দুই কিলোমিটার, সাইকেলে করে মাত্র কয়েক মিনিটের পথ। লিয়ারির কটেজটা খুব সুন্দর। শাদা রঙ বাড়িটার, জানালার পাল্লা সবুজ। গাছপালা, ফুলের বাগান, আর ঝোপঝাড়ে ঘেরা। বাগানটা ছাড়া বাকি সব গাছপালাকে বুনো মনে হয়, নিয়মিত সাফ না করায় জঙ্গল হয়ে গেছে। না, জায়গাটা ভালো, ছেলেমেয়েদের পছন্দ হলো।

তাছাড়া খুব নীরব, বললো রবিন। ভালো লাগে। পড়ালেখার জন্যে এরচে। ভালো জায়গা আর হয় না।

শুব্দ শুনে দরজায় এসে দাঁড়ালো মোটাসোটা, মাঝবয়েসী এক মহিলা, মুখে হাসি।এই যে, এসে পড়েছো তোমরা। এসো এসো, চা তৈরিই করে রেখেছি। ভাবলাম, সাইকেলে করে আসছো, নিশ্চয় খিদে লাগবে।– বাহ্, এই তো চাই! ভাবলো মুসা। না চাইতেই যদি এভাবে খাবার পাওয়া যায়…হেসে বললো সে, আসছি, এক মিনিট। সাইকেলগুলো রেখে আসি। এ হাতমুখ ধুয়ে, চা খেয়ে মালপত্র খুলে গোছাতে চললো ওরা। মাল বেশি নেই। সাইকেলের ক্যারিয়ারে করে যা যা আনতে পেরেছে। খুলে গোছাতে সময় লাগলো না। কাজ শেষ করে বাগানে বেরোলো ওরা। ঘুরে ঘুরে দেখতে লাগলো।

ভালোই লাগবে এখানে, জিনা বললো। জংলা জায়গা। তাছাড়া আমাদের বাড়িও কাছে। ইচ্ছে করলেই গিয়ে নৌকা বের করে নিয়ে দ্বীপে চলে যেতে পিরবো।

ঠিক বলেছো, মুসা একমত হলো। আবহাওয়া ভালো থাকলে সাগরে গিয়ে সাঁতারও কাটা যাবে।

আর মিসেস লিয়ারিকেও আমার পছন্দ হয়েছে। নরম মেজাজ। আমার বাবার মতো বদমেজাজী নয়। এখানে শান্তিতেই থাকতে পারবো আমরা।

খোলা জায়গা পেয়ে টকারেরও সুবিধে হলো। ইচ্ছেমতো গাড়ি চালাতে শুরু করলো সে। যাত্রী হলো নটি। মজা পেয়ে পেছন পেছন ছুটে বেড়াতে লাগলো। রাফিয়ান।

সেদিন বিকেলে ঘরে বসে আলোচনা করে ঠিক করলো ওরা, পরের কয়েকটা দিন কি কি করবে।

পরের দিন থেকে সাঁতার কাটলো ওরা, আশপাশের নির্জন এলাকায় পিকনিক করলো, বাগানে খেললো, যার যা খুশি ইচ্ছে মতো করলো। সবাই খুশি, একমাত্র কিশোর ছাড়া। তার মনের মতো কাজ পায়নি। আশা করেছিলো, যে-রকম জায়গা, একটা না একটা রহস্য পেয়ে যাবেই। চুটিয়ে মাথা খাটাতে পারবে। নিরাশ হতে হয়েছে তাকে। এখন পর্যন্ত কিছুই পায়নি। দিন দুই পরে আরও খারাপ হলো অবস্থা। নামলো মন-খারাপ-করে-দেয়া বৃষ্টি। ঝমঝম ঝমঝম ঝরছে তো ঝরছেই। থামার আর নাম নেই। সেই সঙ্গে ঠাণ্ডা ঝড়ো বাতাস যেন হাড় কাঁপিয়ে দেয়।

ঘরের মধ্যে আর কি খেলা যায়? ইনডোর গেম যা যা আছে, দাবা, কেরম, কোনোটাই ভালো লাগে না ওদের। টকারেরও না। সে গাড়ি হতে পারলে খুশি। কিন্তু জায়গা কম। ছোট বারান্দায় যতোটা ছোটাছুটি করতে পারলো করলো, তারপর বিরক্ত হয়ে সে-ও এসে বসে পড়লো ঘরে।

 ঘরের কোণে আগুনের কাছে পড়ে পড়ে ঘুমায় রাফিয়ান, বানরটা মাঝে মাঝে গিয়ে তার লেজ থেকে উকুণ বেছে দেয়। কখনও সিলিং ফ্যান ধরে দোল খায়, কখনও বা চুপটি করে জানালার ধারে বসে থাকে, গালে হাত দিয়ে গম্ভীর হয়ে।

কিশোরও বেশির ভাগ সময়ই জানালার ধারে বসে থাকে। বাইরের বৃষ্টি দেখে। মাঝেসাঝে ভারি গলায় কবিতা আবৃত্তি করে।

সেদিনও করছিলোঃ গগনে গরজে মেঘ ঘন বরষা, কূলে একা বসে আছি নাহি ভরসা…

পাশে বসে আছে রবিন আর মুসৗ। ওরা এখন বাংলা অনেকটা বোঝে, বলতেও পারে কিছু কিছু।

কিসের নাহি ভরসা কিশোর মিয়া? ভুরু নাচিয়ে হেসে জিজ্ঞেস করলো মুসা।

আর কিসের? জবাবটা দিলো রবিন। রহস্যের।…আরে, এতো মন খারাপ করছো কেন? পাবে, পাবে, নিশ্চয় পেয়ে যাবে এই দুনিয়ায় রহস্যের অভাব নেই।

যা জঙ্গল, আর পোড়ো বাড়ি আছে আশপাশে, মুসা বললো। গুপ্তধনের খোঁজ পেয়ে গেলেও হতো। অন্তত একটা ম্যাপ-ট্যাপ…

চেষ্টা করলে হয়তো গুপ্তধনই পেতে পারো, পেছন থেকে বলে উঠলো লিয়ারি।

ফিরে তাকালো তিন গোয়েন্দা।

মিটিমিটি হাসছে মহিলা। বললো, দাঁড়াও, চা নিয়ে আসি। তারপর বলবো।

সেইদিন লিয়ারির আরেক পরিচয় পেলো ছেলেরা। মহিলা বর্ন স্টোরি টেলার, একেবারে জাত গল্প বলিয়ে। এতো সুন্দর করে গুছিয়ে বলে, না শুনে। উপায় নেই।

একঘেয়ে ভাব অনেকটা কাটলো ছেলেমেয়েদের। খাওয়ার সময় খায়, আর বাকি সময় বসে বসে গল্প শোনে।

বাইরে বৃষ্টির থামাথামি নেই। পড়েই চলেছে। কখনও অঝোর বর্ষণ, কখনও গুঁড়ি গুঁড়ি। মাঝেমাঝে ধেয়ে আসে ঝড়ো হাওয়া, টালির চালের ফাঁকে ঢুকে বিচিত্র শব্দ তোলে।

জানালার ধারে বসে সোয়েটার বুনতে বুনতে গল্প করছে সেদিন লিয়ারি। হঠাৎ বাইরে চেয়ে কি দেখলো। মুখ ফিরিয়ে হেসে বললো, যাক, আর ঘরে বসে থাকতে হবে না। বেরোতে পারবে। মেঘ কাটছে। বৃষ্টি থামলে কোথায় ঘুরতে গেলে ভালো হবে, সেটাও বলে দিতে পারি। রহস্যময় হাসি ফুটলো তার মুখে।

.

০৬.

আরে তাই তো! আকাশের দিকে চেয়ে বললো কিশোর। খেয়ালই করিনি।…তা মিসেস এলমস, কোথায় গেলে ভালো হবে?

কয়েক দিনে কিশোরের স্বভাব অনেকখানিই জানা হয়ে গেছে লিয়ারির। বুঝে গেছে, ছেলেটা কি চায়? ওই যে সেদিন গুপ্তধনের কথা আলোচনা করছিলে, ওয়ালটার ম্যানরের কথা বললাম। ওখানেই যাও। রাস্তায় নেমে বাঁয়ে মোড় নেবে। ছোট একটা পাহাড়ের ওপর…

হা হা, দেখেছি, বলে উঠলো রবিন। আসার দিন

হ্যাঁ, ওটাই।

সেদিন কিন্তু সব কথা বলেননি, কিশোর ধরলো। খালি গুপ্তধনের গুজবের কথাই বলেছেন। ওই দুর্গ কাদের, ওয়ালটাররা কে ছিলো, কিছুই বলেননি।

তাহলে তো চা দরকার। বসো, নিয়ে আসি।

 দাঁড়ান, আমিও আসছি, উঠে দাঁড়ালো রবিন। আপনাকে সাহায্য করবো।

কয়েক মিনিটের মধ্যেই ফিরে এলো দুজনে। লিয়ারির হাতে চায়ের সরঞ্জাম। রবিনের হাতে ইয়া বড় এক কেক।

খাবারের গন্ধে চোখ মেললো রাফিয়ান। উঠে পায়ে পায়ে এগিয়ে এলো।

ফ্যানের একটা পাখা ধরে ঝুলছিলো নটি, ঝুপ করে লাফ দিয়ে পড়লো ঠিক কুকুরটার পিঠে।

ওদের দিকে দুই টুকরো কেক ছুঁড়ে দিলো লিয়ারি। চায়ের কাপে ঘনঘন চুমুক দিলো কয়েকবার। তারপর কাপটা প্লেটে নামিয়ে রেখে বললো, হ্যাঁ, ওয়ালটার দের শরীরে রয়েছে জলদস্যুর রক্ত…

এই এক কথায়ই শ্রোতাদের আকৃষ্ট করে ফেললো লিয়ারি। ওদেরকে আগ্রহী করে বসিয়ে রেখে কাপের বাকি চা-টুকু শেষ করলো। বললো, তোমরা খাচ্ছো না কেন? খাও খাও, আমি বলিহামফ্রে ডেভিড ওয়ালটার ছিলো দুর্ধর্ষ জলদস্যু। সে-ই বানিয়েছিলো ওই দুর্গ। লোকটা ছিলো ওলন্দাজ। তার জ্বালায় অস্থির হয়ে উঠেছিলেন ইংল্যাণ্ডের তৎকালীন রাজা। শেষে বিশাল এক নৌবাহিনী পাঠালেন। হামফ্রেকে ধরার জন্যে। মাঝ সাগরে প্রচণ্ড লড়াই হলো। একে একে ধ্বংস করে। দেয়া হলো হামফ্রের সমস্ত জাহাজ। তার বেশির ভাগ সঙ্গীসাথীই মারা পড়লো। কিন্তু তাকে ধরতে পারলো না নেভি। একটা জাহাজ নিয়ে কোনোমতে পালিয়ে বাঁচলো সে, সোজা চলে এলো আমেরিকায়। ওই একটা জাহাজেও ধনরত্ন কম। ছিলো না। ডাকাতি ছেড়ে দিয়ে বিরাট এক দুর্গ বানিয়ে বাস করতে লাগলো হামফ্রে। নিরাপদেই কাটিয়ে গেল জীবনের শেষ কটা দিন। ও হ্যাঁ, এখানে এসে বিয়ে করেছিলো সে। তাদেরই বংশধর এখানকার ডেভিড ওয়ালটার, ডাক্তার। হয়েছে। ডাক্তারের বউ বিদেশী, এক আইরিশ মহিলা, নরিলি। ছেলেপুলে হয়নি। ডাক্তারের বড় এক ভাই ছিলো, মারা গেছে, এক ছেলে রেখে গেছে। নাম, ড্যানি। ওই ছেলেই একদিন এতোবড় সম্পত্তির মালিক হবে। ড্যানির বাবা ছিলো। আর্কিটেক্ট, লণ্ডনে বিরাট বাড়ি করেছে, অনেক টাকার মালিক। ড্যানি আর তার চাচা-চাচী, ওখানেই থাকে বেশি, এখানে প্রায় আসেই না। এলেও দুচারদিন থেকে আবার চলে যায়। দেশ তো আসলে ওদের ওটা-ই।

