১১.

 ইয়ার্ডে ঢুকতেই দুই ব্যাভারিয়ান ভাইয়ের একজন, রোভারের সঙ্গে দেখা। বলল, এইমাত্র বেরিয়ে গেল লোকটা।

কোন লোক? ভুরু কোঁচকলি কিশোর।

তোমাকেই খুঁজতে এসেছিল। প্রাইভেট ডিটেকটিভ। তোমাকে না পেয়ে নানা রকম উদ্ভট প্রশ্ন শুরু করল আমাকে। তোমাদের ব্যাপারে। যেন তোমরা একেকজন বড় বড় ক্রিমিনাল। দিয়েছি হাঁকিয়ে।

তিন গোয়েন্দার ব্যক্তিগত ওঅর্কশপে ঢুকল দুজনে। একটা টুলের ওপর বসে পড়ে রবিন বলল, কে লোকটা বুঝতে পারছ কিছু?

মনে হয় পারছি, জবাব দিল কিশোর। বীমা কোম্পানির গোয়েন্দা। ক্যাপ্টেন টমার যার কথা বললেন। দাঁড়াও, রোভারকে ডাকি। কি কি বলেছে, জিজ্ঞেস করি।

দরজায় মুখ বের করে রোভারকে ডাকল কিশোর। সে ভেতরে এলে জিজ্ঞেস করল, লোকটা কি বলল, সব খুলে বলুন তো?

হাতের উল্টো পিঠ দিয়ে কপালের ঘাম মুছল রোভার। পুরানো একটা গদি ঝাড়ছিলাম। এই সময় এল সে। বয়েস বেশি না, সাতশি-আটাশ হবে। নাম বলল মিলার প্যাটোলি।

হু। তারপর?

বলল, আমি একজন প্রাইভেট ডিটেকটিভ। আইডেনটিটি বের করে দেখাল।

দেখতে কেমন?

লম্বাও না খাটও না। সুন্দর একটা স্যুট পরেছে। ধূসর ফেল্ট হ্যাট। দাঁতের ব্রাশের মত খাড়া খাড়া গোঁফ।

নকল গোঁফ না তো? রবিনের প্রশ্ন।

কি করে বলব?

তাই তো, কি করে বলবে! হাত দিয়ে ছুঁয়ে না দেখলে তো আর আসল নকল বোঝা যায় না।

আর কিছু জানার নেই। রোভারকে যেতে বলল কিশোর। পকেট থেকে চাবির রিঙটা বের করে টেবিলে রাখল। সেটার দিকে তাকিয়ে রইল চিন্তিত ভঙ্গিতে।

 রবিন বলল, একটা চাবি মোটর বোটের ইগনিশনের। আরেকটা কোন গাড়ির। তৃতীয়টা সাধারণ দরজার তালার।

হু, আনমনে বলল কিশোর, তিনটেই যদি খুঁজে বের করা যেত, ভাল হত।

দুপুরের খাওয়ার আগে বেরেলি না ওরা।

খাওয়া শেষে বেরোল। চলে এল থানায়। চীফ ইয়ান ফ্লেচারকে অফিসে পাওয়া গেল। চাবিগুলোর কথা বলল তাঁকে কিশোর।

পুলিশের ফাইলে সব রকম গাড়ি আর মোটর বোটের ইগনিশনের চাবির ফটোগ্রাফ আছে। একজন অফিসারকে ডেকে প্রয়োজনীয় নির্দেশ দিলেন। চীফ।

দশ মিনিটের মধ্যেই ফিরে এল অফিসার। উত্তেজিত। বলল, স্যার, গাড়িটা একটা বড় মেটিওর স্পেশাল! মনে হয় যে কালো গাড়িটাকে খুঁজছি আমরা, সেটাই।

কিশোর বলল, এই গাড়ি এ শহরে অত বেশি নেই। এখন বের করতে হবে, কটা গাড়ি আছে, তার মধ্যে কোনটা কালো, এবং মালিক কে।

সেটা জানা কঠিন হবে না, ফোনের দিকে হাত বাড়ালেন চীফ। স্টেট মোটর ভেহিকল ব্যুরোকে জিজ্ঞেস করলেই হবে।

 রিসিভার কানে ঠেকিয়ে রেখেই প্যাড আর কলম টেনে নিলেন তিনি। ওপাশের কথা শুনে শুনে এক, দুই করে সিরিয়াল নম্বর দিয়ে লিখতে শুরু করলেন।

কয়েক মিনিট পর রিসিভার নামিয়ে রেখে প্যাড থেকে পাতাটা ছিঁড়ে কিশোরের দিকে বাড়িয়ে দিয়ে বললেন, এই নাও। মোটর ভেহিকল অফিস। থেকে আটটা মেটিওর স্পেশালের রেজিস্ট্রেশন নেয়া হয়েছে। নাম-ঠিকানা লিখে দিলাম।

আগ্রহের সঙ্গে হাত বাড়িয়ে কাগজটী টেনে নিল কিশোর। প্রথম নামটা পড়ল: জেরিল কাস্টার। হাসি ফুটল মুখে। উঠে দাঁড়িয়ে রবিনকে বলল, এসো, যাই।

