সেলুনে ঢোকার সময় পোস্টারটা দেখতে পেল সে। ব্যাটউইং দরজার একপাশে দেয়ালের সাথে সাঁটা, ইদানীং লাগানো হয়েছে। ল-অফিসের ওয়ান্টেড পোস্টারের মত হলদেটে বা মলিন নয় ওটা। বিষয়বস্তুও একটু ভিন্ন রকমের। থমকে গিয়ে দাঁড়িয়ে পড়ল সে, চোখ বুলাল লেখাগুলোয়। জেরেমি টাউন নামের শহরে একজন মার্শাল দরকার, বেতন আলোচনা সাপেক্ষ।

শহরটার কথা সে শুনেছে। মাত্র কয়েকদিন হলো ওটার জন্ম। পাহাড়ে সোনার সন্ধান পেয়েছিল খেয়ালী এক প্রসপেক্টর, সেই থেকে কয়েকদিনের মধ্যে গড়ে উঠেছে। চারপাশ থেকে লোকজন ছুটে গেছে ওখানে-কেউ সোনার আশায়, কেউ ব্যবসা করতে; তাদের সাথে খারাপ কিছু লোকও জুটেছে। এরকম খনিশহরে খারাপ লোকেরাই জুড়ে বসে। সোনা এমন এক জিনিস যা মানুষের বিবেককে দমিয়ে রাখে-লোভ, ঈর্ষা আর অপরাধের জন্ম দেয়।

আরও শুনেছে স্যামুয়েল কিনকেড, কার্ট রক্স, শেইন থমসন সহ বেশ কয়েকজন কুখ্যাত লোক জেরেমি টাউনের উদ্দেশে রওনা দিয়েছে। ওরা সেখানে বসতি করতে বা সৎ উদ্দেশে যাচ্ছে না, অ্যারিজোনার এদিকের খবর যেসব লোক কিছু না কিছু রাখে তারা সবাই জানে এ সত্যটি। কিনকেড বা রক্সের মত লোকদের কাছ থেকে সততা বা দ্ৰতা আশা করা যায় না। যেটা ওদের পছন্দ হয় আপসে না পেলে কেড়ে নেয়, খুন করতেও পিছ-পা হয় না। যেখানেই আইনের হাত দুর্বল সেখানে জুড়ে বসে ওরা, জবরদখল আর লুঠপাট শেষে নতুন কোন শহর বা জনপদের উদ্দেশে ঘোড়া ছোটায়।

পোস্টারের ওপর থেকে চোখ সরিয়ে দরজার দিকে এগোল সে। জেরেমি টাউনের কি হলো বা না-হলে তাতে কিছুই আসে-যায় না ওর। ব্যাটউইং দরজা ঠেলে ভেতরে ঢুকে পড়ল আগন্তুক, অনুসন্ধানী দৃষ্টি চালাল সারা ঘরে। একপাশে দীর্ঘ বারের পেছনে দুজন বারকীপকে দেখতে পেল। ছড়ানো-ছিটানো অনেকগুলো টেবিল-চেয়ার। দেয়ালের কোণে আয়না লাগানো, ইচ্ছে করলে সরাসরি না তাকিয়েও ঘরের যে কারও ওপর নজর রাখা যাবে। পাশে কাচের দেয়াল, লবিটা বার থেকে আলাদা করা। খাওয়ার ব্যবস্থা আছে ওখানে।

মাথা থেকে হ্যাট সরিয়ে চুলে আঙুল চালাল ও, বারের দিকে এগোল। লম্বা পথ পাড়ি দিয়েছে, সারা দিন চলার ফলে গলায় ধূলি আটক খরখরে হয়ে আছে। চুপসে যাওয়া পেটের ব্যবস্থা করার আগে একটা ড্রিঙ্ক দরকার। গলাটা তাতে পরিষ্কার হবে। বারের সামনে টুলের সারির একটায় বসে হুইস্কির ফরমাশ দিল ও। ড্রিঙ্ক আসার পর চুমুক দিয়ে চারপাশে তাকাল আবার। একটা টেবিলে, পোকার খেলা চলছে, কাছে দাঁড়িয়ে দেখছে দুজন লোক। দুটো ভিন্ন টেবিলে বসে গলা ভেজাচ্ছে আরও পাঁচজন।

অনেক দূর থেকে এসেছ বোধহয়? হালকা সুরে জানতে চাইল এক বারকীপ।

মৃদু নড করল সে। হুইস্কিতে আগ্রহ বেশি।

জেরেমি টাউনে যাচ্ছ নাকি?

তাই মনে হচ্ছে তোমার?

দক্ষিণ থেকে এসেছ তুমি। হয় এখানে থাকছ অথবা সামনে এগোবে। বিগ বে-র পর ট্রেইল তো একটাই, আর সেটা জেরেমি টাউনে গেছে।

আমি আরও দূরে যাব, পাহাড় ছাড়িয়ে।

ওদিকে বসতি আছে? কখনও শুনিনি তো!