এলে কি ওই পোড়ো বাড়িতেই থাকে নাকি? জিজ্ঞেস করলো জিনা।

আরে না না, ওখানে থাকবে কি? দুৰ্গটার একটা ঘরের ছাতও অবশিষ্ট নেই, সব ভেঙে পড়েছে। কাছেই আরেকটা সুন্দর বাড়ি বানিয়ে নিয়েছে ডাক্তার,  চমৎকার একটা পার্কের কাছে। বাংলোটার নাম দিয়েছেঃ ওয়ালটার লজ।

ও, দেখেছি তো সেদিন বাড়িটা, মুসা বললো। দুর্গের কাছে গেলেই দেখা যায়।

হ্যাঁ। ওয়ালটার ম্যানর, ওয়ালটার লজ, পার্ক, ওয়ালটার উড, আর ওদিককার প্রায় সমস্ত জায়গাই ওদের। আমার এই কটেজটাও…

কি বললেন? ভুরু কোচকালো কিশোর। আপনার মানে লিয়ারি কটেজও ওয়ালটারদের জায়গার মাঝেই?

আগে ছিলো। এখন আলাদা। আমার স্বামীর দাদা, মানে আমার দাদা-শ্বশুর চাকরি করতো ওয়ালটারদের এস্টেটে। এই জায়গাটা তাকে দান করে দিয়েছে ডাক্তারের দাদা।

ভাঙা দুর্গ দেখার ইচ্ছে নেই আমার, জিনা বললো। ওরকম দুর্গ আমার নিজেরই একটা আছে, এক্কেবারে আস্ত এক দ্বীপ সহ। ভাঙা দেয়াল ছাড়া দেখার আর কি আছে?

পাহাড়ে চড়লেই সাগর দেখতে পাবে। তোমরা যেদিকে সাঁতার কাটতে গেছে, তার উল্টো দিকে। ওখানে সৈকত নেই, সাঁতার কাটতে পারবে না। নামতেই পারবে না। খাড়া পাহাড়, নিচে পাথরের ছড়াছড়ি, ঢেউ আছড়ে পড়ে। মাথা ঘুরে যদি নিচে পড়ো, ছাতু হয়ে যাবে। কাজেই, হুঁশিয়ার থাকবে।

সাগর অনেক দেখেছি। আর কি আছে?

ওয়ালটার উড়। বন। ভেতরে ঝর্না আছে একটা, অনেক বুনো ফুল আছে।

 আর? জিনার মনে হলো, আসল কথাটা বলছে না মহিলা।

আর। হাসলো লিয়ারি। আর আছে একটা অনেক পুরনো কবরস্থান, একেবারে প্রাগৈতিহাসিক কালের। গুহামানবের অনেক কঙ্কাল পাওয়া গেছে। তার ওপরই নতুন কবর বানিয়ে নিয়েছিলো হামফ্রে ওয়ালটার। জলদস্যু ছিলো তো, মন-মানসিকতাই ছিলো অন্যরকম। নইলে বাপু, এতো জায়গা থাকতে পুরনো ওই কবরের ওপর আরেক কবর বানানো কেন?

টিউমিউল্যাস! বিড়বিড় করলো কিশোর।

 টিউ..কী? বুঝতে পারলো না মুসা।

টিউমিউল্যাস। বুঝিয়ে বললো গোয়েন্দাপ্রধান, ওই ধরনের কবরস্থানকে বলে টিউমিউল্যাস।

.

বৃষ্টি থামলো বটে, কিন্তু মেঘ পুরোপুরি কাটেনি। আকাশের মুখ থমথমে। যে কোনো মুহূর্তে ঝরঝর করে শুরু হতে পারে আবার।

নামলে নামুক, জিনা বললো। আর বসে থাকতে পারবো না। বসে থেকে থেকে হাতে-পায়ে খিল ধরে গেছে। একটু ঝাড়া দিয়ে না এলে আর বাঁচবো না।

রেইনকোট পরে বেরোলো ওরা।

রাফিয়ান আর নটির কৃত্রিম কোট দরকার নেই, প্রাকৃতিক আসল রোমশ কোটই আছে। কাজেই পানিকে ওদের বিশেষ ভয় নেই। ভিজলে, জোরে ঝাড়া দিলেই গা থেকে ঝরে যাবে পানি।

ছেলেমেয়েরা চললো পায়ে হেঁটে, নটি চললো রাফিয়ানের পিঠে সওয়ার হয়ে। গলায় গলায় ভাব এখন দুটোতে, মাঝে মাঝে খাবার নিয়ে যদিও লেগে যায় ঝগড়া।

দুর্গের কাছে চলে এলো ওরা। ভেঙেচুরে রয়েছে শত শত বছরের পুরনো দেয়াল, ছাতের চিহ্নও নেই।

দূর, মন খারাপ করে দেয়। বিড়বিড় করলো রবিন।

পুরনো দুর্গের সেলার দেখার খুব ইচ্ছে আমার, টুকার বললো। কিন্তু নামবো কোনখান দিয়ে? পথ তো দেখছি না।

শুধুই ধ্বংসস্তূপ। পুরোপুরি ঢেকে দেয়ার পায়তারা কষছে যেন ঘন ঘাস আর লতার দঙ্গল।

দেখার কিছুই নেই, মুসা বললো।

হ্যাঁ, খামোকাই এলাম। আকাশের দিকে তাকালো কিশোর। জলদি চলো৷ নামলো বলে।

কয়েক পা এগোতে না এগোতেই আবার বৃষ্টি পড়তে শুরু করলো। দৌড়ে চললো ওরা। কিন্তু রেইনকোটেও মানলো না। কটেজে ফিরতে ফিরতে ভিজে চুপচুপে হয়ে গেল সবাই।

 পরের দিনও একই অবস্থা। সকাল থেকে বৃষ্টি। বিকেলের দিকে ধরে এলো। মেঘের ফাঁকে উঁকি দিলো সূর্য।

কিশোর প্রস্তাব দিলো, চলো, বেরোনো যাক।

সবাই রাজি। বেরিয়ে এলো পেছনের বাগানে। বাগানের পরে খানিকটা জংলা জায়গা। কয়েকটা আপেল গাছ আছে, আর আছে অনেক পুরনো বিশাল এক ওক গাছ। সব ভেজা। তার মধ্যেই ঘোরাঘুরি করতে লাগলো ওরা। ঘরে বসে থাকার চাইতে এটা অনেক ভালো মনে হলো।

রাফিয়ান আর নটির আনন্দের সীমা নেই। ছুটোছুটি করে খেলছে।

ভেজা ঘাস বেশিক্ষণ ভালো লাগলো না বানরটার। দুই লাফে গিয়ে উঠলো, ওকের একটা নিচু ডালে। তারপর তরতর করে উঠে গেল মগডালে।

মেঘের আড়ালে ঢুকলো আবার সূর্য।

নটি, এই নটি, নেমে আয়, ডাকলো টকার।

নামতে চাইলো না বানরটা। ওপরে থেকেই চেঁচিয়ে জবাব দিলো, ইঁক! ইঁক!

হুফ! হুফ! করে রাফিয়ানও ওকে নামার জন্যে ডাকলো।

কানেই নিলো না নটি। অনেক দিন পর ঘর থেকে ছাড়া পেয়ে গাছে চড়েছে বানর, নামতে কি আর ইচ্ছে করে? ওদিকে বৃষ্টিও প্রায় এসে যাচ্ছে।

ইতিমধ্যে দুবার-ঘর থেকে বেরিয়ে চা খাওয়ার জন্যে তাগাদা দিয়ে গেছে লিয়ারি।

এই নটি, নামলি না! রেগে গিয়ে ধমক দিলো টকার।

চলো, আমরা হাঁটতে শুরু করি, জিনা বললো। আপনিই নেমে আসবে।

ফোঁটা পড়তে শুরু করলো। থেকে থেকে বিদ্যুৎ চমকাচ্ছে। নামলো না বানরটা।

না নামলে থাক ওখানে, হাত নেড়ে বললো টকার। আমরা চলে যাচ্ছি…

তার কথা শেষ হলো না। প্রচণ্ড শব্দে বাজ পড়লো। সঙ্গে সঙ্গে নামলো। ঝমঝম করে বৃষ্টি।

চমকে উঠলো বানরটা। আর এক মুহূর্ত দেরি করলো না। নামতে শুরু করলো। ওকে ধরার জন্যে হাত বাড়িয়ে দিলো টকার। লাফ দিলো নটি। কিন্তু লক্ষ্যভ্রষ্ট হয়ে টকারের হাতে না পড়ে পড়লো গিয়ে ভেজা ঘাসে। নিচে পানি, ওপরে পানি, এই অবস্থায় হতবুদ্ধি হয়েই বোধহয় মাথা গোঁজার জন্যে সোজা লতানো ঝোপের দিকে দৌড় দিলো ওটা।

আরে ধরো, ধরো! চেঁচিয়ে উঠলো টকার।

বৃষ্টির মাঝে বানরটাকে ধরার জন্যে পেছনে ছুটলো সবাই। রাফিয়ান ভাবলো, এটা একটা নতুন ধরনের খেলা। দৌড়ে গেল নটির কাছে। লাফ দিয়ে তার পিঠে উঠে বসলো বানরটা। আর সওয়ারির আদেশেই যেন সোজা, গিয়ে ঝোপের মধ্যে ঢুকলো কুকুরটা।

ধমক দিয়ে রাফিয়ানকে ডাকতে যাবে জিনা, এই সময় হাত তুলে দেখালো, রবিন। আমার মনে হয় ওখানে যাচ্ছে।

জংলা জায়গাটার ওধারে একটা পুরনো ছাউনি। কাজের জায়গা, কিন্তু কেউ কাজ করে না এখন ওখানে। অব্যবহৃত পড়ে রয়েছে অনেকদিন।

দৌড়ে এসে ছাউনিতে ঢুকলো ওরা। রবিনের অনুমান ঠিকই। নটিকে নিয়ে ওখানেই এসেছে রাফিয়ান। কুকুরটার গলা জড়িয়ে ধরে রেখেছে বানরটা, ঠাণ্ডায়। কিংবা ভয়ে যে কারণেই হোক, কাঁপছে। মনিবকে দেখে লাফিয়ে এসে উঠলো তার কাঁধে।

কালো আকাশটাকে চিরে দিলো যেন বিদ্যুতের শিখা। ভীষণ শব্দে বাজ পড়লো। আবার, তারপর আবার।

খাইছে! বলে উঠলো মুসা। ঝড়ই শুরু হলো দেখছি।

হ্যাঁ, মনে হয় একেবারে মাথার ওপর বাজ পড়ছে, বললো জিনা।

আর বাড়ছেই, কান পেতে ঝড়ের আওয়াজ শুনছে রবিন। এগিয়ে আসছে। বোধহয় সাগরের দিক থেকে…

হঠাৎ উজ্জ্বল নীল আলোয় আলোকিত হয়ে গেল দশদিক। ছাউনির নিচে গা ঘেঁষাঘেঁষি করে এলো ছেলেরা। আলোর প্রায় পর পরই বাজ পড়লো। এতো জোরে আওয়াজ হলো, মনে হলো কানের পর্দা ফেটে গেল ওদের, থরথর করে কেঁপে উঠলো মাটি। চেঁচালো রাফেয়ান। চি-চি করলো বানরটা।

কটেজের ওপর পড়েছে! চোখ বড় বড় হয়ে গেছে টকারের। হায় হায়, বেচারি লিয়ারি…

চুপ! থামিয়ে দিলো তাকে কিশোর। কটেজে নয়। ওই দেখো, ওক গাছটা…দেখেছো?

