জাহাজ সমুদ্রে ভাসতেই সবকিছু স্বাভাবিক হয়ে এল। নাবিকদের উত্তেজনা, ভয়, ভীতি সব উবে গিয়ে সমুদ্র যাত্রার আনন্দ ফুটে উঠল সবার চোখে-মুখে। সমুদ্র। যাত্রার মজাই এটা। যাত্রার আগের মুহূর্ত পর্যন্ত যত ভীতি আর উত্তেজনা। যাত্রা শুরু হলেই সব ঠিক। সবাইকে তখন ভ্রমণের নেশায় পেয়ে বসে।

পাল তুলে তরতরিয়ে ছুটে চলেছে জাহাজ। ইতিমধ্যেই পার হয়ে গেছে রেশ কটি দিন। মাঝে মাঝেই নানান সামুদ্রিক পাখি সঙ্গ নেয় জাহাজের। একদিন ডেকের উপর উড়ে এল একটি পাফিন আর একটি পেট্রল পাখি। ডক্টর গুলি করে পাফিনটা মারলেন। হার্পনার সিম্পসন ডেক থেকে কুড়িয়ে আনল পায়রার চাইতে একটু বড় আকৃতির পাখিটা। ডক্টরকে জিজ্ঞেস করল, এ পাখি তো খাবার যোগ্য নয়, একেবারেই অখাদ্য। তবু কেন খামোকা মারলেন এটাকে?

সামুদ্রিক পাখির মাংসে বোটকা গন্ধ হয়, খেতে খারাপ ঠিকই। কিন্তু আমি এমনভাবে রাঁধব যে তোমার জিভেও পানি এসে যাবে।

আপনি রাঁধতেও জানেন, ডক্টর?

পন্ডিত হতে হলে অনেক কিছুই জানতে হয়। মৃদু হাসলেন ডক্টর ক্লবোনি।

সত্যিই, চমকার রান্না করতে পারেন ক্লবোনি। পাখিটার সমস্ত চর্বি কৌশলে চেঁছে ফেলে দিলেন। আসলে সামুদ্রিক পাখির চর্বিতেই আঁশটে গন্ধটা থাকে। চর্বি ফেলে মসলাপাতি দিয়ে ঠিকমত রাঁধতে পারলে চমক্কার সুস্বাদু ও মুখরোচক হয়।

গালফ স্ট্রীমে ফরওয়ার্ড পৌঁছুল ১৪ এপ্রিল। আরও দুশো মাইল গেলে গ্রীনল্যান্ড। শীতের প্রকোপ এখনও শুরু হয়নি। তবে কিছুটা ঠান্ডা ভাব রয়েছে। চমৎকার আবহাওয়া। ডক্টর তো পরিষ্কার জামা-কাপড় পরে মহা আনন্দে ডেকে ঘুরে বেড়াতে লাগলেন। এভাবে ভালই কেটে যাচ্ছিল, কিন্তু হঠাৎ একদিন দূরে দেখা গেল ভাসমান বরফের একটা চাই।

শ্যানডন ভীষণ অবাক হল। উত্তর মেরু সেই কোথায়, আর এখানে হিমশিলা!

শ্যানডনকে বোঝালেন ডক্টর। ইতিহাসখ্যাত কয়েকটি সমুদ্র যাত্রার গল্প বললেন। গড়গড় করে বলে গেলেন কোন সালের কত তারিখে কখন কোথায় ভাসমান হিমশিলা দেখা গেছে সুমেরু থেকে চল্লিশ-বিয়াল্লিশ ডিগ্রি দূরে। তাই অবাক হবার কোন কারণই নেই।

ডক্টর যেন একটি জীবন্ত বিশ্বকোষ। কোন কিছুই তার অজানা নয়। তবুও তিনি একটি রহস্যের সমাধান আজও করতে পারেননি। সমুদ্রের এই রহস্য তিমি শিকারিরাও লক্ষ্য করে, কিন্তু ব্যাখ্যা জানে না। বাতাস যখন শান্ত থাকে তখন সমুদ্রে বড় বড় ঢেউ ওঠে আর বৃষ্টি নামলেই সমুদ্র একদম শান্ত হয়ে যায়। এই রহস্যটা আজও রহস্যই রয়ে গেছে।

ক্যাপ্টেনের নির্দেশ অনুসারে ফেয়ারওয়েল অন্তরীপ পৌঁছতে হলে শুধু পালের ভরসায় থাকলে চলবে না। শ্যানডন এঞ্জিন চালাবার আদেশ দিল। এঞ্জিন চালু হতেই দ্রুত গতিতে ছুটে চলল জাহাজ। ঝড়ো বাতাস ঠেলে অনেক কষ্টে ফেয়ারওয়েল অন্তরীপে এসে পৌঁছল। দূরবীন চোখে লাগালে গ্রীনল্যান্ডের আবছা আকৃতি দেখা যায় এখন।