শেষ চুমুক দিয়ে বারের ওপর গ্লাস নামিয়ে রাখল আগন্তুক, পকেট থেকে খুচরো পয়সা বের করে বিল মেটাল।

নোটিশটা দেখেছ? উঠতে যাবে এ সময়ে জানতে চাইল বারকীপ।

নড করল সে, চোখে প্রশ্ন ফুটে উঠেছে।

এ পর্যন্ত তিনজন মার্শাল নিয়োগ করেছে ওরা। দুরাতের বেশি টিকতে পারেনি কেউ। থমসনের দলবল যেখানে আছে সেখানে কোন মার্শাল টিকে থাকে কেমন করে? নরক-গুলজার অবস্থা শহরটার। সন্ধ্যার পর হাঙ্গামা, গোলাগুলি শুরু হয়ে যায়। শুনলাম কিনকেডও রওনা দিয়েছে।

হয়তো।

তোমাকে দেখে মনে হচ্ছে ওগুলো ভালই চালাতে পারো, পিস্তলের দিকে ইঙ্গিত করে বলল বারকীপ। হয়তো ওখানে গেলে সমাদর পাবে।

আগ্রহ নেই, বলে দরজার দিকে এগোল আগন্তুক।

পেছন থেকে ওকে দেখল বারকীপ, যুবকের নিস্পৃহ আচরণে অবাক হয়েছে। পশ্চিমে নতুন শহর যে কোন আগন্তুকের কাছে চ্যালেঞ্জ, ধাধা বিশেষ। বিগ বে থেকে জেরেমি টাউন তিন দিনের পথ, কিন্তু সব খবরই আসে এখানে। শহরটা সম্পর্কে দারুণ কৌতূহলী এখানকার সবাই, এমনকি বিগ বে-র বাসিন্দা নয় এমন লোকওঁ। অথচ বিন্দুমাত্র আগ্রহ দেখায়নি আগন্তুক।

দরজা দিয়ে বেরিয়ে যাওয়া দীর্ঘ কাঠামোর দিকে তাকাল বারকীপ-সুঠাম পেশীবহুল শরীর, হাঁটার মধ্যে দৃঢ়তা প্রকাশ পাচ্ছে। সবার আগে অবশ্য ঊরুতে নিচু করে বাঁধা জোড়া পিস্তলের ওপর নজর পড়বে যে কারও। আলাদা দরজা দিয়ে আগন্তুককে লবিতে ঢুকতে দেখল সে। নির্লিপ্ত দেখাচ্ছে তাকে, কোন দিকেই তাকাচ্ছে না। ওঅশ বেসিনে হাত-মুখ ধুয়ে একটা টেবিলে বসে পড়ল, ওয়েট্রেস আসতে খাবারের ফরমাশ দিল। খাওয়ার দিকে ওর মনোযোগ দেখে বারকীপ ধারণা করল লোকটা বেশ ক্ষুধার্ত ছিল। আয়েশ করে খাচ্ছে সে।

বাড়ি ফিরতে সবারই ভাল লাগে, ভাবছে আগন্তুক, তারও লাগছে। এবার অবশ্য দীর্ঘ সময় পর, প্রায় তিন বছর বাদে ফিরছে। শেষবার যখন এসেছিল, এই শহরটা ছিল একেবারে নতুন। কয়েকটা জীর্ণ শ্যাক, একটা সেলুন আর স্টোর ছিল শুরুতে। তিন বছরে বেশ বড় হয়ে উঠেছে বিগ বে। লোকের সমাগমও ঘটেছে।

টেবিলের ওপর ছাইদানিতে সিগারেট গুঁজে রাখার সময় দরজার দিকে ফিরে তাকাল সে, চল্লিশোর্ধ্ব এক লোক আর একটা মেয়ে ঢুকছে। পরনের কাপড়ে ধুলোর ছাপ, দীর্ঘ পথ পাড়ি দেয়ার কারণে চোখে-মুখে ক্লান্তি। কিছুটা অধৈর্য দেখাচ্ছে লোকটিকে, চোখে অস্থির দৃষ্টি। হাত-মুখ ধুয়ে এসে বসল মেয়েটির উল্টোদিকে। তারপর ওয়েট্রেস কাছে যেতে খাবারের ফরমাশ দিল।

মেয়েটির দিকে তাকাল আগন্তুক। দ্বিতীয়বার তাকানোর মত মেয়ে বটে! রূপ উপচে পড়ছে না তবে কমনীয় সৌন্দর্যের স্ফুরণ ঘটেছে ওর মধ্যে। রঙজ্বলা মসৃণ ত্বক। লম্বা, আকর্ষণীয় ফিগার। বিষণ্ণ দেখাচ্ছে ওকে, হয়তো যাত্রার ক্লান্তির কারণে; কিংবা এতগুলো পুরুষের কৌতূহলী দৃষ্টির কেন্দ্রবিন্দু হয়ে পড়ায়, আয়ত নীল দুই চোখে অপ্রতিভ দৃষ্টি দেখে তাই মনে হলো আগন্তুকের।

এ এলাকায় নতুন এসেছে ওরা, একরকম নিশ্চিত সে। হয়তো জেরেমি টাউনই ওদের গন্তব্য।

ওয়েট্রেস পাশ দিয়ে যেতে আরেক কাপ কফির ফরমাশ দিল সে। কফি আসার পর চুমুক দিল, তারপর দরজায় চোখ পড়তে ক্ষীণ সতর্কতার ছাপ পড়ল ওর মুখে। যে লোকটা ঢুকছে তাকে চেনে, জেসি ওয়েন। লম্বা তাগড়া শরীর পাকানো দড়ির মতই মজবুত, পেশীবহুল। ঊরুর হোলস্টারে চকচকে বাটের জোড়া পিস্তল। লম্বা আঙুলগুলো সবসময় কোমরের কাছে থাকছে, এমনকি হাটার সময়েও। পিস্তলে দারুণ চালু জেসি ওয়েনের হাত, বিদ্যুৎ গতিতে ড্র করতে সক্ষম। নিশানাও নিপুণ। হাঁটার মধ্যে আত্মবিশ্বাস ঠিকরে পড়ছে। বেপরোয়া এবং উদ্ধত একটা ভাব আছে ওয়েনের মধ্যে, সহজে বোঝা যায় না। কাউকে পরোয়া করে না এ লোক। কারণও আছে। অ্যারিজোনার এ প্রান্তে প্রথম সারির বন্দুকবাজ হিসেবে তার খ্যাতি।

