ ওরকম কেন?

আমাকে দেখে খুশি হয়েছে মুসা, আরেক দিকে তাকিয়ে জবাব দিল রবিন।

চোখ সরু হয়ে এল কিশোরের। মুসার দিকে দৃষ্টি স্থির। খুশির তো কোন লক্ষণ দেখছি না?

কি করলে লক্ষণটা বোঝা যাবে? রেগে গেল মুসা। দাঁত বের করে হি হি করে হাসতে হবে?

না, তা বলছিনে। তবে মনে হচ্ছে ভূতের তাড়া খেয়ে এসেছ।

 তা অনেকটা ওই রকমই, রবিন বলল।

জ্যাকেট গায়ে দিয়ে এসে আগুনের পাশে বসে পড়ল মুসা আর রবিনও। হাত সেঁকতে সেঁকতে বলতে লাগল কি করে এসেছে। বেশ ভাল ঠাণ্ডা পড়ছে এখন।

চারপাশে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করল রবিন, বাবা কই?

ফেরেনি তো, কিশোর জানাল।

অনেক আগেই চলে আসার কথা, উদ্বিগ্ন হলো রবিন। পাহাড়ের দিকে তাকিয়ে বাবার কথা ভাবল। কপালের জখমটার কথা ভেবে উঠে দাঁড়াল সে। রওনা হয়ে গেল।

মুসাও উঠে দাঁড়াল। দাঁড়াও, আমিও আসছি।

 জোরে একটা নিঃশ্বাস ফেলল কিশোর। এখানে বসে একজনকে ক্যাম্পের ওপর নজর রাখতেই হবে। নইলে বিপদ হতে পারে। দেখার কেউ না থাকলে অনেক সময় ক্যাম্পে ফায়ার ছড়িয়ে পড়ে দাবানলের সৃষ্টি করে। মুসা আর রবিনের। সঙ্গে এবার যাওয়ার ইচ্ছেটা প্রবল হয়ে উঠেছে তার। মিস্টার মিলফোর্ডের জন্যে তারও দুশ্চিন্তা হচ্ছে। কিন্তু কিছু করার নেই। বসে থাকতেই হবে।

পশ্চিম আকাশের দিকে তাকাল মুসা। সূর্য ডোবার আর আধ ঘণ্টা বাকি। তার পরে আলো আর বেশিক্ষণ থাকবে না, ঝুপ করে নামবে অন্ধকার, এসব পাহাড়ী এলাকায় যেমন করে নামে।

পাহাড় বেয়ে উঠতে শুরু করল রবিন। তবে প্রপাতের ধারের পাহাড়ের মত দেয়ালের গায়ে এখানে খোঁচা খোঁচা পাথর বেরিয়ে নেই। পরতের পর পরত এ্যানিট এমন ভাবে পড়েছে, যেন পাহাড়ে চড়ার উপযুক্ত করেই। কোথাও কোথাও খুবই মসৃণ, প্রায় হাত পিছলে যাওয়ার মত, হাজার হাজার বছর আগে। বরফের ধস নামার সময় বরফের ঘষায় এরকম হয়েছে।

চূড়ায় উঠে এল দুজনে। জোরে জোরে দম নিচ্ছে।

উৎকন্ঠিত হয়ে চারপাশে তাকাল রবিন। কই, গেল কোথায়? দেখছি না।

বসে আছেন হয়ত কোথাও। বিশ্রাম নিচ্ছেন, মুসা বলল।

নিচে শত শত মাইল জুড়ে ছড়িয়ে রয়েছে চড়াই উতরাই। ঘন বনে ছাওয়া। ডুবন্ত সূর্যের লম্বা লম্বা ছায়া পড়ছে বনের ওপর, এক অপরূপ দৃশ্যের সৃষ্টি করেছে। সবুজ বনের মাথায় লাল রোদ, যেখানে রোদ পড়তে পারেনি সেখানে গভীর কালো গর্তের মত লাগছে। পাহাড়ের চূড়াগুলোকে মনে হচ্ছে সোনায় তৈরি। কিন্তু এসব দেখার আগ্রহ নেই এখন দুই গোয়েন্দার। ওরা যা দেখতে এসেছে সেই ফায়ার টাওয়ার কোথাও চোখে পড়ল না।

নজর ফেরাল ওরা। যেখানে রয়েছে পাহাড়ের সেই চূড়াটা দেখতে লাগল। লম্বা, গ্র্যানিটে তৈরি একটা মালভূমি। এখানে সেখানে ছড়িয়ে আছে বড় বড় পাথরের চাঙড়। পাথরের মধ্যেই যেখানে সামান্যতম মাটি পেয়েছে সেখানেই গজিয়ে উঠেছে কাঁটাঝোপ। রুক্ষ পাথরের মাঝে টিকে থাকার জন্যে প্রাণপণ লড়াই করে যাচ্ছে। মালভূমির সবটাই দেখতে প্রায় একই রকম। কোথাও কোন বৈচিত্র নেই। উত্তরে আধ মাইল দূরে ঘন হয়ে জন্মেছে পাইন। আরেকটা জঙ্গল, এই মালভূমির সঙ্গে সম্পর্ক নেই। পাহাড়ের ঢাল বেয়ে উঠে গেছে একটা শৈলশিরার কাছে, দ্বিগন্ত আড়াল করে দিয়ে লম্বা হয়ে পড়ে আছে যেন শিরাটা। ওই শিরাটারই কোন প্রান্তে রয়েছে ডায়মণ্ড লেক।

মিলফোর্ডকে খোঁজার জন্যে আলাদা হয়ে দুদিকে সরে গেল মুসা আর রবিন। চিৎকার করে ডাকতে লাগল।

বাবা!

আঙ্কেল!

বাবা!

