আহ, বন্ধ করো, অনুনয় করলো কিশোর, বন্ধ করো ওটা।
সুইভেল চেয়ারে এলিয়ে পড়েছে সে। খসখসে হয়ে উঠেছে কণ্ঠস্বর। প্রচণ্ড যন্ত্রণায় বিকৃত হয়ে গেছে মুখ। তার সব চেয়ে ঘনিষ্ঠ দুজন বন্ধুর সামনে অত্যাচার করা হচ্ছে তাকে, অথচ সেটা থামানোর কোনো চেষ্টা করছে না ওরা। বরং তার কষ্ট দেখে হাসছে মুসা আমান আর রবিন মিলফোর্ড।
ওদের গোপন হেডকোয়ার্টারে বসে আছে তিনজনেই। তাকিয়ে রয়েছে একটা টেলিভিশন সেটের দিকে। পর্দায়, রান্নাঘরের একটা বড় টেবিলের ওপর আসন মুড়ে বসে রয়েছে গোলগাল খুব মোটা একটা বাচ্চা। তার হাত মুচড়ে পেছন দিকে নিয়ে গেছে আট-নয় বছরের একটা ছেলে। এগারো বছরের আরেকটা ছেলে চিনামাটির বাটিতে কি যেন গুলছে। এই ছেলেটা লম্বা, পাতলা, মাথার চুল কামানো, ডিমের মতো চকচক করছে সাদা মাথার চামড়া, স্পষ্ট দেখা যায়। ওর হাবভাব দেখে ওই ডিমের মতো খুলির ভেতরে ডিমের কুসুম ছাড়া মগজ বলে আর কোনো পদার্থ আছে বলে মনে হয় না।
না না, প্লীত (প্লীজ), অস্বাভাবিক ভারি গলায় অনুনয় করলো বাচ্চা ছেলেটা, প্লীত, আমার বতন্ত (বসন্ত) দরকার নাই।
বন্ধ করো! আবার অনুরোধ করলো কিশোর। দোহাই তোমাদের, বন্ধ করো ওটা!
কিন্তু আমি তো দেখতে তাই (চাই), বাচ্চাটার অনুকরণে বললো মুসা হেসে, দেখতে তাই পেত পর্দন্ত কি কলে।
এসো মোটুরাম, জলহস্তীর বাচ্চা, হেসে বললো পর্দার একটা ছেলে, কাছে এসো। এই ছেলেটা নিগ্রো, গাট্টাগোট্টা শরীর, শজারুর কাঁটার মতো দাঁড়িয়ে রয়েছে শক্ত চুল। বয়েস বারো। হাসিটা এতোই নিস্পাপ, দুনিয়ার কোনো খারাপ কাজ সে করতে পারে বলে মনে হয় না। তোমার আম্মু আর আবু যখন দেখবে তোমার শুটিবসন্ত হয়েছে, ভয়ে চোখ উল্টে দেবে। তোমার সাথে ছিলাম বলে সবাই ভাববে ছোঁয়াছে রোগটা আমাদের রক্তেও ঢুকেছে। তখন আর আমাদের ইস্কুলে যেতে হবে না।
হ্যাঁ, তার সুরে সুর মেলালো যেন বিশাল পা-ওয়ালা আরেকটা হেলে, সবাই তাই ভাববে।
পর্দায় মাথাকামানো ছেলেটার নাম মড়ার খুলি, তরল জিনিসটা গোলা শেষ করেছে সে। এগিয়ে গেল বাচ্চাটার দিকে।
দুহাতে চোখ ঢাকলো কিশোর পাশা। এরপর কি ঘটবে জানা আছে। পরিষ্কার মনে আছে তার, কান নাচাতে পারে ডিমের মতো মাথাওয়ালা ছেলেটা। এতো ঘন ঘন নাচায়, বড় বড় লতিদুটোকে তখন মনে হয় জেলি, কানের নিচে লেগে থেকে ঝুলছে।
অভিনেতা হিসে, এটা তার একমাত্র গুণ।
মুসা আর রবিনের হাসি কিশোরের গায়ে জ্বালা ধরালো।
কান নাচাতে নাচাতে গিয়ে একটা রঙ লাগানোর তুলি তুলে আনলো মড়ার খুলি। তারপর বাটি থেকে লাল রঙ তুলে তুলে লাগিয়ে দিতে লাগলো বাচ্চাটার গোলগাল মুখে। শরীর মুচড়ে সরে যাবার চেষ্টা করলো মোটুরাম, কিন্তু কাদলো না। আগের মতোই হাসি হাসি চেহারা।
