সেজব্রাশের মাঝ দিয়ে সাপের মত এঁকেবেঁকে এগিয়ে গেছে সরু রাস্তা, সেই রাস্তা ধরে ধুলো উড়িয়ে লাফাতে লাফাতে ছুটছে একটা স্টেজ কোচ। যাত্রী মাত্র তিন জন। রক বেনন, হিরাম ব্যাগলে আর অপরিচিতা এক বয়স্কা মহিলা। যাত্রাটা দীর্ঘ, তাই পরিশ্রান্ত হয়ে সীটের ওপর গা এলিয়ে চুপ করে বসে আছে সবাই।

তেতে উঠেছে কোচের ছাদ রোদের আঁচে, ভেতরে দম বন্ধ করা ভ্যাপসা গরম। পর্দা ফেলার পরও জানালাগুলো দিয়ে সর্বক্ষণ মিহি ধুলো ঢুকছে। ঘাম আর ধুলোয় চটচট করছে যাত্রীদের শরীর। হাঁসফাঁস একটা অবস্থা। ভোগান্তির ষোলোকলা পূর্ণ করেছে বিরক্তিকর ঝাঁকুনি। হাড়-মাংস সব এক করে ফেলছে।

স্টেজ কোচটা কখনও কখনও একেক লাফে আধমাইল করে পেরিয়ে যাচ্ছে বলে ব্যাগলের ধারণা। এখনও সে ভেবে বের করতে পারেনি মাথার ওপর ওর হ্যাট এখনও বসে থাকছে কি করে। এই ঝুঁকিতে শিরদাঁড়ার খোঁচা খেয়ে খসে পড়ার কথা ওটার। ভ্রু কুঁচকে গেল ব্যাগলের, এই দুঃসাধ্য অভিযানে অংশ নেয়ার পুরস্কার হিসেবে তাকে একটা মেডেল দেয়া উচিত!

ব্যাগলের দুঃখের আরও একটা কারণ হচ্ছে কথা বলতে বেনন তাকে মানা করে দিয়েছে। গোপন একটা কাজে টেইলহল্ট শহরে চলেছে ওরা, পথে যত কম লোকের সঙ্গে পরিচয় হয় ততই ভাল। লোক! কিন্তু মহিলা? উসখুস করে উঠল ব্যাগলে; লোকের বদলে কোন মহিলার সঙ্গে আলাপ জুড়লে অসুবিধা কি? বেনন নিশ্চয়ই রাগ করবে না। 

ইতস্তত করে মহিলার দিকে তাকাল ব্যাগলে, কিন্তু কথা বলার মত সাহস জোগাড় করতে পারল না।

বিধবাকে বিয়ের পর জীবনে তিক্ত একটা সত্য নেহায়েত ঠেকায় পড়ে মর্মে মর্মে উপলব্ধি করেছে সে। মহিলা জাতির কথা শুনতে হয়, একমত হতে হয়, অথবা চুপ করে থাকতে হয়; কথা বলার চেষ্টা করা বা প্রতিবাদ-প্রতিরোধ গড়ে তোলা অর্থহীন: যুক্তি-তর্কের সমস্ত বাঁধ শেষ পর্যন্ত অশ্রুর বাণে কোথায় যেন ভেসে যায়। কিছুক্ষণ ভাবনা চিন্তা শেষে মহিলাকে না ঘটানোই স্থির করল ব্যাগলে। তাছাড়া নির্দেশ অমান্য করলে বেননও রেগে যেতে পারে।

বন্ধুর জন্যে ব্যাগলের বুকের মাঝে দরদ উথলে উঠল। বেননই তো ওকে বাঁচিয়েছে ধরাবাঁধা জীবনের অন্ধকার গলি থেকে। মুক্তির স্বাদ না পেলে, ওই ফার্ম আর ভয়াবহ ওই বিচ্ছু দুটোর সংস্পর্শ থেকে দূরে সরতে না পারলে মরেই যেত সে। বউকে যদি সহ্য করা যায় বউয়ের প্রথম পক্ষের বিচ্ছু দুটোকে সহ্য করা কোন সুস্থ মানুষের কম্ম নয়। খড়ের সঙ্গে মদ মিশিয়ে ওর ঘোড়াকে খাইয়েছে ওদুটো। নেশার চোটে দুই দিন দাঁড়াতে পারেনি ঘোড়াটা। সহ্য করেছে ও। বিচ্ছুর দল ওর কালো বুটে খয়েরী পালিশ লাগিয়েছে। কিছু বলেনি সে। এমনকি ঘুমের মধ্যে ওরা নিয়মিত ওর এক পাশের গোঁফ চেঁছে দেয়ার পরও মুখ বুজে মাটি কামড়ে পড়ে ছিল। কিন্তু যেদিন ওর খোঁজ নিতে ফার্মে এলো বেনন, সেদিনই মনের গভীরে সে বুঝে গেল বেরিয়ে পড়ার সময় হয়েছে।

তিনদিনের মাথায় মার্থাকে প্রায় রাজি করিয়ে ফেলল ব্যাগলে, কথা দিল চারপাশটা একটু ঘুরে নিয়েই দু’মাসের মধ্যে ফিরবেই ফিরবে। বেনন বোঝানোয় শেষ পর্যন্ত রাজি হয়েছে মার্থা অনিচ্ছাসত্ত্বেও।

খুদে দুই বদমাশ আর কান্নারত মার্থার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে হাঁপ ছেড়ে বেঁচেছে ব্যাগলে দিন পনেরো হলো।

