২১.

 বোমাটা টেবিলে রেখে দড়ি বের করল উইক। গোরোর হাত-পা বাঁধল শক্ত করে। বলল, হ্যাঁ, গোরো, ঠিকই বলেছ, ছেলেগুলো আমার বন্দি। এখন তুমিও হলে। আসলে বন্দি তুমি সব সময়ই ছিলে, কিন্তু গবেষণায় এতটাই ডুবে ছিলে, বুঝতে পারোনি সেটা।

সোজা হলো উইক। চোখ জ্বলছে। নিমেষে কেমন বদলে গেছে। ভাবভঙ্গি। কঠিন গলায় বলল, বোমা বানাতে কতখানি সফল হলে, নিজের আবিষ্কারের ফল এখন নিজেই পরখ করতে পারবে। তুমি ভাগ্যবান, তাই না? এতবড় সুযোগ কটী মানুষে পায়?

ভাঙা গলায় গোরো বলল, মাথা খারাপ হয়ে গেছে তোমার, উইক, বদ্ধ উন্মাদ হয়ে গেছ! এ সব করে বাঁচতে পারবে না তুমি

 তাই নাকি? দেখা যাবে। তবে তার আগে তোমার মুখটা বন্ধ করা দরকার।

এক টুকরো কাপড় এনে গোরোর মুখে ঠেসে ভরে দিল উইক। এইবার আমার আসল কাজ চলবে। জোরে একটা নিঃশ্বাস ফেলে বলল, আমার সহকারীগুলো ধরা পড়ে সর্বনাশ করে দিল। থাকলে এখন সাহায্য হত।

আতঙ্কিত চোখে তাকিয়ে তাকিয়ে দেখল বন্দিরী, পকেট থেকে কয়েক টুকরো তার বের করল উইক। কালো বাক্সটার ওপর ঝুঁকে বসে কাজ শুরু করল। দ্রুত নড়াচড়া করছে তার আঙুল, তরগুলোকে যুক্ত করে দিচ্ছে। বাক্সের অ্যান্টেনার সঙ্গে। তারপর বাক্সটা নিয়ে গিয়ে রাখল ঘড়িটার কাছে। তারের অন্য মাথা যুক্ত করল ঘড়ির সঙ্গে। কাঁধের ওপর দিয়ে ফিরে তাকিয়ে বলল, দেখলে গোরো, কেবল তুমিই নও, এ সব কাজ আমিও করতে পারি।

কাজ শেষ করে উঠে দাঁড়াল উইক। নাটকীয় ভঙ্গিতে বিশাল ঘড়িটা দেখাল বন্দিদের। সময়টা দেখে রাখো। তিনটায় সেট করে দিয়েছি। ঘন্টার কাটী যখন তিনের ঘরে পৌঁছবে, ফেটে যাবে বোম।

ঘড়ির দিকে তাকিয়ে আছে দুই গোয়েন্দা। একটা বেজে গেছে। মনে। পড়ল সেই কথা: ঘড়ির সাহায্যে সারা হবে কাজটা…

যেন ওদের মনের কথা পড়তে পেরেই উইক বলল, সেদিন রেস্টুরেন্টে কি কথা শুনেছিলে মনে আছে? ঘড়ির সাহায্যে সারা হবে কাজটী। এখন। বুঝলে তো কি সারা হবে? সন্তুষ্টির হাসি হাসল সে। তবে সেদিন তোমাদের ওড়ানোর কথা বলিনি, কেবল বাড়িটা ধসিয়ে দেয়ার আলোচনা করছিলাম। কল্পনাই করিনি, সময় মত তোমরাও এসে হাজির হবে, কাজ সহজ করে দেবে আমার। এক ঢিলে দুই পাখি মারা হয়ে যাবে। আজকের পর আর কোনদিন আমার কাজে নাক গলাতে আসতে পারবে না তোমরা। ওই বিরক্তিকর ককারটাও না।

মাথা ঠাণ্ডা রাখো, ভয় পেলে সর্বনাশ হবে!–নিজেকে বোঝাল কিশোর। হাত-পায়ের বাঁধন খোলার জন্যে টানাটানি শুরু করেছিল। ককারের কথা বলতেই কান খাড়া করল।

ককার! কোথায় আছেন ব্যাংকার! তাঁকেও এ বাড়িরই কোনখানে। আটকে রাখেনি তো উন্মাদটী!

রবিনও বাঁধন খোলার চেষ্টা করল। এটে বসল আরও দড়ি।

দেখে হাসল উইক, করো, চেষ্টা করা ভাল। তবে লাভ হবে না। অত। কাঁচা কাজ করি না আমি। নিজে নিজে যদি খুলতে পারো, বেরিয়ে যাও, বাধা দেব না।

কিশোরও বুঝল, খুলতে পারবে না। অহেতুক আর সেই চেষ্টা করল না।

ওদের ব্যর্থ হতে দেখে মজা পাচ্ছে যেন উইক। বলল, কি করে এই গুপ্তঘরটা আবিষ্কার করলাম, জানার কৌতূহল হচ্ছে নিশ্চয়? সে-জন্যে গোরোকে ধন্যবাদ দিতেই হয়।

কি করে চোরাই মাল লুকানোর জন্যে একটা জায়গা খুঁজতে খুঁজতে রিভেরা হাউসটার ওপর চোখ পড়ে উইকের, খুলে বলল। মাল রাখতে এসেই একদিন দেখা হয়ে গেল গোরোর সঙ্গে।

গোরো বলল, সে নাকি ফ্রান্সিস রিভেরার খালাত ভাই। ছোটবেলা থেকেই এ বাড়ির সবখানে খেলা করেছে, গুপ্তঘরগুলো সব চেনে। ঘড়ি-ঘরে ঢোকার একটা চাবিও আছে তার কাছে। আবিষ্কারের নেশা আছে তার। রিভেরা মারা যাওয়ার পর তার মনে হলো, তাই তো, গুপ্তঘরটায় গিয়ে গবেষণা করলে তো মন্দ হয় না। বিরক্ত করতে আসবে না লোকে। মন দিয়ে কাজ করা যাবে। সেজন্যেই এসেছিল। দেখা হয়ে গেল আমার সঙ্গে।

আমি ভাবলাম, তাকে কাজে লাগানো দরকার। ঘরটা খুলে দিতে সে আমাকে সাহায্য করবে। সেই ঘরে মাল রাখলে নিজের অজান্তে সেগুলো পাহারাও দেবে। তাকে লোভ দেখলাম, আমি একটা ল্যাবরেটরি বানিয়ে দিতে পারি। নতুন ধরনের যে কোন আবিষ্কার করতে পারলে সেটা বাজারজাত করতে সাহায্য করতে পারি। আমার টোপ গিলে নিল সে।

তারপর থেকে নিশ্চিন্তে ওখানে চোরাই মাল রাখতে লাগলাম। গবেষণা নিয়েই ব্যস্ত থাকত গোরো। আমি কি এনে রাখলাম না রাখলাম তা নিয়ে মাথা ঘামাত না। চোখ তুলেও দেখত না। ভালই চলছিল। বাদ সাধল একদিন ককার। বাড়িটা কিনে নিল। বিপদে পড়ে গেলাম। তাকে না তাড়ালেই নয়। হুমকি দয়ে নোট লিখে রেখে এলাম তার গুপ্তঘরে। সেগুলো পেয়েই সে তোমাদের ডেকে আনল।

দম নেয়ার জন্যে থামল উইক। শয়তানি হাসি ফুটল চোখের তারায়। নিশ্চয় ভাবছ, কি করে ওই বদ্ধ ঘরে নোট রেখে এলাম? সে কথা বলছি না। তোমাদের। এই একটা কৌতূহল নিয়ে মরতে হবে তোমাদের, কোনদিনই জানতে পারবে না।

