স্কুল ছুটি হতেই কারমলের বাড়িতে রওনা হল তিন গোয়েন্দা। বোটানিক্যাল গার্ডেন আর একটা বড় পার্কের পাশে বাড়িটা। খানিক দূরে পাহাড়। সাইকেল, চালাতে চালাতে কিশোর বলল, কড়া নজর রাখবে। বলা যায় না, আমাদের ওপরও চোখ রাখতে পারে কেউ।

খাইছে! কিশোর, দেখ! হাত তুলে পাহাড়ের নিচে দেখাল মুসা।

পাহাড়ের চূড়ায় রয়েছে ওরা। নিচে, বাঁয়ে কারমলের বাড়ি, অনেকখানি জায়গা জুড়ে। বেড়া দেয়া। ভেতরে জঞ্জালের ছড়াছড়ি, পুরানো তক্তা আর আরও নানারকম বাতিল জিনিসের স্তূপ। আর আছে একগাদা বোতল। একপাশে পরিচ্ছন্ন একটা সাদা কটেজ। মাঝখানে পুরানো একটা দালান, দেয়াল ধসে পড়ে পড়ে এই অবস্থা। কিন্তু বাড়ির দিকে চোখ নেই ছেলেদের।

নিচে এক অদ্ভুত দৃশ্য! লোকের ছড়াছড়ি, পিপড়ের মত পিলপিল করছে। বাচ্চা, কিশোর, যুবক, বৃদ্ধ, পুরুষ, মহিলা সবাই পাগলের মত ছুটছে, হুমড়ি খেয়ে পড়ছে এখানে ওখানে, ঝোপঝাড় দলে মাটির সঙ্গে মেশাচ্ছে, জঞ্জাল আর বোতল ছড়িয়ে ফেলছে যেদিকে ইচ্ছে। বসন্তের এই সুন্দর বিকেলে খেপে গেছে যেন মানুষগুলো। চেঁচিয়ে পাড়া মাথায় করেছে।

গলা ফাটিয়ে চেঁচাচ্ছে ওরাঃ ওটা আমার! এই আমি পেয়েছি! …এই, বোতল ছাড়!…ইত্যাদি।

দলবল নিয়ে এসেছেন ইয়ান ফ্লেচার, সামলাতে হিমশিম খেয়ে যাচ্ছেন। কটেজের বারান্দায় দাঁড়িয়ে হতাশ চোখে তাকিয়ে রয়েছে ওদের দিকে এলসা, নরি আর উড। সাইকেল থেকে নেমে এগিয়ে গেল তিন গোয়েন্দা।

হায় হায়রে! সব সূত্র মুছে দিল, প্রায় কেঁদে ফেলল নরি।

সবখানে ভাঙা বোতল, শান্তকণ্ঠে বলল কিশোর। এত কেন?

কারণ, কারমল বোতল সংগ্রহ করত, ঝাঁঝাল কণ্ঠে বলল উড। হাজার হাজার! আসল বোতলটা আর কোনদিনই খুঁজে পাব না আমরা।

কপালের ঘাম মুছতে মুছতে এগিয়ে এলেন ফ্লেচার। পেছন পেছন এল এক মোটালোক আর এক সাংঘাতিক রোগাটে মহিলা। এত পাতলা, মনে হয় বাতাসেই পড়ে যাবে।

সবগুলোকে ভাগান, অফিসার,মহিলা বলল।

বেআইনী ভাবে ঢুকেছে শয়তানগুলো, মোটা লোকটা বলল, সব কটাকে আরেস্ট করুন।

মাথা নাড়লেন চীফ। সবাইকে ঢোকার অনুমতি দিয়ে গেছেন আপনার মামা, মিস্টার এজটার। আর জোর করে ওদেরকে তাড়াতে হলে এখন মিলিটারি ডাকতে হবে। আমাদের পক্ষে সম্ভব না। বড় জোর বাড়িঘর বাঁচানোর চেষ্টা করতে পারি।

মামাটা তো একটা বদ্ধ পাগল ছিল,মুখ ঝামটা দিল মহিলা, পাগলের কথা মানতে হবে নাকি? আসল মালিক আমরা।

কি যে বল, জেনি এজটার, বলে উঠল এলসা, মালিক তোমরা হতে যাবে কেন? তোমাদের সঙ্গে কি সম্পর্ক…।

রক্তের সম্পর্ক থাকলে কিছুটা আমাদের সঙ্গেই আছে, এলসা, জেনি বলল। তোমার তো তা-ও নেই। তোমাদের বুদ্ধিতেই আমাদের ঠকানোর মতলব করেছিল বুড়োটা। আসলে ওকে দেখাশোনা করার জন্যে আরও আগেই চলে আসা উচিত ছিল আমাদের।

