কোন্ড ক্রীক পেরোনর সময় যথারীতি লাগাম টেনে ধরল রয় সলটার। বক্স ডব্লিউ এর ফোরম্যান সে। একত্রিশ বছর বয়স, দীর্ঘদেহী, শক্তসমর্থ।

এ জায়গাটা খুব পছন্দ ওর। এখানেই কোথাও ছোট্ট একটা কাঠের বাড়ি বানাবে সে। সংসার পাতবে। ইচ্ছেটা বহুদিনের তার, মেয়েও ঠিক করে রেখেছে। মনে মনে। সে উদ্দেশ্যে গত তিন বছর ধরে বেতন আর বোনাসের একাংশ জমিয়ে চলেছে।

ওয়াগনারের র‍্যাঞ্চে বছর ছয়েক যাবৎ ফোরম্যানের দায়িত্ব পালন করছে সলটার। ওর বাবা মারা যাওয়ার পর থেকেই। এ র‍্যাঞ্চের এক পাল গরু। অ্যাবিলেন-এ নেয়ার পথে মারা যান তিনি।

জর্জ ওয়াগনার নতুন ফোরম্যান নিয়োগ করার ব্যাপারে বিন্দুমাত্র মাথা ঘামাননি। বাবার মৃত্যুর পর ছেলের কাঁধে তুলে দিয়েছেন দায়িত্ব। তাঁকে হতাশ করেনি রয় সলটার। লোকের কাছ থেকে কিভাবে কাজ আদায় করতে হয় জানা আছে তার। সবাই পছন্দও করে ওকে। সেজন্যে কৃতজ্ঞ সে সবার কাছে।

বাফেলো ফ্ল্যাটের দিকে আবার রওনা দিল ও। নীল চোখ দুটো সরু হল বিরক্তিতে। জর্জ ওয়াগনারের ছেলে জোহানকে খুঁজে আনার জন্যে শহরে চলেছে সে। প্রায়ই যেতে হয়। গত রাতে আবারও ঘোড়া নিয়ে বেরিয়ে গেছে জোহান। বাপের সঙ্গে ঝগড়া করে। র‍্যাঞ্চের বর্তমান পরিস্থিতির কথা ভেবে দীর্ঘশ্বাস চাপল সলটার। জর্জ ওয়াগনার বদলে গেছেন কেমন যেন। ছেলে বড় হলে একটু-আধটু অবাধ্য তো হতেই পারে। কিন্তু সেটা কিছুতেই মানতে পারছেন না ওয়াগনার। ওয়াগনারের মেয়ে তানিয়ার কথা মনে পড়তেই চোখজোড়া আরও সরু হল সলটারের। তানিয়াকে পছন্দ করে সে। বিয়ে করতে চায়। গত তিন বছর ধরে। বলব বলব করেও ওকে বলা হয়নি কথাটা।

জর্জ ওয়াগনার ওকে বলেছিলেন ভবিষ্যতে কোল্ড ক্রীকে হেডকোয়ার্টার বানাতে পারে সে। প্রায় একশো ষাট একর চারণভূমি রয়েছে জায়গাটার চারপাশে। নতুন র‍্যাঞ্চ শুরু করতে পারে-‘বক্স এস’ নাম দিয়ে।

তানিয়া সব সময়ই পছন্দ করত ওকে। খুব ঘনিষ্ঠ ছিল ওরা। একসাথেই বড় হয়েছে। সলটারের বাবা তখন এ র‍্যাঞ্চের ফোরম্যান ছিলেন। কিশোর সলটারের পিছু ছাড়ত না কিশোরী তানিয়া। নিজেকে ছেলে ভাবতে পছন্দ করত সে। ও কথা ভেবে এখন হাসি পেল সলটারের। বেশ ভালভাবেই কেটে যাচ্ছিল। তারপর ঘটল সেই দুর্ঘটনা। গরুর পাল নিয়ে বেরোনর ঠিক পাঁচ দিন পরেই লাশ হয়ে ফিরে এলেন বাবা। খুব ভোরবেলাকে যেন গুলি করে তাকে। তন্ন তন্ন করে। খুঁজেও হত্যাকারীকে বার করতে পারেনি ওরা। বাবার মৃত্যুতে প্রচণ্ড আঘাত পেয়েছে সলটার।

