পনের মিনিটের মাথায় লিসটারের বাড়ির দরজায় এসে দাঁড়াল দুই গোয়েন্দা। কলিং বেল বাজাল কিশোর।

দরজা খুলে দিল এলেনা। পুরনে এখনও সেই নীল পোশাক, পার্টিতে যেটা পরেছিল। তবে এখন আর তেমন ধোপদুরস্ত নেই, কুঁচকে গেছে। হাই-হলিও নেই পায়ে।

টাকার জন্যে নোট পেয়েছেন? জিজ্ঞেস করল কিশোর।

নীরবে একটুকরো কাগজ কিশোরের হাতে তুলে দিল এলেনা। জোরে জোরে পড়ল গোয়েন্দাপ্রধান, বিশপের বই বদল করলেই শুধু ফেরত আসবে বাবা। পুলিশ ডাকা চলবে না। যা করার জলদি করতে হবে। দেরি করলে ভীষণ বিপদ হবে।

পেন্সিল দিয়ে বড় করে লেখা রয়েছে বিশপ শব্দটা। বাকি শব্দগুলো খবরের কাগজের পাতা থেকে কেটে সাটা হয়েছে।

বিশপ শব্দটা খবরের কাগজে হরহামেশা ছাপা হয় না, এলেনা বলল। সেজন্যেই পায়নি। হাতে লিখতে হয়েছে। খামে করে পাঠায়নি। শুধু কাগজটা। .. পেছনের দরজার নিচ দিয়ে ভেতরে ঠেলে দিয়েছে কেউ। তারপর ঘণ্টা বাজিয়ে দৌড়ে পালিয়েছে।

কিডন্যাপিংই, আপনি শিওর? কিশোরের প্রশ্ন। আজ বিকেলে কিন্তু আপনার সন্দেহ হয়েছিল, আপনার আব্বা পুরো ব্যাপারটা প্ল্যান করেই করেছেন।

নাহ্, আব্বা অতোটা খারাপ নয়। দরজার ঘন্টা বাজিয়ে দৌড়ে পালাতেও পারবে না। ক্ষমতা নেই। জোরে হাঁটতেই কষ্ট হয় ইদানীং। এটা কিডন্যাপিংই। এখন আমাকে বিশপের বই খুঁজে বের করতে হবে। কোন বই ওটা এ ব্যাপারে বিন্দুমাত্র ধারণা নেই আমার। তোমাদেরকে সেজন্যেই ডেকেছি। বইটা খুঁজতে আমাকে সাহায্য করতে হবে।

নোটটা তুলে ধরল কিশোর। এটার কথা পুলিশকে জানানো উচিত। জানিয়েছেন?

না। তোমরাও বলবে না। কারণ লোকটা বলতে নিষেধ করে দিয়েছে। এ ঝুঁকি আমি নিতে পারব না। এমনকি আমার আব্বার মত বদমেজাজি লোকের জন্যেও না। বিপদে পড়বে। আরও একটা কথা আছে, তার খারাপ কিছু হলে আমারও সাংঘাতিক ক্ষতি। সম্পত্তির একটা কানাকডিও পাব না। উইলে সে রকমই লেখা আছে। যদি অস্বাভাবিক মৃত্যু হয় তার, কিংবা গায়েব হয়ে যায়। রহস্যজনকভাবে, তাহলে আমাকে ফকিরের মত ঘাড় ধরে এ বাড়ি থেকে বের করে দেয়ার নির্দেশ দেয়া আছে। বোঝ এবার, কেমন বাপ আমার। আমার কোন দোষ না থাকলেও বঞ্চিত করা হবে তখন আমাকে।

হু! মাথা দোলাল কিশোর।

চমকে গেলে নাকি? আব্বা সব সময় খারাপ দিকটাই ভাবে, আর আমাকে সন্দেহ করে। আমার তা-ই মনে হয়। ভেবে দেখ, নিজের মেয়েকে অবিশ্বাস করে। নইলে ওরকম উইল লিখতে পারতো? থাক ওসব কথা। এসো, কাজ শুরু করিগে।

ঘুরে সিঁড়ির দিকে রওনা হল এলেনা। তাকে অনুসরণ করল ছেলেরা। মেয়ের মুখে লিসটারের অদ্ভুত চরিত্রের কথা শুনে অবাক হয়েছে।

ওপরের হলঘরে একটা ভ্যাকুয়াম ক্লিনার লাগান হয়েছে। ছেঁড়া বালিশের পালক যতটা সম্ভব পরিষ্কার করে ফেলেছে এলেনা। তবে পুরোপুরি পারেনি। বিভিন্ন জায়গায় কিছু কিছু রয়ে গেছে এখনও। তা নিয়ে মাথাব্যথা নেই। গোয়েন্দাদের। যে কাজ করতে ডাকা হয়েছে ওদের সে কাজে মনোযোগ দিল। ডেভিড লিসটারের শোবার ঘর থেকে শুরু করল বইটা খোঁজা। বিভিন্ন বিষয়ের ওপর লেখা বই রয়েছে এখানে। দর্শনশাস্ত্র, রসায়ন শাস্ত্রের মত কঠিন বিষয় যেমন রয়েছে তেমনি রয়েছে পাখি নিয়ে গবেষণার বই। তার পাশাপাশিই রয়েছে হালকা বৈজ্ঞানিক কল্পকাহিনী। অভিধান আছে, আছে মূল্যবান পাথরের ওপর লেখা বই। ঠিক তার কাছেই রয়েছে ডিকেনসের লেখা সুদৃশ্য চামড়ায় বাঁধানো একসেট বই।

এই যে একটা পেলাম, ধুলো পড়া নোংরা মলাটের একটা পেপারব্যাক বই। তুলে ধরল কিশোর। নাম দা বিশপ মারডার কেস। এস. এস. ভ্যান ডাইন-এর লেখা একটা রহস্যকাহিনী।

বইটা নিয়ে হলদেটে পাতাগুলো ওল্টাতে লাগল এলেনা। দূর! এটার জন্যে কিডন্যাপিঙের মত একটা অপরাধ করবে না কেউ। থাক এটা। খুঁজতে থাক।

নাকে ধুলো ঢুকেছে রবিনের। জোরে হাঁচি দিল। তাক থেকে বই নামিয়ে মলাট দেখছে, নাম পড়ছে, আবার তুলে রেখে দিচ্ছে আগের জায়গায়। বলল, অনেক পড়াশোনা করেন আপনার আব্বা, তাই না?

না, বই দেখে যতটা মনে হয় ততটা না। বই কেনেই শুধু। নেশা। বলে, সময় করে নিয়ে ভালমত পড়তে শুরু করবে একদিন। সব পড়ে শেষ করে। ফেলবে। কিন্তু সেই সময় আর করতে পারে না। কিনেই চলেছে, কিনেই চলেছে, তাকে তুলে রাখছে। নামানো আর হয় না। বইয়ের মালিক হতে পেরেই যেন খুশি। আব্বা। কোন বই কখনও হাতছাড়া করে না, ফেলে দেয়া তো দূরের কথা। শুধু বইই না, কোন জিনিসই ফেলে না।

বড় দেরাজটার দিকে ঘুরল এলেনা। দেখি, এর ভেতরে কি আছে। বিড়বিড় করতে করতে গিয়ে টান দিয়ে ড্রয়ার খুলল সে। কয়েক জোড়া মোজা, একটা মাফলার আর কাগজের বাণ্ডিল। কাগজগুলো বের করে তার ভেতরে বই খুঁজল। খবরের কাগজের কাটিং, ছেলেদেরকে জানাল। একটা প্রেসক্রিপশন। কিছু। ভ্রমণের ব্রশিয়ার।

কাগজগুলো আবার ড্রয়ারে ছুঁড়ে ফেলল সে। কি খুঁজছি জানা থাকলে অনেক সহজ হত। একটা রহস্যোপন্যাস চেয়ে পাঠিয়েছে একথা একদম বিশ্বাস করতে পারছি না। তাও আবার পুরনো।

এটার ব্যাপারে কি মনে হয়? একটা বই তুলে ধরল রবিন। নাম দা ডে লিংকন ওয়াজ শট। লেখকের নাম জিম বিশপ।

মনে হয় না, কিশোর বলল। যাক। তাকে তুলো না। বাইরেই রাখ।

হতে পারে কোন বইয়ের দুর্লভ প্রথম সংস্করণ, আন্দাজ করল এলেনা। কিংবা প্রকাশই হয়নি এমন কোন পাণ্ডুলিপি চায়। নোট কিংবা বৈজ্ঞানিক গবেষণার নথিপত্রও হতে পারে। অথবা কোন লগবুক-অতীতের কোন গোপন ঘটনার কথা লেখা রয়েছে যাতে। সাংঘাতিক মূল্যবান কোন দলিল। কোন। কনসেনট্রেশন ক্যাম্পের ইতিহাস। হতে পারে না? কী

সবই খুঁজে দেখব, শান্তকণ্ঠে বলল কিশোর।

বুককেসগুলো দেখা শেষ করে পুরনো আলমারির তাকে রাখা বাক্স আর ফোল্ডারগুলোর দিকে দৃষ্টি দিল গোয়েন্দারা। ক্যানূসেল করে দেয়া ব্যাংক চেকের বাণ্ডিল দেখতে পেল। পুরনো টেলিফোনের বিল, পোস্টকার্ড কোন কোনটা সুদূর জিব্রালটার আর কায়রো থেকেও এসেছে। সব শাদা। লেখা নেই। বোঝা গেল। চিঠি লেখার জন্যে নয়, স্যুভনির হিসেবে আনা হয়েছে ওগুলো।

তরুণ বয়েসেই সাগর পাড়ি দিয়েছিল আব্বা, এলেনা জানাল। ইনডাস্ট্রির ব্যবসায় ঢোকার অনেক আগের কথা সেটা। ওয়াল স্ট্রীটে তো তার ডাকনামই দিয়ে ফেলা হয়েছে জলদস্যু। হয়ত পাইরেটই ছিল, কে জানে! নইলে একেবারে জিভারো থেকে শুরু করে এতটা ওঠে কিভাবে? শুরু যখন করে একটা ফুটো পয়সা ছিল না পকেটে। লোকে জানে, একথা। কিন্তু দেখতে দেখতে একটা শিপিং লাইনের মালিক হয়ে গেল। কয়েকটা ডিপার্টমেন্টাল স্টোর দিয়ে ফেলল। তারপর কিনল একটা পেপার মিল, গোটা তিনেক ব্যাংক। অথচ অতটা চালাক লোক নয় সে, সাংঘাতিক বুদ্ধিমান যে তা-ও নয়।

ততটা খারাপও ভাবতে পারছি না, কিশোর বলল।

এই সময় টেলিফোন বাজল। চমকে উঠল এলেনা। রিসিভার তুলে কানে ঠেকাল। দীর্ঘ একটা মুহূর্ত কিছুই বলল না। তারপর চিৎকার করে উঠল, চেষ্টা তো করছি! শোন, কিছু কিছু পেয়েছিও। লাগলে নিয়ে যেতে পার। একটার নাম দা বিশপ মারডার কেস। আরেকটা বইয়ের লেখকের নাম জিম বিশপ…

থেমে গেল সে। ভ্রূকুটি করল। আবার বলল, তোমাকে ঠকানোর কোন ইচ্ছে আমার নেই। শোন, কি খুঁজতে বলছ সেটাই জানি না। জানলে আরে শোন শোন… রিসিভারটা নামিয়ে এনে তাকিয়ে রইল ওটার দিকে।

কিডন্যাপার? জানতে চাইল কিশোর।

হ্যাঁ। তার ধারণা আমি তার সঙ্গে ইয়ার্কি মারছি। পুরনো খুনের গল্পের বই চায় না সে। সে চায় বিশপের বই। আর কোন তথ্য না জানিয়েই লাইন কেটে দিল।

গলা শুনে কি মনে হল? রবিনের প্রশ্ন, চিনলেন?