ঘন বৃষ্টির মাঝ দিয়েও দেখা গেল। দেখলো সবাই। একটু আগের সুন্দর ওঁক গাছটা আর নেই, দাঁড়িয়ে আছে শুধু ওটার পোড়া কালো কাণ্ড, ধোয়া বেরোচ্ছে।

আল্লাহরে! কি সর্বনাশ! আঁতকে উঠে বললো মুসা। কয়েক মিনিট আগে…

নটি ছিলো ওটার ডালে…, বললো টকার।

আর আমরা সবাই ছিলাম ওটার তলায়! জিনা শেষ করলো কথাটা।

.

০৭.

ধীরে ধীরে দূরে সরে গেল বাজের শব্দ। বিদ্যুতের ঝিলিকও কমলো। থেমে আসছে ঝড়।

শোনা গেল লিয়ারির ভয়ার্ত ডাক, কিশোর! জিনা! কোথায় তোমরা?

আমরা ভালোই আছি, চেঁচিয়ে জবাব দিলো কিশোর। আপনি বেরোবেন। না। আমি আসছি। অন্যদেরকে ছাউনিতে থাকতে বলে বেরিয়ে গেল সে। এক ছুটে গিয়ে ঢুকলো কটেজে।

দশ মিনিট পর ফিরে এলো আবার। প্লাস্টিকের ব্যাগে ভরে শুকনো সোয়েটার। নিয়ে এসেছে সবার জন্যে। আর এনেছে বড় একটা ঝুড়ি। তাতে স্যাণ্ডউইচের প্যাকেট, মস্ত এক চকোলেট কেক, বড় এক ফ্লাস্ক কোকা।  

এই না হলে তুমি আমার ভাই! বন্ধুর কাঁধে হাত রেখে হেসে বললো মুসা।

হয়েছে হয়েছে, এসো এখন শেষ করে ফেলা যাক। খুব খিদে পেয়েছে।

তোমারই যখন খিদে, আমার অবস্থা বোঝো!

হেসে উঠলো সবাই।

দেখতে দেখতে শেষ হয়ে গেল সমস্ত খাবার। একটা কণাও অবশিষ্ট থাকলো না। এমনকি মাটিতে যা পড়লো, তা-ও না। চেটেপুটে শেষ করলো রাফিয়ান আর নটি।

বৃষ্টি থেমেছে।

রবিন বললো, চলো তো, কাছে গিয়ে দেখি গাছটার অবস্থা।

ছাউনি থেকে বেরোলো সবাই। হঠাৎ করেই দেখা দিলো সূর্য। মেঘ তাড়িয়ে নিয়ে চলে গেছে ঝড়ো বাতাস।

ইস, এতো সুন্দর গাছটা গেল? আফসোস করে বললো জিনা।

হ্যাঁ, আনমনে বিড়বিড় করলো কিশোর। লিয়ারি বললো না সেদিন, গাছটা অনেক পুরনো। হামফ্রে ওয়ালটার যখন এসেছিলো, তখনও ছিলো।

আরও কাছে এগিয়ে গেল ওরা। গাছটার চারপাশের গোড়ার মাটি যেন খুবলে তুলে ফেলেছে কোনো দানব। গর্ত হয়ে গেছে। একটা পরিখার মাঝখানে দাঁড়িয়ে। রয়েছে যেন এখন পোড়া কাণ্ডটা।

কাণ্ড দেখেছো, কতো বড় গর্ত? টকার বললো। বাজের এতো জোর!

খেলাচ্ছলে লাফ দিয়ে গর্তে নামলো নটি। কি একটা জিনিস কৌতূহল জাগিয়েছে তার। সরু সরু আঙুল দিয়ে মাটি খুঁড়তে শুরু করলো। দেখাদেখি রাফিয়ানও গিয়ে নামলো, মাটি খোঁড়ায় সাহায্য করলো বানরটাকে।

পোকা খুঁজছে, হেসে বললো টকার।

ভুরু কুঁচকে তাকিয়ে আছে কিশোর। গম্ভীর। আরও ভালোমতো দেখার জন্যে গর্তের কিনারে গিয়ে কুঁকলো। কঠিন কিছু একটাতে কুকুরটার নখ লেগে শব্দ হয়েছে। কি ওটা? বললো, এই রাফি, খোড়। আরও খোড়।

হঠাৎ প্রায় একসঙ্গে চেঁচিয়ে উঠলো সবাই। বেরিয়ে পড়েছে রঙচটা, মরচে পড়া একটা ধাতব বাক্স।

কি ওটা? মুসার প্রশ্ন।

হয়তো গুপ্তধন, রসিকতা করে হাসলো রবিন।

হু, গুপ্তধন পাওয়া এতোই সহজ! জিনা বললো।

কিশোর ততোক্ষণে নেমে পড়েছে গর্তে। মাটি সরিয়ে বাক্সটা তুলে আনার চেষ্টা করছে।

ওভাবে পারবে না, মুসা বললো। দাঁড়াও, খন্তা-টন্তা কিছু একটা নিয়ে। আসি। এক দৌড়ে গিয়ে কটেজ থেকে একটা শাবল নিয়ে এলো সে। দুজুনে মিলে খুঁড়ে তুলে আনলো বাক্সটা।

তালা আছে, কিন্তু এতো পুরনো, মরচে পড়ে একেবারে নষ্ট হয়ে গেছে। শাবল দিয়ে এক বাড়ি মারলো মুসা। হুক ভেঙে তালাটা খুলে,ড়ে গেল।

ডালা তুললো কিশোর।

হাঁ হয়ে গেল সবাই।

সত্যি গুপ্তধন! সোনার মোহর আর নানারকম অলংকার।

চোখ ডলো কেউ, কেউ চিমটি কাটলো নিজের হাতে। না, জেগেই তো আছে, স্বপ্ন দেখছে না। তারমানে আসলেই গুপ্তধন পেয়েছে। গুপ্তধন পাওয়া নতুন। কোনো ব্যাপার নয় ওদের জন্যে, আগেও অনেক বার পেয়েছে। তবে এভাবে নয়, অনেক খুঁজতে হয়েছে। এই

বিশ্বাস হচ্ছে না এখনও আমার, বিড়বিড় করলো রবিন।

অনেক কিছুই ঘটে এই পৃথিবীতে, নিচের ঠোঁটে চিমটি কেটে বললো কিশোর, যার কোনো ব্যাখ্যা দেয়া যায় না।…্যাকগে, পেয়েছি এ-তো আর মিছে। কথা নয়। চলো, এগুলো কটেজে নিয়ে যাই। কার জিনিস, হয়তো লিয়ারি বলতে পারবে।

বাক্সটা নিয়ে এলো ওরা। রান্নাঘরের টেবিলে রেখে খুললো।

একবার অকিয়েই স্তব্ধ হয়ে গেল লিয়ারি। অনেকক্ষণ পর কথা ফুটলো মুখে, গুজব তাহলে মিথ্যে নয়! সত্যিই গুপ্তধন লুকিয়ে রেখে গেছে হামফ্রে ওয়ালটার।

সেদিন তো বললেনই লুকিয়েছে, কিশোর বললো।

বলেছিলামঃ লোকে বলে। বিশ্বাস করতাম না। এখন তো নিজের চোখেই দেখতে পাচ্ছি…

কিন্তু লুকালো কেন?

স্বভাব, জবাবটা দিলো রবিন। জলদস্যুরা ধনরত্ন লুকাতে অভ্যস্ত ছিলো, হয়তো সে-কারণেই নিরাপদ জায়গায় এসেও নিশ্চিত হতে পারেনি হামফ্রে। ওয়ালটার। কিছুটা লুকিয়ে রেখেছিলো ওই ওক গাছের তলায়।

কি জানি। হতেও পারে, অনিশ্চিত ভঙ্গিতে হাত নাড়লো কিশোর।

এসো না, কি কি আছে দেখি? একটা লিস্ট তৈরি করে ফেলি, প্রস্তাব দিলো টকার। গুপ্তধনের গল্প শুধু বইয়েই পড়েছে এতোদিন, চোখে দেখেনি।

অন্যদেরও মনে ধরলো কথাটা। অনেকদিন পর একটা নতুন ধরনের কাজ পাওয়া গেছে।

বাক্সে রয়েছেঃ ছয়শো সোনার মোহর, পান্না খচিত এক সেট গহনা, হীরা আর নীলকান্ত মণি বসানো একটা ব্রেসলেট, বিশাল একটা রুবি পাথর, একটা টায়রা, একটা হীরার লকেট, অনেকগুলো আঙটি আর কানের দুল,–প্রায় সবগুলোতেই মূল্যবান পাথর বসানো। বড় বড় মুক্তো আছে অনেকগুলো, গোটা তিনেক সোনার ব্রেসলেট, তিনটে সোনার চেন, দুটো সোনার ঘড়ি (বন্ধ হয়ে আছে), চারটে সোনার বড় বড় মেডেল। আর আছে হাতির দাঁতে খোদাই করা দুটো প্রতিকৃতিঃ একটা পুরুষের, আরেকটা মহিলার। পুরুষেরটার নিচে নাম লেখা রয়েছে হামফ্রে ডেভিড ওয়ালটার। আর মহিলাটার নিচে টেরিলিন ওয়ালটার।

হামফ্রের স্ত্রীর নাম কি ছিলো, জানেন? জিজ্ঞেস করলো কিশোর।

 টেরিলিন…

হু। তারমানে গুপ্তধন হামফ্রেই লুকিয়েছিলো। এই প্রতিকৃতি দুটোই তার প্রমাণ।

কি করবে এখন এগুলো? রবিন জানতে চাইলো।

জবাব না দিয়ে লিয়ারির দিকে তাকালো কিশোর। ডাক্তার ওয়ালটার এখন। কোথায়? এখানে, না লণ্ডনে?

ঠিক বলতে পারবো না, বৃষ্টির জন্যে বেরোতেই তো পারি না, বললো লিয়ারি। তবে সেদিন মুদির বৌ বলছিলো, এখানে নেই। দুচার দিনের মধ্যে আসবে। তারমানে আজ কিংবা কাল আসবে।

জানালার বাইরে তাকালো কিশোর। বৃষ্টি বোধহয় আর আসবে না। বন্ধুদের দিকে ফিরলো। একবার গেলে কেমন হয়? ওয়ালটার লজে? ডাক্তার থাকলে তাঁকে জানাবো খবরটা। এসে নিয়ে যাবেন। আইনতঃ জিনিসগুলো এখন তাঁরই পাওনা।

চলো, মুসা রাজি। হেঁটে, না সাইকেলে?