কিন্তু কিশোরের মুখে হাসির চিহ্নই নেই। আঙুল ফাঁক করে তার ভেতর দিয়ে আবার তাকিয়েছে টিভির দিকে। বিশ্বাসই করতে পারছে না ওই বাচ্চাটাই ছিলো সে নিজে। বাদামী রঙের ফারমার ওভারঅল পরা গোলআলুর মতো মুখওয়ালা ওই বাচ্চাটা সে ছিলো একথা ভাবতেই ইচ্ছে করছে না। নাকে, গালে, সমানে রঙের ফোঁটা দিয়ে চলেছে মড়ার খুলি যে বাচ্চাটার, সে-ই কি আজকের তুখোড় গোয়েন্দা কিশোর পাশা, যার বুদ্ধি দেখে মাঝে মাঝে দুর্ধর্ষ পুলিশবাহিনীরও তাক লেগে যায়?
বিশ্বাস করতে না চাইলেও উপায় নেই, জানে কিশোর। একসময় মোটুরাম ছিলো তার উপাধি, ইংরেজি শব্দটার বাংলা করলে অবশ্য এই নামই দাঁড়ায়। আধ ঘন্টার একটা টিভি সিরিয়ালে অভিনয় করতো সে। হবিটার বাংলা নাম করলে দাঁড়ায় পাগল সংঘ।
জীবনের ওই সময়টাকে ভুলে থাকার যথাসাধ্য চেষ্টা করে কিশোর। তিন বছর বয়েসে নিজের ইচ্ছেয় সে ওই ছবিতে অভিনয় করতে যায়নি। তবে বাবা-মাকেও দোষ দেয় না সে। তারা চেয়েছিলেন একদিন বড় অভিনেতা হবে তাঁদের ছেলে।
একজন বিখ্যাত চিত্রপরিচালক ছিলেন কিশোরের বাবার বন্ধু। প্রায়ই আসতেন তাদের বাড়িতে। এক রোববার বিকেলে খেলতে খেলতে বাচ্চা কিশোর এসে হাজির হলো তার সামনে।
বড় হয়ে খুব ভালো নাচতে পারবে তুমি, খোকা, হেসে বললেন পরিচালক।
না, ওই বয়েসেই অবিশ্বাস্য রকম ভারি গলায় দৃঢ়কণ্ঠে জবাব দিয়েছিলো কিশোর, আমি নাচবো না। আমি পুলিশ হবে। চোর-ডাকাত ধরবো। চোরেরা আমার ভয়ে কাঁপবে।
কিশোরের কথা শুনে দীর্ঘ এক মুহূর্ত তার দিকে তাকিয়ে রইলেন পরিচালক। তারপর তার বাবাকে জিজ্ঞেস করলেন, বয়েস কতো? ছেলেটার পাকা পাকা কথা গুনে তাজ্জব হয়ে গেছেন।
দুই বছর এগারো মাস, জবাব দিয়েছেন বাবা।
এরপর যাওয়ার আগে আর কিশোরের সম্পর্কে একটি কথাও বললেন না পরিচালক। তবে গাড়িতে ওঠার পর আরেকবার বাচ্চাটার দিকে তাকিয়ে আপনমনেই বিড়বিড় করলেন, অসাধারণ প্রতিভা! কাজে লাগাতে পারলে…
কয়েকদিন পরেই এক আজব জায়গায় কিশোরকে নিয়ে গেলেন তার বাবা। স্ক্রীন টেস্ট নেয়া হলো তার। কয়েক মাসের মধ্যেই পাগল সংঘ-এর মোটুরাম হয়ে গেল কিশোর।
ঠিকই আন্দাজ করেছিলেন পরিচালক। ছেলেটা সত্যিই অসাধারণ বুদ্ধিমান। আর অভিনয় যেন সে মায়ের পেট থেকেই শিখে এসেছে, একেবারে স্বাভাবিক, বাস্তব হাসি, কথাবার্তা। পরিচালক যা যা করতে বলেন, ঠিক তা-ই করে। সংলাপ মুখস্থ করায়ও জুড়ি নেই মোটুরামের। একবার বলে দিলেই যেন মগজে গেঁথে যায়, একটি শব্দও ভুল করে না।
শুধু কিশোরের জন্যেই সাংঘাতিক নাম করেছিলো পাগলসংঘ।
টিভিতে অনেক অভিনয় করেছে কিশোর। সিনেমাতেও করতো, যদি না তার বাবা-মা হঠাৎ মোটর দুর্ঘটনায় মারা যেতেন। হয়তো অভিনেতাই হতে হতো তাকে জীবনে।
বাবা-মা মারা যাওয়ার পর তাকে বাঁচালেন যেন নিঃসন্তান মেরিচাচী। নিজের কাছে নিয়ে গেলেন। জিজ্ঞেস করলেন, আর ছবিতে অভিনয় করবি, কিশোর?