হ্যারিস এসেছিল যে রাতে, সে-রাতে একটা ভয়ানক চিৎকার শুনেছ তোমরা। আমিই করেছি চিকরিটী। ভয় দেখিয়ে বুড়োটাকে তাড়ানোর জন্যে। যে ভাবে ছোঁক ছোঁক করছিল, ওকে তাড়ানোর আর কোন উপায় ছিল না।

ঘড়ির দিকে তাকাল উইক। দুটো বাজতে পনেরো মিনিট বাকি। আপন মনেই বলল, নাহ, আর দেরি করা যায় না। এবার যেতে হয়। সময় থাকতেই দূরে সরে যাওয়া উচিত।

ঘড়ির পেছনের গুপ্তঘরটায় গিয়ে ঢুকল সে। বাক্স ফেলার শব্দ কানে আসতে লাগল গোয়েন্দাদের। কয়েক মিনিট পর ক্যানভাসের একটা বড় ব্যাগ কাঁধে ঝুলিয়ে বেরিয়ে এল উইক।

বাইরে ঝিলিক দিয়ে উঠল তীব্র আলো। মূহর্ত পরে বজ্রপাতের বিকট শব্দে থরথর করে কেঁপে উঠল বাড়িটা। তারপর নামল বৃষ্টি। মুষলধারে।

ঝড় আসছে, উইক বলল। এবার বিদায় নিতে হয় তোমাদের কাছে। এগোতে গিয়েও দাঁড়িয়ে গেল সে। ও হ্যাঁ, আরেকটা কথা। পান্নাগুলো কোথায় আছে ভাবছ তো? কাঁধের ব্যাগটাতে চাপড় দিল সে। এটার মধ্যে। আলোটা জ্বেলে রেখে যাচ্ছি যাতে ঘড়ির কাঁটা দেখতে পাও। চলি। গুডবাই।

বেরিয়ে গেল সে। সামনের দরজা খুলে বন্ধ হওয়ার শব্দ শোনা গেল।

বাইরে ঝড়ের তাণ্ডব।

তারমধ্যেও কানে আসছে বিশাল ঘড়িটী চলার জোরাল শব্দ:

 টিক-টক! টিক-টক! টিক-টক!

.

২২.

 সময় কাটছে। কাটছে না বলে বলা যায় উড়ে চলেছে। এমনই হয়। সময় দ্রুত কাটার জন্যে যখন অপেক্ষা করে মানুষ, তখন মনে হয় কাটছেই না। বড় ধীরে গড়িয়ে গড়িয়ে চলে। আর এখন যখন ওরা চাইছে না কাটুক, তখন যেন ছুটছে ঘড়ির কাটা।

কি করে যে পৌনে তিনটে বেজে গেল, টেরই পেল না।

জানোয়ার! দাঁতে দাঁত চাপল কিশোর। এ ভাবে আমাদেরকে ছিন্নভিন্ন হওয়ার জন্যে ফেলে গেল!

হাতে-পায়ে কেটে বসছে দড়ি। মরিয়া হয়ে টানাটানি শুরু করল ঢিল করার জন্যে। সেই একই অবস্থা। লাভ হলো না। সামনের দিকে ছুঁড়ে দেয়ার চেষ্টা করল নিজেকে, যাতে চেয়ার নিয়ে উপুড় হয়ে পড়ে। যাতে বোমাটার কাছাকাছি যেতে পারে।

এতেও কাজ হলো না।

রবিন শরীর মোড়ামড়ি করে হাতটাকে নিয়ে যেতে চাইছে তার পকেটের পেন্সিল কাটার ছোট ছুরিটার কাছে। সেটা আরও অসম্ভব মনে হলো। পকেটের ধারেকাছেও যাচ্ছে না আঙুল।

চুপ করে একই ভাবে পড়ে আছে গোরা। মেনে নিয়েছে যেন এই ভয়াবহ পরিণতি। এই অবস্থার জন্যে মনে মনে নিজেকে দোষারোপ করছে। কিনা বোঝা যাচ্ছে না।

এগিয়ে যাচ্ছে ঘড়ির কাঁটা।

আতঙ্কিত চোখে দেখল ছেলেরা, তিনটা বাজতে আর মাত্র পাঁচ মিনিট বাকি!

চেয়ারে হেলান দিল ওরা। ধসে পড়ল যেন শরীরটা। হাতলের ওপর ঢিল হয়ে গেল আঙুলগুলো। আর কোন আশা নেই!

প্রচণ্ড শব্দে বাজ পড়ল। কাঁপিয়ে দিল বাড়িটাকে। ধীরে ধীরে মিলিয়ে গেল শব্দ। সামনের বড় জানালাটায় দৃষ্টি যেন আটকে গেছে রবিনের। একটা নড়াচড়া দেখতে পাচ্ছে যেন।

দূর, আতঙ্কে মাথা গরম হয়ে গেছে!–ভাবল সে।

কিন্তু চোখ সরাতে পারল না। তারপর যা দেখল, বিশ্বাস করতে পারল না নিজের চোখকে। কাচের ওপাশে একটা মুখ। অতি পরিচিত। মুসার!

হাঁ করে তাকিয়ে আছে রবিন।

 ঝনঝন করে জানালার কাচ ভাঙল। পাল্লা খুলে ঘরে ঢুকল মুসা।

ঘড়ি দেখল কিশোর। আর মাত্র দুই মিনিট। বলল, জলদি করো মুসা! চেঁচিয়ে বলার চেষ্টা করল, কিন্তু জোর নেই গলায়। বোমা লাগানো আছে! দুই মিনিট পরেই ফাটবে! রবিনের পকেটে ছুরি আছে! আগে আমার দড়ি কাটো!

দৌড়ে এল মুসা। কয়েকটা মুহূর্তের জন্যে সময় যেন স্থির হয়ে গেল। ঘোরের মধ্যে যেন মূসাকে দড়ি কাটতে দেখল কিশোর। মুক্ত হওয়ার পর আর একটা সেকেণ্ড দেরি করল না। লাফ দিয়ে উঠে প্রায় ডাইভ দিয়ে গিয়ে পড়ল ঘড়িটার কাছে। হ্যাঁচকা টানে ঘড়ির সঙ্গে যুক্ত বোমার তারগুলো ছিঁড়ে বিচ্ছিন্ন করে দিল। এতক্ষণ পর রক্ত চলাচল শুরু হয়েছে পায়ে। বিচিত্র একট যন্ত্রণা। শরীরের ভার রাখতে পারল না আর পা দুটো। ধপাস করে পড়ে গেল মেঝেতে।

ঘড়িটার দিকে তাকিয়ে আছে সে।

ঢঙঙ! ঢঙঙ! টঙঙ!

তিনবার বাজল ঘণ্টা। কিছুই ঘটল না। স্বস্তিতে চোখ মুদল কিশোর।

 দড়ি কেটে অন্য দুজনকেও মুক্ত করে ফেলল মুসা।

গোটা দুই গোঙানি দিয়ে উঠে বসল গোরো। কাঁপা খসখসে গলায় বলল, আহ, বাঁচালে! ঈশ্বরের দূত হয়ে এসেছ নাকি তুমি!

 চেয়ারে বসে থেকেই রক্ত চলাচল স্বাভাবিক হওয়ার সময় দিল রবিন। তবে মুখে গোঁজা কাপড়টা টেনে খুলে ফেলল। কোটি কোটি ধন্যবাদ দিলেও ওর ঋণ শোধ করতে পারব না আমরা! যমের দুয়ার থেকে ফিরিয়ে এনেছে!

দুই হাত তুলে নাড়তে লাগল মুসা, আরি বাবারে, থামো না! প্রশংসার। ঠেলায় তো পাগল হয়ে যাব! হয়েছিলটা কি?