বাবার মৃত্যুশোক সামলে ওঠার আগেই তানিয়া চলে গেল পুবে। তিন বছর পর ফিরে এল সম্পূর্ণ নতুন এক মেয়ে। আগের সেই চপলা কিশোরীটিকে খুঁজে পাওয়া গেল না তার মাঝে।

সলটারের ধারণা ছিল যতই বদলে যাক ওকে ভুলতে পারেনি তানিয়া। কিন্তু হঠাৎ কোত্থেকে উড়ে এসে জুড়ে বসল উইলবার অসকার। কিনে নিল জেমস হার্বার্টের র‍্যাঞ্চ। ‘র‍্যাফটার ও’ নাম দিল ওটার।

তানিয়ার সঙ্গে ক্যানসাস সিটিতে পরিচয় হয়েছিল অসকারের। র‍্যাঞ্চ কিনলেও সেদিকে মোটেও মন নেই তার। ফোরম্যান ম্যাকগ্র-র হাতে র‍্যাঞ্চ ছেড়ে দিয়ে সময় কাটাতে লাগল তানিয়ার সঙ্গে। ঘনিষ্ঠতা বাড়ল ওদের। কপাল কুঁচকে উঠল সলটারের।

তানিয়ার চেয়ে বছর দশেকের বড় হবে অসকার। মেয়ে পটানর বিদ্যা ভালই জানা আছে তার। ইতোমধ্যেই প্রচুর টাকা উড়িয়েছে। তানিয়াকে দেখিয়েছে তার টাকার জোর।

বাফেলো ফ্ল্যাট এখান থেকে বারো মাইল দূরে। দ্রুত ঘোড়া দাবড়াল সলটার। কেমন যেন অসহিষ্ণ লাগছে ওর। তিক্ততায় ভরে আছে মন। যে-কোন কিছু পেতে হলে কঠোর পরিশ্রম করতে হয়, ভাবল সে। হোক সে মেয়েমানুষ বা র‍্যাঞ্চ। সবাই তো আর অসকারের মত ভাগ্য নিয়ে জন্মায়নি। দাঁতে দাঁত পিষল সলটার।

অসকার লেন কাউন্টিতে আসার পর থেকে তানিয়ার সঙ্গে ওর দূরত্ব বেড়ে গেছে কয়েক যোজন। সরাসরি কিছু বলেনি তানিয়া। সলটারের সঙ্গ এখনও উপভোগ্য তার কাছে। তবে ওর কথা বলার ভঙ্গি আর চাহনি বলে দেয় অনেক কিছু। পাত্র হিসেবে অসকার ওর চেয়ে অনেক বেশি যোগ্য। এমনকি জর্জ ওয়াগনার পর্যন্ত ওর ভবিষ্যৎ পরিকল্পনার ব্যাপারে এখন আর কিছু বলেন না। কোল্ড ক্রীকে বাড়ি বানাবার কথা সলটার ছাড়া আর কারও যেন মনেই নেই। সে ও ঠিক করেছে যোগ্যতা অর্জনের পর তানিয়াকে প্রস্তাব দেবে, তার আগে কখনই নয়।

হঠাৎ গুলির শব্দে চিন্তার জাল ছিঁড়ে গেল ওর, বেশ দূর থেকে এসেছে শব্দটী। ক্রু কুঁচকে উঠল সলটারের। চাইল চারদিকে। মনে হয় শিকার করছে কেউ।

ঘোড়ার পেটে স্পার দাবাল সে। শহরে যেতে হবে। এ ছাড়া আর কারও সাধ্য নেই জোহানকে ফিরিয়ে আনে। খানিক দূর এগোতেই পরপর কয়েকটা গুলি হল। দীর্ঘক্ষণ ধরে প্রতিধ্বনি তুলল শব্দগুলো। লাগাম টেনে ধরল সলটার। শিকারি নয়। কেউ বোধহয় বিপদে পড়েছে। দুটো অস্ত্র থেকে গুলিবর্ষণ চলছে। কোল্ট আর উইনচেস্টার। গুলির শব্দ লক্ষ্য করে ঘোড়া ছোটাল সে। এই অঞ্চলে গত কয়েক মাস ধরে গরু চুরি যাচ্ছে। আশেপাশের প্রত্যেকটা র‍্যাঞ্চই ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। জর্জ ওয়াগনারের র‍্যাঞ্চও বাদ যায়নি। শেরিফ রজার হার্পার চোর ধরার জন্যে মাথার ঘাম পায়ে ফেলেও কিছু করতে পারছে না।