সাহায্যের জন্যে চীফকে আন্তরিক ধন্যবাদ দিয়ে থানা থেকে বেরিয়ে এল দুজনে।

প্রথমে কোথায় যাবে? জিজ্ঞেস করল রবিন।

এক নম্বরটা থেকেই শুরু করব, কোন ঠিকানায় যেতে হবে বলল কিশোর। এক এক করে সন্দেহ কাটাব, আর সন্দেহভাজনদের নাম ছাঁটাই করব।

রকি বীচের রেসিডেনশিয়াল এরিয়ায় অনেক বড় একটা বাড়িতে থাকেন জেরিল কাস্টার। গেটের ভেতরে ঢুকে ড্রাইভওয়ে ধরে কিছুদূর এগোনোর পর গাড়ি রাখল রবিন। দুজনে নেমে হেঁটে চলল।

হঠাৎ কিশোরের হাত খামচে ধরল রবিন। কিশোর, দেখো!

গ্যারেজের দিকে তাকাল কিশোরও। খোলা দরজা দিয়ে দেখা যাচ্ছে। চকচকে নতুন মেটিওর স্পেশাল গাড়িটা।

বাগানে রকিং চেয়ারে বসে আছেন হাসিখুশি এক বৃদ্ধ।

এগিয়ে গেল গোয়েন্দারা।

গুড আফটারনুন, বয়েজ, হেসে বললেন বৃদ্ধ, খুব গরম পড়েছে, না!

হ্যাঁ, বিনয়ের অবতার সেজে গেল কিশোর। আপনি কি মিস্টার কাস্টার, স্যার?

নিশ্চয়, কাস্টারের শরীর খুবই হালকা-পাতলা, কিন্তু তাঁর হালকা নীল চোখের তারা উজ্জ্বল, প্রাণবন্ত। গত উনআশি বছর ধরেই জেরিল কাস্টার হয়ে বেঁচে আছি আমি। এর জন্যে দুঃখ নেই। তরুণ বয়েসে অবশ্য অন্য কিছু হতে ইচ্ছে করত, বিখ্যাত কোন চরিত্র…

জেরিল। সদর দরজার ওপাশ থেকে ডাক শোনা গেল। কার সঙ্গে কথা বলছ? বেরিয়ে এলেন ছোটখাট একজন মহিলা। মাথার সব চুল সাদা। দুই গোয়েন্দার দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলেন, কি কথা বলছ?

বিনীত গলায় জবাব দিল কিশোর, আপনাদের গাড়িটার কথা জানতে এসেছি।

ভাল করেছ, কাস্টার বললেন। তবে ওটাতে চড়তে চেয়ো না, আমাকে চালাতে বোলো না। বাপরে বাপ! তারচেয়ে একপাল পাগলা ঘোড়াকে গাড়িতে জুতে চালানো অনেক সহজ!

গর্বিত ভঙ্গিতে মিসেস কাস্টার বললেন, আমি কিন্তু চালাতে পারি।

 গাড়িটা কেমন লাগে আপনার? জানতে চাইল রবিন।

দারুণ! দুর্দান্ত! যেমন আরাম তেমনি গতি। স্পীডওলা গাড়ি ভাল লাগে আমার।

বৃদ্ধ এই দম্পতির সঙ্গে কথা বলতে ভাল লাগছে কিশোরের। অনেক চালান মনে হয়?

না, তেমন আর সুযোগ পাই কোথায়। বাজার করতে যাই, আর গির্জায় যাই। বাড়ি ছেড়ে বেশি দূর যেতে আর ইচ্ছে করে না আজকাল।

যেটুকু যাই, তাই যথেষ্ট, কাস্টার বললেন। ওর সঙ্গে গাড়িতে উঠলে সারাক্ষণ একটা দোয়াই করি, ঈশ্বর, অ্যাক্সিডেন্ট তো হবেই জানি-দয়া করে পঙ্গু বানিয়ে ভুগিয়ো না আমাকে, মেরে ফেলো!

রবিন আর কিশোর, দুজনেই হাসতে লাগল। বুঝল, এই গাড়িটার খোঁজে আসেনি ওরা।

কিশোর বলল, আপনাদের সময় নষ্ট করলাম। ইদানীং মেটিওর স্পেশীলের প্রতি আগ্রহ জেগেছে আমাদের। তাই জানতে এসেছিলাম, কেমন

ফিরে এসে গাড়িতে উঠল দুই গোয়েন্দা।

রবিন বসল ড্রাইভিং সীটে।

তালিকাটার দিকে তাকাল কিশোর, একজন বাদ। বাকি রইল সাত। একসঙ্গে না গিয়ে ভাগাভাগি হয়ে খোঁজা উচিত আমাদের, তাহলে তাড়াতাড়ি হবে।

কি করবে?

বাড়ি চলো। চাচার ভাঙা গাড়িটা নেব। তুমি একদিকে যাবে, আমি একদিকে।

.

১২.

সন্ধ্যায় ক্লান্ত হয়ে ইয়ার্ডে ফিরল দুজনে। সবগুলো গাড়িই দেখে এসেছে। তবে কোনটার মালিকই দেখতে ককারের মত নয়।

একটাই জবাব হতে পারে এর, কিশোর বলল। গাড়িটা এই এলাকার নয়। অন্য কোনখান থেকে আনা হয়েছে। চোরাই নম্বর প্লেট ব্যবহার করে থাকলেও অবাক হব না।

কিন্তু গাড়িটা আছে কোথায় এখন?

