বোম্বেটে – তিন গোয়েন্দা – রকিব হাসান – সেবা প্রকাশনী
প্রথম প্রকাশঃ অক্টোবর, ১৯৮৯

ক্যারোলিন! চিৎকার করতে করতে সিঁড়ি বেয়ে উঠে এলেন জিনার বাবা মিস্টার পারকার। এই, ক্যারোলিন, কোথায় তুমি?

এই যে, এখানে, বেডরুম থেকে বেরিয়ে এলেন জিনার মা। ঘর সাফ করছি। …কি হলো, এতো চেঁচাচ্ছো কেন?

এই দেখো না, টেলিগ্রাম, বললেন মিস্টার পারকার। প্রফেসর কারসওয়েল। চিনেছো?

কয়েক বছর আগে যে এসেছিলো? খালি খাওয়ার কথা ভুলে যেতো, সেই লোকটা তো? স্বামীর কোটের হাতায় লেগে থাকা ময়লা ঝেড়ে দিলেন মিসেস পারকার।

ওভাবে ঝাড়ছো কেন? ভুরু কোঁচকালেন মিস্টার পারকার। আমি কি ময়লার ডিপো নাকি?…শোনো, আজ আসছে। এক হপ্তা থাকবে।

চমকে উঠলেন মিসেস পারকার। কিন্তু জিনারাও তো আসছে আজ! তুমি জানো।

অ্যাঁ, তাই তো…ভুলে গিয়েছিলাম। থাক, জিনাকে ফোন করে দাও, আগামী হপ্তায় আসতে বলো। জিনার সঙ্গে আবার কিশোর, মুসা আর রবিনও তো আসবে। না, এ-হপ্তায় ওদের আসা চলবে না। প্রফেসরের সঙ্গে আমি শান্তিতে কাজ করতে চাই। নতুন একটা আবিষ্কারের ব্যাপারে..আরে, ওভাবে তাকিয়ে আছো কেন?

তোমাদের পাগলামির জন্যে ছেলেমেয়েদের আনন্দ আমি নষ্ট করতে পারবো। ওরা আজই আসবে। হয়তো এতোক্ষণে রওনা হয়ে গেছে…এক কাজ করো। তোমার বন্ধুকেই মানা করে দাও, যেন পরে আসে।

বেশ, অনিচ্ছা সত্ত্বেও রাজি হলেন মিস্টার পারকার। গৃহিণীকে চটিয়ে দিয়ে পারিবারিক অশান্তি আর অসুবিধে সৃষ্টি করতে চান না। তবে, প্রফেসর খুব মাইণ্ড করবে। বন্ধুকে ফোন করার জন্যে চলে গেলেন তিনি।

বেডরুমে আবার ফিরে এলেন মিসেস পারকার। তাঁকে সাহায্য করার জন্যে একজন কাজের লোক রেখেছেন, তাঁরই বয়েসী এক মহিলা, নাম আইলিন।

সব চেয়ে বেশি অসুবিধে হবে থাকার, বললেন মিসেস পারকার।

ঘর থেকে সবই শুনেছে আইলিন। ঝুল পরিষ্কার করতে করতে মাথা নাড়লো।

ওই যে, আবার ডাকছে। তুমি কাজ করো, আমি শুনে আসি, আবার ঘর থেকে বেরোলেন জিনার মা।

স্টাডি থেকে ডাকছেন মিস্টার পারকার। সে-ঘরে ঢুকলেন জিনার মা। আবার কি হয়েছে?

এই দেখো না, কি কাণ্ড, রিসিভারটা ধরে রেখেছেন মিস্টার পারকার। প্রফেসর নাকি অনেক আগেই রওনা হয়ে গেছে। প্লেনে করে। ইংল্যাণ্ড থেকে আসতে আর কতো সময় লাগবে? আজই পৌঁছে যাবে..আর হ্যাঁ, সঙ্গে তার ছেলেকে নিয়ে আসছে!

তার ছেলে! সত্যি! আমি ওদের জায়গা দেবো কোথায়?

আর তো কোনো উপায় নেই। জিনাকেই ফোন করো। বুঝিয়ে বলো, আগামী হপ্তায় যেন আসে। নাও, ধরো, রিসিভার বাড়িয়ে দিলেন মিস্টার পারকার।

ডায়াল করলেন মিসেস পারকার। হ্যাল্লো। কে?..মিসেস পাশা?… কিশোর কোথায়?.রওনা হয়ে গেছে? কখন?..না না, এমনি। ওরা আসছে কিনা জানার জন্যে. হ্যাঁ। রাখি। গুড বাই। রিসিভার নামিয়ে রাখলেন জিনার মা। জোরে নিঃশ্বাস ফেলে বললেন, রওনা হয়ে গেছে, সকালে। যে কোনো সময় এসে পড়বে। আমি এখন কি যে করি!…তোমাকে নিয়ে আর পারি না। খালি কথা ভল যাও। আর তোমার প্রফেসর বন্ধুও…

আমি কি করবো? রেগে গেলেন বদমেজাজী বিজ্ঞানী। আমি চিঠি দিয়েছি আসার জন্যে, আসছে। টেলিগ্রাম পেলাম আজ…

সেজন্যেই তো বলছি, খালি ভুলে যাও। তুমি তো জানো, ছেলেমেয়েগুলো আজ আসবে, তারপরেও চিঠি লিখতে গেলে কেন? আর লিখলেই যখনু, আগামী হপ্তায় আসতে বললে কি হতো? আসুক, আমি কিছু জানি না। থাকার ব্যবস্থা ভুমি। করবে। আর না পারলে নিজে গিয়ে শুয়ো কয়লা রাখার ঘরে…

ওসব আমি জানি না, কড়া গলায় বললেন মিস্টার পারকার। আইলিন আছে। দুজনে মিলে একটা কিছু ব্যবস্থা করো গিয়ে। আমার অনেক কাজ। এই কাজগুলো, টেবিলে রাখা কাগজের উঁচু একটা স্থূপ দেখালেন তিনি। সব পড়ে শেষ করতে হবে…যাও এখন। আমার মেজাজ খারাপ হয়ে যাচ্ছে…

তোমার যাচ্ছে! আর আমার হয়ে গেছে। আমি বলে দিচ্ছি…জানালার দিকে চোখ পড়তে হঠাৎ থেমে গেলেন মিসেস পারকার। আরি, দেখো দেখো!  

দেখে মিস্টার পারকারও অবাক হলেন। বানর! ওটা এলো কোত্থেকে?