ঠাণ্ডা একঝলক জোরাল হাওয়া বয়ে গেল মালভূমির ওপর দিয়ে। কেঁপে উঠল রবিন। ওর বাবা কোথায়? ওদেরকে কিছু না বলে দূরে কোথাও যাওয়ার কথা। নয়। যাবেন না।

চোখে পড়ল জিনিসটা। তার বাবার নীল ডজারস ক্যাপ।

বাবা! জোরে চিৎকার করে ডাকল আবার রবিন। দৌড়ে এল ক্যাপটার কাছে। পাশেই একটা ম্যানজানিটা ঝাড়। ঝড় তো নয়, যেন ঝাড়ের কঙ্কাল। বাবা! কাছাকাছি কোথাও রয়েছেন তিনি, অনুমান করল সে। কোথায় তুমি?

এই রবিন, পেলে নাকি কিছু? দৌড়ে আসছে মুসা।

কি পেয়েছে দেখাল রবিন। এই ক্যাপটার ওপর বাবার দুর্বলতা আছে। ফেলে যাওয়ার কথা নয়। নিশ্চয় কিছু হয়েছে। খারাপ কিছু। জখম-টখম হয়ে এমনিতেই শরীর কাহিল, পাহাড়ে উঠে আরও খারাপ হয়েছে। মাথা ঘুরে কোথাও পড়ে আছে হয়ত। কিংবা পথ হারিয়েছে।

দেখি তো। ক্যাপটা হাতে নিয়ে দেখতে লাগল মুসা। কোন দুর্ঘটনায় মাথা থেকে পড়ে গেলে যেমন হয়, ছিঁড়ে যায়, ময়লা কিংবা রক্ত লেগে থাকে, সে রকম কিছুই নেই। ঠিকই তো আছে!

বাবা! আবার ডাকল রবিন।

অযথা ভয় পাচ্ছ। মাথা থেকে খুলে পড়ে গেছে। খেয়াল করেননি।

মাথা নাড়ল রবিন। অসম্ভব! মাথা থেকে ক্যাপ খুলে পড়ে যাবে আর খেয়াল করবে না এটা হতেই পারে না। তাছাড়া এটা তার লাকি ক্যাপ।

একটা পাথর কুড়িয়ে নিল মুসা। বলল, একটা পিরামিড বানাই। টুপিটা কোথায় পেলাম তার চিহ্ন। তুমি খোঁজা চালিয়ে যাও।

মাথা ঝাঁকিয়ে সরে গেল রবিন।

পশ্চিমে তাকাল মুসা। উজ্জ্বল কমলা রঙ হয়ে গেছে সূর্যটার। ডুবে যাচ্ছে। দ্রুত হাত চালাল সে। পাথর দিয়ে পিরামিড তৈরি করে চিহ্ন রাখা বনচারী মানুষ আর অভিযাত্রীদের একটা পুরানো কৌশল। বানাতে দেরি হল না। উঠে সে-ও খুঁজতে শুরু করল আবার। কতটা উদ্বিগ্ন হয়েছে, সেটা রবিনকে জানাতে চায় না। তাহলে মন আরও খারাপ হয়ে যাবে বেচারার।

মুখের সামনে হাত জড় করে জোরে জোরে মিলফোর্ডকে ডাকতে লাগল দুজনে। চিৎকার বেরোতে না বেরোতেই সেটাকে উড়িয়ে নিয়ে যাচ্ছে বাতাস, যেন পছন্দ না হওয়ায় ঝেটিয়ে বিদেয় করতে চাইছে ওই শব্দকে। সব জায়গায় খুঁজতে লাগল ওরা। পাথরের আড়ালে, গাছের ছায়ায়, ভূমিকম্পে ফেটে যাওয়া গ্র্যানিটের খাজের ভেতরে।

অবশেষে হাল ছেড়ে দিয়ে মুসা বলল, ফিরে যাওয়া দরকার!

আরও পরে! উত্তরের বনের দিকে এগিয়ে চলেছে রবিন।

গিয়ে লাভ হবে না। এতক্ষণে নিশ্চয় ক্যাম্পে ফিরে গেছেন আঙ্কেল। আমাদের দেরি দেখলে রাগ করবেন।

না, যায়নি! রবিনের বিশ্বাস, কাছাকাছিই কোথাও রয়েছেন তার বাবা।

এই, শোনো, পথ হারাব আমরা। তাহলে আরও বেশি রাগ করবেন তিনি।

 থেমে গেল রবিন। ঝুলে পড়ল কাধ।

সূর্য ডুবে গেছে দেখছ না, পাশে চলে এল মুসা। এখনও বাইরে ঘোরাফেরা করছেন না নিশ্চয় আঙ্কেল। চলো। গিয়ে দেখব, বসে আছেন। আমাদের জন্যেই দুশ্চিন্তা করছেন।

পশ্চিম আকাশের দিকে তাকাল রবিন। গোধূলীর বিচিত্র রঙে রঙিন হয়ে গেছে আকাশ। মুসার কথায় যুক্তি আছে, যদিও মানতে পারছে না রবিন। তার ধারণা, ফিরে যাননি তার বাবা। গিয়ে দেখবে নেই। তাহলে আবার বেরোতে হবে খুঁজতে। কিন্তু এই রাতের বেলা কি ভাবে কোথায় খুঁজবে? কাল সকালের আগে আর হবে না।

যেতে ইচ্ছে করছে না। নিরাশ হয়ে প্রায় খোঁড়াতে খোঁড়াতে হাঁটতে লাগল। সে মুসার সঙ্গে। যেখান দিয়ে চূড়ায় উঠেছিল, চুড়ার সেই ধারটায় এসে থামল। নিচে তাকাল একবার। তারপর নামতে শুরু করল। বেগুনী আকাশ থেকে দ্রুত মিলিয়ে যাচ্ছে দিনের আলো। বিশাল একটা চাঁদ উঠছে, পূর্ণিমার বেশি বাকি নেই। আলো যথেষ্টই ছড়াবে, তবে এতটা বেশি নয় যাতে বনের ভেতর খোঁজা যায়।

