সেলুনের সামনে হিচরেইলে ঘোড়া বাঁধছে এক মাইনার। তার দিকে শহরবাসীর কোন মনোযোগ নেই। হাজারো মাইনারের ভিড়ে সাধারণ একজন মাইনার বলে একে ধরে নিয়েছে সবাই। লোকটার চেহারা দেখে বয়স আন্দাজ করার উপায় নেই, তিরিশ থেকে পঞ্চাশের মধ্যে বলে মোটামুটি ধরে নেয়া যায়। মুখে কাঁচা পাকা দাড়ির ঘন জঙ্গল, কাপড়চোপড় ধুলো জমে এত শক্ত যে খুলে রাখলে আপনি দাঁড়িয়ে থাকবে। বেশির ভাগ পথচারী একবারও তাকাচ্ছে না লোকটার দিকে। তবে শিগগিরই এই লোক হয়ে উঠবে পুরো শহরের আলোচনার কেন্দ্রবিন্দু-মধ্যমণি।

ঘোড়া বাঁধা শেষে ধুপধাপ পা ফেলে তিনটে ধাপ বেয়ে ফুটপাথে উঠল লোকটা, হেলেদুলে হাঁটতে হাঁটতে গিয়ে ঢুকল ক্যাসিনো সেলুনে। টুইন স্প্রিংসের সেলুনগুলোর মধ্যে এটাই সবচেয়ে বড়। ভেতরে গিজগিজ করছে মানুষ। কনুইয়ের ঠেলাগুতো দিয়ে পথ করে বারকাউন্টারের সামনে চলে এলো সে।

বারটেন্ডারের চোখ ঘুরে গেল মাইনারের ওপর থেকে, স্থির হলো পয়সাওয়ালা এক খদ্দেরের ওপর। তাকে ড্রিঙ্ক দিয়ে কয়েকজন পাঞ্চারের ফরমাশ অনুযায়ী ড্রিঙ্ক দিল বারটেন্ডার, উপেক্ষিত রয়ে গেল মাইনার।

অ্যাই, কি হলো? সেলুনের ভেতরে গমগম করে উঠল মাইনারের চড়া গলা, একটা বোতল চাইছি, শুনতে পাচ্ছ না! তাড়াতাড়ি দেবে!

ধীরেসুস্থে তার দিকে এগিয়ে এলো বারটেন্ডার। লোকটা সে দীর্ঘকায়, সব সময়েই অস্থির হয়ে থাকে নিজের শক্তি দেখানোর জন্যে। একই সঙ্গে সেলুনের বাউন্সারের কাজটাও চালিয়ে নেয় সে অনায়াসে। কোন মাতাল ঝামেলা করলে ঘাড় ধরে শূন্যে তুলে নির্দ্বিধায় ছুঁড়ে দেয় সেলুনের বাইরে। মাইনারের সামনে থামল বারটেন্ডার। তা কিসের বোতল চাই তোমার? অবহেলার সঙ্গে জানতে চাইল।

হঠাৎ মনে হলো মাইনার যুবক হয়ে উঠল, চোখের দৃষ্টি তীক্ষ্ণ হয়ে গেল। ঠোঁট বাঁকিয়ে ঘড়ঘড়ে গলায় বলল, বোবোঁ।

জো মেয়ার্স মাইনারের দৃষ্টি অগ্রাহ্য করে কাউন্টারের ওপর দিয়ে সামনে ঝুঁকল। হাসি হাসি চেহারায় বলল, আগে পকেট থেকে পয়সা বের করে দেখাও, বোর্বো পাবে। যদি দেখি অন্যান্য মাইনারের মতো তোমার পকেটও ফাঁকা, তাহলে পোঁদে এক লাথি মেরে সেলুন থেকে বের করে দেব।

বড় দেরি করে ফেলল বারটেন্ডার বামপাশ থেকে আসা মাইনারের ডানহাতি ঘুসি এড়াতে গিয়ে। সোজা চোয়ালে হজম করল সে ঘুসিটা। হুড়মুড় করে কয়েক পা পিছিয়ে গিয়ে সামলে নিল নিজেকে তৈরি হলো আক্রমণে যাবার জন্যে।

গোলমালের গন্ধ পেয়ে সরে গেছে অন্যান্য খদ্দের, সবাই তাকিয়ে আছে। মাইনারের দিকে, কারও কারও চেহারায় ফুটে উঠেছে শ্রদ্ধা। বারটেন্ডারের দিকে খেয়াল নেই আর মাইনারের, কোটে তার অনেক পকেট, সে এখন ব্যস্ত হয়ে কোটের পকেটগুলো হাতড়াচ্ছে। ক্যাসিনো সেলুনের মালিকস্টিভ ডেভিস ছিটকে। বেরিয়ে এলো তার, অফিস থেকে, সন্দিগ্ধ চোখে একবার কর্মচারীর দিকে চেয়ে অসন্তুষ্ট খদ্দেরের দিকে মনোযোগ দিল সে, চোখ বড় বড় হয়ে উঠল মাইনারের পকেট থেকে পেট মোটা একটা টাকার থলে বেরতে দেখে। মাইনারকে থলের। চামড়ার ফিতে খুলে কয়েকটা বড় বড় সোনার টুকরো বের করতে দেখে পিনপতন নিরবতা নামল সেলুনের ভেতর। কাউন্টারে সোনার টুকরোগুলো রাখল মাইনার। আশপাশের মাথাগুলো ঝুঁকে এলো সোনার টুকরো ভাল মতো দেখার আশায়। নাদুসনুদুস হুঁড়ি দুলিয়ে মাইনারের পাশে চলে এলো স্টিভ ডেভিস, চোখে ফুটে উঠেছে শ্রদ্ধার ছাপ। সাধারণ কোন দু’পয়সা দামের মাইনার নয় এ, রীতিমতো পয়সাওয়ালা লোক।

বারের পেছনে হাত বাড়িয়ে জানতে চাইল ডেভিস, আপনি তো বুরু চেয়েছিলেন, তাই না? একটা বোতল ধরিয়ে দিল মাইনারের হাতে। আশা করি এটা আপনাকে সন্তুষ্ট করতে পারবে।

ছোট্ট করে নড করে থলে থেকে আরও কয়েকটা বড় বড় সোনার টুকরো বের করল মাইনার, তারপর অনাবিল হাসি হেসে সব কয়টা টুকরো পুরে ফেলল থলেতে, একটা টুকরো ছাড়া। থলেটা চলে গেল তার পকেটে।

আশা করি এতেই উপস্থিত সবার জন্যে ড্রিঙ্কের ব্যবস্থা হয়ে যাবে, সোনার টুকরোটা দেখিয়ে বোতলের কর্ক খুলতে খুলতে বলল সে। চেহারা গম্ভীর তার, কিন্তু চোখ চকচক করছে আনন্দে।