আমাদের কথা বলার অবস্থা নেই এখন। তুমি কি করে এলে, আগে সেই কথা বলো।

সন্ধ্যায় স্যালভিজ ইয়ার্ডে গিয়ে শুনলাম, দুপুরে খেয়েই বেরিয়ে গেছ। অপেক্ষা করতে লাগলাম। যতই রাত হতে লাগল, তোমরা ফিরলে না, মেরি আন্টির সঙ্গে সঙ্গে আমারও দুশ্চিন্তা বাড়তে থাকল। মাঝরাতেও যখন দেখা নেই তোমাদের, আর থাকতে পারলেন না আন্টি। পুলিশকে ফোন করলেন। ওরাও কিছু বলতে পারল না। ইয়ান ফ্লেচার অফিসে নেই। যে অফিসার ধরল, সে কথা দিল খুজতে বেরোবে। তবে কখন বেরোতে পারবে, বলতে পারল না। অস্থির হয়ে পড়লাম। হঠাৎ করেই মনে হলো রিভেরা হাউসের কথা। তাই তো, ওখানে গিয়ে কোন বিপদে পড়েনি তো!

এটা ভাবার জন্যে আরেকবার তোমাকে ধন্যবাদ, মুসা, কিশোর বলল। এই কালো জিনিসটা দেখছ? একটা সাংঘাতিক বোমা। তুমি আসতে যদি আর কয়েক মিনিট দেরি করতে, এতক্ষণে এই বাড়িটার সঙ্গে সঙ্গে আমরাও ছিন্নভিন্ন হয়ে যেতাম। ই খাইছে! ভয়ে ভয়ে বাক্সটার দিকে তাকাতে লাগল মুসা, বলো কি! এই শয়তানিটা কে করল? ফাটার ভয় নেই তো আর?

না, নেই, মাথা নেড়ে বলল গোরো। দুর্বল ভঙ্গিতে উঠে দাঁড়াল। বোমাটা নেয়ার জন্যে এগোল।

আপনি ঠিক আছেন তো, মিস্টার কিনডার? সাংঘাতিক জোরে মেরেছে। আপনাকে উইক শয়তানটা!

আমি ঠিকই আছি। তোমাদের কাছে আমি কৃতজ্ঞ। তোমরা না থাকলে আজ আমাকে মরতে হত। আমাকে ভেতরে রেখে বোমা ফিট করে চলে যেত। সব আমার দোষ। ওর কথা বিশ্বাস করে এত ভয়ঙ্কর একটা জিনিস বানীতে গেলাম কেন?

আপনি তো আর খারাপের জন্যে বানাননি, ভালর জন্যে বানিয়েছেন। উইক যে আপনার সঙ্গে বেঈমানি করবে, ওদের শয়তানির সমস্ত প্রমাণ নষ্ট করে দেয়ার জন্যে বাড়ি উড়িয়ে দিতে চাইবে, সেটা জানতেন না। অতএব দুঃখ পাওয়ার কিছু নেই। তা ছাড়া আমাদের কোন ক্ষতিও হয়নি। বহাল তবিয়তে আছি সবাই।

এইবার বলে ফেলো তো সব, তাগাদা দিল মুসা। আর টেনশনে থাকতে রাজি নই।

সে-সব পরে শুনলেও হবে। বিপদ এখনও শেষ হয়নি। লুকিয়ে পড়তে হবে আমাদের। নিশ্চয় দূরে কোথাও অপেক্ষা করবে উইক, দেখবে বাড়িটী ধ্বংস হলো কিনা। বোমা ফাটার শব্দ না পেলে কি হলো দেখার জন্যে আবার ফিরে আসতে পারে।

মাথা ঝাঁকাল রবিন, তাই তো! এ কথা তো ভাবিনি! ওর কাছে পিস্তল থাকতে পারে। এবার এলে আর বাঁচতে দেবে না আমাদের।

উদ্বিগ্ন হলো মুসা, কোথায় লুকাব?

গুপ্তঘরটার দিকে হাত তুলল কিশোর।

ঘড়ির পেছনের ফোকরটা এতক্ষণ নজরে পড়েনি মুসার। দেখে হাঁ হয়ে গেল। খাইছে! ওটা আবার কি?

এসো। গেলেই দেখবে।

ছেলেদেরকে টর্চ জ্বালতে বলে সুইচ টিপে আলো নিভিয়ে দিল গোরো। সবাইকে নিয়ে গুপ্তঘরটার দিকে এগোল। সবার শেষে ঢুকল রবিন। কি করে ফোকরের দরজা বন্ধ করতে হবে, বলে দিল গোরো। বন্ধ করল রবিন। সামান্য ফাঁক রেখে দিল, বাইরের ঘরে কি ঘটছে দেখার জন্যে।

.

২৩.

ঘরটা দেখল ছেলেরা। বেশ বড়। মোটা পাইপ দিয়ে বাতাস চলাচলের ব্যবস্থা করা হয়েছে। মনে হলো, অন্য গুপ্তঘরটাও রয়েছে এটার ঠিক ওপরে। টর্চের আলোয় দেখা গেল কিছু আসবাব, কাজের বেঞ্চ, কিছু যন্ত্রপাতি, একটা হট প্লেট আর একটা খুদে রেফ্রিজারেটর।

বাহ, সুবিধা তো ভালই আছে, রবিন বলল।

 এটা আমার ল্যাবরেটরি, গোরো বলল। খারাপ বলা যাবে না।

দরজার কাছে ঘাপটি মেরে রইল ওরা। ইয়ার্ড থেকে বেরোনোর পর যা যা ঘটেছে, মুসাকে বলার সুযোগ পেল রবিন আর কিশোর।

তিনজনে মিলে ভাবতে লাগল, ককার কোথায় আছে। কিন্তু এ মুহূর্তে বাড়িটা খুঁজে দেখার জন্যে বেরোতে সাহস পেল না। বসে আছে উইকের অপেক্ষায়।

থেমে এসেছে বিদ্যুৎ চমকানো। বজ্রপতি আরও আগেই বন্ধ হয়েছে। অন্ধকার নিঃশব্দতার মধ্যে এখন বেশি করে কানে বাজছে:

টিক-টক! টিক-টক! টিক-টক!

কিন্তু শব্দটা এখন কিশোরদের কাছে ভীতিকর নয়।

হঠাৎ স্নায়ু টানটান হয়ে গেল ওদের। সামনের দরজা খোলার শব্দ শুনেছে। লিভিং রুমে ঢুকল পদশব্দ। আলো জুলল।

দরজার ফাঁকে চোখ রাখল রবিন। মোলায়েম গলায় বলল, উইক!

অন্যেরাও গাঁ ঘেষাঘেষি করে এল ফাঁকে চোখ রাখার জন্যে। থমকে দাঁড়াল ঘড়িটার দিকে তাকিয়ে। ছেঁড়া তারগুলো দেখল। যে চেয়ারে বন্দিরা বাঁধা ছিল, ওগুলো দেখল শূন্য। কাটা দড়ি পড়ে আছে মেঝেতে।

ধরতে বেরোব নাকি? জিজ্ঞেস করল রবিন।

মাথা নাড়ল কিশোর, এখন না।

উন্মাদ হয়ে গেল যেন উইক। রাগে লাল হয়ে গেল মুখ। হ্যাঁচকা টানে একটা চেয়ার তুলে মেঝেতে বাড়ি মেরে ভাঙল। চিৎকার করে বলতে লাগল, পালিয়েছে! কি ভাবে…

টান দিয়ে পকেট থেকে পিস্তল বের করল। ছাতের দিকে তুলে ট্রিগার টিপতে শুরু করল। ম্যাগাজিনের গুলি শেষ না করে থামল না।

খালি করে ফেলেছে! ফিসফিস করে বলল রবিন। ভাল!

পিস্তলটা মেঝেতে আছড়ে ফেলে চারপাশে তাকাতে লাগল উইক। দুচোখে উন্মাদের দৃষ্টি। আচমকী হেসে উঠল অট্টহাসি। হুমকি দিয়ে নোট রেখে আসার কথা প্রমাণ করতে পারবে না ওরা, যদি আমি আবিষ্কারটা ধ্বংস করে দিইগোরোর মহামূল্যবান আবিষ্কার…– ঘর থেকে ছুটে বেরিয়ে গেল সে। দুড়দাড় করে সিঁড়ি বেয়ে উঠতে শুরু করল।

না না! দম আটকে যাবে যেন গারোর। ওকে এ কাজ করতে দেয়া যাবে না! আটকাতে হবে!