হ্যাটটা খানিক সামনে টেনে দিল সলটার। গোলাগুলি চলছে এখনও। প্রায়। ডজন দুয়েক গুলির শব্দ কানে এসেছে ইতোমধ্যেই। কেউ নিশ্চয় ভীষণ বিপদে পড়েছে।

কুরুক্ষেত্রের দিকে ঘোড়া দাবড়াল সলটার। অসকার আর ফ্লিন্ট উডককের র‍্যাঞ্চের মধ্যবর্তী সীমানায় রয়েছে এখন সে। গত পাঁচ সপ্তাহ ধরে ফ্লিন্টের গরু ক্রমাগত চুরি যাচ্ছে। হয়ত গণ্ডগোলটা সেজন্যেই, ভাবল সলটার। দুটো র‍্যাঞ্চের মাঝখানের ক্রীকটা পেরোল সে। তীরবেগে ঘোড়া ছোটাল পাহাড় চূড়ার দিকে। চূড়ায় পৌঁছে দেখতে পেল তিন ঘোড়সওয়ার ছুটে আসছে তার দিকে। সঙ্গে গরুর পাল। ওদের পিছু ধাওয়া করছে আরেকজন অশ্বারোহী। বেশিরভাগ গুলি সে-ই ছুঁড়ছে।

স্যাডল বুট থেকে নিজের উইনচেস্টারটা তুলে নিল সন্টার। উজ্জ্বল সূর্যালোক চোখ ধাধিয়ে দিচ্ছে তার। তিন ঘোড়সওয়ার এখন দু’শ গজ দূরে। সোজা ধেয়ে আসছে। তাদের শ’খানেক গজ পেছনে চতুর্থ অশ্বারোহী। তার লম্বা পাতলা শরীরটা দেখে চিনতে পারল সলটার। ফ্লিন্ট উডকক। রাইফেলে কার্তুজ রল সলটার। ফ্লিন্টের শক্র মানে তারও শত্রু। ফাঁকা গুলি করল সে। গুলির শব্দে লোক তিনটি চমকে তাকাল ওর দিকে। লাগাম টেনে ধরল। পরক্ষণেই ওর রেঞ্জের বাইরে ঘোড়া ছোটাল। ওকে লক্ষ্য করে দু’জন গুলি ছুঁড়ল। সলটারের কাছে-পিঠেও এল না ওগুলো। তৃতীয়জন ওদিকে গুলি চালাতে শুরু করেছে পেছন দিকে। ফ্লিন্টকে লক্ষ্য করে। হঠাৎই লাগাম থেকে হাত ছুটে গেল ফ্লিন্টের। ছিটকে পড়ল সে ঘোড়া থেকে। মুখ থুবড়ে মাটিতে পড়ে রইল সে। নিথর। ওর ঘোড়া ওকে ফেলেই ছুটল ঢাল বেয়ে।

হতচকিত হয়ে গেল সলটার। পরমুহূর্তেই সংবিৎ ফিরে পেয়ে তিন অশ্বারোহীর উদ্দেশে গুলি চালাতে লাগল সে। বুঝতে পারল না ওদের কারও গায়ে। গুলি লেগেছে কিনা। তবে ও রিলোড় করার আগেই পানি ছিটিয়ে ক্রীক পেরোল ওরা। চলে গেল রেঞ্জের বাইরে।