লোভীর মতো ছোঁ মেরে সোনার টুকরো হাতে তুলে দেখল ডেভিস।

এবার জটলা বাঁধতে শুরু করল জনতা মাইনারকে ঘিরে। বোকা বোকা চেহারায় ডেভিসের হাতের সোনার দিকে তাকিয়ে থাকল মেয়ার্স। বোতল মুখে তুলে চো-চো করে আধ পাইন্ট নামিয়ে দিল মাইনার। কোটের হাতায় মুখ মুছে ঢেকুর তুলল বড় করে। বোতলের বাকি তরলটুকু ধীরেসুস্থে শেষ করল সে, তারপর আরেকটা বোতলের জন্যে মাথা কাত করে ইশারা দিল।

ডেভিস নিজে খুলে দিল একটা বোতলের মুখ, সবাই দেখল তৃষ্ণার্তের মতো গিলছে মাইনার, নিজের দিকে একটুও খেয়াল নেই, মাতাল হয়ে শেষে হয়তো হারাবে সবই কোন ছিচকে চোরের হাতে। তবে মাইনার কথা বলতে শুরু করতেই সবার এই ধারণা পাল্টে গেল।

এখানে কোন ল্যান্ড অফিস আছে? জানতে চাইল মাইনার।

ধীরে ধীরে মাথা নাড়ল ডেভিস। না। কাছেরটা রলিন্সে, এখান থেকে বিশ পঁচিশ মাইল দক্ষিণে।

কনুইয়ের তো মেরে পথ করে নিয়ে টলতে টলতে দরজার দিকে চলল। মাইনার, পাত্তাই দিচ্ছে না চেপে আসা ভিড়কে। সে কয়েক পা এগোতেই পেছন পেছন চলল ডেভিস, চোখে আশার আলো। ক্লেইম ফাইল করবেন আপনি? জানতে চাইল মাইনারের কাঁধের ওপর মুখটা নিয়ে।

জবাব দেয়ার আগে দীর্ঘ সময় নিল মাইনার, উদগ্রীব মুখগুলোর ওপর ঘুরে এলো তার ঘোলা চোখের দৃষ্টি। ভাব দেখে মনে হলো ঠিক কতটা বলা উচিত হবে, সেব্যাপারে সিদ্ধান্তহীনতায় ভুগছে।

বেশ, মনে হচ্ছে তোমাদের বললে কোন ক্ষতি হয়ে যাবে না আমার, অবশেষে বলল সে। খবরটা এমনিতেই ছড়িয়ে যাবে আমি রলিন্সের ল্যান্ড অফিসে গেলে। তাছাড়া আমাদের ক্লেইমে পাহারা দিচ্ছে আমার বন্ধু।

মাইনার শ্বাস ফেলতেই আরও চেপে এলো তার চারপাশের ভিড়।

এত সোনা একবারে আর কোথাও পাওয়া যায়নি, আমি বাজি ধরে বলতে পারি। পাথরের তলায় পুরো পাঁচ মাইল লম্বা একটা স্তরে সোনা আছে। উপত্যকার, মাটি ঘেঁকে সোনা পাওয়ার কারণ এখন বুঝতে পারছি। স্তরটা দেখে আমার মনে হয়েছে পাহাড়ের তলা দিয়ে ওই পার পর্যন্ত চলে গেছে।

কোন্ পাহাড়? উৎসুক হয়ে জানতে চাইল ডেভিস, তর আর সইছে না তার।

সেমিনো পীক, ওই যে উত্তর-পশ্চিমের ওই পাহাড়টা। কত হবে, চল্লিশ মাইল হবে এখান থেকে। এসেক্স আর উইন্ড রিভার পীকের কাছেই।

সেমিনো পীক! বেশিরভাগ মানুষই নিজের মনে উচ্চারণ করল নামটা। গুঞ্জন উঠল সেলুনে।

ওই পাহাড় তো প্রসপেক্টররা খুঁজে দেখেছে, কিছুই পাওয়া যায়নি, চোখের সামনে সোনার টুকরোটা ধরে সাবধানে বলল ডেভিস। সোনা চিনতে তার ভুল হয় না। জেড অ্যাংগার একবার ধোকা খেয়েছিল ওখানে। সোনা ভেবে কি একটা ধাতু নিয়ে রলিন্স শহরের অ্যাসে অফিসে গিয়ে বোকা বনেছিল।

আমি যে জায়গার কথা বলছি সেখানে কেউ খোঁজেনি, বোতল থেকে আরেক চুমুক খেল মাইনার, ক্যাসপার ক্রীক যেখানে নর্থ প্ল্যাট নদীর সঙ্গে মিশেছে, জায়গাটা ওখানে। ওই ক্ৰীক ধরে উজানে গেলে মাঝ রাস্তায় আরেকটা যে ঝর্না আছে। ওটা ক্যাসপারের সঙ্গে মিশেছে। সেই ঝর্নার পাড় ধরে দুই মাইল গেলে পানির উচ্চতার আন্দাজ বিশ ফুট ওপরে, পাহাড়ের গায়ে আছে সোনা। সোনার সরু একটা পাত, পাঁচ মাইল লম্বা। ঘোলা চোখে চারপাশে তাকাল মাইনার। আমার ধারণা সবার জন্যেই যথেষ্ট আছে ওখানে।

প্রত্যেকে তার কথা শুনেছে। সবাই চেনে জায়গাটা। দ্বিতীয়বার মাইনারকে বলতে হলো না কোথায় সোনা পেয়েছে সে। দীর্ঘ একটা মুহূর্ত নীরবে কাটল, তারপর একে একে বেরিয়ে গেল সবাই সেলুন ছেড়ে। প্রত্যেকে জানে, এখন সে। রসদপত্র নিয়ে রওনা হবে নিজের জন্যে সোনা খুঁড়তে।

জো, তুমি এদিকটা সামলে নিয়ো, কর্মচারীর দিকে তাকাল ডেভিস, আমি যাচ্ছি আমাদের জন্যে জায়গা দখল করতে।

বিস্মিত চোখে মেয়ার্স দেখল তার বস্ দ্রুত পায়ে বেরিয়ে গেল ব্যাটউইং দরজা ঠেলে। মাইনারের দিকে তাকাল মেয়ার্স। বলল, মনে হচ্ছে তোমার ঘুসির কথাটা ভুলে যাওয়া উচিত আমার। আরেকটা বোবোঁর বোতল মাইনারের হাতে ধরিয়ে দিল মেয়ার্স। এটা সেলুনের পক্ষ থেকে। হাসল লোকটা। মনে হচ্ছে এখানে আর কোন কাজ নেই। এবার সেলুন বন্ধ করে দিয়ে আমিও যাব সোনার খোঁজে। আগামী কয়েকদিন সেলুনে কোন লোক আসবে বলে মনে হয় না।

আস্তে করে মাথা দোলাল মাইনার, সেলুনের বাইরে এসে ঘোলা চোখে দেখল মেয়ার্সও তার বসের পদাঙ্ক অনুসরণ করে হিচরেইলে বাধা একটা ঘোড়ার দড়ি খুলছে। সাড়া পড়ে গেছে শহরে, সবাই ব্যস্ত হয়ে জোগাড়যন্ত্র করছে। সন্তুষ্টির একটা ছাপ ফুটে উঠল মাইনারের চেহারায়।