চলুন! সোজা হয়ে দাঁড়াল কিশোর।

গুপ্তঘর থেকে বেরিয়ে এল চারজনে। দৌড়ে ঢুকল সামনের হলঘরে।

অন্ধকার সিঁড়িতে শোনা গেল উইকের গর্জন, বিচ্ছুর দল! সর্বনাশ করে দিয়েছে সব! আমি ওদের ছাড়ব না!

সিঁড়িতে পা রাখল গোরো। নিঃশব্দে উঠতে শুরু করল। তাকে অনুসরণ করল তিন গোয়েন্দা। আবিষ্কার বাঁচানোর জন্যে এতটাই মরিয়া হয়ে উঠেছে বুড়ো মানুষটা, ছেলেদেরও পেছনে ফেলে দ্রুত উঠে যাচ্ছে।

মিস্টার কিনডার, সাবধান! ডেকে বলল রবিন।

ছাতে ওঠার আগেই শয়তানটাকে থামাতে হবে!

 সিঁড়ির মাথায় এসে দম নেয়ার জন্যে থামল সে।

পাশে এসে দাঁড়াল তিন গোয়েন্দা।

ওপরে তাকাল কিশোর। আরও সিঁড়ি আছে। চিলেকোঠায় উঠে গেছে। ওপরের দিকে করে টর্চ জ্বালল। আলোক রশ্মিতে ধরা পড়ল উইক। শিপরিজের মুখ, মুখ বিকৃত করে নিচের দিকে তাকিয়ে আছে।

উইক, আর শয়তানির চেষ্টা করে লাভ নেই, কিশোর বলল, আপনার চেয়ে সংখ্যায় আমরা অনেক বেশি। গায়ে যত জোরই থাক, চারজনের সঙ্গে পারবেন না। নেমে আসুন। জলদি!

নড়ল না উইক। চোখের খেপা দৃষ্টি আরও খেপা হচ্ছে।

 নামুন বলছি! ধমক দিয়ে বলল রবিন। আপনার জারিজুরি খতম!

নড়ে উঠল উইক। ওপর থেকে ঝাঁপ দিল ওদের লক্ষ্য করে। ভারি শরীর নিয়ে ভয়াবহ গতিতে এসে পড়ল ওদের ওপর। সবাইকে ফেলে দিল। ওরা যখন সিঁড়িতে গড়াগড়ি খাচ্ছে, রেলিং ধরে উঠে দাঁড়াল সে। লাফিয়ে লাফিয়ে নেমে যেতে শুরু করল।

ধরো ওকে, মুসা, চিৎকার করে উঠল কিশোর, ওকে পালাতে দেয়া যাবে না। আমিও আসছি! রবিন, তুমি যাও মিস্টার কিনডরের সঙ্গে। ওপরে চলে যাচ্ছে। ছাতে উঠতে দিয়ো না তাকে। এই শরীর নিয়ে উঠতে গেলে মারা পড়বে!

 কিশোরের কথা শেষ হওয়ার অনেক আগেই উঠে পড়েছে মুসা। উইকের পিছু নিয়েছে।

রবিন উঠে গেল চিলেকোঠায়। গোরোকে দেখতে পেল না। ঝোড়ো বাতাসে ঝাঁপটা দিয়ে খুলে ফেলল সামনের একটা জানালার পাল্লা। ওটার কাছে ছুটে এসে বাইরে উঁকি দিল সে।

এখনও মুষলধারে পড়ছে বৃষ্টি। ঠাণ্ডা, প্রবল ঝোড়ো বাতাস বইছে। থেকে থেকে বিদ্যুৎ চমকাচ্ছে এখনও, তবে অনেক দূরে সরে গেছে।

গেল কোথায় গোরো!–ভাবল রবিন। এই ঝড়-বৃষ্টির মধ্যে পিচ্ছিল ছাতে ওঠার চেষ্টা করলে পিছলে পড়ে মরবে।

জানালাটা দিয়ে ঢালু ছাতের একাংশ চোখে পড়ে। অন্ধকারের মধ্যেও আবছা ভাবে দেখা যাচ্ছে চিমনিটা।

গোরো! অস্ফুট স্বরে বলে উঠল রবিন।

এক হাতে চিমনি পেচিয়ে ধরেছে ভিজে চুপচুপে বুড়ো মানুষটা। ইটের তৈরি চিমনির গোড়ায় পা রেখে, কনকনে ঝোড়ো বাতাস আর তুমুল বৃষ্টির পরোয়া না করে, আরেক হাত বাড়িয়ে খুঁজছে কি যেন।

পড়ে মরবে! বাঁচাতে হলে এখুনি যেতে হবে আমাকে।ভাবল রবিন।

দেরি করল না সে। জানালা গলে নেমে পড়ল স্লেটপাথরে তৈরি পিচ্ছিল টালির ছাতে। তার পাহাড়ে চড়ার সমস্ত অভিজ্ঞতা আর প্র্যাকটিস এক করে ভারসাম্য বজায় রেখে খুব সাবধানে ইঞ্চি ইঞ্চি করে এগিয়ে চলল চিমনিটার দিকে।

চিৎকার করে ডাকল, মিস্টার কিনডার, নড়বেন না, আমি আসছি!

ফিরে তাকাল বৃদ্ধ। বলল, ঠিক আছে। ওটা পেয়ে গেছি আমি। নড়ার আর দরকার নেই আমার।

গোরোর পাশে চলে এল রবিন। শান্ত হয়ে আমাকে ধরে থাকুন। আস্তে আস্তে পিছিয়ে যাব আমরা। সমস্ত ভার আমার ওপর ছেড়ে দিন। নিজে কিছু করার চেষ্টা করবেন না।

চিমনি ছেড়ে দিয়ে ওরা ঘুরে দাঁড়ানোর সঙ্গে সঙ্গে প্রচণ্ড এক ঝলক ঝেড়ো বাতাস এসে ঝাঁপটা মারল। টলিয়ে দিল গোরোকে। সামলাতে পারল না সে। কাত হয়ে পড়ে যেতে শুরু করল। সেই সঙ্গে রবিনকেও কাত করে দিল।

ঠেকাতে পারল না রবিন। পড়ে গেলে দুজনে। গড়াতে শুরু করল ছাতের ঢালে। দ্রুত সরে যেতে লাগল কিনারের দিকে।

.

২৪.

 বাইরে চলে গেল উইক।

মুসা আর কিশোরও বেরিয়ে এল।

টর্চ জ্বেলে এদিক ওদিক দেখতে লাগল কিশোর। অন্ধকারে অদৃশ্য হয়ে। গেছে লোকটা।

ফোঁস করে নিঃশ্বাস ফেলল মুসা, দিল মনে হয় গোল খাইয়ে আমাদের!

মাথা ঝাঁকাল কিশোর, সে-রকমই তো মনে হচ্ছে। ও যে ওরকম করে। ঝাঁপ দিয়ে পড়বে, কল্পনাই করিনি!

