ওটা বেলজিয়ান রেসিং হোমার, বলল রবিন। মানে, ওই দুটোই।

নতুন কবুতরটা দেখার পরই গিয়ে দুই সহকারীকে ফোন করেছে কিশোর। কিন্তু নানা কাজের ঝামেলায় লাঞ্চের পরে ছাড়া আলোচনায় বসতে পারল না ওরা।

রকি বীচ পাবলিক লাইব্রেরিতে পার্ট টাইম চাকরি করে রবিন, সকালে ওখানেই গিয়েছিল। ছুটির পর একটা বই খুঁজে বের করে নিয়ে এসেছে। বই খুলে বেলজিয়ান রেসিং হোমারের রঙিন একটা ছবি দেখাল সে।

ছবিটা দেখল কিশোর। তার সামনে ডেস্কের ওপরই রয়েছে ছোট খাঁচায় ভরা নতুন কবুতরটা, ওটার সঙ্গে ছবি মিলিয়ে দেখল।

ঠিকই বলেছ, মাথা দোলাল সে। দুটো পাখিই দেখতে অবিকল এক। শুধু যেটা হারিয়েছে, সেটার এক পায়ে আঙুল ছিল দুটো। দুটোই রেসিং হোমার, বইটা রবিনের দিকে ঠেলে দিল কিশোর।

খাঁচার ফাক দিয়ে আঙুল ঢুকিয়ে দিল মুসা, পাখিটার পালকে আঙুল বোলাল।

ব্যাপারটা পছন্দ হলো কবুতরের, ঘাড় কাত করে উজ্জ্বল চোখে তাকাল সে, সহকারী গোয়েন্দার দিকে।

এখানে প্রায়ই ওরকম ঘটে, কিশোরের দিকে তাকাল মুসা। খেয়াল করোনি? সৈকতের আশেপাশে অনেক বুনো পায়রা দেখেছি, দু-একটা করে আঙুল খোয়া গেছে।

আনমনে মাথা নোয়াল গোয়েন্দাপ্রধান। খেয়াল করেছে কি করেনি বোঝা গেল না এই ভঙ্গি থেকে। ইঁদুর ধরার কল দিয়ে পাখি ধরতে চেষ্টা করে হয়তো লোকে, বেচারা পায়রাগুলোর আঙুল কাটে। রবিনের দিকে তাকাল সে। কিন্তু এগুলোর নাম বেলজিয়ান হোমার হলো কেন?

কবুতরের বই থেকে মুখ তুলল রবিন। ওরা খুব ভাল উড়তে পারে। জন্মায়ই যেন ওড়ার জন্যে, রেসের ঘোড়া যেমন দৌড়ানোর জন্যে জন্মায়। ঘোড়া। বিশেষজ্ঞের মত কবুতর বিশেষজ্ঞও আছে, শত শত পাখির মধ্যে থেকেও আসল পাখিটা ঠিক চিনে বের করে ফেলে। বইয়ের একটা বিশেষ পাতা ঝুড়িতে কিংবা খাঁচায় ভরে-অনেক সময় খাঁচার চারদিকে ঢেকে নিয়ে যায় ওদেরকে লোকে। পাঁচ-ছয় শো মাইল দূরে নিয়ে গিয়ে ছেড়ে দেয়, পথ চিনে ঠিক বাড়ি ফিরে আসে। পাখিগুলো। ঘণ্টায় ষাট মাইল গতিতে উড়তে পারে, একটাও পথ হারায় না।

আবার বইয়ের দিকে তাকাল সে। বেলজিয়ামের জাতীয় খেলা এই কবুতর ওড়ানো। একবার করেছিল কি, একটা রেসিং হোমারকে ঢাকনাওয়ালা ঝুড়িতে ভরে জাহাজের অন্ধকার খোলে করে ইন্দো চায়নায় নিয়ে যাওয়া হয়েছিল। সাত হাজার মাইল পেরিয়ে, চব্বিশ দিন পর দেশে ফিরে এসেছিল ওটা, বেলজিয়ামে। পুরাটাই তার জন্যে অচেনা পথ ছিল।

