ঘটনাটা কি…? গাড়ির ইঞ্জিনের ওপর থেকে মুখ তুলে তাকিয়েই বলে উঠল কিশোর পাশা। সোজা হতে গিয়ে মাথা বুকে গেল পুরানো সাদা রঙের শেভি ইমপালার হুডে।

মাল নিয়ে ফিরে এসেছেন রাশেদ পাশা। উদ্ভট সব জিনিস কেনায় জুড়ি নেই তার, কিন্তু এবার যেন সব কিছুকে ছাড়িয়ে গেছেন।

ইয়াডের বড় ট্রাকটার ড্রাইভিং হুইল ধরে বসে আছেন তিনি। মাথায় পুরানো একটা রোমশ টুপি, পেছনে ঝুলে রয়েছে র্যাকুনের লেজ। টুপি বটে একখানা! ট্রাকের পেছনে ইয়ার্ডের দুই কর্মচারী, ব্যাভারিয়ান ভাই বোরিস আর রোভার বিচিত্র সব জিনিসের মধ্যে বসে আছে।

বিস্মিত হয়ে তাকিয়ে রয়েছে কিশোর। বিশ্বাস করতে পারছে না নিজের চোখকে। মাথাটাথা খারাপ হয়ে গেল নাকি রাশেদ পাশার! সেদিকে তাকিয়ে সরে আসতে গিয়ে কনুই লেগে উল্টে পড়ল ইঞ্জিনের ওপর রাখা একটা মবিলের ক্যান। ক্র্যাংককেসের ভেতর দিয়ে গড়িয়ে ঢুকে যেতে শুরু করল ঘন তেল।

খাইছে! চিৎকার করে উঠল মুসা আমান। গাড়ির চেসিসের নিচ থেকে যেন ছিটকে বেরিয়ে এল। না বলতেই ঢেলে দিলে কেন?

দেখার মত চেহারা হয়েছে তার। চেসিসের নিচে কাজ করতে গিয়ে এমনিতেই কালিতে মাখামাখি হয়ে গিয়েছিল, তার ওপর পড়েছে মবিল। কোঁকড়া চুল বেয়ে গড়াচ্ছে। ইঞ্জিনের মবিল পাল্টাতে নিচে ঢুকেছিল সে। কিশোরকে বানিয়েছিল সহকারী। কিন্তু বলার আগেই তেল ঢেলে দিয়েছে কিশোর।

রেগে গিয়ে মুসা বলল, কি হয়েছে?

ক্যানটা আবার সোজা করে ফেলেছে কিশোর। কিন্তু দেরিতে। সমস্ত তেল পড়ে গেছে ততক্ষণে। বলল, সরি! চমকে গিয়েছিলাম!

কেন? তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ লেগেছে? বলেই চোখ পড়ল মেরিচাচীর ওপর। অফিসের বারান্দা থেকে নেমে গটমট করে এগিয়ে আসছেন ট্রাকের দিকে। রাশেদ পাশার দিকে তাকিয়ে মুসাও চমকে গেল কিশোরের মতই। খাইছে! এ কি কাণ্ড!

রাশেদ পাশা! ফেটে পড়লেন যেন মেরিচাচী। তোমার কি মাথা খারাপ হয়েছে। এসব কি এনেছ! মালগুলোর দিকে হাত নাড়লেন তিনি। এই জঞ্জাল দিয়ে কি হবে!

জঞ্জাল নয় এগুলো, শান্তকন্ঠে বলল রাশেদ পাশা। ইয়ার্ডের মাল, বিক্রির জন্যে। যারা চিনবে, তারা কিনবে।

তোমার মাথার ওই টুপিটাও? আয়নায় দেখেছ মুখটা?

পেছন থেকে লেজটা সামনে নিয়ে এলেন রাশেদ পাশা। লম্বা বেনিতে যেমন হাত বোলায় মেয়েরা, তেমনি করে বোলাতে বোলাতে বললেন, একেবারে আসল মাল। খাটি জিনিস। ব্যাকুনের চামড়ায় তৈরি ডেভি ক্ৰিকেট ক্যাপ।

দ্রুত ট্রাকের পেছন দিকে চলে এলেন মেরিচাচী। যারা চিনবে, তারা কিনবে! হতচ্ছাড়া সব জিনিস! ট্রাঙ্কটার মধ্যে কি?

নিজেই উঠে গিয়ে টান দিয়ে ডালা তুলে ফেললেন। এতগুলো কমিকের বই। এর জন্য টাকা নষ্ট করলে!