তুমুল বৃষ্টির মধ্যেই টর্চের আলোয় ঝোপঝাড় আর গাছপালার মধ্যে উইককে খুঁজতে লাগল ওরা। কিন্তু তার ছায়াও দেখা গেল না আর।

হঠাৎ একটা গাড়ির ইঞ্জিনের শব্দ হলো। ছুটে ড্রাইভওয়েতে ঢুকল ওটা। আচমকা ব্রেক কষে থামানোর চেষ্টা করায় কর্কশ আর্তনাদ তুলল টীয়ার। হেডলাইটের আলো পড়েছে বাড়িটর সামনের অংশে।

 পুলিশ! চিৎকার করে বলল মুসা।

টপাটপ লাফিয়ে নামল ছয়জন পুলিশ অফিসার। ছুটে এল ওদের দিকে।

সবার আগে রয়েছেন পুলিশ চীফ ইয়ান ফ্লেচার। যাক, পাওয়া গেল। কিশোর, তোমার চাচী তো অস্থির হয়ে পড়েছেন…

মুসার কাছে শুনেছি। পরে সব বলব। আগে উইককে খুঁজে বের করা দরকার।

উইকের কি হয়েছে, অল্প কথায় চীফকে জানাল কিশোর। বলল, আমার ধারণী বেরোতে পারেনি, এ বাড়িতেই কোথাও লুকিয়ে আছে। সারাক্ষণ টর্চ জ্বেলে রেখেছি আমরা। আড়াল থেকে বেরোলে আমাদের চোখে পড়তই। এখন আপনারা এসে গেছেন। আর বেরোনোর সাহস পাবে না। ওকে বের করে আনতে হবে।

চিৎকার করে সহকারীদের নির্দেশ দিলেন চীফ, বাড়ির চারপাশে খোঁজো। খেয়াল রেখো, কোনমতেই যেন পেছন দিয়ে বেরিয়ে যেতে না পারে। বাড়িতে যত আলো আছে, সব জ্বেলে দাও।

ককারও সম্ভবত এ বাড়িতেই আছেন, কিশোর বলল। তাকেও খুঁজতে হবে।

চীফ বললেন, তার জন্যে আর চিন্তা করতে হবে না। আমি অফিস থেকে বেরোনোর ঠিক আগে ফোন করেছেন। সারাদিন শহরের বাইরে ছিলেন। তোমাদের বাড়িতেই করেছিলেন। তোমার চাচীর কাছে তোমাদের নিখোঁজ হবার খবর পেয়েছেন। যে কোন মুহূর্তে এখানে চলে আসতে পারেন।

আলোয় আলোকিত হয়ে গেল বাড়িটী।

খাইছে! হঠাৎ আতঙ্কিত হয়ে চিৎকার করে উঠল মুসা। ওপর দিকে হাত তুলে দেখাল।

দেখে বরফের মত জমে গেল যেন কিশোর।

 টালির ছাতের কিনার ধরে ঝুলছে দুটো ছায়া।

রবিন আর গেরো!

একহাতে গোরোকে পেঁচিয়ে ধরে রেখেছে রবিন। আরেক হাতে টালির কিনার খামচে ধরে ঝুলে আছে।

পাশে তাকাল কিশোর। মুসা নেই। চিৎকার করেই সরে গেছে। ঢুকে যাচ্ছে আবার বাড়ির ভেতর।

তার পেছনে ছুটল কিশোর। প্রার্থনা করল, খোদা, আমরা না যাওয়া পর্যন্ত আটকে রাখো ওদের! পড়তে দিয়ো না!

চিলেকোঠার জানালার কাছে পৌঁছে গেল ওরা।

মুসা বলল, আমি নেমে যাচ্ছি। তুমিও এসো। আমার গোড়ালি চেপে ধরে রাখবে।

কিশোর বলল, না, আমি জোরে পারব না। ভার রাখতে পারব না। এতজনের। আমি ওদের তোলার চেষ্টা করব, তুমি ধরে রেখো।

আপত্তি করল না মুসা।

ভেজা, পিচ্ছিল ছাতে নেমে গেল ওরা। কমে এসেছে বৃষ্টি। কিন্তু নতুন আপদ দেখা দিয়েছে। কুয়াশা জমতে আরম্ভ করেছে। বুড়ো আঙুল বাঁকা করে পা টিপে টিপে এগিয়ে যাচ্ছে ওরা।

এখনও ঝুলে আছে রবিন। দেয়ালের গায়ে ছাতের একপাশে টালি যেখানে গাঁথা হয়েছে, তার কাছাকাছি রয়েছে। নিশ্চয় টালির খাজে আঙুল ঢুকিয়ে দিয়েছে সে, নইলে একটা সেকেণ্ডও ঝুলে থাকা সম্ভব হত না।

টর্চ জ্বেলে দেখল কিশোর, টালিতে নয়, কিনার দিয়ে চলে যাওয়া ছাতের পানি নিষ্কাশনের পাইপ আঁকড়ে ধরে ঝুলছে রবিন। গোরোও এখন পুরোপুরি রবিনের ওপর ভর দিয়ে নেই, তার একটা হাতও পাইপ চেপে ধরেছে। তাতে অনেকটা ভার কমেছে রবিনের ওপর থেকে।

একপাশের দেয়ালের যে শিরাটা বেরিয়ে আছে, সাইকেলের সীটে বসার মত করে তাতে বসল মুসী। দুই পা আর গোড়ালি দিয়ে দুদিক থেকে চেপে ধরুল দেয়ালটা। কিশোরকে উপুড় হয়ে শুয়ে পড়তে বলল।

মাথা নিচে পা ওপর দিকে করে ঢালু ছাতে শুয়ে পড়ল কিশোর। শক্ত করে তার গোড়ালি চেপে ধরল মুসা।

সামনে হাত লম্বা করে দিল কিশোর। কিন্তু অল্পের জন্যে রবিনের হাতের নাগাল পেল না। বলল, মুসা, পারছি না!

খুব সাবধানে শিরাটার ওপর ঘষটে ঘষটে আরও কয়েক ইঞ্চি নামল মুসা। হাত এগিয়ে গেল কিশোরের। তার আঙুলগুলো রবিনের হাত ছুঁতে পারল। রবিনের কব্জি চেপে ধরল। বলল, রবিন, ছেড়ে দাও! তোমার আঙুলগুলো দিয়ে আমার কব্জি পেঁচিয়ে ধরো!

ধরল রবিন। আরেক হাতে গোরোকে ঠেলতে লাগল ওপর দিকে, ছাতে তুলে দেয়ার জন্যে।

 অন্য হাত দিয়ে গোরোর হাত চেপে ধরল কিশোর। টানতে লাগল ওপর দিকে।

সাংঘাতিক কঠিন আর যন্ত্রণাদায়ক একটা কাজ। তবে সফল হলো সে। আস্তে আস্তে ওপর দিকে উঠে আসছে গোরো।

দুর্বল হয়ে পড়েছে রবিন। কিশোরের হাতে তার ভার পুরোপুরি ছেড়ে দিয়ে গোরোকে আরও জোরে ঠেলতে লাগল।

অবশেষে ছাতে উঠে এল গোরো। উপুড় হয়ে তাকে চুপ করে শুয়ে পড়তে বলল কিশোর। পড়ে থাকুক। রবিনকে তুলে আনার পর তার ব্যবস্থা করবে।

সবচেয়ে বেশি ভার বহন করতে হচ্ছে মুসাকে। কিন্তু একচুল ঢিল করল না আঙুলের চাপ। দাঁতে দাঁত চেপে ধরে রইল সে।

রবিনও উঠে এল ওপরে। কিশোরের হাতে চাপ অনেকখানি কমল।

তুমি গোরোর পা ধরো, কিশোর বলল। আমি তাকে ধরে রাখছি।

খুব ধীরে তাড়াহুড়ো না করে একটা মানব-শেকল তৈরি করল ওরা। মুসা। ধরে রেখেছে কিশোরের পা। কিশোর ধরল গৌরোর দুই হাত। রবিন ধরল গোরোর দুই পাঁ। পিচ্ছিল ছাতে উপুড় হয়ে শুয়ে আছে পরের তিনজন। টেনে টেনে তাদেরকে সরিয়ে আনতে শুরু করল মুসা।

অবশেষে ছাতের কিনার থেকে সরে এল সবাই।

কিশোর আর রবিনও শিরা আঁকড়ে ধরে হাঁপাতে লাগল।

এই ভয়াবহ টানাটানিতে একেবারেই কাহিল হয়ে পড়েছে গোরো। তাকে ধরে রাখল মুসা।

হাঁপাতে হাঁপাতে রবিন বলল, ভালই সার্কাস দেখলাম আমরা, কি বলো! আর কোন কাজ না পেলে দড়াবাজিকর হয়েও ভাত জোগাড় করতে পারব।

.

