পরদিন সকাল নটায় রকি বীচ ছাড়ল রবিন মিলফোর্ড। কোস্ট হাইওয়ে ধরে সাইকেল চালাল দক্ষিণে, সান্তা মনিকায় যাবে। থিফট অ্যাণ্ড সেভিংস কোম্পানির আশেপাশের স্টোরগুলোতে খোঁজখবর নেবে অন্ধ লোকটার, আর এসেছে কিনা জিজ্ঞেস করবে। তারপর আবার রকি বীচে ফিরে যাবে লাইব্রেরিতে, যেখানে পার্টটাইম চাকরি করে।

রবিনকে চলে যেতে দেখল কিশোর আর মুসা। তারপর ওরা রওনা হল উত্তরে। সাড়ে নটা নাগাদ ম্যালিবু ছাড়ল। শহরের পর থেকে উঠে গেছে পাহাড়ী পথ, পাহাড়ের পিঠের ওপাশ থেকে আবার ঢালু হয়ে নেমেছে। নিকারো অ্যাণ্ড কোম্পানিটা ওখানেই।

জেটির কাছে এসে থামল ওরা। হাইওয়ে ধরে যাবার সময় হাজারবার দেখেছে এই জায়গা ওরা। এর আগে কখনোই নজর দেয়নি তেমন। কিছু ক্যাম্প দেখা যাচ্ছে একধারে। পথের পাশে দাঁড়িয়ে রয়েছে কয়েকটা ভ্যান। জেটির দক্ষিণে সৈকতের এক প্রান্তে মাছ ধরছে কিছু লোক, তাদের মাঝে মহিলাও আছে কয়েকজন। এই ঠান্ডার মাঝেও ওয়েটসুট পরে ঢেউয়ের ওপরে সার্ফিং করছে কিছু লোক।

চমৎকার ঢেউ আজ, মুসা বলল। সে নিজে খুব ভাল সাফার, লোকগুলোকে দেখে সার্ফবোর্ড নিয়ে তারও সাগরে নামতে ইচ্ছে করছে।

কিন্তু ওসবে বিন্দুমাত্র আগ্রহ নেই কিশোরের। সে তাকিয়ে আছে জেটিতে বাঁধা একটা ফিশিং বোটের দিকে। ছোট্ট নাম বোটটার, টিনা। পনেরো মিটার লম্বা। পাইলটের জন্যে হুইল-হাউস আছে, যারা মাছ ধরবে তাদের জন্যে খোলা ডেক। ডেকের হ্যাচ খোলা। নীল উইণ্ডব্রেকার পরা এক তরুণ ঝুঁকে ইঞ্জিনে কি যেন করছে।

বোটটার উল্টোদিকে, জেটির উত্তরে একটা ভেলা বাধা রয়েছে, গ্যাংওয়ে দিয়ে তাতে নামার ব্যবস্থা। ভেলার সঙ্গে বাঁধা একটা দাঁড়টানা নৌকা। জেটি থেকে দূরে গভীর পানিতে ভাসছে বয়ায় বাঁধা সাদা একটা সুন্দর মোটরবোট। ককপিট ঢেকে রাখা হয়েছে তেরপল দিয়ে।

নিশ্চয় ওটাইমিস্টার সাইমনের বোট, কিশোর বলল।

হুঁম, সার্ফারদের ওপর থেকে চোখ সরাচ্ছে না মুসা।

তুমি থাক এখানে। সাইকেল দেখ।

হুঁম। হাসল কিশোর। রাস্তা পেরোল।

রাস্তা থেকে একটা ড্রাইভওয়ে সোজা নেমে গেছে জেটিতে। বাঁয়ে একটা ছোট পার্কিং লট, শূন্য, একটা গাড়িও নেই। ডানে আরেকটা ড্রাইভওয়ে চলে গেছে একটা বাড়ি পর্যন্ত। টালির মত করে লাগানো কাঠের হাত বাড়িটার, ধূসর রঙ বিবর্ণ হয়ে এসেছে। কাঠের দেয়াল সাদা রঙের। কারপোর্টে দাঁড়িয়ে আছে। একটা স্টেশন ওয়াগন।

