দুর্গমগিরি – মাসুদ রানা – কাজী আনোয়ার হোসেন
প্রথম প্রকাশ ১৯৯৯

পোর্ট সাইডে সালতানাত অভ ওমানের শুষ্ক উপকূল রেখে এগিয়ে চলেছে পনেরো হাজার টনী ফ্রেইটার ‘বাংলার গৌরব’। অবশ্য অনেক দূরে রয়েছে তট, বিনকিউলারেও ভালমত দেখা যায় না।

গালফ অভ এডেন হয়ে রেড সী যাচ্ছে বাংলার গৌরব, গন্তব্য জর্ডনের আকাবা বন্দর। সামনে গালফ অভ ওমানের অ্যাপ্রোচ, এখনও দেখা দেয়নি। দেবে কিছুক্ষণের মধ্যে। চারদিকে এখন কেবলই দুস্তর পারাবার।

আগুনের গোলার মত তপ্ত সূর্য অনেকটা হেলে পড়েছে। অ্যাপ্রোচের এবড়োখেবড়ো, উঁচু ক্লিফের ওপর ঝুলছে এ মুহূর্তে। উপসাগরের নীল পানি বিক্ষুব্ধ, সূর্যের লাল রঙ গায়ে মেখে নীলকান্ত মণির মত ঝিকমিক করছে। পানিতে দৃষ্টি পড়লে চোখ ধাঁধিয়ে যায়। গুমোট পরিবেশ। পাথুরে উপকূলের গন্ধ বয়ে নিয়ে আসছে তপ্ত বাতাস।

সুতোর মত কালো উপকূল রেখা দেখা দিতে খোলা ডেকে এসে দাঁড়াল ফখরুল হাসান। চোখ কুঁচকে সেদিকে তাকিয়ে থাকল একদৃষ্টে।

কেউ বলে আফ্রিকা, কেউ মধ্য প্রাচ্য, কিন্তু ফার্স্ট অফিসার ফখরুলের কাছে ওটা চিরকালই আরব। পবিত্র ভূমি। ধু-ধু মরু, উট, বেদুঈন আর রক্ত, একটার সাথে অন্যটা জড়িয়ে আছে ওখানে। আর আছে ঘৃণা, ষড়যন্ত্র, বিশ্বাসঘাতকতা, নির্যাতন আর…আর, মাথা ঝাঁকাল সে ভাবনা থামিয়ে, বঞ্চনার ইতিহাস, বিড় বিড় করে বলল।

হ্যাঁ, জঘন্য, নির্লজ্জ বঞ্চনার ইতিহাস। বঞ্চিত, ভিটেমাটি হারা আরবদের চোখের পানির উপাখ্যান।

গরমে গায়ের ভেতর চিড়বিড় করে উঠল। সামনে তাকিয়ে একটা ফিশিং ডাউ দেখতে পেল ফখরুল, এক ঝাঁক সী গাল পিছু লেগে আছে ওটার। দৈত্যাকার বাংলার গৌরবের দিকে বিশেষ খেয়াল নেই ডাউ চালকের, সামনে দিয়ে আড়াআড়ি ওমান উপসাগরের দিকে যাচ্ছে।

নিস্তব্ধতা চিরে খান খান করে দিল ফ্রেইটারের ফগহর্ন, বিকট ভ-আঁ-ক!শব্দে চমকে উঠল অন্যমনস্ক ফখরুল। বিক্ষুব্ধ সাগরের বুক ছুঁয়ে তীরের দিকে ধেয়ে গেল আওয়াজটা, ক্লিফে ধাক্কা খেয়ে বহু টুকরো হয়ে গিয়ে প্রতিধ্বনিত হতে থাকল। ডাউ চালক ঘুরে তাকাল। পাত্তা দিল না, যেমন চলছিল চলতে থাকল।

অনেক কাছ দিয়ে ফ্রেইটারের পাহাড় সমান উঁচু বো পেরিয়ে উপসাগরের অ্যাপ্রোচের দিকে ছুটে গেল ওটা ঢেউয়ের মাথায় চড়ে নাচতে নাচতে। খোলা সাগর থেকে মাছ ধরে ফিরছে। ওটার সাথে লেগে থাকা সী গালগুলো পিছনের আলোড়িত পানিতে ঝাপাঝপ ডাইভ দিচ্ছে, প্রপেলারের সৃষ্ট ঢেউয়ের সাথে খেলায় মত্ত ছোট ছোট মাছ ঠোঁটে বাধিয়ে উঠে পড়ছে সাথে সাথে।

ক্লিফের ওপাশে ঢলে পড়েছে সূর্য, হাটি-হাঁটি পা-পা করে ঘনিয়ে আসছে আঁধার। সিগারেট ধরিয়ে রেলিঙে দুই কনুইয়ের ভর রেখে দাঁড়াল ফখরুল হাসান। সামনের কথা ভাবছে। গালফ অভ এডেন যত এগিয়ে আসছে, ততই চিন্তা বাড়ছে। নিরাপদে আকাবায় না পৌঁছানো পর্যন্ত স্বস্তি নেই।

 টানা চলে ওখানেই প্রথম নোঙর করার কথা ছিল তাদের, কিন্তু সে প্ল্যান বাধ্য হয়ে বাতিল করতে হয়েছে। আগামী বিশ্বকাপের কোয়ালিফাইং রাউন্ডে খেলতে রিয়াদ যাবে বাংলাদেশের জাতীয় ফুটবল দল। এই জাহাজেই আছে তারা। ওমানের আউটার অ্যাঙ্কোরেজে তাদের, নামিয়ে দিয়ে যেতে হবে। মাসকাট থেকে প্লেনে রিয়াদ যাবে। এদের জন্যে বড়রকম হেরফের ঘটে গেছে প্ল্যানে।

রাউন্ড শুরু হওয়ার আগে কয়েকটা ওয়ার্ম আপ ম্যাচ খেলতে আর্জেন্টিনা গিয়ে ফেঁসে গেছে দলটা। দক্ষিণ আমেরিকার প্রায় সব দেশে বর্তমানে চরম অর্থনৈতিক মন্দা চলছে, পরিস্থিতির ওপর কোন সরকারেরই নিয়ন্ত্রণ নেই। ধর্মঘটে ধর্মঘটে প্রায় অচল ব্রাজিল, চিলি, আর্জেন্টিনা। প্রথম দেশ দুটোর বিমান সংস্থার ধর্মঘট এরমধ্যে দুসপ্তাহ পেরিয়ে গেছে, ভাঙার কোন লক্ষণ। নেই। বাকি ছিল আর্জেন্টাইন জাতীয় বিমান সংস্থা, বাংলাদেশ দল বুয়েনস আইরেস পৌঁছার একদিন পর তারাও অনির্দিষ্টকালের ধর্মঘট ডেকে বসল। কবে পরিস্থিতি স্বাভাবিক হবে ঠিক নেই। অথচ দলের বসে থাকার উপায় নেই, সময়মত অবশ্যই পৌঁছতে হবে। সড়ক পথে আর কোন দেশে গিয়ে যে প্লেনে উঠবে, সে পথও বন্ধ।

মাথা খারাপ হওয়ার দশা হয়েছিল ফুটবল ফেডারেশন কর্তাদের। দূতাবাসে ছোটাছুটি করতে করতে হয়রান। তিনদিন পর ঢাকা থেকে খবর এল, আর্জেন্টিনারই সান্তা ক্রুজ থেকে দেশী এক মালবাহী জাহাজ মধ্যপ্রাচ্যের উদ্দেশে ছাড়বে দুদিন পর, ওটায় উঠে পড়ো। ওয়ার্ম আপ ম্যাচ বাতিল। পরে দুঃখিত হওয়ার চাইতে সময় থাকতে তৎপর হও।

ওইদিনই সন্ধের পর এটায় চড়েছে দল। ওদের জন্যে প্রায় দুসপ্তাহ দ্বিগুণ গতিতে ছোটাতে হয়েছে জাহাজ। তবু ভাল যে শেষ রক্ষা করা গেছে। তিনদিন পর বাংলাদেশের প্রথম খেলা। ঘড়ি দেখল ফখরুল হাসান। আর কিছুক্ষণের মধ্যে ওমানের মিনা কারূজ বন্দরের আউটার অ্যাঙ্কোরেজে নোঙর ফেলবে জাহাজ। সময় বাঁচানোর ব্যবস্থা করা আছে। ওমানী কর্তৃপক্ষের ছোট এক ইয়ট এসে খেলোয়াড়দের নিয়ে যাবে।

আবার সিগারেট ধরাল ফার্স্ট অফিসার। দীর্ঘদেহী সে, বয়স পঁয়ত্রিশ। আগে ছিল বাংলাদেশ নেভিতে। মাটির চাইতে সাগর বেশি ভাল লাগে তার, বেশি টানে। তাই নেভি থেকে রিটায়ার করার পর বাংলাদেশ শিপিং কর্পোরেশনে যোগ দিয়েছে। স্ত্রী মিমি আপত্তি করেছিল, ফখরুল শোনেনি।

বাংলার গৌরব আকাবা পৌঁছলে ছুটিতে যাবে সে। দীর্ঘ দুমাসের ছুটি। কারণ তাদের দ্বিতীয় সন্তান আসছে। মেয়ে আশা করছিল ওরা দুজন, আন্ট্রাসনোগ্রাফিতে দেখা গেছে মেয়েই আসছে। প্রথম সন্তান ছেলে। ছয় বছর বয়স। মেয়ে হবে খবর পাওয়ার পর থেকে মনে মনে অস্থির হয়ে আছে ফার্স্ট অফিসার। কবে দেশে পা রাখতে পারবে, উন্মুখ হয়ে দিন গুনছে। অনাগত মেয়ের জন্যে এটা-ওটা কিনে নিজের কেবিন প্রায় ভরে ফেলেছে। সুযোগ। পেলেই নাড়াচাড়া করে ওসব, আর মনে মনে হাসে।

মেয়ের চেহারা তার মত হবে না মিমির মত, চোখ বুজে ভাবছিল সে, লাউডস্পীকারে নিজের নাম শুনে সচকিত হলো। ল্যান্ডিং পার্টি রেডি কি না, চেক করে দেখার অনুরোধ করছে তাকে গ্রীক ক্যাপ্টেন।

শেষ হয়ে আসা সিগারেট ফেলে সোজা হলো হাসান। চাপা একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে তীরের দিকে তাকাল। উত্তাপের কাঁপা কাঁপা অদৃশ্য ধোয়ার মধ্যে দিয়ে অনেক দূরে মিনা কাবুজ দেখা যাচ্ছে। গুবরে পোকা সাইজের একটা ইয়ট ছুটে আসছে ওদিক থেকে।