২৫.

বাতাস অনেক কমে গেছে, তাই রক্ষা। গোরোকে নিয়ে ছাতের ওপর দিয়ে চিলেকোঠার জানালার দিকে এগোতে অতটা অসুবিধে হলো না ছেলেদের। নিচে হাঁকডাক শোনা যাচ্ছে। উইককে খুঁজতে ব্যস্ত পুলিশ। গোয়েন্দাদের খোঁজ এখনও পড়েনি নিশ্চয়।

জানালা টপকে ভেতরে ঢুকল প্রথমে রবিন আর কিশোর। নিচে থেকে গোরোকে ওপর দিকে ঠেলে দিল মুসা। তাকে টেনে তুলে অনিল দুজনে। মুসা ঢুকল সবার শেষে।

ভয়ানক পরিশ্রম গেছে। চিলেকোঠার মেঝেতেই চিত হয়ে শুয়ে পড়ল ওরা। স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলল।

দুর্বল ভঙ্গিতে ছেলেদের দিকে তাকাল গারো, তোমাদের কৃতজ্ঞতা জানানোর ভাষা আমার জানা নেই। নিজের প্রাণের বিন্দুমাত্র মায়া করলে না! সত্যি বলছি, এত বয়েস হলো, এ রকম ছেলে আমি দেখিনি! তোমরা একেকটা হীরের টুকরো!

 কিশোর ও মুসাকে বলল রবিন, আর আমার নেই তোমাদের দুজনকে কৃতজ্ঞতা জানানোর ভাষা! ছাতের কিনার ধরে ঝুলে পড়ার পর একবারও ভাবিনি আজ বেঁচে ফিরে আসতে পারব।

মুসার দিকে তাকিয়ে হাসল কিশোর, খাওয়া নিয়ে আর তোমাকে ঠাট্টা করব না, মুসা। যত মন চায় খেয়ো। তোমার ওই গণ্ডারের শক্তিই কেবল আজ দুটো প্রাণিকে রক্ষা করল! ধন্যবাদ।

দরাজ হাসি হাসল মুসা, শুকনো ধন্যবাদে কাজ হবে না। আজ রাতেই শিক কাবাব খাওয়াতে হবে। বিশ-পঁচিশ, যতটা খেতে চাই। পয়সার মায়া করতে পারবে না।

করব না। চলো, উইককে পাওয়া গেল কিনা দেখি।

নামতে শুরু করল ওরা। সবার পেছনে আসতে আসতে চিৎকার করে উঠল গোরো, আমার আবিষ্কার! ভুলেই গিয়েছিলাম ওটার কথা!

গোরোকে যেতে দিলে আবার কোন বিপদ বাধাবে। তাই কেউ বাধা দেয়ার আগেই আবার ছুটে চিলেকোঠায় উঠে গেল রবিন। জানালা গলে ছাতে নেমে পড়ল। চিমনির দিকে রওনা হলো। চিমনির কাছে এসে একহাতে চিমনি ধরে আরেক হাত ফোকরের মধ্যে ঢুকিয়ে দিয়ে হাতড়াতে শুরু করল।

কি যেন হাতে লাগল। বের করে আনল সেটা। তারের একটা বাণ্ডিলের মত জিনিস। একমাথায় একটা অদ্ভুত যন্ত্র লাগানো। সেটা পকেটে ভরে চলে এল আবার জানালার কাছে।

তাকে ভেতরে ঢুকতে সাহায্য করল মুসা। ছাতে ঘোরার নেশায় পেল, নাকি আজ তোমাকে? ঘটনাটা কি?

পকেট থেকে জিনিসটা বের করল রবিন। মিস্টার কিনডার…

সে কথা শেষ করার আগেই মেঝেতে লুটিয়ে পড়ল গোরে। ধকল সহ্য করতে পারেনি আর তার বুড়ো শরীর।

ধরাধরি করে তাকে নিচের লিভিং রুমে নিয়ে এসে একটা লম্বা সোফায় শুইয়ে দেয়া হলো।

এই সময় ঘরে ঢুকলেন ফ্লেচার। সঙ্গে আরেকজন লোক। মাথায় স্ট্র হ্যাট।

মিস্টার ককার! বলে উঠল রবিন।

দ্রুত এগিয়ে এলেন ব্যাংকার। স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে বললেন, যাক, তোমরা ভালই আছ। তোমাদের কিছু হলে নিজেকে…

বাধা দিল কিলোর, আমরা ঠিকই আছি। তবে মিস্টার কিনডারের সাহায্য লাগবে। বেহুশ হয়ে গেছে।

একজন অফিসারকে গাড়ি থেকে ফার্স্ট এইড বক্স আনতে পাঠালেন চীফ।

ছাতের ওপর ওদের ভয়াবহ অ্যাডভেঞ্চারের কথা বলল ছেলেরা।

পকেট চাপড়ে রবিন বলল, মিস্টার কিনডারের আবিষ্কার এখন আমার পকেটে।

চীফ জানালেন, উইককে পেলাম না। রোডব্লকের আদেশ দিয়ে দিয়েছি। আমি। শহর থেকে বেরোতে যাতে না পারে। সাংঘাতিক পিচ্ছিল চোরটা! একেবারে পাকাল মাছ!

নিচের ঠোঁটে চিমটি কাটতে কাটতে থমকে গেল কিশোর। জিজ্ঞেস করল, গোলাঘরটায় খুঁজেছেন?

কোন গোলাঘর?

যেটাতে গাড়ি লুকিয়েছিল?

মাথা নাড়লেন চীফ। না। মরিস আসেনি, আমরা ওটা চিনিও না, মনেও পড়েনি।

লাফ দিয়ে উঠে দাঁড়াল কিশোর, রবিন, মুসা, এসো আমার সঙ্গে! বলেই চীফ বাধা দেয়ার আগে রওনা হয়ে গেল দরজার দিকে।

 বেরিয়ে পড়ল তিন গোয়েন্দা। বাইরে ঠাণ্ডা বাতাস বইছে। ঘন হতে আরম্ভ করেছে কুয়াশার চাদর। ভোঁতা করে দিয়েছে জানালার হলদে আলোগুলোকে। ঘন ঝোপে ঢুকে পড়ল ওরা।

গোলাঘরে গিয়ে ঢুকেছে ভাবছ নাকি? জিজ্ঞেস করল রবিন।

 হ্যাঁ।

পেছনে ফিরে তাকাল মুসা। কুয়াশার জন্যে আলোগুলোকে কেমন বিচিত্র লাগছে। টর্চ জ্বালতে গেল।

বাধা দিল কিশোর, জেলো না। উইক দেখলে হুশিয়ার হয়ে যাবে। কিছুই যাতে টের না পায়। চমকে দিতে হবে ওকে।

গাছে তৈরি সুড়ঙ্গমুখের কাছে এসে দাঁড়াল ওরা। লতাপাতার ঢাকন। ফাঁক করল রবিন। ভেতরে পা রাখল তিনজনে। টানটান হয়ে আছে স্নায়ু। আক্রমণের জন্যে প্রস্তুত।

রাত শেষ হয়ে এসেছে। পুবের আকাশে হালকা আলো। সুড়ঙ্গে সেটা প্রবেশ করছে না। এখানে ঘন কালো অন্ধকার। শঙ্কিত হলে কি এই অন্ধকারে বসে থাকলে নিশ্চয় চোখে সয়ে গেছে উইকের। ওরা নাম আগেই না ওদেরকে দেখে ফেলে।

ঝুঁকি নিয়েও তাই টর্চ জ্বালার সিদ্ধান্ত নিল কিশোর।

অন্ধকারের কালো চাদর ছুঁড়ে দিল তীব্র আলোক রশ্মি। সেই আলোয় পথ দেখে দ্রুত এগোল ওরা।

গোলাঘরে ঢুকল। খড়ের গাদা আগের মতই আছে। তবে সামনের দিকের কিছু খড় মাটিতে পড়ে আছে। বেরিয়ে আছে গোপন গ্যারেজের প্রাই উডের দরজা। ভেতরে উঁকি দিল সে।

দেয়ালের কাছে খুট করে একটা শব্দ হতেই পাক খেয়ে ঘুরে তাকাল তিনজনে। মুসার হাতের টর্চের আলো গিয়ে সোজা পড়ল উইকের মুখে। ভিজে, কুঁকড়ে আছে তার কাপড়-চোপড়। চোখে ব্রুনো দৃষ্টি। খড় সরানোর যন্ত্রটা তুলে নিয়েছে। মারাত্মক কাটাগুলো যেন ওদের দিকেই তাকিয়ে আছে।

এইবার তোমাদের শেষ করব আমি! বিষাক্ত গোক্ষোরের মত হিসহিস করে উঠল উইক। লাফ দিয়ে এগিয়ে এল ওদের গেঁথে ফেলার জন্যে।

.