ক্লবোনি ভাবছেন স্যার জন ফ্রাঙ্কলিনের কথা। ১৮৪৫ খ্রিস্টাব্দে ফ্রাঙ্কলিন এই অঞ্চলেই ডিস্কো দ্বীপ পার হয়ে দুটি জাহাজ সহ হঠাৎ করে উধাও হয়ে গিয়েছিলেন। কোন পাত্তাই আর মেলেনি তার।

পরদিন সকালে কেপ ডেজোলেসনে এসে পড়ল জাহাজ। জনসন আক্ষেপ করে ভক্টরকে বলল, মাত্র কয়েক সপ্তাহ ছাড়া সারাটা বছরই এই এলাকা বরফে ঢাকা থাকে। জায়গাটার নাম গ্রীনল্যান্ড রাখা ঠিক হয়নি।

ডক্টর ক্লবোনি আবারও তাঁর জ্ঞানের ভান্ডার খুলে বসলেন, দশম শতাব্দীতে গ্রীনল্যান্ডের অবস্থা এরকম ছিল না। নবম শতাব্দীতেও এখানে সবুজে ছাওয়া সমৃদ্ধ গ্রাম ছিল… একটানা অনেক কথা বলে গেলেন ক্লবোনি। জনসন মনোযোগ দিয়ে শুনল ডক্টরের কথা।

ফরওয়ার্ড যতই এগিয়ে চলেছে দুর্ভোগও ততই বেড়ে চলেছে। চারদিক থেকে বরফ এমনভাবে ভেসে আসছে যে জাহাজ চালানই প্রায় অসম্ভব হয়ে পড়ল। লগি দিয়ে বরফ ঠেলে নৌকার মত চলতে হচ্ছে। একটু অসাবধান হলেই ভাসমান হিমশিলার সঙ্গে ধাক্কা লেগে মারাত্মক কোন দুর্ঘটনা ঘটে যেতে পারে। কদিন একটানা বরফের সঙ্গে যুদ্ধ করে ক্লান্ত হয়ে পড়ল নাবিকেরা।

পথ আর শেষ হয় না। ২৭ এপ্রিল মেরুবৃত্ত পেরিয়ে এল ওরা। দূরের ভাসমান বরফের পাহাড় দেখে মনে হচ্ছে হাত বাড়ালেই ছোঁয়া যাবে, কিন্তু আসলে তা কম করে হলেও দশ-বারো মাইল দূরে! এ এক মরীচিকার খেলা। এমন কি ডক্টর ক্লবোনিও হার মানলেন আলোর এই ভেলকিবাজির কাছে।

যতই দিন যাচ্ছে ততই প্রকৃতি যেন বিরূপ হয়ে উঠছে। আবহাওয়া বদলে যাচ্ছে। বদলে যাচ্ছে সমুদ্রের রূপ। চারদিকে শুধু বরফ আর বরফ। বরফের উপর সূর্যের উজ্জ্বল আলো চারদিকে এমন এক চোখ ধাঁধানো পরিবেশের সৃষ্টি করল যে খালি চোখে চেয়ে থাকাই দায়। সবুজ কাঁচের চশমা পরে নিলেন ডক্টর, অন্যদেরও পরতে উপদেশ দিলেন, আর বললেন-চশমা ছাড়া কেউ যেন রোদের দিকে না তাকায়। এতে ছোঁয়াচে চোখের রোগ দেখা দিতে পারে।

বিপদ যতই এগিয়ে আসছে জাহাজে উদ্ভট জল্পনা-কল্পনা ততই বেড়ে চলেছে। বিশেষ করে ক্যাপ্টেন এবং কুকুরটিই হয়েছে মুল আলোচ্য বিষয়। এখনও ক্যাপ্টেনের কোন পাত্তা নেই, কিন্তু জাহাজ ঠিকই এগিয়ে চলেছে অজানা গন্তব্যস্থলের দিকে। কে জানে কোন বিপদের মাঝে! ক্যাপ্টেন নেই এ কথা অনেকেই মানতে চায় না। ওদের ধারণা ক্যাপ্টেন নিশ্চয়ই জাহাজে আছেন। হঠাৎ একদিন বদ্ধ ঘর খুলে বেরিয়ে আসবেন। এ কথাকে মোটেও আমল না দিয়ে একজন বলে উঠল, এ জাহাজের ক্যাপ্টেন তো ওই কুকুরটি। কেমন তার চলাফেরা! ঠিক যেন জাহাজের মালিক। টহল দিয়ে বেড়াচ্ছে, কোথায় কি হচ্ছে না হচ্ছে দেখছে। পাল ঠিকমত টানা হল কিনা তাও খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখে বেড়ায় কুকুরটা। সেদিন তো একদম ক্যাপ্টেনের মত হালের চাকা ধরে দাঁড়িয়েছিল। এ কথা শুনে কুসংস্কারাচ্ছন্ন নাবিকদের নাভিশ্বাস ওঠে আর কি! কুকুরটিকে আজ পর্যন্ত কেউ খেতে দেখেনি। খাবার যেমনটি দেয়া হয় তেমনটি পড়ে থাকে! তাহলে কি খায়, কোথায় খায় কুকুরটি? মাঝে মাঝেই বরফ পাহাড়ে গিয়ে খানিকক্ষণ বেড়িয়ে আসে সে। কি করে সেখানে? এবার কুকুর-ভীতি বেশ ভালভাবেই পেয়ে বসল নাবিকদের।