কিন্তু কতক্ষণ আর চুপ করে থাকা যায়। আবার মহিলার দিকে তাকাল ব্যাগলে।

অত্যন্ত রুচি সম্পন্ন পোশাক মহিলার পরনে। বয়স ষাটের বেশি হবে তত কম নয়। ছোটখাট আকৃতি, কিন্তু চেহারা দেখে মনে হয় রীতিমত দৃঢ়চেতা। এক কালে যথেষ্ট সুন্দরী ছিল, নিঃসন্দেহে বহু পুরুষের মাথা ঘুরিয়ে দিয়েছে যৌবনে। শেষপর্যন্ত কোন এক দুর্ভাগা নিশ্চয়ই ফাঁদে পা দিয়ে গলায় বিয়ের দড়ি, অর্থাৎ মালা পরেছে। ফোশ করে দীর্ঘশ্বাস ফেলল ব্যাগলে। আজকাল এমন হয়। বিয়ে যারা করেছে সেই সব দুর্ভাগা হতভাগ্য পুরুষদের দুঃখে বুকটা ভারী হয়ে যায় ওর।

আবার ঝাঁকি খেল স্টেজ। এবারের ঝুঁকিটা অন্যান্যবারের তুলনায় জোরাল।

সিধে হয়ে বসে জানালার দিক থেকে মুখ ফেরালেন মহিলা। স্টীল রিমের চৌকো চশমার ভেতর দিয়ে ব্যাগলের দিকে তাকালেন। বিরক্তি সূচক একটা শব্দ করে বললেন, জঘন্য!

আমাকে জঘন্য বলছেন? ইতঃস্তত করে জানতে চাইল ব্যাগলে।

না। আপনাকে কেন বলব! বলছি পশ্চিমের কথা। জানালা দিয়ে তাকিয়ে থাকলে ধুলো দেখতে দেখতে বিরক্তি লেগে যায়।

পশ্চিমের অপমান! গায়ে লেগে গেল ব্যাগলের। বেননের নিষেধ ভুলে বলে বসল, এতই যখন জঘন্য লাগছে যেখান থেকে এসেছেন সেখানে ফিরে গেলেই হয়। কে আপনাকে ঠেকাচ্ছে!

অগ্নিদৃষ্টিতে ব্যাগলের দিকে তাকালেন মহিলা। এবং সম্ভবত এই প্রথম ভালমত দেখলেন। ফলে চেহারায় ফুটে উঠল তাচ্ছিল্য।

মহিলাকে দোষ দেয়া যায় না, দেখার মত সাজে সেজেছে ব্যাগলে। যে কেউ দ্বিতীয়বার ফিরে তাকাতে বাধ্য হবে। না, কানের ঘন লোম আর থুতনি পর্যন্ত ঝুলে থাকা গোঁফের কারণে নয়, ফিরে তাকাতে বাধ্য হবে তারা ব্যাগলের পোশাকের কারণে।

এমনিতে ব্যাগলে হালকা পাতলা মানুষ। দেখে মনে হয় বছর পঞ্চাশেক। জিজ্ঞেস করলে বলে, এই কত আর, হবে বিশ পঞ্চাশ! গোফে আর চুলে হালকা পাক ধরেছে ওর। চেহারাটা সাদামাঠা। জীবনের বেশিরভাগ সময়টা ঘোড়ায় চড়ে কাটানোয় কাঁধ দুটো একটু সামনে ঝুঁকে থাকে।

কিন্তু প্রথম দর্শনে এসব বৈশিষ্ট্য এখন আর কারও চোখে-সে যত বড় ওস্তাদই হোক-ধরা পড়বে না। ওর নিজের মা-ও ওকে চিনতে পারতেন না আজকের এই পোশাকে। আর যদি কপাল দোষে চিনেও ফেলতেন ভুলেও কখনও স্বীকার করতেন না নিজের ছেলে বলে। ভদ্রমহিলার সৌভাগ্য যে মরে গিয়ে বেঁচে গিয়েছেন, ছেলের এরকম খোলতাই রূপ দেখতে হয়নি।

মাথায় ডারবি হ্যাট ব্যাগলের; গায়ে ভালুকের পশমের মত রোঁয়া ওঠা একটা দুই সাইজ বড় ডোরাকাটা কোট। কোটের বোতামগুলো নেই। ভেতরে দেখা যাচ্ছে সাদা-কালো ছোপ দেয়া আঁটো একটা ময়লা ওয়েস্ট কোট। শনের দড়ি দিয়ে প্যান্টটা কোমরে বেঁধে রেখেছে। সুদূর অতীতে কোন এক কালে ওটা কালো রঙের ছিল, শেষ বয়সে পৌঁছে এখন ধূসর হয়ে গেছে। তবে সবচেয়ে অভূতপূর্ব হচ্ছে নিজের হাতে তৈরি ওর জুতো জোড়া। হলুদ বোতাম লাগানো সাদা বুটজুতো ওগুলো। ডান দিকের পাটির খানিকটা অংশ ছিঁড়ে গেছে। সামনের ফাঁক দিয়ে

বেরিয়ে আছে ব্যাগলের মোজা পরা বুড়ো আঙুল।

পুরোপুরি সার্কাসের ক্লাউন। লোক হাসিয়ে সদ্য বেরিয়ে এসেছে তাঁবু থেকে।

স্যার, ব্যাগলেকে আপাদমস্তক দেখে নিয়ে শীতল কণ্ঠে বললেন মহিলা, আপনার সঙ্গে আগে কোথাও আমার পরিচয় হয়েছে বলে তো মনে পড়ছে না।

তাতে কি, এক্ষুণি পরিচয় হয়ে যাবে। আমি… অপ্রস্তুত চেহারায় চট করে বেননের দিকে তাকাল ব্যাগলে।

        স্টার্ন, ও হচ্ছে রিকি স্টার্ন, তাড়াতাড়ি করে বলল বেনন। আরেকটু হলেই নিজের পরিচয় ফাঁস করে দিচ্ছিল ব্যাগলে। বিশেষ একটা কাজে টেইলহল্ট শহরে যাচ্ছে ওরা। এমন একটা কাজ, যে কাজে আছে বিপদ, ঝুঁকি আর অনিশ্চয়তা। আপাতত নিজেদের পরিচয় গোপন রাখতে হবে। এই এলাকায় ওর নাম শোনেনি এমন লোক নেই বললেই চলে। মাত্র দু’বছর হলো ক্ষমা ঘোষণা করেছেন গভর্নর। চোখের ইশারায় ব্যাগলেকে হুঁশিয়ার করে মহিলাকে নিজের সেরা হাসিটা উপহার দিল বেনন। আপনার পরিচয় জানতে পারি কি?