মাথা নাড়ল এলেনা। খসখসে। হয় ঠাণ্ডা লেগেছে, নয়ত মুখে রুমাল দিয়ে নিয়েছিল। যাতে চেনা না যায়। কথায় এক ধরনের টান রয়েছে। তবে বুঝতে পারলাম না কোন দেশের।

আবার গিয়ে দেরাজে খোঁজায় মন দিল এলেনা। শেষ ড্রয়ারটা যখন খোঁজা শেষ করল সে, রবিন আর কিশোর তখন সবগুলো তাক দেখে শেষ করে ফেলেছে। অধৈর্য হয়ে উঠছে তিনজনই। এলেনার খিদে পেয়েছে। নার

ডিনার খাইনি, বলল সে। ফ্রিজেও কিছু নেই। পার্টির জন্যে খাবারের অর্ডার দেয়া হয়েছিল। খুব হিসেব করে। এখন পিজা কিনে এনে খাওয়া ছাড়া আর কোন উপায় নেই।

চলবে, হাসল রবিন।

 রবিন, তুমিও যাও। একটু পনিরটনিরও নিয়ে এসো, কিশোর বলল। আর কোক।

রবিন গেল এলেনার সঙ্গে খাবার কিনতে। কিশোর রয়ে গেল। খোঁজা বন্ধ করল না। পরের বেডরুমটায় রওনা হল সে। চিলেকোঠায় যাওয়ার দরজাটার ওপর চোখ পড়ল।

কি মনে করে টান দিয়ে দরজাটা খুলল সে। সুইচ টিপে সিঁড়ির আলোটা জ্বালল। তারপর উঠতে শুরু করল ওপরে।

এককোণে ঠেলে সরিয়ে রাখা হয়েছে ট্রাঙ্কগুলো। বাক্স আর বুককেস আছে, তবে উপচে পড়ছে না অন্যান্য জায়গার মত। দরজার কাছের তাকগুলো থেকে খোঁজা শুরু করল কিশোর। পাতলা একটা বই টেনে বের করল। নাম দা সিক্রেট অভ টাইপরাইটিং স্পীড। ১৯১৭ সালে লেখা।

বইটা আবার তাকে রেখে দিল। কানে এল নিচে দরজা বন্ধ হওয়ার শব্দ। রবিন! ডাক দিল সে। তুমি?

জবাব এল না। তাকের দিক থেকে ঘুরে কান পাতল কিশোর। হঠাৎ বুঝতে পারল রবিন কিংবা এলেনা নয়। পিজা নিয়ে এত তাড়াতাড়ি আসার কথা নয়। ওদের।

কিন্তু কেউ একজন ঢুকেছে।

আর ডাকল না কিশোর। নড়লও না। স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে রইল। পদশব্দ শোনা গেল। উঠে আসছে কেউ।

কাপড়ের খসখস শোনা গেল। সিঁড়ির মাথার কাছেই পৌঁছে গেছে বোধহয় লোকটা। ভারি নিঃশ্বাস পড়ছে।

কিট করে উঠল লাইট সুইচ। চিলেকোঠার আলো নিভে গেল।

হঠাৎ অনেক বেশি অন্ধকার লাগল কিশোরের কাছে। মনে হল যেন চারদিক থেকে চেপে এসে ধরতে চাইছে। বুককেসের কাছ থেকে সরে গেল সে। লুকোতে গেল আরেকটা বুককেসের আড়ালে। কিন্তু তার আগেই গায়ে এসে পড়ল উজ্জ্বল। আলো। টর্চ।

সরে যাওয়ার চেষ্টা করল কিশোর। সঙ্গে সঙ্গে এল আলোক রশ্মি। গায়ের ওপর থেকে সরছে না। ঘরে ঢুকল লোকটা। উজ্জ্বল আলো চোখে পড়ায় আর কিছুই দেখতে পাচ্ছে না কিশোর। লুকানোর উপায় নেই। বেরোনোর পথ নেই। দরজা আগলে দাঁড়িয়েছে লোকটা।

পিস্তল আছে কি লোকটার হাতে? চোখের ওপর হাত তুলে এনে দেখার চেষ্টা। করল কিশোর। দেখতে পেল না। যা থাকে কপালে ভেবে লাফ দিয়ে এগোল। দা চালানোর মত কোপ মারল লোকটার টর্চ ধরা হাতের কব্জিতে। উফ করে উঠল। লোকটা। টর্চ খসে পড়ল। ঝনঝন করে কাঁচ ভাঙল। গড়িয়ে সরে যাচ্ছে টর্চটা। কয়েকবার মিটমিট করে নিভে গেল আলো। আবার অন্ধকারে ডুবে গেল চিলেকোঠা।

আলো নেই। এবার দুজনেই সমান। অন্ধকারে চলল একে অপরকে পরাজিত করার চেষ্টা। কিশোরের গলা টিপে ধরতে চাইল লোকটা। সরে গেল গোয়েন্দাপ্রধান। পিছাতে গিয়ে কিসে যেন পা বেধে গেল। উল্টে পড়ত আরেকটু হলেই। সামলাতে কষ্ট হল।

হাত পড়ল তার কাঁধে। ঝাড়া দিয়ে সরানোর চেষ্টা করল কিশোর। ছাড়ল না তাকে আঙুলগুলো। খামচে ধরেছে। হাতটা খুজছে বোধহয় মুচড়ে ধরার জন্যেই।

আন্দাজে লোকটার চোয়াল সই করে ঘুসি চালাল কিশোর। লাগল না। পেট সই করে হাত চালাল। এবারেও লাগাতে পারল না। জোরে ঠেলা লাগল কাঁধে ] জোর আছে লোকটার গায়ে। হুমড়ি খেয়ে পড়ল কিশোর। সামলে নিতে পারত, একটা বাক্সে পা বেধে যাওয়াতেই পড়ে গেল।

নিচে দরজা খোলার শব্দ হল।

কিশোর! ডাক দিয়ে বলল রবিন। এনেছি। এসো।

বিড়বিড় করে উঠল আরেকটা কণ্ঠ। কিছু বুঝতে পারল না কিশোর। অন্ধকারে দরজা দিয়ে প্রায় ছুটে বেরোল রহস্যময় হামলাকারী। সিঁড়িতে পায়ের শব্দ দুপদাপ করে নেমে চলে গেল।

হাঁচড়ে পাঁচড়ে উঠে পড়ল কিশোর। দৌড় দিল সে-ও। লোকটাকে ধরার জন্যে। দোতলায় পৌঁছে পায়ের আওয়াজ শুনতে পেল পেছনের সিঁড়িতে।

আবার ডাকল রবিন, এই কিশোর! কি হয়েছে?

জবাব না দিয়ে দৌড়ে নামল কিশোর। রান্নাঘরে ঢুকল। দড়াম করে লেগে গেল ঘরের পেছন দিকের দরজাটা। লোকটা বেরিয়ে গেল। ছুটে গিয়ে সে দরজা। খুলে তাকাতে তাকাতে, আঙিনা পার হয়ে গেল হামলাকারী।

.

০৬.

পুলিশকে খবর দিল এলেনা। এসে রিপোর্ট লিখে নিল ওরা। বাড়ির চারপাশে ঝোপগুলোতে খুঁজে দেখল। গ্যারেজে দেখল। তারপর এলেনাকে পরামর্শ দিল, আবার যদি কেউ হামলা করতে আসে নাইন ওয়ান ওয়ানে যেন ফোন করে।

লিসটারের আর কোন খবর আছে কিনা জিজ্ঞেস করল পুলিশ সান্ত্বনা দিয়ে বলল, ভয় নেই, অনেকেই ওরকম বাড়ি থেকে বেরিয়ে যায়, আবার ফিরেও, আসে। র‍্যানসম নোটটার ব্যাপারে কিছুই বলল না এলেনা। দরজায় দাঁড়িয়ে পুলিশের গাড়িটা চলে যেতে দেখল। জোরে একটা নিঃশ্বাস ফেলে বলল, কে ওই লোক? সাধারণ চোর? নাকি কিডন্যাপার? চিন্তায়ই ফেলে দিল।

আমার ধারণা কিডন্যাপার, রবিন বলল। হয়ত বিশপের বইয়ের জন্যে তর সইছে না আর। অস্থির হয়ে নিজেই দেখতে চলে এসেছে।

হয়ত, কিশোর বলল। তবে তার চেয়ে আমাদেরই খুঁজে দেখার সুযোগ বেশি। আমাদের ওপর দায়িত্বটা ছেড়ে দিয়ে চুপ করে বসে থাকাই তার জন্যে সুবিধে। একটা ব্যাপার অবশ্য জেনে গেলাম, এ বাড়ির ওপর নজর রাখা হচ্ছে।

ভয় ফুটল এলেনার চোখে। আজ রাতে মায়ের কাছে চলে যাব কিনা ভাবছি। এ বাড়িতে আমি একা থাকতে পারব না।

আপনার আম্মা কি কাছেই থাকেন? জিজ্ঞেস করল কিশোর।

সান্তা মনিকায়। আব্বার সঙ্গে ছাড়াছাড়ি হয়ে গেছে। হ্যাঁ, চলেই যাব। কিন্তু…থাকতে পারলেই ভাল হত। আবার ফোন করতে পারে কিডন্যাপার। আমি না থাকলে কথা বলবে কে? কডিকে ফোন করে অবশ্য থাকতে বলতে পারি। আব্বার সেক্রেটারি যখন, এটা তার ডিউটির মধ্যেই পড়ে। কিছু ওভারটাইম দিলেই হবে।

আপনার হবু বর আর তার মা এসে থাকতে পারেন না?

পারত। তবে বোস্টন থেকে নাকি খবর এসেছে, বাড়িতে জরুরী কাজ। আজ রাতেই চলে যেতে হবে ওদেরকে। গুঙিয়ে উঠল এলেনা। নিক অবশ্য থাকতে চেয়েছিল, আমি মানা করে দিয়েছি।

কিশোর বলল, আপনি চাইলে আমি আর রবিন থাকতে পারি।

চোখ মিটমিট করল এলেনা। এমন ভান করতে লাগল এলেনা যেন প্রস্তাবটায় খুশি হয়নি, কিন্তু চেপে রাখতে পারল না। অবশেষে বলল, বেশ। আমি তোমাদের মক্কেল। কাজেই আমার ভালমন্দ দেখার দায়িত্ব এখন তোমাদের। হাসল। তোমাদের বাড়ি থেকে কোন আপত্তি আসবে না তো?