নিচতলা থেকে আইলিনের ডাক শোনা গেল। ম্যাডাম, দেখে যান…বোধহয় আপনাদের মেহমান… বানরটার দিকে হাঁ করে চেয়ে আছেন মিসেস পারকার। জানালার কাছে নাক ঘষছে ছোট্ট জীবটা, হাস্যকর শিশুসুলভ ভাবভঙ্গি। নিশ্চয়। তোমার বন্ধু! গুঙিয়ে উঠলেন তিনি। বানরটাও কি ওদের নাকি? দুম দুম করে কিল পড়লো সদর দরজায়, সারা বাড়ি কেঁপে উঠলো।

তাড়াতাড়ি নিচের তলায় ছুটে এলেন দুজনে।

হ্যাঁ, প্রফেসর কারসওয়েলই এসেছেন। সঙ্গে তাঁর ছেলে। বয়েস নয়-দশের বেশি না। বানরটা এখন বসে রয়েছে ছেলেটার কাঁধে, কখন কিভাবে নেমে এসেছে কে জানে। বানর আর তার মনিবের চেহারায় খুব একটা অমিল নেই।

এয়ারপোর্ট থেকে ট্যাক্সি নিয়ে এসেছেন প্রফেসর। ড্রাইভারের দিকে চেয়ে। বাজখাই গলায় হাঁকলেন, এই, বসে আছো কেন? ব্যাগট্যাগগুলো নামাও। হাঁ। করে কি দেখছো? মিসেস পারকারের দিকে ফিরলেন। এই যে, ম্যাডাম, ভালো। আছেন? আবার এলাম আপনাকে জ্বালাতে।…তা আপনার স্বামী কোথায়? বলতে বলতে ভেতরে ঢুকলেন তিনি। এই যে, হ্যারি। অনেক ইন্টারেস্টিং নিউজ আছে।

 এগিয়ে এসে হাত মেলালেন মিস্টার পারকার। আমার কাছেও আছে। চিঠি। পেয়েই চলে এসেছো, খুব খুশি হয়েছি।

এই যে আমার ছেলে… এতো জোরে ছেলের পিঠে থাবা মারলেন প্রফেসর, আরেকটু হলেই হুমড়ি খেয়ে পড়ে যাচ্ছিলো ছেলেটা। নামটা যেন কি? খালি ভুলে যাই। থাক, বিরক্ত হয়ে হাত নাড়লেন কারসওয়েল। ডাক নামটাই বলি। টকার। মোটরকারের মা আর ট-এর পরে র-টা বাদ দিয়ে দিয়েছি। নিজেকে সারাক্ষণ মোটর গাড়ি ভাবে সে, আর বেশি কথা বলে, সে-জন্যেই এই নাম রেখেছি। হাহ হাহ হা!…আরে, নটি গেল কোথায়? দুষ্ট, দুষ্ট, ভীষণ দুষ্ট, তাই। টকারই ওর নাম রেখেছে টি। আরে গেল কোথায় বানরটা?

 বোবা হয়ে গেছেন যেন মিসেস পারকার। একনাগাড়ে কথা বলে চলেছেন। প্রফেসর কারসওয়েল। কাউকে কিছু বলার সুযোগ দিচ্ছেন না। বানরটাকে দেখা গেল একটা স্ট্যাণ্ডের উপর হ্যাট রাখার স্ট্যাণ্ড–আগায় চড়ে বসে প্রাণপণে দোলাচ্ছে; যেন প্রতিজ্ঞা করেছে সবগুলো হ্যাট মাটিতে না ফেলে ছাড়বে না।

এ-তো সার্কাস বানিয়ে ফেলবে!..হতাশ হয়ে ভাবলেন মিসেস পারকার– আমি এখন কি যে করি! ঘরগুলোও পরিষ্কার হয়নি ঠিকমতো। দুপুরের খাবারেরই বা কি হবে? ইতিমধ্যে ছেলেমেয়েগুলোও যদি এসে যায়…আর বানরটা যা শুরু করেছে! হ্যাটগুলো ফেলে এখন গিয়ে বসেছে হলের বড় আয়নাটার সামনে। নিজেকেই মুখ ভেঙচাচ্ছে।

সবার সঙ্গে কিভাবে যে লিভিংরুমে ঢুকলেন মিসেস পারকার, বলতে পারবেন, না মিস্টার পারকার ছুটে গিয়ে স্টাডি থেকে একগাদা কাগজ এনে টেবিলে বিছিয়ে বসে পড়লেন ওখানেই। আলোচনার জন্যে। এক মুহূর্ত সময় নষ্ট করতে চান না।

এখানে নয়! এতোক্ষণে মুখ খুললেন মিসেস পারকার, কঠিন কণ্ঠে বললেন, তোমার স্টাডিতে যাও।…আইলিন, প্রফেসর সাহেবের মালপত্রগুলো গেস্টরুমে। দিয়ে এসো। ছেলেটা এঘরেই থাকবে, সোফায় শোয়ার ব্যবস্থা করতে হবে। যাও, জলদি রেখে এসো।

বানরটার কি হবে? আড়চোখে ওটার দিকে চেয়ে জিজ্ঞেস করলো আইলিন। ওটারও কি বিছানা…

ও আমার সঙ্গেই থাকবে, বয়েস আর শরীরের তুলনায় অস্বাভাবিক জোরালো কণ্ঠ ছেলেটার। হঠাৎ লাফিয়ে উঠে সিঁড়ির দিকে দিলো দৌড়। বিচিত্র শব্দ করছে।

অবাক হয়ে বললেন মিসেস পারকার, কি হলো? পেট ব্যথা?

 না না, বললেন তার বাবা। ওসব কিছু না। বললাম না, মোটরগাড়ির পাগল। নিজেকে মোটরগাড়ি ভাবে। দৌড়ায় আর এঞ্জিনের শব্দ করে।

আমি একটা গাড়ি, জাগুয়ার কার। সিঁড়ির মাথা থেকে চেঁচিয়ে জবাব দিলো। টকার। এঞ্জিনের শব্দ শুনছেন না? হি-র-র-র-র-র!…এই নটি, জলদি আয়। গাড়িতে চড়বি না?

প্রায় চোখের পলকে সিঁড়ি পেরিয়ে লাফ দিয়ে গিয়ে মনিবের কাঁধে চড়ে চুল খামচে ধরলো নটি। তীক্ষ্ণ কিচমিচ করে উঠলো। ছুটলো জাগুয়ার। প্রচণ্ড গতিতে বেডরুমের ভেতর থেকে ঘুরে এলো একবার, মাঝে মাঝে বিকট শব্দে হর্ন দিচ্ছে।

সব সময় ওরকম করে? প্রফেসরের দিকে চেয়ে বললেন মিসেস পারকার। কাজ করেন কিভাবে?

না, অসুবিধে হয় না, জানালেন প্রফেসর। বাগানে একটা সাউণ্ডপ্রফ ঘর বানিয়ে নিয়েছি। হ্যারি, তোমার স্টাডিও সাউণ্ড প্রুফ, না?