না, সরাসরি জবাব দিলো কিশোর।
ভোর সাড়ে পাঁচটায় উঠে, স্টুডিওতে গিয়ে ঘাড়ে, মুখে, গলায়, রঙ মাখতে তার আপত্তি নেই। ক্যামেরা আর উজ্জ্বল চোখ ধাধানো আলোর সামনে দাঁড়িয়ে ঘামতেও রাজি আছে সে। ক্যামেরার সামনে বসে জটিল ধাধা মেলাতে আর অ্যাডভেঞ্চারের বই পড়ার অভিনয় করতে খুব আগ্রহ তার। তোতলাতে পারে, জড়িয়ে জড়িয়ে কথা বলতে পারে, পরিচালক যা করতে বলেন সব পারে, পারে না শুধু তার সহ-অভিনেতাদের সহ্য করতে।
কিশোর বোঝে কোনটা অভিনয়, আর কোনটা নয়। কিন্তু তার চেয়ে অনেক বড় হয়েও মাথামোটা হবার দলের যেন সেটুকু বোঝার বুদ্ধি নেই। ছবিতে যেমন তাকে খেপায়, হবির বাইরেও খেপায়। অভিনয় করতে করতে যেন ওদের ধারণা হয়ে গেছে এটাই স্বাভাবিক। তাই টিফিনের সময় স্টুডিওর ক্যাফেটেরিয়ায় বসেও তার আইসক্রীমে মরিচের গুঁড়ো ঢেলে দেয়। মেকাপ রুমে তার চেয়ারে আঠা মাখিয়ে রাখে। তার ফারমার ওভারঅলের বোতামগুলো কেটে রাখে। আর সব চেয়ে বেশিদুঃখ লাগে, যখন তাকে ওরা মোটুরাম বলে ডাকে। সব সময় ডাকে। ওদের গোবর পোরা। মাথাগুলোয় যেন কিছুতেই ঢুকতে চায় না বাস্তব জীবনে সে মোটেই মোটুরাম নয়কিশোর পাশা।
কাজেই মেরিচাচী যখন তাকে জিজ্ঞেস করলেন পাগল সংঘ ছবিতে আর অভিনয় করবে কিনা, একটা মুহূর্ত দেরি না করে জবাব দিয়ে দিয়েছে সে, না। তার মনে হলো যেন খাঁচায় বদ্ধ একগাদা খেপা বানরের মাঝখান থেকে তাকে মুক্তি দিতে এসেছেন চাচী। ওই মহিলাকে যে সে এতো ভালোবাসে, শ্রদ্ধা করে, যা বলেন মুখ বুজে শোনে, এটা তার একটা বড় কারণ। তার মা-ও যেটা করেননি। তাই করেছেন ওই মহিলা, তাকে ওই বয়েসেই মতামতের স্বাধীনতা দিয়েছেন, যা পাওয়ার জন্যে সে আকুল হয়ে ছিলো।
কাজেই যেদিন তার কন্ট্রাক্টের সময়সীমা শেষ হলো, সেদিনই পাগল সংঘকে অকূল সাগরে ভাসিয়ে চলে এলো কিশোর। আর কোনোদিন যায়নি ওই ছবিতে অভিনয় করার জন্যে। তার বদলে মন দিলো পড়ালেখায়।
ভালোই কাটছিলো দিন। তারপর বহু বছর পরে হঠাৎ এলো একটা প্রচণ্ড আঘাত। ঝড়ের কবলে-পড়া গাছের মতো নাড়িয়ে দিলো যেন কিশোরকে। টিভির পুরনো অনুষ্ঠান দেখানোর তালিকায় নাম উঠলো পাগল সংঘের।
