দীর্ঘ একটা মুহূর্ত পাথর হয়ে রইল যেন সবাই। দেয়ালে থিরথির করে কাঁপছে। ছুরির হাতল।

কিশোরের কাছে ছুটে গেলেন মেরিচাচী। উদ্বিগ্ন কণ্ঠে প্রায় ককিয়ে উঠলেন, এই, লাগেনি তো কোথাও! কিশোর?

মাথা নাড়ল কিশোর। দাঁড়িয়ে থাকতে পারছে না যেন, ধপ করে গিয়ে বসে পড়ল একটা পুরানো বেঞ্চে। বড় বাঁচা বেঁচেছে। অল্পের জন্যে চোখে লাগেনি ছুরিটা।

কে ছুঁড়ল? পাগলের মত এদিক ওদিক তাকাচ্ছেন ব্যানার।

আ-আমার দিকে তাকাচ্ছেন কেন? এক পা পিছিয়ে গেল টিক।

কে-কে-কেউ ছুঁড়েনি! তোতলাতে শুরু করল রবিন। বাক্স থেকে বেরিয়েছে।

কাছে এসে ভেতরে তাকালেন ব্যানার। গড! ভেতরে গোপন খোপ খুলে গেছে! নিশ্চয় কোথাও হাত দিয়ে ফেলেছিলে, রবিনকে বলল। কোন গোপন সুইচ-টুইচে।…

হ্যাঁ, আমারও তাই মনে হয়, বলল রবিন। গোপন খোপেই ছিল ছুরিটা। খোপের ঢাকনা খুলতেই স্প্রিং ছুটে গেছে। বুবি ট্র্যাপ!

খাইছে! মুসা বলল। খোপ যে খুলবে…।

শাসানোনার ভঙ্গিতে টিক বানাউয়ের দিকে এগোলেন মেরিচাচী। যদি এটা আপনার কাজ হয়ে থাকে…।

বুবি ট্রাপ কাকে বলে তা-ই জানি না আমি! আবার মেজাজ খারাপ হয়ে গেল নাবিকের।

না, আপনি করেননি একাজ! কিশোর বলল। মুখে রঙ ফিরতে শুরু করেছে ওর। উঠে গিয়ে দেয়াল থেকে খুলে নিল ছুরিটা। প্রাচ্যের জিনিস এটা। যতদূর মনে হয়, পূর্ব ভারতীয়। বাজি রেখে বলতে পারি, শত বছর আগে ওই ফাঁদ পেতে রেখেছিল কোন জলদস্যু!

খাইছে!

জলদস্যু? রবিন বলল।

কিশোরের চোখ চকচক করছে। ছুরিটা নিয়ে বাক্সের কাছে ফিরে এল সে। গোপন খোপটা পরীক্ষা করতে লাগল। মাথা ঝাঁকাল সন্তুষ্ট হয়ে। বললাম না? স্প্রিং, হুড়কো, সব হাতে বানানো। মরচে পড়েছে। অনেক পুরানো। দামি জিনিস চোর-ডাকাতের হাত থেকে বাঁচানোর জন্যে এরকম ফাঁদ পাতা হত সেকালে। জাভা আর মালয়ের জলদস্যুরা এসব কাজে ওস্তাদ ছিল।

সবার চোখ ঘুরে গেল টিক বানাউয়ের দিকে।

না-না, তাড়াতাড়ি দুহাত নাড়ল পানির পোকা। আমি ওসব দেশের লোক নই। তবে জাভায় ছিলাম অনেকদিন। কোন জলদস্যুর সঙ্গে আমার কোন সম্পর্ক নেই।

গুঙিয়ে উঠল মুসা। জাভা জায়গাটা যে কোথায়, তা-ই আমি জানি না।

ইন্দোনেশিয়ার একটা বড় দ্বীপ, বলল কিশোর। কাছাকাছি আরও দ্বীপ আছে। সুমাত্রা, নিউ গিনি, বোর্নিও, সেলিবিস, এবং আরও হাজারও ছোট-বড় দ্বীপ। এখন ইন্দোনেশিয়া স্বাধীন, কিন্তু আগে ওলন্দাজ কলোনি ছিল ওখানে। ছোট ছোট শত শত রাজ্য ছিল, ওগুলোকে বলা হত সালতানাত, শাসনকারীদের বলা হত সুলতান। বেশির ভাগই ডাকাত ছিল ওরা।

ব্ল্যাকবিয়ার্ডের মত? জানতে চাইল মুসা। পাল তোলা জাহাজ, ভারি কামান, কালো পতাকায় মানুষের খুলি আর হাড়ের ছবি…।

না, ঠিক ওরকম নয়। এসব ছিল পশ্চিমা জলদস্যদের নিশানা। ব্ল্যাকবিয়ার্ড ছিল ইংরেজ। ঈস্ট ইনডিয়ান জলদস্যুদের বড় জাহাজ ছিল না, জলি রজার পতাকা ছিল না, কামানও ছিল খুব কম। ছোট দ্বীপগুলোতে থাকত ওরা। ইউরোপিয়ান কিংবা আমেরিকান জাহাজ দেখলেই তেড়ে এসে চড়াও হত।