কয়েক লাফে ট্রাকের পেছনে পৌছে গেল কিশোর। কৌতূহলে ফাটছে। উঠে পড়ল ট্রাকে। ট্রাঙ্কের ভেতর গাদা গাদা কমিকের বই।

মারছে! মুসাও এসে দাঁড়িয়েছে ট্রাকের কাছে। লোকটা সাংঘাতিক কমিক ভালবাসত তো! যার কাছ থেকে এনেছে।

অনেক পুরানো, কিশোর বলল। নিশ্চয় অনেকদিন ফেলে রেখেছিল। মুসার দিকে ঝুঁকল। নিচু গলায় জিজ্ঞেস করল, কত টাকা আছে তোমার কাছে?

বেশি না, পকেটে হাত ঢুকিয়ে দিল মুসা।

অ্যাই, কি হয়েছে? রবিন জিজ্ঞেস করল। সবেমাত্র ইয়ার্ডে ঢুকেছে সে। গায়ে সাদা পোলো শার্ট। পরনে খাকি প্যান্ট। সুন্দর লাগছে ওকে।

দেখে খুশি হলো কিশোর, এই যে, ঠিক সময়ে এসে পড়েছ। দেখো তো পকেটে কত টাকা আছে?

পকেটে হাত ঢোকাল রবিন। বেশি নেই। টানাটানি। কেন?

হাসল কিশোর। কিছু কমিক কিনব।

বইগুলো ঘটছেন মেরিচাচী। আরও কিছু আছে কিনা দেখছেন ট্রাঙ্কের ভেতরে। কি কারণে যে এগুলো আনল। এখন কার কাছে বিক্রি করি? কাস্টোমার কোথায়?

এখানে। রবিনের হাত থেকে টাকাগুলো ছোঁ মেরে নিয়ে নিল কিশোর। নিজের পকেটে যা আছে বের করল। তিনজনেরটা একসাথে করে দ্রুত গুনে ফেলল। নাও, বাড়িয়ে দিয়ে বলল, একুশ ডলার সত্তর সেন্ট। তোমার সমস্ত যন্ত্রণা কিনে নিলাম আমরা। কি বলো, চাচী?

নিয়ে যা! জানে বাঁচলাম! টাকাটা নিতে গিয়েও দ্বিধা করলেন মেরিচাচী। কি করবি ওসব পচা কমিক দিয়ে?

কমিক নিয়ে কি করে মানুষ? পড়ব।

চোখে সন্দেহ দেখা দিল মেরিচাচীর। তোর মতলবটা কি বলো তো? কমিক নিয়ে ডুবে থেকে কাজে ফাঁকি দেয়ার ফন্দি না তো?

হেসে ফেললেন রাশেদ পাশা। টাকা দিচ্ছে নিয়ে নাও। এতক্ষণ তো কোথায় বেচবে কোথায় বেচবে করছিলে। কাস্টোমার পেয়েই দিধা কিসের?

তবু দ্বিধা করছেন মেরিচাণী। কোন উদ্দেশ্য না থাকলে কিশোর টাকা দিয়ে কিনত না। এমনিতেও অবশ্য বিক্রির জিনিস প্রয়োজন হলে কিনে নেয় সে, আর দশজন কাস্টোমারের মতই। আবার নিজে যখন কাজ করে দেয়, তখনও তার পারিশ্রমিক নিয়ে নেয়। কঠোর ভাবে মেনে চলে ব্যবসার নিয়ম কানুন! যদিও পুরো ব্যবসাটা একদিন তারই হবে, তবু নিজের মনে করে কিছু নিয়ে নেয় না। তার এই নিয়মনিষ্ঠায় খুবই খুশি মেরিচাচী। বলেন, সাংঘাতিক উন্নতি করবে একদিন তার ছেলে। কিশোরকে ছেলেই ভাবেন নিঃসন্তান মারিয়া পাশা।

আরে নাও না, টাকাটা চাচীর হাতে গুঁজে দিতে দিতে বলল কিশোর। একলা তো কিনিনি। তিনজনে মিলেই কিনেছি।

সেজন্যেই তো ভয়! কি ফন্দি করেছিস কে জানে!

আর কথা বাড়াল না কিশোর। মুসাকে নিয়ে মাল নামাতে শুরু করল। নিচে দাঁড়িয়ে সাহায্য করল রবিন। এগুলোর জন্যে টাকা নিয়েছ?