কিশোর জানতো না যে দেখানো হচ্ছে। জানলো প্রথম, যেদিন তার এক সহপাঠি তার অটোগ্রাফ চেয়ে বসলো। হাসিমুখে দিয়ে দিলো কিশোর, ভাবলো, সে গোয়েন্দা হিসেবে ভালো নাম কামিয়েছে বলেই বুঝি অটোগ্রাফ চেয়েছে ছেলেটা। কিন্তু নাম সই করার পর যখন নিচে লিখলো গোয়েন্দাপ্রধান তখন আপত্তি জানালো ছেলেটা। মাথা নেড়ে বললো, না না, ওটা নয়, মোটুাম সেখো।
চমকে গেল কিশোর।
তারপর গত তিনটে হপ্তা ধরে এই এক জ্বালাতন। ইস্কুলের এমন কোনো ছেলেমেয়ে নেই যারা পাগল সংঘ না দেখেছে। সবাই এখন তাকে মোটুরাম বলে খেপায়। যে মেয়েগুলোকে দেখতে পারে না সে, পাত্তা দেয় না, ওরা পেয়েছে ভারি মজা। কিশোরকে দেখলেই মুচকি হেসে বলে, না না, পীত, আমাকে ধেরে দাও, কাতুকুতু দিও না, প্রীত!
ভয়াবহ দুঃস্বপ্নে পরিণত হয়েছে কিশোরের দিবারাত্রি। তা-ও গ্রীষ্মের ছুটি শুরু হওয়ায় কিছুটা রক্ষে। ইস্কুলে যেতে হয় না, সবার খেপানোও শুনতে হয় না। কিন্তু আজ কোনো কুক্ষণে যে হেডকোয়ার্টারে ঢুকে টেলিভিশন অন করেছিলো। আর করামাত্রই দেখলো পাগল সংঘ চলছে। বন্ধ করে দিয়েছিলো সে সঙ্গে সঙ্গে, জোর করে মুসা গিয়ে আবার খুলেছে।
পর্দার দিকে তাকিয়ে হাসে মুসা আর রনি। মুখ আর গলায় বসন্ত আঁকা শেষ করে এখন শরীরে আঁকার জন্যে মোটুরামের ওভারঅল খোলার চেষ্টা করছে মড়ার খুলি। এই সময় ঝটকা দিয়ে খুলে গেল রান্নাঘরের দরজা। ঘরে ঢুকলো নয় বছরের সুন্দরী একটা মেয়ে, পাগল সংঘে কিশোরের উদ্ধারকারিণী। ছবিতে ওর নাম বটি সুন্দরী।
ছেড়ে দাও ওকে, মড়ার খুলিকে ধমক দিয়ে বললো নেলি।
হা হা, থেরে দাও, হাসিমুখে বললো মোটুরাম। কিন্তু হাড়ার কোনো লক্ষণই নেই মড়ার খুলির। জোর করে নেলিকে নিয়ে গিয়ে আলমারিতে ভরে রাখতে চাইলো। নেলির পক্ষ নিলে নিগ্রো হেলেটা, ওর নাম জিকো, ছবির উপাধি শজারুকাঁটা। চুলের জন্যেই ওরকম নামকরণ। আরও ছেলে আছে। ওরা সবাই গেল মড়ার খুলির পক্ষে। নিমিষে মারপিট আর হৈ-চৈ করে এক এলাহি কাণ্ড বাঁধিয়ে ফেললো। একজন তাক থেকে একটা কেক তুলে নিয়ে ছুঁড়ে মারলো নেলিকে সই করে। সে মাথা সরিয়ে নিতে সেটা এসে পড়লো মোটুরামের মুখে। দুঃখ পাওয়ার চেয়ে বরং খুশি হলো সে। বললো, হ্যাঁ, হুঁ এতা ভালো! বতন্তের তেয়ে অনেক ভালো। বলে নাকেমুখে লেগে থাকা মাখন মুছে নিয়ে খেতে শুরু করলো।
কিশোওর। এই কিশোর, কোথায় তুই?