সাইকেল।

দ্রুত প্যাড়াল করে চললো ওরা। অনেক দিন ঘরে বন্দি হয়ে থাকার পর। মুক্তির আনন্দ, তার ওপর গুপ্তধন পাওয়ার উত্তেজনা, টগবগ করে ফুটছে যেন শরীর রক্ত। টকারের সাইকেল নেই, সে বসেছে মুসার সাইকেলের ক্যারিয়ারে।

নটি চলেছে রাফিয়ানের পিঠে সওয়ার হয়ে।

অবশেষে দূর হয়ে গেছে মেঘ। কড়া রোদে ভেজা মাটি থেকে বাষ্প উঠছে। গাছপালা ঘন সবুজ, এক কণা বালি নেই, ধুয়েমুছে সব সাফ হয়ে গেছে।

দেখতে দেখতে চললো ওরা।

.

০৮.

ভাঙা দুর্গের পাশ দিয়ে পথ চোখে পড়লো ওয়ালটার লজের শাদা, দেয়াল। প্রায় বর্গাকার চমৎকার একটা বাংলো। বেগুনী উইসট্যারিয়া আর অন্যান্য লতায়, ছেয়ে রয়েছে। সুন্দর ছিমছাম বাগানে নানারকম ফুলের ঝাড়, বেড, সবুজ ঘাসে ঢাকা লন।

 গেটের কাছে এসে সাইকেল থেকে নামলো ওরা। পাল্লার লোহার শিকের ফাঁক দিয়ে ভেতরে তাকালো। বাগানে কাজ করছে একটা লোক।

গেটের পাশে লাগানো ঘন্টা বাজানোর শেকল ধরে টানলো কিশোর।

ঘন্টার শব্দে ফিরে তাকালো লোকটা। খোয়া বিছানো পথে জুতোর মচমচ শব্দ তুলে এগিয়ে এলো গেটের কাছে। মাঝবয়েসী, মাথায় পাতলা চুল, ধূসর। গোলগাল মুখে পাতলা ঠোঁটজোড়া বড় বেশি বেমানান। চেহারায় বিরক্তি। পরনে, কর্ডের প্যান্ট-ময়লা, মাটি লেগে রয়েছে। গায়ে নীল ওভারঅল। গভীর কণ্ঠে। জিজ্ঞেস করলো, কি চাই?

ডাক্তার ওয়ালটার আছেন? ভদ্রভাবে জিজ্ঞেস করলো কিশোর।

জবাব দিলো না লোকটা। এক এক করে তাকালো পাঁচজনের মুখের দিকে। তারপর বললো, আজেবাজে ছেলেমেয়ের সঙ্গে কথা বলেন না তিনি।

কথা বলার জন্যে মুখ খুলেও থেমে গেল কিশোর।

লোকটা বললো, তোমাদের মতো কেউ যাতে ঢুকতে না পারে, সেদিকে কড়া। নজর রাখতে বলা হয়েছে আমাকে।

রাগে-লাল হয়ে গেল জিনার মুখ। এমনিতেই ধৈর্য তার কম। ঝাঝালো কণ্ঠে বললো, দেখুন, বড় বড় কথা বলবেন না। আজেবাজে ছেলেমেয়ে নই আমরা। আপনাকেই বরং বাজে লোক মনে হচ্ছে আমার। যান, গিয়ে বলুন, জরুরী কথা। বলতে এসেছি তাঁর সঙ্গে।

আরও গম্ভীর হয়ে গেল কেয়ারটেকার। তারপর হঠাৎ হাসতে আরম্ভ করলো। জরুরী, না? হাহ্ হাহ্ হা! তা জরুরী ব্যাপারটা কি জানতে পারি, ম্যাডাম?

দেখুন, শীতল কণ্ঠে বললো কিশোর। ওর নাম জরজিনা পারকার। প্রফেসর হ্যারিসন পারকারের নাম নিশ্চয় শুনেছেন, বিখ্যাত বিজ্ঞানী, তাঁর মেয়ে। কাজেই বুঝতে পারছেন, আজেবাজে কেউ নই আমরা। এখন দয়া করে গিয়ে যদি ডাক্তার সাহেবকে খবর দেন, খুশি হবো।

দ্বিধা ফুটলো লোকটার চোখে।  

যান, মুসা বললো। গিয়ে বলুন, জরুরী কথা আছে। তাঁরই লাভ।

হ্যাঁ, মুসার কথার পিঠে বলে উঠলো টকার। তাঁর জন্যে সুখবর। গুপ্তধন পাওয়া গেছে।

এই, তুমি চুপ করো তো! ধমক দিয়ে টকারকে থামিয়ে দিলো কিশোর।

গুপ্তধন? ভুরু কোঁচকালো কেয়ারটেকার। তারপর হা-হা করে হাসলো। এই গপ্লোই শোনাতে এসেছো নাকি? নিশ্চয় বলবে, মিস্টার হামফ্রে ওয়ালটারের গুপ্তধন খুঁজে পেয়েছো তোমরা?

কড়া গলায় জিনা বললো, আপনার সঙ্গে আমাদের কোনো কথা নেই! যা বলছি করুন। ডাক্তার ওয়ালটারকে খবর দিন, চাকরিটা না খোয়াতে চাইলে। জলদি করুন।

থাকলে তো খবর দেবো, সামান্য নরম হলো কেয়ারটেকার। বাড়ি নেই। আজ সকালেই আসার কথা ছিলো। বৃষ্টির জন্যেই হয়তো আসতে পারেননি। আকাশ ভালো থাকলে রাতে চলে আসতে পারেন, কিংবা, কাল কিংবা পরশু…ঠিক নেই। আমাকেই খুলে বলো সব। এলে তাঁকে জানিয়ে দেবো।

 কর্কশ ব্যবহার অনেক কোমল হয়ে গেছে লোকটার। কিন্তু তবু কেউই তাকে পছন্দ করতে পারলো না। এমনকি রাফিয়ানও না। শিকের ফাঁক দিয়ে মুখ ঢুকিয়ে। তার জুতো শুকলো, তারপর মৃদু গররর করে উঠলো।

 সরি, বললো কিশোর। ডাক্তার সাহেবকে ছাড়া আর কাউকে বলা যাবে না। কাল আবার আসবো আমরা।

না না, দরকার কি? এসে হয়তো পেলে না, খামোকা কষ্ট করবে। তারচে এক কাজ করো, ঠিকানা রেখে যাও। সাহেব এলেই তোমাদেরকে খবর দেবো।

আবার বোকামি করে বসলো টকার। বলে ফেললো, লিয়ারি কটেজ, চেনেন নিশ্চয়?

চিনি, চিনি, হেসে বললো লোকটা। ওদিক দিয়েই তো রোজ বাজারে যাই। ঠিক আছে, মিস্টার ওয়াল্টার এলে একটা নোট ফেলে যাবোখন তোমাদের লেটার বক্সে।

লোকটার হাসি মোটেও পছন্দ হলো না মুসার। ফেরার পথে বললো, শয়তান লোক। দেখলে, গুপ্তধনের নাম শুনেই কেমন বদলে গেল?

তা না-ও হতে পারে। মিস্টার পারকারের নাম শুনেও বদলাতে পারে, রবিন বললো। আর চেহারা দেখে মানুষ বিচার করা যায় না। মুখে কড়া, মনটা হয়তো নরম।

তুমি নিজে নরম তো, তাই সবাইকে ওরকম ভাবো, বললো জিনা। আমি মুসার সঙ্গে একমত। আস্ত শয়তান লোক। হারামী নাম্বার ওয়ান। এই কিশোর, তুমি কি বলো?

আমারও ভালো লাগেনি।

আমারও না, টকার বললো। গুপ্তধনের কথা বলে বোকামি করিনি তো?

বোকামিই করেছে। আর ঠিকানা দিয়ে করেছো গাধামি। আগ বাড়িয়ে আর কথা বলতে যাবে না কক্ষণো। তোমাকে বলেছি না, আমরা গোয়েন্দা। গোয়েন্দাগিরিতে সব সময় ভেবেচিন্তে কথা বলতে হয়…

কিন্তু অসুবিধে কি হবে?

গুপ্তধনের লোভে আমাদের পেছনে লাগতে পারে। ঠিকানাও বলে দিয়ে এসেছো…

তাই তো! ভুলই হয়ে গেছে…

যা হবার হয়ে গেছে। এখন আর ভেবে লাভ নেই। দেখা যাক কি হয়। হয়তো লোকটা বিশ্বাসই করেনি আমাদের কথা।

 লিয়ারি জানালো ওদেরকে, লোকটার নাম ডেনার। ডাক্তার ওয়ালটারের বাড়িতে মালীর কাজ থেকে শুরু করে কেয়ারটেকারের কাজ, সবই সে করে। ডেনার ভালো কি মন্দ, বলতে পারলো না। কারণ, বোঝার উপায় নেই। মোটেই নাকি মিশুক না লোকটা।

পরদিন সকালে ডেনার কখন এলো লিয়ারি কটেজে কেউই জানলো না। কিন্তু নাস্তার টেবিলেই পাওয়া গেল তার নোট। একটা খামে ভরে চিঠির বাক্সে ফেলে গেছে। লিয়ারি এনে দিলো ছেলেদের।

 নোটে লেখাঃ জরুরী কাজে আটকে পড়েছেন ডাক্তার ওয়ালটার। তোমাদের সঙ্গে দেখা করতে পারছে না বলে দুঃখ প্রকাশ করেছেন। আজ দুপুরের দিকে তোমাদের সঙ্গে দেখা করবে তার ভাইপো ড্যানি ওয়ালটার। জিনিসগুলো তার। হাতে দিয়ে দেয়ার জন্যে অনুরোধ করেছেন ডাক্তার ওয়ালটার।

নিচে ডেনারের সই।

রেগে গিয়ে জিনা বললো, নিজে একটা নোট পর্যন্ত লিখতে পারলো না, এতোই জরুরী কাজে ব্যস্ত? ওই ডেনার ব্যাটা তাকে কি বলেছে, কে জানে! আসলে আমাদের কথা বিশ্বাস করেনি ওরা।

ওদেরই বা দোষ কি? কিশোর বললো। আমাকে বললে আমিও বিশ্বাস করতাম না। নিজের চোখে দেখেছি, বলেই না..তবে ওরকম ভাবে হঠাৎ গুপ্তধন পেয়ে যাওয়ার অনেক কাহিনী জানি আমি।

আমিও জানি, রবিন বললো। বইয়ে পড়েছি। রেফারেন্স বইতেও আছে কিছু কিছু ঘটনার উল্লেখ।

বিশ্বাস করেনি, মুখ ভর্তি খাবার চিবাতে চিবাতে বললো মুসা, তো কি হয়েছে? করবে। যখন বাক্সটা নিয়ে গিয়ে তার সামনে ফেলবে তার ভাতিজা।

ড্যানি আসবে দুপুর নাগাদ। ততোক্ষণ আর কটেজের কাছ থেকে দূরে যেতে, পারছে না ছেলেমেয়েরা। রোদ উঠেছে। বাগানে আর পেছনের জঙ্গলে ঘোরাঘুরি করেই কাটালো ওরা।

দুপুরের আগেই এলো ড্যানি। ছাউনিতে বসে গল্প করছিলো তখন ওরা। মোটর সাইকেলের আওয়াজ শুনে ছুটে গেল।