না। আমাদের এসব অত্যাচার বাড়িতে গা সওয়া হয়ে গেছে। রাতে না ফিরলে এখন আর কিছু মনে করে না। তবে একটা ফোন করে বলে দিতে হবে, বলল কিশোর।

বাসায় বলে দিল কিশোর আর রবিন। এলেনাকে পাহারা দেয়ার জন্যে লিসটারের বাড়িতে রাত কাটাতে অনুমতি মিলল দুজনেরই। ফোন করার পর মনে। পড়ল রবিনের পিজা খাওয়ার কথা। খাওয়া শেষ করে আবার বিশপের বই খোঁজায় মন দিল। দোতলার ঘরে অনেক বই, কাগজপত্র আর স্যুভনির মিলল, ম যেগুলো প্রমাণ করে তরুণ বয়েসে নাবিক ছিলেন লিসটার, সাগরে সাগরে; ঘুরেছেন।

অ্যাডভেঞ্চার প্রিয় লেখক ছিলেন আপনার আব্বা, হাতির দাঁতের তৈরি একটা হাতির প্রতিকৃতির দিকে তাকিয়ে রয়েছে রবিন। ভারত থেকে আনা হয়েছে জিনিসটা। দেশে দেশে ঘুরতে নিশ্চয় খুব ভাল লাগত তার।

অ্যাডভেঞ্চারটা তখন করতে হয়েছে পেটের দায়ে, বিষণ্ন কণ্ঠে বলল এলেনা। যেখানে কাজ পেত সেখানেই চলে যেত। তারপর কোন ভাবে কিছু টাকা। জমিয়ে কিনল লিসটার স্টীমশিপ লাইন। পুরনো মরচে পড়া দুটো মালবাহী। জাহাজ, হিউসটন থেকে ক্যারিবিয়ান বন্দরগুলোতে যাতায়াত করত। ওই দুটো লক্কড় মার্কা জাহাজের আয় থেকেই আরেকটু ভাল আরেকটা জাহাজ কিনল। আরও টাকা জমল। ভিজালিয়ায় ছোট একটা ব্যাংক কিনল। ঢুকে পড়ল স্টক মার্কেটে।

আম্মা বলে ওই সময়টাতেই টাকার জন্যে রীতিমত খেপে ওঠে আব্বা। ভাল একটা মানুষ চোখের সামনে পাকা জুয়াড়ি হয়ে গেল যেন, আম্মার কাছে তা-ই। মনে হয়েছে। আসলে আমার মনে হয় আম্মা আব্বাকে বুঝতে পারেনি।

আপনি পারেন? রবিন জিজ্ঞেস করল।

শ্রাগ করল এলেনা। মনে হয়। অন্তত আর সবার চেয়ে বেশি। মজুতদারী ব্যবসা আরেকটু কম করলেই আমি খুশি হতাম। ওকাজটা আমার ভাল লাগে না। মাল কিনে জমিয়ে রেখে সুযোগ বুঝে ছেড়ে দেয়া। অনেক কিছু শিখিয়েছে। আমাকে আব্বা, তার মধ্যে ওটা একটা। এর জন্যে অবশ্য অনেক সচেতন থাকতে হয়। ভুল করলেই ডুবতে হবে।

আমার পাঁচ বছর বয়েসে আম্মার সঙ্গে আব্বার ডিভোর্স হয়ে যায়। কলেজে যাওয়ার আগে আম্মার কাছেই বেশি থাকতাম। অন্যখানে থাকলেও পরের দিকে প্রায়ই দেখা করতাম আব্বার সঙ্গে। তাকে মনে করিয়ে দিতে চাইতাম যে তার একটা মেয়ে আছে।

দোতলায় খোঁজা শেষ করতে অনেক রাত হয়ে গেল। গুড নাইট জানিয়ে শোবার ঘরে চলে গেল এলেনা। ওপর তলার হলঘরে পালা করে পাহারা দেয়ার সিদ্ধান্ত নিল কিশোর আর রবিন। এলেনার কাছাকাছি থাকতে পারবে এতে। সামনে আর পেছনের দিকটায়ও একই সঙ্গে নজর রাখতে পারবে। পা টিপে টিপে এসে হঠাৎ ওদের ওপর হামলা চালাতে পারবে না কেউ।

প্রথম পালা রবিনের। বেডরুম থেকে একটা আর্মচেয়ার এনে একটা কোকের বোতল হাতে নিয়ে আরাম করে বসল।

আলমারি থেকে কম্বল বের করে অব্যবহৃত শোবার ঘরের একটাতে শুয়ে. পড়ল কিশোর। শুরুতে মনে হল ঘুমই আসবে না। সারাদিন অনেক উত্তেজনা। গেছে। সেগুলো ঘুরছে মাথার মধ্যে।

রবিনের ঝাঁকানিতে ঘুম ভাঙল তার। তিনটে বাজে। আমি আর পারছি না। ওঠো। এবার তুমি যাও।

কম্বলের নিচ থেকে বেরিয়ে এল কিশোর। সেই জায়গায় ঢুকল রবিন। হুমম! গরম কম্বলের জন্যে ধন্যবাদ।

দুঃখিত। তোমার ধন্যবাদটা নিতে পারলাম না, গোঁ গোঁ করে বলল কিশোর। হলঘরে চলে এল পাহারা দিতে। ঠাণ্ডা লাগছে। বসে পড়ল চেয়ারে। তার মনে হল, রাত তিনটে হল দিনের সব চেয়ে বিষণ্ণতম সময়।

ভোর হতে কতক্ষণ লাগবে জানা আছে, কিন্তু সেই সময়টা কাটবে কি করে। বুঝতে পারছে না।

মাথার ওপরে কি যেন নড়ছে। ওপর দিকে তাকাল। দম বন্ধ করে ফেলেছে। কান খাড়া।

কিছুই না! একেবারে নীরব। পুরনো অদ্ভুত এই বাড়িটা, স্নায়ুর ওপর চাপ ফেলতে আরম্ভ করেছে। অলীক কল্পনা শুরু হয়ে গেছে তার।

কিন্তু না, কল্পনা নয়। আবার শোনা গেল। খুব হালকা নড়াচড়া। খালি পায়ে চিলেকোঠার মেঝেতে হাটছে যেন। ছোট্ট, হালকা পাতলা শরীরের কোন মানুষ।

কিন্তু ওখানে তো কারও থাকার কথা নয়!

উঠে দাঁড়াল কিশোর। পা টিপে টিপে নিঃশব্দে উঠে এল সিঁড়ি বেয়ে। চিলেকোঠার দরজার সামনে এসে থামল। হাত বাড়িয়ে নব চেপে ধরে মোচড় দিল। আস্তে ঠেলা দিয়ে ফাঁক করল পাল্লা।

অন্ধকার ঘর। আলোর চিহ্নমাত্র নেই। পরিত্যক্ত জায়গার এক ধরনের পুরনো ধুলোটে গন্ধ এসে নাকে লাগছে।

কেউ আছে। সিঁড়ির মাথায়। দেখতে পাচ্ছে না, তবে কাপড়ের মোলায়েম খসখস কানে আসছে। বুঝতে পারছে তাকে ঠিকই দেখতে পাচ্ছে মানুষটা, ওপর থেকে নিচের দিকে তাকিয়ে।

তেতো হয়ে গেল কিশোরের মন। মস্ত ভুল করেছে আসার আগে সিঁড়ির আলোটা না জ্বেলে। লোকটার হাতে পিস্তল থাকলে চমৎকার একটা নিশানা হয়ে আছে এখন সে।

যে লোকটা তখন আক্রমণ করেছিল এ কি সেই লোক? যদি হয়, ফিরে এল কেন? ভেতরেই বা ঢুকল কিভাবে? চিলেকোঠায় কি করছে?

পিছিয়ে এসে আবার দরজাটা লাগিয়ে দিল কিশোর।

কি হয়েছে? কিশোরের পেছনে ফিসফিস করে কথা শোনা গেল।

এমন চমকে উঠল কিশোর যেন গুলি খেয়েছে।

আরে আমি।

 এলোমেলো হয়ে আছে রবিনের পোশাক। পায়ে জুতো নেই। বিছানা থেকে সোজা উঠে চলে এসেছে। ছাতের দিকে দেখিয়ে বলল, ওপরে কেউ হাঁটছিল। ফিসফিস করছে এখনও।

তুমিও শুনেছো?

মচ করে উঠল একটা তক্তা। সিঁড়ি থেকে সরে গেছে লোকটা। বাড়ির সামনের দিকে চলেছে।

তুমি ঘুমিয়ে পড়েছিলে, কিশোর বলল। ওই লোকটা তোমার সামনে দিয়েই গিয়েছিল। আর কোন পথ ছিল না। ঘুমিয়ে ছিলে বলেই দেখতে পাওনি।

একটুও না? জোর দিয়ে বলল রবিন। এক সেকেণ্ডের জন্যেও না। ঘুম তাড়ানোর জন্যে দুবার উঠে পায়চারিও করেছি।

ভুরু কুঁচকে হাতের দিকে তাকিয়ে রইল কিশোর। যাই হোক, সে ঢুকেছে। জানে সে একা নয়। আমরা রয়েছি। জানে ওখানে কি আছে। আর সেজন্যেই…

 এক টান দিয়ে চিলেকোঠার দরজা খুলে ফেলল সে। চেঁচিয়ে বলল, এই, কে কে ওখানে?

জবাব নেই। তবে হাঁটা বন্ধ হয়ে গেল।

 আবার ডাকল কিশোর।

সাড়া নেই এবারেও।

চিলেকোঠার আলো জ্বালল কিশোর।

না না যেও না! বাধা দিল রবিন। লোকটার কাছে পিস্তল থাকতে পারে!

গুলি করার ইচ্ছে থাকলে এতক্ষণে করে ফেলত। তবে আত্মবিশ্বাসের জোর ততটা নেই।

এক দৌড়ে উঠে গেল সিঁড়ি বেয়ে। কেউ নেই। শূন্য ঘর। বুককেস, ট্রাঙ্ক আর বাক্সগুলো রয়েছে আগের মতই। কিন্তু কোন মানুষ নেই। চিলেকোঠা থেকে লোকটা সিঁড়িঘরে বেরোনোর আগেই সে উঠে যেতে চায়।

নিরাপদেই পৌঁছল। কিন্তু মানুষ দেখতে পেল না। শূন্য চিলে কোঠা। বুককেস, ট্রাঙ্ক, বাক্স সব আগের মতই রয়েছে। মানুষ নেই।

স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে কান পেতে রইল সে।

 কোন শব্দ নেই।

বেরিয়ে এল আবার সিঁড়িতে। নিচে তাকাল। ওর দিকে তাকিয়ে রয়েছে রবিন।

কিছুই নেই, কিশোর জানাল। আমরা…আমরা নিশ্চয় কোন ধরনের হ্যালুসিনেশনের মধ্যে ছিলাম!

আমি বিশ্বাস করি না!

