০৩. কালো মার্কা

বারোটা নাগাদ শরবত আর ওষুধ নিয়ে গেলাম নাবিকের ঘরে। তেমনি পড়ে আছে নাবিক। বিছানার সঙ্গে মিশে আছে একেবারে। সাংঘাতিক দুর্বল। কিন্তু চেহারায় পরিষ্কার উত্তেজনা লক্ষ্য করলাম।

বিছানার পাশে গিয়ে দাঁড়ালাম। চোখ মেলল নাবিক। ক্লান্ত মৃদুকণ্ঠে বলল, তুমি ছাড়া এখানকার সবাই অমানুষ, জিম। তাই তোমার সঙ্গে সব সময় ভাল ব্যবহার করি। অসহায় মানুষের একটা অনুরোধ রাখবে? করুণ আবেদন নাবিকের চোখের তারায়। আমাকে…খানিকটা রাম এনে দেবে? এই ইকটুখানি?

কিন্তু ডাক্তারচাচা…

ওসব ডাক্তার-ফাক্তারের কথা ছাড়, মৃদু গলায় বলল নাবিক। এরা কি জানে? দুনিয়া দেখেছি আমি। পাথরফাটা গরম দেখেছি…পীতজ্বরে তল্লাট সাফ হয়ে যেতে দেখেছি… ভূমিকম্পে পাহাড় ধসে যেতে দেখেছি… আর ওই ব্যাটা ডাক্তার, হুঁহ! …জিম, লক্ষ্মী ছেলে, একটুখানি এনে দাও না আমাকে! ভাল হয়ে উঠলে আরও অনেক মজার গল্প শোনাব। সোনার পুরো একটা গিনি দেব। দাও না!

দেখুন, ডাক্তারচাচার অনুকরণে হুঁশিয়ার করলাম আমি নাবিককে। বেশি রাম খেলে মরবেন। হোটেলের বদনাম হয়ে যাবে। এদিকে বাবার শরীর খুবই খারাপ। এই অবস্থায় যে কোন ধরনের উত্তেজনা তার জন্যে মারাত্মক। ঠিক আছে, এনে দিচ্ছি এক গ্লাস আর চাইলে এক ফোটাও পাবেন না।

এনে দিলাম। চকচক করে উঠল নাবিকের চোখ। বালিশে ভর দিয়ে কোনমতে আধশোয়া হল। গেলাসটা তুলে দিলাম তার হাতে।

ঢক ঢক করে এক নিঃশ্বাসে জ্বলন্ত তরল পদার্থটুকু গিলে ফেলল নাবিক। আহ, চমৎকার! জানটা বাঁচল! একটু শক্তিও পাচ্ছি মনে হচ্ছে। তা দোস্ত, ডাক্তার কি বলে? কতদিন শুয়ে থাকতে হবে এভাবে?

কমপক্ষে এক হপ্তা।

তারমানে কোনদিনই আর বিছানা ছেড়ে উঠতে পারব না! এর আগেই তো ব্ল্যাক স্পট দিয়ে দেবে আমাকে ওরা। আমি কোথায়, কেমন আছি, নিশ্চয়ই ফাঁস হয়ে গেছে এতক্ষণে। নিজেদের ভাগ শেষ করে আমার দিকে নজর পড়েছে ওদের। তোমাকে চুপিচুপি বলছি…কিছু টাকা আছে আমার। অনেক কষ্টে বাঁচিয়েছি। ওগুলো লুট করে নিতে চাইবে ওরা এবার। কিন্তু সেটা হতে দিচ্ছি না আমি কিছুতেই!

বিছানা থেকে মাটিতে পা নামাল নাবিক। উঠে দাঁড়াল। টলে উঠল পরক্ষণেই। পড়ে যাচ্ছিল, লাফ দিয়ে এগিয়ে গিয়ে তাকে ধরলাম। আমার কাঁধ খামচে ধরে কোনমতে টাল সামলাল সে। তারপর ধপাস করে বসে পড়ল বিছানায়। হ্যাচকা টানে উবু হয়ে পড়লাম। দুহাতে খামচে ধরলাম বিছানার কিনারা।

ব্যাটা ডাক্তার! গালাগাল দিল নাবিক। ওই ব্যাটাই আমার এই অবস্থা করেছে। ইসস, কান ভোঁ ভোঁ করছে!

