বাবারে! বলে উঠল রবিন মিলফোর্ড। একেবারে আসল মালয়ী কিরিচ!

কিশোর পাশা আর মুসা আমানকে জিনিসটা দেখাল সে। চোখ চকচক করছে। বাড়ি থেকে মাইল কয়েক দূরের এক রোড সাইড মিউজিয়মে রয়েছে ওরা। আঙুল দিয়ে কিরিচের ধার পরখ করল মুসা।

বিজ্ঞের ভঙ্গিতে মাথা ঝাঁকাল কিশোর। প্রাচীন আমলে ঈস্ট ইণ্ডিজ থেকে অনেক জাহাজ আসত ক্যালিফোর্নিয়ায়, বলল সে। এই মিউজিয়মের বহু জিনিস এসেছে প্রাচ্য থেকে। নীরবে তার লেকচার শুনতে লাগল দুই সহকারী।

এই, কি বকবক শুরু করেছিস ওখানে? ঘরের আরেক প্রান্ত থেকে ধমক লাগালেন মেরিচাচী। সুযোগ পেলেই বক্তৃতা..আয়, এখানে সায়। ট্রাকে মাল তুলতে হবে না?

আসছি, বলে দুই সহকারীর মুচকি হাসি উপেক্ষা করে এগিয়ে গেল কিশোর।

বন্ধ করে দেয়া হচ্ছে মিউজিয়মটা। জিনিসপত্র সব বিক্রি করে দিচ্ছে। সেগুলোই কিনতে এসেছেন মেরিচাচী। সাহায্য করার জন্যে সঙ্গে নিয়ে এসেছেন তিন গোয়েন্দাকে। বড়দিনের ছুটির এই প্রথম দিনেই এরকম বিপদে পড়বে, ভাবতে পারেনি ওরা। তাহলে দূরে দূরে থাকত। অন্তত সকালবেলাটা মেরিচাচীর সামনে না পড়লেই চলত।

কি আর করবে? দীর্ঘশ্বাস ফেলে কাজে হাত লাগাল ওরা। এক এক করে জিনিস বয়ে নিয়ে গিয়ে দিতে লাগল ইয়ার্ডের কর্মচারী, বিশালদেহী ব্যাভারিয়ান বোরিসকে। সে ওগুলো ট্রাকে তুলতে লাগল। ছেলেদের মনের অবস্থা বুঝে আপনমনেই হাসল সে, মৃদু শিস দিতে শুরু করল।

জিনিসপত্র বুঝে নিতে গেলেন মেরিচাচী, মিউজিয়মের মালিক মিস্টার ব্যানারের কাছে।

ওখানকার কাজ শেষ করে আবার আগের জায়গায় ফিরে এলেন মেরিচাচী, ছেলেদের কাজ তদারক করতে। কয়েকটা বাক্স বাঁধায় হাত লাগালেন। মিস্টার ব্যানার গেলেন সামনের হলে, একজন লোকের সঙ্গে কথা বলার জন্যে, এইমাত্র এসেছে লোকটা।

খানিক পরেই মেরিচাচী আর ছেলেদের কানে এল একটা উত্তেজিত কাকে কি কথা দিয়েছেন সে-পরোয়া আমি থোড়াই করি!

শান্তকণ্ঠে বললেন মিস্টার ব্যানার, দেখুন…।

তাকে কথা শেষ করতে দিল না লোকটা। দেখাদেখির কিছু নেই! ওটা এখুনি চাই আমার।

মিউজিয়মের জিনিস নিয়েই কথা কাটাকাটি হচ্ছে, বুঝতে পারলেন মেরিচাচী। তাড়াতাড়ি এগোলেন-হলের দিকে। পেছনে চলল তিন গোয়েন্দা।

ব্যানার বলছেন, সরি, মিস্টার, সব বিক্রি হয়ে গেছে। এখন আর কিছু করার নেই।

সেগুন কাঠের একটা বাক্সের সামনে দাঁড়িয়ে আছেন তিনি। তামার কারুকাজ করা বাক্স। ওটার অন্যপাশে দাঁড়িয়ে আছে খাটো একজন মানুষ। মুখে কালো চাপদাড়ি। রোদেপোড়া কুঁচকানো চামড়া। কোটরে বসা ঘন কালো চোখ। গালে দুটো গভীর কাটা দাগ ঢুকে গেছে দাড়ির ভেতরে। পোশাক দেখে অনুমান করতে কষ্ট হয় না, লোকটা সদাগরী জাহাজের নাবিক।

জ্বলন্ত চোখে মিস্টার ব্যানারের দিকে চেয়ে প্রায় গর্জে উঠল সে, দেখুন, এই বাক্স আমার। আমি এটা ফেরত চাই। হুঁশিয়ার করে দিচ্ছি…।

ধৈর্যের বাঁধ ভাঙল মিউজিয়ম-মালিকের। শুনুন মিস্টার, আমি…।

মিস্টার মিস্টার করছেন কেন? আমার একটা নাম আছে। টিক বানাউ। লোকে নাম রেখেছে পানির পোকা, লোকটা জানাল গর্বের সঙ্গেই। অনেক পথ বয়ে এনেছি ওই বাক্স। ওটাতে বিপদ আছে, বুঝেছেন, বিপদ, ছেলেদের দিকে চোখ পড়তে বিড়বিড় করে কি বলল টিক, কে জানে, বোধহয় গালই দিল। ধমকে উঠল, এই, তোমাদের এখানে কি? সর, যাও, ভাগ। এই বেটি, তুমিও যাও?