কেউ নেই এখানে। চুপ করে এক মুহূর্ত ভাবল কিশোর। তবে এই সিঁড়ি বাদে আসাযাওয়ার আর কোন পথ যদি থাকে, আলাদা কথা। হ্যাঁ, তা-ই হয়েছে। পুরনো বাড়ি একটা। গোপন পথ থাকতেই পারে। আগের দিনে লোকে গুপ্তপথ তৈরি করে রাখত। এই পথের খবর যে ওখানে উঠেছে সে ছাড়া আর কেউ জানে না।

রবিনের পেছনে হলঘরে এসে ঢুকল এলেনা। পরনের শোবার পোশাকটা দুমড়ে কুঁচকে গেছে। ভারি হয়ে আছে চেহারা। কি ব্যাপার? কি হয়েছে? কিশোর, ওখানে কি করছো?

এলেনা, মেয়েটার অনুরোধেই তাকে মিস লিসটার বলা বাদ দিয়েছেনকিশোর। এ বাড়িতে কি কোন গোপন পথ আছে? চিলেকোঠায় ওঠা যায়?

জানি না তো?

কোন গুজব শুনেছেন পথটা সম্পর্কে।

 মাথা নাড়ল এলেনা। না।

 খুঁজতে লাগল কিশোর। বাক্স আর ট্রাঙ্কের পিছনে দেখল। চিমনির কাছের জিনিসপত্র সরাল, যদি কোন গুপ্তদরজা থেকে থাকে ওখানে সে আশায়। রান্নাঘর থেকে একটা টর্চ নিয়ে এল। কাঠের মেঝের শেষ প্রান্তে যেখানে চালু হয়ে। কডিকাঠের ওপর নেমে এসেছে ছাত; সেখানে খানিকটা খোলা জায়গা রয়েছে। হামাগুড়ি দিয়ে দেখতে দেখতে সেখানটায় চলে এল। শোবার ঘরের ছাতের কিছুটা জায়গার পাসটার চোখে পড়ে এখান থেকে। তবে বেরোনোর মত কোন পথ নেই। বহু বছরে অনেক ময়লা জমেছে ওখানে। আর এমন টুকিটাকি জিনিস, যেসব ফেলে দিয়ে তারপর ভুলে যায় লোকে। যেমন, একটা পুরনো, গলফ বল, একটা কোকা কোলার বোতল, আর দলা পাকিয়ে ফেলে দেয়া কিছু কাগজ।

চিলেকোঠার প্রতিটি ইঞ্চি পরীক্ষা করে দেখে তারপর বেরোল কিশোর। নেমে এল নিচের হলঘরে। রবিন আর এলেনা বসে রয়েছে ওখানে।

আশ্চর্য! পথ নেই শুনে বলল রবিন।

সব তোমাদের কল্পনা, বলল এলেনা।

নিজের ঘরে গিয়ে আবার দরজা দিল সে।

শোবার ঘর থেকে গিয়ে কম্বলটা নিয়ে এল রবিন। শরীর মুড়ে বসে পড়ল। কিশোরের আমচেয়ারের পাশে।

শোবে না আর? কিশোর বলল, এখন আমার ডিউটি। চলে যাও।

একা যেতে আর ভাল্লাগছে না। এখানেই থাকি।

বাকি রাতটা ওখানে বসেই কাটাল দুজনে। তাকিয়ে রইল সিঁড়িতে যাওয়ার। পথের দিকে। একটু পর পরই মুখ ভোলে ছাতের দিকে। কান সজাগ এমনি করেই ভোর হল।

 আরেক বার পায়ের আওয়াজ শুনল বলে মনে হল রবিনের। তবে এত হালকা, নিশ্চিত হতে পারল না সত্যিই শুনেছে কিনা।

অবশেষে পাতলা ধূসর আলো দেখা দিল জানালায়। সূর্য উঠতে দেরি নেই। শেষ হল দীর্ঘ বিরক্তিকর পাহারার পালা।

হঠাৎ শক্ত হয়ে গেল কিশোর। তালায় চাবি ঢোকানোর আওয়াজ শুনেছে। নিচতলায়। রান্নাঘরের দরজা খুলল। ওখানে কেউ রয়েছে। যার কাছে চাবি আছে।

একলাফে চেয়ার থেকে উঠে দাঁড়াল কিশোর। অস্ত্র। একটা অস্ত্র দরকার। খালি হাতে আর যাবে না।

কম্বলটা ছুঁড়ে ফেলে দিল রবিন।

 ঠোঁটে আঙুল রেখে তাকে শব্দ করতে মানা করল কিশোর। চুপ থাকতে ইশারা করল। চিলেকোঠার সিঁড়ির দেয়ালে ঝোলানো একটা পিতলের বাসন দেখতে পেয়ে সেটাই খুলে নিল। ভাল কোন অস্ত্র নয়, তবে হাতে একেবারে কিছু না থাকার চেয়ে ভাল।

 পেছনের সিঁড়ি ধরে ছুটে নামতে শুরু করল। পেছনে রবিন।

সিঁড়ির গোড়ায় নেমে রান্নাঘরের ভেতরে তাকানোর চেষ্টা করল। রান্নাঘরের। দরজার ওপরের অর্ধেকটা কাঁচের। কিন্তু অন্য পাশে কাপড়ের পর্দা লাগানো থাকায় এপাশ থেকে ভেতরটা দেখা যায় না। দরজা না খুলে ভেতরে কে আছে দেখার উপায় নেই।

সামনে এগোল কিশোর। বাসনটা শক্ত করে ধরল।

মৃদু একটা খটখট শব্দ হচ্ছিল। থেমে গেল সেটা। হাঁ হয়ে খুলে গেল দরজা।

বাড়ি মারার জন্যে বাসন তুলল কিশোর।

.

০৭.

ও বাবা গো!

চিৎকার করে পিছিয়ে গেল ধূসর চুল এক মহিলা। বাসনের বাড়ি থেকে বাঁচানোর জন্যে দুহাত তুলে নিয়ে এল মাথার ওপর।

 পাথর হয়ে গেছে যেন কিশোর। একটা সেকেণ্ড জমেই রইল সে, বাসনটা তোেলা। মহিলার হাতের বাজারের থলের দিকে তাকিয়ে বুঝতে পারল এই মানুষের কাছ থেকে ক্ষতির আশঙ্কা নেই। সরি, বলে বাসনটা নামিয়ে নিল সে।

পুলিশ! আবার চিৎকার করে উঠল মহিলা। বাঁচাও! বলেই ঘুরে দিল দৌড়। গেটের দিকে।

আরে শুনুন শুনুন! চেঁচিয়ে বলল কিশোর। প্লীজ! এক মিনিট।

শোবার পোশাক পরে খালি পায়ে ছুটতে ছুটতে নেমে এল এলেনা। মহিলাকে দেখতে পেয়ে সে-ও চেঁচিয়ে ডাকল, মিসেস বেকার, শুনুন শুনুন!

কিশোরের পাশ দিয়ে দৌড়ে বেরিয়ে গেল সে। মহিলা অর্ধেক পথ যাওয়ার আগেই তাকে ধরে ফেলল। শুনুন। ওরা ভাল ছেলে। কিছু করবে না।

ধীরে ধীরে ফিরে এল আবার মহিলা।

রবিন, কিশোর, পরিচয় করিয়ে দিল এলেনা। ও মিসেস বেকার। আমাদের হাউসকীপার। মিসেস বেকার; ওরা আমার বডিগার্ড।

 কড়া চোখে গোয়েন্দাদের দিকে তাকাতে লাগল মিসেস বেকার, বিশেষ করে কিশোরের দিকে। জোরে জোরে হাঁপাচ্ছে। কিশোরের মনে হল বহু বছর পর এত জোরে দৌড়েছে মহিলা।

বডিগার্ড? মহিলার চোখে সন্দেহ। গুপ্তধন পেয়েছ নাকি? বডিগার্ড লাগে কেন? তোমার আব্বই বা কোথায়? তোমার জন্যে তিনিই তো যথেষ্ট। যে কোন মানুষের জন্যেই! শয়তানও কাছে ঘেঁষবে না।

আব্বা নেই। নিরুদ্দেশ। কাল থেকে। কিডন্যাপ করা হয়েছে তাকে।

 কিডন্যাপ? বল কি! 

ঠিকই বলছি, এলেনা বলল। বাবার রহস্যময় নিরুদ্দেশের কথা খুলে বলল। র‍্যানসমের নোটটাও দেখাল মিসেস বেকারকে। এরা আমাকে সাহায্য করছে, গোয়েন্দাদের দেখিয়ে বলল সে। বিশপের বই খুঁজছি আমরা। ঈশ্বরই জানেন ওটা কি! ওই নামটা আব্বার মুখে কখনও শুনেছেন?

না, সোজাসাপ্টা জবাব দিল মিসেস বেকার। পাদ্রী-(বিশপ)র সঙ্গে তোমার আব্বার বনিবনা হবে না। কোনদিন হয়েছে বলেও মনে হয় না। তুমি বলতে চাইছ কেউ বাড়িতে ঢুকে, তোমার আব্বাকে তুলে নিয়ে গিয়ে ওই নোট পাঠিয়েছে? ফ্যাকাসে ওই ছোকরাটাকে জামাই করার বিন্দুমাত্র ইচ্ছে নেই তার, তুমি জান। আমারও পছন্দ নয় ছেলেটাকে। পছন্দ করার মত কিছু থাকলে তো করব। তোমার কাছে হেরে গিয়ে ওই পার্টি দেয়াটা মস্ত ভুল হয়ে গেছে তোমার আব্বার। কিন্তু রাজি তুমি করিয়ে ছেড়েছ। আর দিয়েছ রোববারে, এমন একটা দিনে যেদিন আমার ডিউটি নেই। তোমার বাবা কিডন্যাপ হয়েছেন বলছ? আমার বিশ্বাস হয় না। নিশ্চয় চলে গেছেন লুকিয়ে, নোট পাঠিয়েছেন তোমাকে ভয় দেখানোর জন্যে। আসলে কায়দা করে তোমার বিয়েটা ঠেকাতে চাইছেন।

না, জোর দিয়ে বলল এলেনা। আমার তা মনে হয় না। নিজে নিজেই চলে গেছে একথা ভেবে চুপ করে থাকতে পারব না আমি। ঝুঁকিটা নেয়া কি ঠিক আপনিই বলুন? কিডন্যাপাররা যদি কোন ক্ষতি করে তার?