তৃণভূমিতে নেমে শীতে কাঁপা শুরু করল ওরা। ছুটে চলল ক্যাম্পের দিকে। এতে শরীর গরম হবে, শীতটা একটু কম লাগবে। অন্ধকার হয়ে গেছে। আগুনের দিকে তাকিয়ে মনে হতে লাগল ওদের, চারপাশে কিছুদূর পর্যন্ত উষ্ণ একটা চক্র তৈরি করে জ্বলছে যেন আগুন।

মিলফোর্ডকে দেখা গেল না আগুনের পাশে। কিশোর একা।

 পেলে না? জিজ্ঞেস করল গোয়েন্দাপ্রধান।

 শুধু ক্যাপটা, জবাব দিল মুসা।

ধপ করে একটা পাথরের ওপর বসে পড়ল রবিন। বিষণ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল আগুনের দিকে।

মুসার চোখে চোখে তাকাল কিশোর। একটা ভুরু সামান্য উঁচু করল। ইঙ্গিতটা বুঝতে পারল মুসা। রবিনকে সান্ত্বনা দিতে হবে এখন, ওর মন হালকা করার চেষ্টা করতে হবে।

এই, রবিন, আচমকা কথা বলল মুসা, শুনেছি, হট পিসটন নাকি সাংঘাতিক। যে ট্যালেন্ট এজেন্সিতে কাজ করে রবিন, সেখানকারই একটা নতুন রক গ্রুপ হট পিসটন। রবিনের খুব পছন্দ।

হ্যাঁ, ভালই, দায়সারা জবাব দিল রবিন।

আমিও শুনেছি ভাল, কিশোর বলল। যদিও গানবাজনা তার বিশেষ পছন্দ নয়, রবিনের খাতিরেই বলল। ওদের নতুন মিউজিকটা কি?

আমি জানি, মুসা বলল, লো দা গ্রাউণ্ড। দারুণ! আমার খুবই ভাল লেগেছে…।

শোনো, আমি বলি কি…

বাবার কথাই বলতে যাচ্ছে রবিন, বুঝতে পেরে তাকে থামিয়ে দিয়ে আরেক কথায় চলে গেল মুসা, রবিন, বিশ্বাস করবে না, কি ভয়টাই না তখন পেয়েছি! লোকটা ভূতের মত এল, ভূতের মতই হারিয়ে গেল। বনের মধ্যে আমার মনে হয়েছিল-মনে হয়েছিল…কি জানি মনে হয়েছিল? মাথা চুলকাতে লাগল সে।

তোমার কি মনে হয়েছিল, সেটা কি আমরা জানি নাকি? হেসে ফেলল কিশোর।

দাঁড়াও, কি মনে হয়েছিল মনে করি…

হয়েছে, আর মনে করতে হবে না। আমিই বলে দিচ্ছি। প্যান্ট খারাপ হয়ে যাচ্ছিল, আর তুমি টের পাচ্ছিলে না…

খাইছে! তুমি জানলে কি করে?

এতে জানাজানির আর কি আছে? ভূত দেখলেই তো তুমি প্রথমে ওই একটি কাজ করে ফেলো…

হাসল মুসা।

 রবিনের ঠোঁটেও এক চিলতে হাসি ফুটেই মিলিয়ে গেল।

সুযোগটা কাজে লাগাল কিশোর, বেসুরো গলায় গেয়ে উঠল রবীন্দ্রনাথের গান, আমি চিনি গো চিনি তোমারে ওগো বিদেশীনী…

ওই গান থেকে যে কখন ওয়েস্টার্ন বাফেলো গালসে (গার্ল) চলে গেল। খেয়ালই রইল না। যখন খেয়াল হলো, দেখল তিনজনে গলা মেলাচ্ছে। বন্য রাতের আকাশ যেন ভরে দিল তিনটে কণ্ঠ, একেকটা একেক রকম। তিনজনের মাঝে রবিনের গলাই কেবল ভাল। মুসারটা খসখসে, আর কিশোরেরটা শুনলেই লেজ গুটিয়ে পালাবে নেড়ি কুকুর। একটা বাদ্যযন্ত্র হলে ভাল হয়। আর কিছু না পেয়ে দুটো ডাল তুলে নিয়ে ভুটানিদের মত একটার সঙ্গে আরেকটা পিটিয়ে শব্দ করতে লাগল মুসা। ওকে আর রবিনকে অবাক করে দিয়ে লাফিয়ে উঠে দাঁড়াল কিশোর। কোমর দুলিয়ে নাচতে শুরু করল। গলা যেমন বেসুরো, পা-ও তেমনি বেতাল। বাজনা বাজানো আর হল না মুসার। হাসতে হাসতে গড়িয়ে পড়ল। রবিনও না হেসে পারল না। মনে দুর্ভাবনা না থাকলে তারও মুসার দশাই হত। তবে কিছুক্ষণ আগের মত আর ভার হয়ে নেই মন, অনেক হালকা হয়েছে।

মুসা গাইল, আর কয়েক রকমের নাচ নাচল কিশোর। ভুটানি, বাংলাদেশী খেমটা, আফ্রিকান আদিবাসীদের উন্মাদ নৃত্য, আর রক স্টারদের দাপাদাপি, কোনটাই বাদ রাখল না। শেষে ক্লান্ত হয়ে আগুনের ধারে বসে প্রায় জিভ বের করে। হাঁপাতে লাগল।

নাচের শেষ পর্যায়ে তার সঙ্গে মুসা আর রবিনও যোগ দিয়েছে।

রাত হয়েছে। এবার শোয়া দরকার। সেই ব্যবস্থাই করতে লাগল তিনজনে।

মুসা বলল, গায়ের শার্ট খুলে নাও। ঘামে ভিজে গেছে। রাতে কষ্ট পাবে। খুলে শুকনো শার্ট যতগুলো আছে সব পরে নাও।

খুলতে ইচ্ছে করছে না কিশোরের। কিন্তু জানে, মুসা ঠিকই বলেছে। রাতে তাপমাত্রা আরও কমে যাবে, আর ওরা ঘুমিয়ে থাকতে থাকতে যদি আগুন নিভে যায় তাহলে তো সাংঘাতিক অবস্থা হবে গায়ে কাপড় বেশি না থাকলে।