ভদ্রলোকের পোশাক বেনুনের পরনে, ফলে ব্যাগলের সঙ্গী হওয়া সত্ত্বেও মহিলার দৃষ্টি একটু নরম হলো। কণ্ঠস্বরেও আগের ধার থাকল না। আমি মিস অ্যানা হ্যাটার। আপনার পরিচয়…

রিচি স্টার্ন। ব্যাগলেকে দেখাল বেনন। ওর ভাই।

অবিশ্বাস্য! একজন যুবক আরেকজন প্রায় বুড়ো! সত্যিই আশ্চর্য! বিড়বিড় করলেন মহিলা, যেন বেননের কথাটা বিশ্বাস করতে পারছেন না।

কিছু বললেন? মুখ গোমড়া করে জানতে চাইল ব্যাগলে।

না।

ও।

কোত্থেকে আসছেন আপনি, মিস হ্যাটার? পরিবেশ হালকা করতে জিজ্ঞেস করল বেনন।

নিউ হ্যাম্পশায়ারের সাউথ নরউইক থেকে। ওখানে তিরিশ বছর হলো একটা স্কুলে ইংরেজি পড়াই আমি।

ছাত্রগুলোর জন্যে দুঃখ হচ্ছে আমার ব্যথিত চেহারায় মাথা নেড়ে বিড়বিড় করল ব্যাগলে।

আর আপনি কি করেন, মিস্টার রিচি স্টার্নং সার্কাসের ক্লাউন? শুনে ফেলেছেন মহিলা, উত্তরোত্তর ব্যাগলের ওপর রেগে উঠছেন, ক্লাউন কথাটা বলার সময় বিষ-তেতো অবজ্ঞা ঝরল। ঠিক করেছেন পেশাকে হেয় করে অভদ্র লোকটাকে শায়েস্তা করবেন। আমি তো জানি শুধু ঘোলা বুদ্ধির লোকগুলোই ক্লাউনের চাকরি করে।

আপনার ভুল হচ্ছে, গোমড়া মুখে বলল ব্যাগলে। আমি ক্লাউন হতে যাব কেন!

তো? বিজয়ের ঝিলিক টীচারের দু’চোখে।

উড়ে গেল বেননের বাধা। আমি একজন প্রাক্তন আউট-ল, বলল গম্ভীর ব্যাগলে। হৃদয়ের এক কোনে বেদনার তীর খোঁচা লাগাল। মহিলা ওকে বিষাদময় অতীতের কথা স্মরণ করিয়ে দিচ্ছে। যৌবনের অনেকটা সময় আউট-ল দলের সঙ্গে ঘুরেও নিজের ছবিওয়ালা একটা ওয়ান্টেড পোস্টার বাগাতে পারেনি ও নিষ্ঠুর আইন বিভাগের কাছ থেকে। ওকে পাত্তাই দেয়নি আইনের বেকুবগুলো। গুণীর কদর বোঝেনি। অবশ্য এখন অতটা ব্যথা আর নেই ওর মনে, বেননের ক্ষমাপ্রাপ্তির সনদে জালিয়াতি করে নিজের নামটা বসিয়ে নিয়েছে এটা একটা বড় সান্ত্বনা। তবু সামনে বসা এই দজ্জাল মহিলাকে মন থেকে ক্ষমা করতে পারল ব্যাগলে। মহিলা ড্যাবড্যাব করে তাকিয়ে আছে দেখে আবারও বলল, বোঝেননি? আমি আউট-ল ছিলাম। জীবনে কখনও ধরা পড়িনি।

তাহলে সুস্থ জীবনে ফিরে এলেন কেন?

প্রসঙ্গ ঘুরিয়ে দিল বেনন। আপনি এদিকে বেড়াতে এসেছেন, মিস হ্যাটার?

কথা বলার সুযোগ হারিয়ে বেজার হলেও মেনে নিল ব্যাগলে। মুখ ঘুরিয়ে জানালার পর্দা ফাঁক করে বাইরে তাকাল। সেজব্রাশ আর সেজব্রাশ; মিস অ্যানা মিথ্যে বলেননি, উত্তর-পশ্চিমের সেই মন্ট্যানা রকির ফুলে ওঠা উইটিগো প্রান্তর পর্যন্ত চোখে পড়ার মত আর কিছু নেই। ধুলো, পাথর আর সেজব্রাশ।

মিস হ্যাটার বললেন, হ্যাঁ, তা বলতে পারেন, মিস্টার স্টার্ন। টেইলহল্টে যাচ্ছি আমি। বেড়ানো আর কাজ, একসঙ্গে দুটোই হবে। শুনেছেন নিশ্চয়ই এদিকে রেললাইন বসাচ্ছে মন্ট্যানা সেন্ট্রাল রেলরোড? বেড়ানোর ফাঁকে ওদের কাজ তদারক করাও হবে।

আপনি তাহলে রেলরোডের সঙ্গেও জড়িত? জানতে চাইল বেনন।

হা, ও-কথা বললে ভুল হবে না। প্রভাবশালী শেয়ার মালিকদের অনেকের সঙ্গেই আমার পরিচয় আছে। কয়েকজন তো আমারই ছাত্র। কোম্পানি চালুর সময় তিনটা শেয়ারও কিনেছিলাম আমি, কাজেই ওদের কাজ কেমন চলছে জানার অধিকার আছে আমার। আপনি কি বলেন, মিস্টার স্টার্ন?