জেসি ওয়েন, এখানে এসেছে কেন, প্রশ্নটা খোঁচাচ্ছে ওকে। জেরেমি টাউনে যাবে? এটাই স্বাভাবিক। চেহারা-সুরতে অবশ্য ওকে সাধারণ লোক বলে মনে হয়, কেউ ধরতে পারবে না বহু অপরাধের হোতা সে। সুদর্শন, বাকপটু; আচরণ আর পোশাকে ভদ্রলোক। স্বার্থ ছাড়া কোথাও যায় না সে, এবং এখানেও তার ব্যতিক্রম হয়নি, ওয়েনকে যুবতী আর মাঝবয়সী লোকটার সঙ্গে যোগ দিতে দেখে ভাবল আগন্তুক। দেয়ালের আয়না থেকে চোখ সরিয়ে নিল ও। ওয়েন এদের কি ক্ষতি বা উপকার করল তাতে কিছুই আসে-যায় না ওর।

তবে এটা ঠিক, নিজের এলাকা ছেড়ে বহু দূর চলে এসেছে ওয়েন, এবং সচরাচর বড়সড় কোন লাভের আশায় থাকলে এতটা পথ পাড়ি দেয় সে। তাতে তোমার কি? নিজেকে শাসন করল আগন্তুক, শুধু শুধু অন্যের ব্যাপার নিয়ে ভাবছ। কারণটা নিজেই আবিষ্কার করল, আসলে বয়স্ক ভদ্রলোক আর ওই মেয়েটি যে ওয়েনের অসহায় শিকারে পরিণত হতে যাচ্ছে এ ব্যাপারে বিন্দুমাত্র সন্দেহ নেই ওর। হলফ করে বলতে পারবে এদের দুর্বলতার সুযোগ নেবে ওয়েন, হয়তো মেয়েটাকে পটিয়ে ফেলবে, কিংবা…গোল্লায় যাক জেসি ওয়েন!

লম্বা চুমুক দিয়ে কফি শেষ করল সে, তারপর বিল মিটিয়ে বেরিয়ে এল।

পোর্চে দাঁড়িয়ে চোখ কুঁচকে রাস্তার দিকে তাকাল ও। রৌদ্রোজ্জ্বল একটা দুপুর। দীর্ঘ রাস্তার কোথাও লোকজন দেখা যাচ্ছে না। রাস্তায় বেরিয়ে অযথা কে-ই বা গ্রীষ্মের কাঠ-ফাটা রোদে সিদ্ধ হতে চায়! হিচিং রেইলে বাঁধা গ্রুলার দিকে এগোল আগন্তুক, লাগাম ছাড়িয়ে স্যাডলে চেপে বসল। হ্যাটের কার্নিস আরও নিচে নামিয়ে দিয়ে চোখ আর কপালকে রোদের আঁচ থেকে আড়াল করল সে, তারপর চওড়া বিধ্বস্ত রাস্তা ধরে পশ্চিমে এগোল। গুটি কয়েক দালান চোখে পড়ছে এদিকে, বেশিরভাগই আবাসিক বাড়ি। একটা গলির মুখে এসে পড়তে চোখে পড়ল ব্যাপারটা। অন্তত ছয়টা ওয়্যাগন দাড়িয়ে আছে রাস্তার একপাশে, আশপাশে বেশ কিছু লোক দেখা যাচ্ছে, বাচ্চা আর মহিলাও আছে। অপেক্ষা করছে ওরা। হয়তো জেরেমি টাউনে যাচ্ছে এ দলটাও, ভাবল সে।

এই, ভ্যান, দাঁড়াও! পেছন থেকে চেঁচাল কেউ।

ঘোড়ার রাশ টানল ও, পেছনে ঘুরল।

বিশালদেহী এক লোক দৌড়ে আসছে। কাছে আসার পর দেখা গেল রীতিমত হাঁপাচ্ছে সে, নিঃশ্বাসের সাথে ওঠা-নামা করছে প্রশস্ত বুক। ঝকঝকে সাদা দাঁতের সবগুলো বেরিয়ে পড়ল হাসির সাথে। কি খবর, ড্যান?

নড করে ভাল বোঝাতে চাইল আগন্তুক, নির্বিকার মুখে দেখল লোকটিকে। থলথলে মুখ, সর্বত্র চর্বির আধিক্য। লম্বায় ছয় ফুট হবে, চওড়ায়ও তেমনি। বিশালদেহী হ্যান্স কোবার্নকে চেনে সে। মন্টানার সোনা ব্যবসায়ী। হাসলে সুদর্শন দেখায় ওকে, ধূসর চোখ জোড়ায় বন্ধুত্বপূর্ণ চাহনি।

জেরেমিতে যাচ্ছি, বড়সড় একটা চালান আছে, নিজ থেকে বলল ব্যবসায়ী। তোমাকে পেয়ে ভালই হলো। কে জানত যার খোঁজে দুনিয়া তোলপাড় করতে বাকি রেখেছি বিগ বে-তে এসে তাকেই পেয়ে যাব! আমার চিঠি পাওনি?