আমার সাহায্য নিয়ে বালিশে মাথা রেখে আবার ঠিক হয়ে শুলো নাবিক। মিনিটখানেক চোখ বন্ধ করে চুপচাপ পড়ে রইল। আমি দাঁড়িয়ে রইলাম। ওর অবস্থা বিশেষ ভাল ঠেকছে না আমার।

চোখ খুলল নাবিক। আবার সেই পুরানো প্রশ্ন, জিম, খোঁড়া কোন জাহাজীকে দেখেছ?।

এদিক-ওদিক মাথা নাড়লাম।

দেখনি। কিন্তু ব্ল্যাক ডগকে তো দেখলে? পাজির পা-ঝাড়া! যারা তাকে পাঠিয়েছে, তারা তো এক একটা সাক্ষাৎ শয়তান। আমার শরীরের যা অবস্থা, যে-কোন সময় একটা কিছু ঘটে যেতে পারে। তোমাকে সেক্ষেত্রে একটা দায়িত্ব পালন করতে হবে। ওদের নজর এটার ওপর, ঘরের কোণে রাখা সিন্দুকটা দেখিয়ে বলল নাবিক, ওরা এলে ঘোড়া নিয়ে দ্রুত চলে যাবে অপদার্থ ডাক্তারটার কাছে। ম্যাজিস্ট্রেট সে। পুলিশ নিয়ে এসে যেন গ্রেপ্তার করে ফ্লিন্টের দলের সবকটাকে। জানো, ফ্লিন্টের জাহাজে ফার্স্ট মেট ছিলাম আমি… একমাত্র আমিই চিনি সেই জায়গাটা! সাভান্নায় মরতে বসেছিল ফ্লিন্ট। তার রোগশয্যার পাশে ছিলাম আমি। তখনই আমাকে জিনিসটা দেয় সে… তা, যাকগে ওসব কথা। আমি যা বলছি করবে শুধু ওরা ব্ল্যাক স্পট দিলে, তবেই। আবার ব্ল্যাক ডগ এলে… আর হ্যাঁ, খোঁড়া নাবিকের দেখা পেলেও জানাবে ডাক্তারকে। এই খোঁড়াটা আরও বেশি পাজি।

ব্ল্যাক স্পট কি, ক্যাপ্টেন?

মৃত্যু সমন। এলে জানাব তোমাকে। সন্দেহজক লোকের ওপর চোখ রাখবে এখন থেকে। কসম খাচ্ছি, আমার যা কিছু আছে, তোমার সঙ্গে ভাগাভাগি করে নেব।

আরও কিছুক্ষণ বকবক করল নাবিক। ক্রমেই গলার স্বর নিস্তেজ হয়ে আসছে। ডাক্তারচাচার দেয়া ওষুধ দিলাম তাকে। বাচ্চা ছেলের মতই আমার হাত থেকে নিয়ে খেল। বলল, সত্যিই, ওষুধ বড় দরকার এখন আমার। আস্তে আস্তে ঘুমিয়ে পড়ল নাবিক। গভীর ঘুম। ঘর থেকে বেরিয়ে এলাম।

সেদিনই সন্ধ্যায় মারা গেল বাবা। ক্যাপ্টেনের চিন্তা সাময়িকভাবে আমার মন থেকে মুছে গেল। প্রচন্ড শোক তো আছেই, তার ওপর প্রতিবেশীদের আসা যাওয়া, শেষকৃত্য, সরাইখানার দৈনন্দিন কাজকর্ম ইত্যাদি নিয়ে সাংঘাতিক ব্যস্ত রইলাম।