 না, ভাই, জাগুয়ারের শব্দ সইতে না পেরে কানে আঙুল দিলেন মিস্টার পারকার। ছেলে একখান কারসওয়েলের! দুই মিনিটে পাগল করে দেবে সুস্থ মানুষকে! এক হপ্তা কাটবে কি করে? তাড়াতাড়ি উঠে দাঁড়িয়ে বললেন, চলো, স্টাডিতে চলো।

স্টাডিতে ঢুকে দরজা বন্ধ করে দিলেন দুই বিজ্ঞানী। কিন্তু বৃথা। এ-বাড়ির এমন কোনো দরজা নেই, যা ওই হর্নের শব্দ ঠেকাতে পারে।

 ব্যাগ-সুটকেস নিয়ে কুলাতে পারছে না আইলিন। সারা বছরের জন্যে যেন চলে এসেছেন প্রফেসর, এতো মালপত্র এনেছেন। কোনো হোটেলে গিয়ে উঠলো না কেন?–সেগুলোর দিকে চেয়ে থেকে ভাবছেন মিসেস পারকার। জিনারাও এলো বলে। আর সঙ্গে রাফিয়ানকে না নিয়ে আসবে না জিনা। এতগুলো প্রাণী থাকার জায়গা কোথায় করবেন তিনি?

.

০২.

বাস থেকে নেমেই চারটে সাইকেল ভাড়া করলো জিনা। এক হপ্তা থাকবে। বাড়িতে। ততোদিন ঘোরাঘুরির জন্যে সাইকেল দরকার। ক্যারিয়ারে মালপত্র তুলে নিয়ে সাইকেলে চেপে গোবেল ভিলার উদ্দেশে চললো চারজনে। পাশে পাশে। দৌড়ে চললো রাফিয়ান।

দারুণ হবে, না! প্যাড়াল ঘোরাতে ঘোরাতে বললো মুসা। দোতলার জানালা দিয়ে সাগরের দিকে চেয়ে থাকা, খোলা সাগর, খোলা আকাশ! জিনা, এবারও কি তোমার দ্বীপে পিকনিক করতে যাবে?

দেখি, বললো জিনা। এখন গিয়ে বোধহয় সুবিধে হবে না, বৃষ্টির দিন তো। যখন তখন নামবে, দ্বীপে আরাম পাবো না।

বাড়িতেই বা মন্দ কি? রবিন বললো। আর ক্যারোলিন আন্টিও যা ভালো …বেশি হৈ-চৈ করবো না আমরা, আংকেলকে ডিস্টার্ব না করলেই হবে। তাহলেই আর চটবেন না।

আমার মনে হয় না বাবার হাতে এখন কোনো জরুরী কাজ আছে, বললো জিনা।

থাকতেও পারে, বললো কিশোর। চুপচাপ বসে থাকতে হলেই মরেছি। কিছু একটা কাজ না পেলে শুধু সাগর আর আকাশ দেখে কি করে কাটাবো?

 কি কাজের কথা বলছে কিশোর, বুঝতে পারলো অন্য তিনজন। রহস্য কিংবা অ্যাডভেঞ্চার। কিশোর পাশার নেশা।

এগিয়ে চলেছে ওরা।

একপাশে সাগর, ঘন নীল একটা বিশাল আয়না যেন, চকচক করছে উজ্জ্বল রোদে।

সত্যি তুমি লাকি, জিনা, সেদিকে চেয়ে মুসা বললো। এতো সুন্দর জায়গায় বাড়ি…

হাসলো শুধু জিনা।

ওই যে, তোমাদের বাড়ির চিমনি, কিছুক্ষণ পর আবার বললো মুসা। ধোয়া উড়ছে! নিশ্চয় রান্নাঘরের। আমরা এতোগুলো মানুষ যাচ্ছি, দুপুরের রান্না চড়িয়েছেন ক্যারোলিন আন্টি…আহ, মনে হচ্ছে এখান থেকেই সুগন্ধ পাচ্ছি!

গতি বাড়িয়ে দিলো সে।

তার কাণ্ড দেখে হেসে উঠলো সবাই।

গোবেল ভিলার পেছনের গেটে এসে সাইকেল থেকে নামলো চারজন। গ্যারেজের পাশের ছাউনিতে নিয়ে গিয়ে রাখলো সাইকেলগুলো। তারপর চিৎকার করতে করতে দৌড় দিলো জিনা, মা, মাআ, আমরা এসে গেছি! কোথায় তুমি? মা?

পাশে ছুটছে তিন গোয়েন্দা।

হঠাৎ খপ করে জিনার হাত চেপে ধরলো রবিন। জিনা, দেখো! ওই যে, জানালায়!

আরে, বানর এলো কোত্থেকে!…এই এই, রাফি, যাবি না! খবরদার!…আয়, আয় বলছি!

কিন্তু রাফিয়ানকে থামানো গেল না। জানালার কাঁচে নাক ঠেকিয়ে রাখা ছোট্ট জীবটাকে চিনতে পারছে না কুকুরটা। ওটা কি ছোট কোনো কুকুর? নাকি অদ্ভুত কোনো বেড়াল? যা-ই হোক, তাড়াবে ওটাকে, বাড়িছাড়া করে ছাড়বে। গলা। ফাটিয়ে ঘেউ ঘেউ করে দরজার দিকে দৌড় দিলো সে। বেরিয়ে আসছিলো টকার, বিশাল কুকুরের ধাক্কা খেয়ে উল্টে পড়ে গেল। আতঙ্কিত হয়ে বানরটা লাফ দিয়ে। গিয়ে ধরলো দেয়ালে ঝোলানো একটা ছবির ফ্রেম, কিনার ধরে ঝুলে রইলো।

এই কুত্তা! হাঁচড়ে-পাঁচড়ে উঠে দাঁড়ালো টকার। আমার নটিকে বি না! খবরদার বলে দিচ্ছি! বলেই ঠাস করে এক চড় মারলো রাফিয়ানের নাকেমুখে।

ছুটে গিয়ে দ্বিগুণ জোরে ছেলেটার গালে চড় মারলো জিনা। চেঁচিয়ে বললো, শয়তান ছেলে কোথাকার! এত্তোবড় সাহস! আমার রাফির গায়ে হাত দিস! ওটা কি, ওই বাঁদরটা?

মনিবের দুরবস্থা দেখে আরও ঘাবড়ে গেল বানরটা। ছবি ধরে ঝুলে থেকে বিচিত্র কিচির মিচির জুড়ে দিলো। হট্টগোল শুনে দোতলা থেকে নেমে এলো আইলিন। জিনা কিংবা তিন গোয়েন্দাকে আগে দেখেনি সে, তবে বলে দিতে হলো না ওরা কারা। চিনতে পারলো। বললো, কি হয়েছে, জিনা? বানরটা কি করেছে?…আরে এই রাফি, থাম! বাড়ি মাথায় করে ফেলেছিস তো! এই ছেলে, তুমি কাঁদছো কেন? তোমার বানরকে খেয়ে ফেলছে নাকি?

