০২. ব্লাক ডগ

শীত এসে গেল। দ্রুত বাড়ছে ঠান্ডা। প্রচন্ড তুষারপাত তো আছেই, সেই সঙ্গে প্রবল ঝড়। ক্রমেই খারাপের দিকে চলেছে বাবার অবস্থা। বোঝা যাচ্ছে, এই শীত কাটিয়ে উঠতে পারবে না। বাবা শয্যাশায়ী, ফলে, সরাইয়ের সমস্ত দায়িত্ব এসে পড়েছে আমার আর মার ওপর। ব্যস্ততার মাঝে অবাঞ্ছিত অতিথিটির দিকে বিশেষ নজর দিতে পারছি।

জানুয়ারি মাসের একদিন। ভোর হয়েছে। ভয়ঙ্কর শীত। পাহাড়ের পাথুরে পাদদেশে ঢেউ আছড়ে পড়ার মৃদু ছলাৎ-ছল শব্দ। দিগন্তে উঁকি দিয়েছে সূর্য। রশ্মিগুলো সাগরের পানি ছুঁয়ে ছুটে এসে স্পর্শ করেছে পাহাড়ের চূড়া। অন্যান্য দিনের চেয়ে আগে উঠেছে ক্যাপ্টেন। ছুরিটা কোটের তলায় লুকিয়ে, বগল তলায় পিতলের দূরবীন নিয়ে সাগর তীর ধরে এগিয়ে চলেছে। হ্যাটটা পেছন দিকে হেলানো। কনকনে বাতাসে ধোঁয়া হয়ে বেরোচ্ছে তার নিঃশ্বাস। পাথরের বড় চাইটা পেরোবার সময় নাকের ভেতর থেকে বিচিত্র কুদ্ধ শব্দ উঠল, যেন ডাক্তার লিভসীর কথা মনে পড়ে গেছে তার।

মা উপরে, বাবার কাছে। ফিরে এলে খাবে, তাই ক্যাপ্টেনের জন্যে নাস্তার জোগাড় করছি আমি। এই সময় হলঘরের দরজা খুলে গেল। ঘরে ঢুকল একজন লোক। তাকে এর আগে কখনও দেখিনি। গায়ের রঙ ফ্যাকাসে, লম্বাটে গড়ন। বাঁ হাতে দুটো আঙুল নেই। সঙ্গে একটা ছুরি। কিন্তু মারামারি খুব একটা করতে পারে বলে মনে হল না। জাহাজীদের দিকে আমার কড়া নজর, আগেই বলেছি। লোকটাকে ঠিক জাহাজী মনে হচ্ছে না, কিন্তু গায়ে সাগরের গন্ধ একেবারেই নেই, তাও বলা যায় না।

তার জন্যে কি করতে পারি জিজ্ঞেস করলাম। রাম চাইল সে। অর্ডার সরবরাহের জন্যে রওনা দিলাম। একটা চেয়ার টেনে বসে পড়ল আগন্তুক। ফিরে চাইতেই ইশারায় কাছে ডাকল আমাকে। তোয়ালেটা হাতে নিয়ে দাঁড়িয়ে রইলাম।

কাছে এস, খোকা, ডাকল সে। এই এখানে।

এক পা এগোলাম।

চোখের ইঙ্গিতে ক্যাপ্টেনের জন্যে সাজানো টেবিল দেখিয়ে জিজ্ঞেস করল, ওগুলো আমার বন্ধু বিলের জন্যে, না?

বললাম, আমি তার বন্ধু বিলকে চিনি না। তবে খাবারগুলো আমাদের একজন খরিদ্দারের জন্যে। তাকে ক্যাপ্টেন বলে ডাকি আমরা।

বিলকে ক্যাপ্টেন ডাকা যায়। ডান গালে একটা কাটা দাগ আছে তার। ব্যবহার চমৎকার, মাতাল হলে তো কথাই নেই। সে যাকগে। তা দোস্ত কি ঘরেই আছে?

বেড়াতে বেরিয়েছে, জানালাম।

কোন দিকে?