পশ্চিমা জাহাজগুলো তখন ওসব অঞ্চলে যেত মশলা, টিন, চা আর চীন থেকে সিল্ক আনার জন্যে। নানারকম চমকপ্রদ জিনিস নিয়ে য়েত ব্যবসা করার জন্যে, আর নিত ব্যাগভর্তি সোনা-রূপা। অস্ত্রশস্ত্রও নিত। সেসব ছিনিয়ে নেয়ার জন্যেই হামলা চালাত জলদস্যুরা। তবে সব সময়ই হেরে আসত না পশ্চিমারা। পাল্টা হামলা চালাত। অনেক সময় তো ঘরে ঢুকে গিয়ে শেষ করে দিয়ে আসত জলদস্যুদের।

তারমানে এদেশীরাও কম ডাকাত ছিল না, হেসে বলল রবিন। তো, তোমার কি ধারণা? ওই অঞ্চল থেকেই এসেছে এই বুবি ট্র্যাপ?

ধারণা নয়, আমি শিওর, চিন্তিত ভঙ্গিতে গাল চুলকাল কিশোর। শোনা, যায়, এখনও নাকি কিছু জলদস্যু আছে কোন কোন দ্বীপে।

কিশোর, দেখ! চেঁচিয়ে উঠল মুসা। বাক্সের ভেতর ছোট একটা জিনিস পেয়ে তুলে দেখাল, আঙটি! খোপটাতে ছিল।

আর কিছু আছে? রবিন জিজ্ঞেস করল।

ঠেলে মুসাকে সরিয়ে বাক্সের ওপর ঝুঁকল টিক। দেখি তো। ঘোড়ার ডিম আর কিছু নেই।

মুসার হাত থেকে আঙটিটা নিল কিশোর। নিখুঁত, সূক্ষ্ম খোদাই। সোনার হতে পারে, কিংবা তামার, ঠিক বোঝা যাচ্ছে না। মাঝখানে লাল একটা পাথর বসানো।

খাঁটি, কিশোর? মুসা জানতে চাইল।

বুঝতে পারছি না। হতে পারে। খাঁটি সোনার অলঙ্কার যেমন পরত ওখানকার লোকে মেকিও পরত। সোনার রঙ করা, কিন্তু সোনা নয়। ওসব দিয়ে ইউরোপিয়ানরাই বেশি ঠকাত দেশী লোকদের।

আঙটির জন্যে হাত বাড়াল টিক। আসলই হোক আর নকলই হোক, ওট আমার জিনিস, থোকা। বাক্সটা যেহেতু আমার, ভেতরের সব কিছুই আমার। দাম বল। আমার বাক্স আমি নিয়ে যাই।

দেখি আগে, কি কি আছে, মেরিচাচী বললেন। তারপর বলছি…

বাধা দিল কিশোর, চাচী, বাক্সটা কার, কিভাবে জানছি আমরা। নাম -তে আর লেখা নেই। ওরকম গপ্পো যে-কেউ এসে শোনাতে পারে।

আমাকে মিথ্যুক বলছ, ছেলে? খেপা ষাঁড়ের মত গোঁ গোঁ করে উঠল টিক।

বেশ, প্রমাণ করুন যে আপনি সত্যি বলছেন। কাগজ-টাগজ দেখান। কা; কাছ থেকে কিনেছেন, লিখিত আছে? নইলে এমন কাউকে গিয়ে নিয়ে আসুন, যে সাক্ষী দেবে এটা আপনার। বলবে, জাহাজে আপনার কাছে ছিল।

সবাই বলবে। আমার সঙ্গে যেসব নাবিক আছে, সব্বাই। এখন আমার জিনিস…।

ঠিক আছে, কিশোর বলল। বাক্সটা আমরা রেখে দেব। কারও কাছে বেচব। আপনি গিয়ে লোক নিয়ে আসুন। এক হপ্তা রেখে দেব আমরা। বাক্স ছাড়া ওই কটা দিন নিশ্চয় আপনার অসুবিধে হবে না?

হ্যাঁ, ভাল কথা বলেছ, মিস্টার ব্যানার বললেন। টিক বানাউয়ের চোখ জ্বলছে। যথেষ্ট হয়েছে। এত ভাল কথা লাগবে না। আমার। যা দরকার, সেটা নিয়ে তবেই যাব এখান থেকে, কেউ ঠেকাতে পারবে ন। কিশোরের দিকে এগোল। দাও দিখি আঙটিটা।

দরজার দিকে পিছাতে শুরু করল কিশোর।

এই, শুনুন, বাধা দিতে চাইলেন মেরিচাচী।

চুপ! বলে তাকে থামিয়ে দিল নাবিক।

বিশাল ছায়া পড়ল দরজায়। ঘরে ঢুকল ব্যাভারিয়ান। এই, কাকে ধমক দিলে? শান্তকণ্ঠে বলল সে। ম্যাডামকে? যাও, পায়ে ধরে মাপ চাও।

জোর করে বাক্সটা নিয়ে যেতে চাইছে! চেঁচিয়ে জানাল রবিন।

তাই নাকি?

