লাফিয়ে উঠল কিশোর। পিছিয়ে গেল জঞ্জালের কাছে। বরফের মত জমে গেছে যেন মুসা আর রবিন।
পায়ে পায়ে কিশোরের দিকে এগোল টিক। বইটা শক্ত করে বুকের ওপর চেপে ধরেছে কিশোর। মুসা! চেঁচিয়ে উঠল সে। পরিকল্পনা এক!
পাই করে অন্য দুজনের দিকে ঘুরল টিক। খবরদার! কোন চালাকি নয়!
দাড়িওয়ালা নাবিকের কঠিন দৃষ্টি বর্শার ফলার মত বিদ্ধ করছে যেন দুই সহকারী গোয়েন্দাকে। ঢোক গিলল দুজনেই। ওদেরকে ভয় দেখাতে পেরে তাচ্ছিল্যের হাসি হাসল টিক। দাও, বইটা। নিয়ে যাব।
আপনি এক নম্বরের মিথ্যুক! বলে, পাশে সরতে আরম্ভ করল কিশোর। এবং চোর!
হেসে উঠল টিক। ভুল বললে, থোকা। ডাকাত। ছিনিয়ে নিতে এসেছি যে। আর আমার খারাপের দেখেছ কি? দরকার পড়লে…, বাক্যটা শেষ করল না সে। দাও, বইটা।
সরেই যাচ্ছে কিশোর। সঙ্গে সঙ্গে এগোচ্ছে টিক। জঞ্জালের একটা বিশেষ স্কুপের কাছে চলে এল লোকটা। খেয়াল করল না, তার পেছনে চলে গেছে রবিন আর মুসা।
এইবার! চেঁচিয়ে উঠল কিশোর।
নিচু হয়ে স্কুপের নিচ থেকে একটানে দুটো তক্তা বের করে ফেলল রবিন আর মুসা। ফিরে তাকাল টিক। কিন্তু দেরি করে ফেলেছে।
লাফ দিয়ে সরে গেছে রবিন আর মুসা। টিকের গায়ের ওপর ভেঙে পড়ল জঞ্জালের স্তূপ-তত্ত্বা, খাটের স্প্রিং, ভাঙা চেয়ার, ছেড়া কার্পেট। লাথি মেরে, দুহাতে ঠেলে ওসব সরিয়ে বেরোনোর চেষ্টা করছে সে।
দাঁত বের করে হাসছে রবিন আর মুসা।
দাঁড়িয়ে আছ কেন? কিশোর বলল। জলদি দৌড় দাও!
ছড়িয়ে পড়া জঞ্জাল এড়িয়ে লাফিয়ে বেরিয়ে এল ওরা। ছুটল ইয়ার্ডের অফিসের দিকে। ট্রাকে মাল তুলছে বোরিস। তখনও জঞ্জাল সরিয়ে বেরোতে ব্যস্ত টিক, আওয়াজ শোনা যাচ্ছে।
বোরিস ভাই! চিল্কার করে ডাকল মুসা। ওয়ার্কশপে চোর ঢুকেছে! ধরুন ওকে!
তাই নাকি? হাতের ভাঙা চেয়ারটা মাটিতে ফেলে দিল বোরিস। চল তো দেখি।
ওয়ার্কশপে চলল আবার ওরা। আওয়াজ থেমে গেছে। ছুটে বেরোল একজন মানুষ, দৌড় দিল পেছনের বেড়ার দিকে।
ওই যে! বলেই মুসাও দৌড়াল পেছনে।
রবিন বলল, কি জানি নিয়ে যাচ্ছে! হাতে….বোধহয় নোটবুক! কিশোর, কখন ফেললে?