পাহাড়ের দিকে নির্দেশ করলাম। কোন্ পথে, কখন ফিরতে পারে, ধারণা দিলাম। এটাওটা আরও কিছু প্রশ্নের জবাবও দিতে হল।

তা ভাল, বলল আগন্তুক।

মুখের ভাব দেখে কিন্তু ভাল বোধ হল না। কি করব, বুঝতে পারছি না। সরাইয়ের বাইরে বেরোল আগন্তুক। দরজার কাছে দাঁড়িয়ে, মাঝে মাঝে উঁকি মেরে সরাইয়ের কোণের ওদিকে দেখছে। ইদুরের জন্যে যেন অপেক্ষা করছে বেড়াল। আমিও বেরোলাম। রাস্তায় উঠতে যাচ্ছি, ডেকে ফেরাল আমাকে। দ্বিধা করায় রাগের চিহ্ন ফুটল চেহারায়। বকা দিল। দ্রুত ফিরে এলাম। রাগের চিহ্ন মুছে গেল আবার তার চেহারা থেকে। পিঠ চাপড়ে বলল, এই তো লক্ষ্মী ছেলে। খুব ভাল তুই। তোর মত আমারও একটা ছেলে আছে। তাকে নিয়ে আমার গর্ব। কিন্তু কি জানিস, ছোটদের সবচেয়ে বড় গুণ হচ্ছে বড়দের কথা মেনে চলা। বিলের জাহাজে কাজ করলে অনেক আগেই শিখে যেতি এসব•••ওই তো, আসছে বিল। ওমা, হাতে দূরবীনটাও আছে দেখছি! তা চল তো বাবা, কোথাও লুকোই। ওকে চমকে দিতে হবে।

আমাকে ঠেলে নিয়ে ভেতরে ঢুকল আগন্তুক। ঘরের কোণে লুকাল। আমাকে রাখল তার পেছনে। অস্বস্তি বোধ করছি। ভয়ও পাচ্ছি। দেখে মনে হল লোকটাও ভয় পাচ্ছে। এতে ভীতি আরও বাড়ল আমার। হাতল ধরে টেনে খাপের ভেতরে ছুরির ফলাটা আলগা রাখল সে। গলায় যেন রুটির দলা আটকেছে, বারবার ঢোক গিলছে।

ঘরে ঢুকেই পেছনে শব্দ করে দরজা বন্ধ করে দিল ক্যাপ্টেন। ডানে-বাঁয়ে কোনদিকে তাকাল না। সোজা তার জন্যে রাখা খাবারের দিকে এগিয়ে গেল।

বিল! জোর করে গলার স্বর গম্ভীর রাখার চেষ্টা করছে আগন্তুক।

পাঁই করে ঘুরল ক্যাপ্টেন। বিবর্ণ হয়ে গেল মুখ। নাকের ডগা নীলচে হয়ে উঠল। সামনে যেন ভূত দেখছে সে। এক মুহূর্তে যেন আরও বেশি বুড়িয়ে গেছে। অসুস্থ হয়ে পড়েছে। তার জন্যে বলতে কি, করুণাই হল আমার।

পুরানো জাহাজী বন্ধুকে চিনতে পেরেছ তো, দোস্ত? বলল আগন্তুক।

ব্ল্যাক ডগ! গলা দিয়ে আওয়াজ বেরোতে চাইছে না ক্যাপ্টেনের।

তো আর কে? সহজ হয়ে আসছে আগন্তুক। নাটকীয়ভাবে বলল, ব্ল্যাক ডগই আমি, এসে হাজির হয়েছি অ্যাডমিরাল বেনবোয়। পুরানো দিনের কথা মনে পড়ে, দোস্ত? কি দিনই ছিল সে-সব! হাতের আঙুল দুটো হারালাম আমি, বাঁ হাতটা তুলে দেখাল সে।

তা চট করে বলে ফেল তো, কি জন্যে এসেছ?

বলছি, বলল ব্ল্যাক ডগ। কিন্তু আগে এক গেলাস রাম খাওয়া যাক। খোকা… আমার দিকে চাইতেই রওনা দিলাম। ক্যাপ্টেনকে বলছে ডগ, দারুণ ছেলে!