কে বললো কাঁদছি? তেজের সঙ্গে জবাব দিলো টকার। দুহাতে চোখ ডলছে। নটি, নেমে আয়। আয় বলছি.. হারামজাদা কুত্তা খালি ছুঁয়ে দেখুক না তোকে…

 না না, কিছু করবে না, এগিয়ে এসে অভয় দিয়ে বললো কিশোর। তুমি তোমার বানরটাকে নামাও। ছবিটা ফেলে দেবে তো।

জিভ টাকরায় লাগিয়ে চুকচুক করে ডাকলো টকার। ছবি ছেড়ে দিয়ে তার কাঁধে লাফিয়ে নামলো নটি। গলা জড়িয়ে ধরে কুকুরটার দিকে চেয়ে কিচমিচ করে। উঠলো। ভয় যাচ্ছে না।

এই রাফি, ধমক দিলো মুসা। ওটা তোর সমান হলো নাকি? থাম।

ওকে ধমকাচ্ছো কেন? জিনার চোখে আগুন জ্বলছে। ঠিকই তো করছে ও। কে না কে এসে বাড়িতে ঢুকে বসে আছে!…এই ছেলে, কে তুমি?

বলবো না! রাগে গটমট করে বেরিয়ে গেল টকার।

আপনি নিশ্চয় আইলিন? আমি মুসা আমান। ছেলেটা কে?

মিস্টার পারকারের বন্ধু, প্রফেসর কারসওয়েলের ছেলে। আজই এসেছে। আগামী হপ্তায় আসার কথা ছিলো, আগেই এসে বসে আছে।

এখানে থাকবে নাকি? আঁতকে উঠলো জিনা। বাবার তো নেইই, মারও আক্কেল নেই! জানে না, আমরা আসছি? জায়গা দিলো কেন?

থামো, জিনা, হাত তুললো কিশোর। শান্ত হও। আগে শুনিই না সব কথা। হয়তো কোনো ভুল হয়েছে…

হ্যাঁ, ভুলই, বললো আইলিন। মিস্টার পারকার ভুলেই গেছেন, তোমরা আসছে। বন্ধুকে আসার জন্যে চিঠি লিখে দিয়েছেন। বন্ধুও চিঠি পেয়ে আর এক মুহূর্ত দেরি করেননি, এক হপ্তা আগেই চলে এসেছেন। সঙ্গে করে নিয়ে এসেছেন ছেলেকে, তার সঙ্গে আবার একটা বানর। জিনার মা তো ভীষণ দুশ্চিন্তায় পড়েছেন। এতোগুলো মানুষের থাকার জায়গা করবেন কোথায়? প্রফেসর নাহয় গেস্টরুমে থাকলেন, তাঁর ছেলে সোফায়। কিন্তু তোমরা

আমি ওসব বুঝি না, সব শুনে রাগ আরও বাড়লো জিনার। এখুনি গিয়ে মাকে বলছি…

পাগলামি করো না, জিনা, বিরক্ত হয়ে বললো কিশোর। ব্যবস্থা একটা হবেই। তোমার রাগ সামলাও।

 হ্যাঁ, ব্যবস্থা করা হচ্ছে, বললো আইলিন। চিলেকোঠায় দুটো ম্যাট্রেস। বিছিয়ে দেবো, তোমরা তিনজন থাকতে পারবে, তিন গোয়েন্দার দিকে আঙুল নাড়লো সে। কিন্তু যা ধুলো জমেছে, সাফ করতে লাগবে একদিন…বাতাসও খুব। বেশি। ঝড় এলে আর উপায় নেই। ঠাণ্ডায়…

তাতে কিছু হবে না, হাত নেড়ে বললো কিশোর। ধুলো আমরাই সাফ করে নিতে পারবো। আর ঠাণ্ডার সময় কম্বল গায়ে দিয়ে শুয়ে থাকবো, আরামই লাগবে।

আন্টি কই? মেজাজ নিশ্চয়ই খারাপ?

হবে না? তিনি বলেই সামলে নিয়েছেন। অন্য কেউ হলে…আর প্রফেসরেরই কেমন আক্কেল? অন্যের বাড়িতে এমনভাবে ঢুকে পড়লেন, যেন তাঁর নিজের বাড়ি। মালপত্র দিয়েই, বোঝাই করে ফেলেছেন ঘর। তার ওপর আবার একটা আজব ছেলে আর বানর! আমি যখন থালাবাসন ধুই, কেমন জুলজুল করে চেয়ে থাকে ওটা, মনে হয় এসে আমার সঙ্গে সে-ও হাত লাগাতে চায়।

রান্নাঘরের দরজা খুলে বেরিয়ে এলেন জিনার মা। এই যে, এসে পড়েছে, হেসে বললেন। রাফির ডাক শুনলাম। রাফি, দেখে চমকে যাবি, একটা বানর। এসেছে।

চমকে গেছে এসেই, মুখ কালো করে বললো জিনা। মা, তুমি জানো আমরা আসছি। তার পরেও কি করে ওদের জায়গা দিলে?

আহ, জিনা, কি শুরু করলে? তাড়াতাড়ি বললো কিশোর। তুমি এমন করতে থাকলে আমরা চলেই যাবো।…আন্টি, আপনি কিছু ভাববেন না। দরকার হলে দ্বীপে গিয়ে থাকবো আমরা…

তুমি খুব ভালো ছেলে, কিশোর, হাসলেন মিসেস পারকার। অস্বস্তি দূর। হলো চেহারা থেকে। প্রফেসর না এলে কোনো অসুবিধে হতো না তোমাদের, জানোই তো। আর যেমন প্রফেসর কারসওয়েল, তেমনি তোমার আংকেল। দুজনেই এমন ভুলো মন। সারাদিন না খেয়ে থাকলেও মনে করতে পারবে না। ভাববে, হায় হায়, পেটে মোচড় দেয় কেন!

হেসে উঠলো সবাই।

 সে হঠাৎ দরজার দিকে ঘুরে ঘেউ ঘেউ শুরু করলো রাফিয়ান। আবার বানরটার গন্ধ পেয়েছে। কিচমিচ শুনে ছুটে গেল। কী, বাদরের বাচ্চা, আমাকে গাল দেয়! এতোবড় সাহস! আজ তোর একদিন কি আমার একদিন! এমনি ভাবসাব। কুকুরটার।

সিঁড়ির রেলিঙে বানরটা বসে আছে। রাফিকে দেখেই নাচতে শুরু করলো, মুখ ভেঙচাচ্ছে।

লাফ দিয়ে সিঁড়িতে উঠলো রাফিয়ান। কিন্তু বানরটাকে ধরতে পারলো না। তাতে রাগ গেল আরও বেড়ে। তারস্বরে চেঁচাতে লাগলো।

ঝটকা দিয়ে খুলে গেল স্টাডির দরজা। গটমট করে বেরিয়ে এলেন দুই প্রফেসর। রাগে চোখমুখ লাল।

কী, হয়েছে কি! চেঁচিয়ে উঠলেন মিস্টার পারকার। শান্তিতে কাজ করতে পারবো না নাকি?