 ক্রুজ মেসের দিকে এগোল সে ব্যস্ত পায়ে। এখন খারাপই লাগছে দলটার। জন্যে। দুটো সপ্তাহ গল্প-গুজব, হাসি-ঠাট্টায় ভালই কাটল খেলোয়াড় ও কর্মকর্তাদের সাথে। ওরা নেমে গেলে ঠাণ্ডা মেরে যাবে বাংলার গৌরব। নাবিকের জীবন বড় নিঃসঙ্গ জীবন, বন্দরের অফ-শোর লীভ ছাড়া প্রায় বৈচিত্র্যহীন। ফ্রেইটারের নাবিকদের তো আরও। তবু রক্ষা যে তিনদিন পর। সেও ছুটিতে যাচ্ছে, নইলে খারাপ লাগত। এদের অভাব ভোগাত খুব।

সংক্ষিপ্ত আনুষ্ঠানিকতা, আন্তরিক বিদায় সম্ভাষণ ইত্যাদি সেরে খুদে তিন। ডিঙি চড়ে ইয়টে গিয়ে উঠল দলের সদস্যরা। ছেড়ে গেল, ওটা।

একটু পর আবার প্রাণ ফিরে পেল বাংলার গৌরব, পায়ের নিচে ডেকের। কাপন দ্রুত থেকে দ্রুততর হতে লাগল। ফুটবল টীম নিয়ে অনেক দূরে চলে গেছে তখন ওমানী ইয়ট। বন্দরের সমস্ত আলো জ্বলে উঠেছে। অদৃশ্য ধোয়ার মধ্যে দিয়ে ওগুলোকে আলাদা করে চেনা কঠিন, মনে হয় যেন একটাই, আলো-ফিতের মত লম্বা।

বেশ আঁধার হয়ে এসেছে। তার সাথে তাল মিলিয়ে ভেতরের অস্বস্তি বাড়ছে হাসানের। ভয় ভয় একটা অনুভূতি গ্রাস করতে চাইছে। ভয়টা ওর জাহাজের কার্গো নিয়ে। ম্যানিফেস্টোয় কৃষি যন্ত্রপাতি লেখা থাকলেও অন্য কিছু বয়ে নিয়ে চলেছে সে আসলে, এবং সে কথা জাহাজে একমাত্র হাসানই জানে। জানে বলেই ভয়। যদি কোন অঘটন ঘটে যায়, অকল্পনীয় সমস্যায়। পড়ে যাবে বাংলাদেশ। আন্তর্জাতিক প্রচার পাবে ব্যাপারটা।

ইয়ট অদৃশ্য হয়ে যেতে ঘুরে দাঁড়াল ফার্স্ট অফিসার, ফোর কার্গো হোল্ডের পাশ দিয়ে স্টার্নের তিনতলা সুপারস্ট্রাকচারের দিকে এগোল। ওখানকার খাটো, প্রায় খাড়া ইনার স্টেয়ারওয়েল বেয়ে ব্রিজের নিচের লেভেলে পৌঁছল। অফিসারদের সী কেবিন এরিয়া এটা। নিজের বাঙ্কে শুয়ে আছে প্রকাণ্ডদেহী গ্রীক ক্যাপ্টেন, পাপাগাইকোস ইউমেন্ডিস। ব্যারেলের মত চওড়া তার বুক-পেট। ষাটের মত বয়স। দেহের গঠন, হাঁটাচলা সব দানবীয়। হাসিখুশি, প্রাণখোলা মানুষ। হাত-পা ছড়িয়ে বিশ্রাম করছে, এক হাতে পানীয়ের গ্লাস। কেবিনের আলো নেভানো।

আহ, হাসান! গ্রীটিংস, মাই ফ্রেন্ড। ব্যারেলের ভেতর থেকে গমগমে আওয়াজ বের হলো, ধস্তাধস্তি করে বিশাল বপু খাড়া করল ইউমেন্ডিস। ঢুলু ঢুলু। চোখে তাকিয়ে হাসির ভঙ্গি করল। কাম ইন, কাম ইন!

দুমাসের মত হলো এ দায়িত্ব দেয়া হয়েছে তাকে। বাঙালী যে ক্যাপ্টেন ছিলেন, হঠাৎ করে ভীষণরকম অসুস্থ হয়ে পড়লেন। জাহাজ তখন ব্রাজিলের সাও পাওলোতে। কাজেই আর কাউকে নিয়োগ করা ছাড়া উপায় ছিল না। তখন। অস্বাভাবিক কিছু নয় ব্যাপারটা, সাগরে এমন ঘটনা ঘটতেই পারে। ঘটে। প্রচুর দৃষ্টান্ত আছে। পৃথিবীর যে কোনও ব্যস্ত পোর্টে এ ধরনের দুটো চাকরির আশায় বসে থাকা বেকার তবে অভিজ্ঞ ক্যাপ্টেন থেকে খালাসী পর্যন্ত সব পাওয়া যায়।

ইভনিং, ইউমেন্ডিস, ভেতরে পা রাখল ফার্স্ট অফিসার। কেবিন অন্ধকার করে রেখেছ কেন? ঘুমাচ্ছিলে?

না, মাই ফ্রেন্ড। বুড়ির কথা ভাবছিলাম, প্রকাণ্ড ভঁড়ি দুলিয়ে হাসতে লাগল সে। অনেকদিন দেখা নেই তো, ভাবছিলাম এই ট্রিপ শেষ হলে একবার দেশে যাব। চাপদাড়ির নিচে চাপড়া গাল চুলকাল।

অনেকদিন মানে? কেবিনের একমাত্র চেয়ারটায় বসল সে। দুমাস আগেই না শুনলাম দেশ থেকে ফিরেছ?

কপট বিস্ময়ে চোখ কপালে তুলল গ্রীক। মাই গড, বলো কি! দুমাস হয়ে গেছে এরমধ্যে? গ্লাসের পানীয় এক ঢোক চালান করল পেটে।

হাসল হাসান। তুমি দেখছি এই বয়সেও কম বউ পাগল নও!

কারেক্ট, ম্যান, বয়স। বয়সটাই যত নষ্টের গোড়া। আমার এক-আধটা ছেলেমেয়ে যদি থাকত, তাহলে বুড়ির চিন্তা এত না করলেও চলত। কিন্তু নেই বলেই হয়েছে যত জ্বালা। ঘন ঘন দেশে যেতে হয়, বেচারীকে একটু সঙ্গ দিতে হয়। আরেক ঢোক গিলল। তারপর, বলো, কি মনে করে? তোমাকে একটু যেন চিন্তিত মনে হচ্ছে?–

না, সেরকম কিছু না, আমতা আমতা করল সে। ভাবছিলাম…এই অঞ্চলটা সুবিধের না। প্যাঁচে পড়ে উল্টো পথে আসতে হলো, নইলে…

 হ্যাঁ, দুর্ভাগ্য। নইলে আটলান্টিক হয়ে এলে জায়গামত পৌঁছে যেতে পারতাম আমরা এতদিনে। গ্লাস শেষ করে মাথার কাছের টেবিলে রেখে দিল ক্যাপ্টেন। কি আর করা! ঘুরপথে না এলে তো খেলতে পারত না তোমার দেশ। ওদের ধর্মঘট এখনও চলছে।

হ্যাঁ।

চিন্তার কিছু নেই। এখন আর আগের মত ভয় নেই, অনেক ভদ্র হয়ে গেছে এ অঞ্চলের নেটিভরা।

তবু সতর্ক থাকা প্রয়োজন আমাদের, যেন কথার কথা, এমনভাবে বলল। ফার্স্ট অফিসার। নির্দেশ আছে। আজকের রাতটা আমাদের খুব সতর্ক থাকতে হবে। খাড়া থাকতে হবে।

ইঙ্গিতটা ঠিকই বুঝল গ্রীক। কয়েক সেকেন্ড চুপ করে থাকল, অ্যালকোহলের প্রভাবে পানি জমেছে চোখে, তার ভেতর দিয়ে পিট পিট করে অফিসারকে দেখল। আমাকে কখনও মাতাল হতে দেখেছ তুমি, হাসান?

না।

তাহলে নিশ্চিন্ত থাকো, মাই ফ্রেন্ড! ঘাবড়াবার কিছু নেই।

চাপা দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল সে। তোমার মত নিশ্চিত যদি হতে পারতাম!

ওয়েল, তোমার কথামত রেডিও সাইলেন্স বলবৎ করার অর্ডার আগেই। দিয়েছি আমি। এখন…আরও কিছু যোগ করতে চাও ওর সাথে?

ভয় ভয় অনুভূতিটা হঠাৎ করে ফিরে এল, অস্বস্তি লেগে উঠল ফখরুল হাসানের। এই প্রথম মনে হলো ক্যাপ্টেনের সী কেবিনটা খুব ছোট, অপ্রশস্ত। দম আটকে আসছে তার। এয়ার কন্ডিশনিঙের মৃদু গুঞ্জন অসহ্য লেগে উঠল।

ব্যাপার টের পেয়ে উঠল গ্রীক, আলো জ্বেলে দিল। ব্যাপার কি, হাসান? এত দ্বিধা করছ কেন? বলোই না কি বলবে!

লোকটা পুরো সজাগ, সতর্ক হয়ে উঠেছে দেখে স্বস্তি ফিরে এল তার ভেতরে। পকেট থেকে একটা নোট বই বের করে নির্দিষ্ট পাতায় চোখ বোলাল। আজ ডিনারের পর আমরা আমাদের রাডার রেঞ্জ অ্যালার্ম দুহাজার। মিটার স্কেলে ফিক্স করব। যাতে এই সীমার মধ্যে কোন বোট বা কপ্টার, বা আর যা-ই আসুক, সময় থাকতে জানতে পারি।

নো প্রবলেম, মাথা ঝাঁকাল ইউমেন্ডিস। আর?

একই সময় থেকে রেডিও অফিসার জেনারেল ওয়ার্নিঙের জন্যে চ্যানেল বারো, এবং এয়ারক্র্যাফট অ্যাপ্রোচ ওয়ার্নিঙের জন্যে চ্যানেল একশো পাচে কান খাড়া রাখবে।

মনে করো সে ব্যবস্থাও হয়ে গেছে।

কিছু সময় নীরব থাকল ফার্স্ট অফিসার। ভাবছে। যে কার্গো রয়েছে। জাহাজে, তা লোড করার আগে লম্বা প্রস্তুতি নিতে হয়েছে। এক্স নেভাল অফিসার বলে সব ঝক্কি তাকেই সামলাতে হয়েছে, পুরো একটা মাস সময়মত নাওয়া-খাওয়ার সুযোগ পায়নি সে।

ব্রিজের চারদিক এবং ব্রিজ ডেকিং মুড়ে দেয়ার কাজ করতে হয়েছে তাকে। কেভলার কম্পোজিট আর্মার শীট দিয়ে। শ্ৰাপনেল প্রতিরোধক শীট ওটা। উইন্ডোয় ফিট করতে হয়েছে অ্যাসিটিক অ্যাসিড প্রোটেকশন। মিসাইল। আক্রমণে ছিন্নভিন্ন হয়ে সৃপ্লিন্টারে পরিণত হতে পারে বলে সমস্ত ফৰ্মাইকা পাটিশন, টেবিল বদলে প্লাইউড দিয়ে করা হয়েছে নতুন করে। ডেকের সমস্ত। ফায়ার লাইন মুড়ে দেয়া হয়েছে আমার প্লেট দিয়ে। তারপর ইলেকট্রনিক ডিকয় সিস্টেম, আরএএম রাডার-অ্যাবজৰ্বেন্সি প্যাড, আরও কত কি! যত বাধাই আসুক, বাংলার গৌরব যাতে সেসব অগ্রাহ্য করে জায়গামত পৌঁছতে পারে, তার জন্যেই এতসব।

কাল ভোর থেকে প্রত্যেকটা ফায়ার-ফাইটিং টীমকে চব্বিশ ঘণ্টার জন্যে স্ট্যান্ডবাই রাখতে হবে, আকাবা না পৌঁছা পর্যন্ত।

হাসি ফুটল গ্রীকের প্রকাণ্ড মুখে। তুমি দেখছি ভাবনাচিন্তা কোনটাই বাকি রাখোনি, হে!

