কোথাও ঢুকে একটা হ্যামবারগার খেয়ে নিলে কেমন হয়? প্রস্তাব দিল মুসা আমান।

গ্রীষ্মের ছুটি শুরু হয়েছে। ওদের প্রিয় সৈকতে সাঁতার কাটতে গিয়েছিল তিন গোয়েন্দা-কিশোর পাশা, মুসা আমান আর রবিন মিলফোর্ড। প্রায় সারাটা দিনই কাটিয়েছে সৈকতে। সাগর পাড়ের রাস্তা ধরে সাইকেলে করে রকি বীচে বাড়ি ফিরছে এখন। দক্ষিণ ক্যালিফোর্নিয়ার উপকূলবর্তী ছোট্ট একটা শহর রকি বীচ, সান্তা মনিকা থেকে কয়েক মাইল দূরে।

গোয়েন্দা সহকারীর প্রস্তাবে রাজি হয়ে গেল রবিন, সাইকেলের গতি বাড়িয়ে পাশাপাশি হলো মুসার।

যে কোন ব্যাপারে ঠাণ্ডা মাথায় ভালমত খতিয়ে দেখা স্বভাব প্রধান গোয়েন্দা কিশোর পাশার। সাইকেল চালিয়ে গরম হয়ে উঠেছে শরীর, সারা দিন সাঁতার কেটে ক্লান্ত। ভেবে দেখল, মুসার কথাটা মন্দ না। তারও খিদে পেয়েছে। সামনেই পথের পাশের পাহাড় চূড়ায় পুরানো স্ন্যাকস রেস্টুরেন্টটায় থেমে কিছু খেয়ে নিলে ভালই হয়, পেটও ঠাণ্ডা হবে, বিশ্রামও হবে।

কিন্তু হ্যাঁ বলল না কিশোর, আরও খতিয়ে ডাবল। এখন বাজে বিকেল তিনটে, নাস্তা করেছে সেই সকাল ছটায়। কিছু মুখে না দিয়ে বাড়ি ফিরলে–মেরিচাচী যদি শোনেন-এত বেলা পর্যন্ত কিছু খায়নি ওরা, বকা যে কি পরিমাণ দেবেনো, খেয়ে নেয়াই ভাল।

ঠিক আছে, চেঁচিয়ে সামনের দুই সঙ্গীকে বলল কিশোর সামনে থাম। ওশনসাইড রেস্তোরায় খাব।

এ-সময়ে ভিড় থাকে না, এক-দেড় ঘণ্টা আগেই দুপুরের খাওয়া খেয়ে চলে গেছে লোকে। রেস্তোরা প্রায় খালি। রাস্তার দিকে একটা জানালার পাশে বসল তিন গোয়েন্দা। পা লম্বা করে দিয়ে চেয়ারেই আধশোয়া হয়ে পড়ল মুসা। মেনু দেখায় মন দিল রবিন।

ঘরে যে কজন খদের আছে তাদেরকে দেখছে কিশোর। লোকের চেহারা দেখে তাদের স্বভাব অনুমান করা তার হবি। তাছাড়া সব জিনিসই খুব খুঁটিয়ে দেখে সে, কোথাও এতটুকু ফাক রাখতে চায় না।

একটা লোক বিশেষভাবে কিশোরের দৃষ্টি আকর্ষণ করল। হালকা-পাতলা, ওদেশের মানুষের তুলনায় বেটেই বলা চলে, পাঁচ ফুট পাঁচের বেশি না। গাঢ় বাদামী সুট পরনে, সাদা শাট-গলার কাছে দুটো বোতাম খোলা, চোখা কালো জুতো, অবিশ্বাস্য রকমের বড় পায়ের পাতা। বুক পকেটে ভঁজ করে রাখা একটা মুক্তোশিকার কাগজ, তার কয়েকটা শব্দ বেরিয়ে আছে, পড়া যায়, তা থেকেই বুঝল কিশোর, লোকটার ঘোড়দৌড়ের নেশা আছে, জুয়াড়ী।