খাইছে! গুঙিয়ে উঠল মুসা।
যাবে কোথায়? দৌড়াতে দৌড়াতে বলল বোরিস। ধরে ফেলব।
নাহ্, আর পারব না, থেমে গেল কিশোর। হাঁপাচ্ছে। নিশ্চয় তোমাদের কাউকে ঢুকতে দেখেছে লাল কুকুর চার দিয়ে। বেরিয়ে যাবে।
অন্য তিনজন থামল না। তাড়া করে গেল। কিন্তু লাল কুকুর চার দিয়ে বেরিয়ে দেখল পথ নির্জন। টিক বানাউয়ের ছায়াও নেই।
আরে, ওই তো! হাত নাড়ল মুসা। সবুজ ফোক্সওয়াগেন।
স্বল্প আলোকিত পথ ধরে ছুটে গেল গাড়িটা। দেখতে দেখতে পৌঁছে গেল পথের মোড়ে।
গেল পালিয়ে ব্যাটাআ! হাত ঝাড়ল রবিন। ধরতে পারলে আজ…! কোমরে হাত দিয়ে দাঁড়িয়েছে বোরিস।
আফসোস করতে করতে ফিরে এল ওরা। ছেলেরা ঢুকল ওয়ার্কশপে। বোরিস চলে গেল তার কাজে।
ছড়িয়ে পড়া জঞ্জালের দিকে তাকিয়ে মুখ বাঁকাল ছেলেরা, তেতো হয়ে গেল মন। আবার ওগুলো তুলে যথাস্থানে গুছিয়ে রাখা…দূর! কিন্তু কি আর করা? রাখতেই হবে।
কাজই বাড়ল শুধু, তিক্ত কণ্ঠে বলল মুসা। না পারলাম টিক ব্যাটাকে আটকাতে, না পারলাম বইটা রাখতে।
হাসল কিশোর। শার্টের বুকের কাছে হাত ঢুকিয়ে গেঞ্জির ভেতর থেকে বের করে আনল ভাজ করা একমুঠো কাগজ। অয়েলস্কিনের খাপটা নেই।
নোটবুক, জানাল সে। পাতাগুলো খুলে গেছে। পরিকল্পনা এক বলে আমি চিৎকার করতেই টিক তোমাদের দিকে ফিরেছিল। ওই সুযোগে একটানে পাতাগুলো বের করে গেঞ্জির ভেতরে ভরেছি। খাপটা ফেলে দিয়েছি মাটিতে। জিনিসটা খুব ভারি। না খুললে বুঝবে না, ভেতরে কিছু নেই। সেই ফাঁকিতেই
পড়েছে টিক। তাড়াহুড়োয় খোলারও সময় পায়নি। জাস্ট তুলে নিয়ে দৌড়।
মুসার মুখে হাসি ছড়াল। কিশোর, তুমি একটা জিনিয়াস! নিশ্চয়ই! একমত হল রবিন।
খোলাখুলি প্রশংসায় লজ্জা পেল কিশোর। তাড়াতাড়ি বলল, যাক, একটা ব্যাপার স্পষ্ট করে দিয়ে গেল টিক।
কি করে? রবিন অবাক। কিছুই তো বলল না, খালি বইটা দাও বইটা দাও ছাড়া।
আসল কথাটাই তো বলল। কেন, বুঝতে পারছ না? আঙটি চায়নি, বাক্স চায়নি, খালি বই?
খাইছে! মুসা বলল। তাই তো। শুধু বই। নোটবুকটা।
বইটা যে বাক্সে ছিল, জানত, বলল রবিন।
কিংবা অনুমান করেছিল, কিশোর বলল। আসলে বাক্স নয়, নোটবুকটা নেয়াই উদ্দেশ্য ছিল তার। বাক্সটা কিনতে চেয়েছিল এটার জন্যেই।
নোটবুক এত দামি? কি আছে ওতে? জানতে চাইল মুসা।
পাতাগুলো তুলে ধরল কিশোর। এটা একটা জার্নাল, মুসা। একধরনের ডায়েরী। প্রতিদিনের হিসেব-নিকেশ, ঘটনার কথা লেখা হয়। আমি…
জার্নাল? বাধা দিয়ে বলল রবিন। কিশোর, আমিও একটা জার্নাল পড়ে এসেছি। লিখেছিল লিটল মারমেইডের বেঁচে যাওয়া এক নাবিক, হিসটোরিক্যাল সোসাইটিতে জেনে আসা তথ্যগুলো জানাল রবিন। বাওরাড ডাইয়ের কথা মুখেই সব বলেছেন প্রফেসর, পুস্তিকাটাতে নতুন কিছু পাইনি। তবে জাহাজটার কথা বিস্তারিত লেখা আছে। কোন জায়গায় ঝড়ের কবলে পড়েছে, কোথায় গিয়ে প্রবালপ্রাচীরে ধাক্কা খেয়েছে, ভোর পর্যন্ত কোথায় ছিল, সব। কিভাবে বেঁচে তীরে উঠেছে ডাই, পরের দুবছর কোথায় কোথায় ছিল, এসবও লিখেছে। বাড়ি তৈরির একটা সুবিধেমত জায়গার জন্যে ক্যালিফোর্নিয়ার অনেক জায়গায় ঘুরেছে সে।