ঘোড়ার পিঠে তাড়াহুড়ো করে বাঁধা স্যাডল রোল চাপিয়ে শহর ছাড়ছে মানুষ। কেউ কেউ ওয়্যাগন বা বাগি ভর্তি করছে খাবার, কাপড় আর কোদাল শাবল দিয়ে। বিবাহিতরা বউ-বাচ্চাকেও সঙ্গে নিচ্ছে নিরাপত্তার কথা ভেবে। নতুন শহরে কেউ যে থাকবে না সোনার খবর ফাঁস হওয়ার পর, এটা প্রায় নিশ্চিত। ঝপাঝপ বন্ধ হয়ে যাচ্ছে দোকানগুলোর ঝাঁপ। এরাও কয়েকদিনের জন্যে স্বর্ণসন্ধানী হতে বিন্দুমাত্র দ্বিধা করছে না। রাস্তায় উড়ছে ভারী ধুলোর মেঘ। গড়গড় শব্দে গড়াচ্ছে ওয়াগন আর বাগিগুলোর চাকা। খবর দেয়ার আধঘণ্টা পর মাইনার একা দাঁড়িয়ে থাকল টুইন স্প্রিংসের রাস্তায়, তার কাছে মনে হলো সে ছাড়া গোটা শহরে বুঝি আর একজনও নেই।

আবার সেলুনে ঢুকল মাইনার, বার থেকে সংগ্রহ করল কয়েকটা ভাল জাতের। মদের বোতল, তারপর সেগুলো কোটের পকেটে ভরে বাইরে এসে ঘোড়ায় চড়ে রওনা হয়ে গেল নিজের পথে। ধীরেসুস্থে দক্ষিণে, রলিন্সের দিকে চলেছে, যেন তাড়া নেই কোন। ব্যাঙ্ক পার হওয়ার সময় হাসল মাইনার, দেখল ভেতরে দু’জন লোক কাজ করছে এখনও। এরা বোধহয় সোনার খোঁজে যাবে না, আশা করছে সোনাই যথাসময়ে তাদের কাছে আসবে।

রলিন্সের ট্রেইলে কয়েক মাইল এগোনোর পর ট্রেইল ছেড়ে গভীর একটা ক্যানিয়নের ভেতর দিয়ে পথ করে এগোল মাইনার। এঁকেবেঁকে ওপর দিকে উঠেছে ক্যানিয়নের মেঝে, বাঁকগুলো পার হবার সময় তার ভঙ্গি দেখে মনে হলো এখান দিয়ে আগেও বহুবার যাতায়াত করেছে। বড় একটা বাঁক ঘুরতে ক্যানিয়ন শেষ হয়ে গেল। খোলা একটা জমি সামনে। সে দেখল, দুটো মস্ত বোল্ডারের। মাঝখানে দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করছে এক লোক।

কি খবর, ডেভ, মাইনারের ঘোড়া থামতেই জানতে চাইল লোকটা। সোনার খবরে হিড়িক উঠেছে?

উঠেছে মানে! এত দ্রুত কোন শহর খালি হতে আমি দেখিনি, স্লিম। শেষ যখন দেখলাম, কয়েক বছর আগে ওগালায় প্লেগের খবর ছড়িয়ে পড়তে সবাই। পালাল, তাতেও কয়েক ঘণ্টা লেগেছিল, টুইন স্প্রিংসের এরা ওদেরও ছাড়িয়ে গেছে।

হাসল স্লিম, সরে মাইনারকে এগোনোর পথ করে দিল। সামনে বাড়ল মাইনার, একটু পরেই চলে এলো ঘাসে ছাওয়া ছোট্ট একটা উপত্যকায়। উপত্যকার বেশ খানিকটা ভেতরে পাহাড়ের গায়ে ঝুলন্ত একটা মস্ত পাথরের নিচে জ্বলছে একটা আগুন। সেই আগুনটাকে ঘিরে বসে আছে একদল লোক বিশ্রাম। নিচ্ছে, সিগারেট ফুকছে, গল্প করছে মৃদুস্বরে। ডেভ তাদের কাছে গিয়ে ঘোড়। থেকে নামতেই বেশির ভাগ লোক উঠে দাঁড়িয়ে তাকে স্বাগত জানাল। একজন একটা কফির মগ দিল মাইনারের হাতে।

অবস্থা কেমন?

জানতে যে চেয়েছে সে লম্বা, রোদে পোড়া সুদর্শন চেহারার, চোখ দুটো এত ধূসর যে ওপেক রঙের বলে ভুল হয়। একনজর দেখলেই বোঝা যায় সে এই দলের একচ্ছত্র অধিপতি।

শহরে এখন দু’জনের বেশি নেই, লিউ। আমার ধারণা তাদের দুজনের মধ্যে একজন আবার সন্ধের আগেই চলে যাবে সেমিনোর দিকে।

মাইনারকে দেখে এখন আর মনে হচ্ছে না সে প্রৌঢ়, হাঁটাচলার মসূণ ভঙ্গি দেখে বোঝা যাচ্ছে রীতিমতো চঞ্চল এক যুবক সে। চেহারায় সেই ঢিলেঢালা ভাব নেই, কঠোর মুখভঙ্গি। যেকোন বিপদের মোকাবিলায় সক্ষম।

আমার ধারণা ব্যাঙ্কার থাকবে। লোকটা ভাববে ব্যাঙ্কে বসে সোনা নিয়ে আসা লোকজনের সঙ্গে লেনদেন করেই যথেষ্ট টাকা লাভ করতে পারবে সে।

ডেভের কথা শুনে হাসির একটা হুল্লোড় উঠল। লিউয়ের ঠোঁটেও হাসির একটা রেখা দেখা দিল।

সেমিনোয় সোনা নেই এটা প্রচার হয়ে যাবার আগেই তাহলে ব্যাঙ্কার একটা দর্শন দিয়ে আসতে হচ্ছে, শান্ত গলায় বলল সে। সন্ধের সময় রওনা হব আমরা।

টুইন স্পিংসে ঢোকার পর কৌতূহলী হয়ে উঠল দুই রাইডার। কেউ নেই চারধারে, যেন পরিত্যক্ত একটা মৃত শহর। অথচ বাড়িঘর নতুন, সাদা রঙের বেড়াগুলো ঝকঝকে। তাছাড়া রলিঙ্গের কাছে কোন ভুতুড়ে শহর নেই।

এই শহরের বাতাসটা আমার ঠিক পছন্দ হচ্ছে না, বেনন, বলল কানে লোমওয়ালা ত্যাড়াবাকা চেহারার বয়স্ক লোকটা। মোটা গোঁফে তা দিয়ে আরেকবার দেখে নিল সে রাস্তার দু’পাশ।