‘অবশ্যই!’ মহিলা জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছেন দেখে সায় দিয়ে মাথা দোলাল বেনন।

তাছাড়া শুনছি ওখানে গোলমাল চলছে, বললেন হ্যাটার। আপনার কি মনে হয়, স্পারটা ওরা শেষ করতে পারবে?

স্পারটা ঠিক কোথায় হচ্ছে না জানলে কি করে বলি, মিস হ্যাটার? ভালমতই জানে বেনন কোথায় স্পার তৈরি করছে মন্ট্যানা সেন্ট্রাল। টেইলহল্টে ওরা রেলওয়ের হয়ে গোয়েন্দাগিরি করতেই চলেছে, কিন্তু মহিলাকে তা বলা যাবে না।

‘এত বড় একটা খবর আপনি জানেন না!’ বিস্মিত চেহারায় বেননকে দেখলেন মহিলা। উইটিগোর পরফাইরিতে যাবার জন্যে পথ তৈরি করছে ওরা। পরফাইরির নাম তো শুনেছেন? শোনেননি? বলেন কি! পরফাইরি একটা মাইনিং ক্যাম্প। সবাই মনে করেছিল সোনা শেষ, তাই মরে যাচ্ছিল শহরটা। হঠাৎ আবার সোনা পাওয়া গেছে। সেই সঙ্গে আরও কি কি সব। মাইনগুলোর সঙ্গে দারুণ ব্যবসা করতে পারবে রেলরোড যদি পরফাইরি পর্যন্ত লাইন টেনে নিয়ে যেতে পারে। আমি মিরিন্ডাকে বললাম যাচ্ছি যখন ওদিকে, এক ঢিলে দুই পাখি মেরে আসব, মালিকপক্ষের তরফ থেকে দেখে আসব পার কতদূর এগোল। আপনাকে বোধহয় মিরিন্ডার কথা বলা হয়নি? কি যে হয়েছে। আমার! ইদানীং অনেক কিছুই মনে রাখতে পারি না। মিরিন্ডা হচ্ছে আমাদের স্কুলের টীচার। একই সঙ্গে কলেজে পড়েছি আমরা। স্কুলে ও বোটানি পড়ায়। খুবই মিষ্টি মেয়ে। একনাগাড়ে কথা শোনাবার সুযোগ পেয়ে বড় করে দম নিলেন মহিলা। মনে বোধহয় বৃষ্টিহীন মেঘের মত ভদ্রতার হালকা ছায়া খেলল। এই দেখুন, এত কথা বললাম আর কার কাছে যাচ্ছি তা-ই বলা হয়নি। আপনি আবার বিরক্ত হচ্ছেন না তো, মিস্টার স্টার্ন?

হচ্ছিই তো! মনে মনে বলল বেনন। হাসি হাসি একটা ভঙ্গি করে মুখে বলল, না, না, ছিহ, বিরক্ত হব কেন!

আপনি সত্যি ভদ্রলোক; অনেকের অনেক কিছু শেখার আছে আপনার কাছ থেকে। আড়চোখে ব্যাগলেকে একবার দেখে নিয়ে আবার বেননের দিকে তাকালেন মিস হ্যাটার। এদিকে এসেছি আমি আসলে আমার ফুপাত ভাই লুকাসের নিমন্ত্রণে। বলা যায় জোরাজুরি শুরু করে দিয়েছিল ও। একটু অবাকই লাগছে-দশ বছর পর চিঠি লিখে হঠাৎ এভাবে আবদার… পরপর দুটো চিঠি! লুকাস হচ্ছে আমার মাটিল্ডা ফুপুর বড় ছেলে, তারমানে আমার চেয়ে কয়েক বছরের বড়ই হবে। মানা করতে পারলাম না।এত করে বলছে যখন! মিরিন্ডাকে বললাম এক ঢিলে দুই পাখি মারতে চললাম। তারপরেই রওয়ানা হয়ে গেছি।

চুপ করে থাকলে অভদ্রতা হয়ে যায়,বার দুয়েক মনে মনে নিজের কপাল চাপড়ে জিজ্ঞেস করল বেনন, আপনার ভাই টেইলহল্টেই থাকে? স্টেজ কিন্তু টেইলহল্টের পর আর যাবে না।

জানি। না, ও থাকে শহরের আরেক ধারে নিজের র‍্যাঞ্চে। র‍্যাঞ্চ আছে ওর। আমাকে নিতে স্টেশনে আসবে। জানি শরীর খারাপ। তবু আসবে। বুঝতে পারছি না একটা স্পারের জন্যে এত উতলা হবার কি আছে। চিঠিতে বারবার করে লিখেছে স্পারটা যেন আমি অবশ্যই সঙ্গে করে নিয়ে আসি। অদ্ভুত ব্যাপার!

স্পার, মিস হ্যাটার? রহস্যের গন্ধ পেল বেনন। চোখের কোনে দেখল নড়েচড়ে বসেছে ব্যাগলে।

মাথা দোলালেন টীচার। হ্যাঁ, সাধারণ একটা স্পার। কয়েক বছর ধরেই আছে আমার কাছে। একবার ঘর সাজাব বলে পশ্চিমের একটা স্মৃতিচিহ্ন চেয়েছিলাম লুকাসের কাছে। স্পারটা পাঠিয়েছিল ও।

মাত্র একটা? একটু অবাক লাগল বেননের। স্পার তো জোড়ায় জোড়ায় থাকে?