যা। তোমাদেরকে দেখতে পারত না বলেই তো, বোনের সঙ্গে গলা মেলাল মোটা মাইক, ঘরে জায়গা দেয়নি। ওই কটেজে থাকতে দিয়েছে।

তোমাকে কটেজেও দিত না, উড বলল। দশ বছর ধরে খবর নেই, এখন এসেছ দরদ দেখাতে। বেআইনী ভাবে তোমরাই বরং ঢুকেছ।

এই, তুমি বলার কে! চেঁচিয়ে উঠল জেনি।

তুমিও হাত মিলিয়েছ এলসার সঙ্গে! গর্জে উঠল মাইক। তোমরা দুজনে মিলে আমাদের ঠকানোর মতলব করেছ। কিন্তু আমরা জানি, আসল উইল একটা আছে, তাতে নিশ্চয় নাম রয়েছে আমাদের।

আসল উইলে নরি আর এলসার নাম আছে। আর কারও না, উকিল বলল।

রাগে ঘোঘোৎ করে উঠল মাইক। সেকথা শুধু তুমি বলছ। উইলটা হারাল কি করে, অ্যাঁ? আমার তো মনে হচ্ছে, আসল উইলটা তুমিই গাপ করে দিয়েছ, আমাদের ধোকা দেয়ার জন্যে।

তাহলে তো ভালই হত, উকিল হাসল। তোমরা একটা কানাকড়িও পেতে, সব পেত নরি।

আমরাও কারমলের বংশধর! আবার চেঁচিয়ে উঠল জেনি। সম্পত্তির ভাগ আমরাও পাব। ক্যালিফোর্নিয়ার আইনে কিছুই পাবে না। যদি তোমাদের মামার ছেলে বা নাতি না থাকত, তাহলে পেতে।

জ্বলন্ত চোখে নরির দিকে তাকাল ভাইবোন। ছেলেটার চোখে ওদের দৃষ্টিরই প্রতিফলন দেখতে পেল।

দেখে নেব, কুৎসিত ভঙ্গিতে দাঁত খিচাল মাইক।

নিয়ো, এলসা বলল। দয়া করে এখন বেরোও আমার বাড়ি থেকে।

মুলোর মত লাল হয়ে গেল ভাইবোনের মুখ।

আমাদের জিনিস আমরা আদায় করে নেবই, মনে রেখ, দাঁতে দাঁত চেপে বলল জেনি। কি করে নিতে হয় তা-ও আমরা জানি।

গটমট করে চলে গেল দুজনে। ওদিকে লড়াই বাধিয়ে দিয়েছে দুই হোকরা। ভাইবোনের দিকে চেয়ে শাগ করে ছেলেদের লড়াই থামাতে এগিয়ে গেলেন চীফ।

ব্যাটারা একেবারেই ছোটলোক, ফস করে বলে ফেলল মুসা।

ঠিকই বলেছ, একমত, হল উকিল। কারমল এখন থাকলে ঝেটিয়ে বিদেয় করত। একটা পয়সাও পাবে না ব্যাটারা। যাকগে, এখন আমাদের কাজ সেরে ফেলা দরকার। বোতলটা খুঁজতে হবে…

ভেতরে যাওয়া দরকার আমাদের, বাধা দিয়ে বলল কিশোর।

জবাবের অপেক্ষা না করেই কটেজে ঢুকে পড়ল গোয়েন্দাপ্রধান। অন্যেরা অনুসরণ করল। পরিপাটি লিভিংরুমে চোখ বোলাচ্ছে কিশোর। ভোলা জানালা দিয়ে ফুরফুরে চমৎকার বাতাস আসছে।

মিস্টার কারমলের ঘরে বোতল খুঁজেছেন আপনারা? উকিল আর এলসার দিকে তাকাল কিশোর।

জবাবটা দিল নরি, খুঁজেছি। পাইনি। পাওয়ার কথাও না, আনমনে বলল কিশোর। আমার মনে হয় নেই।

পকেট থেকে ধাঁধার নকলটা বের করল সে। এখান থেকেই শুরু করার কথা বলেছেন কারমল, তাঁর বাড়ি থেকেই। কবিতার মত করে লিখেছেনঃ হোয়্যার দ্য ওয়াইল্ড ডগস লিভস। বিশেষ ধরনের কোড।