জবাব মিলল না। সে রাতে জবাব না জেনেই ঘুমাতে যেতে হলো ওদের।

পরদিন সকালে কিশোর নাস্তা সেরে ওঅর্কশপে এসে ঢুকেছে কেবল, এই সময় এল মুসা। ফোঁস করে নিঃশ্বাস ছেড়ে টুলে বসতে বসতে বলল, পালিয়েছি, বুঝলে, আর পারব না। কাজ অনেক করেছি।

গোয়েন্দাগিরি করবে তো? নাকি সেটাও বন্ধ?।

উপযুক্ত খাবার পেলে করতে আপত্তি নেই, হেসে জবাব দিল মুসা।

এই সময় রবিন এল।

কেসটার অনেক কিছুই এখনও মুসার অজানা। তাকে জানানো হলো।

খাইছে! মুসা বলল। এ তো সাংঘাতিক জটিল! কোন সূত্রই নেই! কি করে কি করবে?

মেটিওর স্পেশালটা খুঁজতে হবে। আর কোন পথ নেই, কিশোর বলল।

তো, এখন কি খুঁজতে বেরোবে?

এখন মিস্টার ককারের সঙ্গে দেখা করতে যাব।

 ককারের ব্যাংকে তাঁর অফিসে দেখা করল তিন গোয়েন্দা।

ওদের সন্দেহের কথা শুনে খেপে গেলেন ব্যাংকার, কি, আমার বাড়িটাকে চোরাই মাল পাচারের স্টেশন বানিয়েছে! ধরতে পারলে ঘাড় মটকাব! হুমকি দিয়েছে কেন বুঝলাম। ভয় দেখিয়ে আমাকে দূরে সরিয়ে রাখতে চেয়েছে, যাতে নিরাপদে শয়তানি চালিয়ে যেতে পারে।

হ্যাঁ, মাথা ঝাঁকাল কিশোর। তবে কি করে নোটগুলো গুপ্তঘরে ফেলে এসেছে, সেই রহস্যটা জানা হয়নি এখনও।

তা বটে। আর কি কি জেনেছ তোমরা?

 জাহাজের কেবিন থেকে ক্যাপ্টেন টমারের পান্নার হার চুরির ঘটনা বলে কিশোর বলল, মনে হচ্ছে ডুডলি হ্যারিসের হারও চুরি করেছে একই চেরি।

ছেলেদের অবাক করে দিয়ে তীক্ষ্ণ স্বরে বললেন ককার, আমার তা মনে হয় না! হ্যাঁলুসিনেশনে ভুগছে হ্যারিস। কোন জিনিস চুরি যায়নি তার। একটা বানানো গল্প বলে দিয়েছে।

কথা বললে সময় নষ্ট। ব্যাংকারের সময় আর নষ্ট করল না গোয়েন্দারা। নতুন কিছু ঘটলে, কিংবা তথ্য পেলে তাঁকে জানাবে বলে যাওয়ার জন্যে উঠে দাঁড়াল। শেষ মুহূর্তে ডুপ্লিকেট চাবিটার কথা জিজ্ঞেস করল কিশোর। লজ্জিত হয়ে ব্যাংকার বললেন, আবার ভুলে গেছেন। খুব তাড়াতাড়িই বানিয়ে দেবেন, বলে দিলেন।

বিদায় নিয়ে বেরিয়ে এল ছেলেরা। রকি বীচে ফিরে চলল।

 হ্যারিসের ব্যাপারে ককারের মন্তব্যটা নিয়ে মাথা ঘামাতে লাগল।

কিশোর, কি মনে হয় তোমার? প্রশ্ন করল মুসা, সত্যি কি জিনিস চুরি গেছে হ্যারিসের?

গেছে। ককার এখনও রেগে আছেন তাঁর ওপর, তাই মানতে চাইছেন না। এগুলো তাঁর রাগের কথা। তবে হ্যারিসের সঙ্গে আরেকবার দেখা করতে অসুবিধে নেই আমাদের।

হঠাৎ করে লক্ষ করল কিশোর, মুসার আগ্রহ অন্য দিকে সরে গেছে। বাইরের দিকে তাকিয়ে আছে সে।

কি ব্যাপার? জানতে চাইল কিশোর।

জবাব না দিয়ে চেঁচিয়ে উঠল মুসা, রবিন, অত জোরে চালিয়ো না! ঠিক জায়গায় থামাতে পারবে না তো?

কোথায় থামাব?

ওই যে মিল্ক বারটার কাছে। সানডি খুব ভাল বানায় ওর–প্রচুর মাখন, চেরি আর বাদাম মেশায়। নামটাও দিয়েছে দারুণ, বিগল ইগলু। রাখো রাখো, গাড়ি রাখো। লাঞ্চের সময় হয়ে গেছে। আগেই বলে রাখি, পয়সাটা তোমাদের কারও দিতে হবে। তাড়াহুড়া করে বাড়ি থেকে পালিয়েছি, টাকা নিতে ভুলে গেছি।

হেসে ফেলল কিশোর। বলল, গাড়ি রাখো, রবিন, এই পেটুককে নিয়ে আর পারা গেল না।

সাদা ছোট বাড়িটার সামনে গাড়ি রাখল রবিন।

শীঘ্রি ভেতরের একটা টেবিল ঘিরে বসল ওরা।

ওয়েইট্রেস এসে দাঁড়ালে অর্ডার দিল মুসা, চারটে বড় সাইজের বিগলু। ইগলু।

কিন্তু লোক তো তোমরা তিনজন?