মাথা নাড়ল ড্যান গত দুমাস চলার মধ্যে আছি।

অ। আর আমি কিনা ভেবেছি প্রস্তাবটা তোমার পছন্দ হয়নি। পায়ের ভর বদল করল সে। এসো, আমার বাগিতে চলো, একসাথে পান করা যাক। বহু দিন পর দেখা হলো। তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে ড্যানকে দেখল সে, যুবকের মধ্যে কোন আগ্রহ আছে কিনা বোঝার চেষ্টা করছে। তাছাড়া…আমরা বোধহয় ব্যবসা নিয়েও আলাপ করতে পারি, অন্তত আমার তাই ধারণা।

ওসব নিয়ে ভাবছি না আমি, নিস্পৃহ কণ্ঠে বলল ও।

রসো! না শুনেই খেপে যাচ্ছ কেন? আমি তো তোমাকে প্রস্তাব দেইনি এখনও। আগে তো আমার বাগিতে দশটা মিনিট কাটিয়ে যাও। মেরী আছে। ঘুরে উল্টোদিকে হাঁটতে শুরু করল সে।

খানিক কি যেন ভাবল ড্যান, তারপর স্যাডল ত্যাগ করে ঘোড়ার লাগাম হাতে সোনা ব্যবসায়ীর পেছন পেছন এগোল। ষাট গজ দূরে প্রথম বাগিটাই হ্যান্স কোবার্নের। ওটার পেছনে এসে মিসেসকে ডাকল সে। পাটাতনে উঠে পর্দা সরিয়ে আহ্বান করল ড্যানকে।

বাগির দেয়ালের আটার সঙ্গে ঘোড়াকে পিকেট করল ড্যান, তারপর ওপরে উঠে এল। ভেতরে অপরিসর জায়গা, কিন্তু তাতেই সংসার গুছিয়ে নিয়েছে ওরা। দরকারী জিনিসপত্র সব গুছিয়ে রাখা, টুকিটাকি ছাড়াও একটা স্টোভ রয়েছে এক কোণে; মাঝখানে ছোট্ট একটা টেবিল, পাশে দুটো চেয়ার। মিসেস কোবার্নকে ওপাশে দাড়িয়ে থাকতে দেখে টুপি খুলে নড করল ও। ক্ষীণ হাসল মহিলা, স্বামীর মতই স্বাস্থ্যবতী। হাসিখুশি।

অনেকদিন পর, তাই না, ড্যান?

তোমাদের ওদিকে যাওয়া হয়নি ইদানীং,মাথা ঝাঁকিয়ে ব্যাখ্যা দিল সে।

আসলে ইচ্ছে হয়নি তোমার, চাপা স্বরে অভিযোগ করল মেরী কোবার্ন। কোণের অপরিসর জায়গায় থালা-বাটি নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়ল, একটু পর দুটো থালায় আপেল-পাই পরিবেশন করল।

জেরেমিতে যাচ্ছ? জানতে চাইল ড্যান।

চামচে করে অনেকটা পাই মুখে পুরেছে কোবার্ন, সেই অবস্থায় মাথা ঝাঁকাল। ঢোক গিলে খাবার চালান করে দিল পাকস্থলীতে, তারপর বলল, চালানটা বেশ বড়সড়, প্রায় দুই লাখ ডলারের সোনা, থেমে হাতের চেটো দিয়ে মুখ মুছল সে, খেই ধরল এরপর: আমার আশঙ্কা হচ্ছে হয়তো লুঠ করার চেষ্টা করবে কেউ। কাউন্টির সব খারাপ লোক গিয়ে জড়ো হয়েছে জেরেমি টাউনে… থমসন, কিনকেড, রক্স তো আছেই, শুনেছি নেইল ডেভিসও আস্তানা গেড়েছে শহরের আশপাশে। জানোই তো এমন সুযোগ কখনও ছাড়ে না ও। সেজন্যেই তোমার সঙ্গে যোগাযোগ করার চেষ্টা করেছি। কিন্তু উত্তর না পেয়ে ভাবলাম ইচ্ছে নেই তোমার।

শূন্য থালা টেবিলের ওপর নামিয়ে রেখে সোনা ব্যবসায়ীর দিকে তাকাল। ড্যান, আগ্রহের ছিটেফোঁটাও নেই ওর মুখে, একেবারেই নির্বিকার দেখাচ্ছে। ভেতরে ভেতরে দমে গেল হ্যান্স কোবার্ন, ভেবেছিল ওর বিপদের কথা শুনে কিছুটা হলেও নরম হবে সে।

টাকা ছড়ালে যোগ্য লোকের অভাব হয় না, দার্শনিক সুরে মন্তব্য করল ড্যান।

যোগ্য লোক? কিন্তু ড্যান, শুধু যোগ্য লোক হলে তো চলবে না, তাকে একইসঙ্গে বিশ্বস্তও হতে হবে। দুই লাখ ডলার চাট্টিখানি ব্যাপার নয়। তোমার উত্তর না পেয়ে মন্টানা থেকে দুজনকে ভাড়া করেছি, কিন্তু ওই যে বললাম, ওদের ওপর আস্থা বা বিশ্বাস কোনটাই রাখতে পারছি না।

তোমাকে পেলে নিশ্চিন্ত হতে পারতাম। ড্যানি লসন স্টেজগার্ডের দায়িত্বে থাকবে জানলে স্টেজ লুঠ করার আগে হাজারবার চিন্তা করবে রক্স বা কিনকেডরা। কিন্তু কি আর করা! অসহায় একটা ভঙ্গি করল সোনা ব্যবসায়ী, উঠে গিয়ে দেয়ালে ঝোলানো কাবার্ড থেকে হুইস্কির বোতল আর গ্লাস বের করল। পানীয় ঢেলে অফার করল লসনকে। ব্যস্ত না থাকলে আমার কাজটা নিতে পারো, ড্যান। ফী নিয়ে তোমার সঙ্গে কখনও দুকথা হয়নি আমার। যোগ্য লোকের কদর বুঝি আমি, সমাদরও করি।

