সেই বুড়ো লোকটা

এবারের কাহিনিটি ভারতীয় এক তরুণের। চলুন এটা শুনি তার মুখ থেকেই।

১৯৮৮-৮৯ সালের ঘটনা। বাবা তখন মুম্বাই থেকে লনাভালা বদলি হলেন। মুম্বাই থেকে মোটামুটি ১২০ কিলোমিটার দূরের পাহাড়ি একটা স্টেশন এই নাভালা। তখন আমি পড়ি ক্লাস নাইনে। গ্রীষ্মের ছুটিতে মা, বড় ভাই আর আমি বাবার কাছে চলে যেতাম।

আমার চাচাতো ভাই পরাগ, যে আমার থেকে কয়েক বছরের বড়, থাকত লনাভালাতেই। সেখানে গেলেই তাই একসঙ্গে প্রচুর ঘোরাফেরা আর আড্ডাবাজি হত। তবে আমাদের অবসর বিনোদনের সবচেয়ে পছন্দের জায়গা ছিল কাছের একটা পাহাড়। একটা স্কুলের পাশেই ছিল ওটা। সাইকেলে চেপে ফ্লাস্ক ভর্তি কফি নিয়ে চলে যেতাম পাহাড়টায়। ঠাণ্ডা হাওয়া খেতে-খেতে গল্প চলত, আর তাকিয়ে থাকতাম তারার দিকে। পরাগের দু-জন বন্ধুও সাধারণত সাইকেল নিয়ে আসত আমাদের সঙ্গ দিতে।

এক রাতের ঘটনা। প্রিয় জায়গাটায় বসে কফি পান আর নানান আলাপে মশগুল আমরা। এসময়ই একজন মানুষকে আসতে দেখলাম এদিকে। কাছাকাছি হতেই দেখলাম রোগা, বুড়ো একজন মানুষ। এত রাতে এমন একজন লোককে এখানে দেখে অবাক হলাম সবাই। কৌতূহল নিয়ে জিজ্ঞেস করলাম তিনি এখানে কী করছেন আর তার কোনো সাহায্য লাগবে কিনা। বুড়ো জানালেন কাছের একটা গ্রামে থাকেন। আর মুম্বাইয়ের দিকে যাওয়া রাতের শেষ ট্রেনটা ধরবেন। মুম্বাইয়ে ছেলের কাছে যাবেন। লোকটার দুর্বল শরীর দেখে এমনিতেই মায়া হচ্ছে। তারপর আবার মনে হলো হেঁটে গেলে নির্ঘাত ট্রেনটা মিস করবেন। আর এসময় এদিক থেকে রেলস্টেশনে পৌঁছনোর কোনো যান পাওয়ারও সুযোগ নেই। কাজেই পরাগ তাকে তার বাই সাইকেলে করে স্টেশনে পৌঁছে দিতে চাইল। পরাগের বন্ধুর সাইকেলে চেপে আমি আর আমার ভাইও ওদের সঙ্গী হলাম। তঁকে স্টেশনে নামিয়ে দিয়ে এসে আবারও গল্পে মেতে উঠলাম।

তারপরই যেটা ঘটল এটা মনে করে আজও শরীরে কাঁটা দিয়ে ওঠে আমার। লোকটাকে নামিয়ে দিয়ে আসার পর আধ ঘণ্টাও পার হয়নি। সবারই ঘুম-ঘুম আসছে। বাসায় ফিরে যাওয়ার কথা ভাবতে শুরু করলাম। এসময়ই অন্ধকারে একটা কাঠামোকে আসতে দেখলাম, একটু আগের লোকটা যেদিক থেকে এসেছেন সেদিক থেকেই। তারপরই অবাক বিস্ময়ে আবিষ্কার করলাম সেই পলকা দেহের বুড়ো লোকটাই এগিয়ে এল আমাদের দিকে,যাকে অল্প আগে স্টেশনে নামিয়ে দিয়ে এসেছি। বুড়ো কাছে এসে স্টেশনে পৌঁছে দেওয়ার অনুরোধ করলেন।

আমরা সবাইই বড় রকমের একটা ধাক্কা খেয়েছি। মনে হলো যেন একটা ঘোরের মধ্যে আছি। নড়তে পর্যন্ত পারছি না। মাত্র আধ ঘণ্টার মধ্যে লোকটার পক্ষে কোনোমতেই হেঁটে এখানে আসা সম্ভব নয়। আর তিনি ফিরে এসে আবার স্টেশনেই বা যেতে চাইবেন কেন?

মনে-মনে প্রার্থনা করতে শুরু করলাম। আর এর জোরেই হোক কিংবা অন্য কোনো কারণে হঠাৎ করেই যেন ঘোর কেটে গেল আমার। ধাক্কা দিয়ে অন্যদেরও স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরিয়ে আনলাম। তারপর সাইকেলে উঠে দ্রুত এই জায়গা ছাড়লাম, একবারও পিছু ফিরে তাকাবার সাহস করলাম না।

রাতে আমাদের একজনেরও ঘুম হলো না।

কয়েকদিন পর স্থানীয় লোকেদের সেই বুড়ো লোকটার কথা জিজ্ঞেস করলাম। কিন্তু কেউই তার ব্যাপারে কিছু বলতে পারল না। এমনকী বুড়ো লোকটাকে দেখেছে এমন মানুষও পাওয়া গেল।। তবে রাতে ওই পাহাড়টার কাছে না ঘেঁষার পরামর্শ দেওয়া হলো।

এরপরও আরও অনেকবার লনাভালা গিয়েছি। কিন্তু কখনও আমাদের পুরানো আড্ডার জায়গাটায় যাওয়ার সাহস করিনি।

<

Super User