না না, পারবে পারবে, বললেন বটে মিসেস পারকার, কিন্তু পরিষ্কার বুঝতে পারছেন, সারাদিনই ঘটতে থাকবে এ-ধরনের ঘটনা। বানরটাকে নতুন দেখেছে তো, সহ্য করতে পারছে না এখনও রাফি। ঠিক হয়ে যাবে সব। যাও, কাজ করোগে। দরজাটা বন্ধ করে দিও। আমি দেখবো, আর যেন গোলমাল করতে না পারে।

ঘাউ-ঘাউ করে চেঁচিয়ে বাড়ি মাথায় করছে রাফিয়ান। চোখে পড়লো প্রফেসরকে। নতুন লোক দেখে সমস্ত রাগ গিয়ে পড়লো তার ওপর। সিঁড়ি থেকে নেমে তেড়ে এলো।

এক দৌড়ে গিয়ে স্টাডিতে ঢুকে পড়লেন কারসওয়েল।

হাসি থামাতে পারলো না ছেলেরা। বিশেষ করে মুসা। হাসতে হাসতে চোখ দিয়ে পানি বেরিয়ে গেল তার।

 জিনা, কুত্তাটাকে থামা! গর্জে উঠলেন মিস্টার পারকার। নইলে দেবো বিদেয় করে! বলে আর দাঁড়ালেন না। চলে গেলেন কাজের ঘরে।

উঁহ, দেবো বিদেয় করে! পেছন থেকে মুখ ভেঙচে বললো জিনা। ভাগ্যিস তার বাবা শুনতে পাননি। মা, বাবাকে হুঁশিয়ার করে দিও। রাফি চলে গেলে আমিও যেদিকে দুচোখ যায় চলে যাবো।..আরি, বানরটার কাণ্ড দেখো! আরে ঘড়ির ওপর বসেছে তো! নষ্ট না করে দেয়!..বিদেয় করবে, বললেই হলো। কেন, রাফিকে কেন, ওই বাঁদরের বাচ্চাটাকে দেখে না?

.

০৩.

কাজে হাত দিলো তিন গোয়েন্দা। টেনেহিঁচড়ে নিয়ে গিয়ে চিলেকোঠায় তুললো দুটো পুরনো ম্যাট্রেস। ঠাণ্ডা বাতাস! কিন্তু কি করার আছে? বাইরে তাঁবুতে থাকলে ঠাণ্ডা আরও বেশি লাগবে।

গাল ফুলিয়েই রেখেছে জিনা।

ওরকম করে রাখলে শেষে আবার নামাতে পারবে না, ঠাট্টা করলো মুসা। ফুলেই থাকবে। হাসো, হাসো। তোমার মায়ের কথা একবার ভাবো? আমাদের চেয়ে তাঁর অবস্থা বহুত খারাপ। কি চিন্তায়ই না পড়েছেন!

আসলেই মিসেস পারকারের অবস্থা কাহিল। নয়জন লোকের খাবার জোগাড় করা, সহজ ব্যাপার নয়। রান্নাঘর থেকে আর বেরানোর জো নেই বেচারি আইলিনের। ছেলেমেয়েরা ঘরের কাজে সাহায্য করলো। সাইকেল নিয়ে বাজারে গেল বাজার করে আনতে।

ওই টকারটা কিছু করে না কেন? পরের দিন রাগ করে বললো জিনা।

করে না কে বললো? ওই তো করছে, হেসে বাগানের দিকে দেখালো রবিন।

বাগানময় ছুটে বেড়াচ্ছে ছেলেটা। ভীষণ শব্দ করছে।

এই টকার, চুপ করবে? ডেকে বললো জিনা। তোমার বাবার কাজে। অসুবিধে হচ্ছে…,

তুমি চুপ করো! ধমক দিয়ে বললো টকার। দেখছো না আমি এখন বেন্টলি কার হয়েছি? ভারি শক্তিশালী এঞ্জিন। আর এই দেখো, ব্রেক করলে কেমন। নিঃশব্দে থেমে যায়, একটুও ঝাঁকুনি লাগে না। আর দেখো… বলেই জোরে পোঁ পোঁ করে হর্ন বাজালো দুবার। দারুণ, তাই না?

খুলে গেল স্টাডিরুমের জানালা। দেখা গেল দুই বিজ্ঞানীর ক্রুদ্ধ মুখ।

এই টকার, কি হচ্ছে? রেগেমেগে বললেন কারসওয়েল। এতো হৈ-চৈ কিসের? চুপ করে থাকতে পারো না?

বেন্টলি গাড়ি কিছুতেই নিঃশব্দে চলতে পারে না, বোঝানোর চেষ্টা করলো। টকার। কিন্তু কিছুতেই বুঝতে চাইলেন না বোকা মানুষ দুজন। শেষে একটা মিনি-কার হওয়ার অনুমতি চাইলো সে। এই দেখো না, বাবা, কেমন আস্তে শব্দ করে, ছুটতে ছুটতে শব্দ করে দেখালো টকার। ধরতে গেলে কোনো শব্দই নেই…।

দড়াম করে বন্ধ হয়ে গেল জানালা।

দরজা খোলা পেয়ে সোজা রান্নাঘরে ঢুকে পড়লো মিনি-কার। জানালো, খুব খিদে পেয়েছে। খাবার পাওয়া যাবে কি?

গাড়িটাড়িকে খাওয়াই না আমি, জবাব দিয়ে দিলো আইলিন। এখানে পেট্রল নেই। যাও, ভাগো।

এঞ্জিনের মৃদু গুঞ্জন তুলে রান্নাঘর থেকে বেরিয়ে এলো মিনিকার, যাত্রী খুঁজতে লাগলো। জানালার চৌকাঠে বসে আছে নটি, ডাকতেই লাফ দিয়ে গিয়ে চড়ে বসলো দুপেয়ে গাড়ির কাঁধে। গাড়ির চুল খামচে ধরে রইলো, যাতে ঝাঁকুনি লাগলে, পড়ে না যায়।

সারা বাগানে চক্কর দিতে লাগলো গাড়ি। মাঝে মাঝেই তীক্ষ্ণ হর্ন বেজে ওঠে।

আজব ছেলে। আইলিনের দিকে চেয়ে বললেন মিসেস পারকার। ভালোই লাগছে ওকে। এই ঝামেলা না থাকলে বসে বসে দেখতাম আর কি করে? গাড়ির এমন পাগল…  

তার পরদিন থেকে শুরু হলো বৃষ্টি। বাইরে বেরোতে পারে না টকার। ঘরের ভতরেই গাড়ি চালাতে শুরু করলো। প্রায় পাগল করে তুললো ঘরের সবাইকে।

দেখো, বিশ বারের মাথায় আর সইতে না পেরে ধমক দিলো আইলিন। তুমি মরিস মাইনর, স্টিন, কনসাল, নাকি রোলস, কিছু শুনতে চাই না আমি। আর রান্নাঘরে ঢুকবে না, ব্যস। রোলস রয়েসের মতো গাড়ির লজ্জা করে না, রুটি চুরি করে?