তারমানে, ধীরে ধীরে বলল রবিন, বটল আর স্টপারও কোন ধরনের কোড? আসল বোতল না হয়ে বোতলের মত দেখতে কোন জিনিসের কথা বুঝিয়ে থাকতে পারেন।

তেমন দেখতে কিছু নেই এখানে, এলসা বলল।

কিন্তু পানি আছে! আস্তে কথা যেন বলতেই পারে না নরি, চেঁচাল, বোটানিক্যাল গার্ডেনের পাশে, হাঁস পালে যে পুকুরে।

রবিন বলল, পরের লাইনটা বলছে, অ্যাবাভ দ্য অ্যাপলস অ্যাণ্ড পেয়ারস অল অ্যালোন। আপেল গাছের কথা বলছে হয়ত। পুকুরটার পাড়ে আছে ওরকম গাছ?

উত্তেজিত হয়ে উঠল উড। ঠিক বলেছ!

বেশ… শুরু করল কিশোর, শেষ করতে পারল না।

জানালার বাইরে থেকে শোনা গেল গা জ্বালানো খিকখিক হাসি। বলল, অনেক ধন্যবাদ তোমাদেরকে, মাথামোটার দল! পায়ের শব্দ শোনা গেল।

জানালার কাছে দৌড়ে গেল মুসা। চেঁচিয়ে বলল, শুঁটকি টেরি!,

বোটানিক্যাল গার্ডেনের দিকে ছুটে যাচ্ছে তালপাতার সেপাই এক তরুণ, তিন গোয়েন্দার চেয়ে কিছু বড়। ওদের চিরশত্রু টেরিয়ার ডয়েল।

নে ফেলেছে, গুঙিয়ে উঠল মুসা। আগেই ভাবা উচিত ছিল…

ভেব না,সান্ত্বনা দিল কিশোর, বেশি দূর এগোতে পারবে না। বিলাবং বলে হয়ত হাঁসের পুকুরটা বুঝিয়েছেন কারমল, আপলস অ্যাণ্ড পেয়ারসের মানে গাছ-ও হতে পারে। এত সহজ মনে হয় না। অন্য কোন মানে আছে।

এক এক করে সবার মুখের দিকে তাকাল কিশোর। কেউ জবাব দিতে পারল। ভ্রূকুটি করল সে। কারমলের ব্যাপারে যত বেশি জানতে পারব, তার ধাঁধার সমাধান করা তত সহজ হবে। জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকাল উডের দিকে।

বেশ, শোন, উকিল বলল। উনিশশো, দুই সালে অস্ট্রেলিয়ায় জন্মেছিল, কারমল। তার বাবা ছিল একজন আসামী। তখন আসামীদেরকে সাজা দিয়ে, অস্ট্রেলিয়ায় পাঠাত ইংল্যাণ্ডের লোকেরা। বাপের চেয়ে কোন অংশে ভাল ছিল না কারমল, ছেলেবেলায়ই ভীষণ দুষ্ট ছিল। অল্প বয়েসেই বুশরেঞ্জার, মানে ডাকাত হয়ে গেল সে। ডাকাতি করে বড়লোক হল। তবে অপরাধী সে, আইনের কাছ থেকে পালিয়ে বেড়াতে হত। তরুণ বয়েসে চলে গেল ক্যানাডায়, আরও অনেক টাকা কামাল, বিয়ে করল অনেক বয়েসে, একটা ছেলে হল। বছর বিশেক আগে এসেছিল রকি বীচে, তারপর একাই বাস করেছে। অনেকটা সন্ন্যাসীর মত জীবন যাপন। তার ছেলে বছর পাঁচেক আগে যখন মোটর অ্যাক্সিডেন্টে মারা গেল, এলসার যাবার জায়গা রইল না। কাজেই তাকে নিজের কাছে নিয়ে এল বুড়ো। আলাদা কটেজ বানিয়ে দিল। দুনিয়ার সব মানুষকে সন্দেহ করত সে, কাউকে নিজের ঘরের ধারেকাছে ঘেঁষতে দিত না। অস্ট্রেলিয়া ছাড়া আর কোন দেশকে ভালবাসত না, বাপের মতই গোঁড়া ককনি ছিল বোধহয়। দুর্ধর্ষ এক মানুষ।

রবিন বলল, ধাঁধায় অস্ট্রেলিয়ান শব্দ ব্যবহার করেছেন কারমল। অ্যাপলস অ্যাণ্ড পেয়ারস বলে অস্ট্রেলিয়ান বা ক্যানাডিয়ান কিছু বোঝননি তো?