মাত্র কয়েক মিনিটের পথ। লিয়ারির কটেজটা খুব সুন্দর। শাদা রঙ বাড়িটার, জানালার পাল্লা সবুজ। গাছপালা, ফুলের বাগান, আর ঝোপঝাড়ে ঘেরা। বাগানটা ছাড়া বাকি সব গাছপালাকে বুনো মনে হয়, নিয়মিত সাফ না করায় জঙ্গল হয়ে গেছে। না, জায়গাটা ভালো, ছেলেমেয়েদের পছন্দ হলো।

তাছাড়া খুব নীরব, বললো রবিন। ভালো লাগে। পড়ালেখার জন্যে এরচে। ভালো জায়গা আর হয় না।

শুব্দ শুনে দরজায় এসে দাঁড়ালো মোটাসোটা, মাঝবয়েসী এক মহিলা, মুখে হাসি।এই যে, এসে পড়েছো তোমরা। এসো এসো, চা তৈরিই করে রেখেছি। ভাবলাম, সাইকেলে করে আসছো, নিশ্চয় খিদে লাগবে।– বাহ্, এই তো চাই! ভাবলো মুসা। না চাইতেই যদি এভাবে খাবার পাওয়া যায়…হেসে বললো সে, আসছি, এক মিনিট। সাইকেলগুলো রেখে আসি। এ হাতমুখ ধুয়ে, চা খেয়ে মালপত্র খুলে গোছাতে চললো ওরা। মাল বেশি নেই। সাইকেলের ক্যারিয়ারে করে যা যা আনতে পেরেছে। খুলে গোছাতে সময় লাগলো না। কাজ শেষ করে বাগানে বেরোলো ওরা। ঘুরে ঘুরে দেখতে লাগলো।

ভালোই লাগবে এখানে, জিনা বললো। জংলা জায়গা। তাছাড়া আমাদের বাড়িও কাছে। ইচ্ছে করলেই গিয়ে নৌকা বের করে নিয়ে দ্বীপে চলে যেতে পিরবো।

ঠিক বলেছো, মুসা একমত হলো। আবহাওয়া ভালো থাকলে সাগরে গিয়ে সাঁতারও কাটা যাবে।

আর মিসেস লিয়ারিকেও আমার পছন্দ হয়েছে। নরম মেজাজ। আমার বাবার মতো বদমেজাজী নয়। এখানে শান্তিতেই থাকতে পারবো আমরা।

খোলা জায়গা পেয়ে টকারেরও সুবিধে হলো। ইচ্ছেমতো গাড়ি চালাতে শুরু করলো সে। যাত্রী হলো নটি। মজা পেয়ে পেছন পেছন ছুটে বেড়াতে লাগলো। রাফিয়ান।

সেদিন বিকেলে ঘরে বসে আলোচনা করে ঠিক করলো ওরা, পরের কয়েকটা দিন কি কি করবে।

পরের দিন থেকে সাঁতার কাটলো ওরা, আশপাশের নির্জন এলাকায় পিকনিক করলো, বাগানে খেললো, যার যা খুশি ইচ্ছে মতো করলো। সবাই খুশি, একমাত্র কিশোর ছাড়া। তার মনের মতো কাজ পায়নি। আশা করেছিলো, যে-রকম জায়গা, একটা না একটা রহস্য পেয়ে যাবেই। চুটিয়ে মাথা খাটাতে পারবে। নিরাশ হতে হয়েছে তাকে। এখন পর্যন্ত কিছুই পায়নি। দিন দুই পরে আরও খারাপ হলো অবস্থা। নামলো মন-খারাপ-করে-দেয়া বৃষ্টি। ঝমঝম ঝমঝম ঝরছে তো ঝরছেই। থামার আর নাম নেই। সেই সঙ্গে ঠাণ্ডা ঝড়ো বাতাস যেন হাড় কাঁপিয়ে দেয়।

ঘরের মধ্যে আর কি খেলা যায়? ইনডোর গেম যা যা আছে, দাবা, কেরম, কোনোটাই ভালো লাগে না ওদের। টকারেরও না। সে গাড়ি হতে পারলে খুশি। কিন্তু জায়গা কম। ছোট বারান্দায় যতোটা ছোটাছুটি করতে পারলো করলো, তারপর বিরক্ত হয়ে সে-ও এসে বসে পড়লো ঘরে।

 ঘরের কোণে আগুনের কাছে পড়ে পড়ে ঘুমায় রাফিয়ান, বানরটা মাঝে মাঝে গিয়ে তার লেজ থেকে উকুণ বেছে দেয়। কখনও সিলিং ফ্যান ধরে দোল খায়, কখনও বা চুপটি করে জানালার ধারে বসে থাকে, গালে হাত দিয়ে গম্ভীর হয়ে।

কিশোরও বেশির ভাগ সময়ই জানালার ধারে বসে থাকে। বাইরের বৃষ্টি দেখে। মাঝেসাঝে ভারি গলায় কবিতা আবৃত্তি করে।

সেদিনও করছিলোঃ গগনে গরজে মেঘ ঘন বরষা, কূলে একা বসে আছি নাহি ভরসা…

পাশে বসে আছে রবিন আর মুসৗ। ওরা এখন বাংলা অনেকটা বোঝে, বলতেও পারে কিছু কিছু।

কিসের নাহি ভরসা কিশোর মিয়া? ভুরু নাচিয়ে হেসে জিজ্ঞেস করলো মুসা।

আর কিসের? জবাবটা দিলো রবিন। রহস্যের।…আরে, এতো মন খারাপ করছো কেন? পাবে, পাবে, নিশ্চয় পেয়ে যাবে এই দুনিয়ায় রহস্যের অভাব নেই।

যা জঙ্গল, আর পোড়ো বাড়ি আছে আশপাশে, মুসা বললো। গুপ্তধনের খোঁজ পেয়ে গেলেও হতো। অন্তত একটা ম্যাপ-ট্যাপ…

চেষ্টা করলে হয়তো গুপ্তধনই পেতে পারো, পেছন থেকে বলে উঠলো লিয়ারি।

ফিরে তাকালো তিন গোয়েন্দা।

মিটিমিটি হাসছে মহিলা। বললো, দাঁড়াও, চা নিয়ে আসি। তারপর বলবো।

সেইদিন লিয়ারির আরেক পরিচয় পেলো ছেলেরা। মহিলা বর্ন স্টোরি টেলার, একেবারে জাত গল্প বলিয়ে। এতো সুন্দর করে গুছিয়ে বলে, না শুনে। উপায় নেই।

একঘেয়ে ভাব অনেকটা কাটলো ছেলেমেয়েদের। খাওয়ার সময় খায়, আর বাকি সময় বসে বসে গল্প শোনে।

বাইরে বৃষ্টির থামাথামি নেই। পড়েই চলেছে। কখনও অঝোর বর্ষণ, কখনও গুঁড়ি গুঁড়ি। মাঝেমাঝে ধেয়ে আসে ঝড়ো হাওয়া, টালির চালের ফাঁকে ঢুকে বিচিত্র শব্দ তোলে।

জানালার ধারে বসে সোয়েটার বুনতে বুনতে গল্প করছে সেদিন লিয়ারি। হঠাৎ বাইরে চেয়ে কি দেখলো। মুখ ফিরিয়ে হেসে বললো, যাক, আর ঘরে বসে থাকতে হবে না। বেরোতে পারবে। মেঘ কাটছে। বৃষ্টি থামলে কোথায় ঘুরতে গেলে ভালো হবে, সেটাও বলে দিতে পারি। রহস্যময় হাসি ফুটলো তার মুখে।

.

০৬.

আরে তাই তো! আকাশের দিকে চেয়ে বললো কিশোর। খেয়ালই করিনি।…তা মিসেস এলমস, কোথায় গেলে ভালো হবে?

কয়েক দিনে কিশোরের স্বভাব অনেকখানিই জানা হয়ে গেছে লিয়ারির। বুঝে গেছে, ছেলেটা কি চায়? ওই যে সেদিন গুপ্তধনের কথা আলোচনা করছিলে, ওয়ালটার ম্যানরের কথা বললাম। ওখানেই যাও। রাস্তায় নেমে বাঁয়ে মোড় নেবে। ছোট একটা পাহাড়ের ওপর…

হা হা, দেখেছি, বলে উঠলো রবিন। আসার দিন

হ্যাঁ, ওটাই।

সেদিন কিন্তু সব কথা বলেননি, কিশোর ধরলো। খালি গুপ্তধনের গুজবের কথাই বলেছেন। ওই দুর্গ কাদের, ওয়ালটাররা কে ছিলো, কিছুই বলেননি।

তাহলে তো চা দরকার। বসো, নিয়ে আসি।

 দাঁড়ান, আমিও আসছি, উঠে দাঁড়ালো রবিন। আপনাকে সাহায্য করবো।

কয়েক মিনিটের মধ্যেই ফিরে এলো দুজনে। লিয়ারির হাতে চায়ের সরঞ্জাম। রবিনের হাতে ইয়া বড় এক কেক।

খাবারের গন্ধে চোখ মেললো রাফিয়ান। উঠে পায়ে পায়ে এগিয়ে এলো।

ফ্যানের একটা পাখা ধরে ঝুলছিলো নটি, ঝুপ করে লাফ দিয়ে পড়লো ঠিক কুকুরটার পিঠে।

ওদের দিকে দুই টুকরো কেক ছুঁড়ে দিলো লিয়ারি। চায়ের কাপে ঘনঘন চুমুক দিলো কয়েকবার। তারপর কাপটা প্লেটে নামিয়ে রেখে বললো, হ্যাঁ, ওয়ালটার দের শরীরে রয়েছে জলদস্যুর রক্ত…

এই এক কথায়ই শ্রোতাদের আকৃষ্ট করে ফেললো লিয়ারি। ওদেরকে আগ্রহী করে বসিয়ে রেখে কাপের বাকি চা-টুকু শেষ করলো। বললো, তোমরা খাচ্ছো না কেন? খাও খাও, আমি বলিহামফ্রে ডেভিড ওয়ালটার ছিলো দুর্ধর্ষ জলদস্যু। সে-ই বানিয়েছিলো ওই দুর্গ। লোকটা ছিলো ওলন্দাজ। তার জ্বালায় অস্থির হয়ে উঠেছিলেন ইংল্যাণ্ডের তৎকালীন রাজা। শেষে বিশাল এক নৌবাহিনী পাঠালেন। হামফ্রেকে ধরার জন্যে। মাঝ সাগরে প্রচণ্ড লড়াই হলো। একে একে ধ্বংস করে। দেয়া হলো হামফ্রের সমস্ত জাহাজ। তার বেশির ভাগ সঙ্গীসাথীই মারা পড়লো। কিন্তু তাকে ধরতে পারলো না নেভি। একটা জাহাজ নিয়ে কোনোমতে পালিয়ে বাঁচলো সে, সোজা চলে এলো আমেরিকায়। ওই একটা জাহাজেও ধনরত্ন কম। ছিলো না। ডাকাতি ছেড়ে দিয়ে বিরাট এক দুর্গ বানিয়ে বাস করতে লাগলো হামফ্রে। নিরাপদেই কাটিয়ে গেল জীবনের শেষ কটা দিন। ও হ্যাঁ, এখানে এসে বিয়ে করেছিলো সে। তাদেরই বংশধর এখানকার ডেভিড ওয়ালটার, ডাক্তার। হয়েছে। ডাক্তারের বউ বিদেশী, এক আইরিশ মহিলা, নরিলি। ছেলেপুলে হয়নি। ডাক্তারের বড় এক ভাই ছিলো, মারা গেছে, এক ছেলে রেখে গেছে। নাম, ড্যানি। ওই ছেলেই একদিন এতোবড় সম্পত্তির মালিক হবে। ড্যানির বাবা ছিলো। আর্কিটেক্ট, লণ্ডনে বিরাট বাড়ি করেছে, অনেক টাকার মালিক। ড্যানি আর তার চাচা-চাচী, ওখানেই থাকে বেশি, এখানে প্রায় আসেই না। এলেও দুচারদিন থেকে আবার চলে যায়। দেশ তো আসলে ওদের ওটা-ই।