তাই? না, লুকাস আমাকে ওই একটাই দিয়েছে। পায়ের কাছে রাখা ব্যাগটা দেখালেন মিস অ্যানা। এই যে এটাতে রেখেছি ওর মহামূল্যবান স্পার।

আর সব মালপত্র স্টেজের মাথায় ওঠালেও এই ব্যাগটা নিজের কাছে রাখার জন্যে ড্রাইভারের সঙ্গে প্রায় ঝগড়া বাধিয়ে ফেলার উপক্রম করেছিলেন মহিলা, এতক্ষণে তার কারণ জানা গেল।

লুকাস হ্যাটার নামের এক র‍্যাঞ্চারের কথা আমি উইটিগোতে শুনেছি, বলল ব্যাগলে। লোকে তাকে পাগলা হ্যাটার বলে ডাকত। জানি না সত্যি কিনা, তবে সে নাকি সৌভাগ্যের আশায় দরজার গায়ে একটা স্পার গেঁথে রেখেছিল। একদিন দরজা খুলতেই স্পারটা তার মাথায় পড়ল। মাথায় হ্যাট ছিল না, ফলে সেই আঘাত হ্যাটার সইতে পারল না, জীবনের তরে আধপাগলা হয়ে গেল।

আঁতকে উঠলেন মহিলা। মুখে হাত চাপা দিয়ে বলে উঠলেন, হায় ঈশ্বর! সত্যি পাগল হয়ে গেছে লুকাস?

আমার জানায় কোন ভুল নেই, জানাল গম্ভীর ব্যাগলে। একটু দুঃখই হচ্ছে ওর, পাগলের কথায় এত দূর পথ এত কষ্ট করে চলে এসেছে মহিলা।

আচ্ছা, বেননের দিকে তাকালেন বৃদ্ধা। আপনার কি মনে হয়, পাগল হয়ে গেছে বলেই স্পারের কথা চিঠিতে ওরকম বারবার করে লিখেছে লুকাস?

সম্ভবত। মাথা দুলিয়ে জবাব দিল ব্যাগলে। তারপর দীর্ঘশ্বাস ফেলে আফসোসের সঙ্গে মাথা নাড়ল। আমার এক চাচা একবার দিশে হারিয়ে ফেলেছিল। এখনও বেচারা হুঁস ফিরে পায়নি। নিজেকে সে লাইট পোস্ট ভাবত; সারারাত খামোকা দাঁড়িয়ে থাকত রাস্তার ধারে জ্বলে ওঠার অপেক্ষায়। চাচী তাকে বাড়ির সামনে দাঁড় করিয়ে পাহারাদারির কাজটা করিয়ে নিত।

কী ভয়ানক! তারপর? নিজের ভাইয়ের ওরকম পরিণতি কল্পনা করে চমকে উঠলেন মহিলা।

এখনও চাচা জ্বলে ওঠার অপেক্ষায় দাড়িয়ে থাকে। তবে সারারাত আর পারে না। বয়স হয়েছে তো!

সে-ও আউট-ল ছিল?

আমাদের পরিবারের সবাই আউট-ল।

আপনার ভাই রিকি, ইনিও আউট-ল?

না, ও আমাদের পরিবারের কলঙ্ক।

ইতস্তত করে ব্যাগলের দিকে তাকালেন অ্যানি। একটা ব্যক্তিগত প্রশ্ন করতে পারি?

অবশ্যই। একটা কেন, হাজারটা করুন।

আপনি নিজেকে বলেন প্রাক্তন আউট-ল। আচ্ছা, হঠাৎ করে কেন আপনি আইনের পথে ফিরে এলেন?

মানুষের নির্মম অবিবেচনা আমাকে কঠোর এই সিদ্ধান্ত নিতে বাধ্য করেছে, বিষাদগ্রস্ত চেহারায় বলল ব্যাগলে। সততার অভাব আমাকে আইনের গণ্ডীতে ফিরিয়ে এনেছে।

বুঝলাম না। কৌতূহলে চিকচিক করে উঠল মিস হ্যাটারের চোখ। একটু খুলে বলবেনন কি?

বেশ, বলব… আপনি যখন জানতে চাইছেন। জানালার দিকে পিঠ ফিরিয়ে মহিলার মুখোমুখি হলো ব্যাগলে। বারকয়েক কেশে নিয়ে বলতে শুরু করল : এঘটনা হচ্ছে ওয়াইয়োমিঙের ছোট এক শহরের। শহরের নামটা বলব না। আমি তখন আউট-লদের একটা দলের সঙ্গে পাহাড়ে পাহাড়ে মহাফুর্তিতে ঘুরে বেড়াচ্ছি। বেশ কাটছিল দিনগুলো; মূল্যবান যা কিছু ঘোড়ার পিঠে নেয়া যায় নিয়ে চম্পট দিতাম আমরা। লোকালয়ের মানুষ সংবিৎ ফিরে পাবার আগেই আবার পাহাড়ে ফিরে যেতাম। কিন্তু এত সুখ কপালে বেশিদিন সইল না, ডাকাতি করতে গিয়ে পাসির হাতে দু’জন মরতেই কাপুরুষের মত দল ভেঙে দিয়ে আমাকে একা ফেলে চলে গেল সবাই। মনটা ভেঙে টুকরো টুকরো হয়ে গেল। কিন্তু দমলাম না, সিদ্ধান্ত নিলাম আমি একাই একটা ব্যাঙ্ক ডাকাতি করব।

মহিলা যাতে দুঃসাহসিকতার মাত্রাটা বোঝে সেজন্যে ঠোঁটে চালিয়াতি হাসি ঝুলিয়ে থামল ব্যাগলে।

একা একটা ব্যাঙ্ক ডাকাতি করা কি খুবই কঠিন? বড় বড় চোখ করে জানতে চাইলেন অ্যানি।

তো কঠিন নয়? মানইজ্জত বাঁচাতে জবাবদিহির সুরে পাল্টা প্রশ্ন ছুঁড়ল ব্যাগলে। তাহলে জেসি জেমস ব্যাঙ্ক ডাকাতির সময় তার ভাইকে সঙ্গে রাখত কেন শুনি? ওর প্যান্ট খসে গেলে পরিয়ে দেয়ার জন্যে?