রোলসের কি দোষ? প্রতিবাদ করলো টকার। পেট্রল পায় না, কিছু খেয়ে। তো বাঁচতে হবে তাকে? চলতে তো হবে? আর খালি আমাকে বকেন কেন? নটি আপেল চুরি করছে, তাকে যে কিছু বলেন না?

আবার ঢুকেছে নাকি? আঁতকে উঠে দৌড় দিলো আইলিন। বলি, দরজাটা কে খুলেছে? কে?

রাফিয়ান, নির্দ্বিধায় বলে দিলো টকার।

এই, এই শয়তান, বেরো বেরো! ভাঁড়ারে ঢুকে চেঁচাতে লাগলো আইলিন। বানরটাকে বের করে দিয়ে বেরিয়ে এলো। রাফি খোলেনি। ও খুব ভালো, তোমার বানরটার মতো চোর না।

নটিও খুব ভালো।

ভালো, না? রাফি ওকে ধরতে পারলে দেখাবে মজা। আজ যা একখান কাজ করে এসেছে নানটি। রাফি খুব রেগে আছে।

কি করেছে, নটি?

কি করেছে? রাফির বাসন থেকে হাড় চুরি করে ফেলে দিয়েছে। ঘাউ করে তেড়ে এসেছিলো রাফি। ধরতে পারেনি, তাই বেঁচে গেছে বানরটা। আরেকটু হলেই আজ লেজ হারাতে হতো। কামড়ে ছিঁড়ে নিতে রাফি।

শঙ্কিত হলো টকার। কণ্ঠস্বর নরম করে বললো, আপনারা কেউ ওকে দেখতে পারেন না। অথচ নটি কতো ভালো। দেখেন না, কেমন বেজার হয়ে বসে আছে?

এক কোণে জড়োসড়ো হয়ে বসে আছে ছোট্ট বানরটা। এক হাত মাথায় রেখে আরেক হাতে মুখ ঢেকেছে। বাদামী একটা চোখ চেয়ে রয়েছে আঙুলের ফাঁক দিয়ে, বিষণ্ণ, যেন নীরবে কাঁদছে।

আরে, আবার ন্যাকামিও জানে! হেসে ফেললো আইলিন। এই নে, একটা। বিস্কুট নে। খবরদার, আর কখনও চুরি করবি না।

চোখের পলকে বিষণ্ণতা দূর হয়ে গেল বানরটার। লাফ দিয়ে এসে ছোঁ মেরে প্রায় কেড়ে নিলো বিস্কুটটা। ছুটে গেল দরজার দিকে।

দরজা বন্ধ। এগিয়ে গিয়ে খুলে দিলো টকার। সঙ্গে সঙ্গে ভেতরে ঢুকলো রাফিয়ান। নাক উঁচু। চুলায় চড়ানো গরম স্যুপের মিষ্টি গন্ধ শুকছে।

তড়াক করে এক লাফে গিয়ে একটা চেয়ারের ওপর উঠলো নটি। ভয়ে গুঙিয়ে উঠলো। যেন বিশাল কুকুরটার কাছে মাপ চাইছে।

এক কান খাড়া করলো রাফিয়ান, নাড়লো। বানরটার ভাষা যেন বুঝতে পারছে। ফিরে তাকালো।

এক অদ্ভুত কাণ্ড করলো বানরটা। আইলিনকে সাংঘাতিক অবাক করে দিয়ে বিস্কুটটা বাড়িয়ে ধরলো রাফিয়ানের দিকে। নিচু স্বরে কিচমিচ করছে।

দীর্ঘ এক মুহূর্ত তাকিয়ে রইলো কুকুরটা। তারপর এগিয়ে গিয়ে মুখে নিলো বিস্কুটটা। দুই চিবান দিয়েই কোৎ করে গিলে ফেললো।

আশ্চর্য! আনমনে বিড়বিড় করলো আইলিন। কি বুদ্ধি! সকাল বেলা হাড় চুরি করেছে। অপরাধ করে ফেলেছে। বিস্কুট দিয়ে এখন মাপ চেয়ে নিচ্ছে।

লম্বা জিভ বের করে ঠোঁট চাটলো রাফিয়ান। তারপর হঠাৎ আগ বাড়িয়ে নটির খুদে, নাকটা চেটে দিলো। হয়ে গেল ভাব।

 নিজের চোখকে বিশ্বাস করতে পারছে না আইলিন। জিনাকে খবরটা জানানোর জন্যে দোতলায় ছুটলো।

শুনে জিনা বিশ্বাসই করতে চাইলো না। আইলিনের চাপাচাপিতে শেষে নিচে নেমে এলো।

 নটি তখন রাফিয়ানের পিঠে উঠে ঘোড়া চড়ছে। আর আনন্দে হাততালি দিয়ে চেঁচাচ্ছে টকার। আরো, আরো জোরে হাঁট, রাফি। রেসের ঘোড়ার মতো ছুটতে পারিস না…

না-আ! চিৎকার করে উঠলো জিনা। এই রাফি, থাম! বানরটাকে নামা পিঠ থেকে। গাধা হয়ে গেছিস নাকি?

পিঠ থেকে নেমে রাফিয়ানের পায়ের ফাঁকে গিয়ে ঢুকলো বানরটা। ভয়ে ভয়ে তাকালো জিনার দিকে।

রাফিয়ান বুঝতে পারলো, তার মনিব রেগে গেছে। জিনার দিকে চেয়ে বিচিত্র মুখভঙ্গি করলো, যেন হাসলো। তারপর আলতো করে চেটে দিলো বানরটার মাথা। যেন বলতে চাইছে, ভয় নেইরে! আমার মনিবকে বাইরে থেকেই ভয় লাগে। ভেতরটা ওর বড় ভালো।

চোখে পানি এসে গেল আইলিনের। তার মনে হলো, রাফিয়ানের মতো ভালো কুকুর আর দুনিয়ায় নেই। বললো, দেখলে, জিনা, কতো বড় হৃদয় ওর! বানরটার সঙ্গে দোস্তি করেছে বলে ওকে আর কিছু বোলো না।