পাশের দীর্ঘদেহী আরোহী আস্তে করে মাথা দোলাল। একেও দেখতে সুদর্শন বলা যাবে না, তবে চেহারায় একটা আলাদা আকর্ষণ আছে। চোখ দুটোতে আছে মায়া। ভোলা মনের লোক হলে একে প্রথম দর্শনেই পছন্দ না করে উপায় নেই কারও। মন্ট্যানার বিখ্যাত দস্যু, রক বেনন তার নাম। এখন গভর্নরের ক্ষমার কল্যাণে আইন তাকে ধাওয়া করে না, কাজেই নিশ্চিন্তে ঘুরে বেড়াচ্ছে, এটাই তার নেশা। ঠিক করেছে বাঁধনে জড়াবে না কখনও জীবনে। এখানে এসেছে একজনের অনুরোধে, বিশেষ একটা কাজে।

ঠিকই বলেছ, ব্যাগলে, অবশেষে মন্তব্য করল বেনন।

আমি যা বলি ঠিকই বলি, সন্তুষ্ট স্বরে বলল ব্যাগলে। অসন্তুষ্ট হওয়ার কোন কারণ নেই। এমনকি বেনন বকলেও, কৃতজ্ঞ ব্যাগলে কিছুতেই ভুলতে পারবে না যে বছরে অন্তত দু’বার যেখানেই থাকুক কষ্ট করে তার ফার্মে আসে বেনন, তার বউকে বুঝিয়ে শুনিয়ে ব্যাগলেকে নিয়ে বেরিয়ে পড়ে পনেরো দিনের জন্যে। এই ক’টা দিনের অপেক্ষায় বউয়ের বকা আর বাচ্চা ছেলে-মেয়ে দুটোর সব জ্বালাতন মুখ বুজে সহ্য করে নিতে পারে ও।

বাড়ির রং দেখে বোঝা যাচ্ছে ভুতুড়ে শহর নয়, অথচ কেউ নেই! চওড়া কাঁধ ঝাঁকিয়ে শ্রাগ করল বেনন। তাতে অবশ্য আমাদের কিছু যায় আসে না, আমরা সেলুনে ড্রিঙ্ক খুঁজে পেলেই খুশি থাকব, কি বলো, ব্যাগলে? গলার ধুলো দূর করা দরকার।

ধুলো না থাকলেও দিনে অন্তত দশ ঘণ্টা মাতাল থাকা দরকারি, গভীর বিশ্বাসের সঙ্গে বলল ব্যাগলে। তারপর অভিযোগের সুরে যোগ করল, ফার্মে ওরা আমাকে এক ফোঁটাও খেতে দেয় না।

সবচেয়ে বড় সেলুনটার সামনে ঘোড়া থামাল দুই কাউবয়। সাইনবোর্ডে বড় করে লেখা রয়েছে, ক্যাসিনো সেলুন। আরেকবার চোখে অস্বস্তি নিয়ে রাস্তায় নজর বুলিয়ে নিল ওরা, তারপর হিচরেইলে ঘোড়া বেঁধে ব্যাটউইং ডোর ঠেলে ঢুকে পড়ল সেলুনের ভেতরে। দুতিনটে ধেড়ে ইঁদুর ওদের দেখে দৌড়ে গিয়ে লুকিয়ে পড়ল নিজেদের আস্তানায়।

দেখে মনে হচ্ছে অনেক লোক সমাগম ছিল এখানে কয়েক দিন আগেও, বলল বেনন চিন্তিত চেহারায়। আঙুল তাক করে মেঝে দেখাল। ধুলোতে অনেক পায়ের ছাপ। এলোমেলো, বিক্ষিপ্ত, তবে তাজা ছাপ। অনেক কথা বলছে নীরব সেলুনটা। দেখেছ, একটা টেবিল দেখাল বেনন, এত তাড়াতাড়ি চলে গেছে যে গ্লাসের ড্রিঙ্কটুকুও শেষ করতে পারেনি।

ওরা কী বুঝবে ড্রিঙ্কের কদর, নাক কুঁচকাল ব্যাগলে, ওদের বউ যদি আমারটার মতো হতো তবে টের পেত।

তা ঠিক, দ্বিমত পোষণ করতে পারল না বেনন। লম্বা বারের পেছনে চলে এলো ও, চোখ বোলাল সারি সারি বোতলের ওপর। বোবো? না, অত খরচ করার মতো আর্থিক অবস্থা নেই। রাই হুইস্কি? হ্যাঁ, এটাই তো খুঁজছিল এতক্ষণ। একটা রাই হুইস্কির বোতল নামাল বেনন, দুটো পরিষ্কার গ্লাসে হুইস্কি ঢেলে একটা গ্লাস বাড়িয়ে দিল ব্যাগলের দিকে। ব্যাগলেকে চো-চো করে গলায় তরলটুকু ঢালতে। দেখে চুমুক দিল গ্লাসে, চারপাশে একবার চোখ বুলিয়ে নিল, তারপর বলল, তোমার কি মনে হয়, একসঙ্গে সেলুনের সব লোক বেরিয়ে যাবে এমন কি কারণ থাকতে পারে!

সেটাই তো চিন্তা করে বের করতে চাইছি সেই তখন থেকে।

কাউন্টারের নিচের তাকে চোখ পড়তেই চকচক করে উঠল বেননের চোখ। হাত বাড়িয়ে তুলে নিল গউচো চুরুটের বাক্সটা। পকেট থেকে কয়েন বের করে মদ আর চুরুটের দামটা রেখে দিল বাক্সের জায়গায়। বাক্স চলে গেল পকেটে। একটা চুরুট ধরাল বেনন। ধোয়া ছেড়ে বলল, মাত্র দুটো কারণে কোন শহর এভাবে খালি হয়ে যেতে পারে, ব্যাগলে। হয় প্লেগের ভয়ে, নাহলে কাছের শহরের বিরাট বড়লোক কেউ মরার আগে ঘোষণা দিয়েছে, এই শহর থেকে যে মা যাবে তাকেই সমস্ত সম্পত্তি লিখে দেবে।

কারণ হতে পারে তিনটে, নাক কুঁচকে মতামত জানাল ব্যাগলে। তুমি যে চুরুট টানছ সেরকম চুরুট যদি বেশ কয়েকজন একসঙ্গে ধরায়, তাহলেও শহর খালি হতে দেরি হবে না।

বারের কাছ থেকে সরে গেল ব্যাগলে। নির্বিকার চেহারায় ধোঁয়া ছাড়ল বেনন। পা বাড়িয়ে বলল, চলো, ঘুরেফিরে দেখি শহরটা।

রাস্তায় নেমে একধারের বাড়িঘরের সমস্ত দরজা খুলে দেখছে ওরা। সবখানে দ্রুত শহর ছাড়ার চিহ্ন। ব্যাঙ্কে আসার আগে পর্যন্ত দৃশ্যে কোন পরিবর্তন ওদের চোখে পড়ল না।