রাম নিয়ে ফিরে এলাম। টেবিলে দুজনে মুখোমুখি বসেছে। দরজার দিকে পাশ ফিরে বসেছে ব্ল্যাক ডগ। বন্ধুর ওপর চোখ রাখতেও সুবিধে, দরকার পড়লে চট করে পালিয়ে যাওয়াও সহজ।

আমাকে চলে যেতে বলল ব্ল্যাক ডগ। হুঁশিয়ার করে দিল, যেন কোন ফাঁক ফোকর দিয়ে ওদের দিকে চোখ রাখার কিংবা কোন কথা শোনার চেষ্টা না করি।

বারের ভেতরে চলে এলাম। কান খাড়া রাখলাম ঠিকই। নিচু গলায় কথাবার্তার আওয়াজ পাচ্ছি, কিন্তু কিছুই বুঝতে পারছি না। আস্তে আস্তে স্বর চড়তে লাগল। দুএকটা শব্দ বুঝতে পারছি এখন। গালাগালি করছে ক্যাপ্টেন।

হঠাৎ শুরু হল চেঁচামেচি। ধাতব শব্দ হল। ছিটকে পড়ল চেয়ার টেবিল। একটা আর্তনাদ শোনা গেল। বারের কোণ থেকে বেরিয়ে এসে দেখি দরজার দিকে ছুটছে ব্ল্যাক ডগ। তার পেছনে খোলা ছুরি হাতে তাড়া করছে ক্যাপ্টেন। ব্ল্যাক ডগের হাতেও ছুরি। কাঁধ থেকে রক্ত ঝরছে। দরজার কাছে পৌঁছে গেছে ব্ল্যাক ডগ। ধরতে পারবে না বুঝে ছুরি ছুঁড়ে মারল ক্যাপ্টেন। লাগলে ওখানেই শেষ হয়ে যেত ডগ। কিন্তু তার কপাল ভাল। লক্ষ্যভ্রষ্ট হয়ে সাইনবোর্ডটায় গিয়ে বিধল ছুরি। আজও সেই চিহ্ন আছে আমাদের সাইনবোর্ডে।

আধ মিনিটেই পাহাড়ের ওপাশে হারিয়ে গেল ব্ল্যাক ডগ। কিছুক্ষণ সাইনবোর্ডটার দিকে তাকিয়ে রইল ক্যাপ্টেন। চোখের ওপর হাত বোলাল কয়েকবার। তারপর ফিরে দাঁড়াল। আমাকে বলল, জিম, রাম! জলদি! বলতে বলতে টলে উঠল সে। দেয়ালে হাত রেখে কোনমতে সামলে নিল।

কোথাও লেগেছে? রাম! রাম আনো জলদি! পালাতে হবে আমাকে!

রাম আনতে ছুটলাম। ব্যাপারটার আকস্মিকতায় ঘাবড়ে গেছি। একটা গেলাস ভাঙলাম। মাথার ভেতর কেমন যেন গোলমাল হয়ে গেছে। বসার ঘরে ভারি কিছু পতনের শব্দে চমকে বার থেকে দৌড়ে বেরোলাম। দেখি, মেঝেতে চিৎ হয়ে পড়ে আছে  ক্যাপ্টেন।

হট্টগোল শুনে দোতলা থেকে নেমে এসেছে মা। দুজনেই ছুটে গেলাম ক্যাপ্টেনের কাছে। পাশে বসে তার মাথাটা তুলে ধরলাম। শ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছে ক্যাপ্টেনের। মুখ ফ্যাকাসে, চোখ বন্ধ।

কি যে শুরু হল ছাই! কেঁদেই ফেলবে যেন মা, এদিকে তোর বাবার এই অবস্থা!

কি করে সাহায্য করব ক্যাপ্টেনকে বুঝতে পারছি না। মারপিট করতে গিয়ে শরীরের কোথাও মারাত্মক আঘাত পেয়েছে? রাম এনে গেলাবার চেষ্টা করলাম। কিন্তু বদ্ধ দাঁতের ফাঁক দিয়ে গেলানো গেল না। এই সময় বাবাকে দেখতে এলেন ডাক্তার লিভসী। হাঁপ ছেড়ে বাঁচলাম।

দেখুন তো, বললাম সমস্বরে। কোথায় চোট লেগেছে?