২৬.

 খবরদার! গর্জন শোনা গেল পেছনে। নড়লে খুলি ফুটো করে দেব। হাত থেকে ওটা ফেলো, উইক!

থমকে গেল উইক। ফিরে তাকাল। দেখল, উদ্যত পিস্তল হাতে দরজায় দাঁড়িয়ে আছেন চীফ ইয়ান ফ্লেচার। পেছনে আরও দুজন পুলিশ অফিসার। তাদের হাতেও পিস্তল।

একটা মুহূর্ত দ্বিধা করল উইক। তারপর হাত থেকে ছেড়ে দিল যন্ত্রটা। খটাং করে মেঝেতে পড়ল ওটা।

আবার লিভিং-রুমে ফিরে এল তিন গোয়েন্দা।

উইককে হাতকড়া পরিয়ে নিয়ে আসা হয়েছে। কারও দিকে তাকাচ্ছে। না সে। খানিক আগের ঝোড়ো আকাশের অবস্থা হয়েছে তার চেহারার।

 প্রচণ্ড পরিশ্রম গেছে। তার ওপর ভেজা কাপড়-চোপড়। থরথর করে কাঁপছে তিন গোয়েন্দা। শুকনো চাদরের ব্যবস্থা করা হলো ওদের জন্যে।

শান্তিতে ঘুমিয়ে আছে গোরো। তার মুখের দিকে একবার তাকিয়ে গোয়েন্দাদের দিকে ফিরলেন ককার, বললেন, আমি একে চিনতে পেরেছি। কয়েক বছর আগে একটা চমৎকার আবিষ্কার করেছিল। তার সেই ইলেকট্রনিক যন্ত্রটা বাজারজাত করার জন্যে টাকা ধার চাইতে এসেছিল আমার কাছে। না দিয়ে তখন ভুল করেছি। যন্ত্রটা লোকের উপকারে লাগত। টাকা না পাওয়াতেই উইক শিপরিজের মত বাজে লোকের খপ্পরে পড়ল। আরেকটু হলেই অজি সর্বনাশ করে ফেলেছিল তার বোমা!

শুনেছেন তাহলে, তিক্ত কণ্ঠে বলল রবিন।

মাথা ঝাঁকালেন ককার। ঘৃণার দৃষ্টিতে তাকালেন উইকের দিকে। আবার ছেলেদের দিকে ফিরলেন। তবে এবার আর ভুল করব না আমি। ব্যাংক থেকে ঋণ পাওয়ার ব্যবস্থা করে দেব কিনডারকে। যত ইচ্ছে গবেষণা করুক, আমার বাড়িটা ব্যবহার করুক, কিচ্ছু বলব না।

এ কথা শুনে খুশি হলো তিন গোয়েন্দা।

রবিন বলল, আজ আপনাকে না পেয়ে আমরা ভেবেছিলাম খারাপ কিছু ঘটেছে। সেজন্যেই এখানে এসেছিলাম দেখার জন্যে। কি হয়েছিল বলুন তো?

 ব্যাংকার জানালেন, খুব সকালে একটা জরুরী কাজে শহরের বাইরে। চলে গিয়েছিলেন। অফিসকে জানিয়ে যেতে পারেননি। বললেন, মাঝরাতে ফিরেছি। বাড়িতে ফিরে জানলাম, আমাকে না পেয়ে চিন্তিত হয়ে পুলিশ এসেছিল খুঁজতে। ইয়ার্ডে কিশোরের চাচী আর থানায় চীফ ইয়ান ফ্লেচারের সঙ্গে যোগাযোগ করলাম তখন।

হাতকড়া পরা উইকের দিকে তাকালেন তিনি। তোমরা আমার বাড়িতে ঢুকলে কি করে? চাবি পেলে কোথায়?

খকখক করে হাসল উইক। ওটা আর এমন কি ব্যাপার। তালাওয়ালা এনে চাবি বানিয়ে নিয়েছি।

এই জন্যেই তলার গায়ে আঁচড়ের দাগ দেখা গেছে, ভাবল কিশোর।

আমার গুপ্তঘরে ঢুকে নোট রেখে এলে কি ভাবে? জিজ্ঞেস করলেন ককার।

সেটি বলছি না, কিশোরদের দেখিয়ে বলল উইক। এরা জিজ্ঞেস করেছিল, এদেরকেও বলিনি। মাথায় বুদ্ধি কম না ওদের, পারলে বের করে নিক।

চ্যালেঞ্জটা গ্রহণ করল কিশোর। হাত বাড়াল, রবিন, কিনডারের যন্ত্রটা দেখি দাও তো?

পকেট থেকে অদ্ভুত যন্ত্রটা বের করে দিল রবিন।

কৌতূহলী হয়ে ওটার দিকে তাকাল সবাই।

হাতে নিয়ে ভাল করে দেখতে লাগল কিশোর। তিন ইঞ্চি লম্বা ছোট একটা প্লাটফর্ম তৈরি করে তাতে দুটো ওয়াটারপ্রুফ ব্যাটারি বসানো হয়েছে। তার নিচে রয়েছে চাকা। এক প্রান্তে ছোট ছোট একজোড়া খাজকাটা চোয়ালের মত জিনিস।

আমার অনুমান ভুল না হলে, কিশোর বলল, চাকাগুলো কয়েকবার ঘোরার পর হাঁ করে খুলে যায় চোয়াল দুটো। ঠিক কতবার ঘুরবে, সেটা সেট করে দেয়া আছে। চোয়াল খুললে চাকাগুলো থেমে যায়। আপনাআপনি আবার যখন চোয়াল দুটো বন্ধ হয়, চাকাঁ চালু হয়ে যায়। তবে তখন উল্টো দিকে ঘোরে।

দারুণ খেলনা তো! ককার বললেন।

হ্যাঁ। আমার বিশ্বাস, আপনার গুপ্তঘরে নোট রেখে আসার কাজে এই যন্ত্রটাই ব্যবহার করা হত।

কি!

উইক বাদে সবাই কৌতূহলী হয়ে তাকিয়ে আছে কিশোরের দিকে।

চোয়ালগুলো দেখুন, কিশোর বলল, খাজ কাটা আছে। এতে কাগজের টুকরো ধরিয়ে দিলে চেপে ধরে রাখবে। তারের সাহায্যে যন্ত্রটা চিমনি দিয়ে নিচে নামিয়ে দিলে চাকায় ভর করে চলে যাবে ঘরের মাঝখানে। সেখানে চোয়াল খুলে কাগজ ফেলে দিয়ে ফিরে আসবে চিমনির কাছে। তার টেনে তখন আবার এটা তুলে নিলেই হলো। ছাতে উঠে উইক করেছে এই কাজ।

বিস্ময়ে বড় বড় হয়ে গেল ককারের চোখ। এ জন্যেই, মাথা দুলিয়ে। বললেন তিনি, এই জন্যেই আমরা বুঝতে পারিনি টাইম লক লাগানো ঘরে চোর ঢোকে কি করে! এ রকম একটা খেলনী যে তৈরি করে ফেলবে কেউ, কে ভাবতে পেরেছিল!