রাশল্যান্ড ব্যাঙ্ক। বড় একটা সাইনবোর্ড টাঙানো আছে বাড়ির সামনে। ভেতরে ঢুকল ওরা, বুঝতে দেরি হলো না মেঝের ধুলোয় পড়ে থাকা লাশ দুটোর মধ্যে ভাল কাপড় পরা লোকটাই ছিল রাশল্যান্ড। দুজনের কোটেই বুকের কাছটা কালচে হয়ে আছে জমাট রক্তে।

বেনন আর ব্যাগলে, দুজনেই গভীর মনোযোগে লোক দু’জনকে পরীক্ষা করে দেখল। অন্তত একদিন আগে মারা গেছে। প্রত্যেকের বেলায় কেবল একটা করে বুলেট খরচ করা হয়েছে।

চোখে চোখে কথা হয়ে গেল বেনন আর ব্যাগলের, ব্যাঙ্কটা সার্চ করে দেখল ওরা। কার্পেটের নিচে পাওয়া গেল একটা ট্র্যাপ ডোর। ওটা খুলে নিচে নেমে এলো। ছোট্ট একটা ডাগআউট। সেটা মজবুত ছিল। এখন দরজাটা খোলা। সম্ভবত খুলিয়ে নেয়া হয়েছে রাশল্যান্ড বা কর্মচারীকে দিয়ে। ভেতরে একটা ফুটো পয়সাও নেই।

একটা ব্যাপার নিশ্চিত, বলল গম্ভীর বেনন, শহরে কেউ একজন রয়ে গিয়েছিল কাজটা সারতে, প্লেগের কারণে শহর খালি হয়নি।

সিঁড়ি বেয়ে ব্যাঙ্কের অফিসে চলে এলো বেনন। চিন্তিত চেহারায় তাকে অনুসরণ করল ব্যাগলে। পেছন থেকে অনিশ্চিত গলায় বলল, আমাদের বোধহয় কেটে পড়া উচিত, বেনন! শিগগিরই কেউ এসে পড়বে, আর এলেই একের পর এক প্রশ্ন করতে থাকবে। উপযুক্ত জবাব দিতে না পারলে আমাদেরকে ওরা ঝুলিয়ে দিতে পারে।

জবাব দিল না বেনন। অধৈর্য ব্যাগলে বলল, তোমার হাবভাব দেখে মনে হচ্ছে নড়ার কোন ইচ্ছে নেই।

কৌতূহল হচ্ছে, অস্বীকার করব না, বলল বেনন। তবে সেজন্যে হাজারো প্রশ্নের মুখোমুখি হবার কোন ইচ্ছে আমারও নেই। ঠিকই বলেছ, এখানে থাকার আর কোন মানে নেই। চোখে অস্বস্তি নিয়ে লাশ দুটোর দিকে তাকাল বেনন। ওদের ব্যবস্থা শহরের লোকরাই করবে। চলো, কেটে পড়ি।

ওরা দু’জন ব্যাঙ্কের দরজায় পৌঁছেছে এমন সময়ে স্টেজকোচটা রাস্তার বাঁক ঘুরে ওদের ছাড়িয়ে খানিকটা সামনে থামল। ধুলো থিতিয়ে আসার আগেই লাফ দিয়ে নামল ড্রাইভার, যাত্রীদের মালামাল নামাচ্ছে।

কথা বলবে না, যা বলার আমি বলব, নিচু স্বরে ব্যাগলেকে বলল বেণন। বোর্ডওয়াকে এসে দাড়াল ওরা।

স্টেজ ড্রাইভারের হুড়োহুড়ির কারণ বোক গেল স্টেজ থেকে অপূর্ব সুন্দরী যুবতী মেয়েটা নামতেই। সোনালী চুল মস্তু খোঁপায় আটকানো, নীল একটা পোশাক পরে আছে যুবতী! ঠোঁট দুটো সরু কিন্তু পুরুষ্ট। মুখটা পানপাতার মতো। খাড়া নাক! আত্মসম্মান আছে। ঢিলেঢালা পোশাক তার খাপখোলা যৌবনকে আড়াল করতে পারেনি। পোড়া ঘিয়ের মতো গায়ের রং যুবতীর। একে দেখালে রানী ক্লিওপেট্রা রাগে-দুঃখে লোকসমক্ষে মুখ দেখানো বন্ধ করে দিত। লজ্জা হতো বিশ্বের দ্বিতীয় সুন্দরী হওয়ায়। যুবতীকে হাত ধরে নামাল সুদর্শন এক যুবক। পেটা স্বাস্থ্য তার, পরনের কাপড় বলে দিচ্ছে টাকার কোন অভাব নেই। এই দু’জনের পরে নামল মোটাসোটা বেঁটে এক লোক। তার কোটের পকেটের ওপর একটা টিনের তারা দেখে বোঝা গেল মার্শাল।

বোর্ডওয়াকে উঠল তিন যাত্রী। বেনন আর ব্যাগলেকে পাশ কাটিয়ে ব্যাঙ্কের দরজার দিকে পা বাড়াল যুবক আর যুবতী। দ্রুত পিছিয়ে ব্যাঙ্কের দরজার সামনে দাড়াল বেনন, দু’হাত দুদিকে বাড়িয়ে বাধা দিল তাদেরকে ব্যাঙ্কে ঢুকতে। তার পাশে দুর্লঙ্ প্রাচীরের মতো দাঁড়িয়ে গেল ব্যাগলে। রাস্তায় দাঁড়িয়ে কড়া চোখে বেনন আর ব্যাগলেকে দেখল মার্শাল। চেহারায় বিস্ময় চাপা দিয়ে রাখতে পারছে সে। বারকয়েক তাকাল ফাঁকা রাস্তার দিকে। শহরটা এরকম খালি খালি লাগছে কেন সেটা বুঝতে চেষ্টা করায় তার জ কুঁচকে উঠল।

আয়ত নীল চোখে বিস্ময় নিয়ে বেননের দিকে তাকাল মেয়েটা। চেহারায় অনিশ্চিত একটা ভাব।

আমি হলে ভেতরে যেতাম না, ম্যাম, মার্শালকে অগ্রাহ্য করে নিচু গলায় বলল বেনন। ভেতরে লাশ পড়ে আছে।

আশঙ্কার ছাপ পড়ল মেয়েটার সুন্দর মুখে। বেদানা রঙা গাল ফ্যাকাসে হয়ে গেল। বেননকে একরকম ঠেলে সরিয়ে ব্যাঙ্কের ভেতরে ঢুকে গেল মেয়েটা। সঙ্গের যুবক তার পেছন পেছন ঢুকল।

সবাই গেছে কোথায়? কারা তোমরা? মার্শালের ভাব দেখে মনে হলো। সামনের এই দুই ধূলিধূসরিত লোক দু’জনকেই শহর খালি হবার পেছনে দায়ী করছে সে।