তখুনি ঘোড়ায় চাপল সলটার। রাইফেলটা বুটে রেখে ধাওয়া করল লোকগুলোকে। এ মুহূর্তে অনেকখানি দূরে চলে গেছে ওরা। ঘোড়ার গতি দ্রুত হল সলটারের গোড়ালির খোঁচায়। স্যাডলবুট থেকে রাইফেলটা তুলে নিল ও। প্রায় আওতার বাইরে চলে যাওয়া আবছা শরীরগুলোকে লক্ষ্য করে পরপর কয়েকটা গুলি করল সে। তবে তার কোন প্রতিক্রিয়া দেখা গেল না। এযাত্রা আসলে বেঁচে গেছে লোকগুলো। হাল ছেড়ে দিল সলটার, আরে! ওদিকে ফ্লিন্ট আহত অবস্থায় পড়ে রয়েছে, হঠাৎ মনে পড়ল ওর। ঘোড়ার মুখ ফেরাল দ্রুত। তীব্রগতিতে ছুটছে এখন ওটা। ফ্লিন্টের কাছে শিগগিরই ফিরে এল ও। চাইল ওর অসাড় দেহের দিকে। বারুদের গন্ধ মিলিয়ে যায়নি এখনও।

ফ্লিন্টের ঘোড়াটা মালিকের কাছে ফিরে এসেছে তখন, নিজের ঘোড়া থেকে লাফিয়ে নামল সলটার। হাঁটু গেড়ে বসল ফ্লিন্টের পাশে। ধীরে ধীরে চিত করে শোয়াল ওকে। ফ্লিন্টের ফ্যাকাসে মুখের দিকে চাইল সে। র‍্যাঞ্চার চোখ মেলল এসময়।

হাঁফ ছেড়ে বাঁচল সলটার। ওর দিকে শূন্যদৃষ্টিতে চাইল ফ্লিন্ট। যেন বুঝতে পারছে না কিছু।

কোথায় লেগেছে, ফ্লিন্ট? প্রশ্ন করল সলটার। জবাব দিল না ফ্লিন্ট। উঠে বসল বহুকষ্টে। ওর ডান কাঁধ ভেসে যাচ্ছে রক্তে। ভিজে লাল হয়ে গেছে শার্ট। ওকে আবার শুইয়ে দিল সলটার।

গরু চোরের দল, কঁপা গলায় বলল ফ্লিন্ট। চিনেছ কাউকে? প্রশ্ন করল সে।

নাহ, ফ্রিন্টের শার্ট খুলতে খুলতে বলল সলটার। ক্ষতস্থানটা বেরিয়ে পড়তে চমকে উঠল সে। জলদি ডাক্তার রবসনকে দেখানো দরকার। তুমি বাড়িতে শুয়ে অপেক্ষা করবে নাকি আমার সঙ্গে শহরে যাবে?

যাব, বলল ফ্লিন্ট। ওঠার চেষ্টা করছে। বছর পঞ্চাশেক বয়স ওর। রুক্ষ মুখটা সাদা হয়ে গেছে। রাগী দু’চোখে এখন বেদনা ফুটে উঠেছে। এলাকার কারও হাত আছে এর পেছনে, আমার বিশ্বাস, বলল ফ্লিন্ট।

র‍্যাঞ্চারের গলা থেকে রুমালটা খুলে নিল সলটার। ক্ষতস্থান বাঁধল ওটা দিয়ে।

ওদেরকে আগে কখনও দেখেছ এখানে? জিজ্ঞেস করল সে।

জানি না, আমি গুলি ছুঁড়তেই ব্যস্ত ছিলাম। চেহারা দেখিনি।

ওদের দেখলে কখন?

সকালে গিয়েছিলাম বাথানে। দেখি প্রায় খালি করে ফেলেছে। সঙ্গে সঙ্গে পায়ের চিহ্ন দেখে ধাওয়া করলাম।

তোমার লোকেরা জানে?

হুঁ, বলল ফ্লিন্ট। হাঁক দিয়ে এসেছি।

এসময় ঘোড়ার খুরের শব্দ শুনতে পেল ওরা। ফ্রিন্টের কাউবয়রা আসছে। বড় দেরি করে ফেলেছে এরা।

ব্যাণ্ডেজ বাঁধা হয়ে গেলে স্যাডলে অতি কষ্টে চেপে বসল ফ্লিন্ট। যন্ত্রণায় বিকৃত হল মুখ। ঘোড়ায় চেপে ওর পাশাপাশি চলতে লাগল সলটার। চারদিকটা পর্যবেক্ষণ করল সে।

ফ্লিন্টের কাউবয়দের দু’জন এসময় চলে এল ওদের কাছে।

বসের কি হয়েছে? উদ্বিগ্ন কণ্ঠে প্রশ্ন করল একজন। কোথায় যাচ্ছেন?