বলবো, কে বললো আপনাকে? সত্যি সত্যি অবাক মনে হলো জিনাকে। রাফির মতো ভালো কুকুর সারা পৃথিবীতে আর একটিও নেই। এগিয়ে গিয়ে হাত। বুলিয়ে দিতে লাগলো ওটার মাথায়।

জিনার হাত চেটে দিলো রাফিয়ান। নটির দিকে তাকালো। মনের ভাব, আর ভয় নেই। এবার সবাই আমরা বন্ধু হয়ে গেলাম।

এক কোণে চুপ করে দাঁড়িয়ে আছে, টকার। জিনার ভয়ে। কিন্তু কুকুরটার মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দেখে ভয় কাটলো তার, হাসলো। এতো জোরে লরির

এঞ্জিনের মতো গর্জে উঠলো, চমকে গেল সবাই। ভেঁপু বাজালো জোরে। অর্থাৎঃ. সরো, সরো, আমি এখন ছুটতে শুরু করবো।

আরে থামো, থামো! তাড়াতাড়ি বাধা দিলো আইলিন।

চুপ, বোকা ছেলে, বললো জিনা।

হুফ! রাফিয়ান বললো।

এভাবে ভেঁপু বাজালে এখুনি এসে হাজির হবেন দুই প্রফেসর, আইলিন। বললো। এই ছেলে, শান্ত কিছু হতে পারো না? এই যেমন ধরো, সাইকেল?

কথাটা মনে ধরলো টকারের। সাইকেলের চাকার মৃদু হিসহিস আওয়াজ তুলে রান্নাঘর থেকে ছুটে হলে বেরোলো। তারপর বেল বাজালো টিংটিং করে। শব্দটা এতোই নিখুঁত আর বাস্তব মনে হলো, মিসেস পারকার ভাবলেন, কেউ বুঝি। এসেছে। কে এসেছে, দেখার জন্যে বেরিয়ে এলেন তিনি।

প্রায় একই সময়ে খুলে গেল স্টাডির দরজা। বেরিয়ে এলেন দুই বিজ্ঞানী। টকারকে ধরে ঝাঁকাতে শুরু করলেন কারসওয়েল। পকেট থেকে ছিটকে বেরিয়ে গিয়ে মেঝেতে পড়লো দুটো পেন্সিল।

চেঁচাতে লাগলো টকার। গলা ফাটিয়ে। আর তার গলার যা জোর!

চেঁচামেচি শুনে রান্নাঘর থেকে বেরিয়ে এলো জিনা। চিলেকোঠা থেকে তিন। গোয়েন্দা। আইলিনও বেরোলো, আরেকটু হলেই ধাক্কা দিয়ে ফেলে দিয়েছিলো রান্নাঘরের দরজার কাছে দাঁড়ানো মিসেস পারকারকে।

ব্যাপার দেখে আর হাসি চাপতে পারলো না জিনা। তার রাগ যেমন বেশি, হাসিও বেশি। হাসতে শুরু করলে থামতে চায় না। হো হো করে হাসছে।

 কিন্তু জিনার মতো মজা পেলেন না দুই প্রফেসর। বরং বিরক্তিতে কুঁচকে গেল ভুরু।

এই মেয়ে! রাগে জ্বলছে মিস্টার পারকারের চোখ। কি হয়েছে? এতো হাসির কি হয়েছে, শুনি? ছেলেটাকে আরও আসকারা দিচ্ছো? পেয়েছে কি? জানো না, অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটা কাজ করছি আমরা? দুনিয়ার মানুষের কতো উপকার হবে, আমরা সফল হলে! ক্যারোলিন, বের করো ওদের। আর সহ্য করবো না। যেখানে খুশি যাক। শুনেছো? যেখানে খুশি!

গটগট করে হেঁটে গিয়ে স্টাডিতে ঢুকলেন তিনি।

 টকারকে ছেড়ে কারসওয়েলও তাঁর পিছু নিলেন।

দড়াম করে বন্ধ হয়ে গেল দরজা।

.

০৪.

ঘটনার আকস্মিকতায় বোবা হয়ে গেছেন মিসেস পারকার। কি করবেন এখন? ওই বিজ্ঞানীগুলো যে কি! সারা দুনিয়ার মানুষের শান্তির জন্যে, সুখের জন্যে, ওদের চোখে ঘুম নেই, দুশ্চিন্তার অন্ত নেই, অথচ নিজের ঘরের লোকের সুখের কথা একবারও যদি ভাবে!

জিনার গোমড়া মুখের দিকে চেয়ে হাসলেন তিনি। হাত ধরে টানলেন, আয়, লিভিংরুমে। একটা ব্যবস্থা করতেই হবে। এভাবে চলতে পারে না। তোর বাবা সত্যি একটা জরুরী কাজে ব্যস্ত, এ-সময় তাকে ডিসটার্ব করা ঠিক হচ্ছে না।

ছেলেমেয়েদেরকে নিয়ে লিভিংরুমে ঢুকলেন তিনি। আইলিন সঙ্গে এলো। রাফিয়ানও এলো পিছু পিছু। নটিকে দেখা যাচ্ছে না। ভয় পেয়ে গিয়ে কোথাও লুকিয়েছে।

সোফায় বুসলো সবাই। রাফিয়ান গিয়ে ঢুকলো একটা টেবিলের তলায়, সামনের দুই পা ছড়িয়ে দিয়ে তার ওপর থুতনি রাখলো।

আলোচনা শুরু হলো।

 মা, জিনা বললো। এটা আমাদের বাড়ি। কেন এখান থেকে যাবো…

হয়েছে হয়েছে, হাত তুললেন মা। তুইও যেমন, তোর বাপও তেমন। কথায় কথায় রেগে যাস, আবার ঠাণ্ডা হতেও সময় লাগে না। আমার হয়েছে যতো জ্বালা..যাকগে, এখন একটা উপায় বের করা দরকার।

আসলে, এখান থেকে আমাদের এখন চলে যাওয়া উচিত, বললো। কিশোর।

এক কাজ করলেই পারি, মুসা বললো। গোবেল দ্বীপে…

হা, গোবেল দ্বীপ, রবিনও সায় জানালো।

 কিন্তু মিসেস পারকার মাথা নাড়লেন। না, এখন আবহাওয়া ভালো না। বৃষ্টির যা মতিগতি, চলতেই থাকবে। ঝড়ও আসতে পারে। এই সময় দ্বীপে গিয়ে, বৃষ্টিতে ভিজে শেষে অসুখ বাধাবে।  

তাহলে তোমার কি পরামর্শ? জিনার রাগ যাচ্ছে না।

খাইছে! বলে উঠলো মুসা। ওই বানরটা কি শুরু করেছে? থামাও না ওকে।

 কি দরকার? টকার বললো। আগুন খোঁচাচ্ছে, খোঁচাক। ঠাণ্ডা লাগছে হয়তো ওর।

আবার একটা ঝামেলা বাধাবে, দ্রুত গিয়ে বানরটার হাত থেকে আগুন খোঁচানোর লোহার দণ্ডটা কেড়ে নিলো আইলিন। এই নটি, ঘরে আগুন লাগাতে। চাস? যা, সর।