হুঁ, বিড় বিড় করল কিশোর।

দেখি, বইটা নিয়ে মিনিটখানেক পড়ল মুসা। চেঁচিয়ে উঠল, খাইছে, খবর আনা-নেয়ার কাজও দেখছি করে কবুতর। জানতাম না তো। ঐতিহাসিক ব্যাপারস্যাপার। গল জয় করার সময় সীজার কবুতর ব্যবহার করেছিলেন। আমেরিকান আর্মি বহু বছর ধরে কবুতর কাজে লাগিয়েছে। এই তো কিছুদিন আগে, কোরিয়ার যুদ্ধেও নাকি কবুতর ব্যবহার হয়েছিল। কাণ্ড! নিয়মিত কবুতর ডাক বিভাগ নাকি ছিল লস অ্যাঞ্জেলেস আর ক্যাটালিনা দ্বীপের মাঝে। কিশোর, তুমি জানো এসব?

জবাব দিল না কিশোর। নিচের ঠোঁটে চিমটি কাটছে। খানিকক্ষণ পর বলল, প্রশ্ন দাঁড়াচ্ছে, কিভাবে? এবং কেন?

বই বলছে, কেউই সঠিক জানে না, কিভাবে পথ চিনে বাড়ি ফেরে ওরা, মুসার হাত থেকে বইটা নিল রবিন। ব্যাপারটা নিয়ে কর্নেল ইউনিভার্সিটিতে অনেক গবেষণা হয়েছে। বিজ্ঞানীদের ধারণা, বায়ুমণ্ডলের চাপের ওপর নির্ভর করে কবুতর।

বাতাসের চাপের তারতম্য নিখুঁতভাবে বুঝতে পারে, আর শ্রবণশক্তিও অত্যন্ত প্রখর ওদের। তবে এ-সবই অনুমান। এই যে, এখানে একজন প্রফেসর বলেছেন : পায়রা পথ চিনে কিভাবে বাড়ি ফেরে জানতে হলে ঠিক ওদের মতই হতে হবে আমাদের, ওদের মত অনুভব করতে হবে, ওদের মত করে ভাবতে হবে।

বন্দি থাকতে পাখিটার কেমন লাগছে, কি ভাবছে এখন, অনুমানের চেষ্টা করল রবিন।

মাথা নাড়ল কিশোর। কিভাবে ওরা বাড়ি ফেরে আমি জানতে চাইনি। আমার প্রশ্ন, এই পাখিটা কি করে খাঁচায় এল, আর দু-আঙুলেটাই বা গেল কোথায়? রাতের বেলা এই বদলটা কে করেছে? কি করে জানল, দু-আঙুলেটা কোথায় আছে? আর কেনই বা এই কাজ করল সে?

আমার দিকে চেও না, হাত নাড়ল মুসা, কিছু বলতে পারব না। টোকা দিয়ে পায়রাটাকে আবার আদর করল সে। মৃদু বাগবাকুম করে পালক ফুলিয়ে তার আদরের জবাব দিল পাখিটা, মনিব আদর করলে কুকুর আর বেড়াল যেমন করে অনেকটা তেমনি। একটা নাম দেয়া দরকার। কি রাখা যায়, বলত? টম?

এক নম্বর, মুসার কথা যেন শুনতেই পায়নি কিশোর, রিংকি নিজেই পাখিটাকে সরিয়েছে। আমাদের কার্ড আছে ওর কাছে। রকি বীচে আমরা পরিচিত। যে কাউকে জিজ্ঞেস করলেই দেখিয়ে দেবে কিশোর পাশা কোথায় থাকে।

হ্যাঁ, তা দেবে,মুসা মাথা দোলাল।

নাম্বার টু, কথা অব্যাহত রাখল কিশোর, রিংকি যাকে অনুসরণ করেছে, সেই সবুজ ভ্যানওয়ালাও এ-কাজ করতে পারে। পথের মোড়ে গাড়ি রেখে ঘাপটি মেরে ছিল, মুসার সাইকেলে বাক্সটা দেখে পিছু নিয়ে আমাদের জায়গা চিনে গেছে। তবে এটা ঠিক মেনে নেয়া যায় না। সাইকেলের পেছনে এলে দেখতে পেতাম। তবুও, গভীর হয়ে তাকাল পাখিটার দিকে, যেন সব দোষ ওটার। রিংকি আর তার সবুজ গাড়িটার দিকে, যেন সব দোষ ওটার। রিংকি আর তার সবুজ গাড়িঅলা সঙ্গীর সম্পর্কেও কিছু জানি না আমরা। রিংকির ঠিকানা জানি না, শুধু জানি, সান্তা। মনিকায় কোথায় থাকে। গাড়ির নাম্বার প্লেটে এমও কে লেখা দেখেছি, এত তাড়াতাড়ি গাড়ি ঘুরিয়ে চলে গেল, নম্বরটা পড়তে পারিনি। সবুজ ভ্যানের প্লেটে কাদা লেগে ছিল, পড়া যাচ্ছিল না। কোন সূত্র নেই আমাদের হাতে, একটা ব্যাপার বাদে।