কাঁধে গুলি লেগেছে। বলল সলটার। শহরে যাচ্ছি, ডাক্তার দেখাব।

তোমরা গরুগুলো র‍্যাঞ্চে নিয়ে যাও। সবাইকে বলবে চিন্তার কিছু নেই, শিগগিরই ফিরছি আমি, কোনমতে বলল ফ্লিন্ট। কাউবয় দু’জন অন্যদের সঙ্গে যোগ দিতে চলে গেল। গরু ফিরিয়ে নেবে র‍্যাঞ্চে।

রাসলাররা নিশ্চয়ই চিহ্ন রেখে গেছে। শহর থেকে ফিরেই খুঁজতে বেরোব। এভাবে চলতে পারে না। গত পরশু রাতে আবারও চুরি হয়েছে আমাদের র‍্যাঞ্চে। এবার গেছে একশটা। অসকার কাল রাতে এসেছিল। ওর নাকি পঞ্চাশটা গেছে, কঠিন গলায় বলল সলটার।

ভালই চালাচ্ছে শালারা, দাঁতের ফাঁকে বলল ফ্লিন্ট, কিন্তু গরুগুলো বেচছে কোথায়? এ এলাকায় নয় নিশ্চয়। এখানকার কোন র‍্যাঞ্চারই ওদের সঙ্গে কারবার করবে না। গরু তাড়িয়ে নিচ্ছে অথচ তার কোন চিহ্ন নেই কেন?

নিশ্চয়ই আছে, শহরের ট্রেইল ধরে এগোতে এগোতে বলল সলটার। গাফিলতি তো করছ তোমরা। আমি জর্জকেও বলেছি সব র‍্যাঞ্চার মিলে এর সমাধানের জন্যে কাজ করতে। আমার কথা কানেই তোলেনি। আসলে তোমরা প্রত্যেকেই আলাদাভাবে লড়াই করতে চাও, এভাবে হবে না, সবাই মিলে বসে একটা কিছু বুদ্ধি বার কর। দেখবে সপ্তাহ দুয়েকের মধ্যেই চোর ধরা পড়ে গেছে।

হয়ত তোমার কথাই ঠিক, বলল ফ্লিন্ট। তবে আমার বিশেষ কিছু করার নেই, আমি ছোট র‍্যাঞ্চার। জর্জ ওয়াগনার আর অসকার ব্যবস্থা নিক। আমরা তো আছিই।

জর্জ বদলে গেছে, দ্রুত বলল সলটার। জোহানের সঙ্গে তার গোলমাল লেগেই আছে। আসলে ছেলেকে মাথায় তুলেছে সে। অকর্মার ধাড়ি একটা। র‍্যাঞ্চের কোন কাজেই আসে না।

আসল সমস্যা অন্যখানে, ডানদিকে খানিকটা ঝুঁকে বসে বলল ফ্লিন্ট। বাজে লোকের পাল্লায় পড়ে গেছে ছোঁকরা। অসকারের ফোরম্যান ম্যাকগ্র আর অন্যান্যদের সঙ্গে মিশে গোল্লায় যাচ্ছে। মদ-জুয়া ধরে ফেলেছে।

জানি, ঠাণ্ডা গলায় বলল সলটার। আবেগ ঝেড়ে ফেলতে চাইল গলা থেকে। পারল না।

ম্যাকগ্র আগে জর্জ ওয়াগনারের র‍্যাঞ্চে ছিল। সলটারের বাবা মারা যাওয়ার পর সবার ধারণা ছিল সে-ই এবার ফোরম্যান হবে। ম্যাকগ্র সব সময়ই গোমড়ামুখো কঠোর চরিত্রের লোক। দুর্ব্যবহারে অভ্যস্ত। রয় সলটার ফোরম্যানের দায়িত্ব গ্রহণ করার পর লোকের সঙ্গে ওর দুর্ব্যবহারের মাত্রা আরও বেড়ে যায়। তবে বক্স ডব্লিউ তখনও ছাড়েনি ও, তারপর অসকার এখানে র‍্যাঞ্চ কেনার পর কিভাবে যেন ওর ফোরম্যানের চাকরিটা বাগিয়ে নেয় সে, বক্স ডব্লিউ ছেড়ে চলে যায়। এরপর সাটারের সঙ্গে আর কখনও কথা বলেনি ও।