এলে কি ওই পোড়ো বাড়িতেই থাকে নাকি? জিজ্ঞেস করলো জিনা।

আরে না না, ওখানে থাকবে কি? দুৰ্গটার একটা ঘরের ছাতও অবশিষ্ট নেই, সব ভেঙে পড়েছে। কাছেই আরেকটা সুন্দর বাড়ি বানিয়ে নিয়েছে ডাক্তার,  চমৎকার একটা পার্কের কাছে। বাংলোটার নাম দিয়েছেঃ ওয়ালটার লজ।

ও, দেখেছি তো সেদিন বাড়িটা, মুসা বললো। দুর্গের কাছে গেলেই দেখা যায়।

হ্যাঁ। ওয়ালটার ম্যানর, ওয়ালটার লজ, পার্ক, ওয়ালটার উড, আর ওদিককার প্রায় সমস্ত জায়গাই ওদের। আমার এই কটেজটাও…

কি বললেন? ভুরু কোচকালো কিশোর। আপনার মানে লিয়ারি কটেজও ওয়ালটারদের জায়গার মাঝেই?

আগে ছিলো। এখন আলাদা। আমার স্বামীর দাদা, মানে আমার দাদা-শ্বশুর চাকরি করতো ওয়ালটারদের এস্টেটে। এই জায়গাটা তাকে দান করে দিয়েছে ডাক্তারের দাদা।

ভাঙা দুর্গ দেখার ইচ্ছে নেই আমার, জিনা বললো। ওরকম দুর্গ আমার নিজেরই একটা আছে, এক্কেবারে আস্ত এক দ্বীপ সহ। ভাঙা দেয়াল ছাড়া দেখার আর কি আছে?

পাহাড়ে চড়লেই সাগর দেখতে পাবে। তোমরা যেদিকে সাঁতার কাটতে গেছে, তার উল্টো দিকে। ওখানে সৈকত নেই, সাঁতার কাটতে পারবে না। নামতেই পারবে না। খাড়া পাহাড়, নিচে পাথরের ছড়াছড়ি, ঢেউ আছড়ে পড়ে। মাথা ঘুরে যদি নিচে পড়ো, ছাতু হয়ে যাবে। কাজেই, হুঁশিয়ার থাকবে।

সাগর অনেক দেখেছি। আর কি আছে?

ওয়ালটার উড়। বন। ভেতরে ঝর্না আছে একটা, অনেক বুনো ফুল আছে।

 আর? জিনার মনে হলো, আসল কথাটা বলছে না মহিলা।

আর। হাসলো লিয়ারি। আর আছে একটা অনেক পুরনো কবরস্থান, একেবারে প্রাগৈতিহাসিক কালের। গুহামানবের অনেক কঙ্কাল পাওয়া গেছে। তার ওপরই নতুন কবর বানিয়ে নিয়েছিলো হামফ্রে ওয়ালটার। জলদস্যু ছিলো তো, মন-মানসিকতাই ছিলো অন্যরকম। নইলে বাপু, এতো জায়গা থাকতে পুরনো ওই কবরের ওপর আরেক কবর বানানো কেন?

টিউমিউল্যাস! বিড়বিড় করলো কিশোর।

 টিউ..কী? বুঝতে পারলো না মুসা।

টিউমিউল্যাস। বুঝিয়ে বললো গোয়েন্দাপ্রধান, ওই ধরনের কবরস্থানকে বলে টিউমিউল্যাস।

.

বৃষ্টি থামলো বটে, কিন্তু মেঘ পুরোপুরি কাটেনি। আকাশের মুখ থমথমে। যে কোনো মুহূর্তে ঝরঝর করে শুরু হতে পারে আবার।

নামলে নামুক, জিনা বললো। আর বসে থাকতে পারবো না। বসে থেকে থেকে হাতে-পায়ে খিল ধরে গেছে। একটু ঝাড়া দিয়ে না এলে আর বাঁচবো না।

রেইনকোট পরে বেরোলো ওরা।

রাফিয়ান আর নটির কৃত্রিম কোট দরকার নেই, প্রাকৃতিক আসল রোমশ কোটই আছে। কাজেই পানিকে ওদের বিশেষ ভয় নেই। ভিজলে, জোরে ঝাড়া দিলেই গা থেকে ঝরে যাবে পানি।

ছেলেমেয়েরা চললো পায়ে হেঁটে, নটি চললো রাফিয়ানের পিঠে সওয়ার হয়ে। গলায় গলায় ভাব এখন দুটোতে, মাঝে মাঝে খাবার নিয়ে যদিও লেগে যায় ঝগড়া।

দুর্গের কাছে চলে এলো ওরা। ভেঙেচুরে রয়েছে শত শত বছরের পুরনো দেয়াল, ছাতের চিহ্নও নেই।

দূর, মন খারাপ করে দেয়। বিড়বিড় করলো রবিন।

পুরনো দুর্গের সেলার দেখার খুব ইচ্ছে আমার, টুকার বললো। কিন্তু নামবো কোনখান দিয়ে? পথ তো দেখছি না।

শুধুই ধ্বংসস্তূপ। পুরোপুরি ঢেকে দেয়ার পায়তারা কষছে যেন ঘন ঘাস আর লতার দঙ্গল।

দেখার কিছুই নেই, মুসা বললো।

হ্যাঁ, খামোকাই এলাম। আকাশের দিকে তাকালো কিশোর। জলদি চলো৷ নামলো বলে।

কয়েক পা এগোতে না এগোতেই আবার বৃষ্টি পড়তে শুরু করলো। দৌড়ে চললো ওরা। কিন্তু রেইনকোটেও মানলো না। কটেজে ফিরতে ফিরতে ভিজে চুপচুপে হয়ে গেল সবাই।

 পরের দিনও একই অবস্থা। সকাল থেকে বৃষ্টি। বিকেলের দিকে ধরে এলো। মেঘের ফাঁকে উঁকি দিলো সূর্য।

কিশোর প্রস্তাব দিলো, চলো, বেরোনো যাক।

সবাই রাজি। বেরিয়ে এলো পেছনের বাগানে। বাগানের পরে খানিকটা জংলা জায়গা। কয়েকটা আপেল গাছ আছে, আর আছে অনেক পুরনো বিশাল এক ওক গাছ। সব ভেজা। তার মধ্যেই ঘোরাঘুরি করতে লাগলো ওরা। ঘরে বসে থাকার চাইতে এটা অনেক ভালো মনে হলো।

রাফিয়ান আর নটির আনন্দের সীমা নেই। ছুটোছুটি করে খেলছে।

ভেজা ঘাস বেশিক্ষণ ভালো লাগলো না বানরটার। দুই লাফে গিয়ে উঠলো, ওকের একটা নিচু ডালে। তারপর তরতর করে উঠে গেল মগডালে।

মেঘের আড়ালে ঢুকলো আবার সূর্য।

নটি, এই নটি, নেমে আয়, ডাকলো টকার।

নামতে চাইলো না বানরটা। ওপরে থেকেই চেঁচিয়ে জবাব দিলো, ইঁক! ইঁক!

হুফ! হুফ! করে রাফিয়ানও ওকে নামার জন্যে ডাকলো।

কানেই নিলো না নটি। অনেক দিন পর ঘর থেকে ছাড়া পেয়ে গাছে চড়েছে বানর, নামতে কি আর ইচ্ছে করে? ওদিকে বৃষ্টিও প্রায় এসে যাচ্ছে।

ইতিমধ্যে দুবার-ঘর থেকে বেরিয়ে চা খাওয়ার জন্যে তাগাদা দিয়ে গেছে লিয়ারি।

এই নটি, নামলি না! রেগে গিয়ে ধমক দিলো টকার।

চলো, আমরা হাঁটতে শুরু করি, জিনা বললো। আপনিই নেমে আসবে।

ফোঁটা পড়তে শুরু করলো। থেকে থেকে বিদ্যুৎ চমকাচ্ছে। নামলো না বানরটা।

না নামলে থাক ওখানে, হাত নেড়ে বললো টকার। আমরা চলে যাচ্ছি…

তার কথা শেষ হলো না। প্রচণ্ড শব্দে বাজ পড়লো। সঙ্গে সঙ্গে নামলো। ঝমঝম করে বৃষ্টি।

চমকে উঠলো বানরটা। আর এক মুহূর্ত দেরি করলো না। নামতে শুরু করলো। ওকে ধরার জন্যে হাত বাড়িয়ে দিলো টকার। লাফ দিলো নটি। কিন্তু লক্ষ্যভ্রষ্ট হয়ে টকারের হাতে না পড়ে পড়লো গিয়ে ভেজা ঘাসে। নিচে পানি, ওপরে পানি, এই অবস্থায় হতবুদ্ধি হয়েই বোধহয় মাথা গোঁজার জন্যে সোজা লতানো ঝোপের দিকে দৌড় দিলো ওটা।

আরে ধরো, ধরো! চেঁচিয়ে উঠলো টকার।

বৃষ্টির মাঝে বানরটাকে ধরার জন্যে পেছনে ছুটলো সবাই। রাফিয়ান ভাবলো, এটা একটা নতুন ধরনের খেলা। দৌড়ে গেল নটির কাছে। লাফ দিয়ে তার পিঠে উঠে বসলো বানরটা। আর সওয়ারির আদেশেই যেন সোজা, গিয়ে ঝোপের মধ্যে ঢুকলো কুকুরটা।

ধমক দিয়ে রাফিয়ানকে ডাকতে যাবে জিনা, এই সময় হাত তুলে দেখালো, রবিন। আমার মনে হয় ওখানে যাচ্ছে।

জংলা জায়গাটার ওধারে একটা পুরনো ছাউনি। কাজের জায়গা, কিন্তু কেউ কাজ করে না এখন ওখানে। অব্যবহৃত পড়ে রয়েছে অনেকদিন।

দৌড়ে এসে ছাউনিতে ঢুকলো ওরা। রবিনের অনুমান ঠিকই। নটিকে নিয়ে ওখানেই এসেছে রাফিয়ান। কুকুরটার গলা জড়িয়ে ধরে রেখেছে বানরটা, ঠাণ্ডায়। কিংবা ভয়ে যে কারণেই হোক, কাঁপছে। মনিবকে দেখে লাফিয়ে এসে উঠলো তার কাঁধে।

কালো আকাশটাকে চিরে দিলো যেন বিদ্যুতের শিখা। ভীষণ শব্দে বাজ পড়লো। আবার, তারপর আবার।

খাইছে! বলে উঠলো মুসা। ঝড়ই শুরু হলো দেখছি।

হ্যাঁ, মনে হয় একেবারে মাথার ওপর বাজ পড়ছে, বললো জিনা।

আর বাড়ছেই, কান পেতে ঝড়ের আওয়াজ শুনছে রবিন। এগিয়ে আসছে। বোধহয় সাগরের দিক থেকে…

হঠাৎ উজ্জ্বল নীল আলোয় আলোকিত হয়ে গেল দশদিক। ছাউনির নিচে গা ঘেঁষাঘেঁষি করে এলো ছেলেরা। আলোর প্রায় পর পরই বাজ পড়লো। এতো জোরে আওয়াজ হলো, মনে হলো কানের পর্দা ফেটে গেল ওদের, থরথর করে কেঁপে উঠলো মাটি। চেঁচালো রাফেয়ান। চি-চি করলো বানরটা।

কটেজের ওপর পড়েছে! চোখ বড় বড় হয়ে গেছে টকারের। হায় হায়, বেচারি লিয়ারি…

চুপ! থামিয়ে দিলো তাকে কিশোর। কটেজে নয়। ওই দেখো, ওক গাছটা…দেখেছো?