সত্যি আমি দুঃখিত। আসলে এব্যাপারে কিছু জানি না তো! আপনি রাগ করেননি তো, মিস্টার স্টার্ন?

না। মিস হ্যাটারের নরম ব্যবহারে মার্জনাটুকু দয়াবান ব্যাগলে নির্দ্বিধায় ক্ষমা করে দিল। একটু জিরিয়ে নেয়ার ভান করে যখন বুঝল মহিলা কৌতূহলে হাঁসফাস করছে তখন বলতে লাগল: ওই ডাকাতির জন্যে খুব সাবধানে পরিকল্পনা করলাম আমি। জানি এই সফলতার ওপর নির্ভর করছে আমার আউট-ল জীবনের ভবিষ্যৎ।…কোথাও কোন খুঁত রাখলাম না। এমন এক জায়গায় ঘোড়াটা রাখলাম, না ব্যাঙ্কের কাছে না দূরে। অপরিচিত একটা ঘোড়া ব্যাঙ্কের সামনে দেখে লোকে যে সন্দেহ করবে সে-উপায় নেই।

তারপর ঠিক সময়ে টুপ করে ঢুকে পড়লাম ব্যাঙ্কে। তখন দুপুর। অর্ধেক কর্মচারী খেতে গেছে। কেউ ভাবতেই পারবে না; মাত্র পাঁচ মিনিটে কাজ সেরে বেরিয়ে এলাম আমি।

একটা গুলি ছুঁড়তে হয়নি, একটা ধমক কাউকে দিতে হয়নি, বললে কেউ বিশ্বাস করবে না, বিনা বাধায় টাকা ভরা একটা পেট মোটা থলে কাঁধে ফেলে বোর্ডওয়াকে পা রাখলাম আমি। কিন্তু আফসোসের কথা কি বলব, তারপরই মাথায় আকাশ ভেঙে পড়ল। বিনা মেঘে বজ্রপাত হলেও মনে এতটা দুঃখ পেতাম না আমি। হঠাৎ দেখি হিচর্যাকে আমার ঘোড়াটা নেই। ঝুঁকি নিয়ে সৎ ভাবে আমি যখন দুটো পয়সা রোজগার করতে ব্যাঙ্কে ঢুকেছি, তখন কোথাকার কোন এক আত্মসম্মানজ্ঞানহীন নীচমনা ঘোটলোক চোরের বাচ্চা আমার ঘোড়াটা নিয়ে নিশ্চিন্তে চলে গেছে!

তারপর? ভদ্রতার খাতিরে কথার মাঝে উৎসাহ দিলেন ভদ্রমহিলা।

কি আর করব, বাধ্য হয়ে আরেকজনের ঘোড়া ধার করে ওখান থেকে সটকে পড়লাম আমি।

দীর্ঘক্ষণ চুপ করে থাকলেন মিস হ্যাটার। জ কুঁচকে রেখেছেন। গভীর চিন্তায় মগ্ন। বেননের চেহারাটা গম্ভীর। অতিরিক্ত গম্ভীর। হেসে ফেললে খুবই দুঃখ পাবে ব্যাগলে।

আমি দুঃখিত, অবশেষে মুখ খুললেন টীচার। আপনার গল্প বিশ্বাসযোগ্য নয়। যতই চেষ্টা করুন ছাপাবে না কেউ। বলা উচিত নয়, তবুও বলি, সাহিত্য জগতে আমার নাম অনেকেই জানে। কাগজে আমার কবিতা ছাপা হয়। দু’একটা হয়তো পড়েওছেন। ‘শিশুর হাসি মায়ের খুশি’ কবিতাটা খুব প্রশংসিত হয়েছিল। যাই হোক, আপনার গল্পে কাকতালীয় ঘটনা বেশি বেশি প্রাধান্য পেয়েছে।

গল্প? কাকতালীয় ঘটনা? খাবি খেল ব্যাগলে। অবুঝের সঙ্গে একমত হতে পারছে না এমন ভঙ্গিতে ধীরে ধীরে মাথা নাড়ল। না, মিস হ্যাটার, গল্প নয়; আমার এ ঘটনা পুরোপুরি সত্য। আমি যদি এক বিন্দু মিথ্যে বলে থাকি এই স্টেজ এখনই এই মুহূর্তে এত দ্রুত থেমে যাক যে আমি যেন হুমড়ি খেয়ে মেঝেতে পড়ে যাই।

দুর্ভাগ্য ব্যাগলের, হঠাৎ করেই জায়গায় থেমে দাঁড়াল স্টেজ। কথা শেষ করার প্রায় সঙ্গে সঙ্গে মেঝেতে হুমড়ি খেয়ে পড়ে গেল। ব্যাগলে।

স্টেজ কেন থেমেছে দেখতে জানালা দিয়ে বাইরে তাকাল বেনন। গলা বাড়িয়ে দেখল রাস্তার ধুলোতে সুটকেস রেখে তার ওপর বসে আছে এক চাইনিজ।

সুটকেস সহ এগিয়ে এলো লোকটা। ড্রাইভারের সঙ্গে আলাপ সেরে দু’মিনিটের মাথায় উঠে পড়ল স্টেজে।

চিনদেশের মানুষ! বেননের দিকে তাকিয়ে চোখ বড় বড় করে নিচু গলায় বললেন মিস হ্যাটার।