সশব্দে নোট বই বন্ধ করল ফখরুল হাসান, হাসির ভঙ্গি করল। পথে বেরিয়ে যা কখনও ঘটবে না ভাবা হয়, দেখা যায় শেষ পর্যন্ত তাই ঘটে বসে আছে। তাই… থেমে শ্রাগ করল। আমরা কোনরকম ঝুঁকি নেব না।

বুঝেছি। আমার মনে হয় এসব ক্ষেত্রে পাইরেট নয়, ইনশিওরেন্সওয়ালাদের বেশি ভয় করে জাহাজ কোম্পানিগুলো। প্রিমিয়াম চার্জ লো রাখার জন্যে কত যে ঝামেলা করতে হয়, বাপরে! তারপরও যদি একটু স্বস্তি পাওয়া যেত। উরুতে চড়াৎ করে চাপড় মারল গ্রীক। চলো, ব্রিজে যাই। ইয়েস?

অ্যাফট স্টেয়ারওয়েল বেয়ে ওপরে উঠে পড়ল দুজনে। সংক্ষিপ্ত প্যাসেজ। ধরে হুইলহাউসে যাওয়ার পথে রেডিও রূমের খোলা দরজার সামনে দাঁড়াল। ভেতরে উঁকি দিয়ে সেটের সামনে বসা অল্পবয়সী অফিসারকে দেখল ক্যাপ্টেন। হেই, জয়ন্ত, টোটাল রেডিও সাইলেন্স, রিমেমবার? নো মোর সিগন্যালস্ টু ইওর মিলিয়ন রিলেটিভস, রাইট? চওড়া করে হাসল।

 ঘুরে তাকাল জয়ন্ত। রাইট, ক্যাপ্টেন, বলল হাসি চেপে।

ফার্স্ট মেট রফিক আছে শুধু হুইলহাউসে। পায়ের শব্দে ঘুরে তাকাল সে। অল কারেক্ট, স্কিপার, রিপোর্ট করল।

মাথা ঝাঁকাল গ্রীক। ফার্স্ট অফিসারকে অনুসরণ করে স্টারবোর্ড ব্রিজ উইঙে এসে দাঁড়াল। কোস্টলাইনের ওপাশে পুরোপুরি ডুব মেরেছে সূর্য। দ্রুত ফুরিয়ে। আসছে গোধূলির আলো। হালকা কমলা রঙের আকাশের পটভূমিতে পরিষ্কার ফুটে আছে ওমানের জেবেল ক্লিফের আউটলাইন। অজস্র ক্লিফ। অগুনতি।

 আহ! লম্বা করে দম নিয়ে বুক ভরে গুমোট বাতাস টানল ক্যাপ্টেন। সামনের দিগন্তে তাকাল চোখ কুঁচকে। সাগর আর আকাশ! বলল বিড়বিড করে। আকাশ আর সাগর। গত ত্রিশ বছরের প্রায় রোজই এই দৃশ্য দেখে আসছি আমি, মাই ফ্রেন্ড। সেম ভিউ। অবশ্য সবসময় আবহাওয়া এত চমৎকার থাকে না।

দেখে দেখে ক্লান্ত হয়ে পড়েছ মনে হচ্ছে? সিগারেটের প্যাকেট বের। করল হাসান, ক্যাপ্টেনকে একটা দিয়ে নিজে ধরাল।

হ্যাঁ, বন্ধু, একগাল ধোয়া ছেড়ে বলল সে। ঠিক ধরেছ, ক্লান্ত হয়ে পড়েছি আমি। ইরাক-ইরান যুদ্ধের সময় আমার খুব ঘনিষ্ঠ দুই বন্ধু মারা গেছে। এই সাগরে। দুজনেই বড় ভাল মানুষ ছিল। এদিকে এলেই ওদের কথা মনে পড়ে, খুব খারাপ লাগে।

লোকটাকে সমবেদনা জানাবার জন্যে মুখ খুলেছিল ফখরুল, তখনই হুইলহাউস থেকে ফার্স্ট মেটের তীক্ষ্ণ চিৎকার ভেসে এল স্মল ক্র্যাফট, স্কিপার! সামনে দেখুন, দুটো স্মল ক্র্যাফট, এদিকেই…!

বিদ্যুৎবেগে ঘুরে তাকাল হাসান। চিৎকারের মর্ম বোঝামাত্র এমন এক ঝাঁকি খেয়েছে, মনে হলো অদৃশ্য একটা উত্তপ্ত লোহার শিক বুঝি কেউ ঢুকিয়ে দিয়েছে কানের মধ্যে। ক্যাপ্টেনও ঘুরল, অনিশ্চিত ভঙ্গিতে তাকাল। ওদিকে বিনকিউলার চোখে লাগিয়ে সামনের দিকে চেয়ে আছে রফিক, চোয়াল স্কুলে। পড়েছে বিস্ময়ে। সচকিত হয়ে ফগহর্ন বাজাল সে, সন্ধের শান্ত, সমাহিত পরিবেশ শিউরে উঠল, কাপন ধরল গুমোট, প্রায় স্থির বাতাসে। রফিকের দৃষ্টি অনুসরণ করে সামনে তাকাল ফার্স্ট অফিসার, অজানা আশঙ্কায় ধড়ফড় করছে বুকের মধ্যে।

ভয়তাড়িত চোখে প্রথমে কিছুই দেখতে পেল না। দেখল একটুপর। খুব নিচু, প্রায় ফ্ল্যাট দুটো খুদে কাঠামো, নীলচে ফসফরেসেন্ট ঢেউয়ের সাথে। লুকোচুরি খেলছে যেন। ওগুলোর শক্তিশালী আউটবোর্ড এঞ্জিনের মৃদু গুঞ্জন শুনতে পেল সে।

মুহূর্তের জন্যে হৃৎস্পন্দন বন্ধ হয়ে গেল। ইয়াল্লা! ভাবল ফার্স্ট অফিসার, ওগুলো কি! কারা ওরা?

রেলিঙে পেটের ভর রেখে ঝুঁকে দাঁড়াল, দেহের প্রায় অর্ধেক বাইরে ঝুলিয়ে আরও ভাল করে দেখার চেষ্টা করল। মনে হলো রাবারের তৈরি হেভি ডিউটি জেমিনি ইনফ্লেটেবল ওগুলো, পাশাপাশি ছুটে আসছে বাংলার গৌরবের বো সোজা। লাফিয়ে ঢেউয়ের মাথায় উঠছে, পরক্ষণে ঝাঁপ দিয়ে পড়ছে দুই ঢেউয়ের মাঝে, মুহূর্তের জন্যে অদৃশ্য হয়েই ফের মাথা তুলছে। কোত্থেকে এল ওগুলো?

নিশ্চই ওমানী প্যাট্রল হবে। তার দ্বিতীয় চিন্তাটা ভাষায় প্রকাশ করল গ্রীক। হ্যাঁ, ঠিক তাই।

কিছু বলল না হাসান, ভেতরে ঝড় বইছে। দ্বিধা, আশঙ্কা আর আতঙ্কে নড়ার শক্তি হারিয়ে ফেলেছে। ওমানীরা প্যাট্রল দেয় বোটে, ওসবে চড়ে নয়, এবং এরকম আচমকা হাজির হয় না ওরা। রেডিওর সাহায্যে যোগাযোগ করে। তবে চ্যালেঞ্জ করে। এটা ওমানীদের স্টাইল নয়, হতেই পারে না। তাহলে?

এখনও অন্তত সাতশো মিটার দূরে আছে ওগুলো। এই আলোয় ওদের যে সময় থাকতে দেখা গেছে, তাই অনেক ভাগ্যের কথা। আবার ধমকে উঠল ফগহন, আওয়াজটা যেন প্রাণের সঞ্চার করল ক্যাপ্টেনের মধ্যে। লম্বা তিন পদক্ষেপে হুইলহাউসে পৌঁছে গেল সে।

স্পীড কত?

সেভেন নট, স্কিপার, উদ্বিগ্ন গলায় বলল ফার্স্ট মেট।

ঘোঁৎ জাতীয় আওয়াজ বের হলো লোকটার গলা দিয়ে। গলা চড়িয়ে নির্দেশ দিল, রিভার্স এঞ্জিন!

অসহায় চোখে একপলক ফখরুল হাসানকে দেখল রফিক, হাত বাড়াল। কন্ট্রোলের দিকে। ঘামছে। কি করছ তুমি! বিস্ময় ফুটল ফার্স্ট অফিসারের কণ্ঠে। রিভার্স দিলে ওরা…ওরা…

তুমি চাও ওদের ওপর জাহাজ তুলে দিই আমি? গম্ভীর হয়ে উঠল ক্যাপ্টেনের চেহারা। যদি ওরা ওমানী প্যাট্রল হয়, কি ঘটবে ভেবে দেখেছ?রফিকের দিকে তাকাল। ডু ইট ফর গডস সেক, ম্যান!