 মাথা নাড়তে লাগল মিসেস বেকার। বিচ্ছিরি অবস্থা। বাজারের থলেতে হাত ঢুকিয়ে একটা অ্যাপ্রন বের করে আনল। সেটা পরে নিয়ে নাস্তা বানাতে বসল। কথা বলে চলেছে একনাগাড়ে। বাড়ি হল এটা একটা? অভিশাপ আছে এর। ওপর। সব সময়ই খারাপ ঘটনা ঘটছে। বাড়িটা বানিয়েছিল ডিক ব্রাউন নামে এক লোক। আমার পড়শী শেলি টেনারের কাছে শুনেছি এসব। ব্রাউন খুব ধনী লোক ছিল। কিন্তু যেদিন বাড়িটা তৈরি শেষ হল সেদিনই সব কিছু খোয়াল। স্টক মার্কেট ধসে পড়ল, সেটা কবে যেন? হ্যাঁ, উনিশ শো উনত্রিশ সালে। ব্রাউন এখানে। থাকতে আসেনি। বহু বছর খালিই পড়ে রইল বাড়িটা। তারপর, আমি যেই নিউ : ইয়র্কে চলে গেলাম কার্পলি নামের এক পরিবার বাড়িটা কিনল। ওদের কথা মনে আছে আমার। দ্রলোক বেশ বড়সড় শরীরের মানুষ ছিলেন, একদিন পড়ে গেলেন সিঁড়ি থেকে। কোমর ভাঙলেন। জীবনে আর সোজা হয়ে দাঁড়াতে পারেননি। হাটাচলা বাদ।

কার্পলিদের পরে এল মিস হ্যাঁমারসন। বৃদ্ধা। অনেক টাকার মালিক। একা মানুষ। সেজন্যেই বোধ করি তার এক ভাস্তিকে নিয়ে এল। মেয়েটাকে আমি দেখেছি। সুন্দর ছিল খুব। কিন্তু বিষণ্ণ। সারাক্ষণই মন খারাপ করে রাখত। এর জন্যে অবশ্যই মিস হ্যাঁমারসন দায়ী। বেশি কড়াকডি করত মেয়েটার সঙ্গে। ইস্কুল থেকে এসেই রাতের খাবার বানাতে সাহায্য করতে হত ফুফুকে। মিস হ্যাঁমারসন। বলত, কাজ করা ভাল, তাতে আখেরে উন্নতি হয়। চরিত্র ঠিক হয়। আমার বিশ্বাস, চাকরের পয়সা বাঁচাতেই মেয়েটাকে এনেছিল বুড়ি। সাংঘাতিক কিপটে ছিল তো। আহারে, বেচারি মেয়েটার জন্যে খুব কষ্ট হত আমার। ওর বয়েসী ছেলেমেয়েরা যখন খেলত, কিংবা গল্প করত, সে তখন খেটে মরত রান্নাঘরে।

 মেয়েটার চোদ্দ বছর বয়েস তখন। একদিন একটা চুলের কাটা হারিয়ে গেল। মিস হ্যাঁমারসনের। দোষ দিয়ে বসল মেয়েটাকে। বলল সে-ই চুরি করেছে। রাগ করে তখন মেয়েটাকে তার বাবা-মার কাছে পাঠিয়ে দিল। শুনেছি, কয়েক বছর পর একটা শয়তান ছেলের সঙ্গে পালিয়ে গেছে মেয়েটা। তার পর যা হয় তা-ই হল। কিছু দিন পর মেয়েটাকে ফেলে রেখে পালাল ছোকরা। শেষ খবর যা জানি, স্যানফ্রানসিসকোয় আছে মেয়েটা। একটা মার্কেটে চাকরি করে।

ডিম, টোস্ট আর ভাজা মাংস এনে টেবিলে সাজিয়ে দিল মিসেস বেকার। এক কাপ কফি খাবার জন্যে নিজেও বসল সবার সঙ্গে।

এ বাড়িতে ভূতের উপদ্রব আছে, শুনেছেন কখনও? কিশোর জিজ্ঞেস করল। এখানে যেসব কাণ্ড হয়েছে তাতে নিশ্চয় অনেক কানাঘুষা করেছে লোকে। গুজব রটেছে।

লোকে তো বলেই, মিসেস বেকার বলল। আর পুরনো বাড়ির ব্যাপারে খামোকাই অনেক কথা বলে, কিছু না থাকলেও। তবে এ বাড়ি সম্পর্কে আমি। তেমন কিছু শুনিনি। কিছু দেখিওনি। বাড়িটা আনলাকি, একথাই শুধু বলতে পারি। আর মাঝে মাঝে, মেঘলা দিনে এমন মনে হয়…মনে হয় কি যেন তাকিয়ে রয়েছে আমার দিকে! লুকিয়ে আমাকে দেখছে। কেন যে এমন লাগে বলতে পারব না। রাতের বেলা আর কিছুতেই থাকতে রাজি নই আমি এখানে।

যত্তোসব ছেঁদো কথা! বিড় বিড় করল এলেনা।

চিলেকোঠায় ঘুরে বেড়ানো কোন কিছুর কথা আপনি শুনেছেন? জিজ্ঞেস করল রবিন।

চিলেকোঠায়? মাথা নাড়ল মিসেস বেকার। নাহ! ওরকম কিছুই শুনিনি, আমি। চিলেকোঠায় কিংবা কোনখানেই কিছু আছে বলে জানি না। শুধু শুধু আমার মনে হয়, আছে.। কোথাও কোন একটা ব্যাপার রয়েছে, ঠিক বুঝতে পারি না।

কফির কাপে ঘন ঘন কয়েকবার চুমুক দিল মিসেস বেকার। গম্ভীর হয়ে গেছে।

প্রসঙ্গটা বদল করল দুই গোয়েন্দা। মিসেস বেকার তেমন কোন তথ্য দিতে পারল না ওদেরকে। তবে একটা ব্যাপারে নিশ্চিত হয়ে গেল ওরা, গত রাতের ঘটনাটা এ বাড়িতে নতুন।

নাস্তা শেষ করে, এলেনার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে বেরিয়ে পড়ল ওরা। স্যালভিজ ইয়ার্ডে ঢুকতেই দেখা হয়ে গেল মেরিচাচীর সঙ্গে। কিশোর ভেবেছিল, তাকে দেখলেই নানা কথা জিজ্ঞেস করতে শুরু করবেন তিনি। কিন্তু করলেন না। ফুরসৎ নেই। কাজে ব্যস্ত। প্যাসাডেনায় একটা পুরনো বাড়ি ভেঙে নতুন করে ভোলা হবে। ওটার যত পুরনো জিনিসপত্র আছে সব কিনে নিয়ে এসেছেন রাশেদ পাশা। শুধু তাই নয়, পুরনো ইটও নিয়ে এসেছেন। সুড়কি লেগে রয়েছে। কিশোর আর রবিনকে দেখেই কাজে লাগিয়ে দিলেন মেরিচাচী। ইট পরিষ্কারের কাজ।

মেজাজ খিঁচড়ে গেল কিশোরের। কিন্তু কিছু করার উপায় নেই। মেরিচাচীর মুখের ওপর না বলার সাহস নেই তার। কাজ শেষ করতে করতে অনেক বেলা হয়ে গেল। ঘরে ঢুকে হাতমুখ ধুয়ে এল দুজনে। খেতে দিলেন চাচী। স্যাণ্ডউইচ। ডাইনিং রুমে বসে না খেয়ে সেগুলো নিয়ে ওয়ার্কশপে চলে এল ওরা।

বেঞ্চে বসে খাবার চিবুচ্ছে, এই সময় মাথার ওপরের লাল আলোটা জ্বলে নিভে জানান দিল হেডকোয়ার্টারে টেলিফোন বাজছে।

দুই সুড়ঙ্গ দিয়ে এসে ট্রেলারে ঢুকল দুজনে। রিসিভার তুলে নিল কিশোর। ফোন করেছে ডেভিভ লিটারের সেক্রেটারি কডি হোয়েরটা।

এলেনা বলল তোমাকে ফোন করতে। সারা সকাল ধরে সেই রহস্যময় বইটা খুঁজেছি। পাইনি। তখন এলেনা বলল, তার আব্বার কমপিউটারে খোঁজ নিতে। ফাইল দেখলে হয়ত কিছু জানা যাবে। কিন্তু ফাইল বের করার সংকেত জানি না। এলেনা তোমাকে আসতে বলেছে। তার ধারণা, তুমি কিছু করতে পারবে।

 রবিনের দিকে ঘুরল কিশোর। রিসিভারে হাত চাপা দিয়ে হোয়েরটা কি। বলেছে বলল। জিজ্ঞেস করল, যাবে নাকি?

যাব।

হাত সরিয়ে নিয়ে হোয়েরটাকে বলল কিশোর, আমরা আসছি।

বাইরে বেরিয়েই মুসাকে দেখতে পেল ওরা। সাইকেল স্ট্যাণ্ডে তুলছে সহকারী গোয়েন্দা। লিসটারের বাড়িতে যাবে কিনা জিজ্ঞেস করল তাকে কিশোর। বলল, এলেনা আমাদের সহ্য করে নিয়েছে।

আমি তাকে পারব কিনা জানি না, মুসা বলল। বাপের চেয়ে কোন অংশে কম নয়।

 কিন্তু রবিন আর কিশোর যখন রওনা হল ঠিকই ওদের সঙ্গে চলল সে।

কয়েক মিনিট পরেই লিসটারের বাড়ির দরজায় এসে দাঁড়াল তিন গোয়েন্দা। বেল। বাজাল। মিসেস বেকার খুলে দিল দরজা। এক হাতে একটা স্প্রে, উইনডো। ক্লীনার, আরেক হাতে একমুঠো পেপার টাওয়েল, জানালা পরিষ্কার করছিল বোধহয়। খুশি খুশি গলায় বলল, এদ্দিন পরে সুযোগ পেলাম। সব ময়লা এবার ঝেটিয়ে বিদেয় করব। বুড়োটার জ্বালায় পারতাম না। ছুতেই দিত না কোন কিছু। তোমরা যাও। এলেনা আর কডি কমপিউটার রুমে অপেক্ষা করছে।

 ঘুরে সিঁড়ির দিকে রওনা হল মিসেস বেকার। তার পেছনে চলল তিন গোয়েন্দা। সিঁড়ির মাথায় উঠে ইশারায় কমপিউটার রুমের দিকে যেতে বলে নিজে গিয়ে ঢুকল একটা শোবার ঘরে।

 দুটো কমপিউটারের মধ্যে যেটা ছোট, সেটার সামনে বসে রয়েছে হোয়েরটা। চাবি টিপছে। প্রতিটি চাপের পর পরই টিইট টিইট শব্দ করছে কমপিউটার।

তার পেছনে দাঁড়িয়ে মনিটরের দিকে তাকিয়ে রয়েছে এলেনা।

এটা আব্বার ব্যক্তিগত কমপিউটার, ছেলেদেরকে জানাল, সে। আব্বার অফিসে যে কমপিউটার সিসটেম রয়েছে তারই একটা অংশ এই বড়টা। তবে ছোটটা একেবারে আলাদা। এটার সঙ্গে কোনটার যোগাযোগ নেই। মডেম নেই, কাজেই বাইরের কেউ ঢুকতে পারবে না এটাতে। সংকেতটা বের করতে পারলেই তার ফাইলগুলো দেখতে পারব। এমনও হতে পারে, বিশপের বই আসলে বইই। নয়, অন্য কোন কিছুর সংকেত। কোড নেম।

মাথা নাড়ল হোয়েরটা। বুই না ছাই। আসলে মিস্টার লিসটারের ওপর ভীষণ রাগ আছে কারও। শোধ তুলছে। তিনি নিখোঁজ হলে অনেকেরই সুবিধে হয়, অনেকেই খুশি হবে। কি জানি কি করেছেন। মাথায় ছিট আছে তো। হয়ত নিজেই বেরিয়ে চলে গেছেন।

উনি তোমার বস! কঠিন কণ্ঠে বলল এলেনা। ভদ্রভাবে কথা বল!