কী? আগ্রহে সামনে ঝুঁকল মুসা।

পায়রা। সাধারণ কবুতর নয়। খুব সাবধানে যত্ন করে বড় করা, নিখুঁত টেনিং দেয়া রেসিং হোমার। রেসের ঘোড়ার মত এসব নিয়ে যেসব লোক মাথা ঘামায় তাদের একজন আরেকজনকে চেনার কথা। সম্ভাবনাটা খুবই জোরাল। নিশ্চয় কোন ক্লাব বা সংগঠন রয়েছে যেখানে মিলিত হয় ওরা, বলতে বলতেই হাত বাড়িয়ে টেলিফোন গাইড টেনে নিল। ওই কবুতর পোষে কিংবা ট্রেনিং দেয় এমন কারও খোঁজ পেলে পাখিটা দেখানোও যাবে। চেনে কিনা জানা যাবে…।

পাখি পাখি করছ কেন? প্রতিবাদ করল মুসা। নাম বললেই হয়। টম নামটা মন্দ কি?

হয়তো বলতে পারবে কে এটার মালিক! হলদে রঙের পাতাগুলো দ্রুত উল্টে চলল কিশোর, সেই সঙ্গে বিড় বিড় করে গেল, পি ফর পিজিয়ন…এ ফর অ্যাসোসিয়েশন…সি ফর ক্লাব। তারপর প্রায় মিনিটখানেক নীরব রইল মুখ, আঙুলগুলো কাজ করেই গেল, তীক্ষ্ণ চোখে পরীক্ষা করল পাতার পর পাতা। অবশেষে হতাশ কণ্ঠে বলল, নাহ্ কিচ্ছু নেই। শুধু পি ফর পেট শপ, পোষা পশুপাখির দোকান, শেষ তিনটে শব্দ বাংলায় বলল।

কিংবা মিস কারমাইকেল, রবিন যোগ করল।

গাইড থেকে চোখ তুলল কিশোর। এই মিস কারমাইকেলটা কে?

প্রায়ই আমাদের লাইব্রেরিতে আসেন। বই যা নেন, সব পাখি সম্পর্কে লেখা! পাখি বলতে পাগনা! একবার জিজ্ঞেস করেছিলাম। বললেন, একটা পাখিসংগঠনের প্রেসিডেন্ট তিনি।

গাইড বুকটা বন্ধ করে কেবিনেটে রেখে দিল কিশোর। তাহলে তাকে গিয়ে ধরতে হয়। কবুতর বিশেষজ্ঞ কেউ আছে কিনা হয়তো তিনি জানবেন। মহিলার ঠিকানা জানো?

না, গাল চুলকাল রবিন। তবে রকি বীচেই থাকেন, নইলে এখানকার লাইব্রেরিতে আসতেন না। পুরো নামটা অবশ্য জানি, লাইব্রেরি কার্ডে দেখেছি। কোরিন কারমাইকেল।

নামটা গাইড বুকে সহজেই খুঁজে পেল কিশোর। হ্যাঁ, রকি বীচেই থাকেন মহিলা, মইিল দুয়েক দূরে, অ্যালটো ড্রাইভে।

সাইকেল নিয়েই যেতে পারি, মুসা বলল। কিন্তু টমকে কি করব?।

কি টম টম করছ? বলল কিশোর। কবুতরের আর কোন নাম খুঁজে পেলে না।

কেন মন্দ কি? মানুষের নাম টম, কুকুর-বেড়াল-ছাগল-শুয়োর-ঘোড়া সব কিছুর নামই যদি টম হতে পারে, কবুতরের বেলায় অসুবিধে কি?