দ্রুত শার্ট বদলে নিল ওরা। তার ওপরে চড়াল জ্যাকেট। চেন টেনে দিয়ে মুসা বলল, মোজাও খোলো। ভেজা মোজা শরীরের তাপ শুষে নেয়।

জুতো খুলে মোজায় টান দিতেই দুর্গন্ধ বেরেতে শুরু করল। নাক কুঁচকে ফেলল তিনজনেই। মোজা বদলে জিনসের প্যান্টের নিচটা মোজার ভেতরে গুঁজে দিল। শার্ট জল প্যান্টের ভেতরে। মোটকথা বাতাস ঢোকার কোন পথই রাখল না।

 রাতের জন্যে রাখা খাবার ভাগ করে দিল কিশোর। খুব সামান্য খাবার। কিছু পপকর্ন আর ক্যাণ্ডি। ধীরে ধীরে খেল ওরা। তারপর ডালপাতা বিছিয়ে পুরু করে ম্যাট্রেস তৈরি করল।

পপকর্নের খালি প্যাকেটগুলো নিয়ে গিয়ে বিমানের ভেতরে রেখে এল মুসা। বলল, এসব ছড়িয়ে ফেলে রাখলে গন্ধে গন্ধে এসে হাজির হবে বুনো জানোয়ার। আর কিছু না পেয়ে শেষে আমাদেরকেই ধরে খাবে।

মাইলার স্পেস ব্লাঙ্কেট মুড়ি দিয়ে আগুনের পাশে গুটিশুটি হয়ে শুয়ে পড়ল। ওরা। আগুনের নিচের অংশটা নীল, ওপরের কমলা রঙের শিখা যেন লকলক করে বেড়ে উঠে লাফ দিয়ে দিয়ে কালো তারাজ্বলা আকাশ ছুঁতে চাইছে।

চোখ মুদল ওরা। বিশ্রাম দরকার, আগামী দিনের পরিশ্রমের জন্যে। মিস্টার মিলফোর্ডকে খুঁজে বের করতে হবে।

হঠাৎ করেই কথাটা মনে এল কিশোরের। ঘুমজড়িত গলায় জিজ্ঞেস করল, রবিন, তোমার কন্ট্যাক্ট লেন্সের কি খবর? কবে খুলতে হবে?

কি একটা অসুবিধে দেখা দিয়েছে রবিনের চোখে। কন্ট্যাক্ট লেন্স পরার পরামর্শ দিয়েছেন ডাক্তার।

আরও হপ্তাখানেক পরে থাকতে হবে।

ও। তাহলে সময় আছে। এখান থেকে বেরিয়ে যেতে সাতদিনের বেশি লাগবে না আমাদের। অসুবিধেয় পড়তে হবে না তোমাকে। সময় মতই গিয়ে খুলতে পারবে।

রবিন চুপ করে রইল। তিক্ত হাসি হাসল মুসা। নিঃশব্দে। আদৌ কোন দিন। এই দুর্গোম বুনো এলাকা থেকে বেরিয়ে যেতে পারবে কি-না, যথেষ্ট সন্দেহ আছে। তার।

ঘুমিয়ে পড়ল কিশোর আর মুসা। অস্বস্তি নিয়ে ঘুমিয়েছে, ফলে গাঢ় হচ্ছে না ঘুম। রবিন ঘুমাতেই পারল না। চোখ খোলা। তাকিয়ে রয়েছে আকাশের দিকে। তারা দেখছে। ওই যে বিগ ডিপার, ওটা উরসা মেজর, আর ওটা বাবা, কোথায় তুমি! প্রায় নিঃশব্দে ককিয়ে উঠল সে। ভেব না, বাবা, কোনমতে রাতটা কাটাও। কাল তোমাকে খুঁজে বের করবই আমরা!

 চোখ মুদল অবশেষে রবিন। একটা পেঁচা কিরর কিরর করল। হউউ হউউ করল কোট। বনের ভেতরে ঘুরে বেড়াতে লাগল একটা বড় জানোয়ার। বহুদূরে পাহাড়ী পথে ট্রাকের ভারি ইঞ্জিনের শব্দ মৃদুভাবে কানে এল বলে মনে হল তার। রাতের বেলা শব্দ অনেক দূরে ভেসে যায়, আর অনেক সময় নীরবতার মাঝে থেকে নানা রকম অদ্ভুত কল্পনাও করতে থাকে মানুষ, ভুল শোনে…

ভারি হয়ে এল রবিনের নিঃশ্বাস। জেগে থেকে এখন রাবার কোন উপকারই। করতে পারবে না, বুঝতে পারছে। নিজের শরীরেই ক্ষতি করবে। তাতে পরোক্ষভাবে তার বাবার ক্ষতিই হবে, যদি কাল খুঁজতে বেরোতে না পারে সে। ধীরে ধীরে ঢিলে করে দিল শরীর। স্নায়ু ঢিল করতেই চেপে ধরল এসে সারাদিনের পরিশ্রমের ক্লান্তি। ঘুমিয়ে পড়ল। মুসা আর কিশোরের মতই তার ঘুমও গাঢ় হতে পারছে না। ঘুমের মধ্যেই অবচেতন মনে একটা প্রশ্ন ঘোরাঘুরি করছে, কোথায় রয়েছে সে?

.

০৬.