মেরিচাচীর ডাক শোনা গেল বাইরে থেকে।
জলদি বেরিয়ে আয়, আবার বললেন তিনি।
এইই সুযোগ। আর দেরি করলো না কিশোর। লাফিয়ে উঠে গিয়ে বন্ধ করে দিলে টেলিভিশন। মোটামের হাসিখুসি আলুর মতো মুখ অদৃশ্য হয়ে যাওয়ায় হাঁপ ছেড়ে বাচলো সে, অন্যদিকে মন খারাপ হয়ে গেল রবিন আর মুসার। ওদের দেখার খুব ইচ্ছে ছিলো। কিন্তু মেরিচাচীর নির্দেশ অমান্য করে এখানে বসে থাকার সাহস ওদের নেই।
জঞ্জালের ভেতর থেকে গোপন পথ দিয়ে বেরিয়ে এলো ওরা।
এই যে, এসেছিস, মেরিচাচী বললেন।
জ্যাকেট খুলতে খুলতে কিশোর জিজ্ঞেস করলো, কি কাজ করতে হবে, বলো?
কিন্তু কাজ করার জন্যে ডাকেননি মেরিচাচী। গেটের দিকে দেখালেন।
গুঙিয়ে উঠলো কিশোর। আবার! পাগল সংঘ টিভিতে দেখানোর পর থেকেই অনেক লোক আসে তার সঙ্গে দেখা করতে। খবরের কাগজের রিপোর্টারও থাকে তাদের মধ্যে। মোটুরামকে নিয়ে ফীচার স্টোরি করতে। হেডিং লেখেঃ মোটুম এখন কোথায়? কিংবা মোটুরামের কি হয়েছে?
ওকে যেতে বলল, লোকটাকে দেখিয়ে চাচীকে অনুরোধ করলো কিশোর। বলে দাও, আমি কথা বলতে চাই না।
অনেক বার বলেছি, যায় না। ও বলছে, কথাটা নাকি জরুরী। সহানুভূতির হাসি হাসলেন চাচী। কিশোরের কেমন লাগছে বুঝতে পারছেন। টেলিভিশনে সিরিয়ালটা দেখানোর পর থেকে যে লোকে তাকে বিরক্ত করছে, জানেন একথা। দেখছিস না, কি রকম বড় গাড়িতে চড়ে এসেছে। আমি বলায় বললো, যতোক্ষণ লাগে বসে থাকবে। তুই খেয়েদেয়ে জিরিয়ে নিয়ে যখন খুশি দেখা কর, ও বসে থাকবে। এরপর আর কি কলবো?