তাতে তোমার কি? চারটে বলেছি, চারটে, ব্যস। দিতে অসুবিধে আছে?

না না, অসুবিধে কি? চলে গেল ওয়েইট্রেস।

লাঞ্চ আওয়ার এখন। ভিড়। প্রায় সব টেবিলেই লোক আছে। গুঞ্জন চলছে। মাথার ওপরের একাধিক অদৃশ্য স্পীকারে মৃদু শব্দে বাজছে রক এ মিউজিক। সব কিছু ছাপিয়ে হঠাৎ পেছন থেকে একটা কথা কানে এল কিশোরের, ..ঘড়ির সাহায্যে সারা হবে কাজটা!

.

১৩.

 ঘড়ির কথা শুনেই লাফ দিয়ে উঠে দাঁড়াল কিশোর। কে বলছে দেখার জন্যে ঘুরতে গেল। খাবারের ট্রে নিয়ে তার একেবারে কাছে চলে এসেছিল ওয়েইট্রেস, হাতের ধাক্কায় উল্টে পড়ল ট্রে-টা। ঝনঝন করে ভাঙিল কাচের বড় বড় পেয়ালগুলো। মেঝেতে ছড়িয়ে গেল মুসার অত সাধের বিগলু ইগলু।

একটা মুহূর্তের জন্যে স্তব্ধ হয়ে গেল গুঞ্জন। পরক্ষণেই স্বাভাবিক হয়ে গেল। হাত থেকে খাবারের প্লেট পড়ে ভাঙাটা নতুন কিছু না।

দুজন লোক বেরিয়ে যাচ্ছে। হাঁটার সময় কথা বলছিল ওরা, কিশোরের কানে এসেছে। ওদের দেখিয়ে চিৎকার করে উঠল সে, মুসা, ওদের ধরতে হবে! জলদি এসো!

আবার স্তব্ধ হলো গুঞ্জন। এইবার বিস্মিত হলো শ্রোতারা। তবে তাদের তোয়াক্কা করল না কিশোর। দৌড় দিল লোক দুজনের পেছনে।

চিৎকার শুনে লোকগুলোও ফিরে তাকিয়েছে। একটা মুহূর্ত দেখল তিন গোয়েন্দাকে। তারপর ওরাও ছুটতে শুরু করল।

গোয়েন্দারা বাইরে বেরিয়ে দেখল, একটা কালো গাড়িতে উঠে পড়ছে ওরা।

ছেড়ে দিল গাড়িটা। রকি বীচের দিকে চলে গেল।

লম্বা লোকটাকে দেখলে! ছুটতে ছুটতে বলল কিশোর। শরীর একেবারেই ককারের মত!

রবিনের ফোক্স ওয়াগেন নিয়ে এসেছে ওরা। ড্রাইভিং সীটে বসল মুসা। অন্য দুজন উঠে দরজা বন্ধ করতে না করতেই গাড়ি ছেড়ে দিল সে। পিছু নিল কালো গাড়িটার।

পাকা রাস্তায় টায়ারের কর্কশ আর্তনাদ তুলে রবারের অনেকখানি ছাল চামড়া রেখে যখন মোড় ঘেরাল সে, অনেক দূরে চলে গেছে তখন সামনের গাড়িটা। এক্সিলারেটর যতটা যায়, চেপে ধরল মুসা।

প্রচণ্ড শব্দ করতে লাগল পুরানো ইঞ্জিন। ভেঙে টুকরো টুকরো হয়ে পড়ার হুমকি দিচ্ছে যেন। কেয়ারই করল না মুসা।

মেটিওর স্পেশাল হলে ধরতে পারবে না, কিশোর বলল। পত্তিাই পাবে না।

দেখা যাক, মুসা বলল।

উঁচু হতে লাগল হাইওয়ে। সামনে হঠাৎ করে নেমে গেছে। তারপরে মোড়। কালো গাড়িটা একবার চোখে পড়ছে, একবার অদৃশ্য। হাল ছাড়ল না। মুসা। আঠার মত লেগে রইল পেছনে।

রকি বীচের কাছাকাছি পৌঁছল ওরা।

সামনের দিকে তাকিয়ে কিশোর বলল, ম্যানিলা রোডের দিকে যাচ্ছে। মনে হয়?