বিপদ আসছে, বিপদ! ভাসমান বরফের পাহাড় চারদিক থেকে ঘিরে ধরছে জাহাজকে, যেন পিষে মারবে। নাবিকেরা বরফ কাটার করাত নিয়ে তৈরি হয়ে রইল। এইসব বরফের চাই যে চাপ সৃষ্টি করতে পারে তা প্রায় এক কোটি টনের কাছাকাছি। ভয় পেলেও নাবিকেরা সাহসের সঙ্গে লড়াই করে মরতে চায়। কাপুরুষের মত হাল ছেড়ে দিতে তারা নারাজ। নাবিকদের উদ্যমের প্রশংসা করতে হয়। কিন্তু সারাদিন অক্লান্ত পরিশ্রম করেও জাহাজকে এগিয়ে নেয়া গেল না। বরফের গায়ে লোহার গলুই দিয়ে ঠেলা মেরেও পথ করে নেয়া গেল না। শেষ পর্যন্ত রাতে নোঙর ফেলতে বাধ্য হল ওরা।

তাপমাত্রা ক্রমেই নেমে আসছে। পরদিন তাপমাত্রা নেমে এল শূন্যের আট ডিগ্রি নিচে। এই আবহাওয়াতেও উত্তরের দিকে কয়েক মাইল এগিয়ে গেল ফরওয়ার্ড। মাঝরাতের দিকে ডাঙা থেকে তিরিশ মাইল দূরে এসে পৌঁছুল।

বিপদ বেড়েই চলেছে। এতক্ষণ ভালই ছিল। এখন বরফের বিশাল চাক ভেঙে ভেঙে ভেসে যাচ্ছে। যে-কোন মুহুর্তে সাংঘাতিক সংঘর্ষ ঘটে যেতে পারে। এই বিপদে হালের চাকা হাতে নিল গ্যারী। জাহাজ চালাতে সবচেয়ে ঝানু এই গ্যারী। এঁকেবেঁকে আশ্চর্যভাবে গা বাঁচিয়ে এগিয়ে নিয়ে চলেছে সে। ফরওয়ার্ডের নাবিকেরা দুভাগে জাহাজের সামনে ও পিছনে দাঁড়িয়ে লম্বা লগি দিয়ে ভাসমান হিমশিলা ঠেলে জাহাজের পথ করে নিচ্ছে।

বিপদের যেন আর শেষ নেই। একটা বিপদ কাটছে তো আর একটা এসে হাজির হচ্ছে। এ যাত্রা বুঝি আর পার পাওয়া গেল না। সাক্ষাৎ যমদূতের মত এগিয়ে আসছে এক বিরাট বরফ পাহাড়। ঘুরতে ঘুরতে আসছে আর আশপাশ থেকে ভেঙে ভেঙে কামানের গোলার মত আওয়াজ হচ্ছে। ডানে-বায়ে কোনদিকেই যাবার পথ নেই। একশো ফুট উচু পাহাড় সোজা এগিয়ে আসছে। মৃত্যু এবার অবধারিত। নাবিকেরা ভীত সন্ত্রস্ত্র হয়ে লগি ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে শুয়ে পড়ল ডেকের উপর।

এই এল বলে–!

ওই টালমাটাল অবস্থায় কে যেন অচেনা গলায় ধমক দিয়ে সবাইকে চুপ থাকতে বলল।

শুধু গ্যারী একা অসম সাহসে হাল ধরে রইল। হঠাৎ জাহাজের ওপর একটা বিরাট ঢেউ ভেঙে পড়ল। বিকট এক ঝাপটা খেয়ে জাহাজ এগিয়ে চলেছে। সামনে সূর্যের উজ্জ্বল আলোয় সমুদ্রের ঢেউ খেলা করছে। অদৃশ্য হয়ে গেছে সেই মৃত্যুদূত হিমশিলা।

অবাক চোখে জনসন প্রশ্ন করল, ডক্টর, আমরা কি বেঁচে গেলাম? কিভাবে বাঁচলাম আমরা?

স্রেফ কপালের জোরে! হিমশিলার গা থেকে সমানে বরফ ভেঙে পড়ছিল বলে সেটা সামনের দিকে ঠিকমত এগোতে পারছিল না। তার ওপর আবার চারদিককার চাপ। সবকিছু মিলিয়ে বেচারা পড়েছিল একটু বেকায়দায়; আর সেজন্যেই তো জাহাজের ওপর পড়বি পড়বি করেও শেষমেষ কাত হয়ে আছড়ে পড়ল সমুদ্রে। তবে হ্যাঁ, আর মিনিট দুয়েক দেরি হলেই রক্ষে ছিল না-একেবারে চ্যাপ্টা হয়ে যেত জাহাজটা।

<

Super User