হুঁ, মুসার অকাট্য যুক্তির পর আর তর্ক করল না কিশোর। কিন্তু কবুতরটাকে সঙ্গে নিয়ে যাওয়ার ব্যাপারে আপত্তি জানাল।

কোথায় রেখে যাব তাহলে? বলল মুসা।

এখানেই…

খুব কষ্ট পাবে। তারচে বাইরের বড় খাঁচাটায়…

না, মাথা নাড়ল কিশোর, চুরির ভয় আছে। গত রাতের কথা ভুলে গেছ?

তাহলে নিয়ে যাওয়াই ভাল।

আমারও তাই মনে হয়, মুসার পক্ষ নিল রবিন। নইলে ফিরে এসে হয়তো দেখব তিন আঙুলের জায়গায় চার আঙুলওলা আরেকটা পায়রা বসে আছে।

ভোটে হেরে যাচ্ছে কিশোর, কি ভেবে রাজি হয়ে গেল সঙ্গে নিতে।

দুই সুড়ঙ্গের মুখের ঢাকনা সরিয়ে খাঁচাটা নিয়ে নামল মুসা। তার পেছনে রবিন।

নামার জন্যে এগিয়েও থমকে গেল কিশোর, কুটি করে ফিরল। ডেস্কের কাছে এসে তার নতুন আবিষ্কার ফোন-এলে-জবাব-দেয়ার মেশিনটার সুইচ অন করে দিল। তারপর এসে নামল দুই সুড়ঙ্গে।

রকি বীচের পূর্ব প্রান্তে অ্যালটো ডাইভ। ধনী মানুষের পাড়া। অনেক জায়গা নিয়ে বিশাল সব বাড়ি। রাস্তার ধারে গেট, গেটের পরে একরের পর একর জুড়ে বাগান, লন আর গাছপালার পরে রয়েছে বাড়িগুলো, কোনটা আংশিক চোখে পড়ে, কোনটা গাছের জঙ্গলের ওপাশে একেবারেই অদৃশ্য।

লোহার মস্ত এক সদর দরজার সামনে সাইকেল থেকে নামল তিন গোয়েন্দা। গেটের পাশে কংক্রিটের থামে বসানো শ্বেত পাথরের ডিম্বাকৃতি ফলক, তাতে কুচকুচে কালো হরফে লেখা রয়েছে : মিউজিক নেস্ট।

এটাই, বলল কিশোর।

আরেক পাশের থামে খোপ কেটে তাতে ইনটারকম সিসটেম বসান হয়েছে। সুইচ টিপে যন্ত্রটার সামনে দাঁড়াল কিশোর জবাব দেয়ার জন্যে। কিছুই শোনা গেল না। আবার সুইচ টিপে যন্ত্রটায় কান ঠেকাল সে।

জবাব এলেও কথা বোঝা যাবে কিনা সন্দেহ। মিউজিক নেস্টের আশেপাশে অনেকখানি জায়গা জুড়ে যে হারে কলরব আর হই চই। চেঁচিয়ে কথা বলেও একে। অন্যের কথা ঠিকমত শুনতে পাবে না।

অবস্থা অনেকটা বড় সড় ইলেকট্রনিক মার্কেটের মত। পুরো ভলিয়ুমে বাজানো রেডিও আর টেপরেকর্ডারের মিউজিকের শব্দে ওখানে যেমন টেকা দায়, এখানেও তেমনি অবস্থা। তফাত শুধু মার্কেটে মানুষের কণ্ঠ আর নানারকম বাদ্যযন্ত্রের বাজনা, এখানে পাখির কলরব। শিস, কিচির-মিচির, তীক্ষ একঘেয়ে চিৎকার, কা-কা, সব মিলিয়ে সে এক এলাহি কাণ্ড।

আবার সুইচ টিপল কিশোর। জবাবে কিছু একটা শোনাও গেল, কিন্তু বোঝ গেল না। আর ঠিক সেই মুহূর্ত কর্কশ ডাক ছেড়ে আকাশে উড়ল একঝাক টিয়ে।

ইনটারকমের কাছ থেকে সরে এল কিশোর, বিরক্ত চোখে তাকাল গাছপালার মাথার ওপরে উড়ন্ত পাখিগুলোর দিকে। গাছের ডালে অসংখ্য কাকাতুয়া, উজ্জ্বল লাল, হলুদ আর নীলের মাঝে গাছের ঘন সবুজ পাতাও ফেকাসে দেখাচ্ছে। টিয়েগুলোর সঙ্গে পাল্লা দিয়েই যেন কণ্ঠস্বর আরও উঁচু পর্দায় তুলে দিল কাকাতুয়ার। দল।