তার ধারণাই ঠিক। সেই পথই ধরল সামনের কালো গাড়িটা।

মোড় আর বনজঙ্গল এদিকটীয় বেশি। চোখের আড়ালে চলে গেল গাড়িটা।

রিভেরা এস্টেট চোখে পড়ল। গেট দেখা গেল। কিন্তু গাড়িটাকে আর দেখা গেল না। উধাও হয়ে গেছে।

গেট বন্ধ। ভেতরেও নেই গাড়িটা।

থেমো না, কিশোর বলল। এগিয়ে যাও।

 কিন্তু পুরো রাস্তাটা পার হয়ে এসেও আর দেখল না গাড়িটাকে।

 গেল! হতাশ ভঙ্গিতে সীটে হেলান দিল কিশোর।

তোমার এত কষ্ট কাজে লাগল না, মুসাকে বলল রবিন।

গাড়ি থামিয়ে দিল মুসা। ফিরে তাকিয়ে কিশোরকে জিজ্ঞেস করল, কি করব?

ডুডলি হ্যারিসের সঙ্গে দেখা করতে যাব।

ওই রোডেই তার বাড়ি, জানা আছে মুসার। গাড়ি ঘুরিয়ে নিয়ে আবার চালাল।

সাগরের দিকে মুখ করা পাহাড়ের ঢালে তৈরি পাথরের বাড়িটা চোখে পড়ল। বিশাল দুটো টাওয়ার, পাথরের দেয়াল আর আদিম চেহারা পুরানো আমলের দুর্গের রূপ দিয়েছে বাড়িটাকে। নিজের সীমানা কাঁটাতারের বেড়া দিয়ে ঘিরে নিয়েছেন হ্যারিস। গেটে তালা নেই।

ড্রাইভওয়েতে গাড়ি ঢোকাল মুসা।

ঘণ্টা শুনে বেরিয়ে এলেন হ্যারিস। গম্ভীর হয়ে ছিলেন। তিন গোয়েন্দাকে দেখে উজ্জ্বল হলো চেহারা। ডেকে নিয়ে গেলেন লিভিং রুমে।

বেশি ভূমিকা না করে বললেন, দেখো, আমি তোমাদের সাহায্য চাই। আমার জিনিসগুলো খুঁজে বের করে দাও, আমি তোমাদের পুরস্কৃত করব।

তারমানে চুরির কেসটা আমাদের নিতে বলছেন আপনি? রবিন বলল।

অনেক জটিল কেসের সমাধান করেছ তোমরা, পুলিশও হিমশিম খেয়ে গিয়েছিল যেগুলো নিয়ে। আমার পান্নাগুলো যদি কেউ বের করে আনতে পারে, তোমরাই পারবে।

কিশোরের দিকে চোখ পড়তে থেমে গেলেন তিনি।

তাঁর দিকে নজর নেই কিশোরের। উঠে দাঁড়াচ্ছে। নজর বাগানের দিকের একটা জানালায়।

জিজ্ঞেস করল মুসা, কি? কিছু দেখেছ নাকি?

ফিসফিস করে জবাব দিল কিশোর, আড়ি পেতে আছে কেউ, আমাদের কথা শুনছে!

পেছনের দরজার দিকে ছুটল সে। ওদিক দিয়ে বেরিয়ে ঘুরে বাগানে চলে যাবে। পেছন থেকে ধরার চেষ্টা করবে লোকটাকে।

.

১৪.

তাকে দেখে ফেলল লোকটা। কিংবা কিছু টের পেয়ে গেল। পাতাবাহারের বেড়া পার হয়ে লাফাতে লাফাতে ছুটল পেছনের সীমানার দিকে। গায়ে। বাদামী রঙের স্পোর্টস জ্যাকেট। ছুটতে গিয়ে ঝাঁকি লেগে কোণগুলো লাফাচ্ছে। বানরের দক্ষতায় কাটাতারের বেড়া ডিঙিয়ে চলে গেল ওপাশের রাস্তায়। ফিরে তাকাল একবার। দাড়ি-গোঁফে ঢাকা মুখ।

মুসা আর রবিনও ততক্ষণে বেরিয়ে চলে এসেছে।

তিনজনেই ছুটল বেড়ার দিকে।

বেড়ার কাছে এসে দাঁড়িয়ে গেল ওরা। ফাঁক দিয়ে রাস্তার এ পাশ ওপাশ দেখল কিশোর। অবাক হয়ে গেল। নেই লোকটা। গেল কোথায় এত তাড়াতাড়ি?

নীল জ্যাকেট পরা আরেকজন লোক রাস্তার উল্টোদিকে দাঁড়িয়ে নতুন তৈরি হওয়া দুটো বড় বাড়ির দিকে তাকিয়ে আছে।

ডাকল তাকে কিশোর, এই যে, শুনছেন?…একজন লোককে দেখেছেন। এদিকে, বড় বড় দাড়ি!

ওই তো, ওই বাড়িগুলোর মাঝখানে ঢুকে গেল, জবাব দিল লোকটা। তাড়া করেছিলে নাকি? চোর?