বেনন জবাব দেবার আগেই ব্যাঙ্কের ভেতর থেকে তীক্ষ্ণ আর্তচিৎকার শোনা গেল। দ্রুতপায়ে বেননকে পাশ কাটাল মার্শাল, দরজার চৌকাঠে দাঁড়িয়ে ভেতরে উঁকি দিল। মেয়েটাকে মাটিতে পড়ে থাকা একটা শরীরের পাশে বসে থাকতে দেখে বুঝে নিল যা বোঝার, তারপর ঘুরে মুখোমুখি হলো বেননের। চেহারাটা ভোঁতা হলেও মার্শালের হাতটা চালু। ঝটকা দিয়ে, হোলস্টার থেকে টেনে বের করল সে প্রকাণ্ড সিক্সগান, নিষ্কম্প হাতে তাক করল বেনন আর ব্যাগলের দিকে।

গানবেল্টগুলো খুলে ফেলে দাও, আদেশ দিল গম্ভীর, ভারী গলায়। তাড়াতাড়ি হাত নাড়াতে যেয়ো না, আমি ঠাট্টা করছি না।

দু’জনের কাউকে দেখে মনে হলো না মার্শালের কথাটা কানে গেছে। চোখে করুণা নিয়ে মার্শালকে দেখল বেনন। কোন কিছু না জেনে সিদ্ধান্তে পৌঁছে যেয়ে না, বলল ও।

কোল্টটা নড়ল না একচুল। মার্শালের চেহারাতেও কোন পরিবর্তন এলো না। দৃষ্টি বলে দিল সে কি ভাবছে। সামনের এই দুজনই কুকর্মটা করেছে এব্যাপারে মনে কোন সন্দেহ নেই তার। আবার তস্কর দু’জনকে সে আদেশ দিতে যাবে এমন সময় ব্যাগলে বলে উঠল, বিশ্বাস না হয় তুমি নিজে গিয়ে দেখে এসো, লোক দুটো অন্তত চব্বিশ ঘণ্টা আগে মারা গেছে। আমাদের ট্র্যাক দেখলেও বুঝবে এই কিছুক্ষণ আগে আমরা এসেছি শহরে। অবাক হয়ে গিয়েছিলাম কেউ নেই দেখে, সেলুনে গেলাম, সেখান থেকে বেরিয়ে কারণ খুঁজতে বেরিয়ে ব্যাঙ্কে এসে দেখি এই কাণ্ড। মাত্র ব্যাঙ্ক থেকে বেরিয়েছি এমন সময়ে তোমরা এলে।

ব্যাগলের কথা শেষ হবার আগেই ব্যাঙ্ক থেকে বেরিয়ে এলো মেয়েটা। যুবক তাকে এক হাতে জড়িয়ে ধরে রেখেছে, নাহলে হয়তো পড়েই যেত যুবতী। যুবকের চেহারাতেও একই অবিশ্বাসের ছাপ দেখল নেন।

ওদের মিষ্টি কথায় কান দেয়ার কোন প্রয়োজন নেই, জেস, খানিকটা নির্দেশের সুরেই মার্শালকে বলল যুবক। কাজটা এদেরই তাতে আমার কোন সন্দেহ নেই। টাকাগুলো কোথাও লুকিয়ে রেখেছে নিশ্চয়ই। এখানে এসেছে যাতে কেউ তাদের সন্দেহ না করে। পাসি খুঁজতে বেরলে পালিয়ে পার পাবে না বুঝতে পেরেছিল নিশ্চয়ই।

যা মনে আসছে বলে যাচ্ছ তুমি, মিস্টার, আপত্তির সুরে বলল ব্যাগলে, ভাবতে চাইলে কত কিছুই ভাবা যায়। আমি যদি তোমাকে একটা ছাগল ভাবি তাহলে আমাকে ঠেকাচ্ছে কে!

বকবক থামিয়ে গানবেল্ট খুলে ফেলো, ধমক দিল মার্শাল। জেলখানায় আগে ঢোকাই, তারপর বোঝা যাবে তোমরা কি করেছ আর করোনি।

লোকটা অধৈর্য হয়ে উঠছে। ট্রিগারে আঙুলের চাপ বেড়েছে এটা লক্ষ করেছে বেনন আর ব্যাগলে, দু’জনই। কথা না বাড়িয়ে নির্দেশ পালন করল ওরা।

আমারও মনে হচ্ছে ঠিকই বলেছ তুমি, ডিলন, গানবেল্ট বোর্ডওয়াকে পড়ার পর যুবককে উদ্দেশ্য করে বলল মার্শাল তার মোটা গলায়। যুবতীর দিকে। চোখে সহানুভূতি নিয়ে তাকাল। তোমার বাবার এই দুঃখজনক পরিণতির জন্যে আমি সত্যিই দুঃখিত, মিস শার্লি। ভেবো না, আমি দেখব এই হারামী দুটো যাতে এজন্যে ফাঁসিতে ঝোলে।

চোখে চোখে কথা হলো বেনন আর ব্যাগলের। অবস্থা খারাপের দিকে যাচ্ছে। ড্রাইভার ব্যাঙ্কের ভেতরটা ঘুরে এলো। তাতে অবস্থার কোন উন্নতি হলো না। দেরি না করে এসো ওদের আমরা ঝুলিয়ে দিই, জেস, নাকি গলায় আবেদন জানাল সে। আপনি কি বলেন, মিস্টার ডিলন?

এখনও আমরা নিশ্চিত নই যে এরাই ব্যাঙ্ক ডাকাতি আর খুনগুলো করেছে, রুব, শান্ত স্বরে জবাব দিল ডিলন। তবে সেটা সম্ভবত এরাই খালি করেছে। অপেক্ষা করব আমরা, শহরের সবাই ফিরুক, যদি সিদ্ধান্ত হয় যে এরা দোষী তাহলে আমাদের কিছু করতে হবে না, ওরাই এদের ঝুলিয়ে দেবে।

তা দেবে, সায় দিল ড্রাইভার। কিন্তু কোন জাহান্নামে গেছে সবাই? সেটা বোধহয় এরা বলতে পারবে, মতামত প্রকাশ করল মার্শাল।

সুদর্শন যুবক কিছু না বলে মেয়েটার দিকে তাকাল। শার্লি তার বাবার লাশ দেখার ধাক্কা কিছুটা কাটিয়ে উঠেছে ইতিমধ্যে। শার্লির বাহুতে আলতো করে হাত রাখল ডিলন। চলো, শার্লি, তোমাকে বাড়ি পৌঁছে দিচ্ছি আমি। চিন্তা কোরো না,

আমার ওপর ছেড়ে দাও সব, এদিকটা আমি সামলে নেব।

ধন্যবাদ, লিউ, ক্লান্ত কণ্ঠে বলল শার্লি। সন্দেহের চোখে একবার দেখে নিল বেনন আর ব্যাগলেকে, তারপর ঘুরে দাঁড়িয়ে পা বাড়াল ডিলনের পাশে।

চলো তোমরা, তাড়া লাগাল মার্শাল, বেনন আর ব্যাগলেকে এগোতে ইশারা করে ড্রাইভারের উদ্দেশে বলল, অস্ত্রগুলো নিয়ে আমার পেছন পেছন আসো, রুব।