ঠাণ্ডা, শীতল সূর্য উঠল পর্বতের ঢালের ওপরে। বিছানা ছেড়ে উঠে পড়ল তিন গোয়েন্দা। হাত ডলে, মাটিতে লাথি মেরে পা গরম করতে লাগল। আগুন নিভে গেছে। রাতে আর আগুনে কাঠ ফেলা হয়নি। তবে ঠাণ্ডা লাগেনি ওদের। স্পেস ব্ল্যাঙ্কেট আর শার্টগুলো শরীর গরম রেখেছে।

যাক, আমরা ভাল থাকাতে, রবিন বলল, বাবার উপকার হবে।

অবশিষ্ট পপকর্নগুলো দিয়ে নাস্তা সারল ওরা। ক্যাণ্ডি বাঁচিয়ে রাখল রাতের জন্যে। ঝোপের ওপর শুকানোর জন্যে ছড়িয়ে দিল ব্ল্যাঙ্কেট। বাড়তি মোজা আর শার্ট খুলে নিল থেকে।

সেসনা থেকে ছোট একটা নোটবুক হাতে বেরিয়ে এল রবিন। বন্ধুদেরকে দেখিয়ে বলল, এটা বাবার। প্রথম পাতায় কালকের তারিখ আর একটা লোকের নাম লেখা রয়েছে। হ্যারিস হেরিং। চেনো নাকি?

না, একসাথে জবাব দিল কিশোর আর মুসা।

ওর সঙ্গে দেখা করতেই বোধহয় যাচ্ছিল বাবা, অনুমান করল রবিন। তারিখটা ঠিক আছে। এই একটা নোটবুকই সঙ্গে এনেছে। বইটা পকেটে রেখে বিমান থেকে নেমে এল সে। তিনজনে মিলে রওনা হল তৃণভূমি ধরে পাহাড়ের দিকে।

গ্র্যানিটের দেয়ালে প্রথমে চড়ল রবিন। অন্য দুজনের অপেক্ষায় দাঁড়িয়ে রইল। কোমরে হাত, চিবুক উঁচু, তাকিয়ে তাকিয়ে চারপাশের রুক্ষ, নির্জন পাহাড় দেখছে সে। বাবার নীল ক্যাপটা মাথায়। বয়েস আরও বেশি আর স্বাস্থ্য আরেকটু ভাল হলে রোজার মিলফোর্ড বলেই চালিয়ে দেয়া যেত তাকে।

ছড়িয়ে পড়ব আমরা, বলল সে। কাল রাতে আমি আর মুসা এখানে খুঁজেছি। আরও উত্তরে চলে যাব আমি, গাছগুলোর দিকে। তোমরা একজন বায়ে যাও, আরেকজন ডানে। এক ঘন্টা পর ফিরে এসে এখানে এই পিরামিডের কাছে মিলিত হব। ঠিক আছে?

তিনজনের ঘড়ি মিলিয়ে নিয়ে রওনা হয়ে গেল ওরা। মিস্টার মিলফোর্ডকে ডাকতে ডাকতে চলল। মানুষ লুকিয়ে থাকতে পারে এরকম কোন জায়গাই দেখা বাদ দিল না।

অনেকখানি জায়গা নিয়ে খুঁজল ওরা। তারপর ফেরার জন্যে ঘুরল। তিনজনেই ভাবছে, অন্য দুজন হয়ত কিছু দেখতে পেয়েছে। ফিরে এল ওরা।

পিরামিড়টাকে আর দেখতে পেল না।

কোথায় গেল? অবাক হয়ে প্রশ্ন করল মুসা।

 ধূসর গ্র্যানিটের ওপর ঘুরতে লাগল ওরা।

ছিল তো এখানেই, রবিন বলল।

না, মনে হয় ওখানে, মুসা বুলল।

দুজনেই ভুল করছ তোমরা, কিশোর বলল। এখানেই ছিল ওটা। গ্র্যানিটের গায়ে ওই যে গোল শ্যাওলার দাগ ওটা তখনও দেখে গেছি। এখান থেকেই রওনা হয়েছিলাম আমরা।

নিচু হয়ে একটা সিগারেটের গোড়া তুলে নিল সে। অন্য দুজনকে দেখিয়ে ৪ বলল, দেখ। কাগজটা কি রকম সাদা দেখেছ? তার মানে বেশি পুরানো নয়। আজ সকালে আমরা রওনা হওয়ার সময় এটা এখানে ছিল না। তাহলে চোখে পড়তই।

কি বোঝাতে চাইছ? মুসার চোখের পাতা সরু হয়ে এসেছে।

বোঝাতে চাইছে, চিন্তিত ভঙ্গিতে রবিন বলল, কেউ এসেছিল এখানে। যে সিগারেট খায়। আমাদের চিহ্ন নষ্ট করেছে। হয়ত আমাদের ওপর নজর রাখতে এসেছিল, তিনজন তিনদিকে চলে যাওয়ায় পারেনি। একসাথে আর কজনের ওপর রাখবে। তাছাড়া গাছপালা ঝোপঝাড় তেমন নেই যে আড়ালে থেকে পিছু নেবে।

 কিংবা হয়ত এমনিতেই ঘুরতে এসেছিল, সিগারেটের গোড়াটা ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেখছে কিশোর। লম্বা ফিল্টারের সঙ্গে যেখানে সাদা কাগজ জোড়া দেয়া হয়েছে, সেখানে সরু একটা সবুজ রঙের ব্যাণ্ড। দামি জিনিস। গোড়াটা শার্টের পকেটে রেখে দিল সে।

সময় নষ্ট করা উচিত না, রবিন বলল। বাবা এখানে নেই। মুসা কাল যেখানে গিয়েছিল সেখানে গিয়ে দেখা দরকার। একজন লোককে দেখেছিল সে। হয়ত বাবাকেই দেখেছে।

আমার যথেষ্ট সন্দেহ আছে, মুসা বলল।

কিন্তু হতে তো পারে। ভাল করে দেখনি তুমি। হয়তো মাথা ঘুরে পড়ে গিয়ে। আবার কপালে ব্যথা পেয়েছিল বাবা। ফলে মাথার ঠিকঠিকানা ছিল না, তোমার। ডাক চিনতে পারেনি।

চিনতে পারুক বা না পারুক, জবাব দিল না কেন? শুনতে পাননি, এটা বলতে পারবে না।

 এ কথার জবাব দিতে পারল না রবিন। বলল, একটা কাজ অবশ্য করতে পারি। কাকে দেখেছিলে, সেটা জানার চেষ্টা করা যায়। ফরেস্ট সার্ভিসের লোক হতে পারে। তাদের পেলে তো বেঁচেই গেলাম। আমাদের চেয়ে অনেক বেশি জায়গায় খুঁজতে পারবে তারা। এখানকার বনও তাদের চেনা।