ঠিক আছে, কি আর করা! কপাল চাপড়ালো কিশোর। দেখি, খেদানো যায় কিনা।
বিরাট গাড়ি। ফরাসী সিত্রো। সামনের অংশটা দেখতে অনেকটা তিমির মাথার মতো। গাড়ি থেকে নেমে তিন গোয়েন্দার দিকে এগিয়ে আসা লোকটাও তার গাড়ির মতোই বড়, বিলাসী। প্রথমেই লোকটার দাঁত দৃষ্টি আকর্ষণ করলো কিশোরের। বড় বড় সাদা দাঁতগুলো লোকটার রোদে পোড়া চামড়ার পটভূমিতে যেন চাঁদের মতো ঝলমল করছে। যখনই হাসে তখনই চমকায়।
কিশোর পাশা, আরও চওড়া হাসি উপহার দিয়ে বললো লোকটা, আমার নাম হ্যারিস বেকার। মুভি স্টুডিওর বিজ্ঞাপন ম্যানেজার।
মুসা আর রবিনের মাঝখানে শক্ত হয়ে দাঁড়িয়ে রইলো কিশোর। ভুরু কুঁচকে তাকিয়ে আছে বেকারের দিকে।
তোমাকে একটা প্রস্তাব দিতে এসেছি, আশা করি পছন্দ হবে তোমার, এমনভাবে কথা বলে লোকটা মনে হয় তার কণ্ঠস্বরও হাসে। পাগল সংঘের সমস্ত অভিনেতাকে স্টুডিওতে আসার দাওয়াত করেছি। ওখানেই লাঞ্চ খাবে। লাঞ্চের পর…
থ্যাংক ইউ, আমার কোনো আগ্রহ নেই, বলে যাবার জন্যে ঘুরলো কিশোর।
পুরনো বন্ধুদের সাথে আবার দেখা হোক, এটা চাও না? বিশাল একটা থাবা কিশোরের কাঁধে ফেলে তাকে আটকালো বেকার। মড়ার খুলি, শিকারী কুকুর,
ভারিপদ, আর…।
না, থ্যাংক ইউ, বলে কাঁধ থেকে লোকটার হাত সরানোর চেষ্টা করলো কিশোর। কিন্তু লোকটার ভালুক-থাবা শক্ত হলো আরও। ওই বোকাগুলোর সঙ্গে জীবনে আর কোনোদিন দেখা করতে চাই না আমি…
আরও চওড়া হলো বেকারের হাসি। আমিও এটাই আশা করেছিলাম।
কি বললেন? কিশোর আশা করেনি লোকটা এরকম কথা কলবে।
তোমাকে অনেক বিরক্ত করেছে ওরা, তাই না? জ্বালাতন করেছে। মোটুরাম বলে খেপিয়েছে। ওদেরকে ঘৃণা তো করবেই।
মানুষকে ঘৃণা করি না আমি, শীতল গলায় বললো কিশোর। তবে ওদের পছন্দ করি না, এটা ঠিক। অপছন্দ আর ঘৃণাকে নিশ্চয় এক বলবেন না আপনি?
ওয়ান্ডারফুল! বেকারের রোদেপোড়া মুখে চাঁদের হাসি উজ্জল হলো আরও। চমৎকার গুছিয়ে কথা বলো তুমি। ওদের কাছে যাওয়ার একটা সুযোগ করে দিচ্ছি আমি তোমাকে। যাতে ওদের বুঝিয়ে দিতে পারো, সেই ছোটবেলা থেকেই ওদেরকে গাধা মনে করে এসেছো তুমি, এবং আসলেই ওরা গাধা। কি, সেটা প্রমাণ করতে চাও না?
কিভাবে? এই প্রথম আগ্রহ ঝিলিক দিলো কিশোরের চোখে।
কিশোরের কথার সরাসরি জবাব দিলো না বেকার। ঘুরিয়ে বললো, সারা দেশের লোকের সামনে প্রমাণ করবে ওরা বোকা। টেলিভিশন ক্যামেরার সামনে দাঁড়িয়ে বলবে সেকথা। দুটো কুইজ শো-এর বন্দোবস্ত করেছে টিভি। পাগল সংঘের সবাই একে অন্যের বিরুদ্ধে প্রতিযোগিতা করবে। আমার বিশ্বাস, কিশোর, তুমিই জিতবে। তোমার ব্যাপারে শুনেছি আমি। ওগুলোর সবকটার মাথায় ঘোল ঢেলে দিতে পারবে।
কিশোরে মনের পর্দায় মড়ার খুলির ডিমের মতো মাথাটা ঝিলিক দিয়ে উঠলো। গাধাটার বোকার মতো হাসি যেন স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছে অযথাই হাত মুচড়ে দিচ্ছে মোটুরামের। তার টিফিন সঁটিয়ে, বাক্সে মরা ইঁদুর রেখে দিয়ে ফ্যাকফ্যাক করে হাসছে।
হারিস বেকারের হাসিমুখের দিকে তাকিয়ে এসব কথা ভাবছে কিশোর।
ফাস্ট প্রাইজটা তুমিই পাবে, কিশোর, আগুনে যেন ঘি ঢাললো অসাধারণ ধূর্ত লোকটা। আর পুরস্কারের অঙ্কটা জানো কতো? বিশ হাজার ডলার।
<