তোমার বাবা মারা যাওয়ার সময় থেকেই গণ্ডগোলের শুরু, ফ্লিন্ট বলল।

বাবা মারা যায়নি, দৃঢ়তার সঙ্গে বলল সলটার। তাকে মারা হয়েছে।

কিন্তু এতদিনেও তো জানা গেল না কিছু। তোমার কি মনে হয়? কেউ শিকার করতে গিয়ে ভুল করে

অসম্ভব, বলল সলটার। শিকারি হলে গুলি করার পর অবশ্যই ভুল বুঝতে পারত। লাশ নিয়ে আসত।

তা ঠিক। তাকে সম্ভবত খুন করা হয়েছিল, সোজা হয়ে বসল ফ্লিন্ট। ব্যথায় কুঁকড়ে উঠল সে। কিন্তু বাবা তো কখনও কারও ক্ষতি করেনি, ফ্লিন্টের দিকে চেয়ে বলল সলটার।

ক্ষতি না করলেও শত্রু জন্মায়। কে যে কখন কি ভাবে শত্রু হয়ে যাবে। বোঝার উপায় নেই।

বেশ অনেকদূর চলার পর ঘোড়া থামাল ফ্লিন্ট। স্যাডল থেকে ইচ্ছে করে পিছলে পড়ল ঘাসে। হাত পা ছড়িয়ে, চোখ বুজে শুয়ে রইল। সলটার ঘোড়া থেকে নেমে ওর ওপর ঝুঁকতেই খানিকক্ষণ বিশ্রাম নেয়ার কথা বলল ফ্লিন্ট। ওর দুর্দশা স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছে সলটার। তাই বলল, তুমি বরং এখানেই শুয়ে থাক। আমি ডাক্তার আর ওয়াগন নিয়ে ফিরে আসছি।

দরকার নেই। আমাকে স্যাডলে তুলে দাও, কোনক্রমে উঠে দাঁড়াল ফ্লিন্ট।

আবার এগিয়ে চলল ওরা। খানিক বাদেই দেখা গেল শহর। বাফেলো ফ্ল্যাট। স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলল সলটার। ওরা মেইন রোড ধরে চলেছে এখন। একপাশে কাত হয়ে রয়েছে ফ্লিন্ট। ওর পাশে ঘোড়া নিয়ে এল সলটার। ফ্লিন্টকে পড়ে যেতে দেখলেই ধরে ফেলবে।

সবে বিকেল হয়েছে। প্রচুর লোকজন এখন রাস্তায়। এসময় স্যালুনের সামনের দিক থেকে ডাকল কে যেন। সলটার চেয়ে দেখল পরিচিত এক লোক। হাত তুলল সে। তবে থামল না। ফ্লিন্টকে যত দ্রুত সম্ভব ডাক্তারের কাছে নিয়ে যেতে হবে। জেলখানা পেরোল ওরা। ল অফিসের দরজায় শেরিফ রজার হার্পার দাঁড়িয়ে ছিল। মাঝবয়সী লোকটি কঠোর হলেও ন্যায়পরায়ণ। ফ্লিন্টের এ অবস্থা দেখে এগিয়ে এল সে।

কি খবর, হার্পার? আমরা ডাক্তারের কাছে যাচ্ছি। যাবে নাকি? আবার রাসলারদের উপদ্রব, বলল সলটার।

দীর্ঘ পদক্ষেপে ওদের কাছে পৌঁছে গেল শেরিফ। ওরা গুলি করেছে?