বাড়ি আর জেটির মাঝামাঝি ছোট একটা কেবিন। তিন দিকে বড় বড় জানালা, আর একদিকে দরজা, ডকের দিকে ফেরানো। ওটা অফিস। জানালা দিয়ে কিশোর দেখল, ভেতরে বসা ধূসর-চুল কালো পোশাক পরা এক মহিলা হিসেবের খাতা দেখছে। কাছেই বসা এক তরুণী, কোঁকড়া লাল চুল, টেলিফোনে কথা বলছে।

অফিসের কাছে এসে কাচের এপাশ থেকে তরুণীর দিকে চেয়ে হাসল কিশোর, তারপর দরজা ঠেলে ভেতরে ঢুকল।

অফিসে নোনা পানি, রবারের বুট, সাগরের শ্যাওলা আর ছত্রাকের মিশ্র গন্ধ। একধারে দেয়াল ঘেঁষে রাখা একটা কাঠের বেঞ্চ। ওটার সামনে টেবিলে রাখা মাছ-ধরার ওপর লেখা ছোট ছোট পুস্তিকা। চ্যানেল আইল্যাণ্ডস, আর উপকূলের কাছাকাছি কোথায় কোথায় ভাল বেড়ানোর জায়গা আছে, মাছ ধরা যাবে, তারও উল্লেখ রয়েছে ওগুলোতে।

হাত দিয়ে মাউথপিস ঢেকে কিশোরকে বলল তরুণী, এক মিনিট।

আমার তাড়াহুড়ো নেই,কিশোর জানাল।

মুখ তুলে তাকাল বয়স্ক মহিলা। অন্তর্ভেদী দৃষ্টি। কেন যেন ভয় লাগে ওই চোখের দিকে তাকালে। কালো চোখের তারা স্থির, কিশোরের মনে হল তার মনের, কথা সব পড়ে ফেলছে মহিলা। আনমনা হাসি। একবার তাকিয়েই আবার খাতায় চোখ ফেরাল সে।

অস্বস্তি বোধ করছে কিশোর। ফিরে চাইল ডকের দিকে। টিনার ইঞ্জিন পরীক্ষা শেষ করেছে উণ্ডব্রেকার পরা তরুণ। হ্যাচ লাগিয়ে ডেকের কিনারে এসে লাফ দিয়ে নামল জেটিতে। শিস দিতে দিতে এগিয়ে এল অফিসের দিকে।

ও-কে, কথা বলছে লাল-চুল তরুণী। তাহলে শনিবার দিন। তেতাল্লিশ। আরও বেশি হলে জানাবেন, ঠিক আছে?  রিসিভার রেখে এগিয়ে আসা তরুণকে দেখল এক মুহূর্ত। তারপর ফিরল কিশোরের দিকে। কি সাহায্য করতে পারি?

একটা মানিব্যাগ পেয়েছেন? কোন রকম ভূমিকা করল না কিশোর। কেউ দিয়ে গেছে আপনাদের কাছে? মিস্টার সাইমন তার মানিব্যাগ হারিয়েছেন, দুএক দিন আগে।

মিস্টার সাইমন? এসেছিলেন নাকি? কই, দেখিনি তো। উইণ্ডব্রেকার পরা লোকটাকে ঘরে ঢুকতে দেখে জিজ্ঞেস করল মেয়েটা, বিল, মিস্টার সাইমনকে নিয়ে গিয়েছিলে? নৌকাটায় খুঁজে দেখ তো আছে কিনা।

নেই, জবাব দিল তরুণ। দুদিন আগে এসেছিলেন। বোটে তুলে দিয়ে এসেছিলাম, তারপর আবার ডকে ফিরিয়ে এনেছি। নৌকায় মানিব্যাগ পড়লে অবশ্যই দেখতাম।

কিশোরের দিকে তাকিয়ে ভুরু নাচাল সে, মিস্টার সাইমন এলেন না কেন? টেলিফোনও তো করতে পারতেন?