পাখি! চেঁচিয়ে বলল মুসা। পুরো এলাকাটা পাখিতে… শেষ শব্দটা বোঝা গেল না, টিয়েগুলো সমস্বরে আবার চেঁচিয়ে উঠেছে।

ভরা, মুসার চেয়েও জোরে বলল কিশোর। শুধু কাকাতুয়া আর টিয়েই নয়, স্টারলিং, ক্যানারি, লার্ক, চড়ুই, কাক, চিল, শকুন, বাজ, দোয়েল, বুলবুল, কোন পাখিরই অভাব নেই এখানে। ডালে বসে চেঁচাচ্ছে কেউ, কেউ লাফালাফি করছে, কেউ এক ডাল থেকে আরেক ডালে উড়ে যাচ্ছে ফুরুত করে, কেউ বা আবার মহা গভীর হয়ে বসে রয়েছে চুপচাপ।

বাড়ির ভেতরে ঢোকার পথ খুঁজল কিশোর। গেটের পাল্লায় শুধু খিল লাগানো, তালা-টালা নেই। শিকের ফাক দিয়ে হাত ঢুকিয়ে খিল তুলে ফেলল। পাহারাদার কেউ আছে কিনা তাকিয়ে দেখল এপাশ-ওপাশ। নির্জন সাইলে নিয়ে ঢুকে পড়ল সে ভেতরে।

অন্য দুজনও ঢুকল। পান্না ঠেলে লাগিয়ে আবার জায়গা মত খিলটা তুলে দিল মুসা। এবার কি? কিশোরের কানে মুখ ঠেকিয়ে জিজ্ঞেস করল।

গাছপালার ভেতরে দিয়ে একেবেঁকে যাওয়া গাড়িচলা পথটা দেখাল কিশোর, সাইকেল চালিয়ে যাওয়ার ইঙ্গিত করল।

এগিয়ে চলেছে তিন গোয়েন্দা। কলরং সামান্যতম নি, বরং বাড়ছে বলে মনে হলো ওদের। ওই প্রচণ্ড শব্দ বেশিক্ষণ আর সইতে পারত . বিন, হ্যাণ্ডেল ছেড়ে দিয়ে দু-হাতে কান ঢাকল, শুধু পা আর কোমরের সাহায্যে ব্যালান্স করে সাইকেল চালাচ্ছে।

আগে আগে ছিল কিশোর, হঠাৎ থেমে গেল। গাছগাছালি আর পঙ্গপালের মত পাখির ঝাকের ফাঁক-ফোকর দিয়ে একটা বিশাল বাড়ির খানিকট চোখে পড়ছে। কিন্তু বাড়ি দেখে থমকায়নি সে, অন্য কারণ

পাখির কলকাকলী ভেদ করে কানে আসছে আরেকটা কণ্ঠ, মহিলা কণ্ঠের গান, তীক্ষ্ণ, উঁচু পর্দা, কিন্তু শুনতে খারাপ লাগে না। নরম গলায় গাইলে আর এত

সব কোলাহল না থাকলে বেশ মিষ্টিই শোনাবে।

আরেকটু আগে বাড়ল ওরা।

আবার গান গাইল মহিলা, কথাগুলো বোঝা গেল এবার : তিনটে ছেলে ড্রাইভওয়েতে, কি চাই ওদের, কি চাই।

সুরটা পরিচিত মনে হলো রবিনের। ও, মনে পড়েছে দি ব্যাট হাইম অভ দা রিপাবলিক।

আসছে ওরা আরও কাছে, গেয়েই চলেছেন মহিলা, আসছে ওরা আসছে গো। ভয় পেয়ো না মিষ্টি পাখি, ভয় পেয়ো না লক্ষ্মীরা! হয়তো ওরা কোনই ক্ষতি করবে নাকো তোমাদের।

সাইকেল থেকে নেমে হ্যাণ্ডেল ধরে ঠেলে নিয়ে চলল তিন কিশোর।

গাছের জঙ্গল আর বাড়ির মাঝের ছড়ানো লনে দাঁড়িয়ে আছেন মাঝবয়েসী মহিলা। সাধারণের চেয়ে বেশিই লম্বা! গরমকালের ঢেলা হালকা পোশক পরনে। মাথায় নরম হ্যাট, চওড়া কানা। গোলগাল বেশ সুন্দর চেহারা।