একতলা একটা বাড়িতে মার্শালের অফিস। ওটাই জেলখানা। সিক্সগান তাক করে রেখে পেছন না ফিরেই দরজার তালা খুলল মার্শাল, একপাশে সরে নিরাপদ দূরত্বে গিয়ে দাঁড়াল। তার ইশারা পেয়ে ভেতরে ঢুকল বেনন আর ব্যাগলে। ওদের পর মার্শাল ঢুকল। ড্রাইভার রুব দেয়ালে গাঁথা দুটো পেরেকে ঝুলিয়ে রাখল গানবেল্ট দুটো।

নাম কি তোমাদের! হুক থেকে চাবির একটা রিং নামাতে নামাতে জানতে চাইল মার্শাল।

আমি বেনন। রক বেনন। আর আমার সঙ্গে এ ব্যাগলে, হিরাম ব্যাগলে।

কি বললে? চোখ বিস্ফারিত হলো মার্শালের। বেনন? রক বেনন? কোন বেনন? আমাদের এই মন্ট্যানার বেনন?

ওপর নিচে মাথা দোলাল বেনন।

চোখ সরু হয়ে গেল মার্শালের। তাহলে পুরনো সেই পাপী আবার লাইনে ফিরে এসেছে! কড়া চোখে ব্যাগলেকে দেখল। সঙ্গের এটাও নিশ্চয়ই একই নর্দমার কীট?মাথা নাড়ল সে। তোমাদের কপাল খারাপ যে আমার এলাকায়। কাজ সারতে এসেছিলে।

তুমি ভাল করেই জানো যে আমাকে ক্ষমা করে দেয়া হয়েছে, বলল বেনন। বিন্দুমাত্র চিন্তিত দেখাচ্ছে না ওকে। পঞ্চোর পকেট থেকে একটা সিগার বের করে ধরাল। ধোয়া ছুঁড়ল ছাদ লক্ষ্য করে, তারপর ঠোঁটের কোনা দিয়ে বলল, আমি বিশ্বাস করি না তুমি একটা গাধা, মার্শাল। তুমি কি চাও আমি আমার ধারণা পাল্টে ফেলি? মার্শালের চোখে তাকাল বেনন। আমি দোষী হলে কখনও নিজের পরিচয় দিতাম?

ব্যাগলে মাথা দোলাল বেননের যুক্তি শুনে।

আমি জারম্যান জেস, বেনন, নামটা গুরুত্ব বহন করে এমন ভাবে ধীর গলায় বলল মার্শাল। আমার নাম শুনে থাকবে হয়তো। আজ পর্যন্ত কোন আউট ল আমাকে ফাঁকি দিতে পারেনি। অফিসের আরেকপ্রান্তে একটা দরজা। দরজাটা খোলা। খাটো একটা করিডরের পর সেলের শিক দেখা যাচ্ছে। অস্ত্রের মুখে করিডরে ওদের নিয়ে এলো মার্শাল, সেলের দরজার দিকে ইঙ্গিত করল। অনেক সময় নষ্ট হয়েছে, এবার ভেতরে ঢোকো।

পিচুটি ভরা চোখে প্রশংসা নিয়ে মার্শাল জেসের কথায় সায় দিয়ে মাথা দোলাল ড্রাইভার রুব, মার্শাল চাবি দিতেই এগিয়ে গিয়ে সেলের দরজার তালা। খুলে দরজা মেলে ধরল। তাকে সরে যেতে বলল মার্শাল, বেনন আর ব্যাগলেকে ঢুকতে বলল সেলের ভেতরে। নির্দেশ পালন করে পিছিয়ে সরে গেল রুব। আইগুই না করে ভেতরে ঢুকল বেনন আর ব্যাগলে। পেছনে দড়াম করে দরজাটা। বন্ধ করে দিয়ে ছিটকিনি আটকাল জেস, হোলস্টারে অস্ত্রটা রেখে রুবের কাছ থেকে চাবি নিয়ে তালায় ঢোকাল লক করার জন্যে, পর মুহূর্তে জমে গেল মূর্তির মতো। ঘুরে দাঁড়িয়েছে বেনন, শিকের ফাঁক দিয়ে ছোট্ট ডেরিঞ্জারটার নল ঢুকিয়ে গুঁতো দিয়েছে মার্শালের ভুড়িতে। পেটের দিকে তাকিয়ে ডেরিঞ্জারের নলটাকে কামানের নল বলে মনে হলো মার্শালের, বেননের চোখে শীতল চাহনি বুকে কাপ ধরিয়ে দিল।

দরজাটা খোলো, নাহলে থলথলে হুঁড়ি ফুটো হয়ে যাবে, হুঁশিয়ার করল বেনন।

আরেকবার বলো, বলল ব্যাগলে, ওর গুবরে পোকার সমান মগজে কথাটা ঢুকেছে কিনা কে জানে! ঢুকেছে তাতে সন্দেহ নেই কোন। কাঁপা হাতে ছিটকিনি খুলল মার্শাল জেস। দরজা ঠেলে বেরিয়ে এলো বেনন, লোকটাকে পিছিয়ে যেতে বাধ্য করল। বেননকে পাশ কাটিয়ে অফিসে চলে এলো ব্যাগলে, পেরেক থেকে গানবেল্ট দুটো খসিয়ে নিজেরটা পরে নিল ব্যস্ত হাতে, বেননেরটা পরিয়ে দিল বেননকে। সিক্সগান বের করে ড্রাইভারের দিকে চোখ গরম করে তাকাল ব্যাগলে। ঝুলিয়ে দেয়া উচিত, না?

কি যেন বলতে চাইল রুব, গলা দিয়ে শুধু গোঁ-গোঁ আওয়াজ বেরল।

ভেবো না পালাতে পারবে তোমরা, শাসানোর সুরে বলে উঠল জারম্যান। এই কাউন্টি ছেড়ে বেরনোর আগেই ধরা পড়তে হবে।

তোমরা হোট শহরের মার্শালরা সব একই রকম, আফসোস করে মাথা নাড়ল বেনন। প্রমাণ ছাড়াই যাকে তাকে ধরে বসো অপরাধী মনে করে।

জবাব দিল না জারম্যান, মনে মনে নিজেকে শাপান্ত করল, বন্দিদের সার্চ না করে বিরাট একটা ভুল করেছে সে কাজে।

আমরা এই কাউন্টিতে থাকব নাকি চলে যাব সেটা আলাদা ব্যাপার, জারম্যান, বলল বেনন। তবে যদি চলে যেতে চাই তাহলে তোমার সাধ্য নেই ঠেকাও। আমার মনে হয় তোমার উচিত রলিন্সে শেরিফ মায়ার্সের সঙ্গে যোগাযোগ করা, তাহলেই তোমার ধারণা পাল্টে যাবে। বুঝতে পারবে যে আমরা কোন অপরাধ করিনি। মায়ার্স আমাদের ভাল মতোই চেনে।