পরস্পরের দিকে তাকিয়ে মাথা ঝাঁকাল কিশোর আর মুসা। ঠিকই বলেছে। রবিন। ফরেস্ট সার্ভিসের লোক পেলে অনেক সহজ হয়ে যাবে খোঁজা। বুনন এলাকায় তল্লাশি চালানোর মত যন্ত্রপাতি এবং লোকবল আছে তাদের।

তাড়াহুড়ো করে ক্যাম্পে ফিরে এল ওরা। একেবারেই নিভে গেছে ক্যাম্পফায়ারের কয়লা। তবু আরও নিশ্চিত হওয়ার জন্যে তার ওপরে মাটি ছড়িয়ে দিল কিশোর। তৃণভূমির মাঝখানে পাথর সাজিয়ে বড় করে এস ও এস লিখল রবিন আর মুসা। যাতে ওপর দিয়ে গেলে বিমানের চোখে পড়ে। পপকর্ন আর ক্যাণ্ডি পকেটে ভরল তিনজনে। পানির বোতলটা নিল রবিন।

স্পেস ব্ল্যাঙ্কেটগুলোও নিতে হবে, মুসা বলল। আর ইমারজেন্সি কিটটা। বিপদে তো পড়েই আছি, আরও বাড়তে পারে। তৈরি হয়ে যাওয়াই ভাল।

মুসার সঙ্গে একমত হয়ে মাথা নাড়ল কিশোর আর রবিন। রবিনের আফসোস হতে লাগল, ইস, তার বাবা যদি সাথে করে একটা স্পেস ব্লাঙ্কেট অন্তত নিয়ে যেতেন! ভাল হত।

উঁচু গাছের মাথার ফাঁকফোকর দিয়ে ঢুকছে রোদের বর্শা, গোল গোল হয়ে এসে পড়ছে মাটিতে। পায়ে চলা সরু পথ ধরে একসারিতে এগিয়ে চলেছে ভিন গোয়েন্দা। আগের দিন এই পথ ধরেই গিয়েছিল মুসা। রবিনের মাথায় নীল টুপিটা পরাই আছে। তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে দেখতে দেখতে চলেছে কোথাও তার বাবার চিহ্ন আছে কিনা।

এক চিলতে ভোলা জায়গা দেখা গেল। বিমানের ইঞ্জিনের শব্দ কানে এল এই সময়।

হায় হায়, চলে গেল তো! খোলা জায়গাটার দিকে দৌড় দিল কিশোর।

অন্য দুজনও এল পেছনে। তিনজনেই হাত তুলে চেঁচিয়ে ডাকতে লাগল, নাচতে লাগল, বিমানটার দৃষ্টি আকর্ষণের জন্যে। অনেক ওপর দিয়ে উড়ছে ওটা।

হয়তো আমার জানে, অন্য দুচোখে পড়ার সম্ভাবনা

চিৎকার করতে করতেই পকেট থেকে একটানে ওর স্পেস ব্ল্যাঙ্কেটটা বের করে খুলে নাড়তে লাগল মুসা। রবিন আর কিশোরও একই কাজ করল। জোরে জোরে ওপর দিকে লাফ মারতে লাগল রবিন। যে কোন ভাবেই হোক, বিমানটার চোখে পড়তে চায়। বাবাকে সাহায্য করার জন্যে মরিয়া হয়ে উঠেছে।

এই যে এখানে! আমরা এখানে! চেঁচিয়ে চলেছে।

আরে দেখো না, আমরা এখানে! বলল কিশোর।

কিন্তু বিমানটা ওদেরকে দেখতে পেয়েছে বলে মনে হলো না। একই গতিতে সোজা এগিয়ে যেতে লাগল। ছোট হয়ে যাচ্ছে। আরও ছোট।

হয়তো আমাদের এস ও এস দেখতে পেয়েছে। আশা করল রবিন।

কিন্তু সে যেমন জানে, অন্য দুজনও জানে, অত ওপর থেকে ঘাসের মধ্যে তৈরি পাথরের এস ও এস-টা বিমানের চোখে পড়ার সম্ভাবনা খুবই কম।

আবার রাস্তা ধরে হাঁটতে শুরু করল রবিন। এখানে আর সময় নষ্ট করতে চায় না। বাবাকে খুঁজে বের করতেই হবে!

অন্য দুজনেরও একই সংকল্প। বের করতেই হবে।

গুড়গুড় করে উঠল মুসার পাকস্থলী। কিশোরেরও একই অবস্থা।

হাই-ফাই স্টেরিও হয়ে গেছে পেট, রসিকতা করার চেষ্টা করল মুসা, কিন্তু নিমের তেতো ঝরল কণ্ঠ থেকে।

হাসল রবিন। বাজাতে থাক। কি আর করবে?

হঠাৎ থমকে দাঁড়াল মুসা। ঠোঁটে আঙুল চেপে ধরেছে। কয়েকটা পাইন। গাছের ফাঁক দিয়ে তাকিয়ে রয়েছে, বাঁয়ে।

ওর দৃষ্টি অনুসরণ করে রবিনও তাকাল। ছায়ার ভেতরে ডাল নড়ছে। ওর বাবা না তো! মৃদু খসখস শব্দ হলো। অবশেষে দেখা গেল যে ডাল নাড়িয়েছে। তাকে। ছায়ায় ছায়ায় এগোচ্ছে। সাংঘাতিক হতাশ হলো রবিন। ওর বাবা নয়।

ইশারায় রবিন আর কিশোরকে ওখানেই থাকতে বলে রওনা হয়ে গেল মুসা। যেন পিছলে ঢুকে অদৃশ্য হয়ে গেল গাছপালার আড়ালে।