চোট-ফোট কিছু না। আসলে স্ট্রোক হয়েছে ওর। আগেই সাবধান করেছিলাম। মিসেস হকিন্স, আপনি ওপরে চলে যান। আপনার স্বামী অসুস্থ। কোন কথা জানাবেন না তাকে। একে কি করা যায় দেখছি আমি। জিম, একটা বোল নিয়ে এসো তো।

বোল নিয়ে ফিরে এসে দেখলাম, ক্যাপ্টেনের কোট-শার্টের আস্তিন ছিড়ে ফেলেছেন ডাক্তারচাচা। পেশিবহুল হাত বেরিয়ে পড়েছে। হাতে উল্কিতে লেখা রয়েছেঃ হিয়ারস লাক, এ ফেয়ার উইন্ড, বিলি বোস হিজ ফ্যান্সি। বাহুর ওপরে, কাঁধের কাছে আঁকা একটা ছবি। ফাঁসিতে ঝুলছে একজন মানুষ। জলদস্যুদের সাংকেতিক চিহ্ন, ছবিটা দেখিয়ে মন্তব্য করলেন ডাক্তারচাচা। জিম, রক্ত দেখলে ভয় পাবে না তো?

জ্বী, না।

গুড। বোলটা ধরো, বলেই নাবিকের হাতের শিরায় ডাক্তারী-ছুরি দিয়ে খোঁচা মারলেন।

অনেকখানি রক্ত বেরিয়ে যাবার পর চোখ খুলল ক্যাপ্টেন। ঘোলাটে চোখে তাকাল চারদিকে। ডাক্তারচাচার দিকে চেয়ে ভুরু কোঁচকাল। আমার দিকে চেয়ে খানিকটা স্বস্তি পেল যেন। কিন্তু হঠাৎই আবার বিবর্ণ হয়ে গেল চেহারা। শরীরটাকে তোলার চেষ্টা করে বলল, ব্ল্যাক ডগ? কোথায়?

ওসব ডগ-ফগ কিছু নেই এখানে, বললেন ডাক্তাচাচা। স্ট্রোক হয়েছিল আপনার। বেশি রাম খাবার ফল। ইচ্ছা একেবারেই ছিল না, তবু গোর থেকে ফিরিয়ে আনা হল আপনাকে এইমাত্র। তা বোনস…

…আমার নাম বোনস নয়, বাধা দিয়ে বলল নাবিক।

তর্ক করার কোন ইচ্ছে আমার নেই। নামটা আপনার হাতে লেখা রয়েছে। সে যাকগে। আবার হুশিয়ার করছি, এরপর রাম খেলে… তা এক-আধ গেলাস খেলে তেমন ক্ষতি হবে না, কিন্তু আপনি তো খেতেই থাকবেন। তাহলে আর সাগর দেখতে হবে না বেশিদিন। বোঝা গেছে?

হ্যাঁ-না কিছুই বলল না নাবিক।

চলুন, আরেকটু সাহায্য করি আপনাকে, আমার দিকে ফিরলেন ডাক্তারচাচা। জিম, এসো, হাত লাগাও।

ধরে কোনমতে দোতলায় তার ঘরে নিয়ে গেলাম নাবিককে। বিছানায় শুইয়ে দিলাম। বালিশে মাথা রেখে একেবারে নেতিয়ে পড়ল সে। জ্ঞান হারাল নাকি?

না, হারায়নি। ডাক্তারচাচার কথায় চোখ মেলেছে, আবারও সাবধান করছি, রাম ছাড়ুন। নইলে খুব দ্রুত পৌঁছে যাবেন কবরে।

আমাকে নিয়ে নাবিকের ঘর থেকে বেরিয়ে এলেন ডাক্তারচাচা। বাবাকে দেখতে যাবেন এবার।

বারান্দা ধরে হাঁটতে হাঁটতে বললেন, জিম, যে কোন লোক যত খারাপ হোক, অসুস্থ হয়ে পড়লে ডাক্তারের কাছে তার একটাই পরিচয়। রোগী। শোন, ওকে রাম দিও না আর। ড্রিংক চাইলে, শরবত দেবে। ওর পুরোপুরি রেস্টের প্রয়োজন এখন। আর একটা স্ট্রোক হলেই শেষ…

<

Super User