দীর্ঘ একটা মুহূর্ত সেদিকে তাকিয়ে থেকে জোসিকে জিজ্ঞেস করল কিশোর, ও অমন করল কেন?

জানি না, বিষন্ন মনে হলো জোসিকে। সেই ছোটবেলা থেকে আমাদের বন্ধুত্ব। কিছুদিন থেকে কী যে হয়েছে ওর, একেবারেই সহ্য করতে পারে না আমাকে। ডগ রেসে বার বার আমার কাছে পরাজয়টা মেনে নিতে পারছে না বোধহয়।

প্রতিযোগিতায় হারজিত তো আছেই, মুসা বলল। তার জন্য এত শত্রুতা? নিশ্চয় তুমি ওর চেয়ে ভাল মাশার, নইলে জেতো কেন?

মাশার! বাহ, চমৎকার উচ্চারণ, হাসি ফুটল জোসির মুখে। শেখো, শেখো, শিখে ফেললা আমাদের ভাষা। কঠিন কিছু না।

মুসার মনে হলো ওর প্রশ্নটা এড়িয়ে গেল জোসি।

যে রাস্তা ধরে চলেছে ওরা, সেটা গেছে একটা ভোলা চতুরের ধার দিয়ে। পঞ্চান্ন গ্যালনের অনেকগুলো বড় বড় ড্রাম রাখা আছে চত্বরে। পাশে একটা ছোট্ট ছাউনি। ছাউনির ভিতর থেকে আসছে ইঞ্জিনের শব্দ।

কীসের শব্দ জানতে চাইল মুসা।

জেনারেটর, জোসি বলল। ডিজেলে চলে। ওই ড্রামগুলোতে ডিজেল ভর্তি। গরমকালে ইউকনে যখন বরফ থাকে না, তখন বার্জে করে নিয়ে আসা হয়। হিসেব করে বিদ্যুৎ খরচ করতে হয় আমাদের। বসন্তে বরফ গলা শুরু হওয়ার আগে তেল ফুরিয়ে গেলে বিপদ। জেনারেটর চলবে না। বিদ্যুৎ বন্ধ। অন্ধকারে থাকতে হবে রাতের বেলা।

চিন্তিত অন্যমনস্ক ভঙ্গিতে হেঁটে চলেছে কিশোর। শহরটা বড় বেশি নিঃসঙ্গ। অস্বস্তি লাগছে ওর। এখানে সব কিছু ঠিকঠাক মত চললে কোন ভয় নেই। কিন্তু যে কোন অঘটন কিংবা অনিয়ম ঘটলে, তা সে যত সামান্যই হোক না কেন, শহরটাকে ধ্বংসের মুখে ঠেলে দিতে পারে।

টেড সিউলের কথা ভাবল কিশোর। রহসময় আচরণ করেছে। জোসিকে জিজ্ঞেস করল, জোসি, টেড যে তোমাকে শাসিয়ে গেল, কতটা ক্ষতি করতে পারে?

আগে আগে হাঁটছে জোসি। ফিরে তাকিয়ে জবাব দিল, বাদ দাও ওর কথা। কামড়ের চেয়ে ঘেউ ঘেউ বেশি।

হেসে রসিকতা করল মুসা, হাস্কিগুলোর মত।

হাস্কিরা ভীষণ প্রয়োজনীয় প্রাণী, হাসিটা ফিরিয়ে দিল জাসি। টেডের সমস্যাটা হলো, ও শুধুই ফাস্ট হতে চায়। কিন্তু সব তো আর ওর পছন্দমত চলবে না।

কখনও হেরেছ ওর কাছে? কিশোর জিজ্ঞেস করল।

একবার প্রায় হেরে গিয়েছিলাম।

তারমানে হারনি। বুঝলাম, এ জন্যই জেদ বেড়ে গেছে ওর,মুসা বলল। জেদ থেকে শত্রুতা।

প্রতিযোগিতা যত বড় মাপের হয়, উত্তেজনা তত বাড়ে। কিশোর জানে, ইডিটারোড রেসের মত কুকুর-দৌড়ের এতবড় প্রতিযোগিতা পৃথিবীর আর কোথাও হয় না। তাতে অংশ গ্রহণ করতে পারাটাও বিরাট সম্মানের ব্যাপার। স্বাভাবিকভাবেই গ্লিটারবাসীরা এ নিয়ে উত্তেজিত। দুটো দলে ভাগ হয়ে গেছে তারা। কারও সাপোর্ট জোসির পিছনে, কারও টেডের। হেরে গেলে ভক্তদের কাছে মুখ দেখাতে পারবে না এই দুশ্চিন্তায়ই নিশ্চয় খিটখিটে হয়ে গেছে টেড।

মোড় নিয়ে আরেকটা পায়ে চলা পথে নামল ওরা। লম্বা একজন মানুষকে আসতে দেখল। গায়ে সবুজ পার্কা। পরনে সবুজ টুয়িলের প্যান্ট।

বিগস আসছে, জোসি বলল। ইলকিস বিগস্। কোম্পানির লোক।

কিশোর জিজ্ঞেস করল, কোন কোম্পানি?