কি ভেবে দাঁড়াল না কিশোর। রবিনকে নিয়ে রাস্তা ধরে দ্রুত পা চালাল। মুসার সঙ্গে সঙ্গে থাকার চেষ্টা করল। পাতায় ঘষা লাগার খসখস কানে আসছে। ওদের, মাঝে মাঝে চোখেও পড়ছে মুসাকে। কিন্তু যে লোকটার পিছু নিয়েছে, তাকে আর দেখতে পেল না।

তবে মুসা দেখতে পাচ্ছে। লোকটার সঙ্গে একই গতিতে এগিয়ে চলেছে। গাছপালার আড়ালে আড়ালে। সেই লোকটাই, আগের দিন যাকে দেখেছিল, কোন সন্দেহ নেই। নিঃশব্দে চলার চেষ্টা করছে সে।

বেশ কিছুদূর যাওয়ার পর বোধহয় সন্দেহ হলো লোকটার, শব্দটব্দ কানে। গেছে হয়তো। দেখে ফেলল মুসাকে। ঝট করে ডানে ঘুরে ঘন গাছের জটলার ভেতরে ঢুকে পড়ল সে। দৌড়াতে শুরু করল। আগের দিনের মতই খসাতে চাইছে।

কিন্তু আর ছাড়ল না মুসা। চোখের পলকে পেরিয়ে এল জটলাটা। যেন হোঁচট খেয়ে দাঁড়িয়ে গেল। অবাক হয়েছে। সামনে দাঁড়িয়ে আছে তারই বয়েসী একটা ইনডিয়ান ছেলে। চকচকে কালো চোখ।

চামড়ার ফতুয়া গায়ে, পরনে জিনস।

গাছের ঘন ছায়ায় স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে আছে ছেলেটা। এতটাই চুপচাপ, মনে। হয় গাছ হয়ে যেতে চাইছে। গাছের সঙ্গে মিশে গিয়ে আত্মগোপনের একটা চমৎকার কৌশল এটা ইনডিয়ানদের। চট করে চোখে পড়ে না। মুখের একটা পেশী কাঁপছে না, এমনকি চোখের পলকও পড়ছে না।

ঘন ঘন নিঃশ্বাস পড়ছে মুসার। বলল, এই, আমাদের সাহায্য দরকার…

জবাব দিল না ইনডিয়ান ছেলেটা। গোড়ালিতে ভর দিয়ে চরকির মত পাক খেয়ে ঘুরল, তারপর নিঃশব্দে ছুটে ঢুকে পড়ল গাছের আরেকটা জটলায়।

পিছু নিল মুসা। দেখতে পাচ্ছে না আর ছেলেটাকে। গাছপালা যেন গিলে নিয়েছে তাকে। শব্দ না করে এত দ্রুত যে কেউ ছুটতে পারে না দেখলে বিশ্বাস করত না মুসা।

ইতিমধ্যে থেমে থাকেনি কিশোর আর রবিন। রাস্তা ধরে এগিয়েই চলেছে। হাঁপাচ্ছে দুজনেই। শেষ যেন হবে না এই সীমাহীন পথ। বার বার তাকাচ্ছে ওরা। মুসাকে দেখার জন্যে। দেখতে পাচ্ছে না।

তারপর হঠাৎ করেই একশো ফুট সামনে বনের ভেতর থেকে বেরিয়ে রাস্তায় উঠল মুসা। জোরে জোরে হাঁপাচ্ছে। ঘামে চকচক করছে কালো মুখ।

দৌড়ে কাছে এল কিশোর আর রবিন।

ওকে দেখেছ? জিজ্ঞেস করল মুসা।

কাকে?

 ইনডিয়ান ছেলেটাকে?

 কী? রবিন অবাক।

 দেখেছি। হারিয়েও ফেলেছি। চলো।

বুনো পথ ধরে এগোল আবার তিনজনে। সামনে পাহাড়ের কারণে উঁচুনিচু হতে আরম্ভ করেছে পথ। চলতে চলতেই জানাল মুসা, কি হয়েছে।

তাহলে এদিকেই যাচ্ছিল সে! চিন্তিত ভঙ্গিতে বলল রবিন।

সামনে কি আছে আল্লাহই জানে,মুসা বলল।

বেশি সামনে যাতে যেতে না হয় আর! বিড়বিড় করে বলল কিশোর। পা ব্যথা হয়ে গেছে!

মাটিতে বসে গাছের গায়ে হেলান দিয়ে পাঁচ মিনিট বিশ্রাম নিয়ে নিল ওরা। তারপর আবার উঠে চলতে লাগল।

অনেক ওপরে উঠেছে সূর্য। গরম বাড়ছে। ডানা মেলে যেন ভেসে রয়েছে। প্রজাপতি। কিচ কিচ করে তীক্ষ্ণ ডাক ছাড়ছে নীল জে পাখি। বাতাসে পাইনের গন্ধ।

অধৈর্য, অস্থির হয়ে পড়ছে মুসা। সামনে চলে যাচ্ছে সে। রবিন আর কিশোর পড়ে যাচ্ছে পেছনে। ওদের এগিয়ে আসার অপেক্ষায় দাঁড়িয়ে থাকতে হচ্ছে তাকে। চিৎকার করে বলছে ওদেরকে তাড়াতাড়ি করার জন্যে।

কয়েকবার এরকম হলো। আরও একবার আগে চলে গেল মুসা। পথের বাঁকে হারিয়ে গেল। ওখান থেকেই চেঁচিয়ে ডাকতে লাগল ওদের।

রবিন জিজ্ঞেস করল, কি হয়েছে?

নিশ্চয় কিছু দেখতে পেয়েছে, কিশোর বলল। আল্লাহ, ভাল কিছু যেন হয়! অ্যা

ই, আরেকটা রাস্তা!