 সতেরো হাজার হর্সপাওয়ারের বারমেস্টার অ্যান্ড ওয়েন ডিজেল এঞ্জিন চালিত ভ্যারিয়েবল-পিচ্ প্রপেলার হঠাৎ করে জবরদস্তী উল্টো ঘুরতে শুরু করায় ভীষণভাবে কাঁপতে লাগল দানবীয় ফ্রেইটার। প্রতিটা রিভেট পর্যন্ত কাঁপছে। তারপরও স্থির হতে প্রচুর সময় নিল বাংলার গৌরব। ওদিকে দুশ্চিন্তার মেঘে ছেয়ে গেছে ফার্স্ট অফিসারের চেহারা।

আমরা ওদের পাশ কাটিয়ে যেতে পারি, ব্যস্ত গলায় বলল সে।

ডানে-বাঁয়ে মাথা দোলাল ক্যাপ্টেন। তাতে বিপদ হতে পারে, মাই ফ্রেন্ড! আমরা ওদের ফাঁকি দিতে চেষ্টা করছি ভেবে… থেমে গেল কথা শেষ না করে।

অস্থির পায়ে বেরিয়ে এল হাসান, আবার রেলিঙে ভর দিয়ে সামনে তাকাল। অসহায় লাগছে নিজেকে, দিশা করে উঠতে পারছে না কি করবে। মন বলছে জাহাজ থামিয়ে দেয়া ঠিক হয়নি, ভুল করেছে ক্যাপ্টেন। কিন্তু কি করার আছে হাসানের? লোকটা ক্যাপ্টেন, জাহাজের সুপ্রীম কমান্ড, তার নির্দেশ না মেনে উপায় কি? ওরা যদি ওমানী হয়ে থাকে, তাহলে ঠিক কাজই করেছে মানুষটা। নইলে নিঃসন্দেহে ঝামেলা হত। আর যদি তা না হয়ে থাকে, তাহলে ভুল করেছে। শখের করাতে  পড়েছে জাহাজ। ওদের পরিচয় না জানা পর্যন্ত…

অনেক কাছে এসে পড়েছে দুই জেমিনি। এত কাছ থেকে ওদের পথরোধ করার সুযোগ ওরা কি করে পেল রাডারের চোখ এড়িয়ে, বুঝতে দেরি হলো না ফার্স্ট অফিসারের। ওগুলো বেলজিয়ামের তৈরি, খুবই সফিস্টিকেটেড ক্র্যাফট। ভেতরে বাতাস ভরে চালানো হয়। ইচ্ছে হলে বাতাস রিলিজ করে। সাগরে ভাসিয়েও রাখা যায় হাই-প্রেশার এয়ার-বটুলের সাহায্যে। স্পেশাল ফোর্সের জন্যে তৈরি, রাডারকে ফাঁকি দেয়ার বিশেষ ব্যবস্থা আছে।

প্রয়োজনমত যখন খুশি সুইচ টিপলেই হুশশ! করে ফুলেফেঁপে ওঠে, টার্গেট কিছু বুঝে ওঠার আগেই ঘাড়ের ওপর এসে পড়ে।

হঠাৎ করে পরস্পরের কাছ থেকে আলাদা হয়ে গেল দুই জেমিনি, কোনাকুনি ছুটে গেল বাংলার গৌরবের ডানে ও বায়ে। ওদের ভোতা বো ঢেউয়ের মাথায় ঘন ঘন চাটি মারছে। স্বস্তির নিঃশ্বাস ছাড়তে যাচ্ছিল হাসান। ভয়ের কিছু নেই ভেবে, তখনই আবছা লাইনটার ওপর চোখ পড়ল। দুটো বিট মিস্ করল হৃৎপিণ্ড, পরমুহর্তে ঘোড়ার মত লাফাতে শুরু করল।

দুই জেমিনির বো-র সাথে বাঁধা আছে লাইনটার দুই প্রান্ত, ওদের মাঝের ব্যবধান যত বাড়ছে, ওটাও ততই দীর্ঘ হচ্ছে। পানিতে সাপের মত কিলবিল করছে। রেলিঙে ঠুকে নিজের মাথা গুড়ো করে ফেলতে ইচ্ছে হলো হাসানের। ব্রিটিশদের স্পেশাল বোট সার্ভিসের স্ট্যান্ডার্ড মেথড ওটা, জানে সে। শুধু জানেই না, এ ট্রেনিং নেয়া আছে তার। আর যেই হোক, সে কি করে এই ফাঁদে পা দিল? তার তো সন্দেহ করা উচিত ছিল…গলার সমস্ত জোর দিয়ে চেঁচিয়ে উঠল সে, ওরা বোর্ডিং পার্টি, ইউমেন্ডিস! ফুল স্পীড দাও, ফুল স্পীড!

চেহারা দেখে মনে হলো বুঝি প্যারালাইজড় হয়ে গেছে ক্যাপ্টেন। চোখ বিস্ফারিত, ঠোঁট কাঁপছে। চেষ্টা করেও নড়তে বা গলায় স্বর ফোঁটাতে পারছে না।

 সময় নষ্ট না করে এক লাফে ভেতরে ঢুকে পড়ল হাসান, ঘেমে গোসল করে ওঠা ফার্স্ট মেটকে এক ধাক্কায় আরেক মাথায় পাঠিয়ে দিয়ে এঞ্জিনরূমকে ফুল অ্যাহেড নির্দেশ দিল। প্রচণ্ড উত্তেজনায় থর থর করে কাঁপছে তার সর্বাঙ্গ, সোজা দাঁড়িয়ে থাকতে কষ্ট হচ্ছে। নিচ থেকে চাপা ক্রিং ক্রিং আওয়াজ ভেসে আসতে একটা ঝাঁকি খেয়ে সচকিত হলো ক্যাপ্টেন, বিশাল বপু নিয়ে আক্রমণাত্মক ভঙ্গিতে হাসানের দিকে ঘুরল। রাগে ভয়ঙ্কর হয়ে উঠেছে চেহারা।

হাউ ডেয়ার ইউ…

প্রচণ্ড এক ধমক মেরে তাকে থামিয়ে দিল সে, উত্তেজিত হয়ে কন্ট্রোল ছেড়ে দুহাতে গায়ের জোরে এক ধাক্কা মেরে বসল। তাল সামলাতে না পেরে টলোমলো পায়ে হুইলহাউস থেকে বেরিয়ে গেল লোকটা। হয়তো রেলিঙের ওপরই পড়ত গিয়ে, কিন্তু শেষ মুহূর্তে দরজার ফ্রেম খাবলে ধরে ঠেকাল নিজেকে, আগুন চোখ মেলে ওর দিকে তাকিয়ে থাকল।

 পাত্তা দিল না ফার্স্ট অফিসার, অ্যাকশন স্টেশন ক্রুদের সতর্ক করার জন্যে অ্যালার্ম ক্ল্যাক্সন বাজিয়ে দিয়েছে ততক্ষণে। এদিকে নড়তে শুরু করেছে দৈত্যাকার বাংলার গৌরব, ডেপ্লেট কাঁপাছে ডিজেল এঞ্জিনের গুরুগম্ভীর ধক ধক আওয়াজের সাথে তাল রেখে। ক্রমে গতি বাড়তে শুরু করেছে।

কিন্তু তার মন বলছে দেরি হয়ে গেছে। হেরে গেছে ওরা। যদি ইউমেন্ডিস গতি না কমাত, বো-র আঘাতে হয় লাইনটা কেটে যেত, নয়তো বেশি মজবুত হলে { দুটোকে সাথে বাধিয়ে নিয়ে চলতে থাকত ফেইটার। লাইনের টানে দুদকের হালের ওপর এসে অছিড়ে পড়ত দুই জেমিনি, হাত হয়ে যেত বোঙি পাটির প্রত্যেকে। কিন্তু এখনকার-ধীরগতি ওদের আরও সুবিধে করে দিল। একেবারে অনায়াস স্বচ্ছন্দে টেনে নিয়ে এল গায়ের ওপর।

 দৌড়ে বেরিয়ে এল হাসান, ব্রিজ উইঙে দাঁড়িয়ে নিচে তাকাল। মুহূর্তের জন্যে এদিকের ক্র্যাফটাকে দেখতে পেল সে। অ্যামিডশিপ বরাবর হালের সাথে মিশে দাঁড়িয়ে পড়েছে। কালো পোশাক আর মুখোশ পরা কয়েকটা কাঠামো নড়েচড়ে উঠল ওটায়। নিচের রেলিঙে মৃদু টুং-টং শব্দ উঠল, থ্যাপলিং হুক ছুঁড়ে মারছে ওরা নিচ থেকে। লাইন ধরে বলে ওপরে উঠে আসার আয়োজন সম্পন্ন করেছে বোর্ডিং পার্টি, আর মাত্র কয়েক সেকেন্ড। তারপর… তারপর

এর পরের সবকিছু ঘটল অবিশ্বাস্য দ্রুততার সাথে। অ্যাকশন স্টেশনের হতভম্ব ক্রুরা ঠিকমত দাঁড়াতে পারার আগেই প্রথম কালো ছায়া রেলিং টপকে  ঝুপ করে লাফিয়ে পড়ল ডেকে। ভেজা কাপড় বেয়ে টপ টপ করে পানি ঝরছে তার, হাতে শোভা পাচ্ছে এম-সিক্সটিন অ্যাসল্ট রাইফেল। আরও একজন উঠল…আরও একজন। প্রেতের মত উঠছে ওরা।

ফখরুল হাসানের সেদিকে খেয়াল নেই। ওপরের ডেকে বুলহর্ন নিয়ে। পাগলের মত ছোটাছুটি করছে, গলা ফাটিয়ে চাচাচ্ছে, রিপেল বোর্ডারস! রিপেল অল বোর্ডারস্ বাই অল মীন! রিপেল…রিপেল…রিপেল।

এক সময় হুঁশ হলো। বুলর্হন ফেলে ক্যাপ্টেনের কলার মুঠো করে ধরল। সে শক্ত করে। তোমাকে আমি তোমাকে আমি…

ঝটকা মেরে হাতটা সরিয়ে দিল গ্রীক। থামো! তুমি আমাদের সবাইকে মারতে চাও নাকি? আমার কি দোষ, আমি কি জেনে বুঝে করেছি?

কেবিনের ড্রয়ারে পড়ে থাকা নিজের ব্রাউনিংটার কথা খেয়াল হতে আফসোস হলো ফার্স্ট অফিসারের। সব কিছু এত দ্রুত ঘটে গেল যে ওটার কথা মনে করার মত সুযোগও আসেনি, নইলে যতগুলোকে সম্ভব শেষ করে দেয়া যেত।

 একসঙ্গে অনেক জোড়া পায়ের আওয়াজ কানে আসতে ঘুরে তাকাল সে। হঠাৎ করে একদম শান্ত, স্থির হয়ে গেছে। মেইন ডেকের স্টেয়ারওয়েল বেয়ে উঠে এল তিন কমান্ডো, খোলা উইঙে ওদের দেখতে পেয়ে থেমে পড়ল। পিজর বরাবর অস্ত্র ধরে দাঁড়িয়ে থাকল ভদ্রলোকের মত। যেন দাঁড়িয়ে থাকবে। বলেই এত ঝুঁকি নিয়ে জাহাজে চড়েছে, দুনিয়ায় আর কোন কাজ নেই।

পিছনে জোর এক চড়াৎ! শব্দে চমকে উঠে ঘুরে তাকাল ফার্স্ট অফিসার। হুইলহাউসে দাঁড়িয়ে আছে আরও দুই কমান্ডো। নিশ্চই আউটার ল্যাডার বেয়ে। উঠেছে হারামজাদারা, তারপর হ্যাঁচওয়ে দিয়ে…রফিকের গালে চার আঙুলের লালচে দাগ বসে আছে দেখে ভাবনার রাশ টেনে ধরল সে, আওয়াজটা কিসের। ছিল বুঝে নিল। মাথার ওপর দুহাত তুলে দাঁড়িয়ে আছে মেট, চড়ের চোটে পানি এসে গেছে চোখে। হয়তো নির্দেশ পালন করতে দেরি করে ফেলেছিল।

রাডার স্ক্রীনের আলোয় কমান্ডোদের পোশাক চক চক করছে দেখল সে। রাবার স্যুট। কোমরে চওড়া, অ্যামিউনিশন বেল্ট বাধা। কাঁধের পেশী শক্ত, আড়ষ্ট হয়ে উঠল হাসানের। অজ্ঞাত পরিচয় এতজন অস্ত্রধারী দেখে ভয় তো পায়ইনি, উল্টে বরং রাগে অস্থির। কিছুটা নিজের ভুলের জন্যে, বোকামির, জন্যে, কিছুটা বর্তমান অসহায় অবস্থার জন্যে। অদম্য একটা প্রবণতা মাথাচাড়া দিয়ে উঠছে ভেতরে।

কি ঘটিয়ে বসত বলা যায় না, কিন্তু তার আগেই ঠেকাল ওকে পাপাগাইকোস ইউমেন্ডিস। মেরুদণ্ডের ওপর তার পিস্তলের চাপ খেয়ে ঘুরে তাকাল বিস্মিত, হতবাক ফার্স্ট অফিসার।

নো, মাই ফ্রেন্ড! হাসল লোকটা। যুদ্ধ শেষ। কেন অহেতুক আত্মহত্যা করতে যাচ্ছ?