তার কাঁধে বসে আছে একটা তোতা, হ্যাটের চঁদিতে শুয়ে ঝিমাচ্ছে একটা ক্যানারি। আর ঠিক মাথার ওপরে শূন্যে ফড়ফড় করে ডানা ঝাপটাচ্ছে একটা বাজ, বসার সুবিধেমত জায়গা খুঁজছে।

কথা কিছু থাকলে বলার, বলে শুনি গান গেয়ে, তিন গোয়েন্দা একেবারে কাছে চলে এল বললেন মহিলা। দরাজ গলায় গাইবে গান, নইলে কানে ঢুকবে না, কিছুই কানে ঢুকবে না।

পাগলের পাল্লায় পড়েছে, কোন সন্দেহ নেই মুসার, জরুরী অবস্থায় পালানোর জন্যে তৈরি হয়ে রইল। রবিন,চুপ। বার বার তাকাচ্ছে কিশোরের দিকে।

কিশোর বুঝল, জবাব তাকেই দিতে হবে। খুব ভাল অভিনেতা সে, শিশুকালেই টেলিভিশনে অভিনয় করে অনেক সুনাম-কুড়িয়েছে, কিন্তু গানের ব্যাপারে সে আনাড়ি। কখনও গলা সেধে দেখেনি। এমনকি বাথরুমেও কখনও গুনগুন করেছে কিনা মনে পড়ে না। সমস্যায় পড়ে গেল। মনে মনে গুছিয়ে নিল শব্দগুলো কবিতার মত করে, তারপর হেঁড়ে গলায় গান ধরল? মিস কোরিনকে খুঁজি মোরা, পাখির যিনি বিশারদ; আপনি কি সেই…আপনি কি সেই…ইয়ে মানে… ইয়ে-তাল ছন্দ কথা সব হারিয়ে তোলাতে শুরু করল গোয়েন্দাপ্রধান।

হা-হা করে হেসে উঠেই রবিনের কনুইয়ের তো খেয়ে আঁউক করে থেমে গেল মুসা। বোধহয় শুনতে পাননি মহিলা, তাই ফিরে তাকালেন না। কিশোরের, কথার জবাব দিলেন আমিই সেই মিস কোরিন, খুঁজছ যাকে তোমরা।

আবার কিশোরের পালা। কেশে গলা পরিষ্কার করে নিল সে, অসহায় ভঙ্গিতে তাকাল মিস কারমাইকেলের দিকে। সুর করে বলল, অনুপ্রবেশ করেছি বলে আমরা সবাই দুঃখিত। দি ব্যাটল হাইম অভ দ্য রিপাবলিক ঠিক রাখতে হিমশিম খেয়ে যাচ্ছে সে। কিন্তু কোন ছিল না উপায়… থেমে গেল সে। না, কথা আটকে যায়নি, তার প্রতি মনোযোগ হারিয়েছেন মহিলা, চেয়ে রয়েছেন মুসার হাতের খাঁচাটার দিকে।

হাসলেন মিস কারমাইকেল, আন্তরিক হাসি, নেচে নেচে এগোলেন মুসার দিকে।

এক লাফে পিছিয়ে গেল মুসা। দ্রুত একবার তাকাল দু-পাশে। কোনদিকে দৌড় দিলে সুবিধে হবে আন্দাজ করল

কিন্তু দৌড় দিতে হলো না। তার আগেই গান গেয়ে উঠলেন মহিলা, সোনা আমার, লক্ষ্মী সোনা, কি চমৎকার দেখিতে টিটিরিংনা টিটিরিং টিটুটিরিংনা টিউটিরিং। বলেই কবুতরের গলা নকল করে বাগবাকুম করে উঠলেন।

ছোঁ মেরে মুসার হাত থেকে খাঁচাটা ছিনিয়ে নিলেন মিস কারমাইকেল। বুকে জড়িয়ে ধরে আবার গাইলেন, সেনা আমার, লক্ষ্মী সোনা, দেব ওদের পুরস্কার। টিউটিরিংনা টিউটিরিংনা…

<

Super User