হুইস্কিতে চুমুক দিল ড্যানি লসন। কিছুদিন হলো ছেড়ে দিয়েছি এসব, হ্যান্স। ঝামেলা বেশি এ কাজে।

দুঃসংবাদ, অন্তত আমার জন্যে, বিরস মুখে মন্তব্য করল কোবার্ন।

জেরেমি টাউন তেতে আছে এখন। মেরীকে নিয়ে ওখানে যাওয়া বোধহয় ঠিক হচ্ছে না তোমার।

আমি এমনিতেই যেতাম। মেরী জেদ ধরল ও-ও আসবে, অগত্যা… কাঁধ উঁচিয়ে স্ত্রীর দিকে তাকাল সে। বরাবরই সাহস বেশি ওর। এমনকি আমার চেয়েও।

তবুও…শহরটার পরিস্থিতি ভাল নয়। এটা অবশ্য শোনা কথা।

বাদ দাও, হওয়ার হবে! তুমি যাচ্ছ কোথায়?

ওদিকেই।

তাহলে একসঙ্গেই যেতে পারি আমরা?

উঁহু, তোমাদের বোধহয় আরও দেরি হবে।

কাল সকালে রওনা দিচ্ছি আমরা। একদিন বিশ্রাম নেব এখানে।

ওরা কারা? বাইরের ওয়্যাগন সারির দিকে ইঙ্গিত করল লসন।

বিভিন্ন দিক থেকে এসেছে, বেশিরভাগই আনাড়ি লোক। কয়েকজন আছে পশ্চিমে একেবারে নতুন। সবাইকে গাইড করছে জেসি ওয়েন। আর লোক পেল

ওরা! স্বীকার করছি এরকম একটা রাইডের নেতৃত্ব দেওয়ার ক্ষমতা আছে ওর, তবে ওকে বিশ্বাস করা কঠিন, এটাই হচ্ছে যত চিন্তার ব্যাপার।

নীরবে হুইস্কিতে চুমুক দিল লসন।

লারকিন হাঁদাটা ওর যুবতী মেয়েকে নিয়ে এসেছে। বোকা আর কাকে বলে? এমন জায়গায় কেউ অমন সুন্দরী মেয়েকে নিয়ে যায়? সোনার স্বপ্নে বিভোর, জেরেমি টাউনে গিয়ে মাটি খুঁড়ে বস্তায় বস্তায় সোনা তুলবে! আরে বাবা, তোমার জন্যে কেউ বাকি রেখেছে কিছু? শহরের চৌহদ্দিতে যত জায়গা ছিল সবই ক্লেইম করে ফেলেছে লোকজন। জবরদখলের কয়েকটা ঘটনাও ঘটেছে। ব্যাটাকে বুড়ো আঙুল দেখাবে জেসি ওয়েন। এরই মধ্যে মেয়েটার পেছনে লেগেছে হারামজাদা!

যার সমস্যা তাকেই ভাবতে দাও, মৃদু অসন্তোষ প্রকাশ করল মেরী। তোমার নিজেরই কম নেই এ মুহূর্তে।

ওদের জন্যে করুণা হচ্ছে। লারকিন আর ওর মেয়ে দুজনেই পশ্চিমে নতুন। ওয়েন ওদের সর্বনাশ করে ছাড়লে একটুও অবাক হব না।

তুমি শুধু সমালোচনাই করছ, অভিযোগ করল মেরী। পারলে ওদের সাহায্য করো, নইলে মুখ বন্ধ রাখো।

এদের সাথে ভিড়লে কিভাবে? প্রসঙ্গ পাল্টাল লসন।

ভেবে দেখলাম লম্বা পথ পাড়ি দিতে হবে, কখন কোন বিপদ আসে তার ঠিক আছে? সাথে লোকজন থাকলে মন্দ হয় না। এই দলটা তখন রেডরক থেকে রওনা দিচ্ছিল, ভিড়ে গেলাম ওদের সঙ্গে। এ জন্যে অবশ্য ওয়েনকে বিশ ডলার

ফী দিতে হবে।

মিসেস কোবার্নকে নড করে উঠে দাঁড়াল ড্যানি লসন, ধন্যবাদ দিয়ে বেরিয়ে এল বাইরে। প্রথমেই খেয়াল করল পেছনের ওয়্যাগনের কাছাকাছি দাঁড়িয়ে সিগারেট ফুকছে, দুজন। নিরাসক্ত দৃষ্টিতে ওকে দেখল লোকগুলো, ওর পিস্তলের ওপর নজর আটকে থাকল কয়েক সেকেন্ড, তারপর নিচু স্বরে নিজেদের মধ্যে গল্প জুড়ে দিল।

এরা? জানতে চাইল লসন।

পাশে এসে দাঁড়িয়েছে ব্যবসায়ী, আনমনে মাথা ঝাঁকাল। বিশ্বাস করা যায় এমন লোক পাওয়া কঠিন, ড্যান।

তারমানে তুমি নিজেই ওদের বিশ্বাস করছ না?

একবিন্দুও না।

ওখানে কি প্রচুর সোনা পাওয়া গেছে?