সরি, কীবোর্ডের দিকে ফিরল হোয়েরটা। কর্মচারীদের ব্যাপারে তথ্য জোগাড় করেন তিনি, তিন গোয়েন্দাকে বলল সে। তাদের অতীত জীবন, ব্যক্তিগত জীবন, সব। যেহেতু আমি তার সেক্রেটারি, তাই জানি। এসব জানতে হলে গোয়েন্দা লাগাতে হয়। প্রাইভেট ইনভেসটিগেটর। তাদের বিলগুলো আমাকেই করতে হয়। তবে রিপোর্ট আমাকে দেখতে দেয়া হয় না। সেটা শুধু মিস্টার লিসটারই দেখেন। আমার বিশ্বাস কিছু কিছু কর্মচারীর অতীত এত বেশি গোলমেলে, অফিসের ফাইলে সেগুলো রাখা যায় না। তাই ব্যক্তিগত কমপিউটারে ঢুকিয়ে রেখেছেন তিনি। কিন্তু বিশপের বই? কোন বিশপের সঙ্গে তাঁর আলাপ নেই।

কোড নেম, আবার বলল এলেনা। কোড নেম হতে পারে।

পাসওয়ার্ড নয়, এটা জেনে গেছি, হোয়েরটা বলল। দেখলামই তো টেস্ট করে।

মিনিট খানেক চুপ করে থেকে ভাবল সে। তারপর টাইপ করে লিখল হাসলার

পি এইচ ইউ এস টি এল ই আর, পড়ল মুসা। মানে কি?

হাসলার কি জান না?

আভিধানিক অর্থ জানি। তিনটে মানে হয়। কর্মতৎপর ব্যক্তি, যে লোক তাড়াহুড়ো করে কাজ করে এবং প্রতারক। কোনটা বোঝাতে চাইছেন?

=ভেঙে বলি। ধর ফুটবল খেলতে নামল কোন লোক। তাকে ভালমত চেনে না। অন্য খেলোয়াড়েরা। তার সম্পর্কে বিশেষ কিছু জানে না। শুরুতে ভাল খেলতে না। পারার অভিনয় করে গেল সে। তারপর সুযোগ বুঝে কায়দা করে গোল দিয়ে। দিল। এমন সময় গোল, যখন প্রতিপক্ষের আর কিছুই করার থাকল না। ওই চালাকি অবশ্য মিস্টার লিসটারও পছন্দ করেন, তাই লিখলাম। চালাক লোক দরকার তার। আর এমন লোক যাদের অতীত রহস্যময়, কোন গোলমাল আছে। ওই ধরনের লোককে খাটানোর সুবিধে, তার দুর্বলতা জানা থাকলে।

আব্বা খুব চালাক, তাই না?

এলেনার কথার জবাব দিল না হোয়েরটা।

টিট টিট করছে কমপিউটার। মনিটরে লেখা উঠলঃ অশুদ্ধ সংকেত। আবার চেষ্টা করুন। এবার স্লাই ফক্স টাইপ করল হোয়েরটা।

আবার টিট টিট করল যন্ত্র। আবার মেসেজ দিল, অশুদ্ধ। আমার বাবা ধূর্ত শেয়াল? তুমি…তুমি একটা শয়তান! চেঁচিয়ে উঠল আচমকা এলেনা। সে জন্যেই এসব লিখছ!

তাহলে বন্ধ করে দেব? শীতল কণ্ঠে বলল হোয়েরটা। কমপিউটারে খোঁজার আইডিয়াটা কিন্তু তোমারই ছিল।

না, থামব না! জানতেই হবে আমাদের। কিন্তু আব্বার অপমান হয় এমন কিছু করতে পারবে না তুমি। ভাল করেই জান ব্যবসাটা তার কাছে একটা মজার খেলা। উঁচু মানের ফুটবল কোচ বলা যায় তাকে। ভীষণ চালাক। তাতে দোষটা কোথায়? চালাক না হলে কি ব্যবসা করা যায়? আর আব্বা চায় সব সময়। জিততে। জেতার জন্যে যা যা দরকার সবই করে।

 নীরবে মনিটরের দিকে তাকিয়ে রয়েছে কিশোর। ঢুলু ঢুলু চোখ, যেন তন্দ্রালু। হয়ে উঠেছে। হঠাৎ সজাগ হয়ে উঠল, খেলা? আপনার আব্বা ব্যবসাটাকে খেলা হিসেবে দেখেন? পাসওয়ার্ডের সূত্র এর মধ্যে নেই তো?

দ্রুত গেম শব্দটা টাইপ করে ফেলল হোয়েরটা। টিইট টিইট করে একঘেয়ে শব্দ করল যন্ত্র।

নানা রকম খেলা চালিয়ে যান, রবিন পরামর্শ দিল। ফুটবল দিয়ে শুরু করুন।

ফুটবল দিয়ে লাভ হল না। বেজবল, বাস্কেট বল, হকি, কোনটা দিয়েই নয়।

খেলাধুলায় বিশেষ আগ্রহ ছিল না আব্বার, এলেনা বলল। অন্য কিছু দিয়ে। চেষ্টা করা যাক।

একচেটিয়া ব্যবসা করার খুব আগ্রহ, হোয়েরটা বলল। মনোপলি লিখে দেখা যাক।

তাতেও সুবিধে হল না।

পোকার লিখে দেখুন তো, মুসা বলল।

একে একে পোকার, জিন রামি, পিনোকল, ব্ল্যাকজ্যাক, সব কিছু দিয়েই দেখা হল। নিরাশ করল কমপিউটার।

তাসের নাম দেয়া শুরু করি, বলে এস লিখল হোয়েরটা। তারপর কিং। সেই একই অবস্থা। কোন মেসেজ দিতে পারল না যন্ত্র। কিন্তু যেই জোকার লেখা হল, অন্য মেসেজ দেখা দিল স্ক্রীনে। আসুন, আমরা খেলা করি! আমন্ত্রণ জানাল, কমপিউটার।

খাইছে! বলে উঠল মুসা।

কমপিউটারকে একটা নির্দেশ দিল হোয়েরটা।

নামের একটা লম্বা তালিকা ফুটে উঠল মনিটরে। ডোপের ওপর একটা ফাইল খুলেছেন লিসটার। এনথনির নামেও আছে একটা। ভিজালিয়া ব্যাংকের ম্যানেজার। আর বড় বড় অফিসারদের নাম চিনতে পারল হোয়েরটা। আরও অনেক নাম, এমনকি হাউসকীপার মিসেস বেকারের নামও রয়েছে ফাইলে।

আরেকটা ফাইল দেখা গেল কডি হোয়েরটার নামে।

আপনাকেও বাদ দেননি, মুচকি হাসল রবিন।

আড়চোখে সেক্রেটারির দিকে তাকিয়ে কিশোর দেখতে পেল হোয়েরটার কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম। এলেনারও নজর এড়াল না সেটা। আপনার ফাইলে কি আছে?

সাধারণত যা থাকে, কোনমতে বলল হোয়েরটা। বয়েস, শিক্ষা, এসব।

দেখি তো, খসখসে হয়ে গেছে এলেনার কণ্ঠ।

এলেনা, আমার ফাইল দেখে….

আমি দেখব!

শ্রাগ করল হোয়েরটা। একটা চাবি টিপল। লিস্টে তার নামের কাছে চলে এল কারসরটা। আরেকটা চাবি টিপল সে। মিলিয়ে গেল নামের তালিকা। পর্দায় ফুটল কডি হোয়েরটা। তার পরে দেখা দিলঃ আসল নাম আরনি ভিনসেনজো। বাবার নাম কার্লো ভিনসেনজো। আমাকে কিছু করার তালে আছে মনে হয়। আরও কিছুদিন কাছাকাছি রাখব। কর্মঠ লোক। আমার ভয়ে যখন কাপে, দরদর করে ঘামে, দেখতে খুব ভাল লাগে আমার।

লাফিয়ে উঠে দাঁড়াল হোয়েরটা। কমপিউটারের দিকে পেছন করে দাঁড়িয়ে বলল, আমি যাচ্ছি! আর কখনও ফিরব না!

.

০৮.

সর্বনাশ! গলার কাছে হাত নিয়ে গেল এলেনা। কার্লো ভিনসেনজোর ছেলে কডি! সে-ই! কিডন্যাপ সে-ই করেছে।

একটা ভুরু উঁচু করল কিশোর। সহায়তা করে থাকতে পারে। তবে সে নিজে কিডন্যাপটা করেনি। সারাক্ষণ পার্টিতে ছিল, মনে আছে? আর সহায়তাইবা করবে কেন? কার্লো ভিনসেনজোই বা কে?

একজন লোক…ওয়েস্ট লস অ্যাঞ্জেলেসের একজন টায়ার ব্যবসায়ী। যে জায়গাটায় তার দোকান সে জায়গাটা আব্বার খুব পছন্দ। অফিসের জন্যে একটা। বহুতল বাড়ি বানাতে চায় ওখানে। অনেক টাকার অফার দিয়েছে আব্বা, বিক্রি করতে রাজি হয়নি ভিনসেনজো। তখন তার দোকানের পাশে আরেকটা টায়ারের দোকান দিয়েছে আব্বা। শস্তায় ভাল জিনিস বিক্রি করছে। তাতে তার লস হলেও কেয়ার করছে না। আসলে ভিনসেনজোর ব্যবসা খারাপ করে দিয়ে তাকে ওখান থেকে তোলার জন্যেই একাজ করেছে আব্বা। টিকে থাকার চেষ্টা করেছে। ভিনসেনজো। কম দামে টায়ার দেয়ার চেষ্টা করেছে। আব্বার সঙ্গে পারেনি, লস দেয়ার মত এত টাকা তার নেই। ছয় মাসের মধ্যেই কাবু হয়ে গেছে বেচারা।

কাজেই তার ছেলে ছদ্ম নামে চাকরি নিয়েছে এখানে, এলেনার কথার খেই ধরল রবিন। আপনার আব্বার ক্ষতি করার জন্যে। কিন্তু তার আগেই আপনার আব্বা জেনে গেছেন হোয়েরটার আসল পরিচয়। হোয়েরটা কি করে ভাবতে পারল। যে লোক অন্যের ব্যাপারে খোঁজ নেয়ার জন্যে গোয়েন্দা লাগান, তার বিরুদ্ধে সে। কিছু করতে পারবে?

হয়ত ভেবেছে তার কভার স্টোরি এত ভাল যে গোয়েন্দাকে বোকা বানিয়ে দিতে পারবে, কিশোর বলল। কীবোর্ডের সামনে বসে পড়ল। কডি হোয়েরটার ফাইলের ফুল প্রিন্ট দেয়ার জন্যে নির্দেশ দিল কমপিউটারকে। জীবন্ত হয়ে উঠল প্রিন্টার। কটকট কটকট করে আধ মিনিটের মধ্যেই বের করে দিল হোয়েরটার ফাইল। বের করে নিয়ে জোরে জোরে পড়ল কিশোর, সবাইকে শোনানোর জন্যে।

চাকরির দরখাস্তে যে ঠিকানা আর ফোন নম্বর ব্যবহার করেছে হোয়েরটা, সেটা তার হাই স্কুলের এক বন্ধুর। রুটিন চেক করে কিছু পাওয়া যায়নি। তারপর গোয়েন্দা লাগিয়েছেন লিসটার। জেনেছেন, কাজের শেষে ওশন পার্কে ভিনসেনজোর বাড়িতে রোজ যায় হোয়েরটা। প্রতিবেশীদের কাছে খোঁজ নিয়েছে গোয়েন্দা। বীমার দালাল পরিচয় দিয়ে। সত্যি কথাগুলো জেনে এসেছে।

হ্যাঁ, মাথা দোলাল রবিন। কিডন্যাপের একটা মোটিভ দেখা যাচ্ছে। লোকটাকে দেখে কিন্তু মনে হয় না এতবড় একটা অপরাধ করতে পারে।

তা অবশ্য হয় না, একমত হল এলেনা। আর এই বিশপের বই…এটার মাখামুণ্ডু কিছুই বুঝতে পারছি না। কডি হোয়েরটা:নাহ, আমার ভাল লাগছে না!