চট করে মেরিচাচীর দিকে তাকাল একবার কিশোর। হাসি চাপতে কষ্ট হল।

রাগে টকটকে লাল হয়ে গেল মেরিচাচীর মুখ। কি, দাড়িওলা ছাগল! ভদ্রতা ভুলে চেঁচিয়ে উঠলেন তিনি। আমি বেটি, না! দেখাচ্ছি মজা! এই কিশোর, বোরিসকে ডাক তো…! কথা আটকে গেল তাঁর।

মহিলা এত রেগে যাবেন, কল্পনাও করেনি নাবিক। তাছাড়া কাজের পোশাক পরে এসেছেন মেরিচাচী, টিক মনে করেছে, কাজের লোক–টোকই হবে। এখন বুঝল, ভুল করে ফেলেছে।

ভুল করেছেন আপনি, মিস্টার পানির পোকা, লোকটার ব্যবহারে ব্যানারও রেগেছেন। একজন মহিলাকে অপমান করেছেন। জানেন উনি কে? রকি বীচের সব চেয়ে বড় স্যালভিজ ইয়ার্ডের মালিক। এখানকার সমস্ত জিনিসপত্র, ওই বাক্স, সবই কিনেছেন।

চোখ মিটমিট করল নাবিক। আমি…আমি দুঃখিত, ম্যাডাম। মেজাজ ঠিক রাখতে পারিনি। পানিতে পানিতে থাকি তো, ভদ্রতা আর কোথায় শিখব, বলুন? তাছাড়া অনেক দিন ধরে এই বাক্সটা খুঁজছি, আজ হঠাৎ পেয়ে গিয়ে মাথার ঠিক ছিল না।

লোকটা নরম হয়ে মাপ চাইতে মেরিচাচীও লজ্জিত হলেন। ছেলেরা বাক্সটা ঘিরে দাঁড়িয়েছে। হাত বুলিয়ে দেখছে। বললেন, এটা আপনার হলে এখানে এল কিভাবে?

চুরি গিয়েছিল, ম্যাডাম। এক হারামজাদা চুরি করেছিল আমার জাহাজ থেকে। হপ্তা দুই আগে স্যান ফ্রান্সিসকোয় ভিড়েছিল, তখন। নিয়ে গিয়ে বেচে দেয় সেকেণ্ডহ্যাণ্ড মাল বেচে ওরকম এক দোকানির কাছে। দোকানি সোজা পাঠিয়ে দিয়েছে এখানে। খোঁজ করতে করতে আমিও চলে এসেছি।

কিন্তু..।

মেরিচাচীর কথার মাঝখানে বলে উঠল রবিন, এই নামটা কার? ডালা তুলে ফেলেছে ওরা। ভেতরের দিকে লেখা লিটল মারমেইড নামটা দেখিয়ে জিজ্ঞেস করল, আপনার জাহাজের, মিস্টার বানা?

না, থোকা, টিক বলল। অনেক পুরানো বাক্স এটা। আমার হাতে পড়ার আগে কম করে হলেও পঞ্চাশ জনের হাত ঘুরে এসেছে। সিঙ্গাপুরে যখন বাক্সটা কিনলাম, তখনই ওই নাম দেখেছি।

ব্যানার জানালেন, গতকাল পেয়েছি এটা, মিসেস পাশা। মরিস ডিলম্যানকে বলে রেখেছিলাম, মিউজিয়মে রাখার মত জিনিস পেলেই যেন পাঠায়। পাঠিয়ে দিয়েছে। ব্যবসা যে ছেড়ে দিচ্ছি, একথা আর জানানো হয়নি ওকে।

ন্যায্য দাম দিতে রাজি আছি আমি, টিক বানাউ বলল।

বেশ, বললেন মেরিচাচী। ধরে নিলাম, জিনিসটা আপনার। মিস্টার ব্যানার কিনেছেন, তারপর আমার কাছে।

কথা শেষ করতে পারলেন না এবারেও।

বিচিত্র খড়খড় শব্দ হল।

কী…? বলতে গিয়ে থেমে গেল রবিন।

কট করে আরেকটা শব্দ হয়েছে।

ঝিক করে উঠল জিনিসটা। ডালার ওপর ঝুঁকে ছিল কিশোর, তার কানের পাশ দিয়ে শাঁ করে গিয়ে দেয়ালে বিধল একটা ছুরি।

<

Super User