ঘন বৃষ্টির মাঝ দিয়েও দেখা গেল। দেখলো সবাই। একটু আগের সুন্দর ওঁক গাছটা আর নেই, দাঁড়িয়ে আছে শুধু ওটার পোড়া কালো কাণ্ড, ধোয়া বেরোচ্ছে।

আল্লাহরে! কি সর্বনাশ! আঁতকে উঠে বললো মুসা। কয়েক মিনিট আগে…

নটি ছিলো ওটার ডালে…, বললো টকার।

আর আমরা সবাই ছিলাম ওটার তলায়! জিনা শেষ করলো কথাটা।

.

০৭.

ধীরে ধীরে দূরে সরে গেল বাজের শব্দ। বিদ্যুতের ঝিলিকও কমলো। থেমে আসছে ঝড়।

শোনা গেল লিয়ারির ভয়ার্ত ডাক, কিশোর! জিনা! কোথায় তোমরা?

আমরা ভালোই আছি, চেঁচিয়ে জবাব দিলো কিশোর। আপনি বেরোবেন। না। আমি আসছি। অন্যদেরকে ছাউনিতে থাকতে বলে বেরিয়ে গেল সে। এক ছুটে গিয়ে ঢুকলো কটেজে।

দশ মিনিট পর ফিরে এলো আবার। প্লাস্টিকের ব্যাগে ভরে শুকনো সোয়েটার। নিয়ে এসেছে সবার জন্যে। আর এনেছে বড় একটা ঝুড়ি। তাতে স্যাণ্ডউইচের প্যাকেট, মস্ত এক চকোলেট কেক, বড় এক ফ্লাস্ক কোকা।  

এই না হলে তুমি আমার ভাই! বন্ধুর কাঁধে হাত রেখে হেসে বললো মুসা।

হয়েছে হয়েছে, এসো এখন শেষ করে ফেলা যাক। খুব খিদে পেয়েছে।

তোমারই যখন খিদে, আমার অবস্থা বোঝো!

হেসে উঠলো সবাই।

দেখতে দেখতে শেষ হয়ে গেল সমস্ত খাবার। একটা কণাও অবশিষ্ট থাকলো না। এমনকি মাটিতে যা পড়লো, তা-ও না। চেটেপুটে শেষ করলো রাফিয়ান আর নটি।

বৃষ্টি থেমেছে।

রবিন বললো, চলো তো, কাছে গিয়ে দেখি গাছটার অবস্থা।

ছাউনি থেকে বেরোলো সবাই। হঠাৎ করেই দেখা দিলো সূর্য। মেঘ তাড়িয়ে নিয়ে চলে গেছে ঝড়ো বাতাস।

ইস, এতো সুন্দর গাছটা গেল? আফসোস করে বললো জিনা।

হ্যাঁ, আনমনে বিড়বিড় করলো কিশোর। লিয়ারি বললো না সেদিন, গাছটা অনেক পুরনো। হামফ্রে ওয়ালটার যখন এসেছিলো, তখনও ছিলো।

আরও কাছে এগিয়ে গেল ওরা। গাছটার চারপাশের গোড়ার মাটি যেন খুবলে তুলে ফেলেছে কোনো দানব। গর্ত হয়ে গেছে। একটা পরিখার মাঝখানে দাঁড়িয়ে। রয়েছে যেন এখন পোড়া কাণ্ডটা।

কাণ্ড দেখেছো, কতো বড় গর্ত? টকার বললো। বাজের এতো জোর!

খেলাচ্ছলে লাফ দিয়ে গর্তে নামলো নটি। কি একটা জিনিস কৌতূহল জাগিয়েছে তার। সরু সরু আঙুল দিয়ে মাটি খুঁড়তে শুরু করলো। দেখাদেখি রাফিয়ানও গিয়ে নামলো, মাটি খোঁড়ায় সাহায্য করলো বানরটাকে।

পোকা খুঁজছে, হেসে বললো টকার।

ভুরু কুঁচকে তাকিয়ে আছে কিশোর। গম্ভীর। আরও ভালোমতো দেখার জন্যে গর্তের কিনারে গিয়ে কুঁকলো। কঠিন কিছু একটাতে কুকুরটার নখ লেগে শব্দ হয়েছে। কি ওটা? বললো, এই রাফি, খোড়। আরও খোড়।

হঠাৎ প্রায় একসঙ্গে চেঁচিয়ে উঠলো সবাই। বেরিয়ে পড়েছে রঙচটা, মরচে পড়া একটা ধাতব বাক্স।

কি ওটা? মুসার প্রশ্ন।

হয়তো গুপ্তধন, রসিকতা করে হাসলো রবিন।

হু, গুপ্তধন পাওয়া এতোই সহজ! জিনা বললো।

কিশোর ততোক্ষণে নেমে পড়েছে গর্তে। মাটি সরিয়ে বাক্সটা তুলে আনার চেষ্টা করছে।

ওভাবে পারবে না, মুসা বললো। দাঁড়াও, খন্তা-টন্তা কিছু একটা নিয়ে। আসি। এক দৌড়ে গিয়ে কটেজ থেকে একটা শাবল নিয়ে এলো সে। দুজুনে মিলে খুঁড়ে তুলে আনলো বাক্সটা।

তালা আছে, কিন্তু এতো পুরনো, মরচে পড়ে একেবারে নষ্ট হয়ে গেছে। শাবল দিয়ে এক বাড়ি মারলো মুসা। হুক ভেঙে তালাটা খুলে,ড়ে গেল।

ডালা তুললো কিশোর।

হাঁ হয়ে গেল সবাই।

সত্যি গুপ্তধন! সোনার মোহর আর নানারকম অলংকার।

চোখ ডলো কেউ, কেউ চিমটি কাটলো নিজের হাতে। না, জেগেই তো আছে, স্বপ্ন দেখছে না। তারমানে আসলেই গুপ্তধন পেয়েছে। গুপ্তধন পাওয়া নতুন। কোনো ব্যাপার নয় ওদের জন্যে, আগেও অনেক বার পেয়েছে। তবে এভাবে নয়, অনেক খুঁজতে হয়েছে। এই

বিশ্বাস হচ্ছে না এখনও আমার, বিড়বিড় করলো রবিন।

অনেক কিছুই ঘটে এই পৃথিবীতে, নিচের ঠোঁটে চিমটি কেটে বললো কিশোর, যার কোনো ব্যাখ্যা দেয়া যায় না।…্যাকগে, পেয়েছি এ-তো আর মিছে। কথা নয়। চলো, এগুলো কটেজে নিয়ে যাই। কার জিনিস, হয়তো লিয়ারি বলতে পারবে।

বাক্সটা নিয়ে এলো ওরা। রান্নাঘরের টেবিলে রেখে খুললো।

একবার অকিয়েই স্তব্ধ হয়ে গেল লিয়ারি। অনেকক্ষণ পর কথা ফুটলো মুখে, গুজব তাহলে মিথ্যে নয়! সত্যিই গুপ্তধন লুকিয়ে রেখে গেছে হামফ্রে ওয়ালটার।

সেদিন তো বললেনই লুকিয়েছে, কিশোর বললো।

বলেছিলামঃ লোকে বলে। বিশ্বাস করতাম না। এখন তো নিজের চোখেই দেখতে পাচ্ছি…

কিন্তু লুকালো কেন?

স্বভাব, জবাবটা দিলো রবিন। জলদস্যুরা ধনরত্ন লুকাতে অভ্যস্ত ছিলো, হয়তো সে-কারণেই নিরাপদ জায়গায় এসেও নিশ্চিত হতে পারেনি হামফ্রে। ওয়ালটার। কিছুটা লুকিয়ে রেখেছিলো ওই ওক গাছের তলায়।

কি জানি। হতেও পারে, অনিশ্চিত ভঙ্গিতে হাত নাড়লো কিশোর।

এসো না, কি কি আছে দেখি? একটা লিস্ট তৈরি করে ফেলি, প্রস্তাব দিলো টকার। গুপ্তধনের গল্প শুধু বইয়েই পড়েছে এতোদিন, চোখে দেখেনি।

অন্যদেরও মনে ধরলো কথাটা। অনেকদিন পর একটা নতুন ধরনের কাজ পাওয়া গেছে।

বাক্সে রয়েছেঃ ছয়শো সোনার মোহর, পান্না খচিত এক সেট গহনা, হীরা আর নীলকান্ত মণি বসানো একটা ব্রেসলেট, বিশাল একটা রুবি পাথর, একটা টায়রা, একটা হীরার লকেট, অনেকগুলো আঙটি আর কানের দুল,–প্রায় সবগুলোতেই মূল্যবান পাথর বসানো। বড় বড় মুক্তো আছে অনেকগুলো, গোটা তিনেক সোনার ব্রেসলেট, তিনটে সোনার চেন, দুটো সোনার ঘড়ি (বন্ধ হয়ে আছে), চারটে সোনার বড় বড় মেডেল। আর আছে হাতির দাঁতে খোদাই করা দুটো প্রতিকৃতিঃ একটা পুরুষের, আরেকটা মহিলার। পুরুষেরটার নিচে নাম লেখা রয়েছে হামফ্রে ডেভিড ওয়ালটার। আর মহিলাটার নিচে টেরিলিন ওয়ালটার।

হামফ্রের স্ত্রীর নাম কি ছিলো, জানেন? জিজ্ঞেস করলো কিশোর।

 টেরিলিন…

হু। তারমানে গুপ্তধন হামফ্রেই লুকিয়েছিলো। এই প্রতিকৃতি দুটোই তার প্রমাণ।

কি করবে এখন এগুলো? রবিন জানতে চাইলো।

জবাব না দিয়ে লিয়ারির দিকে তাকালো কিশোর। ডাক্তার ওয়ালটার এখন। কোথায়? এখানে, না লণ্ডনে?

ঠিক বলতে পারবো না, বৃষ্টির জন্যে বেরোতেই তো পারি না, বললো লিয়ারি। তবে সেদিন মুদির বৌ বলছিলো, এখানে নেই। দুচার দিনের মধ্যে আসবে। তারমানে আজ কিংবা কাল আসবে।

জানালার বাইরে তাকালো কিশোর। বৃষ্টি বোধহয় আর আসবে না। বন্ধুদের দিকে ফিরলো। একবার গেলে কেমন হয়? ওয়ালটার লজে? ডাক্তার থাকলে তাঁকে জানাবো খবরটা। এসে নিয়ে যাবেন। আইনতঃ জিনিসগুলো এখন তাঁরই পাওনা।

চলো, মুসা রাজি। হেঁটে, না সাইকেলে?