বিস্তর। এতবড় খনির কথা আমি কখনও শুনিনি।

এবং ঝামেলাও বেশি হবে, মন্তব্য করল ও।

দয়া করে প্রস্তাবটা ভেবে দেখবে? অনুরোধ করল কোবার্ন।

মাথায় টুপি চাপাল লসন, গ্রুলার বাঁধন খোলার সময় ফিরে তাকাল। সোনা ব্যবসায়ীর চোখে চোখ রেখে স্মিত হাসল, দেখা হওয়ার পর থেকে মানুষটাকে এই প্রথম হাসতে দেখছে হ্যান্স কোবার্ন। তেমন কোন প্রস্তাব কি দিয়েছ আমাকে?

না, সরাসরি কোন প্রস্তাব দেইনি। তবে কাজটা কি, আর আমি কি চাই তুমি ঠিকই বুঝতে পেরেছ।

অন্য কেউ হলে সাফ না করে দিতাম, ওয়্যাগণের দরজায় এসে দাঁড়ানো মেরী কোবানের উদ্দেশে ক্ষীণ নড করল ও। তবে তোমার কথা আলাদা। হয়তো ভেবে দেখব…তোমার চালান কবে রওনা দিচ্ছে?

পাঁচ দিন পর।

হয়তো জেরেমিতে দেখা হবে আবার, স্যাডলে চাপার সময় বলল লসন। হাঁটুর গুতোয় ঘোড়াকে এগোনোর নির্দেশ দিল। গলি ধরে এগোল গ্রুলাটা।

পেছন থেকে তাকিয়ে থাকল স্বামী-স্ত্রী। মূল রাস্তায় উঠে ডানে মোড় নিতে আড়ালে পড়ে গেল ড্যানি লসনের অবয়ব। পাশ ফিরে ক্রুদের দিকে তাকাল ব্যবসায়ী।

লোকটা কে? জানতে চাইল এক ক্রু।

ওকে চেনার দরকার নেই তোমার, বিরক্ত স্বরে বলল হ্যান্স কোবার্ন। নিজের চরকায় তেল দাও, বিল! আর এখানে বসে না থেকে ঘুরে-ফিরে খানিকটা খোঁজ-খবর নিলেও পারো। হয়তো পরে কাজে লাগতে পারে এমন কোন তথ্য পেয়ে যাবে।

সেটা তোমাকে বলে দিতে হবে না, চাঁছাছোলা স্বরে উত্তর দিল বিল নামের ক্রু। নিজের কাজ আমরা ভালই বুঝি। অযথা জ্ঞান দিতে এসো না। মি. কোবার্ন, জেরেমি টাউনে পৌঁছানোর পর আমাদের কাজ শুরু হবে। আপাতত আমরা বেকার। বুঝতে পারছ?

হয়তো তখন আর তোমাদের কাউকে প্রয়োজন হবে না আমার।

কি বললে? তীক্ষ্ণ স্বরে জানতে চাইল অন্যজন, অবাক হয়েছে।

তেমন কিছু না। বলেছি তোমাদের কাজ-কারবার পছন্দ হচ্ছে না আমার। ঠিক করেছি জেরেমিতে গিয়ে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেব। তখন হয়তো তোমাদের বিদায়ও করে দিতে পারি। তবে নিশ্চিন্ত থাকো, পাওনা ঠিকই পাবে।

শীতল দৃষ্টিতে ওর দিকে তাকাল বিল নিকোল। এ কাজটা করতে পারবে না তুমি।

আমার যা ইচ্ছে করব, তোমাদের কি!

বেশ তো। চুক্তি অনুযায়ী টাকা পেলেই আমরা খুশি, বলল অন্যজন।

পাবে।

তুমি কি ওকে ভাড়া করার কথা ভাবছ নাকি? কৌতূহলী স্বরে জানতে চাইল বিল।

করলেই বা তোমার অসুবিধে কি?

আমাদের চেয়ে টাফ লোক নাকি, তোমার ভাব-চক্করে মনে হচ্ছে কেউকাটা কেউ? তাচ্ছিল্যের সাথে জানতে চাইল সে।

শুনে রাখো, বিল, ও হচ্ছে ড্যানি লসন। ভাল করে মাথায় ঢুকিয়ে নাও কথাটা—তোমার মত বিল নিকোলদের পাত্তা দেয় না ওই লোক।

থমকে গেল বিল নিকোল, সতর্ক দৃষ্টি ফুটে উঠেছে চোখে। আনমনে একটা কাঁধ উঁচাল সে, তারপর সিগারেট ফেলে বুটের তলায় পিষল। হতে পারে। তবে আগাম সবকিছু বলা যায় কি? কে বলতে পারে ওখানে মরতে যাচ্ছে না সে?

প্রশ্নটা দ্বিধায় ফেলে দিল সোনা ব্যবসায়ীকে। কি যেন ভাবল সে, তারপর ক্ষীণ হাসল। স্বপ্ন দেখছ নাকি, বিল? ওর মুখোমুখি দাঁড়াতে হলে আরও কয়েকজনের সাহায্য হয়তো দরকার পড়বে তোমার।

কে জানে উল্টোটাও তো হতে পারে!