পরের দিনই কিন্তু নিচে নামল ক্যাপ্টেন। খেলও, কিন্তু অতি সামান্য। তবে রাম খেল প্রচুর। বারে গিয়ে নিজে নিয়েই খেল। তার মেজাজ দেখে বাধা দিতে সাহস করল না কেউ। বাবার শেষকৃত্যের আগের দিন রাতে তো গলা পর্যন্ত মদ গিলল। কুৎসিত গানটাও গাইল। নোংরামির চুড়ান্ত করে ছাড়ল একেবারে। শরীরের ওপর এই অত্যাচারে সাংঘাতিক রকম দুর্বল হয়ে পড়ছে সে ক্রমেই। আশঙ্কা হল, যে-কোন সময় ঢলে পড়ে মরে যেতে পারে। এদিকে ডাক্তারচাচাও নেই। দূরে কোথায় রোগী দেখতে গেছেন, বাবা মারা যাবার পর, এখনও ফেরেননি।

দুর্বল শরীর নিয়ে সিঁড়ি বেয়ে ওঠা-নামা করে ক্যাপ্টেন। কখনও দরজার বাইরে মুখ বাড়িয়ে সাগর দেখে, বাতাসে ভেসে আসা নোনাপানির গন্ধ নেবার চেষ্টা করে জোরে জোরে শ্বাস টেনে। আমার সঙ্গে কথা বলাও প্রায় ছেড়ে দিয়েছে। মেজাজ হয়ে উঠেছে অস্বাভাবিক রুক্ষ। মরে মরে অবস্থা, কিন্তু তবু হলঘরে বসে ছুরিটা খুলে টেবিলে রাখা তার বদভ্যাসে দাঁড়িয়েছে। মানুষজনের যাতায়াত নিয়ে বিশেষ মাথা ঘামায় না। চিন্তায় ডুবে থাকে।

বাবার শেষকৃত্যের পরের দিন। বিচ্ছিরি রকমের কুয়াশা পড়ছে। কনকনে ঠান্ডা। বেলা তিনটে নাগাদ কোন কারণ ছাড়াই দরজার কাছে গিয়ে দাঁড়ালাম। বাবার জন্যে মনটা কেমন করছে। এই সময়ই দেখলাম লোকটাকে। ধীর পায়ে এগোচ্ছে লাঠি ঠুকতে ঠুকতে। চলার ধরন দেখে অনুমান করলাম, সে অন্ধ। চোখ আর নাক সবুজ আচ্ছাদনে ঢাকা। সামনের দিকে কুঁজো হয়ে হাঁটছে। পরনে জাহাজীদের পুরানো শতচ্ছিন্ন জোব্বা। বিকলাঙ্গও মনে হচ্ছে তাকে। তীব্র ঠান্ডায় কুয়াশার ভেতর দিয়ে হেঁটে আসা লোকটাকে এক আজব প্রাণী বলে মনে হল আমার।

দরজার সামনে এসে দাঁড়াল লোকটা। তীক্ষকণ্ঠে যেন বাতাসকে উদ্দেশ্য করে বলল, গড ব্লেস কিং জর্জ। অন্ধ মানুষ আমি। দেশের কাজে চোখ হারিয়েছি। কেউ যদি বলে দিত, কোথায় এসেছি!

এটা অ্যাডমিরাল বেনবো ই্ন, বললাম। জায়গার নাম ব্ল্যাক হিল কোভ।

বাচ্চা ছেলের কথা শুনলাম? হাতটা একটু ধরবে, বাবা? হাত বাড়িয়ে দিল সে।

ধরলাম। চমকে উঠলাম পরক্ষণেই। প্রচন্ড জোরে আমার হাত চেপে ধরেছে আগন্তুক। ব্যথা লাগছে। হাত ছাড়িয়ে নেবার জোর চেষ্টা করলাম। পারলাম না। ঝটকা মেরে আমাকে একেবারে গায়ের ওপর এনে ফেলল লোকটা। বলল, আমাকে ক্যাপ্টেনের কাছে নিয়ে চল!