কাউন্টারের সামনে এক কাপ কফি নিয়ে টুলে বসেছে লোকটা, খালি নড়ছে, উসখুস করছে, খানিক পর পরই মাথা বাড়য়ে জানালা দিয়ে উঁকি মারছে রাস্তার দিকে। বেশ বড়সড় টুলে বসেছে, পাশে রেখেছে- চার কোণা একটা বাক্স, একটু পর পরই ছুঁয়ে দেখছে বাক্সটা জায়গামত আছে কিনা। যেন কেউ নিয়ে যাবে ওটা। একটা জালি কাপড় দিয়ে মোড়া বাক্স, কাপড়ের জোড়াগুলো নিপুণভাবে টেপ দিয়ে আটকানো।

আরেকবার জানালার বাইরে লোকটা উঁকি দিতেই কিশোরও মাথা খানিকটা সরিয়ে চট করে দেখে নিল রাস্তায় কি দেখা যাচ্ছে। একই সঙ্গে চোখের কোণ দিয়ে লোকটার ওপরও নজর রেখেছে।

কই, তেমন কিছু তো না। প্রায় নিঃশব্দে চলে গেল কয়েকটা লিমোসিন। ওগুলোকে গুরুত্ব দিল না লোকটা। তারপর শোনা গেল মোটরের জোরাল গো গো, আরেকটা গাড়ি আসছে। টুল থেকে লাফিয়ে উঠে জানালা দিয়ে বাইরে চেয়ে রইল নোকটা, সতর্ক দৃষ্টি, কারও আসার অপেক্ষা করছে বুঝি। একটা ক্যাম্পার গাড়ি দেখা গেল। আবার এসে টুলে বসে পড়ল সে।

ভারি কোন গাড়ি-ভ্যান বা ট্রাক জাতীয় কিছুর অপেক্ষায় রয়েছে লোকটা-ডাকল কিশোর।

হ্যামবারগার নিয়ে এল ওয়েইটেল। নিজের প্লেট টেনে নিল কিশোর। বন রুটির ওপরের অংশ ছিড়ে আলাদা করে রেখে মাংসসহ বাকিটুকু তুলে নিয়ে কামড় বসাল।

অবাক কাণ্ড! চোখ টিপল লোকটা।হেসে তার জবাব দিল কিশোর।

ব্যাপারটাকে আমন্ত্রণ ধরে নিল লোকটা। চারকোণা বাক্সটা হাত নিয়ে এগিয়ে এল তিন গোয়েন্দার দিকে।

সাঁতার কাটতে গিয়েছিলে? সাধারণ একটা প্রশ্ন, লোকটার বলার পরনে বিশেষ অর্থবহ হয়ে উঠল। চোখও টিপল সেই সঙ্গে।

হ্যাঁ, হ্যামবারগারে মুখ বোঝাই মুসার, হাসতে পারছে না ঠিকমত। উইলস বীচে।

উইলস বীচ? মুসার কথার প্রতিধ্বনি করল যেন লোকটা। এজন্যেই এত খিদে পেয়েছে। চোখ টিপল।

এমনি একটা কথার কথা বলল লোকটা, তাতে হাসির কিছু নেই, কিন্তু হেসে ফেলল তিন গোয়েন্দা। কথার সঙ্গে চোখ টেপাটা বেশ মজার মনে হয়েছে ওদের কাছে।

লোকটাও হাসল।

বসি তোমাদের কাছে? চোখ টিপল লোকটা।

জানালার কাছে রে সরিয়ে নিল কিশোর, তার পাশের খালি চেয়ারে বসল লোকটা। বাক্সটা নামিয়ে রাখল মেঝেতে।

আমার নাম মেটার, অসকার স্লেটার, বলতে বলতেই ডান চোখ টিপল বেশ জোর দিয়ে।

নিজেদের নাম বলল তিন গোয়েন্দা।

পরিচিত হয়ে খুশি হলাম, স্বাভাবিক কথা, কিন্তু লোকটার চোখ টেপ অস্বাভাবিক করে তুলল কথাটা ভারি এঞ্জিনের শব্দ শোনা যেতেই লাফিয়ে উঠে জানালা দিয়ে উঁকি দিল একটা তেলের ট্রাক চলে গেল। আবার বসে পড়ল সে।