জবাব দিল না কিশোর। গেট কাছেই। সেদিকে ছুটল। গেট দিয়ে বেরিয়ে এসে দৌড় দিল বাড়িগুলোর দিকে। কিন্তু বাদামী জ্যাকেট-ওয়ালা লোকটাকে দেখতে পেল না আর।

বাড়িগুলোর ওপাশের রাস্তায় খুঁজতে গেল কিশোর। আশপাশে লুকানোর সম্ভাব্য যত জায়গা দেখল, সব খুঁজে দেখতে লাগল মুসা আর রবিন।

পেল না লোকটাকে। গায়েব হয়ে গেছে।

একসঙ্গে ডুডলির বাড়িতে ফিরে চলল তিনজনে।

 রাস্তায় এসে নীল জ্যাকেট পরা লোকটাকেও দেখতে পেল না।

এই লোকটা সত্যি বলেছে তো আমাদের? মুসার প্রশ্ন।

পেছনের বাগানে ওদের জন্য অপেক্ষা করছেন হ্যারিস।

কাছে এসে মাথা নেড়ে কিশোর জানাল, পেলাম না ওকে। তবে আপনার কেস আমরা নিলাম। পান্নাগুলো খুঁজে বের করে দেব।

পরদিন সকাল দশটায় থানায় চলল কিশোর আর রবিন। মুসা আসেনি। পালাতে পারেনি আজ। মা আটকে দিয়েছেন। চীফের সঙ্গে কথা বলে জানতে চায় কিশোর, বন্দরের চুরি রহস্যের সুরাহা হলো কিনা, কিংবা নতুন তথ্য পাওয়া গেল কিনা।

কড়া রোদ উঠেছে। গরম পড়ছে খুব। দোকানের ডিসপ্লে উইণ্ডোগুলোতে যেগুলোতে রোদ এসে পড়ে হয় সেগুলোতে শাটার টেনে দেয়া, নয়তো মোটা কাপড় দিয়ে ঢেকে দেয়া হয়েছে।

কিশোর, দেখো! ঐ হ্যাট পরা লম্বা একজন লোকের দিকে আঙুল তুলল রবিন। ওদের দিকে পেছন করে রাস্তার ধারের একটা দোকানের উইণ্ডোর দিকে তাকিয়ে আছে লোকটা। অ্যালেক্স ককার, না সেই লোকটা? ককার হলে এ সময়ে ব্যাংক ফেলে এখানে কি করছেন?

চলো, জিজ্ঞেস করি।

রাস্তা পার হয়ে এল ওরা।

পেছন থেকে মৃদু গলায় ডাকল কিশোর, মিস্টার ককার!

ঘুরে তাকাল লোকটা।

এক পা পিছিয়ে এল কিশোর। লোকটা ককার নয়।

কি চাই? কর্কশ গলায় জিজ্ঞেস করল লোকটা।

হ্যারিসের পান্নাগুলো আপনিই সরিয়েছেন, তাই না? ফস করে বলে বসল রবিন। বলেই বুঝল, এ ভাবে জিজ্ঞেস করাটা ঠিক হয়নি।

কিসের পান্না? কি বলছ! তোমাদের আমি চিনি না। কথাবার্তা সাবধানে বলবে বলে দিলাম। নইলে পুলিশ ডাকব।

ধাক্কা দিয়ে ছেলেদের সরিয়ে, কয়েকজন ফেরিওয়ালাকে ঠেলে প্রায় ছুটে গিয়ে মোড়ের কাছে দাঁড়ানো একটা কালো গাড়িতে উঠে পড়ল লোকটা। চোখের পলকে মিশে গেল যানবাহনের ভিড়ে।

ওকে যেতে দিলাম কেন? নিজের ওপরই খেপে গেল রবিন।

আর কোন উপায় ছিল না বলে, কিশোর বলল। চোর চোর বলে চিৎকার করেও লাভ হত না, ও-ই যে চুরি করেছে কোন প্রমাণ নেই আমাদের হাতে। যাই হোক, গাড়িটার নম্বর দেখেছি। ফ্লেচারকে বলব।

মেটিওর নয়। যদ্দুর মনে হয়, গতকাল এই গাড়িটাকেই ফলো করেছিলাম। মুসা থাকলে বলতে পারত।

যেদিকে যাচ্ছিল, আবার রওনা হলো ওরা।

.

হু, তাহলে চোরটাকে দেখে এসেছ, সব শুনে মাথা দুলিয়ে বললেন চীফ। নাম্বারটা বলো।

কিশোর বলল, লিখে নিলেন চীফ। অফিসারকে ডাকলেন।

খোঁজ পাওয়া গেল গাড়িটার। রকি বীচেরই রেজিস্ট্রেশন, জনৈক ডেভিড কুপারের নামে। ফোন করে পাওয়া গেল সেই লোককে। থানা থেকে করা হয়েছে শুনে বলল, তার গাড়িটা চুরি গেছে। পুলিশকে খবর দেয়ার কথা ভাবছিল সে।

দয়া করে একবার আসতে পারেন থানায়, মিস্টার কুপার? অনুরোধ করলেন চীফ। সামনাসামনি সব শুনতে পারলে ভাল হয়। আপনার গাড়িটা খুঁজে বের করার ব্যবস্থা করতে পারি। নাকি আমরাই আসব?

না না, দরকার নেই, আমিই আসছি, কুপার বলল।

.

১৫.