এই জন্যেই নাম হয়েছে বান্দর, বিমল হাসিতে ঝকঝকে শাদা দাঁত বেরিয়ে গেল মুসার।

বেশ, আবার শুরু করলো জিনা। দ্বীপে যেতে মানা করছে। এখানেও থাকতে দেবে না। যাবো কোথায়? আমি কোনো হোটেলে-টোটেলে যেতে পারবো না বাপু, আগেই বলে দিলাম।

নীরবতা। সমস্যাটা কঠিন।

আমি জানি, কোথায় যাবো! চেঁচিয়ে উঠলো টকার।

বেহেশতটা কোথায় শুনি? ভুরু নাচালো জিনা।

লাইট-হাউস, সবাইকে অবাক হয়ে তার দিকে চেয়ে থাকতে দেখে মাথা ঝোঁকালো টকার। হ্যাঁ, আমার লাইট-হাউস। এমন করে তাকাচ্ছো কেন? লাইট হাউস চেনো না নাকি?

দেখো, টকার, শান্তকণ্ঠে রবিন বললো, এটা মজা করার সময় নয়।

মজা করছি না। বিশ্বাস না হলে বাবাকে গিয়ে জিজ্ঞেস করে দেখো।

কিন্তু টকার, মিসেস পারকার হাসলেন। তোমার বয়েসী কেউ লাইট হাউসের মালিক হতে পারে না, তাই না?

 আমি হয়েছি, রেগে উঠলো টকার। শান্তিতে কাজ করার জন্যে বাবা ওটা কিনেছিলো। কিছুদিন কাজও করেছিলো। আমি গিয়েছিলাম সঙ্গে। আহ, কি সুন্দর জায়গা! বাতাস আর বাতাস, আর সারাক্ষণ ঢেউ!

সেটা তো তোমার বাবার, কিশোর বললো। তোমার না।

কেন নয়? আমি চাইলে কেন দেবে না? তার আর দরকার নেই ওটা। কারও কাছে বিক্রিও করতে পারেনি। আমিও ওটা নেয়ার জন্যে পাগল হয়ে গেলাম। ব্যস, দিয়ে দিলো।

খাইছে! জিনার আছে দ্বীপ, টকারের লাইট-হাউস। ভাবছি, আমার একটা আগ্নেয়গিরি কিংবা মরুভূমি থাকলে ভালো হতো।

মুসার কথায় হেসে উঠলো সবাই।

 জিনার রাগ শেষ। চোখ চকচক করছে। তোমার লাইট-হাউসটা কোথায়?

আমাদের বাড়ি থেকে দশ মাইল দূরে, পশ্চিমে। বিশাল, জানো? পুরনো ল্যাম্পটা এখনও আছে, তবে এখন আর জ্বালানো হয় না।

কেন হয় না? প্রশ্ন করলো মুসা।

ওই লাইট-হাউস বাতিল করে দেয়া হয়েছে। ভালো জায়গায় নুতন. আরেকটা বানানো হয়েছে, আধুনিক, ওটাই এখন জাহাজকে সাবধান করে দেয়। পুরনোটা বেচে দেয়া হয়েছে সে-জন্যেই। বাবার জন্যে জায়গাটা চমৎকার। কেউ ডিসটার্ব করতে পারে না। তবু রেগে গেছে বাবা, সী-গালদের ওপর। পাখিগুলো নাকি বেশি শব্দ করে। আমার কিন্তু খুব ভালো লাগে। বাবা বলে, সী-গালেরা। বেড়ালের মতো মিউমিউ করে, তার কাজের ক্ষতি করে…

তা তো বুঝলাম, টকারকে থামিয়ে দিয়ে বললেন মিসেস পারকার। খুব ভালো জায়গা। কিন্তু ওটা লণ্ডনে, এখন যেতে পারবে না। আমাদের সমস্যার। সমাধান হচ্ছে না।

আমার খুব যেতে ইচ্ছে করছে, মা, আবদার ধরলো জিনা। বাবাকে বলেই। দেখো না।

বললেই হবে নাকি? এখানেই আবহাওয়া খারাপ, ওখানে নিশ্চয় আরও বেশি খারাপ। তাছাড়া প্রফেসর কারসওয়েল চলে এসেছেন এখানে, তিনি বাড়িতে থাকলে না হয় এক কথা ছিলো…পরে কোনো এক সময় যাস। আপাততঃ এখানেই কোথাও ব্যবস্থা করতে হবে…

একটা জায়গা আছে, বলে উঠলো আইলিন। অবশ্য যদি এখন খালি পাওয়া যায়।

সব কটা চোখ ঘুরে গেল তার দিকে।

মিসেস লিয়ারি এলমস-এর কটেজ, আবার বললো আইলিন। ভাড়া দেয়। খাবারও ভালো।

হু, নাম শুনেছি, বললেন মিসেস পারকার। কাছেই কোথায় যেন। যাইনি। কখনও।

হা। বড় জোর দুই কিলোমিটার এখান থেকে।

 যোগাযোগ করতে হবে কিভাবে?

ফোন নম্বর জানি আমি।

তাহলে একটা রিঙ করো না, প্লীজ। দেখো, খালি আছে কিনা।

 টেলিফোন করলো আইলিন। টুরিস্ট সীজন নয়, খালিই আছে কটেজ। ভাড়া করে ফেলা হলো।

ফিরে এসে বসতে বসতে বললো আইলিন, ভালো জায়গা। তোমাদের খুব পছন্দ হবে। ওটার আশপাশে পুরনো অনেক ভাঙা দুর্গ আছে…

তাই নাকি! লাফিয়ে উঠে দাঁড়ালো টকার। দুর্গ দেখতে আমার খুব ভালো লাগে। পুরনো হলে তো আরও বেশি। সেই আনন্দেই সে একটা রেসিং-কার হয়ে গেল, ছুটতে শুরু করলো তীব্র গতিতে, সেই সঙ্গে এঞ্জিনের বিকট শব্দ।

ঘুমিয়ে পড়েছিলো, চমকে জেগে উঠে টেবিলের নিচ থেকে বেরিয়ে ঘেউ ঘেউ জুড়ে দিলো রাফিয়ান। বানরটাও তীক্ষ্ণ কিচির-মিচির শুরু করলো।

আরে থামো, থামো! তাড়াতাড়ি উঠে টকারকে থামাতে ছুটে গেলেন, মিসেস পারকার। তোমার এঞ্জিন বন্ধ করো। নইলে এখুনি আবার বেরিয়ে আসবে ওরা!

<

Super User