আমার নাম স্লেটার বটে, বলল সে, কিন্তু চোখ টিপি বলে সবাই ডাকে রিংকি। বলতে বলতেই আরেকবার চোখ টিপল।

এবার আর হাসি এল না ছেলেদের, খারাপ লাগছে লোকটার জন্যে। চোখ সে ইচ্ছে করে টেপে না, এটা তার মুদ্রাদোষ। চেষ্টা করেও ঠেকাতে পারে না।

এক সঙ্গে বসে চা খেলো ওরা। একটা দশ ডলারের বিল ওয়েইট্রেসের হাতে ধরিয়ে দিয়ে স্লেটার বলল, হ্যামবারগারের দামও রাখুন, চোখ টিপল। না না, মানা কোরো না। আমি তোমাদের খাওয়ালাম। বন্ধু ভাবতে আপত্তি আছে? চোখ টিপল।

কোমরে হাত রেখে দাঁড়িয়েছে ওয়েইট্রেস, স্লেটারের চোখ টেপার কি অর্থ করেছে কে জানে, রাগ দেখা গেল তার চোখে। কিছু বলতে গিয়েও বলল না। নোটটা নিয়ে গটমট করে হেঁটে চলে গেল। বিল রেখে ভাঙতি নিয়ে ফিরে এল।

মেহমানদারীর জন্যে সেটারকে ধন্যবাদ জানাল ছেলেরা।

পরের কয়েক মিনিটেও ভারি কোন এঞ্জিনের শব্দ শোনা গেল না। সেটার উত্তেজিত, কথা বলার পরিবেশ নয়। তাছাড়া কি বলবে? অর্ধেকটা রুটি রেখে দিয়েছিল বলে নিজেই নিজেকে ধন্যবাদ জানাল এখন কিশোর, চুপচাপ খাচ্ছে ওটা,

কথা বলতে হচ্ছে না উসখুস করছে অন্যেরা।

অবশেষে কিশোরই সহজ করল পরিবেশ। জিজ্ঞেস করল, সান্তা মনিকায় থাকেন আপনি, না?

ঝট করে সোজা হয়ে গেল স্লেটার। হাত চলে গেল বাক্সের ওপর। পরের কয়েকটা সেকেণ্ড তার ডান চোখটা দ্রুত বার বার উঠল নামল। কি করে জানলে? শুকনো কণ্ঠ।

লোকটাকে চমক দিতে চায়নি কিশোর। হাসল। না না, তেমন কিছু ভেবে বলিনি। এটা আমার কাছে খেলা; এক ধরনের খেলা, বুঝিয়ে বলল সে। পার্কিং লটে তিনটে গাড়ি দেখলাম। একটার সামনের সীটে একটা খেলনা ভালুক পড়ে আছে। ধরে নিলাম ওটা ওই মহিলার, ওই যে সলে একটা মেয়ে। আরেকটা গাড়ির ছাতে দেখলাম সাফবোর্ড বাধা। সুগঠিত স্বাস্থ্য, রোদে পোড়া বিবর্ণ চুল এক তরুণ কোক খাচ্ছে কাউন্টারের কাছে দাঁড়িয়ে, তাকে দেখিয়ে বলল গোয়েন্দা প্রধান, ওই গাড়িটা ওর। কি করে বুঝলাম? স্বাস্থ্য আর চুল দেখেছেন? সার্ফবোর্ড নিয়ে ঢেউয়ের ওপর দিয়ে ছুটে চলা ওকেই মানায়, না? স্লেটারের দিকে চেয়ে মাথা নাড়ল সে। বাকি থাকল আর একটা গাড়ি। সান্তা মনিকার নাম্বার প্লেট।