একটামাত্র শব্দ উচ্চারণ করল ফখরুল হাসান। বিশ্বাসঘাতক! দাঁতে দাঁত পিষে বলল কোনমতে।

.

০২.

চোখে আলো পড়তে অস্বস্তিকর ঘুম ভাঙল ফখরুল হাসানের। মাথার অনেক ওপরের বড় একটা ফাঁক দিয়ে ভেতরে এসেছে দিনের প্রথম আলো। ওটা অ্যাঙ্কর চেইন রান-আউট অ্যাপারচার। বো-র কাছের চেইন লকারে আটকে রাখা হয়েছে ওকে। জাহাজ থেমে নেই। রাতে বেদখল হওয়ার পর থেকেই শুরু হয়েছে চলা। আট নয় ঘণ্টা হলো চলছে বাংলার গৌরব। কোনদিকে, কে জানে?

রেইডারদের পরিচয় জানা হয়নি, তবে যারাই হোক ওরা, সবাই কড়া ট্রেনিং পাওয়া, ভারি স্মার্ট, মনে মনে হলেও স্বীকার না করে উপায় নেই। প্রফেশনাল, অহেতুক ত্রাস সৃষ্টি করতে চায়নি ক্রুদের মধ্যে। করেনি। দরকারও ছিল না। কারণ পরিস্থিতি প্রথম থেকে সম্পূর্ণ তাদের নিয়ন্ত্রণেই ছিল।

অবশ্য, তিক্ত মনে ভাবল হাসান, সে জন্যে বিশ্বাসঘাতক ঐকটাকেও ক্রেডিট কিছুটা দিতে হয়। তার সাহায্য না পেলে বাংলার গৌরব দখল করা। কিছুতেই সম্ভব ছিল না ওদের পক্ষে।

হারামজাদা পাপাগাইকোস ইউমেন্ডিস!

কিন্তু কি করে? এই একটা প্রশ্নের উত্তর আবার নতুন করে হাতড়ে বেড়াতে লাগল সে। কি করে জানল সে ওদের গোপন কার্গোর কথা? কবে, কিভাবে যোগাযোগ করল সে রেইডারদের সাথে? কার মাধ্যমে? নাকি এটা স্রেফ একটা পাইরেসি? কার্গো কি, না জেনেই থেমে মাথা দোলাল ফখরুল হাসান। হতে পারে না, অসম্ভব। জেনেশুনেই এসব ঘটানো হয়েছে। কিন্তু কি করে এত গোপন এক তথ্য ফাঁস হলো, মাথায় আসছে না।

ধীরে ধীরে আরেকটা সম্ভাবনার কথা মনে জাগল। ওরা যখন সাও পাওলোয় জাহাজের নিরাপদ চলা নিশ্চিত করতে ব্যস্ত, তখনই হয়তো ফাস হয়েছে খবরটা, সে যে করেই হোক। হঠাৎ ধড়মড় করে উঠে বসল হাসান। ক্যাপ্টেনের হঠাৎ করে অসুস্থ হয়ে পড়া স্যাবটাজ ছিল না তো? কোন অদৃশ্য। মহল তাকে সরিয়ে ইউমেন্ডিসকে ক্যাপ্টেন হিসেবে বাংলার গৌরবে তুলে। দেয়ার জন্যে কলকাঠি নেড়েছিল?

বাল্কহেড়ে হেলান দিয়ে স্তম্ভিতের মত বসে থাকল সে। সম্ভাবনাটা যত নাড়াচাড়া করছে, ততই অন্ধকার থেকে আলোয় বেরিয়ে আসছে অবিশ্বাস্য, নগ্ন সত্যটা। একসময় আপনমনে মাথা দোলাল, এ না হয়েই পারে না। তাহলে…তাহলে এই রেইডার পার্টি, এরা কারা? ওমানী? না। সৌদি? না। ইরাকী, বা ইরানী? না। জর্ডানী? না।

কি কার্গো রয়েছে বাংলার গৌরবে, না জেনে এ কাজ করা হয়নি, বরং জেনেশুনেই করা হয়েছে। তাই যদি হয়, তাহলে তাদের কারোরই বাগড়া দেয়ার কথা নয়। কোন স্বার্থ নেই তাদের এর পিছনে, থাকতে পারে না। তাহলে বাকি থাকে আর একটা মাত্র পক্ষ।

সে ইসরায়েল!

ইহুদীবাদী, জায়নবাদী ইসরায়েল। ঘৃণ্য সাম্রাজ্যবাদী শক্তির নির্লজ্জ সমর্থনপুষ্ট মধ্যপ্রাচ্যের বিষফোঁড়া। একমাত্র ইসরায়েলেরই স্বার্থ আছে এর। পিছনে। এই জন্যেই, আবার মাথা দোলাল হাসান, এই জন্যেই। ওরা জানত তার পরিচয়। হয়তো তাই প্রথম সুযোগেই সবার থেকে আলাদা করে ফেলেছে তাকে, ফ্রগমার্চ করিয়ে নিয়ে এসেছে ওকে এই চেইন লকার পর্যন্ত। পরনের কাপড়-চোপড় খুলে একটা বয়লার স্যুট পরতে বাধ্য করেছে, জুতো। বদলে রাবার সোল ক্যাম্বিসের জুতো পরিয়েছে। তাও. ফিতেহীন। তারপর প্লাস্টিককাফ স্ট্রিপ দিয়ে হাত-পা মজবুত করে বেঁধে ফেলে রেখে গেছে।

ফোঁস করে দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল ফখরুল হাসান, কোনমতে যদি একবার বের হতে পারত এখান থেকে, তারপর কোনমতে যদি ক্রুজ মেসে পৌঁছে সদ্য সেট করা সার্টি এমার্জেন্সি রেডিও বীকনের সুইচ টিপে…

হাতের বাঁধন খোলার চেষ্টা করে দেখেছে সে, খুব শক্ত। জোরাজুরি করলে কেটে বসে।

সচকিত হলো সে। বদলে গেছে এঞ্জিনের একঘেয়ে আওয়াজ, অল্প সময়ের মধ্যে বেশ কয়েকবার ডানে-বাঁয়ে ঘুরল বাংলার গৌরব। থেমে পড়ল। বন্ধ হয়ে গেল এঞ্জিন। অদ্ভুত, ভয়ঙ্কর নীরবতা! একটু একটু দুলছে জাহাজ, সুপারস্ট্রাকচারের এখানে-ওখানে মৃদু ক্যাচকোচ আওয়াজ উঠছে। অনেক নিচে খোলের গায়ে অলস চাপড় মারছে পানি। এ ছাড়া আর কোন শব্দ নেই।

কোথায় জায়গাটা কোথায় লকারের বাইরের ডেকপ্লটে কয়েক জোড়া ভারী পায়ের আওয়াজ উঠল। জ্যাচের জ্যাচ খেলা হলো, তারপর হ্যাঁচ। বোদ। ঝাঁপিয়ে পড়ল ভেতরে। (চাখ ময়ে আসতে ঘুরে তাকাল ফখরুল। তিন কমান্ডো বাইরে দাঁড়িয়ে আছে। একজন এসে বাধন কেটে দিল ওর।

বেরিয়ে এসো, বাইরে দাঁড়ানো এক কমাতে আববীতে বলল। মৃদু, তবে কর্তৃত্বের সুর আছে বলার মধ্যে। তাকেই নেতা মনে হলো।

পিছন থেকে ধাক্কা খেয়ে এগোল সে। বাইরে এরইমধ্যে সব ভাজা হতে শুরু করেছে রোদের তেজে। মনে এনে কমাবে নির্দেশের টান সঠিক খাপে বসার চেষ্টা করল হাসান। ও হিব্রুভাষী, কোন সন্দেহই নেই। পা চালাবার বিশেষ গরজ দেখাল না সে, আড়চোখে লোকগুলোকে দেখে নিল। নেতা বাদে অন্যরা সশস্ত্র, তৈরি। উপায় নেই কিছু করার।

সূর্যের অ্যাঙ্গেল দেখে বিয়ারিং নেয়ার চেষ্টা করল। প্রায় আকাশ ছোঁয়া ধুসর রঙের এক পাথরে ক্লিফের খুব কাছে দাঁড়িয়ে আছে বাংলার গৌরব। এটা একটা ইনলেট। চারদিকেই ক্লিফ-অতন্দ্র প্রহরীর মত মাথা তুলে দাঁড়িয়ে আছে সগর্বে। বহু বহু শতাব্দীর প্রাচীন। সবগুলোর চুড়ো থেকে অদৃশ্য ধোয়া উড়ছে অসহ্য তাপে। নরওয়েজিয়ান ফিওর্ডগুলোর সাথে যথেষ্ট মিল আছে এখানকার।

দশটা বাংলার গৌরবকে লুকিয়ে রাখা যাবে, এত বড় ইনলেট এটা। কাছের ক্লিফের সাথে বাঁধা আছে ফ্রেইটার। যেখানে ওটার লাইন বাধা, সেখানে এবং ডেকে কয়েকজন রেইডারকে দেখল হাসান, ক্যানভাসের ক্যামোফ্লেজ শীট দিয়ে ফ্রেইটার ঢেকে দেয়ার কাজে ব্যস্ত। অনেকটা কাজ এগিয়ে গেছে এরমধ্যে। ইনলেটে ঢোকার মুখের দিকে তাকাল সে, জেবেলের ভাঙা রিমের ওপর চোখ পড়ল। মাইলখানেক দূরে ইনলেটের মুখ আড়াল করে রেখেছে ওটা।

ছিনতাই হওয়ার পর থেকে চলার গতি, সময় এবং সূর্যের অ্যাঙ্গেল, ইত্যাদি মিলিয়ে জটিল অঙ্ক কষতে শুরু করল হাসান মনে মনে। সিদ্ধান্তে পৌঁছল, এ জায়গা নিশ্চই বিশাল, বিস্তীর্ণ মুসানডেম পেনিনসুলার দক্ষিণ প্রান্তের কোথাও হবে। হরমুজ প্রণালীর সৃষ্টি এই পেনিনসুলা থেকেই। অবশ্য অনেক দূরে রয়েছে প্রণালী, একশো মাইলেরও বেশি বৈরী কোস্টলাইনের আরেক মাথায়। এরমধ্যে আছে অসংখ্য হাই-সাইডেড বে-র গোলকধাঁধা, ইনলেট। এক-আধটা জেলে পল্লী ছাড়া পুরো এলাকা বিরান।

 এক অর্থে বাংলার গৌরবকে বিশ্বের বুক থেকে নিশ্চিহ্ন করে দিয়েছে এরা। কেউ কিছু জানবে না, টের পাবে না। হাসানের জানা আছে, এক-আধটা মাছ ধরার আরবী ডাউ ছাড়া কোন নৌযান এ অঞ্চলের ধার ঘেঁষে না।

কমান্ডোদের দিকে নজর দিল। মোট আটজন ওরা নেতাসহ। নেতা। লোকটা অন্যদের তুলনায় খাটো-পাঁচ ফুট ছয় হবে হয়তো। নীল চোখ। পাশে সবার চেয়ে চওড়া। ষাঁড়ের মত প্রশস্ত কাঁধ। অভিব্যক্তিহীন চেহারা। মাথা কঁকিয়ে তাকে ক্রুজ মেস দেখাল হাসান। আমি ওদের সাথে যোগ দিতে পারি?