বলতে পারব না, বলে এলসার দিকে তাকাল উড।

এলসাও মাথা নাড়ল। বলল, বাড়ি চলে যাও এখন। গিয়ে ভালমত ভাব। দেরি হয়ে গেছে।

নিরাশ হয়েছে নরি। তার হিরোরা পরাজিত, ধাঁধার সমাধান করতে পারেনি। তিন গোয়েন্দাও অখুশি। দেখল, পরাজিত হয়ে আরও অনেকেই ফিরে যাচ্ছে। নীরবে সাইকেল চালাল ওরা রকি বীচের দিকে।

নীরবতা ভাঙল মুসা, কিশোর, ককনি কি?

লণ্ডনের ইষ্ট এতে যাদের বাড়ি তাদেরকে বলে ককনি। কেউ কেউ বলে, সেইন্ট মেরিলবাউ গির্জার ঘন্টার শব্দ যতদূর যায়, ততদূরের মধ্যে যাদের জন্ম তারা আসল ককনি। সে যাই হোক, ককনিদের কিছু কিছু শব্দের উচ্চারণ অদ্ভুত। হটকে বলে অট, ব্লেমকে বলে ব্লাইম, এরকম। অস্ট্রেলিয়ানরাও করে ওরকম।

কিশোর, রবিন বলল। উচ্চারণের ওপর ভিত্তি করে শব্দ বসানো হয়নি তো, ধাঁধায়? হয়ত…

সিটের ওপর হঠাৎ সোজা হয়ে গেল কিশোর। কেঁপে উঠে আরেকটু হলেই কাত হয়ে পড়ে গিয়েছিল সাইকেল। ককজি! চেঁচিয়ে উঠল সে। হয়ত…

কিশোর! বাধা দিল মুসা। স্যালভিজ ইয়ার্ডের কাছে চলে এসেছে ওরা। রাস্তার ধারে একটা পরিচিত গাড়ি দাঁড়িয়ে আছে, সেদিকে চোখ পড়েছে তার। শুঁটকি!

লাল গাড়িটা খালি মনে হল। ভাল করে তাকাতে চোখে পড়ল, সামান্য নড়ল একটা মাথা। ধৈর্য ধরে অপেক্ষা করছে টেরিয়ার। নিশ্চয় ওদের পিছু নিয়ে এসেছে।

জলদি, বলতে বলতে পকেট থেকে নকলটা বের করল কিশোর, এমন ভাব কর, যেন জরুরী কিছু জেনে ফেলেছি আমরা। তোমাদেরকে তদন্ত করতে পাঠাচ্ছি।

তাড়াহুড়ো করে চলে যাবে, যাতে তোমাদের পিছু নেয় সে। আমার মাথায় একটা আইডিয়া এসেছে, দেখতে যাচ্ছি ঠিক কিনা। শুঁটকি পিছু নিক, চাই না।

টোপ গিলল শুঁটকি। দ্রুত প্যাড়া করে একটা বাড়ির মোড়ে যাবার সময় স্পোর্টসকারের ইঞ্জিনের শব্দ শুনল রবিন আর মুসা।

ইয়ার্ডের গেট দিয়ে কিশোর ঢুকে যাওয়াতক অপেক্ষা করেছে টেরিয়ার, তারপর পিছু নিয়েছে রবিন আর মুসার।

তাকে পিছে পিছে টেনে নিয়ে চলল দুই সহকারী গোয়েন্দা। এমন ভাব করল, যেন কেউ পিছু নিয়েছে এটা বুঝতেই পারেনি। অহেতুক কয়েকটা আঁকাবাঁকা মোড় ঘুরে সময় নষ্ট করে শেষে বাড়ির পথ ধরল ওরা।

রবিনকে বাড়িতে ঢুকতে দেখে অবাক হল শুঁটকি। তারপর মুসার পিছু নিল। খানিক পরে দেখল, মুসাও বাড়িতে ঢুকছে। ড্রাইভওয়েতে ঢুকে ফিরে তাকাল মুসা। হাহ হাহ করে হেসে শুঁটকির দিকে চেয়ে হাত নাড়ল রাগিয়ে দেয়ার জন্যে। গাড়ি ঘুরিয়ে ধুলোর ঝড় তুলে চলে গেল বঁটকি।

রাতে খাওয়ার পর কিশোরকে ফোন করল রবিন।

কি জানি কোথায় গেল, মেরিচাচী জবাব দিলেন। তাড়াহুড়ো করে খেয়েই বেরিয়ে গেল।…না, কোথায় গেছে বলে যায়নি।

অবাক হয়ে রবিন ভাবল, গেল কোথায় কিশোর?

<

Super User