মাথা দোলাল বেনন। মন্ট্যানা রেলওয়েতে মজুরের কাজ করছে ওদেশের অনেক লোক।

কিন্তু বেননের ধারণা ভুল। এই লোক আর যাই হোক কুলি মজুর নয়। চৌকো চোয়াল লোকটার। পাতলা বেঁটেখাট শরীর। পরনে কালো রঙের একটা দামী কাপড়ের অক্সিডেন্টাল সুট। হলদে চেহারায় প্রখর বুদ্ধিমত্তার ছাপ।

সুটকেসটা মেঝেতে রেখে মিস অ্যানা হ্যাটারের পাশেই বসল সে। ক্ষমা প্রার্থনার হাসি ঠোঁটে নিয়ে সবাইকে দেখল। কোমল বিনয়ী স্বরে বলল, হঠাৎ করে মাঝ রাস্তায় আপনাদের এভাবে বিরক্ত করার জন্যে আমি দুঃখিত। আসলে পশ্চিমা কৌতুকের শিকার হয়েছি আমি। শেষ স্টপেজে ওরা বলল হাঁটতে থাকলেই কিছুক্ষণের মধ্যে টেইলহল্টে পৌঁছে যাব। ওদের বিশ্বাস করা মোটেই উচিত হয়নি আমার।

আছে কিছু বদমাশ, বলল ব্যাগলে। এই মাত্র মেঝে থেকে উঠে গায়ের ধুলো ঝেড়ে সীটে এসে বসেছে। কতক্ষণ ধরে হাঁটছেন?

তা প্রায় আড়াই ঘণ্টা। হাত বাড়িয়ে দিল চাইনিজ। আমি ডক্টর ওয়াং।

ডাক্তার? হাতটা ধরে ঝাঁকিয়ে ছেড়ে দিল ব্যাগলে! দু’চোখে সন্দেহ নিয়ে জানতে চাইল, যদি ডাক্তারই হতে তোমার কালো ব্যাগটা থাকত; ওটা কই?

আমি ওষুধের ডাক্তার নই। প্যালানটোলজিস্ট। ব্যাগলেকে বোকার মত তাকিয়ে থাকতে দেখে ওয়াঙের হাসিটা দীর্ঘস্থায়ী হলো। আমি ডায়নোসরের ফসিল খুঁজতে টেইলহল্ট যাচ্ছি। আমার দৃঢ় বিশ্বাস ওখানে অনুসন্ধান করলে ফসিল পাওয়া যাবে।

বুঝলাম, কথাটা বললেও ব্যাগলের চেহারা দেখে বোঝা গেল কিছুই বোঝেনি।

দুলে উঠে সামনে বাড়ল স্টেজ। আবার শুরু হলো ধুলো ঢোকা। কথা ছাপিয়ে উঠল চাকা গড়ানোর গড়গড় আর কোচের ক্যাচ-কোচ ককানি।

ডক্টর ওয়াং কোচে ওঠার পর হঠাৎ করেই পরিবেশ পাল্টে গেছে। চুপ করে গেল সবাই। অস্বস্তিকর একটা নীরবতা নামল কোচের ভেতর। ভদ্রবেশী ওয়াংকে বিপজ্জনক মনে করার কোন কারণ নেই, তবু লোকটার উপস্থিতি বেননকে সতর্ক করে তুলল। লোকটার অমায়িক হাসির আড়ালে আরও কি যেন আছে আবছা ভাবে অনুভব করতে পারছে ও।

আউট-ল জীবনে অনেকবার মৃত্যুর ঝুঁকি নিয়েছে বেনন। সাহস, ষষ্ঠ ইন্দ্রিয় আর বুদ্ধির বলে বেঁচে গেছে বারবার। ও জানে অনুভূতিকে গুরুত্ব না দেয়া বোকামি। সতর্ক নজর রাখল বেনন চাইনিজের ওপর। আপনমনে কি যেন ভাবছে লোকটা। কোন দিকে খেয়াল নেই, আর কারও অস্তিত্ব যেন ভুলেই গেছে।

মাইলের পর মাইল পেছনে পড়ে যাচ্ছে, পেছনে ধুলোর মেঘ উড়িয়ে একটানা এগিয়ে চলেছে স্টেজ। সূর্যটা ডিমের কুসুমের মত রং ধরে হেলে পড়েছে পশ্চিমে, তবে গরম এখনও কমেনি। মাঝে মাঝেই রুমাল বের করে মুখের ঘাম মুছছে বেনন। ওর দেখাদেখি সিল্কের একটা সাদা রুমাল বের করে হলুদ মুখটা মুছল ডক্টর ওয়াং। তারপর রুমাল সহ হাতটা কোলের ওপর রেখে আবার ভাবনায় তলিয়ে গেল।

আধঘণ্টা পর ঝিমাতে লাগলেন মিস হ্যাটার। পাঁচ মিনিট পর ঘুমিয়েও পড়লেন। আরও কিছুক্ষণ পর ব্যাগলেও চোখ বুজল। হেলে পড়ল মাথা। ঘুমন্ত মিস হ্যাটারের কাঁধটা বালিশের মত ব্যবহার করছে ও। ব্যাগলের নাক ডাকার আওয়াজে কোচের আওয়াজ চাপা পড়ে গেল। ঘুম জিনিসটা ছোঁয়াচে রোগের মত। তন্দ্রায় পেয়ে বসল বেননকে। মিনিট দশেক নিদ্রা দেবীর আরাধনা করে চোখ মেলল ও, দেখল আর সবাই ঘুমাচ্ছে। মস্ত একটা কালো মাকড়সার মত সীটের ওপর পড়ে আছে ডক্টর ওয়াং।