গুপ্তধনের কথা কিছু লেখেনি? জিজ্ঞেস করল মুসা।
মাথা নাড়ল রবিন। এমনকি ক্যাপ্টেনের কথা, বিপদের কথা, কিছুই না। শুধু বাড়ির ব্যাপারে। সব ভোঁতা।
কিন্তু কিশোরের কাছে ব্যাপারটা ভোতা লাগল না। বলল, দেখ, জার্নালটা বাক্সের দেয়ালে লুকানো পেয়েছি। মোটা এক পরত তক্তার ওপর পাতলা আরেক পরত লাগিয়ে তৈরি দেয়াল, মাঝখানটা ফাঁপা, তার মধ্যে ছিল। ভেতরটা শুকনো রাখার জন্যেই হয়ত ওরকম করে বানিয়েছিল, যাতে পানি ঢুকতে না পারে। প্রথমে বুঝতে পারিনি। বাক্সটা ধরে যখন জোরে ঝাঁকালাম, ভেতরে শুনলাম মৃদু আওয়াজ।
তখন আরও ভালমত দেখলাম। চোখে পড়ল আলগা কাঠ। ভেতরের দেয়াল একরকম, আর বাইরেরটা আরেক। তবে রঙ, কাঠের দাগে তফাৎ খুব সামান্য। ভাল করে না দেখলে চোখেই পড়ে না। ধ্রু-ড্রাইভার দিয়ে খুঁচিয়ে চলটা তুলে ফেললাম। তারপর পাতলা কাঠটা ফাঁক করে ফেলতে অসুবিধে হয়নি। কোটের একটা হ্যাঙার দিয়ে টেনে বের করেছি অয়েলস্কিনে মোড়া জার্নালটা।
নিশ্চয়ই কেউ লুকিয়েছিল? মুসা বলল।
মনে হয় না। দেয়ালের ওপরের দিকটা ফাঁক হয়ে গিয়েছিল হয়ত। তখন কোনভাবে জার্নালটা পড়েছে ভেতরে। নেহাত কাকতালীয় ঘটনা। তারপর আবার দেয়ালটা মেরামত করে ফেলা হয়েছে। যে করেছে, সে খেয়ালই করেনি ভেতরে একটা জিনিস রয়েছে।
কিন্তু টিক বানাউ ঠিকই আন্দাজ করেছে, ওটা ভেতরে আছে, মুসা বলল। জার্নালটা চায় সে। কেন?
রবিন, পয়লা পৃষ্ঠাটা পড,কাগজগুলো বাড়িয়ে দিল কিশোর।
বেঞ্চে রাখা আলোর কাছাকাছি পাতাগুলো নিয়ে গেল রবিন। জোরে জোরে পড়ল, বাওরাড ডাই, ফ্যানটম লেক, ক্যালিফোর্নিয়া, অক্টোবর ২৯, ১৮৯৬!
…কিশোর, ওই জার্নালটাও এই লোকই লিখেছে- যেটা পড়ে এলাম, লিটল মারমেইডের বেঁচে যাওয়া নাবিক।
ওই জার্নালের শেষ তারিখটা মনে আছে? কোন তারিখে শেষ করেছে?
এটা ঊনত্রিশে শুরু, ওটা শেষ হয়েছে আটাশ তারিখে। তারমানে ওটার পরের অংশ এটা।
এটাতে হয়ত গুপ্তধনের কথা লেখা আছে! তুড়ি বাজাল মুসা।
মাথা নাড়ল কিশোর। না; সে-রকম কিছু দেখলাম না। রবিন যেটা পড়ে এসেছে, ও-রকমই। কোথায় কোথায় গিয়েছিল ডাই, কি কি করেছে। ব্যস, এসব।
তাহলে টিক চাইছে কেন? আবার প্রশ্ন করল মুসা। সে-ও কি গুজবের পিছেই ছুটছে?
এই জার্নালই যে চাইছে, শিওর হচ্ছি কি করে? রবিন প্রশ্ন তুলল।
জবাব দিল না কিশোর। খানিক পরে চিন্তিত ভঙ্গিতে বলল, রবিন, তুমি বললে, ডাই পরিবার এই কিছুদিন আগে জার্নালটা হিসটোরিক্যাল সোসাইটিকে দান করেছে?
হ্যাঁ।…তারমানে…
তারমানে কাছাকাছিই কোথাও বাস করছে ওরা। বাক্যটা শেষ করে দিল কিশোর। এস।
দুই সুড়ঙ্গে ঢুকল কিশোর। পেছনে রবিন আর মুসা।
ট্রাপচার তুলে হেডকোয়ার্টারে ঢুকল ওরা। ডেস্কে বসে টেলিফোন বুক খুলল কিশোর। এই যে, পাওয়া গেছে। মিসেস বাওরাড ডাই, চার, ফ্যান্টম লেক রোড। মুসা, ম্যাপটা, জলদি।
বিশাল ম্যাপটায় চোখ বোলাচ্ছে কিশোর। জার্নালটার জন্যে নতুন একটা খাপ বানাচ্ছে রবিন।
অবশেষে মুখ তুলল গোয়েন্দাপ্রধান। এই যে। মাইল তিনেক পুবে, পর্বতের ভেতরে, হাসল সে। কাল সাইকেল নিয়ে বেড়াতে যাব। দেখা করে আসব মিসেস ডাইয়ের সঙ্গে।
<