মাথা খারাপ হয়ে গেছে আজকে ওর, মুসা বলল। প্রথমে আমার মুখে তেল ঢালল। তারপর টাকা-পয়সা কেড়ে নিয়ে গিয়ে কতগুলো পুরানো কমিক…

মবিল? মুসার মাথা শুকে নাক কুঁচকাল রবিন। আমি তো ভেবেছিলাম, মাথায় তেল দেয়া আরম্ভ করেছ বুঝি।

এসব কথা বাদ দাও তো! অধৈর্য হয়ে হাত নাড়ল কিশোর। রবিনের দিকে তাকাল। বললে তো টাকা-পয়সা কেড়ে নিয়ে কতগুলো পুরানো কমিক কিনেছি। আসলে টাকা খাটালাম, মস্ত লাভের জন্যে।

টাকা খাটালে? ভুরু কুঁচকে গেল রবিনের। যা দিয়েছ তার বহুগুণ ফেরত পাবে।ট্রাঙ্কটায় টোকা দিল কিশোর।

এই আবর্জনা থেকে? মুসার কষ্ঠে অবিশ্বাস।

অত অবহেলা কোরো না। এর মধ্যে গুপ্তধন লুকানো আছে। জাননা, পুরানো কমিকের দাম মাঝে মাঝে কত বেড়ে যায়? কিছু তো হাজার হাজার ডলারে বিক্রি হয়।

হাজার হাজার…? ট্রাঙ্কটার দিকে তাকিয়ে রয়েছে রবিন।

নিশ্চয়ই। তবে কয়েকশো ডলার তো পাবই। দুই হাতের তালু এক করে জোরে জোরে ডলল কিশোর। বেশিও হতে পারে। তাতে আমার একটা গাড়ি কেনা হয়ে যাবে হয়তো। তবে যাই লাভ হবে, তিনজনে ভাগাভাগি করে নেব আমরা।

পরের শুক্রবারে মুসার ইমপালায় চড়ে শহরতলীতে রওনা হলো তিন গোয়েন্দা। তিনজনেরই অবসর। মুসার বাড়িতে কাজ নেই, রবিনের ছুটি, আর মেরিচাচীও কিশোরকে নতুন কাজ গছাতে ব্যর্থ হয়েছেন, কারণ সেদিন কোন কাজই নেই ইয়ার্ডে।

প্রচুর ধোঁয়া বেরোচ্ছে এগজস্ট পাইপ থেকে। রিয়ারভিউ মিররে সেই ধোঁয়ার দিকে তাকিয়ে মুখ বাঁকাল মুসা। তুমি একটা সর্বনাশ করেছ, কিশোর। সেই যে মবিল ফেললে তার জের এখনও চলছে। ইঞ্জিনের গা থেকে পুড়ে শেষ হয়নি।…আমার চুলে তো এখনও গন্ধ আছে!

তেল তো অনেক ভাল, রবিল ফোড়ন কাটল। পুরানো কমিক পড়তে পড়তে যে অন্ধ হয়ে যাইনি এটাই বেশি। বাপরে বাপ! লাইব্রেরিতে পুরানো বই মোছার চেয়ে বিরক্তিকর এটা।

তোমার মত বইয়ের পোকাও একথা বলছ? সামনের রাস্তার ওপর মুসার নজর। তবে যা-ই বলো, কিছু কিছু পড়তে কিন্তু ভালই লেগেছে। ছোটবেলার কথা মনে পড়ে গেছে, যখন ওসব পড়তাম। যেমন ধরো, ক্রিমসন ফ্যান্টমের কথাই। মাথা নেড়ে জোরে একটা নিঃশ্বাস ফেলল সে। ও তো সাংঘাতিক জিনিস। এখনও ভাল্লাগে।

তোমার লাগে, পেছনের সীটে বসেছে রবিন। মেঝেতে পায়ের কাছে পড়ে থাকা মলাটের বাক্সটার দিকে তাকিয়ে বিরক্ত মুখভঙ্গি করল। আমার লাগে না। বাক্সটায় একটা লাথি মেরে বলল, এগুলো আমার পড়তে হয়েছে, ভাল না মন্দ বোঝার জন্যে, ভাবলেই মেজাজ খিচড়ে যায়। কমিকের মধ্যে কিছু আছে নাকি!