তার ইঙ্গিতে মেসের হ্যাঁচওয়ে খুলে দিল একজন। ভেতরে ধোয়া ছাড়া। বিশেষ কিছু চোখে পড়ল না ওর পয়লা দর্শনে। যান! নির্দেশ দিল নেতা।

এখানে কেন এসেছি আমরা জানতে পারি? কতদিন থাকতে হবে?

নীল চোখে ধৈর্য হারানোর লক্ষণ ফুটল। ভেতরে যান!

যেতে হলো না, অন্যজনের ধাক্কায় আপনিই মেসে সেঁধিয়ে গেল সে। মেসের এখানে-সেখানে ছড়িয়ে আছে জাহাজের অফিসার- সবাই। সবাই দেখল তাকে, কিন্তু অনিশ্চিত ভবিষ্যতের চিন্তায় এতই ডুবে আছে যে উঠে এসে কথা বলার গরজ দেখাল না একজনও। ফার্স্ট মেট রফিক শুধু হাসল একটু ভ্যাঙচানোর মত করে। সিগারেটের ধোঁয়ায় চোখ জ্বালা করে উঠল হাসানের।

হেই, মাই ফ্রেন্ড! ক্যাপ্টেনের গলা শুনে ঘুরে তাকাল। আগের মতই হাসি খুশি দেখাচ্ছে লোকটাকে, যেন সব স্বাভাবিক আছে। কিছুই ঘটেনি। এদিকে, আমার কাছে এসে বোসো।

তার ধারেকাছে ঘেঁষার ইচ্ছে না থাকলেও এগোতে হলো হাসানকে। কারণ তার গোপন সার্চি রেডিও বীকনের বেঞ্চ লকারের ঠিক ওপরে বসে আছে ব্যাটা। চেহারা স্বাভাবিক রাখার চেষ্টা করে তার পাশে বসল হাসান। প্রায় সাথে সাথে ওর নাস্তা আর গরম কফি নিয়ে এল ফিলিপিনো কুক।

আমি খুব দুঃখিত ওরা তোমাকে চেইন লকারে আটকে রেখেছে বলে, বলল গ্রীক। যদিও চেহারা দেখে উল্টোটাই মনে হলো।

ধন্যবাদ, নিরাসক্ত কণ্ঠে বলল ও। কিন্তু এসবের অর্থ কি বলো দেখি! এরা কারা, কোন দেশী? কথার ফাঁকে হেলান দিয়ে বসল, একহাতে মুঠো করে ধরে রেখেছে গদিমোড়া বেঞ্চের সামনের কিনারা। একটু একটু করে ইউমেন্ডিসের দিকে এগোচ্ছে হাতটা, তার উরুর নিচে, কিনারার ভেতরদিকে সেট করা আছে বীকনের সুইচ।

এরা? জর্ডানিয়ান কমান্ডো।

লোকটার মুখের দিকে তাকাল ফার্স্ট অফিসার। কামন, ইউমেন্ডিস। ওরা যদি জর্ডানিয়ান হয়, আমি তাহলে সক্রেটিস।

শ্রাগ করল সে। এ নিয়ে প্রশ্ন না করাই ভাল। ওদের কানে গেলে বিপদ ঘটে যেতে পারে।

ওরা কার্গো হোল্ডে ঢুকেছে?

হয়তো, আমি দেখিনি। সন্দেহের চোখে ওকে দেখল গ্রীক। ক্রেটে কি আছে আসলে বলো তো! কেন ওরা হাইজ্যাক করল শিপ?

হাত থেকে কাপ ছুটে গেল হাসানের, বেশ খানিকটা গরম কফি লোকটার উরুতে পড়তেই ছিটকে উঠে দাঁড়াল সে। চেহারা বিকৃত করে জোরে জোরে ডলতে লাগল জায়গাটা। সরি! বলে ঝুঁকে নিজের ডান জুতোয় ঢুকে পড়া কফি ঝেড়ে ফেলল হাসান জুতো খুলে, অন্যহাত দেহের আড়ালে রেখে লকারে ভরে দিল, টান মেরে বের করে ফেলল বীকনের পিন।

সোজা হয়ে বসল তারপর। বুকের বিশ মনী পাথটা নেমে গেছে। অনেক হালকা লাগছে এখন নিজেকে। সঙ্কেত জায়গামত পৌঁছলে হলো, তারপর দেখা যাবে এদের কত ক্ষমতা। নিজের জায়গায় বসতে যাচ্ছিল ও, এমন সময় দড়াম করে খুলে গেল দরজা। এম-সিকুটিন হাতে নেতাকে ওখানে দাঁড়ানো দেখা গেল।

ইউ, হাসান, চেঁচিয়ে উঠল সে। কোথায় ওটা?

কি! সোজা হলো ও।

ভেতরে এসে দাঁড়াল লোকটা, রাইফেলের নল ঠেসে ধরল ফার্স্ট মেট। রফিকের কানের ওপর। তিন পর্যন্ত গুনব আমি, এরমধ্যে বলতে হবে কোথায় আছে তোমার ডিসট্রেস বীকন। ওয়ান…টু…

ওকে, ওকে! নিচু হয়ে বীকনটা বের করল সে, ছুঁড়ে দিল মেস টেবিলের ও মাথার দিকে। ওটা মুঠোয় নিয়ে বেরিয়ে গেল কমান্ডো, দরজা বন্ধ হওয়ার শব্দে কেঁপে উঠল মেস।

ধীরে ধীরে বসে পড়ল ফখরুল হাসান। জানার উপায় নেই, পেনিনসুলার উত্তর প্রান্তে, বেশ একটু দূরে রয়েছে আরেক অজ্ঞাতপরিচয় জাহাজ, তার সঙ্কেত ইন্টারসেপ্ট করেছে ওটা। এদের খবরটা জানিয়ে দিয়েছে। বিশেষ এক সম্পর্ক আছে ওটার কমান্ডোদের সাথে।

.

০৩.

তিনদিন পর। ঢাকা।

বিসিআই প্রধান মেজর জেনারেল (অব.) রাহাত খানের মুখোমুখি বসা মেজর (অব.) মাসুদ রানা। স্বভাবসুলভ ঋজু ভঙ্গিতে বসে আছেন বৃদ্ধ, আরেকদিকে তাকিয়ে ভাবছেন কি যেন। ঘন, কাঁচাপাকা ভুরু কুঁচকে আছে। পাইপ কখন নিভে ঠাণ্ডা হয়ে গেছে খেয়ালই নেই। টেনে চলেছেন ঘন ঘন।

বেশ কিছুক্ষণ থেকে ও তরফ থেকে আর কিছু আসছে না দেখে মুখ খুলল রানা। এ কবেকার কথা, স্যার?

 বাঘের চোখে তাকালেন বৃদ্ধ, যেন সব দোষ ওরই। তিনদিন আগের। জেরিকো তাই বলছে। ইয়াসির আরাফাতের সামরিক উপদেষ্টার মেসেজ পেয়েছি আমি, আজ খুব ভোরে। জেরিকো সীমিত স্বায়ত্বশাসন পাওয়া, ফিলিস্তিনের রাজধানী।

হানান আবদুল্লাহ?

হ্যাঁ। খোলা সাগর থেকে স্রেফ হাওয়া হয়ে গেছে অতবড় জাহাজটা। কোথায় নিয়ে যাওয়া হয়েছে কে জানে! সাগরে তো নিশ্চই, আকাশ পথেও তিনদিন ধরে তন্ন তন্ন করে খুঁজছে ওটাকে আল-ফাতাহ, পাত্তাই নেই। খবর শুনে আরাফাতের মাথা খারাপ হওয়ার দশা।

 পোড়া তামাক ফেলে নতুন করে ভরলেন তিনি। ধরিয়ে পরপর কয়েকটা টান দিলেন। ওগুলো ফিলিস্তিনীদের পেতেই হবে, রানা। নইলে আরাফাতের সমস্ত পরিকল্পনা মাঠে মারা যাবে।

কাজটা ইসরাইলীদের সন্দেহ করছেন?

পাল্টা প্রশ্নে ওকে বিপদে ফেলে দিলেন বৃদ্ধ। ঘটনা তো মোটামুটি শুনলে, তোমার কমন সেন্স কি বলে? পরক্ষণে ওর ফেঁসে যাওয়া চেহারা দেখে মাথা ঝাঁকালেন। ওরাই। কোন সন্দেহ নেই।

 চুপ করে থাকল রানা। ভাবছে। বেগিন-আরাফাত শান্তি চুক্তির পর পশ্চিম তীরের জেরিকো, নাবলুস, হেবরন ও রামাল্লা এবং গাঁজার যে অংশ ফিলিস্তিনী স্বায়ত্বশাসনের অধীনে ছেড়ে দিয়েছে ইসরাইল, তাই নিয়ে স্বাধীন ফিলিস্তিন গঠন করতে তৈরি হচ্ছেন আরাফাত। ভেতরে ভেতরে জোর প্রস্তুতি চলছে।

তাকে গোপনে সমর্থন করছে কিছু আরব দেশ, অস্ত্র কেনার জন্যে প্রচুর। টাকাও দিয়েছে। কারণ স্বাধীনতা ঘোষণা করতে হলে সবার আগে অস্ত্র চাই ওদের, নইলে ইসরাইলের আক্রমণে একদিনও টিকতে পারবে না ফিলিস্তিন। সে টাকায় অস্ত্র কিনেছেন আরাফাত। ওদের ব্যাপারে বাংলাদেশ সবসময়ই সহানুভূতিশীল, চিরকাল ওদের ন্যায্য অধিকারকে সমর্থন করে আসছে। এই প্রক্রিয়ায়, ঢাকাও অংশ নিয়েছে। নগদ সাহায্য করার ক্ষমতা নেই, তাই বিনেভাড়ায় নিজের জাহাজ দিয়ে অস্ত্র বহনে সাহায্য করেছে আরাফাতকে।

কিন্তু যে করেই হোক, শেষ পর্যন্ত জানাজানি হয়ে গেছে ব্যাপারটা, কয়েক বিলিয়ন ডলারের অস্ত্রসহ উধাও হয়ে গেছে বাংলার গৌরব।

এর পিছনে ওটার গ্রীক ক্যাপ্টেনের নিশ্চই কোন হাত আছে, আবার। বললেন রাহাত খান। সাও পাওলোয় অস্ত্র তোলার আগে বেশ কিছু কাজ করা। হয়েছে জাহাজটার, নিরাপত্তামূলক আরকি! ওই সময় আমাদের দেশী ক্যাপ্টেন অসুস্থ হয়ে পড়ে হঠাৎ করে। অল্প-স্বল্প নয়, ভালরকম। তাঁকে রিপ্লেস করা ছাড়া উপায় ছিল না। কিন্তু…

নড়েচড়ে বসল ও। বুড়োকে আচমকা ব্রেক কষতে দেখে বাকিটা শোনার আগ্রহ বেড়ে গেল। কিন্তু কি, স্যার?