ওরাই তো করবে। আমি নিজেকে গুলি করব নাকি? প্রায় চিৎকার করে উঠল ফ্লিন্ট।

চুপ করে রইল শেরিফ।

সলটার পৌঁছে গেল ডাক্তারের বাড়ির সামনে। দ্রুত নেমে পড়ল স্যাডল থেকে। ধীরে ধীরে ঘোড়া থেকে নামার চেষ্টা করল ফ্লিন্ট। ওর সব শক্তি আর সহ্যক্ষমতা যেন শেষ হয়ে গেছে। দ্রুত ওর দুপাশে পৌঁছে গেল সলটার আর শেরিফ। দু’পাশ থেকে ধরে ওকে নামাল। নিয়ে চলল ডাক্তারের বাড়ির দিকে।

মারাত্মক জখম? প্রশ্ন করল শেরিফ।

কাঁধে লেগেছে, খুব মারাত্মক কিছু নয়। তবে রক্ত পড়েছে প্রচুর, সলটার বলল।

ডাক্তারের সার্জারিতে নিয়ে যাওয়া হল ফ্লিন্টকে। বসানো হল গদিওয়ালা কাউচে। শেরিফ গেল ডাক্তার ডাকতে। এই ফাঁকে ফ্লিন্টকে শুইয়ে দিল সলটার। গায়ে কম্বল চাপা দিল। শেরিফ ডাক্তার নিয়ে ফিরে এল। ডাক্তার তার সরঞ্জাম ধোয়ার কাজ শুরু করতেই হার্পার বলল, পুরো ঘটনাটা খুলে বল তো, সলটার, তুমি এতে জড়ালে কিভাবে?

সলটার নিজের দেখা আর ফ্লিন্টের মুখে শোনা সব ঘটনা খুলে বলল। মন দিয়ে শুনল শেরিফ। সব শোনা হলে পর বলল, ওদের কাউকে চিনতে পেরেছ?

একশ গজ দূর থেকে দেখেছি। চেনার প্রশ্নই ওঠে না। ঘোড়াগুলোও অপরিচিত, জবাব দিল সলটার।

আমি বুঝি না গরু চোরের দল আসে কোত্থেকে, আবার চুরি করে পালায়ই বা কোথায়। চেষ্টার ত্রুটি তো করছি না আমি। ফল পাচ্ছি কই? অসহিষ্ণু গলায় বলল শেরিফ।

দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল সলটার। ওদের সাহস দিনকে দিন বেড়েই চলেছে। গুলি করতেও দ্বিধা করছে না ওরা। দেখি, র‍্যাঞ্চে ফিরে জর্জের সঙ্গে কথা বলব।

অবশ্য ইদানীং কোন ব্যাপারেই মন নেই তার। হয়ত বয়স একটা কারণ, বলল। সলটার।

কত আর বয়স! আমার মতই হবে, দ্রুত বলল শেরিফ। মুচকি হাসল। সলটার। শেরিফের আঁতে ঘা লেগেছে।

জর্জের ব্যাপারটা আলাদা, ও তো আর তোমার মত একা নয়। দু’দুটো উঠতি বয়সের ছেলেমেয়ে সামলাতে হয় তাকে। তানিয়াকে নিয়ে অবশ্য চিন্তা নেই তার। ওকে আসলে ভোগাচ্ছে জোহান।

ছোকরাটাকে প্রায়ই শহরে দেখি, বলল শেরিফ। জর্জ আমার পুরানো বন্ধু, ওকে ভালমতই চিনি আমি। মনে হয় ছেলেকে লাইনে আনতে পারবে সে।

পারলেই ভাল, বলল সলটার। চোখ জোড়া সরু হল এক মুহূর্তের জন্যে। ওর দৃষ্টি গেল ফ্লিন্টের কাঁধে। ক্ষতস্থান থেকে সরু লম্বা একটা যন্ত্র বার করছে ডাক্তার। দলা পাকানো একটা সীসের টুকরো চিমটের মত যন্ত্রটায় আটকে রয়েছে। শিউরে উঠল সলটার। কিন্তু ফ্লিন্টের কোন ভাবান্তর নেই। আবার শেরিফের দিকে দৃষ্টি দিল সে।

জোহানের সঙ্গে স্যালুনের মেয়েটার কি সম্পর্ক? জান কিছু?