নীরবে কিশোরের দিকে চেয়ে আছে সেটার। চমৎকার খেলা। একেবারে গোয়েন্দাগিরি।

গোয়েন্দাই আমরা, কথাটা গোপন রাখার প্রয়োজন দেখল না কিশোর। এরা দুজন আমার সহকারী।

পকেট থেকে একটা কার্ড বের করে স্লেটারের দিকে বাড়িয়ে ধরল সে।

বিড়বিড় করে পড়ল লোকটা, কিশোর পাশা, গোয়েন্দাপ্রধান…মুসা আমান, সহকারী গোয়েন্দা…রবিন মিলফোর্ড, নথি গবেষক।…, টেলিফোন নম্বরটাও পড়ল। পাশা স্যালভিজ ইয়ার্ডের নম্বর নয়, তিন গোয়েন্দার ব্যক্তিগত টেলিফোন নম্বর। নিজেদের রোজগার থেকে ওটার বিল দেয় ওরা।

আশ্চর্যবোধক চিহ্নগুলো কেন? জিজ্ঞেস করল স্লেটার।

অদ্ভুত সব রকম রহস্যের কিনারা করতে আমরা প্রস্তুত, বিশেষ বিশেষ সময়ে দুর্বোধ করে কথা বলা কিংবা কঠিন শব্দ ব্যবহার করা কিশোরের স্বভাব।

মাথা ঝাঁকাল স্লেটার। কি ভেবে কার্ডটা রেখে দিল পকেটে। খুব বেশি:… থেমে গেল সে।

কি বলতে চেয়েছিল-বেশি রহস্য, বেশি মক্কেল, না বেশি কেস-বোঝা গেল। লাফিয়ে উঠে গিয়ে দাঁড়িয়েছে জানালার কাছে। ভারি মোটরের গর্জন,কানে আসছে। শব্দের অসঙ্গতিই প্রকাশ করে দিচ্ছে, দোষ আছে এঞ্জিনে।

কিশোরও তাকিয়ে আছে জানালা দিয়ে। পাহাড়ী পথের মোড় ঘুরে গো গো করতে করতে আসছে একটা গাড়ি। ড্রাইভারকে জাপানী বলে মনে হলো।

স্লেটারের দিকে ফিরল কিশোর। কিন্তু আগের জায়গায় নেই…দরজার কাছে চলে গেছে। আরেক মুহূর্ত পরেই বেরিয়ে ছুটে যাবে পারকিং লটের দিকে।

সবার আগে লাফ দিয়ে উঠল মুসা। নিয়মিত ব্যায়াম করে, শরীরের ক্ষিপ্রতাও তাই অন্য দুজনের চেয়ে বেশি। মেঝেতে রাখা বাক্সটা থাবা দিয়ে তুলে দৌড় দিল লোকটার পেছনে। এই যে, শুনুন, চেঁচিয়ে ডাকল সে, আপনার বাক্স…।

থামল না স্লেটার।

পেছন পেছন দৌড়াল মুসা। কিন্তু দেরি হয়ে গেছে। গাড়িতে উঠে দরজা বন্ধ করছে স্লেটার। স্টার্ট নিয়ে শাঁ করে বেরিয়ে গেল দুই দরজার কালো সিডান গাড়িটা, হাইওয়েতে উঠেই স্পীড বাড়িয়ে দিল।

ফিরে এল মুসা। বাক্সটা নামিয়ে রাখল টেবিলের পাশে।

নিচের ঠোঁটে চিমটি কাটছে কিশোর, গভীর ভাবনায় মগ্ন। চিমটি কাটে কেন জিজ্ঞেস করেছে মুসা। কিশোরের জবাব, এতে নাকি তার একাগ্রতা আনতে

সুবিধে হয়।

বাক্সটা ওয়েইট্রেসের কাছে রেখে যাব, রবিন বলল। রিংকি শিওর ফিরে আসবে। ওটা নিতে।

মুসাও তার কথায় সায় দিল।

কিন্তু কিশোর চুপ। চিমটি কেটেই চলেছে। সবুজ ভ্যান দেখে স্লেটারের অস্বাভাবিক উত্তেজনা কৌতূহলী করে তুলছে তাকে। তার সদা-সন্দিহান মন সব প্রশ্নের জবাব খোজে, জবাব না পাওয়া পর্যন্ত নিরস্ত হয় না।