সাইকেল।

দ্রুত প্যাড়াল করে চললো ওরা। অনেক দিন ঘরে বন্দি হয়ে থাকার পর। মুক্তির আনন্দ, তার ওপর গুপ্তধন পাওয়ার উত্তেজনা, টগবগ করে ফুটছে যেন শরীর রক্ত। টকারের সাইকেল নেই, সে বসেছে মুসার সাইকেলের ক্যারিয়ারে।

নটি চলেছে রাফিয়ানের পিঠে সওয়ার হয়ে।

অবশেষে দূর হয়ে গেছে মেঘ। কড়া রোদে ভেজা মাটি থেকে বাষ্প উঠছে। গাছপালা ঘন সবুজ, এক কণা বালি নেই, ধুয়েমুছে সব সাফ হয়ে গেছে।

দেখতে দেখতে চললো ওরা।

.

০৮.

ভাঙা দুর্গের পাশ দিয়ে পথ চোখে পড়লো ওয়ালটার লজের শাদা, দেয়াল। প্রায় বর্গাকার চমৎকার একটা বাংলো। বেগুনী উইসট্যারিয়া আর অন্যান্য লতায়, ছেয়ে রয়েছে। সুন্দর ছিমছাম বাগানে নানারকম ফুলের ঝাড়, বেড, সবুজ ঘাসে ঢাকা লন।

 গেটের কাছে এসে সাইকেল থেকে নামলো ওরা। পাল্লার লোহার শিকের ফাঁক দিয়ে ভেতরে তাকালো। বাগানে কাজ করছে একটা লোক।

গেটের পাশে লাগানো ঘন্টা বাজানোর শেকল ধরে টানলো কিশোর।

ঘন্টার শব্দে ফিরে তাকালো লোকটা। খোয়া বিছানো পথে জুতোর মচমচ শব্দ তুলে এগিয়ে এলো গেটের কাছে। মাঝবয়েসী, মাথায় পাতলা চুল, ধূসর। গোলগাল মুখে পাতলা ঠোঁটজোড়া বড় বেশি বেমানান। চেহারায় বিরক্তি। পরনে, কর্ডের প্যান্ট-ময়লা, মাটি লেগে রয়েছে। গায়ে নীল ওভারঅল। গভীর কণ্ঠে। জিজ্ঞেস করলো, কি চাই?

ডাক্তার ওয়ালটার আছেন? ভদ্রভাবে জিজ্ঞেস করলো কিশোর।

জবাব দিলো না লোকটা। এক এক করে তাকালো পাঁচজনের মুখের দিকে। তারপর বললো, আজেবাজে ছেলেমেয়ের সঙ্গে কথা বলেন না তিনি।

কথা বলার জন্যে মুখ খুলেও থেমে গেল কিশোর।

লোকটা বললো, তোমাদের মতো কেউ যাতে ঢুকতে না পারে, সেদিকে কড়া। নজর রাখতে বলা হয়েছে আমাকে।

রাগে-লাল হয়ে গেল জিনার মুখ। এমনিতেই ধৈর্য তার কম। ঝাঝালো কণ্ঠে বললো, দেখুন, বড় বড় কথা বলবেন না। আজেবাজে ছেলেমেয়ে নই আমরা। আপনাকেই বরং বাজে লোক মনে হচ্ছে আমার। যান, গিয়ে বলুন, জরুরী কথা। বলতে এসেছি তাঁর সঙ্গে।

আরও গম্ভীর হয়ে গেল কেয়ারটেকার। তারপর হঠাৎ হাসতে আরম্ভ করলো। জরুরী, না? হাহ্ হাহ্ হা! তা জরুরী ব্যাপারটা কি জানতে পারি, ম্যাডাম?

দেখুন, শীতল কণ্ঠে বললো কিশোর। ওর নাম জরজিনা পারকার। প্রফেসর হ্যারিসন পারকারের নাম নিশ্চয় শুনেছেন, বিখ্যাত বিজ্ঞানী, তাঁর মেয়ে। কাজেই বুঝতে পারছেন, আজেবাজে কেউ নই আমরা। এখন দয়া করে গিয়ে যদি ডাক্তার সাহেবকে খবর দেন, খুশি হবো।

দ্বিধা ফুটলো লোকটার চোখে।  

যান, মুসা বললো। গিয়ে বলুন, জরুরী কথা আছে। তাঁরই লাভ।

হ্যাঁ, মুসার কথার পিঠে বলে উঠলো টকার। তাঁর জন্যে সুখবর। গুপ্তধন পাওয়া গেছে।

এই, তুমি চুপ করো তো! ধমক দিয়ে টকারকে থামিয়ে দিলো কিশোর।

গুপ্তধন? ভুরু কোঁচকালো কেয়ারটেকার। তারপর হা-হা করে হাসলো। এই গপ্লোই শোনাতে এসেছো নাকি? নিশ্চয় বলবে, মিস্টার হামফ্রে ওয়ালটারের গুপ্তধন খুঁজে পেয়েছো তোমরা?

কড়া গলায় জিনা বললো, আপনার সঙ্গে আমাদের কোনো কথা নেই! যা বলছি করুন। ডাক্তার ওয়ালটারকে খবর দিন, চাকরিটা না খোয়াতে চাইলে। জলদি করুন।

থাকলে তো খবর দেবো, সামান্য নরম হলো কেয়ারটেকার। বাড়ি নেই। আজ সকালেই আসার কথা ছিলো। বৃষ্টির জন্যেই হয়তো আসতে পারেননি। আকাশ ভালো থাকলে রাতে চলে আসতে পারেন, কিংবা, কাল কিংবা পরশু…ঠিক নেই। আমাকেই খুলে বলো সব। এলে তাঁকে জানিয়ে দেবো।

 কর্কশ ব্যবহার অনেক কোমল হয়ে গেছে লোকটার। কিন্তু তবু কেউই তাকে পছন্দ করতে পারলো না। এমনকি রাফিয়ানও না। শিকের ফাঁক দিয়ে মুখ ঢুকিয়ে। তার জুতো শুকলো, তারপর মৃদু গররর করে উঠলো।

 সরি, বললো কিশোর। ডাক্তার সাহেবকে ছাড়া আর কাউকে বলা যাবে না। কাল আবার আসবো আমরা।

না না, দরকার কি? এসে হয়তো পেলে না, খামোকা কষ্ট করবে। তারচে এক কাজ করো, ঠিকানা রেখে যাও। সাহেব এলেই তোমাদেরকে খবর দেবো।

আবার বোকামি করে বসলো টকার। বলে ফেললো, লিয়ারি কটেজ, চেনেন নিশ্চয়?

চিনি, চিনি, হেসে বললো লোকটা। ওদিক দিয়েই তো রোজ বাজারে যাই। ঠিক আছে, মিস্টার ওয়াল্টার এলে একটা নোট ফেলে যাবোখন তোমাদের লেটার বক্সে।

লোকটার হাসি মোটেও পছন্দ হলো না মুসার। ফেরার পথে বললো, শয়তান লোক। দেখলে, গুপ্তধনের নাম শুনেই কেমন বদলে গেল?

তা না-ও হতে পারে। মিস্টার পারকারের নাম শুনেও বদলাতে পারে, রবিন বললো। আর চেহারা দেখে মানুষ বিচার করা যায় না। মুখে কড়া, মনটা হয়তো নরম।

তুমি নিজে নরম তো, তাই সবাইকে ওরকম ভাবো, বললো জিনা। আমি মুসার সঙ্গে একমত। আস্ত শয়তান লোক। হারামী নাম্বার ওয়ান। এই কিশোর, তুমি কি বলো?

আমারও ভালো লাগেনি।

আমারও না, টকার বললো। গুপ্তধনের কথা বলে বোকামি করিনি তো?

বোকামিই করেছে। আর ঠিকানা দিয়ে করেছো গাধামি। আগ বাড়িয়ে আর কথা বলতে যাবে না কক্ষণো। তোমাকে বলেছি না, আমরা গোয়েন্দা। গোয়েন্দাগিরিতে সব সময় ভেবেচিন্তে কথা বলতে হয়…

কিন্তু অসুবিধে কি হবে?

গুপ্তধনের লোভে আমাদের পেছনে লাগতে পারে। ঠিকানাও বলে দিয়ে এসেছো…

তাই তো! ভুলই হয়ে গেছে…

যা হবার হয়ে গেছে। এখন আর ভেবে লাভ নেই। দেখা যাক কি হয়। হয়তো লোকটা বিশ্বাসই করেনি আমাদের কথা।

 লিয়ারি জানালো ওদেরকে, লোকটার নাম ডেনার। ডাক্তার ওয়ালটারের বাড়িতে মালীর কাজ থেকে শুরু করে কেয়ারটেকারের কাজ, সবই সে করে। ডেনার ভালো কি মন্দ, বলতে পারলো না। কারণ, বোঝার উপায় নেই। মোটেই নাকি মিশুক না লোকটা।

পরদিন সকালে ডেনার কখন এলো লিয়ারি কটেজে কেউই জানলো না। কিন্তু নাস্তার টেবিলেই পাওয়া গেল তার নোট। একটা খামে ভরে চিঠির বাক্সে ফেলে গেছে। লিয়ারি এনে দিলো ছেলেদের।

 নোটে লেখাঃ জরুরী কাজে আটকে পড়েছেন ডাক্তার ওয়ালটার। তোমাদের সঙ্গে দেখা করতে পারছে না বলে দুঃখ প্রকাশ করেছেন। আজ দুপুরের দিকে তোমাদের সঙ্গে দেখা করবে তার ভাইপো ড্যানি ওয়ালটার। জিনিসগুলো তার। হাতে দিয়ে দেয়ার জন্যে অনুরোধ করেছেন ডাক্তার ওয়ালটার।

নিচে ডেনারের সই।

রেগে গিয়ে জিনা বললো, নিজে একটা নোট পর্যন্ত লিখতে পারলো না, এতোই জরুরী কাজে ব্যস্ত? ওই ডেনার ব্যাটা তাকে কি বলেছে, কে জানে! আসলে আমাদের কথা বিশ্বাস করেনি ওরা।

ওদেরই বা দোষ কি? কিশোর বললো। আমাকে বললে আমিও বিশ্বাস করতাম না। নিজের চোখে দেখেছি, বলেই না..তবে ওরকম ভাবে হঠাৎ গুপ্তধন পেয়ে যাওয়ার অনেক কাহিনী জানি আমি।

আমিও জানি, রবিন বললো। বইয়ে পড়েছি। রেফারেন্স বইতেও আছে কিছু কিছু ঘটনার উল্লেখ।

বিশ্বাস করেনি, মুখ ভর্তি খাবার চিবাতে চিবাতে বললো মুসা, তো কি হয়েছে? করবে। যখন বাক্সটা নিয়ে গিয়ে তার সামনে ফেলবে তার ভাতিজা।

ড্যানি আসবে দুপুর নাগাদ। ততোক্ষণ আর কটেজের কাছ থেকে দূরে যেতে, পারছে না ছেলেমেয়েরা। রোদ উঠেছে। বাগানে আর পেছনের জঙ্গলে ঘোরাঘুরি করেই কাটালো ওরা।

দুপুরের আগেই এলো ড্যানি। ছাউনিতে বসে গল্প করছিলো তখন ওরা। মোটর সাইকেলের আওয়াজ শুনে ছুটে গেল।

<

Super User