থিম পার্ক কর্পোরেশন, বললাম না তখন। গ্লিটারেও একটা থিম পার্ক বানাতে চায়। প্রতি শীতেই গ্লিটারে এসে হাজির হয় ও। কোম্পানির পক্ষে প্রচার চালায়। এবার একেবারে আটঘাট বেঁধে এসেছে। ভোট না নিয়ে আর যাবে না। হা-না একটা কিছু সিদ্ধান্ত জেনে তবেই যাবে।

মুখে ঝলমলে হাসি নিয়ে দৃঢ় আত্মপ্রত্যয়ের সঙ্গে লম্বা লম্বা পা ফেলে এগিয়ে এল বিগস্। হ্যালো, জোসি। কিশোর-মুসাকে দেখাল। এরাই নিশ্চয় তোমার রকি বিচের বন্ধু। কিশোর কোন জন, আর মুসা কোন জন?

ও কিশোর, দেখিয়ে দিল জোসি। আর ও মুসা। ইডিটারোড রেসে আমাকে সাহায্য করবে।

কিশোর ও মুসার দিকে তাকিয়ে আন্তরিক হাসি হাসল বিগস্। আলাস্কায় স্বাগতম। তোমরা আসতে না আসতে কীভাবে জেনে গেলাম ভেবে অবাক হচ্ছ নিশ্চয়? এখানে খবর খুব দ্রুত ছড়ায়। আচ্ছা যাই, পরে কথা হবে। জরুরি কাজ আছে আমার।

চলে গেল বিগস্।

লোকটা কিন্তু খুব আন্তরিক, মুসা বলল। কাজের প্রতি ভীষণ সিরিয়াস।

মনে হয়, জোসি বলল।

মনে হয় মানে? তোমার সন্দেহ আছে নাকি?

বাদ দাও, হাত নেড়ে যেন বিগসকে উড়িয়ে দিল জোসি। চলো।

আবার পা বাড়াল ওরা। কিছুদূর এগোতে জোসির কেবিনটা চোখে পড়ল। এটাতেই কিশোরদের থাকার ব্যবস্থা করা হয়েছে। তিন পাশে বন, একপাশে নদী। নদীর দিকটা ভোলা থাকায় রোদ পাওয়া যাবে।

চাচা-চাচীর কেবিনের দিকে তাকাল জোসি। জানালার পর্দা টানা দেখে বলল, ও, এখনও আসেনি। এত দেরি করছে কেন? তোমরা এখন বিশ্রাম নেবে?

মুসা বলল, ঘরে যেতে ইচ্ছে করছে না। তবে তোমার জরুরি কাজ থাকলে…

আমার কাজ নেই, জোসি বলল। শ্লেজে চড়ে ঘুরবে?

চেঁচিয়ে উঠল মুসা, নিশ্চয়ই!

চলো, চলো! জবাব দিতে এক মুহূর্ত দ্বিধা করল না কিশোরও।

কুকুরগুলোর কাছে ফিরে এল ওরা। স্টোরেজ শেড অর্থাৎ মালপত্র রাখার ছাউনি থেকে ওক কাঠে তৈরি স্লেজটা বের করতে জোসিকে

সাহায্য করল দুজনে।

স্লেজের আকার দেখে মুসা অবাক। এত লম্বা?

প্রচুর খাবার আর জিনিসপত্র সঙ্গে নিতে হয়, জোসি বলল। চলার পথে ঘুমানোর কাজটাও গাড়িতেই সারতে হয়। বড় করে তো বানাতেই হবে।

গাড়ির সঙ্গে লম্বা এক সারি লাগাম জুড়ে দিতে লাগল জোসি। কী ঘটতে যাচ্ছে বুঝে ফেলল কুকুরগুলো। আগ্রহ আর উত্তেজনায় প্রচণ্ড চিৎকার আর লাফালাফি শুরু করল।

গাড়িতে জোতা শিখবে? জিজ্ঞেস করল জোসি।

এতে শেখার কি আছে? মুসা বলল, লাগাম পরিয়ে দিলেই হয়।

না, হয় না। উল্টোপাল্টা লাগালে হবে না। এরও নিয়ম আছে। গাড়ির কাছ থেকে সারি দিয়ে নিয়ে যেতে হবে। গাড়ির একেবারে কাছে যে কুকুরগুলোকে বাঁধা হবে, ওগুলোকে বলে হুইল ডগ। আগের কুকুর পিছে, আর পিছের কুকুর আগে বাঁধলে ঠিকমত টানতেই পারবে না।