আমি বলি কি, বাক্সটা হেডকোয়ার্টারে নিয়ে যাওয়া যাক, অবশেষে মুখ খুলল কিশোর, তার ধারণা আরেকটা রোমাঞ্চকর জটিল রহস্যের সন্ধান মিলতে যাচ্ছে। যত্ন করে রেখে দেব। রংকি যোগাযোগ করবেই। ওর কাছে আমাদের ফোন নম্বর আছে। প্রতিবাদ করার জন্যে মুসা মুখ খুলতে যাচ্ছে দেখে তাড়াতাড়ি বলল, তাছাড়া ওয়েইট্রেসের কাছে বাক্সটা ফেলে যায়নি রিংকি, তাই না? আমাদের কাছে রেখে গেছে। আমাদের বিশ্বাস করেছে?

বিশ্বাস না ছাই, বাধা দিলই মুসা। ভুলে ফেলে গেছে। বলল বটে, কিন্তু জানে সে, কোন লাভ হবে না। একবার যখন সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছে কিশোর, বাক্সটা নিয়ে যাবেই।

আধ ঘণ্টা পর, হেডকোয়াটারে ফিরে এল তিন গোয়েন্দা।

পাশা স্যালভিজ ইয়ার্ডে তিরিশ ফুট লম্বা একটা মোবাইল হোম ট্রেলারের ভেতরে ওদের হেডকোয়ার্টার। অনেক দিন আগে পুরানো মাল হিসেবে কিনে এনেছিলেন ওটা কিশোরের চাচা রাশেদ পাশা! এতই বাতিল, বিক্রি করতে। পারেননি। জঞ্জালের তলায় চাপা পড়ে গেছে এখন পুরোপুরি। ওটাকেই মেরামত করে ঠিকঠাক করে হেডকোয়ার্টার বানিয়েছে কিশোর, বেরোনো আর ঢোকার জন্যে কয়েকটা গোপন পথ আছে, জানে শুধু ওরাই।

ট্রেলারের ভেতরে সাজানো-গোছানো ছোট্ট একটা অফিস আছে, চেয়ারটেবিল-ফাইলিং কেবিনেট, সবই আছে তাতে। ডেস্কের ওপর রয়েছে টেলিফোন। ছোট একটা আধুনিক ল্যাবরেটরি, আর ফটোগ্রাফিক ডার্করুমও রয়েছে ট্রেলারে।

সাইকেলের ক্যারিয়ারে করে বাক্সটা এনেছে মুসা, অফিসে ঢুকে নামিয়ে রাখা ডেস্কের ওপর। নিয়ে তো এলাম অন্যের জিনিস, খুশি হতে পারছে না সে। কি করবে এখন? খুলে দেখবে?

ডেস্কের ওপাশে তার সুইভেল চেয়ারে বসেছে কিশোর। মাথা নাড়ল। সেটা বোধহয় উচিত হবে না… থেমে গেল। কুঁচকে গেছে ভুরু। কাত হয়ে কান ঠেকাল অয়েলপেপারে মোড়া বাক্সটার গায়ে।

শুনতে পাচ্ছে তিনজনেই। বাক্সের ভেতর মৃদু ফড়ফড় শব্দ। জীবন্ত কিছু একটা রয়েছে।

খাইছে! বলে উঠল মুসা। আর ফেলে রাখা গেল না। খুলতেই হচ্ছে।

জন্তু-জানোয়ারের ভক্ত মুসা। আগে প্রায়ই রাস্তা থেকে ভবঘুরে কুকুর-বেড়াল ধরে নিয়ে আসত পোষার জন্যে। একদিন তো কোথা জানি একটা রোমওঠা, রোগা, বেতো গাধাই ধরে নিয়ে এসেছিল। মুসার মা তার ঠিক উল্টো, দুচোখে দেখতে পারে না জন্তু-জানোয়ার। কুকুর বেড়াল পর্যন্ত সহ্য করেছেন তিনি, কিন্তু গাধাটাকে আঁটাপেটা করে তাড়িয়েছেন, দু-এক ঘা মুসার পিঠেও পড়েছে। এখন বাক্সের ভেতরে নড়াচড়া শুনে তার পুরানো ভালবাসা মাথাচাড়া দিয়ে উঠল, হয়তো পোষার মত কিছু পাওয়া যাবে, এমন কিছু যাতে মা আপত্তি করবেন না।