ধরুন ওকে, বোরিস ভাই, কিশোর বলল।

ধরছি।

বোরিসকে দেখেই থমকে গিয়েছিল টিক। এগোতে দেখে মিস্টার ব্যানারের আড়ালে চলে গেল। শেষে বিপদ বুঝে এক ধাক্কায় মিউজিয়ম-মালিককে বোরিসের গায়ের ওপর ফেলে দরজার দিকে দিল দৌড়।

ধরুন, ধরুন! চেঁচিয়ে উঠল মুসা।

চিত হয়ে পড়ে গেছে বোরিস। তার গায়ের ওপর পড়েছেন বেচারা ব্যানার। জট ছাড়িয়ে দুজনে যখন উঠে দাঁড়াল, বেরিয়ে গেছে টিক। মিউজিয়মের পেছনে গাড়ির ইঞ্জিনের শব্দ হল। ছুটে বাইরে বেরোল ছেলেরা। দেখল, ধুলো উড়িয়ে চলে যাচ্ছে একটা গাড়ি। কোস্ট হাইওয়ে ধরে ছুটে হারিয়ে গেল পাহাড়ের মোড়ে।

ঝামেলা গেল, হাত ঝাড়লেন মেরিচাচী। কাজ সেরে ফেলা দরকার। দাঁড়িয়ে থেক না। মালগুলো তুলে ফেল। …

বুঝতে পারছি না, রবিন বলল। বাক্সটার কী প্রয়োজন তার? এত আগ্রহ কেন?

সুন্দর দেখেছে তো, মেরিচাচী বললেন। ফাঁকি দিয়ে নিতে চেয়েছিল আরকি। যাও যাও, কাজ সেরে ফেল। একবারে শেষ হবে না মাল, আবার আসতে হবে।

ঘন্টাখানেক পর মালের ছোটখাটো একটা পাহাড় তৈরি হল ট্রাকের পেছনে। সামনে উঠে বসলেন মেরিচাচী আর বোরিস। পেছনে ছেলেদেরকে উঠতে সাহায্য করলেন ব্যানার।

মিস্টার ব্যানার, ভুরু কুঁচকে রেখেছে কিশোর। আপনি বললেন স্যান ফ্রান্সিসকোর মরিস ডিলম্যান বাক্সটা পাঠিয়েছে আপনার কাছে?

হ্যাঁ। স্থানীয় লোকের আগ্রহ রয়েছে জাহাজটার ওপর। একশো বছর আগে রকি বীচের কাছেই ডুবেছিল লিটল মারমেইড। মাঝে মাঝেই ওটার জিনিসপত্র বেরিয়ে আসে লোকের হাতে, আমার সামনে পড়লে কিনি…মানে, কিনতাম। এখন আর কিনব না।

নিশ্চয়। এখন আর কি দরকার, কিশোর বলল। হ্যাঁ, একশো নয়, কিছু কম। আঠারশো চুরানব্বই সালে ডুবেছিল জাহাজটা।

ছুটে চলেছে ট্রাক। ভাবনায় ডুবে আছে কিশোর। রবিন আর কিশোর কথা বলছে, দুপাশের দৃশ্য দেখছে।

ইয়ার্ডে পৌঁছল ট্রাক।

মুসা বলল, কিশোর, ফলো করা হয়েছে আমাদের। সবুজ একটা ফোক্সওয়াগেন। সারা পথ পিছে পিছে এসেছে।

লাফিয়ে ট্রাক থেকে নামল তিন গোয়েন্দা। ছুটে গেল গেটের কাছে। পথের পাশে দাঁড়িয়ে আছে সবুজ ফোক্সওয়াগেন। কিন্তু ভেতরে কে আছে, ছেলেরা সেটা দেখার আগেই স্টার্ট নিয়ে টায়ারের তীক্ষ্ণ আর্তনাদ তুলে পথে উঠল গাড়ি, মুখ ঘুরিয়ে চলে গেল।

খাইছে! টিক বানাউ?

হতে পারে, কিশোর বলল। কিন্তু মিউজিয়ম থেকে তো উল্টোদিকে গিয়েছিল সে, এদিকে নয়। আমাদের পিছু নিল কিভাবে?

বাক্সটার ব্যাপারে আরও আগ্রহী লোক আছে হয়ত, রবিন বলল।

কিংবা হয়ত লিটল মারমেইডের ধ্বংসাবশেষের ব্যাপারে আগ্রহী। রহস্যের গন্ধ পেয়েছে কিশোর পাশা, উত্তেজনায় ফেটে পড়বে যেন। তিন গোয়েন্দার জন্যে আরেকটা কেস। আমরা এখন…

তোরা এখনও এখানে? পেছন থেকে ওদেরকে চমকে দিলেন মেরিচাচী। ট্রাকের মাল নামাবি কখন? জলদি কর, জলদি কর।

ফোঁস করে নিঃশ্বাস ফেলে গিয়ে মাল নামানোয় হাত লাগাল ছেলেরা। পুরানো বাক্সের রহস্য সমাধান আপাতত বাদ।

<

Super User