ভাল লোকের নাম বলেছ! তিক্ত সুরে বলল জারম্যান। কয়েক সপ্তাহ আগে অ্যাম্বুশে মারা গেছে সে। চোখ সরু করল মার্শাল। কে জানে, তোমরাই হয়তো তার হত্যাকারী।

এ তো খামোকা একের পর এক দোষ চাপিয়ে দিচ্ছে! রেগে গেল ব্যাগলে। বেননের দিকে তাকাল, চোখ চকচক করছে শয়তানিতে। দেব নাকি ব্যাটার পাছায় জোরসে একটা লাথি কষিয়ে, মগজটা নড়ে উঠবে, তাতে বুদ্ধি খুলতে পারে। লোকটার।

হয়তো কাজ হতো, ধীরে বলল বেনন, কিন্তু আমার ধারণা পাছার বদলে মগজটা ওর পায়ের বুড়ো আঙুলে।

আমি যাচ্ছি ঘোড়া আনতে, কথা না বাড়িয়ে দরজার দিকে পা বাড়াল ব্যাগলে। এব্যাটা যখন মানবেই না যে আমরা নির্দোষ, তো সরে পড়া যাক।

নীরবে মাথা দোলাল বেনন।

মার্শালের অফিস থেকে বের হয়ে বোর্ডওয়াক থেকে নামার সময় শহরের শেষ প্রান্ত থেকে ডিলনকে আসতে দেখল ব্যাগলে। পাত্তা না দিয়ে ক্যাসিনো। সেলুনের দিকে চলল ও। সেলুনের হিচরেইলের সামনে শান্ত হয়ে দাড়িয়ে আছে ঘোড়া দুটো। সময় নিয়ে দড়ি খুলল ব্যাগলে, ডিলনকে পাশে আসার সুযোগ করে দিল।

মনে হচ্ছে জেসকে বোঝাতে পেরেছ যে তোমরা খুনি নও, সাইডওয়াকে দাঁড়িয়ে পড়ে মন্তব্য করল ডিলন।

তোমার গায়ে পড়া ভাবটা আমার পছন্দ হচ্ছে না, বন্ধু। গোঁফে তা দিল ব্যাগলে। মার্শালকে আমরা কি বুঝিয়েছি তাতে তোমার এত কি?

ডিলনের ধূসর চোখ সরু হয়ে গেল, মুখটা দেখে মনে হলো পাথর কেটে তৈরি। পা ফাঁক করে গানম্যানদের মতো দাঁড়াল লোকটা। শান্ত, ভাব-বিবর্জিত গলায় বলল, টুইন স্প্রিংসের সব কিছুতেই আমার স্বার্থ জড়িয়ে আছে।

কারণটা কি, বন্ধু? ব্যাগলে একেবারেই অবিচল। দরকার পড়লে মুহূর্তের মধ্যে সিক্সগান বের করতে পারবে।

এই শহরটা ডিলনরা তৈরি করেছে, মিস্টার, ডিলনদের টাকাতেই এই শহর চলে।

তার মানে এই নয় যে তুমিই এই শহরের আইন। গায়ে পড়ে লাগতে আসার কোন অধিকারও কেউ দেয়নি তোমাকে।

এক সেকেন্ডের জন্যে মনে হলো ড্র করতে যাচ্ছে ডিলন। দেরি না করে থাবা দিয়ে সিক্সগান বের করে আনল ব্যাগলে, তারপর দেখল শরীরে ঢিল দিয়ে দাঁড়িয়েছে ডিলন, চোখে টিটকারি খেলা করছে। এবার, এই এতক্ষণ পর সতর্ক হবার প্রয়োজনীয়তা অনুভব করল ব্যাগলে। তার চিনতে ভুল না হলে সামনে দাড়ানো এই লোকটা অত্যন্ত বিপজ্জনক একজন।

তুমি বোধহয় ভাবো অস্ত্রে তোমার হাত যথেষ্ট চালু, শান্ত স্বরে বলল ডিলন। ধারণাটা পাল্টে ফেলো। আমি যদি ড্র করতাম, এতক্ষণে রাস্তায় পড়ে থাকত তোমার লাশ। হয়তো ড্র আমি করবও, যদি প্রমাণ পাই যে তুমি আর তোমার দোস্ত মিলে রাল্যান্ডের খুনটা করেছ।

অজান্তেই একটা ঢোক গিলল ব্যাগলে। রেগে গেল অস্বস্তি বোধ করছে। বলে। অস্ত্রষ্টা নেড়ে হুকুম দিল, গানবেল্টটা খুলে হাত উঁচিয়ে দাঁড়াও। বাকল খোলার সময় আস্তে হাত নাড়বে। যদি তাড়াহুড়ো দেখি তো গুলি করে পরে জানতে চাই কারণটা।

দেহের পেশি শক্ত হয়ে গেল ডিলনের, কিন্তু ব্যাগলের নির্দেশটা পালন করল সে। লাথি দিয়ে দূরে সরিয়ে দিল গানবেল্ট। ওটা তুলে নিল ব্যাগলে, ডিলনকে বোর্ডওয়াক ধরে আসতে ইশারা করল। ঘোড়া দুটোর দড়ি ধরে নিয়ে চলল জেল হাউজের দিকে।

ও জেলখানার সামনে যাবার আগেই মার্শাল আর ড্রাইভারকে অস্ত্রের মুখে নিয়ে ভেতর থেকে বেরিয়ে এলো বেনন। বোর্ডওয়াকে থমকে দাঁড়িয়ে ওদেরকে দেখল ডিলন, নিচু স্বরে বলল, আচ্ছা, এই তাহলে ব্যাপার!

ওরাই খুনী, কোন সন্দেহ নেই, মতামত জানাল মার্শাল। চোখের ইশারায়। বেননকে দেখাল। এ মন্ট্যানার কুখ্যাত দস্যু রক বেনন। সঙ্গেরটাও পাক্কা হারামি।

কতদূর যাবে, বলল ডিলন। আমার ধারণা দু’দিনের বেশি লাগবে না ওদের ধরে ঝুলিয়ে দিতে।

হয়তো তাই, জবাব দিল ব্যাগলে। কিন্তু একটা কথা মনে রেখো, আমরা যদি ফাঁসিতে ঝুলি তা দেখার ভাগ্য তোমার হবে না।

রাস্তায় পা রেখে ঘোড়ার দড়ি ধরল বেনন। অস্ত্রের নল এখনও মার্শালের। দিকে। পরস্পারের মধ্যে দৃষ্টি বিনিময় হলো বেনন আর ব্যাগলের। মাথা দোলাল ব্যাগলে। ওরা দুজন স্যাডলে উঠতে যাবে এমন সময় শুনতে পেল ঘোড়ার খুরের আওয়াজ। রাস্তা ধরে দ্রুত এগিয়ে আসছে ঘোড়াটা। বন্দিদের চোখে নতুন আশার আলো দেখতে পেল বেনন। ডিলনের চেহারায় ঘৃণা, নিষ্ঠুরতা খেলা করছে।

<

Super User