একটা কুকুরের বাঁধন খুলে স্লেজের একেবারে কাছের সুটটার সামনে নিয়ে এল জোসি। প্যাড লাগানো লাগামটা পরিয়ে দিতে লাগল। বাধা দিল না কুকুরটা।

ওদের মনিব কে, সেটা ওদেরকে ভালমত বুঝিয়ে দিতে হবে, জোসি বলল। দুর্বলতা প্রকাশ করা চলবে না কোনভাবেই। বাঁধন খুলে কীভাবে কুকুরকে নিয়ে আসতে হয়, দেখলে। এখন যাও। মুসা, তুমি রেড লাইটকে নিয়ে এসো। আর কিশোর, তুমি হোয়াইট ক্লাউডকে।

কোনটা রেড লাইট আর কোনটা হোয়াইট ক্লাউড, আঙুল তুলে দেখিয়ে দিল জোসি। বাঁধন খুলে কলার ধরে কুকুর দুটোকে স্লেজের কাছে টেনে নিয়ে এল কিশোর ও মুসা। সেগুলোকে লাগামের সঙ্গে জুড়ে দিতে লাগল জোসি। ডায়মওহার্টের পালা এল সবশেষে। চোখের আন্দাজে মেপে দেখল কিশোর। টানার সময় গাড়ি থেকে প্রায় চল্লিশ ফুট দূরে থাকবে এই নেতা-কুকুরটা। কুকুরের এই স্লেজ চালানোর জন্য অনেক জায়গা লাগে।

প্রচণ্ড শক্তি ও আত্মবিশ্বাসে ভরা একটা পাওয়ার হাউসে পরিণত হয়েছে যেন হাস্কি কুকুরের সম্মিলিত দলটা। ক্রমাগত লেজ নেড়ে নেড়ে লাফানো শুরু করেছে কুকুরগুলো। ছোটার জন্য অস্থির। যেন শুধু এ কাজটা করার জন্যই বেঁচে আছে ওরা। গাড়ি টেনে নিয়ে দৌড়ানোটা যেন ওদের নেশা।

ভালমত দৌড় করিয়ে আনতে হবে ওদের, জোসি বলল। গাড়িতে ওজন দরকার। মালপত্র তো নেই, সে-জায়গাটা তোমরা পূরণ করো। গাড়িতে গিয়ে বসো।

উঠে বসল মুসা। মুখোমুখি বসল কিশোর। শ্লেজের পিছনে রানারের ওপর উঠে দাঁড়াল জোসি।

দারুণ গাড়ি। স্টিয়ারিং হুইল নেই। অ্যাক্সিলারেটর নেই, মুসা বলল।

সিটবেল্ট নেই। এয়ারব্যাগ নেই, বলল কিশোর।

হাসাহাসি করতে লাগল তিনজনে।

কাঁধের ওপর দিয়ে ফিরে তাকাল ডায়মণ্ডহার্ট। উত্তেজনায় কাঁপছে। কিশোরের মনে হলো, কুকুরটাও যেন মজা পাচ্ছে ওদের রসিকতায়।

কুকুরগুলোর উদ্দেশ্যে চিৎকার করে উঠল জোসি, হাইক! হাইক!

জমাট তুষারে পা বসিয়ে টান দিল কুকুরগুলো। একসঙ্গে ঝাঁপ দিল সামনের দিকে। অসমতল বরফের ওপর দিয়ে ঝাকি খেতে খেতে নদীর দিকে ছুটল স্লেজ। আচমকা এই তীব্র গতিবেগ অবাক করল কিশোর ও মুসাকে।

হাইক! হাইক! আবার চিৎকার করে উঠল জোসি। বাঁ পায়ের ভর রানারে রেখে ডান পা নামিয়ে লগি দিয়ে নৌকা বাওয়ার মত করে ঠেলা মারছে, গতি বাড়াতে সাহায্য করছে কুকুরগুলোকে।

পার্কার গলার কাছের ফিতে বাধল কিশোর। মাথার হুড তুলে কান ঢাকল। বাতাসে বরফের ছোঁয়া। হাঁটার সময় এত গতিও থাকে না, এত বাতাসও লাগে না। কনকনে ঠাণ্ডা ইতিমধ্যেই ওর নাক-গাল অসাড় করে দিয়েছে।

নদীর পাড়ে পৌঁছল গাড়ি। জমাট বরফের ওপর গাড়িটা লাফিয়ে ওঠার সময় থাবা দিয়ে গাড়ির ধার খামচে ধরল কিশোর। ওর মনে হলো, আকাশে উড়াল দিয়েছে স্লেজ।

মহা আনন্দে চিৎকার করে উঠল মুসা, ইয়াহু!