নিকোলের উম্মায় হৃক্ষেপ করল না হ্যান্স কোবার্ন। ঘুরে ওয়্যাগনের ভেতরে ঢুকে পড়তে গিয়ে রাস্তায় চোখ পড়ল তার। দেখল ফিরে আসছে লারকিনরা, সঙ্গে জেসি ওয়েন। দাড়িয়ে থেকে ওদেরকে দেখল কোবার্ন। মেয়েটির পাশাপাশি হাঁটছে ওয়েন। সমানে মুখ চলছে তার।

তুমি বোধহয় ক্লান্ত, ম্যাম, ওয়্যাগনের কাছে আসতে বলল ওয়েন। বিশ্রাম নাও। কোন দরকার হলে আমাকে একটা খবর দিয়ে শুধু, ঝটপট চলে আসব। তোমাদের সবাইকে জেরেমিতে পৌঁছে দেওয়ার দায়িত্ব যখন নিয়েছি, তখন নিশ্চিন্তে আমার ওপর নির্ভর করতে পারো।

ধন্যবাদ, মি. ওয়েন, বলে ওয়্যাগনের ভেতর ঢুকে পড়ল মেয়েটি।

নির্বিকার মুখে চারপাশে উৎসুক লোকদের দেখল জেসি ওয়েন, ক্ষণিকের জন্যে বিল নিকোল আর ওর সঙ্গীর ওপর থমকে গেল দৃষ্টি, তারপর দৃষ্টি ফিরিয়ে হ্যান্স কোবানের দিকে ফিরল। বিড়বিড় করে উইশ করল সে। ঘুরে ফিরতি পথে শহরের মূল অংশের দিকে এগোল।

ভেতরে ঢুকে পর্দা নামিয়ে দিল হ্যান্স কোবার্ন। চুলোয় কি যেন বসিয়েছে মেরী। স্ত্রীর পাশে গিয়ে দাঁড়াল সে। হারামজাদার ভাব দেখে মনে হচ্ছে দুনিয়াতে ওর চেয়ে ভদ্রলোক বুঝি, আর দ্বিতীয়টি নেই, তপ্ত স্বরে অসন্তোষ প্রকাশ করল সোনা ব্যবসায়ী। আরে, শয়তান, তোকে হাড়ে হাড়ে চিনি আমি!

সবাইকে সতর্ক করা তোমার দায়িত্ব, হ্যান্স।

অন্তত একশো মাইল পাড়ি দিয়েছে ওরা, কোন ঝামেলা বা অঘটন ঘটেনি। সবার আস্থা অর্জন করেছে ওয়েন। ওর বিরুদ্ধে কিছু বলতে গেলে আমাকে বিশ্বাস করবে না কেউ, ভাববে অযথাই ওর সমালোচনা করছি।

ড্যান কি কাজটা নেবে?

বোঝা যাচ্ছে না, চিন্তিত দেখাল কোবার্নকে। ওর মতিগতি বোঝা কঠিন। কি ভেবে যে কি করে বসে তার ঠিক নেই। ভাবছি জেরেমি টাউনে কেন যাচ্ছে ও। খুনে-বদমাশে ভর্তি হয়ে গেছে শহরটা। ওখানে ওর কোন কাজ থাকতে পারে না।

কেন, ওয়্যাগনের লোকগুলো সবাই কি খারাপ?

আমি তা বোঝাতে চাইনি। ড্যানি লসন এমন এক মানুষ কিনকেড বা রক্সদের সাথে যার কখনও মিল খায় না। আলাদা পথের মানুষ ও। বরং ওই খুনী লোকগুলোর বিপক্ষেই ওকে ভাল মানায়। আরেকটা পক্ষ আমরা, নিরীহ কিছু উচ্চাকাঙক্ষী লোক। এদের নিয়ে যত বিপদ, নিজেদের চামড়া বাঁচাতে জানি না, আর এ জন্যেই আমাদের ওপর চড়াও হওয়ার সুযোগ পেয়ে যায় কিনকেডরা।

ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে তুমি বোধহয় লারকিনদের কথা বোঝাতে চাইছ?

নিঃসন্দেহে।

বাদ দাও ওদের কথা। তোমার নিজের ঝামেলা কি কম?

মাথা ঝাঁকিয়ে সায় জানাল সোনা ব্যবসায়ী। সোনার চালান, জেরেমি টাউনের ভবিষ্যৎ নিজের ব্যবসা…দুশ্চিন্তার হাজারটা বিষয়। বিল নিকোল আর ওর সঙ্গীকে বিন্দুমাত্র বিশ্বাস করতে পারছে না, অথচ হাতের কাছে বিশ্বস্ত এবং যোগ্য তেমন কাউকে পায়নি। সোনার পরিমাণ বেশি হওয়ায় দুশ্চিন্তাও বেড়েছে ওর। নিরাপদে মন্টানায় পৌঁছবে তো সাপ্লাই, নাকি পথে লুঠ হয়ে যাবে? ড্যানি লসন গার্ডের দায়িত্বে থাকলে নিশ্চিন্ত বোধ করত ও। আগেও কোবার্নের হয়ে কাজ করেছে সে, ছোটখাট কিছু ঝামেলা হলেও প্রতিবারই গন্তব্যে পৌঁছেছে সাপ্লাই।

বাগির বাইরে বেরিয়ে এল সে। সন্ধে পর্যন্ত কয়েকটা সেলুন আর বারে ঘোরাঘুরি করে কাটাল। লোকজনের কথা শুনে, আলাপ করে বোঝার চেষ্টা করল সাপ্লাইটা সম্পর্কে কি ভাবছে এরা। কিন্তু বিফল হতে হলো ওকে, সোনার চালান নয় বরং জেরেমি টাউনের ভবিষ্যৎ নিয়ে আগ্রহী সবাই।

বাগিতে ফিরে এসে অবাক হলো ও, দেখল মেরীর সাথে আলাপ করছে লারকিনের মেয়েটা।

স্বামীর সঙ্গে অতিথির পরিচয় করিয়ে দিল মেরী কোবার্ন।

উঠে দাঁড়িয়ে নড করল জুলিয়া লারকিন, তারপর হাত বাড়িয়ে দিল সোনা ব্যবসায়ীর দিকে।

বোসো, প্লীজ, ম্যাম, অনুরোধ করল হ্যান্স কোবার্ন।

ধন্যবাদ।

একা থাকতে খারাপ লাগছিল ওর, স্বামীর উদ্দেশে ব্যাখ্যা দিল মেরী, তারপর জুলিয়ার দিকে ফিরল। এখন থেকে যখন ইচ্ছে চলে আসবে, বুঝেছ, জুলি?