মাঝেমধ্যে জাহাজের ক্ষেত্রে এরকম ঘটে। কেউ বেশি অসুস্থ হয়ে পড়লে তাকে রিপ্লেস করে অন্য কাউকে নেয়া হয়, সে যে কোন দেশের হতে পারে। অভিজ্ঞ হলেই হলো। ডান চোখের পাশটা চুলকে নিলেন। তবে গুরুত্বপূর্ণ কেউ হলে তার ব্যাকগ্রাউন্ড ভালভাবে চেক করে নিতে হয়। শিপিং কর্পোরেশন এই গ্রীকের বেলায় তা ঠিকমত করেনি, করেছে দায়সারাভাবে। এ ব্যাপারে এতদিন কিছু জানায়নি ওরা আমাদের। এখন জানাচ্ছে চাপে পড়ে।

নতুন করে চেক করা হয়েছে এর ব্যাকগ্রাউন্ড?

 হ্যাঁ। আমরা করেছি। রেকর্ড ভাল নয়। অন্যমনস্কতার সুযোগে পাইপ আবার নিভে গেছে দেখে বিরক্ত হয়ে ওটা রেখে দিলেন তিনি। লোকটাকে জাহাজে তুলে দেয়ার জন্যে কোন বিশেষ মহল আমাদের ক্যাপ্টেনকে খাবারের সাথে স্লো পয়জন করে অসুস্থ করে তুলেছে।

ঝুঁকে বসল ও। বিষ!

ওপর-নিচে মাথা দোলালেন বৃদ্ধ। বিরক্তিতে চেহারা কুঁচকে উঠল। সময়মত এসব জানা গেলে হয়তো কিছু করা যেত, কিন্তু…এতসব অপদার্থ অফিসার দিয়ে চালানো হয় বলেই কর্পোরেশনগুলোর এই অবস্থা। এক বিচ্ছিরি। কাণ্ড! আমরাই সেধে ওদের প্রস্তাব দিলাম সাহায্য করব বলে, অথচ কি হয়ে গেল দেখো।

চুপ করে থাকল রানা। বৃদ্ধও ভাবনায় ডুবে গেলেন। নীরবতা ক্রমে জমাট বাঁধতে শুরু করল রূমে। এয়ার কন্ডিশনিঙের মৃদু গুঞ্জন ছাড়া আর কোন শব্দ নেই। সাউন্ড প্রাফ বলে বাইরের কোন আওয়াজ আসে না এ রূমে।

তোমাকে যেতে হবে, রানা, অকস্মাৎ বলে উঠলেন তিনি। যে ভাবে হোক জাহাজ-অস্ত্র উদ্ধার করে দেশের মুখরক্ষা করো।

 জি, স্যার।

কোত্থেকে কাজ শুরু করবে, তোমাকেই তা ঠিক করতে হবে। প্রথমে লন্ডন যেতে হবে। আরাফাতের সামরিক উপদেষ্টা ওখানে আছেন। দেখা। করবে ওর সাথে। ভদ্রলোক হয়তো আরও কিছু লেটেস্ট তথ্য দিতে পারবেন। তবে যাই করবে, আনঅফিশিয়ালী করতে হবে। ফিলিস্তিনীদের অধিকার যত ন্যায়সঙ্গতই হোক, জানাজানি হয়ে গেলে কঠিন হয়ে উঠবে পরিস্থিতি। এই ছুতোয় ইসরায়েল- হয়তো ওদের স্বায়ত্বশাসনও বাতিল করে দেবে। নতুন করে আগুন জ্বলে উঠবে মধ্যপ্রাচ্যে।ইঙ্গিতে আলোচনার সমাপ্তি টানলেন বৃদ্ধ।

সোহেলের সাথে দেখা করো। তোমার টিকেটিঙের ব্যবস্থা করে দেবে ও।

জ্বি। উঠে পড়ল রানা।

.

তিনদিন আগের ঘটনা। জেরুজালেম।

এক গভীর রাত। গুরুত্বপূর্ণ সভা চলছে প্রধানমন্ত্রীর অফিসে। প্রধানমন্ত্রী তার দুহ হন্টেলিজেন্স অ্যাফেয়ার্স অ্যাডভাইজার, প্রতিরক্ষা বাহিনী যাহাল প্রধান এবং গোয়েন্দা সংস্থা মোসাদ প্রধান রয়েছে মীটিঙে।

কয়েকজনের চেহারা ফোলা। জরুরী ডাক পেয়ে বিছানা ছেড়ে উঠে। সেছে। তবে প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন (বেঞ্জামিন) নেতানিয়াহু ও মোসাদ চীফ হয়েহুদা বেন মেহর স্বাভাবিক। চেহারায় ঘুমের কোন চিহ্ন নেই। পূর্ণ সজাগ।

অপারেশন যেনেক জাম্প নিয়ে আলোচনা চলছে। যদিও বিশেষ কিছু। নেই আজ আলোচনার। কথাবার্তা আগেই হয়ে গেছে। আজ বৈঠক বসেছে। গোপন এক তৎপরতার বিরুদ্ধে সরকারের সময়োচিত সিদ্ধান্ত, পদক্ষেপ ইত্যাদির পর যাহালের একদল কমান্ডোর মিশনের সাফল্য ও পরের করণীয় নিয়ে একমত হওয়ার জন্যে। অবশ্য সাফল্যের কথা আনুষ্ঠানিকভাবে জানানো হয়নি এখনও।

দামী দেয়াল ঘড়ি রাত দুটো ঘোষণা করতে নড়েচড়ে বসল যাহাল চীফ, মেজর জেনারেল ইয়াদ এলিয়াহুদ। মানুষটা খাটো, টাকমাথা। দেহ সুলে শুয়োরের মত, চর্বি থলথলে। ঘাড় প্রায় নেই। থুতনির নিচে তিনটে ভাজ। সামনে রাখা কালো এক ফোল্ডার কাছে টেনে আনল সে, সোনার ফ্রেমের আধখানা চাঁদের মত রীডিং গ্লাসের মধ্যে দিয়ে চোখ রেখে খুলল। হিব্রুতে টাইপ করা পুরু একটামাত্র শীট রয়েছে ভেতরে, তুলে নিল ওটা।

মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর অনুমতি নিয়ে আমি ঘোষণা করছি, হাস্যকররকম চিকন, মিকিমাউসের মত গলায় চি-চি করে বলল সে। আমাদের কমান্ডো বাহিনীর মিশন, অপারেশন যেনেক শতকরা একশো ভাগ সফল হয়েছে। অন্যদের চাপা সন্তুষ্টি আর বাহবার মধ্যে বলে চলল এলিয়াহুদ, অস্ত্রবাহী জাহাজ এখন নির্দিষ্ট গন্তব্যের পথে রয়েছে।

বোর্ডিঙের সময় কোন অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটেনি, ওরা বাধা দেয়ার সুযোগ। পায়নি। একটা বুলেটও খরচ হয়নি, প্রাণহানী দূরের কথা, কেউ সামান্যতম আহতও হয়নি। আশা করছি কাল দুপুরের আগেই ওটার জায়গামত অ্যাঙ্কর করার খবর পাওয়া যাবে। আমাদের মাদার শিপ যাচ্ছে ওদিকে। আশা করছি সপ্তাখানেক পর বাংলার গৌরবের কার্গো ওটায় রিলোড করা সম্ভব হবে।

কয়েক সেকেন্ড নীরবতার পর মুখ খুলল মোসাদ চীফ। মন্তব্য করল, সময় আরেকটু এগিয়ে আনা গেলে ভাল হত। মাথা দুলিয়ে তাকে সমর্থন জানাল প্রধানমন্ত্রী। এধরনের কাজ যত তাড়াতাড়ি শেষ করা যায় তত ভাল।  

হ্যাঁ। তবে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী ও সভাসদরা নিশ্চই জানেন যে একেবারে শেষ মুহূর্তে বাংলাদেশী জাহাজটা তার রুট বদলেছে। সাউথ আটলান্টিক দিয়ে না এসে নর্থ প্যাসিফিক ঘুরে এসেছে। প্রথমে আমাদের প্ল্যান ছিল মোজাম্বিক চ্যানেলে ওটার পথরোধ করার, কিন্তু তা হয়নি। ওটা ঘুরপথে রওনা হতে নতুন হাইডিং প্লেস ঠিক করতে হয়েছে আমাদের হুড়োহুড়ি করে। আনুষঙ্গিক আরও হাজারটা ঝামেলা ছিল। তারওপর বাংলার গৌরব প্রায় ডবল স্পীডে ছুটেছে, কিন্তু আমাদের সে উপায় ছিল না। তেমন কিছু করতে গেলে আরাফাতের আরব বন্ধু দেশগুলোর সন্দেহ হত। তাই, গাল চুলকাল এলিয়াহুদ।

প্রধানমন্ত্রীর দিকে তাকিয়ে চোখ পিট পিট করল। একটু পিছিয়ে পড়েছি আমরা। শিপ পিছনে ফেলে এগিয়ে যেতে হয়েছে কমান্ডোদের। তবু, এত অসুবিধের মধ্যেও যে কাজটা ওরা শেষ পর্যন্ত করতে পেরেছে, তাই যথেষ্ট।

ঠিক। সন্তুষ্ট দেখাল প্রধানমন্ত্রীকে। ধীরে ধীরে হাসি ফুটল মুখে। বেশ ভালই দেখিয়েছে ওরা। গুড!

বুকের ছাতি ফুলে উঠল এলিয়াহুদের। যেনেকের কমান্ডার পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ কমান্ডো, মিস্টার প্রাইম মিনিস্টার। ওর জুড়ি নেই।

কি যেন নাম?