সাবধান! ঘাড় ঘুরিয়ে রবিনের দিকে তাকিয়ে বলল কিশোর, এগুলো ব্যবসার মাল। নষ্ট করলে টাকা নষ্ট হবে। মালগুলো খুঁজে বের করতে হবে আগে আমাদের, সব চেয়ে দামিগুলো। ছিঁড়েটিড়ে নিয়ে গেলে হয়তো কিনতেই রাজি হবে না ইন্টারকমিকনের ওরা।

ওরাই যদি বাঁচায়। নইলে এসব আবর্জনা কিনবে কে গাঁটের পয়সা খরচ করে? ভাগ্যিস কাগজে কমিকস কনভেশনের খবরটা পড়েছিলে।

কিশোর হাসল। রবিন, এতটা কিপটে হয়ে গেলে কি করে তুমি? দাঁড়াও, আগে পেয়েনি টাকাটা। গোনার কাজে লাগিয়ে দেব। গুনতে গুনতে শেষে টাকার ওপরই ঘেন্না ধরে যাবে।

এসে গেছি, ঘোষণা করল মুসা। দ্য সেনচুরি গ্র্যান্ড প্লাজা।

কাচ আর ইস্পাতে তৈরি পরিষ্কার আকাশে মাথা তুলে দাঁড়ানো চকচকে টাওয়ারটার দিকে তাকাল রবিন। এরকম একটা জায়গায় কমিক বিক্রি হয়!

আগস্ট মাসের পঁচা গরম পড়ছে। ঘামছে কিশোর। বলল, এই মুসা, গাড়ি এখানেই রাখ কোথাও। গিয়ে দেখা যাক কি ধরনের সম্মেলন হচ্ছে।

ড্রাইভওয়ে দিয়ে হোটলের আন্ডারগ্রাউন্ড পার্কিং গ্যারেজে গাড়ি নিয়ে এল মুসা। আজব এক কংক্রীটে তৈরি জঙ্গলের মত লাগছে জায়গাটাকে। মোটা মোটা থাম ধরে রেখেছে ছাত এবং তার ওপরের বাড়িটাকে। উজ্জ্বল রঙ করে জায়গাটাকে মোটামুটি একটা সুন্দর রূপ দেয়ার চেষ্টা করেছে কর্তৃপক্ষ, কিন্তু কতটা সফল হয়েছে বলা মুশকিল। মুসার অন্তত ভাল লাগছে না। গাড়ির এগজস্টের ধোঁয়া, অল্প আলো, আর অসংখ্য থামের ছায়া কেমন যেন ভূতুড়ে করে তুলেছে পরিবেশ।

খালি একটা জায়গায় গাড়ি ঢুকিয়ে দিয়ে মুসা বলল, নাও, থামলাম। বেরোও সবাই।

বেরোও বললেই কি আর হয়, রবিন বলল। যা একখান বোঝা নিয়ে এলাম। লেখাগুলো যেমন বিচ্ছিরি, ওজনটাও তেমনি বাজে। দেখি, নাও তো।

আবার এটাতেও আমাকে টানছ কেন? প্রতিবাদ জানাল মুসা। তোমাদেরকে ড্রাইভ করে যে এখানে নিয়ে এলাম, সেটা কিছু না?

সেটা আমিও করতে পারতাম।

পারলে তো তোমার ফোক্স ওয়াগেনে করেই আসতাম। ওই গোবরে পোকার ভেতরে জায়গা হলো না বলেই তো…আসলে ওই বাক্সটার জন্যেই হলো না।

বিরক্ত চোখে দুই সহকারীর দিকে তাকাল কিশোর। তোমাদের যখন এতই কষ্ট লাগছে, ঠিক আছে, আমিই নিতে পারব। বাক্সটা ধরে টান দিল সে। আগের মত শুটকি ভাব নাকি আমাকে?

না, তা ভাবব কেন? মুসা বলল। জুডো ক্লাসের ব্যায়াম অনেক মেরামত করে দিয়েছে তোমাকে। শরীর আরও ভাল হয়ে যেত, যদি কারাতে শিখতে।

এমনিতেই যথেষ্ট হয়েছে। ভারি বোঝা নিয়ে এলিভেটরের কাছে পৌঁছতে পৌঁছতেই হাঁপিয়ে উঠল কিশোর।

কল বাটন টিপতেই খুলে গেল এলিভেটরের দরজা।

ঢুকল তিনজনে। পায়ের শব্দ কানে এল। দৌড়ে আসছে কেউ এলিভেটর ধরার জন্যে। ঝট করে একটা হাত ঢুকে গেল দরজার ফাঁকে, পুরোপুরি বন্ধ হয়ে যাওয়ার আগেই। আবার ঝটকা দিয়ে খুলে গেল দরজা। একজন লোক। শরীরের মাংস খসে খসে পড়ছে তার।

<

Super User