বড় কমপিউটারের সামনে বসে পড়ল সে। চোখ বন্ধ করে কপাল টিপে ধরল। কডি একাজ করেছে একথা বিশ্বাসই করতে পারছি না। করেওনি। তাহলে। এই কমপিউটারটা নষ্ট করে দিতই, যাতে তার নাম না জানতে পারি। নাহ, সে করেনি। অন্য কারও কাজ।

মাথা ঝাঁকাল কিশোর। ও-কে। আরও কিছু ফাইল দেখা যাক। মিরহাম এনথনির ফাইলটার জন্যে নির্দেশ দিল কমপিউটারকে।

শুরুতে এনথনির ওপরও রুটিন চেক করা হয়েছে। বিয়ে করেছিল, স্ত্রী মারা গেছে। ছেলেমেয়ে নেই। সার্চন্ট এলাকার একটা বাড়িতে বাস করে। ডি. এল. ডিপার্টমেন্ট স্টোরের ম্যানেজারের পদটা নেয়ার আগে অন্য মালিকের আরেকটা স্টোরের ডিরেক্টর অভ অপারেশনের দায়িত্ব নিয়ে কাজ করেছে। লিসটারের স্টোরটা সান্তা মনিকায়।

 খানিক পরেই এনথনির ডোসিয়ার আর সাধারণ রুটিন চেকের আওতায় থাকল না। আরও গভীরে ঢুকতে লাগল। একবার গ্রেফতার হয়েছে। একটা বীমা কোম্পানিতে জালিয়াতির অভিযোগে। একটা বাড়ির মালিক ছিল সে। আগুন লেগে পুড়ে যাওয়ার পর বীমা কোম্পানি সন্দেহ করে বসল এতে এনথনির হাত রয়েছে। অ্যারেস্ট করা হলেও পরে তাকে সসম্মানে ছেড়ে দিতে বাধ্য হয় পুলিশ, কারণ কোম্পানি তার বিরুদ্ধে আনীত অভিযোগ প্রমাণ করতে পারেনি। তারপর। প্রথম স্টোরটায় চাকরি নিল এনথনি। সেখানেও তার বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ। আছে। সরাসরি কেউ কিছু বলেনি। তবে কানাঘুষা হয়েছে, কন্ট্রাকটর আর। সাপ্লাইয়ারদের কাছ থেকে ঘুষ নিত সে।

 ফাইলের শেষে দুটো শব্দে, খুব বাজে একটা মন্তব্য পেশ করা হয়েছেঃ উইমেন-চেজার। অর্থাৎ মহিলাদের পেছনে লাগার বদস্বভাব আছে।

লিটারের উকিল ডোপের ডোসিয়ারও কম মজার নয়। ডোপ ছিল একজন। জুয়াড়ি। রেসের খেলা আর পোকারে আসক্ত। স্টক মার্কেটেও বেশ বড় বড় ঝুঁকি নিয়েছে। লিসটারের সন্দেহ জরুরী কাজে খরচের জন্যে যে ফাণ্ড রাখা আছে তার কাছে সেটা থেকে সে নিজের প্রয়োজনে খরচ করে। বার অ্যাসোসিয়েশনে। যোগাযোগ করে তার অ্যাকাউন্ট চেক করানোরও হুমকি দিয়েছেন তিনি। এক হুমকিতেই কাজ হয়ে গেছে বলে লিটারের ধারণা।

ভিজালিয়া ব্যাংকের ম্যানেজারের ফাইল বলছে, ডোপ নেভিতে ছিল আগে। সেখান থেকে বের করে দেয়া হয়েছে তাকে, কি একটা অপরাধ করেছিল বলে। লিসটার যে একথা জেনেছেন, সেটা আবার জানিয়ে দিয়েছেন ম্যানেজারকে।

ফাইলের পর ফাইল দেখে চলল কিশোর। একের পর এক মজার তথ্য উঠে আসছে মনিটরের পর্দায়। মিসেস বেকারেরও একটা বড় রকমের দোষ রয়েছে। প্রতি হপ্তায়ই একটা বিশেষ জায়গায় জুয়া খেলতে যায়। নেশা হয়ে গেছে সেটা।

এসব দেখে কোন লাভ হবে না আমাদের, এলেনা বলল অবশেষে। এখানে। এমন একদল লোকের ডোসিয়ার যারা আব্বাকে দুচোখে দেখতে পারে না। ঘৃণা করে। তার কোন বন্ধু নেই। ভাবতেই খারাপ লাগছে আমার। লোকের ব্যক্তিগত জীবন ঘাটাঘাটি করেছে, এটাও ভাল্লাগছে না আমার।

কেঁদে ফেলবে যেন সে। এই একটি বার বাবার পক্ষে সাফাই গাইছে না।

কিশোরকেও স্বীকার করতে হল, এই সব গোপন ফাইল আসল কাজের কোন সাহায্য করছে না। প্রত্যেকেরই মোটিভ রয়েছে লিসটারের ক্ষতি করার। কিন্তু কোন একজন বিশেষ মানুষ বেরিয়ে আসছে না যাকে সন্দেহ করা যায়। সবাইকেই করা যায়, আবার কাউকেই করা যায় না।

 আর একটা ফাইল আছে, বলল সে। এটাও দেখার দরকার। ফাইলটার। নাম মুজের/ভিয়েজা। স্প্যানিশ এই শব্দের মানে বৃদ্ধা মহিলা।

বাহ, ভাল কথা, মুসা বলল। হয়ত মিসেস বেকারের সম্পর্কে আরও কিছু লেখা রয়েছে। তার দুর্বলতা যাতে প্রকাশ না হয় সে জন্যে মিস্টার লিসটারকে গায়েব করে দিয়েছে।

কিন্তু আবার ফেরত দেবেও বলেছে, মনে করিয়ে দিল রবিন। বিশপের বইটা দিলে। প্রতিশোধ বলতে পার। দুর্বলতা ঢাকা দেয়ার জন্যে কিডন্যাপটা করেনি।

ওদের কথা শুনছে না কিশোর। আনমনেই বলল, মিসেস বেকারের ফাইল স্প্যানিশে লেখা থাকবে কেন? চাবি টিপে ফাইলটা কল করল সে।

অন্য ফাইলের চেয়ে এটা আলাদা। একটা চিঠি। এলেনাকে লেখাঃ

সোগামোসোকে দিয়ে শুরু কর। বৃদ্ধা মহিলার কাছে যাও। মধ্যগ্রীষ্মের দিনে সূর্যাস্তের সময় তার ছায়া স্পর্শ করে ঈশ্বরের অশ্রুকে। সব তোমার জন্যে। তবে সিয়েটার ব্যাপারে সাবধান থেক। সে কি লিগাল? চেক ইনস।

চমৎকার, এতক্ষণে খুশি হল কিশোর। চিঠিটার একটা প্রিন্ট আউট বের করে দিতে নির্দেশ দিল কমপিউটারকে। কাগজের ওপর ছোটাছুটি শুরু করল প্রিন্ট হেড। এই সুযোগে এলেনার দিকে তাকাল সে। চোখে জিজ্ঞাসা।

মাথা নাড়ল এলেনা।

কিছুই বুঝতে পারছেন না? জিজ্ঞেস করল কিশোর।

একটা বর্ণও না।

সিয়েটার ব্যাপারে সাবধান থাকতে বলা হয়েছে। বলেই সরাসরি এলেনার চোখের দিকে তাকাল কিশোর। তাকে চেনেন?

 শ্রাগ করল এলেনা। আব্বার আরেক ফেরেশতা হবে হয়ত। কর্মচারী। ব্যবসার সহযোগীও হতে পারে। পার্টিতে কোন সিয়েটাকে আসতে দেখিনি। মারাত্মক কিছু শত্রুকে মনে হচ্ছে দাওয়াত থেকে বাদই দিয়েছিল আব্বা।

কাঁদতে শুরু করল এলেনা। গাল বেয়ে গড়িয়ে পড়ল পানি। মোছার চেষ্টা করল না সে।

 ঠিক আছে, কিশোর বলল। আর কোথাও কোন সূত্র আছে কিনা দেখা দরকার।

টেবিলের ড্রয়ার ঘাটতে শুরু করল সে। রবিনও তাকে সাহায্য করল। একটা ছোট নোটবুক পেয়ে তুলে, দেখাল। অ্যাড্রেস বুক। অনেক ঠিকানা আছে। হাতে লেখা।

প্রতিটি পৃষ্ঠার প্রতিটা ঠিকানা খুঁটিয়ে দেখা হল, কিন্তু কোন সিয়েটাকে পাওয়া গেল না।

আম্মা হয়ত জানতে পারে, এলেনা বলল। সামলে নিয়েছে। ইদানীং আর আব্বার সঙ্গে দেখা হয় না তার, কথাও হয় না। তবে অনেক পুরনো কেউ হতে পারে, একসাথে যখন ছিল দুজনে তখনকার কোন সিয়েটা থাকতেও পারে।

ফোন করে জিজ্ঞেস করবেন? মুসা জানতে চাইল।

ইয়ে…তাতেও সমস্যা আছে। আম্মা রেগে আছে আমার ওপর। এখানে। আসাটা একদম পছন্দ নয় তার। আমার হবু বরকেও দেখতে পারে না।…যাই হোক, চেষ্টা করে দেখি।

রিসিভার তুলে নিয়ে ডায়াল করল এলেনা। ওপাশের কথা শুনে কানের কাছ থেকে সরিয়ে এনে বলল, ঘরে নেই। জবাব দিচ্ছে অ্যানসারিং মেশিন। রিসিভারে কিচকিচ শুনে তাড়াতাড়ি আবার কানে ঠেকাল সে। কে? আম্মা? কোথায় গিয়েছিলে? আমি। আম্মা, শান, আব্বাকে মনে হয় কিডন্যাপ করা হয়েছে। তিনটে ছেলে আমাকে সাহায্য করার চেষ্টা করছে। ওরা তিন গোয়েন্দা, কিশোর পাশা, মুসা আমান আর রবিন মিলফোর্ড। তোমার সঙ্গে দেখা করতে চায়। কথা বলবে?…আচ্ছা।…কিছু জানা থাকলে ওদেরকে বলে দিও। আমি চলে আসতাম তোমার কাছে, কিন্তু আব্বা বাড়িতে নেই। খালি ফেলে যেতেও পারছি না। আব্বার ব্যাপারটা ফয়সালা হলেই চলে আসব।