উনি ব্যস্ত। গত দুদিনে আরও দুজায়গায় গিয়েছেন। কোথায়, ফেলেছেন মনে করতে পারছেন না। তাঁকে বলেছি, আমি খুঁজে দেখব। ফোন করেননি তার কারণ, ফোন করলে পাত্তা দেয় না লোকে। দায়সারা গোছের একটা জবাব দিয়ে রেখে দেয়।

অন্ধ এক ভিখিরিকে দেখেছেন মিস্টার সাইমন, সবে বানিয়ে বলতে যাচ্ছিল কিশোর, বলে উঠল বয়স্ক মহিলা, মানিব্যাগের কথা জিজ্ঞেস করছ? আশ্চর্য! কাল রাতে মানিব্যাগ স্বপ্নে দেখেছি আমি।

তরুণী হাসল। আমার শাশুড়ি খুধ আজব মানুষ। তার স্বপ্ন প্রায়ই ফলে যায়। ভয়ঙ্কর মহিলা।

স্বপ্ন দেখলেই ভয়ঙ্কর হয়ে যায় নাকি মানুষ? মহিলার কথায় বিদেশী টান, রেগে যাওয়ায় জোরাল হল। তোমাদেরকে কতবার বলেছি, স্বপ্ন দেখলে ভয় পাই আমি। কাল রাতে দেখলাম, আজব একটা লোক এল। মাটি থেকে একটা মানিব্যাগ কুড়িয়ে নিয়ে চট করে পকেটে রেখে দিল।

লোকটা অদ্ভুত। ধূসর চুল, মৃত্যুর আগে আমার কাসটে লিনির যেমন ছিল। তবে কাসটেলিনির মত ছোট আর বুড়ো নয় লোকটা। বয়েস আরও কম, চোখে কালো চশমা। মুখে কাটা দাগ, মনে হয় কেউ কেটে দিয়েছে ছুরি দিয়ে। হাতের লাঠি অন্ধের মত ঠকঠক করছিল। বুঝতে পারছিল আমি ওকে দেখছি। আমার জন্যে ও বিপজ্জনক, আমি জানি। সাংঘাতিক এক দুঃস্বপ্ন, অথচ কত বাস্তব। তরুণীর দিকে তাকাল মহিলা। খুব ভাবনা হচ্ছে আমার, এলসি।

বিচিত্র একটা শব্দ, কিশোরের মনে হল লোকটার গলা চেপে ধরা হয়েছে। ফিরে তাকাল সে। ফ্যাকাসে হয়ে গেছে বিল। মৃদু কাপছে।

কি হল, বিল? এলসি জিজ্ঞেস করল। ওরকম চেহারার কাউকে চেন নাকি?

না না, আমি চিনব কোত্থেকে? কথাটা বেশ জোরেই বলে ফেলল বিল মিসেস নিকারো এমন ভাবে বলে না, যেন একেবারে সত্যি সত্যি দেখেছে।

তোমার কথা বুঝতে পারছি।

এক মুহূর্ত কেউ কিছু বলল না। তারপর দুই মহিলাকেই ধন্যবাদ জানিয়ে অফিস থেকে বেরিয়ে এল কিশোর। রাস্তা পেরিয়ে দ্রুত চলে এল মুসার কাছে। তখনও স্বপ্নিল চোখে সাফারদের দিকে তাকিয়ে রয়েছে গোয়েন্দা সহকারী।

মনে হয় আসল জায়গায় ঢিল মেরেছি! কিশোর জানাল। অফিসের বৃদ্ধা মহিলা মিসেস নিকারো। আর তরুণী তার ছেলের বৌ। সে বলল, তার শাশুড়ির স্বপ্ন নাকি সব ফলে যায়।

তারমানে বলতে চাইছ, ঘটনা ঘটার আগেই সেটা স্বপ্নে দেখে মহিলা?

হয়ত। যা ঘটে গেছে, সেটাও বোধহয় দেখে। এবার দেখেছে, একটা, মানিব্যাগ কুড়িয়ে নিয়ে পকেটে রাখছে এক লোক, অন্ধ, হাতে লাঠি। গালে কাটা দাগ। লোকটা নাকি মহিলার জন্যে বিপজ্জনক।

যাহ্, বানিয়ে বলছ!

মোটেও না। মহিলা যা বলল, তা-ই বললাম। ভয় পাচ্ছে। ভয় ওই লোকটাও পেয়েছে, উইণ্ডব্রেকার পরা, খানিক আগে ইঞ্জিনে কাজ করছিল যে। মহিলার স্বপ্নের কথা শুনেই আঁতকে উঠেছে। নিশ্চয় অন্ধ লোকটার কথা কিছু জানে সে। এবং সেটা প্রকাশ করতে চায় না। আমাদের এই রহস্যের সঙ্গে সম্পর্ক আছে তার।

<

Super User