আধঘণ্টা পর একজন পুলিশ অফিসারের সঙ্গে অফিসে ঢুকল সম্ভান্ত পোশাক পরা, মাঝবয়েসী, হালকা-পাতলা এক লোক। তাকে পৌঁছে দিয়ে চলে গেল অফিসার। নিজের পরিচয় দিল লোকটা, ডেভিড কুপার।

কিশোর আর রবিনের চেনা শত্রু হয়ে যেতে পারে ভেবে ফাইল র‍্যাকের আড়ালে ওদের লুকিয়ে পড়তে বললেন চীফ। ওখান থেকে উঁকি মেরে দেখতেও পারবে ওরা, কথাও শুনতে পাবে।

পরিচয় আর হাত মেলানোর পর বললেন চীফ, হ্যাঁ, গাড়িটার কথা বলুন, মিস্টার কুপার। কোথায় রাখতেন?

অবশ্যই গ্যারেজে।

কিশোর দেখল, চীফের দিকে মুখ করে থাকলেও চোখজোড়া অস্থির হয়ে এদিক ওদিক ঘুরছে লোকটার।

গ্যারেজ থেকে গাড়ি নিয়ে গেল? চোরটীর সাহস আছে বলতে হবে।

গ্যারেজ থেকে চুরি যায়নি। বাড়ির সামনে রাস্তার মোড়ে রেখেছিলাম, ওখান থেকে নিয়ে গেছে।

কবে? কাল রাতে?

অ্যাঁ!…হ্যাঁ, কাল রাতে।

হু, লোকটার চোখের দিকে তাকালেন চীফ, কাল রাতে? নিশ্চয় খুব দুশ্চিন্তায় ছিলেন?

চোখ সরিয়ে নিল কুপার। অ্যাঁ!..হ্যাঁ, তা তো বটেই..দুশ্চিন্তাই তো হবার কথা, তাই না? সকালে ঘুম থেকে ওঠার পর যখন জানতে পারলাম গাড়িটা নেই, তখন থেকেই দুশ্চিন্তা শুরু হয়েছে।

সকালে কটায় ওঠেন ঘুম থেকে?

সাতটা।

ওই সময় দেখলেন গাড়িটা চুরি গেছে? আপনাকে ফোন করেছি সাড়ে দশটায়। তারমানে চুরি গেছে জানার পরেও সাড়ে তিন ঘণ্টা পার করে দিয়েছেন, পুলিশকে খবর দেননি, আবার বলছেন খুব দুশ্চিন্তা হচ্ছিল।

আ-আমি… তখন বুঝতেই পারিনি গাড়িটা চুরি গেছে! চোখ মিটমিট করতে লাগল কুপার। কথা খুঁজে পাচ্ছে না যেন। হঠাৎ করেই রেগে উঠল, এমন জেরা শুরু করেছেন যেন আমি একটা ক্রিমিনাল!

কিছু মনে করবেন না, মিস্টার কুপার, আপনার আচরণই এ ভাবে কথা বলতে বাধ্য করছে আমাকে।

কি দেখলেন আমার আচরণের মধ্যে? খেঁকিয়ে উঠল কুপার।

আস্তে কথা বলুন। কি আচরণ করছেন, সেটা আপনিও বুঝতে পারছেন। যাকগে, গাড়ি চুরির রিপোর্ট করতে এসেছিলেন, করা হয়েছে। আপনি এখন যেতে পারেন। গাড়ির খোঁজ পেলে আপনাকে জানানো হবে।

কুপার চলে যাওয়ার পর বেরিয়ে এল কিশোর আর রবিন।

এত নার্ভাস কেন লোকটা? চীফের দিকে তাকাল রবিন। কথা বলতেই কেমন করছিল।

মিথ্যে কথা বলতে গেলে আর কি করবে, চীফ বললেন। ওর ওপর নজর রাখতে হবে। যেই পা ফসকাবে, অমনি কাঁক করে ধরব।

.

ইয়ার্ডে ফিরে দেখল ওরা টেলিফোনে কথা বলছেন মেরিচাচী। ওদের দেখেই বললেন, মুসা, ওরা এসে গেছে। কথা বলতে পারো। তবে আগেই বলে দিচ্ছি, আজ বিকেলে কোথাও আর বেরোতে পারবে না কিশোর। আমাদের বাড়ির ঘাস এত বড় হয়ে গেছে, গরু চরানো যাবে। তোমার আংকেল গেছে বোরিস আর রোভারকে নিয়ে মাল কিনতে। সুতরাং কিশোরকে বেরোতে দেয়া যাবে না।

কিশোরের হাসি হাসি মুখটা কালো হয়ে গেছে হঠাৎ। কেন, বুঝতে পারলেন চাচী। ফোনটা তার দিকে বাড়িয়ে দিয়ে বললেন, নে, কথা বল। তবে বেরোনোর চিন্তা করবি না বলে দিলাম আগেই।

 সারাটা বিকেল আর বেরোনো হলো না। সন্ধ্যার আলোও যখন নিভে এল, তখন কাজ শেষ করে, হাতমুখ ধুয়ে, চা খেয়ে নিল কিশোর। রাস্তার আলোগুলো জ্বলেছে। গেটের দিকে এগোতে যাবে সে, ঘ্যাঁচ করে এসে থামল একটা পুরানো গাড়ি। জানালা দিয়ে মুখ বের করল মুসা আর রবিন। এই সময়ই আসতে বলেছে ওদেরকে কিশোর।