জানালা দিয়ে মাথা বের করল বেনন। উইটিগো রেঞ্জের ওপর ঝুলে আছে অস্তগামী সূর্য। ছায়া নেমে আসছে চারপাশে। দূরের ওই নীলচে টিলাগুলোর গায়ে কালচে ছোপ লেগেছে। যদিও অনেক দূরে, তবুও মনে হচ্ছে হাত বাড়ালেই ছুঁয়ে দেয়া যাবে ওগুলোকে। টেইলহল্ট–এখনও অনেক দূরে, ওখানে পৌঁছোতে পৌঁছোতে বেশ রাত হয়ে যাবে।

সীটের ওপর পিঠ সোজা করে বসে চোখ কচলে ঘুম তাড়াতে চাইল ও। স্টেজ থেকে নেমে হাত-পায়ের খিল ছাড়াতে পারলে বেশ হত, কিন্তু তার কোন উপায় নেই। স্টেজ থামবে না, টেইলহন্টের আগের শেষ স্টেশনটা বেশ কয়েক মাইল পেছনে ফেলে এসেছে ওরা।

একটা ব্লাফের পাশ ঘেঁষে এগোচ্ছে স্টেজ কোচ। সেজব্রাশ এখানে উঁচু ব্লাফটাকে জায়গা ছেড়ে দিয়েছে। আঁধার হয়ে আসছে। চারপাশ। ঝোঁপগুলোকে দেখাচ্ছে কালো স্তুপের মত। ব্লাফটা

পেরলে আবার দেখা যাবে শেষ বিকেলের আলো।

বাঁক ঘুরল স্টেজ, পরমুহূর্তে কর্কশ আওয়াজ তুলে থেমে দাড়াল। কষে ব্রেক টেনেছে ড্রাইভার।

জানালা দিয়ে বেনন দেখল রাস্তা আটকে ঘোড়ার পিঠে বসে আছে তিনজন অশ্বারোহী। চেহারা চেনার উপায় নেই, মুখে রুমাল বেঁধে রেখেছে সবাই। প্রত্যেকের হাতে উদ্যত অস্ত্র। ড্রাইভারকে হুঁশিয়ার করার ভঙ্গিতে অস্ত্র নাড়ছে সামনের জন।

ঘুম ভেঙে যাওয়ায় স্টেজ কেন থেমেছে বুঝতে জানালা দিয়ে গলা বের করলেন মিস হ্যাটার, সামনের দৃশ্য দেখে ফুপিয়ে উঠলেন। চোখে প্রশ্ন নিয়ে পরামর্শের আশায় বেননের দিকে তাকাল ব্যাগলে।

হায় ঈশ্বর! ডাকাত! চট করে ব্যাগলের দিকে ফিরলেন টীচার। কে ওরা! নিশ্চয়ই তোমার বন্ধু?

বিরস চেহারায় মাথা নাড়ল ব্যাগলে। হলে খুশি হতাম!

ড্রাইভার নিশ্চয়ই মাথার ওপর হাত তুলে ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে বসে আছে-ওদিক থেকে কোন সাহায্য পাওয়া যাবে না, বলল বেনন। তাকিয়ে দেখল কিছুই হয়নি এমন ভঙ্গিতে কোলের ওপর রুমাল ফেলে তার ওপর দু’হাত রেখে বসে আছে ডক্টর ওয়াং। চেহারায় ভয়ের লেশমাত্র নেই। আবার ডাকাতদের দিকে চোখ ফেরাল সে। একজন থেকে আরেকজনকে আলাদা করার উপায় নেই, প্রত্যেকের পরনে রেঞ্জের সাধারণ পোশাক; ইচ্ছে করলে মুহূর্তে মিশে যেতে পারবে ভিড়ের মাঝে। অবশ্য তেমন ইচ্ছে যে তাদের নেই তা পরিষ্কার বোঝা গেল। সামনের লোকটা ঘোড়া থেকে নেমে স্টেজের পাশে এসে মিস ্যাটারের জানালায় দাঁড়াল।

অ্যাই যে তুমি! টীচারের দিকে আঙুল তাক করে বিকট এক ধমক দিল লোকটা। স্পারটা কোথায়?

আ…আমি জানি না। ভালয় ভালয় বের করো, নাহলে খুন করে ফেলব।

গলার কাছে চলে গেল মিস হ্যাটারের দু’হাত। ফিসফিস করে জানতে চাইলেন, লুকাসের স্পার নিয়ে কি করবে তোমরা?

আরে বুড়ি, সেটা তোমার না জানলেও চলবে। অস্ত্রটা প্রৌঢ়ার নাকের সামনে ধরে নাড়ল দুবৃত্ত। যা চাইছি জলদি বের করে দাও বাঁচতে চাইলে।

মুখ কালো হয়ে গেল মিস অ্যানির। বোঝা গেল মূল্য যাই হোক স্পারটা তাঁর কাছে নগণ্য নয়, হুমকির মুখে ডাকাতদের ওটা দিয়ে দিতে হলে মনে সাংঘাতিক কষ্ট পাবেন তিনি।

বেনন জানে না কেন, তবে ডক্টর ওয়াং স্টেজে ওঠার পর থেকেই এরকম কোন অঘটন ঘটবে বলে মনে হচ্ছিল ওর। লোকটার আচরণে যদিও অস্বাভাবিক কিছু নেই; এপর্যন্ত ডাকাত দলের উদ্দেশে কোন আকার ইঙ্গিতও করেনি, তবু কেন যেন মনে হচ্ছে চোখে পড়া উচিত ছিল এমন কিছু একটা ওর নজর এড়িয়ে যাচ্ছে।

মনস্থির করে নিল বেনন, এখন এসব ভেবে নষ্ট করার সময় নেই, এখন বিপদের মুখে ঝাঁপিয়ে পড়ার সময়। একজন ভদ্রমহিলার সম্মান এখানে ধূলিস্যাৎ হতে যাচ্ছে। যথেষ্ট অপমান হয়েছেন মহিলা। আর সহ্য করা যায় না।

<

Super User