উইকের দিকে ফিরল কিশোর। আপনি গোরোকে বুঝিয়েছেন, এই খেলনাটা বাজারজাত করার জন্যে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা করবেন। তার কাছ থেকে চেয়ে নিয়েছেন ওটা। তারপর গিয়ে ওই কুকাজ করেছেন। আশা করি, আর দোষ এড়াতে পারবেন না। গুপ্তঘরে নোট যে আপনিই রেখেছেন, পুলিশ প্রমাণ করতে পারবে এখন, কি বলেন?

চুপ করে রইল উইক। চোখের দৃষ্টিতে কিশোরকে ভস্ম করার চেষ্টা করতে লাগল।

 এখানকার কাজ আপাতত শেষ। উইককে থানায় নিয়ে যাওয়ার আদেশ দিলেন ফ্লেচার।

 হাত তুলল কিশোর, এক মিনিট, পান্নার জিনিসগুলো কোথায়, আগে জিজ্ঞেস করে নিই। কোথায় লুকিয়েছেন ওগুলো, উইক?

এবারেও জবাব দিল না উইক। ঘৃণায় একবার থুথু ফেলে আরেক দিকে মুখ ঘুরিয়ে নিল।

 বার বার জিজ্ঞেস করেও জবাব পাওয়া গেল না ওর কাছ থেকে। শেষে রাগ করে অফিসারদের আদেশ দিলেন চীফ, নিয়ে যাও থানায়, তারপর দেখা যাবে।

তারমানে জিনিসগুলো বের করার জন্যে আবার খুঁজতে আসতে হবে, বলল একজন অফিসার। এখনই কাজটা সেরে ফেলব নাকি, চীফ?

সেরে ফেললে মন্দ হয় না, আবার আসার ঝামেলা থেকে বাঁচা যাবে। এই, একজন গিয়ে বোমাটা চেক করো তত, ফাটার সম্ভাবনা আছে কিনা দেখো।

ঘরের মধ্যে চেক করতে গেলে ফেটে গিয়ে যদি দুর্ঘটনা ঘটে যায় এ জন্যে ঝুঁকি নিল না পুলিশ। কালো বাক্সের মত জিনিসটা বের করে নিয়ে বাড়ির কাছ থেকে দূরে খানিকটা খোলা জায়গায় চলে গেল দুজন অফিসার।

এত ভীষণ ক্লান্ত তিন গোয়েন্দা। তবু ঠিক করল, পীন্নীগুলো না খুঁজে যাবে না। বোমা বের করল যে দুজন অফিসার তাদের সঙ্গে বেরিয়ে এল।

কোনখান থেকে শুরু করব? জানতে চাইল মুসা।

চারপাশে চোখ বোলাতে লাগল কিশোর। সূর্য উঠছে। কুয়াশা কাটতে আরম্ভ করেছে সোনালি রোদ। প্রাসাদ থেকে পাঁচশো গজ দূরে ঝোপে ঢাকা একটা জায়গায় চোখ আটকে গেল তার। আঙুল তুলে দেখাল।

বাড়িটাতে বোমা ফিট করে দূরে বসে যদি দেখতে চাই ফাটল কিনা, এর চেয়ে ভাল জায়গা আর নেই এ বাড়িতে। সূতরাং ওখান থেকেই শুরু করব।

বৃষ্টি আর কুয়াশায় ভেজা ঘাস মাড়িয়ে এগিয়ে গেল ওরা। ঝোপগুলোর ভেতর উঁকি দিয়ে দেখল ক্যানভাসের ব্যগিটী আছে কিনা। কিন্তু হতাশ হতে হলো! নেই।

আশপাশে ওরকম জায়গা আর আছে কিনা দেখল। তা-ও নেই।

পুরানো একটা ম্যাপল গাছের দিকে তাকিয়ে আছে রবিন। গোড়ার সামান্য ওপর থেকেই বেশ কয়েকটা ডাল ছড়িয়ে গেছে। কিশোরকে বলল, সহজেই ওঠা যাবে। ওতে চড়ে দেখব নাকি ভাল জায়গা আছে কিনা?

দেখো।

 গাছটায় চড়া কঠিন কিছু না। নিচের একটা মোটা ডালে চড়ে তাকাল। স্পষ্ট দেখা যায় প্রাসাদটী। আরও ভাল করে দেখার জন্যে মাথার ওপরের একটা ডালে হাত দিতে গিয়েই ধড়াস করে এক লাফ মারল হৃৎপিণ্ড। পাতার আড়ালে ঝুলিয়ে রাখা হয়েছে ব্যাগটী।

পেয়েছি! পেয়েছি। চিৎকার করে উঠল সে।

দৌড়ে এল মূসা আর কিশোর।

ভারি ব্যাগটা নামাতে রবিনকে সাহায্য করল মুসা।

ব্যাগটা নিয়ে লিভিংরুমে ফিরে এল ওরা। হেসে বলল কিশোর, এগুলো না পেলে হ্যারিসকে খুশি করতে পারতাম না। আর মক্কেলকে খুশি করতে না পারলে মন খুঁতখুঁত করতে থাকে আমাদের।

সে তো দেখতেই পাচ্ছি, হেসে বললেন চীফ।

উইককে নিয়ে চলে গেল অফিসারেরা। সঙ্গে নিয়ে গেল বোমাটা আর ব্যাগে ভরা পন্নিার জিনিসগুলো। পরে যার যার জিনিস ফিরিয়ে দিতে পারবে।

তিন গোয়েন্দাকে বাড়ি পৌঁছে দেয়ার জন্যে রয়ে গেলেন চীফ। ককার আর গোরের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে, পরে দেখা করবে কথা দিয়ে ওরাও বাড়ি যেতে তৈরি হলো।

মুসা বলল, একটা জরুরী কথা কিন্তু ভুলে গেছ।

কি? ভুরু কোঁচকাল কিশোর।

শিক কাবাব। পঁচিশটা খাওয়ানোর কথা ছিল।

পঁচিশটা শিক কাবাব। কৌতূহল হলো ব্যাংকারের। ঘটনা কি জানতে চাইলেন।

জানানো হলো তাকে।

 শুনে হাসতে শুরু করলেন তিনি। ফ্লেচার আর গোরোও হাসল।

ককার বললেন, কুছ পরোয় নেই, আমি খাওয়াব তোমাকে শিক কাবাব। যত খেতে পারো। পঞ্চাশটা খেলেও আপত্তি নেই। এখন বাড়ি যাও। বিশ্রাম নাও। বিকেলে চলে এসো এখানে। তোমাদের সঙ্গে আমার আরও কথা আছে। বুদ্ধিমান মানুষের সঙ্গে কথা বলতে আমার ভাল লাগে। তোমাদের নিয়ে একসঙ্গে বেরোব। যে রেস্টুরেন্ট দেখাবে মুসা, তাতেই ঢুকব। ঠিক আছে?

ঝকঝকে সাদা দাঁত বের করে হাসল মুসা, অনেক ধন্যবাদ আপনাকে, স্যার।

ধন্যবাদগুলো তো আসলে তোমাদের পাওনা। চীফের দিকে তাকালেন ককার। আপনি আসবেন, চীফ? চলুন না, একসঙ্গে ডিনার খাই আজ?

হাসলেন চীফ। কথা দিতে পারছি না, ভাই। গত দুই রাত আপনাদের এই কেসের জন্যে দুচোখের পাতা এক করতে পারিনি। ভাবছি, আজ প্রাণ ভরে ঘুমাব। কিশোর, এসো, ওঠো। তোমাদের বাড়ি পৌঁছে দিয়ে তারপর আমার ছুটি।

Super User