পিচ্ছিল বরফে উঠে আসায় গতি বেড়ে গেল স্লেজের। আরও জোরে টানতে লাগল কুকুরগুলো। গতি বাড়ানোর জন্য ওগুলোরও যেন রোখ চেপে গেছে।

চিৎকার করে বলল জোসি, আরে থাম, থাম!

শীতের রৌদ্রালোকে ঝকঝক করছে সাদা বরফ। চোখে লাগে। চোখের পাতা সরু করে চারপাশে তাকাতে লাগল কিশোর। দিগন্ত পর্যন্ত বিস্তৃত সীমাহীন আলাস্কার বরফে ঢাকা এই আদিম প্রকৃতিতে কিছুই নড়ছে না, কোন শব্দ নেই, একমাত্র বরফের ওপর দিয়ে ছুটে চলা স্লেজ ও একপাল কুকুরের নিঃশ্বাসের শব্দ ছাড়া।

সামনে দুই ভাগ হয়ে গেছে পথটা। চিৎকার করে ডায়মণ্ডহার্টকে নির্দেশ দিল জোসি, জি! ডায়মণ্ড, জি!

মুহূর্তে ডানে মোড় নিল ডায়মণ্ডহার্ট।

ডানে ঘোরার জন্য জি, কিশোর বলল, বাঁয়ে ঘোরাতে হলে?

হউ! জোসি বলল। স্লেজ ডগকে প্রথম যে দুটো শব্দ শিখতে হয়, তা হলো এই জি আর হউ।

ভীষণ ঠাণ্ডা! মুসা বলল।

হ্যাঁ।

তাপমাত্রা এখন শূন্যের বিশ ডিগ্রি নীচে।

নদীর ওপর দিয়ে কোণাকুণি ছুটছে স্লেজ। বহু ব্যবহৃত পথটা দেখে বোঝা যায় মাত্র একটা স্লেজ চালিয়ে এই রাস্তা তৈরি করা সম্ভব নয়। শহরের অন্য মাশাররাও নিশ্চয় এই পথ ব্যবহার করে। লাকড়ি আনতে নদী পেরিয়ে বনে যায়। ইউকন নদীটা শীতকালে হয়ে যায় গ্লিটারবাসীর মহাসড়ক।

কে আসে দেখো! জোসি বলল।

একসঙ্গে ফিরে তাকাল কিশোর-মুসা দুজনেই।

ওদিকে নয়, বাঁয়ে তাকাও, জোসি বলল।

গলা লম্বা করে বাঁয়ে তাকাল কিশোর। নদীর তীর ধরে আরেকটা কুকুর-বাহিনীকে এগিয়ে আসতে দেখল। জোসিকে জিজ্ঞেস করল, কে, টেড নাকি? তোমার সঙ্গে রেস খেলতে আসছে?

নাহ্, প্র্যাকটিস করছে।

দৌড়াচ্ছে তো খুব জোরে, বিড়বিড় করল মুসা। পালাচ্ছে নাকি?

পালাবে কেন? টেডের দিকে তাকিয়ে আছে জোসি। গাড়িতে মালপত্র নেই, বোঝা নেই, সে-কারণেই গতি বেশি। এভাবে প্র্যাকটিস করাটা ভুল। তাতে আসল রেসের সময় যখন বোঝা নিয়ে দৌড়াবে কুকুরগুলো, অনভ্যস্ততার কারণে অসুবিধে হবে ওদের। যা ইচ্ছে করুকগে, আমার কী।

টেডকে ভাল করে দেখার জন্য অনেকখানি ঘাড় ঘোরাল কিশোর।

আচমকা চেঁচিয়ে উঠল, জোসি, এত ধােয়া কেন শহরে?

কাঁধের ওপর দিয়ে ফিরে তাকাল জোসি। চমকে গেল সে-ও। হুয়া! হুয়া! বলে উত্তেজিত চিৎকার করে থামতে বলল কুকুরগুলোকে। এত জোরে ব্লেড-ব্রেক চেপে ধরল, তুষারে বসে গেল ব্রেকের ব্লেড। নৌকার মত দুলে উঠল স্লেজ। প্রচণ্ড ঝাঁকি লাগল।

দাঁড়িয়ে গেল ডায়মণ্ডহার্ট সহ বাকি কুকুরগুলো।

কিছু একটা হয়েছে, চিন্তিত ভঙ্গিতে ধোঁয়ার দিকে তাকিয়ে আছে জোসি। শহরের একধারে কালো ধোয়ার মোটা একটা রেখা আকাশে উঠে যাচ্ছে।

কীসের ধোঁয়া? জানতে চাইল মুসা।

চাচার কেবিনে আগুন লেগেছে! জোসি বলল।

<

Super User