আপনার নেমসেক হাসল যাহাল চীফ। ইয়েহোনাথান (জোনাথন) নেতানিয়াহু। সার্ভিসে কর্নেল ইয়োন্নি নামে ডাকে সবই।

ওদের সাফল্যের সম্মানে টোস্ট করার প্রস্তাব রাখছি আমি, ইয়েহুদা বেন মেইর বলল।

নিশ্চই, নিশ্চই! সম্মতি দিল প্রধানমন্ত্রী।

একটু পর যে যার শ্যাম্পেনের গ্লাস তুলে ধরল, এলিয়াহুদের উদ্দেশে এক চোখ টিপে হাসল মোসাদ চীফ। লেচাইম (চিয়ার্স)!

.

এক ঘণ্টা পর। বাংলার গৌরব।

আঁধার চিরে অজ্ঞাত গন্তব্যের উদ্দেশে ছুটে চলেছে ফ্রেইটার। ভোর হতে বেশি দেরি নেই। পোর্ট সাইড ব্রিজ উইঙে দাঁড়িয়ে সিগারেট টানছে কমান্ডো নেতা কর্নেল নেতানিয়াহু ওরফে ইয়োন্নি। দুপাশে দুই সঙ্গী। ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা নিয়ে কথা বলছে ওরা নিশ্চিন্তে। শুনে ফেলার কেউ নেই কাছেপিঠে।

ফার্স্ট অফিসারকে আটকে রাখা হয়েছে চেইন লকারে, ক্যাপ্টেনসহ অন্যদের ত্রুজ মেসে।

নিজের ছোট, তবে খুবই শক্তিশালী ট্রান্সিভারে একটা মেসেজ রিসিভ করল ইয়োনি। জেরুজালেম থেকে মাদার শিপ হয়ে এসেছে। আরেক নেতানিয়াহু পাঠিয়েছে ওটা, ইসরায়েলের সবচেয়ে ক্ষমতাধর ব্যক্তি। সংক্ষিপ্ত মেসেজ কল হাকাভদ (ওয়েল ডান)!

মৃদু হাসি ফুটল কমান্ডারের অভিব্যক্তিহীন মুখে। শুধু মুখেই, চোখ পর্যন্ত পৌঁছল না হাসিটা। পৌঁছায় না কখনও।

 *

মেশিনগানের টানা হুঙ্কারে পথ ভুলে গেছে যেন মরুর তপ্ত বাতাস, কোন পথে যাবে বুঝতে না পেরে স্থির হয়ে গেছে। সূর্য ওপর থেকে গনগনে আগুন ঢালছে।

মাথার বড়জোর দুইঞ্চি ওপর দিয়ে শিস কেটে ছুটে যাচ্ছে ঝাঁক ঝাঁক বুলেট, বাধ্য হয়ে বালিতে নাক ঢুকিয়ে কাঁটাতারের আঁকাবাকা প্রতিবন্ধক এড়িয়ে এগোতে হচ্ছে যুবককে। মাথা একচুল তোলার উপায় নেই। বালিতে মুখ ভরে গেছে, ঘামে জবজবে ড্রিল শার্ট দেখে বোঝা যায় না ওটা সত্যিই শার্ট, না চামড়া।

নোনতা ঘাম দৃষ্টিপথ আড়াল করে রেখেছে বলে পরিষ্কার দেখতে পাচ্ছে না সে। প্রায় অন্ধের মত সামনে ছুটছে, বড়সড় গিরগিটি যেন একটা। গলা। শুকিয়ে কাঠ, পানির জন্যে বুকের ছাতি ফেটে যাচ্ছে, অথচ সেদিকে খুব একটা খেয়াল নেই জামাল শামলুর। ট্রেনিং রানের প্রায় শেষ মাথায় পৌঁছে গেছে সে। আরেকটু গেলেই দৌড় শেষ।

কেবল দৌড় শেষ করলেই চলবে না, আজ ফার্স্ট হতে চায় সে। একজন সাচ্চা যোদ্ধা হতে চায়। দেখতে চায় আল-ফাতাহর কমান্ডিং অফিসারের মুখে নিজের নাম উচ্চারিত হওয়ার সময় যেন গর্ব আর সন্তুষ্টির ছোঁয়া ফোটে। একটা সুযোগ চায় জামাল একান্ত আপনজনদের নির্মম হত্যাকাণ্ডের প্রতিশোধ নেয়ার।

শাতিলা রিফিউজি ক্যাম্পে ইসরাইলী সৈন্যরা কুকুরের মত গুলি করে মেরেছিল ওঁর নিরীহ মা-বাবাকে, ভাইকে। আরও শ শ নিরপরাধ ফিলিস্তিনীকেও। ছোট ছিল জামাল, স্রেফ ভাগ্যের জোরে বেঁচে গেছে। কিন্তু ছোট চোখে সেদিন যা দেখেছে ও, আজও সে স্মৃতি জ্বলজ্বল করছে। রক্তের সাগর বইয়ে দিয়েছিল ওরা সাবরা-শাতিলা ক্যাম্পে। কুকুরকেও অত নির্দয়ভাবে মারে না বোধহয় মানুষ।

একেবারে আচমকা ক্যাম্পে ক্যাম্পে ঢুকে নামাজে বসা, খেতে বসা, ঘুমিয়ে থাকা মানুষকে নির্বিচারে গুলি করেছে সেদিন ইসরাইলী সৈন্যরা, নিশ্চিন্তে মায়ের বুকের দুধ খেতে থাকা শিশুকে মেরেছে, মাকেও মেরেছে। অসহায় ফিলিস্তিনীদের বুকফাটা কান্নায় সেদিন আল্লার আরশ কেঁপেছে কি না জামাল জানে না, তবে ওর ছোট্ট বুক কেঁপে গিয়েছিল ভীষণভাবে। মার রক্তাক্ত মৃতদেহ জড়িয়ে ভয়ে কাঠ হয়ে পড়ে ছিল উপুড় হয়ে। চারদিকে এত চিৎকার, এত ছোটাছুটি, কান্না আর গুলির শব্দে পালাতে সাহস হয়নি। ভাগ্য ভাল, ওকে অনড় দেখে মরে গেছে ভেবে আর গুলি খরচ করেনি ইসরাইলীরা।

বেঁচে গেল জামাল শামলু। সে কবেকার কথা, অথচ আজও শান্তিতে ঘুমাতে পারে না ও। চমকে চমকে ওঠে ঘুমের মধ্যে, মার যন্ত্রণাকাতর মুখ ভেসে ওঠে চোখের সামনে। বাবা, বড় ভাই জালালের চেহারা ভেসে ওঠে। জালাল রুটি খাচ্ছিল তখন। বুলডোজার এসে যখন লাশ গণকবরে নিয়ে যাচ্ছে, তখনও ওর দাঁতের ফাঁকে খানিকটা রুটি আটকে ছিল, দেখেছে জামাল। পরিষ্কার মনে আছে।  

তারপর দিন যত গড়িয়েছে, ওর প্রতিজ্ঞাও তত মজবুত হয়েছে। প্রতিশোধের আগুন দাউ দাউ করে জ্বলছে বুকে। রক্ত চাই জামাল শামলুর, অনেক রক্ত। ইহুদীর রক্তে গোসল না করা পর্যন্ত শান্তি নেই ওর। সে সুযোগ এসেছে আজ। আজই ওর ট্রেনিঙের শেষ দিন, ওকে আজ প্রমাণ করতে হবে…। আরও দ্রুত এগোতে চেষ্টা করল যুবক। বাড়তি চাপ পড়ায় নির্যাতিত প্রতিটা পেশী তীব্র আর্তনাদ করে উঠল, খেয়ালই নেই সেদিকে।

হঠাৎ পাশেই আর কারও ঘন, ভারী নিঃশ্বাস পতনের শব্দ উঠতে ঘুরে তাকাল সে। দারভিশ হামামকে দেখতে পেয়ে রাগে; হতাশায় অস্থির হয়ে উঠল। সার্জেন্ট হামাম। বিশালদেহী এক দানব। বয়স ত্রিশের মত। চওড়া, নিরেট পাথরের মত মজবুত কাঁধ , চৌকো চোয়াল। প্রতিজ্ঞায় দৃঢ় সংঘবদ্ধ পাতলা ঠোঁট। ওর মত নতুন রিক্রুটদের ঘষেমেজে তৈরি করছে সে।

দারভিশ হামাম স্পেশাল ফোর্সের সদস্য, জানে শামলু। ফিলিস্তিন কমব্যাট সুইমার ইউনিটের কমান্ডার। ট্রেইনীরা যেমন শ্রদ্ধা করে তাকে, তেমনি ভয়ও পায় বাঘের মত। ট্রেনিঙের সময় বাঘের মতই কড়া মানুষটা। কোনদিনও একে হারাতে পারেনি শামলু, ইউনিটের কেউ পারেনি। শেষ মুহূর্তে ঠিকই সবাইকে পিছনে ফেলে দেয়।

কিন্তু আজ…আরও দ্রুত এগোতে চেষ্টা করল যুবক। বুলেটের পরোয়া না করে বেশ খানিকটা উঁচু হলো সুবিধে হবে ভেবে। সেকেন্ডে সেকেন্ডে চুলে গরম নিঃশ্বাস ছেড়ে ছুটে যাচ্ছে ধাতব মৃত্যু, পরোয়া নেই।

নিচু হও! ধমকে উঠল সার্জেন্ট। নিচু হও, গাধা কোথাকার!

হলো সে, তবে গতি প্রায় আগের মতই থাকল। শেষ পর্যন্ত দুইঞ্চির ব্যবধানে জিতেই গেল জামাল। ওর ব্যগ্রতা দেখে যে নিজের গতি ইচ্ছে করে কমিয়ে দিয়েছে সার্জেন্ট, বুঝতে পারেনি।

অভিনন্দন! নিজের পিঠে সার্জেন্টের শক্ত হাতের চাপড় খেয়ে কষ্ট ভুলে গেল জামাল। ঘাম মোছার ফাঁকে উদ্ভাসিত হাসিমুখে ঘুরে তাকাল। খুব ভাল করেছ তুমি, জামাল। চমৎকার! আমি খুব খুশি হয়েছি।

বুকের মধ্যে আনন্দের বান ডাকল যুবকের, আবেগের বশে সার্জেন্টের হাতের উল্টোপিঠে চুমু খেল সে। ধন্যবাদ, সার্জেন্ট।

আমাকে ধন্যবাদ দেয়ার কিছু নেই, সব কৃতিতু তোমার, তোয়ালে দিয়ে। মুখের ঘাম মুছল দারভিশ হামাম। কিন্তু শেষ সময় তুমি আজ যা করেছ, আর কখনও কোরো না। খবরদার! তোমাকে বেঁচে থাকতে হবে, প্রতিশোধ নিতে হবে, ভুলো না।

চোয়াল দৃঢ় হয়ে উঠল জামাল শামলুর, চাউনি কঠোর হয়ে উঠল। প্রায় ফিস ফিস করে বলল সে, ভুলব না।

যুবক স্বপ্নেও কল্পনা করেনি এর মাত্র চব্বিশ ঘণ্টা পর কামনা পূরণ হতে যাচ্ছে তার।

<

Super User