ফড়াত করে এক টানে বাক্সের কোণের চীজকুথ ছিড়ে ফেলল মুসা। খানিকটা তারের জাল দেখা গেল! পুরো কাগজটাই ছাড়িয়ে নিল সে। জালের খাঁচার ভেতরে একটা কবুতর।

খুব সুন্দর একটা পাখি। ফুলে থাকা পালক, হাত পাখার মত ছড়ানো লেজ। গাঢ় ধূসর পালকগুলো এত চকচকে, আলাদা একটা উজ্জ্বল বেগুনী আভা ছড়াচ্ছে।

কিশোরই প্রথম লক্ষ করল খুঁতটা, পাখিটার একটা আঙুল নেই। ডান পায়ে তিনটেই আছে, কিন্তু বাঁ পায়ে দুটো।

এত ছোট খাঁচায় রাখা যাবে না, বলল মুসা। যদি রাখতেই হয়, রেখেই দিই কি বলো? হ্যাঁ, তাহলে বড় আরেকটা খাঁচা বানিয়ে নিতে হবে।

হ্যাঁ, একমত হলো কিশোর। চার বাই দুই ফুট ছ-টা জাল লাগবে। কিছু তার কাটা, একটা হাতুরি। তক্তা লাগবে কয়েকটা।

ইয়ার্ডেই পাওয়া গেল সব। পুরানো মালের ডিপো, এসব জিনিসের অভাব নেই। তিন গোয়েন্দার ব্যক্তিগত ওয়ার্কশপে কাজ চলল। কবুতরটার জন্যে আরামদায়ক শক্ত একটা খাঁচা বানিয়ে ফেলল ওরা দেখতে দেখতে।

অফিস থেকে পাখিটাকে নিয়ে এল মুসা। একটা প্লাসটিকের বাকেটে কিছু গমের দানা রেখে খাঁচার ভেতরে ঠেলে দিল কিশোর। পানির বন্দোবস্ত করল রবিন।

ছোট খাঁচা থেকে বের করে বড় খাঁচায় কবুতরটাকে ঢুকিয়ে দিল মুসা। যাও, আরাম করে থাকো।

বেশ সুখী মনে হলো পাখিটাকে। গমের দানা করে খেলো কিছুক্ষণ, পানিতে ঠোঁট ডুবিয়ে ঝটকা দিয়ে ওপরের দিকে তুলে তুলে পানি খেতে লাগল। বার দুই বাগবাকুম করে খাঁচার কোণায় গিয়ে পাখার ভেতরে মাথা ঢুকিয়ে বসে পড়ল। তার জন্যে দিন শেষ, ঘুমানোর সময়।

পাখিটাকে ওয়ার্কশপেই রেখে আঙিনায় বেরিয়ে এল ওরা। সাইকেল নিয়ে যার যার বাড়ি রওনা হলো মুসা আর রবিন, কিশোর চলে গেল তার ঘরের দিকে।

পরদিন খুব সকালে ঘুম থেকে উঠল কিশোর। হাতমুখ ধুয়ে কাপড় পরে চলে এল ওয়ার্কশপে।

দানা খাচ্ছে কবুতরটা, বেসাবে মনে হয়, রাতে কোন অসুকেধি হয়নি।

বসে পড়ে খাঁচার তারে নাক ঠেকাল কিশোর। দেখতে দেখতে বলল, কোথা থেকে এসেছ? ওই বাক্সে ভরে রেখেছিল কেন তোমাকে রিংকি? এত নার্ভাস দেখাচ্ছিল কেন তাকে?

কবুতরটাকে ঘিরে কোন একটা ঘোর রহস্য রয়েছে। কি, সেটা ভাবতে ভাবতেই হঠাৎ করে ব্যাপারটা চোখে পড়ল কিশোরের। রহস্যটা আরও ঘনীভূত হলো।

পাখিটার দুই পায়েই এখন তিনটে করে আঙুল।

<

Super User