মাকে গুড বাই জানিয়ে রিসিভার নামিয়ে রাখল এলেনা। যেতে পার। আমার আম্মা খুব ভাল। সবাইকেই সাধ্যমত সাহায্য করে।

যতগুলো প্রিন্ট আউট বের করেছে, সব একখানে করল কিশোর। মায়ের ঠিকানা লিখে দিল এলেনা। সংক্ষিপ্ত আলোচনার পর ঠিক হল, মুসা থাকবে এ বাড়িতে। বাকি দিনটা। রাতটাও। মিসেস বেকার রাতে থাকে না, বাড়ি চলে যায়। তার স্বামী আছে। রবিন বাড়িতে যাবে, কিছু জরুরী কাজ আছে। সেখান থেকে মিউজিকের অফিসে গিয়ে টু মেরে দেখে আসবে একবার কি পরিস্থিতি। রকি বীচ লাইব্রেরিতে যাবে। অনেক দিন যায় না ওখানে। অথচ কত বছর কাজ করেছে। সময় পেয়েছে যখন লাইব্রেরিয়ানের সঙ্গে দেখা করে আসবে। আরও মা একটা কারণ আছে লাইব্রেরিতে যাওয়ার। রেফারেন্স বইতে সোগামোসো খুজবে।

সিয়েটার রেফারেন্স খোঁজার বোধহয় কোন প্রয়োজন নেই, কিশোরকে বলল সে। লস অ্যাঞ্জেলেসের ফোন বুকে ওই নামের অভাব নেই। তবে সোগামোসোটা সাধারণ নাম নয়। এই রহস্য ভেদের শুরু এটা দিয়েও হতে পারে।

কোন লোকের নাম না-ও হতে পারে এটা, কিশোর বলল। কোন জায়গা। কিংবা কোম্পানির নাম হলে অবাক হব না।

কিশোর যাবে এলেনার মায়ের সঙ্গে দেখা করতে। এলেনা আর বন্ধুদের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে রওনা হল সে। সাইকেল নিয়ে চলল সান্তা মনিকায়। এই আরেকবার আফসোস হতে লাগল একটা গাড়ি নেই বলে। ভাল জিনিস ছাড়া তার মন ভরে না। আর ভাল কিনতে হলে নতুন দরকার। এত টাকা নেই। পুরনো ভাল জিনিস কে খুঁজে দেবে? মুসা তো কথা কানেই তোলে না। নিকভাইটারও দেখা নেই…

নির্জন একটা রাস্তার ধারে ভদ্রমহিলার বাড়ি। একতলা। লিসটারের বাড়ির ঠিক উল্টো। নতুন রং করা। ঝকঝকে তকতকে। সুন্দর বাগান। সবুজ লন। পায়ে চলা যে পথটা চলে গেছে বাড়ির দরজায়, সেটাতে একটা কুটোও, পড়ে নেই। দিনে অনেকবার করে ঝাট দেয়া হয়, বোঝা যায়।

ঘন্টা বাজাতেই খুলে দিলেন, এলেনার মা। সুন্দর চেহারা। কফি রঙের চুল। একই রঙের চোখ। মোটাই বলতে হবে তাকে। তবে চামড়া বেশ মসৃণ, কোথাও একটা ভাজ নেই। ডেভিড লিসটারের চেয়ে বয়স অনেক কম।

 তুমি নিশ্চয় তিন গোয়েন্দার একজন, বললেন তিনি। বেরোতে হবে। বেশি। সময় দিতে পারব না, তোমাকে। এসো।

হলঘরের ভেতর দিয়ে কিশোরকে লিভিং রুমে নিয়ে এলেন মহিলা। নরম সবুজ কার্পেট। সোফা আর অন্যান্য আসবাবপত্রের কভার শাদা মখমলের তৈরি।

 ফায়ারপ্লেসের কাছে বড় একটা চেয়ারে বসলেন ভদ্রমহিলা। কিশোর বসল। সোফায়। এলেনা ভাল আছে? জিজ্ঞেস করলেন তিনি। সত্যি বল তো, ও আসছে না কেন?

ফোন করে খবর জানতে চাইতে পারে কিডন্যাপার, জবাব দিল কিশোর। সে জন্যে রয়ে গেছে।

আমারও ওখানে যাওয়া উচিত, কিন্তু ভাল লাগে না। ওই বাড়িটাকে দেখলেই রাগ হয় আমার, ঘৃণা করি। ওখানে ঢোকার পর থেকে অশান্তি শুরু হল। আমাদের। তার আগে ভালই ছিলাম।…এলেনা কি একা রয়েছে?

না। আমার বন্ধু মুসা রয়েছে তার সঙ্গে।

 তোমার বন্ধু? নিশ্চয় তোমারই বয়েসী। পুলিশ কোথায়? এরকম। পরিস্থিতিতে ওদেরকে দরকার। একটা ছেলে আর কতটা সাহায্য করতে পারবে। এলেনাকে।

বয়েস অল্প, কিন্তু কোন বয়স্ক লোকের চেয়ে কম নয় মুসা। কারাত জানে। গুলি চালাতে পারে। দুচারজনকে খালি হাতেই পিটিয়ে তক্তা করে দিতে পারে। পুলিশকে খবর দিতে মানা করেছে কিডন্যাপার। হুঁশিয়ার করে দিয়েছে তাহলে মিস্টার লিসটারের ক্ষতি করবে। বিশপের বইটা দিলেই তাকে ছেড়ে দেবে। বলেছে।

বিশপের বই? সামনে ঝুঁকলেন ভদ্রমহিলা। কিশোরের মনে হল অন্যমনস্ক হয়ে গেছেন তিনি। যেন কোন শব্দ শুনে কান খাড়া করেছেন। অপেক্ষা করছেন আবার শোনার আশায়।

কিশোরও কান পাতল। কিছুই শুনল না। বাড়িটা বেশি নীরব।

বিশপের বই সম্পর্কে কিছু জানেন আপনি?

মাথা নাড়লেন ভদ্র মহিলা। না। কিছুই জানি না। আজকাল ডেভিড কি করছে না করছে কোন খোঁজই রাখি না আমি। এ জন্যেই কি দেখা করতে এসেছ? বইয়ের ব্যাপারে খোঁজ নিতে? হাজার হাজার বই আছে ডেভিডের। ওগুলো দেখেছ?

দেখেছি। কিডন্যাপার যেটা খুঁজছে সেটা পাইনি। আপনি সিয়েটা নামে কাউকে চেনেন? আর সোগামোসো?

সোগা-কি?

 ফোঁস করে নিঃশ্বাস ফেলল কিশোর।

আমি খুব একটা সাহায্য করতে পারছি না, তাই না? বললেন ভদ্রমহিলা। সরি। জানলে অবশ্যই বলতাম। আবার বল তো নামটা। সিয়েটা বাদে আরেকটার কথা যেটা বললে?

সোগামোসো।

মাথা নাড়লেন তিনি। সরি।

মিস্টার লিসটারকে কি কখনও বৃদ্ধা মহিলার কথা বলতে শুনেছেন? স্প্যানিশে ওটার মানে মুজের ভিয়েজা।

 বলতে পারলেন না তিনি। ঈশ্বরের অশ্রুর কথাও তিনি কিছু জানেন না। দ্রুত জবাব সারছেন। কিশোর চলে গেলেই খুশি হন।

ঈশ্বরের অশ্রু বেশ কাব্য করে বলা হয়েছে, বললেন তিনি। কিন্তু ডেভিড। কবিতা নিয়ে মাথা ঘামায় না। সরি, আমি কিছুই বলতে পারব না। আইলিন লিসটারে খোঁজ নিয়েছ? অনেক সময় ওখানে জিনিস রাখে ডেভিড।

আইলিন লিসটার?

ওর ইয়টের নাম। আমার আর ডেভিডের নামে জাহাজটার নাম রেখেছে ও। ওটা কেনার সময় সম্পর্ক ভালোই ছিল আমাদের।

উঠে দাঁড়ালেন ভদ্রমহিলা। যেতে হবে এবার, সে কথা আর মুখ ফুটে বলতে হল না কিশোরকে। সে-ও উঠল। মহিলার পিছু পিছু চলে এল দরজার কাছে। তিন গোয়েন্দার একটা কার্ড ধরিয়ে দিয়ে বলল, যদি কিছু মনে পড়ে আপনার, আমাদের তদন্তে সাহায্য হবে ভাবেন, তাহলে দয়া করে এই নাম্বারে ফোন করবেন।

করবেন, বললেন তিনি। বেরিয়ে এল কিশোর।

মোড়ের কাছে এসে থামতে হল তাকে। একটা বাসকে সরে যাওয়ার সুযোগ দেয়ার জন্যে। পেছন ফিরে তাকাল একবার, এলেনার মায়ের বাড়ির দিকে।

গাঁট্টাগোট্টা একজন লোক বেরিয়ে আসছে পায়েচলা পথ ধরে বড় রাস্তার দিকে। লোকটাকে আগে দেখেছে কিশোর। লিসটারের বাড়িতে। এলেনার পার্টির একজন মেহমান ছিল ওই লোক।

এনথনি! বিড়বিড় করল বিস্মিত কিশোর।

লিসটারকে সরিয়ে দেয়ার যথেষ্ট মোটিভ রয়েছে লোকটার। ও বাড়িতে কি করছে সে? কিশোর যখন মহিলার সঙ্গে কথা বলছিল তখন নিশ্চয় সে বাড়িতে ছিল ও। দুজনের কথা নিশ্চয় শুনেছে। কল্পনায় দেখতে পেল কিশোর, রান্নাঘরে ঝুঁকে রয়েছে লোকটা, দরজায় কান পেতে।

এ কারণেই উত্তেজিত হয়ে ছিলেন ভদ্রমহিলা। বার বার অন্যমনস্ক হয়ে যাচ্ছিলেন। তাড়াহুড়া করে বের করে দিতে চেয়েছিলেন কিশোরকে। বাইরে যাওয়ার কথা নয় তার। ঘরে লোক রেখে বাইরে যাওয়ার প্রশ্নই ওঠে না।

ব্যাপারটা কি? এলেনার মা আর এনথনি মিলে ষড়যন্ত্র করেছে? মহিলার চেহারা দেখে মনেই হয় না এরকম একটা অপরাধ করতে পারেন। তবে বলা যায় না কিছুই। অপরাধ জগৎ এমনই একটা জগৎ, যেখানে যা খুশি ঘটতে পারে। চেহারা কোন ব্যাপার নয়। যেটা অসম্ভব বলে মনে হয়, সেটাই ঘটে যেতে পারে।

রাস্তা পেরোল এনথনি। কিছুদূরে পার্ক করে রাখা একটা গাড়িতে গিয়ে উঠল। জ্বলে উঠল ব্রেক লাইট। একজস্ট পাইপ থেকে এক ঝলক ধোয়া বেরোল। চলতে শুরু করল গাড়িটা।

 সাইকেল ঘোরাল কিশোর। পিছু নিল গাড়িটার। দুশো গজ পেছনে থেকে অনুসরণ করে চলল। পায়ের সমস্ত শক্তি দিয়ে প্যাডাল করছে, যতোটা জোরে সম্ভব ঘোরাতে চাইছে চাকা।

<

Super User