নড করল মেয়েটি। আমি এলে হয়তো তোমার কাজের ক্ষতি হবে।

নাহ্, তোমার সঙ্গ পেলে বরং ভালই লাগবে। হ্যান্স তত বেশিরভাগ সময় বাইরে থাকে। সময় কাটানো আমার জন্যেও সমস্যা।

পশ্চিমে এই প্রথম এসেছ তোমরা? জানতে চাইল কোবার্ন।

বাবা আগেও একবার এসেছিল। আমি কিন্তু একেবারে নতুন।

কেমন লাগছে? তোমাদের সনোরার পরিবেশ কিংবা জীবনযাত্রার চেয়ে এখানকার জীবন সম্পূর্ণ আলাদা।

অন্তত খারাপ লাগছে না, ক্লিষ্ট হেসে বলল জুলিয়া, ওর চোখের গভীরে দ্বিধা দেখে বোঝা গেল এ ব্যাপারে নিজেও নিশ্চিত নয়। বিভিন্ন ধরনের মানুষ, এদের বোঝা কঠিন। সব জায়গায় রুক্ষতার ছোঁয়া। কিন্তু এর মধ্যেও কি যেন একটা আছে। পরিশ্রমী মানুষ দেখতে ভাল লাগে আমার।

মেরী কফি পরিবেশন করতে কাপ তুলে নিয়ে চুমুক দিল ওরা। আরও দুএকটা সৌজন্যমূলক কথাবার্তা শেষে উঠে দাঁড়াল জুলিয়া, ধন্যবাদ জানাল দম্পতিকে। তারপর বাগি থেকে নেমে পড়ল।

চলো, তোমাকে এগিয়ে দেই, বলে নেমে এল কোবার্ন।

মাত্র তো কয়েক গজ পথ। আমি একাই যেতে পারব।

নিশ্চয়ই পারবে। তবুও তোমাকে এগিয়ে দেয়া আমার কর্তব্য।

মৃদু মাথা ঝাঁকাল মেয়েটা।

দুটো ওয়্যাগন পেরিয়ে পরেরটার সামনে এসে থামল জুলিয়া। ধন্যবাদ, মি. কোবার্ন, বলল ও। ভেতরে এলে খুশি হব।

অন্য কোন দিন। হেসে ফিরতি পথ ধরল সোনা ব্যবসায়ী।

 

পরদিন সকালে জেরেমি টাউনের উদ্দেশে যাত্রা করল দলটা। একটা মাসট্যাঙে চড়ে গাইড করছে জেসি ওয়েন। রুক্ষ ট্রেইল ধরে এগিয়ে চলল ছয়টা ওয়্যাগন। ক্রমশ শ্লথ হয়ে এল গতি, চড়াই-উত্রাই পেরিয়ে এগোতে হচ্ছে। সামনে ধূসর প্রান্তরের বুক চিরে চলে গেছে ট্রেইল, সবুজের চিহ্ন তাতে কমই। দিগন্তের শেষ প্রান্তে আবছা ভাবে চোখে পড়ছে সুউচ্চ জারকান মাউন্টেন্‌সের অবয়ব। কাছে মনে হলেও যথেষ্ট দূরে ওটা।

দিনের শেষে মাইল দশ এগোনোর পর যখন একটা শুকিয়ে যাওয়া ক্রীকের কাছে ক্যাম্প করল ক্লান্ত লোকগুলো, তখনও ওদের কাছে মনে হলো সারা দিনে একটুও এগোয়নি। জারকান পাহাড়শ্রেণীকে একই রকম লাগছে। আকারে হয়তো কিছুটা বড় দেখাচ্ছে এখন, কিন্তু খালি চোখে দেখে বোঝা কঠিন ঠিক কতটা দূরত্বে আছে। তবে এরা সবাই জানে পাহাড়ের কাছাকাছি তাদের গন্তব্য। জারকান মাউন্টেসের শুরুতেই গড়ে উঠেছে সোনার শহর জেরেমি টাউন।

তবে হতাশ হলো না কেউ। ছয় দিন আগে যে স্বপ্ন বুকে নিয়ে মন্টানা থেকে যাত্রা শুরু করেছিল ওরা, তা বিলীন বা ম্লান হয়ে যায়নি; বরং আরও উজ্জ্বল হয়েছে, যেহেতু জানে দুদিনের মধ্যে পৌঁছে যাবে স্বপ্নের শহরে। সেখানে যে অনেক অনিশ্চয়তা আর কঠিন কিছু সময় অপেক্ষা করছে তা ভাবেনি কেউ, কারও মাথায়ও আসেনি। প্রতি রাতের মতই তারাজ্বলা আকাশ বা ওয়্যাগনের ভেতরকার গাঢ় অন্ধকারের দিকে তাকিয়ে সোনা আর উজ্জ্বল ভবিষ্যতের কথা ভেবে ঘুমিয়ে পড়ল লোকগুলো।

তবে কয়েকজনের ভবিষ্যৎ ভাবনা একটু ভিন্ন, তাদের মধ্যে জেসি ওয়েন একজন।

<

Super User