হেলগার কথা বলছ? বলল শেরিফ। মেয়েটা ম্যাকগ্র-র বান্ধবী। ওর সঙ্গে মাখামাখি করছে জোহান। আশ্চর্য ব্যাপার, ম্যাকগ্র কিছুই বলছে না, অথচ গত বছর একজনকে খুন করতে বসেছিল সে। হেলগার প্রতি নাকি অতিরিক্ত আগ্রহ দেখাচ্ছিল লোকটি।

হুঁ, চিন্তিত ভঙ্গিতে বলল সলটার। ম্যাকগ্রর মতলবটা জানা দরকার আমার।

আমি জানতে চাই রাসলারদের রহস্য, দৃঢ় কণ্ঠে বলল শেরিফ।

ওই তিন রাসলারের ট্র্যাক পরীক্ষা করে দেখতে পার, সলটার বলল। আমার সঙ্গে আজই চল, আমি জায়গামত নিয়ে যাব। অসকারের রেঞ্জের ওপর দিয়ে পালিয়েছে ওরা। কাজেই খুঁজে বার করতে অসুবিধে হবে না।

আমিও তাই ভাবছিলাম, বলল শেরিফ। কিন্তু এখন গিয়ে কি আর লাভ হবে? ট্রাক মুছে দেয়া ওদের জন্যে অসম্ভব কিছুই নয়। এর আগে কয়েকবার রেড রিজ পর্যন্ত রাসলারদের ধাওয়া করে গিয়েছিলাম। তারপর আর খুঁজে পাইনি।

ওপথেই গরু পাচার হচ্ছে, বলল সলটার, তারমানে প্রতিবারই অসকারের র‍্যাঞ্চ পেরোচ্ছে ওরা।

অসকারের লোকজন এর সঙ্গে জড়িত রয়েছে মনে করছ তুমি? তা না-ও হতে পারে। কারও না কারও র‍্যাঞ্চের ওপর দিয়ে তো গরু তাড়িয়ে নিতে হবেই। অসকারের র‍্যাঞ্চের ওপর দিয়ে নিচ্ছে। এতে কিছু প্রমাণিত হয় না, শেরিফ বলল।

তা হয়ত হয় না। তবে নজর রাখতে তো আর ক্ষতি নেই। আমি জর্জকে বলব পাহারা বসাতে। আমাদের লোকেরা পাহারা দিলে কিছু না কিছু জানা। যাবেই।

ওদের সঙ্গে আমি থাকতে পারলে ভাল হত, বলল শেরিফ। কিন্তু জানই তো একজন মাত্র ডেপুটি আমার। তা-ও আবার ভরসা করার মত নয়। তাই সব কিছুতেই হাজারবার ভাবতে হয়।

মাথা ঝাঁকিয়ে সায় দিল সলটার।

শেরিফের ডেপুটি ডিক উইলসনকে দুচোখে দেখতে পারে না সে। তানিয়ার সঙ্গে দেখা হলেই ব্যাটা ঘেঁসাঘেঁসি করতে চায়। তানিয়ার আশপাশে কাউকেই সহ্য করতে পারে না ও।

দেখি জোহানের খোঁজ করি গিয়ে, দরজার দিকে এগোতে এগোতে বলল সলটার। তুমি স্পটে যেতে চাইলে তোমাকে নিয়ে আধ ঘণ্টার মধ্যে রওনা দেব আমি। জোহানকে তো স্যালুনেই পাওয়া যাবে। কি বল? শেরিফকে প্রশ্ন করল সলটার।

হ্যাঁ। কাল সারারাত ওখানেই ছিল সে। আজ সকালেও যেতে দেখেছি।

একটা ব্যাপার বুঝি না, দরজার কাছে পৌঁছে বলল সলটার, ম্যাকগ্র আর আমি একই কাজ করি, দুজনেই ফোরম্যান। ও এত অবসর পায়, কিভাবে? আমার তো কাজের চাপে ঘুম প্রায় হারাম।

মানুষে মানুষে তফাৎ আছে। সবাই তো আর তোমার মত নয় যে কাজ নিয়ে পাগল। তাছাড়া ম্যাকগ্রর বস্ র‍্যাঞ্চে থাকে না। জানই তো কেন, বলল শেরিফ।

চুপ করে রইল সলটার, জবাব দিল না।

তুমি একা ফিরতে পারবে, ফ্লিন্ট? নাকি আমি পৌঁছে দেব? প্রশ্ন করল সলটার।

পারব, সলটার, বলল ফ্লিন্ট। ছেলেরা আমার খোঁজে শহরে আসবেই।

<

Super User