আঁ…আমি পারব না…আমাকে মেরে ফেলবে।

ওসব শুনতে চাই না! চাপা গলায় ধমকে উঠল অন্ধ, জলদি চল্‌! নইলে দিলাম কব্জি ভেঙে…। প্রচন্ড জোরে আমার কব্জি মুচড়ে দিল সে।

 

অস্কুট আর্তনাদ করে উঠলাম যন্ত্রণায়। অন্ধকে থামাবার ব্যর্থ চেষ্টা করলাম, সব সময় ছুরি সঙ্গে রাখে ক্যাপ…ওহহ…।

আমিও ছুরি রাখি, কব্জির ওপর হাতের চাপ বাড়াল আবার অন্ধ। ধানাই-পানাই বাদ দিয়ে চল জলদি! ভয়ঙ্কর কর্কশ হয়ে উঠেছে কণ্ঠস্বর। জীবনে শুনিনি এমনটি। সত্যিই ভয় পেলাম এবার। আর দ্বিরুক্তি না করে নিয়ে চললাম তাকে।

আমার শরীর ঘেঁষে, সাঁড়াশির মত কঠিন আঙুলে কব্জি চেপে ধরে পাশে পাশে চলল অন্ধ। সিড়ি বেয়ে উঠতে উঠতে আমাকে হুঁশিয়ার করল, কোনরকম চালাকি নয়। যেখানে নিয়ে যেতে বলছি, সোজা সেখানে…

দরজা ঠেলে ঘরে ঢুকলাম। নেশায় বুদ হয়ে পড়ে আছে ক্যাপ্টেন। দরজা খোলার শব্দেও চোখ তুলল না। ডেকে বললাম, ক্যাপ্টেন, দেখুন কে এসেছে!

কে? চোখ মেলল ক্যাপ্টেন। অন্ধের ওপর চোখ পড়তেই স্থির হয়ে গেল ঘোলাটে দৃষ্টি। দ্বিধা, তারপর ভয়, সবশেষে আতঙ্ক ফুটল নাবিকের চোখের তারায়। চকিতে যেন বয়েস আরও বেড়ে গেল তার। রাজ্যের ক্লান্তি এসে ভর করেছে রোগশীর্ণ মুখে। ঢলে পড়ে যাবে যেন যে-কোন সময়। এসে গেছ! ফিসফিস করে বলল ক্যাপ্টেন।

হ্যাঁ, আমার কব্জিতে আবার আঙুলের চাপ বাড়াল অন্ধ। বলল, এই ছোঁড়া, ওর পাশে নিয়ে যা আমাকে।

ক্যাপ্টেনের একেবারে গা ঘেঁষে দাঁড়াল অন্ধ। আমার কব্জি ছেড়ে দিল। একলাফে পিছিয়ে এলাম আমি। কব্জি ডলতে লাগলাম।

তোমার ডান হাতটা, বিল, আদেশ দিল অন্ধ।

অভিভূতের মত হাত বাড়াল ক্যাপ্টেন। কি একটা জিনিস গুঁজে দিল ক্যাপ্টেনের মুঠোয় অন্ধ। ধরল সেটা নাবিক, কিন্তু দেখার প্রয়োজন বোধ করল না।

জিনিসটা দিয়েই ঘুরে দাঁড়াল অন্ধ। লাঠিটা মাটিতে ঠুকে ঠুকে পথ চিনে নিয়ে নির্ভুলভাবে দরজা দিয়ে বেরিয়ে গেল সে। সিঁড়িতে তার লাঠির শব্দ মিলিয়ে যেতেই ছুটে গেলাম ক্যাপ্টেনের কাছে।

এতক্ষণে মুঠো খুলে চাইল ক্যাপ্টেন। এক টুকরো কাগজ। তাতে লেখাঃ দশটায়! আর মাত্র  ছয় ঘন্টা পরে!!

লাফিয়ে উঠে দাঁড়াল ক্যাপ্টেন। পরক্ষণেই হাত চলে গেল গলার কাছে। অদ্ভুত ঘড়ঘড় শব্দ বেরোচ্ছে গলা দিয়ে। কয়েক মুহূর্ত নিজেকে খাড়া রাখার ব্যর্থ চেষ্টা করল সে। তারপর দড়াম করে মুখ থুবড়ে পড়ল মেঝেতে।

চেঁচিয়ে মাকে ডাকলাম। ছুটে এল মা। কিন্তু বড় দেরি হয়ে গেছে। করার আর কিছুই নেই।

লোকটাকে কোন সময়েই ভাল লাগেনি আমার। কিন্তু আশ্চর্য! তার মৃত্যুতে অঝোর কান্না রোধ করতে পারলাম না কিছুতেই। কেন, নিজেও বুঝিনি সেদিন।

<

Super User