যতটা তাড়াতাড়ি সম্ভব মুসার কাছে চলে এল অন্য দুজন। সরু আরেকটা কাঁচা রাস্তার কিনারে দাঁড়িয়ে রয়েছে মুসা। উত্তর-পুবের বন থেকে বেরিয়ে আবার দক্ষিণ-পশ্চিমের জঙ্গলে ঢুকে গেছে পথটা। জন্তু-জানোয়ারের পায়ের ছাপের মাঝে নতুন আরেকটা দাগ দেখতে পেল ওরা, গাড়ির চাকার দাগ।

কই, আকাশ থেকে তো দেখিনি পথটা? রবিনের প্রশ্ন।

এই এলাকায় আসার পর দেখার সুযোগই পেলাম কই?

কিশোর বলল। এখানকার আকাশে ঢোকার পর তো কেবল ভয়ে ভয়েই কাটিয়েছি, কখন আছড়ে পড়বে প্লেন।

 রাস্তার এদিক ওদিক তাকাতে লাগল ওরা। দুই ধারে প্রচুর গাছপালা ঝোপঝাড় আছে, দুটো গাড়ি পাশাপাশি পার হতে পারবে,, একটা ঢুকলে আর অর্ধেকটার জায়গা হবে বড়জোর।

ভাটির দিকেই যাই? নিজেকেই যেন প্রশ্ন করল কিশোর। নিচের দিকে গেলে হাঁটতে সুবিধে। শ্রান্ত পা চলতে চাইছে না। ওপরে ওঠা বড় কঠিন।

চলো, মুসাকে যেদিকেই যেতে বলা হোক, রাজি।

 চলো, দাঁড়িয়ে থেকে কি হবে? তাগাদা দিল রবিন। সাহায্য এখন ভীষণ প্রয়োজন ওদের। নিজেদের জন্যে যতটা না হোক, তার বাবাকে খোঁজার জন্যে বেশি।

নিচে নামাটা অনেক সহজ। প্রায় দৌড়ে নামতে লাগল ওরা। একটু পরেই দেখতে পেল তীক্ষ্ণ বাঁক নিয়ে পশ্চিমে চলে গেছে রাস্তাটা।

মাটি শুকনো, কঠিন। গভীর দাগ হয়ে আছে। শরৎকালে আর বুসন্তে বৃষ্টিতে ভিজে নরম হয়েছিল মাটি, তখন পড়েছে দাগগুলো, পরে রোদে শুকিয়ে ওরকম হয়ে গেছে।

পাশাপাশি হাঁটছে এখন ওরা। যেমন খিদে পেয়েছে, তেমনি ক্লান্ত। কথা প্রায় বলছেই না। এগিয়ে যাওয়ার দিকেই কেবল ঝোঁক। ডালে ডালে অসংখ্য পাখি দেখা যাচ্ছে। উড়ছে, বসছে, ডাকছে। ক্রমেই আরও, আরও ওপরে উঠছে সূর্য। গরম হচ্ছে রোদ।

খুব মৃদু প্রতিধ্বনির মত করে এসে কানে বাজল শব্দটা। থেমে গিয়ে পরস্পরের দিকে তাকাল ওরা। কিসের শব্দ? কয়েক সেকেণ্ড দাঁড়িয়ে থেকে শব্দটা ভাল করে শুনে আবার এগোল। খানিক পরেই চিনতে পারল। অনেক মানুষের কথাবার্তা, কুকুরের ডাক আর ছেলেমেয়ের চিৎকার। বিচিত্র কলরব।

শহরের কোলাহল নয়। শহর বা গ্রাম যা-ই হোক, মানুষ তো! আশায় দুলে উঠল ওদের বুক।

চলার গতি আপনাআপনি বেড়ে গেল।

হাসি ফুটল রবিনের মুখে।

আরেকটা মোড় ঘুরে চওড়া হয়ে গেল পথটা। পথের মাথায় কতগুলো কাঠের পুরানো নরবড়ে কুঁড়ে। চারপাশ ঘিরে আছে রেডউড গাছ। কুঁড়ের বাইরে উঠানে পড়ে আছে মাছ ধরার আর শিকারের সরজ্ঞাম, মুরগীর খাবার দেয়ার গামলা। চারাগাছে তৈরি লম্বা ফ্রেমে, ঝোলানো রয়েছে চামড়া, শুকানর জন্যে। শরীর তোবড়ানো, পুরানো ঝরঝরে পিকআপ ট্রাক আর জীপ মরে পড়ে আছে যেন, কিংবা মরার প্রহর গুনছে।

ইনডিয়ানদের ছোট একটা গ্রাম। খেলা করছিল দুটো ছেলে, পরনে শার্ট, গায়ে টি-শার্ট। খেলা থেকে মুখ তুলে হাঁ করে তাকিয়ে রইল তিন গোয়েন্দার দিকে। চোখ লাল, নাক থেকে পানি গড়াচ্ছে। ওদের পাশের বাদামী রঙের কুকুরটা লাফাতে লাফাতে ছুটে এল গোয়েন্দাদের জুতো শোকার জন্যে।

 কি কারণে যেন খুব ব্যস্ত হয়ে উঠেছে গাঁয়ের লোক। ছড়ানো একটা উঠানে জড় হতে আরম্ভ করেছে মহিলা আর বাচ্চারা।

দ্রিম দ্রিম করে বাজতে শুরু করল ঢাক।

অ্যাই, তুমি! আঙুল তুলে চিৎকার করে বলল মুসা, শোনো! দাঁড়াও!

একটা কুঁড়ের দিকে দৌড় দিল সে। চামড়ার ফতুয়া আর জিনস পরা এক ইনডিয়ান ছেলের কাঁধ খামচে ধরল এসে। হ্যাঁচকা টান দিয়ে ছেলেটাকে ঘুরিয়ে ফেলল নিজের দিকে। আরেকটু হলেই পড়ে যাচ্ছিল ছেলেটা। জ্বলন্ত চোখে তাকাল সে মুসার দিকে। কঠিন, ভয়ঙ্কর হয়ে উঠেছে চেহারা।

তুমিই! জ্বলন্ত দৃষ্টিতে ফিরিয়ে দিয়ে বলল মুসা, হ্যাঁ, তোমাকেই দেখেছিলাম তখন! পিছু নিয়েছিলাম!

Super User