কোথায় যাব? কিশোর গাড়িতে উঠলে জানতে চাইল মুসা।

রিঙের তিন নম্বর চাবিটার ওপর গবেষণা চালাব আজ, কিশোর বলল। আমার বিশ্বাস, এটা রিভেরা হাউসের কোন দরজার তালার।

রিভেরা হাউস থেকে বেশ খানিকটা দূরে ম্যানিলা রোডের ধারে গাড়ি রাখল মুসা। পুরোপুরি অন্ধকার হয়ে গেছে তখন। বাকি পথটা হেঁটে এল। ওরা। এগোল দেয়ালের ধার ঘেঁষে। গেট খোলা। নিঃশব্দে ঢুকে পড়ল ভেতরে।

তারাখচিত আকাশের পটভূমিতে আবছা অন্ধকার একটা ভূতুড়ে ছায়ার মত মাথা তুলে আছে বাড়িটা। চাঁদ ওঠেনি এখনও। পা টিপে টিপে গিয়ে। বারান্দায় উঠল কিশোর।

তালায় চাবি ঢুকিয়ে কয়েকবার মোচড় দিয়েও খুলতে পারল না। ফিরে তাকিয়ে বন্ধুদের জানাল, লাগছে না। পেছনে চলো।

কিন্তু পেছনের দরজায়ও লাগল না চাবিটা।

 সেলারের ঢাকনার না তো? রবিন বলল।

সেদিকেই চলল ওরা।

তালায় চাবি ঢোকাল কিশোর। মোচড় দিতেই ঘুরে গেল। খুলে গেল তালা। লেগেছে! উত্তেজিত হয়ে বলল সে।

ভারি ঢাকনাটা খুলল ওরা। সিঁড়ি নেমে গেছে মাটির নিচের ঘরে। সেই সিঁড়ি বেয়ে সাবধানে নেমে চলল ওরা নিচের অন্ধকারে।

টর্চ আছে সঙ্গে, কিন্তু জালতে সাহস করল না। এই অন্ধকারে জ্বাললে ওপরের ফোকর দিয়ে আলো বেরোবে, অনেক দূর থেকেও দেখা যাবে সেটা। আশেপাশে কেউ থাকলে দেখে ফেলবে।

স্যাঁতসেঁতে ঘর, ভাপসা গন্ধ বেরোচ্ছে। ভ্যাম্পায়ারের কথা মনে পড়ে গেল মুসার। গায়ে কাঁটা দিল তার। অদ্ভুত এক অনুভূতি মনে হচ্ছে, আড়াল থেকে কেউ নজর রাখছে তার ওপর। অন্য দুজনের সঙ্গে গা ঘেষাঘেষি করে। এল সে। হঠাৎ এক চিৎকার দিয়ে লাফিয়ে একপাশে সরে গেল। পরক্ষণেই ধূড়ম-ধাডুম করে পতনের শব্দ।

কোমরে ঝোলানো টর্চের সুইচ টিপে দিল কিশোর।

আলোক রশ্মি ঘুরে গিয়ে পড়ল মুসার মুখে। কতগুলো কাঠের বাক্সের মধ্যে প্রায় ডুবে রয়েছে সে। চোলে জাতক। ঘড়ঘড়ে স্বরে বলল, কি-কি যেন। একটা নরম…চলে গেল আমার পায়ের ওপর দিয়ে। বাদুড়ের নখের মত

ওই যে তোমার বাড়ি, টর্চের আলো নেড়ে এককোণে দেখাল রবিন।

অনেক বড় একটা ইঁদুরকে কুঁজো হয়ে থাকতে দেখা গেল। মুসার চেয়ে বেশি ভয় পেয়েছে।

গায়ে আলো পড়তে শুটিগুটি একপাশে সরে গেল ওটা।

মুসাকে উঠতে সাহায্য করল রবিন অব কিশোর।

এখনও গা কাঁপছে মুসার। কিশোরের পিছু পিছু চুপচাপ এগোল আরেকটা সিঁড়ির দিকে।

শব্দটা তার কানেই আগে ঢুকল। দাঁড়িয়ে গিয়ে ফিসফিস করে বলল, ওপরতলায় কেউ আছে!

কথা শোনা গেল। মেঝেতে বসানো কাঠের ঢাকনা তোলার শব্দ হলো।

চোর হলে কেয়ার করি না, ঢোক গিলল মুসা, কিন্তু অন্য কিছু হলে…

 তাকে কথা শেষ করতে দিল না রবিন। চলো, দেখি।

 সিঁড়ির মাথার দরজাটায় তালা দেয়া।

নিচের ঠোঁটে চিমটি কাটল একবার কিশোর। বলল, আমরা ঢুকতে না পারলেও ওদেরকে বের করে আনতে পারি। চেঁচাও। গলা ফাটিয়ে চিৎকার করো। বেরোতে বাধ্য হবে ব্যাটীরা।

চেঁচাতে শুরু করল তিনজনে। সেই সঙ্গে থাবা আর কিল মারতে লাগল দরজায়। মিনিটখানেক পরেই দরজার ওপাশ থেকে জোরে জোরে কথা শোনা গেল, অ্যাই, কে, বলো তো! নিশ্চয় পুলিশ! পালাও! জলদি পালাও!

ভারি পায়ের শব্দ ছুটে গেল ঘরের অন্য প্রান্তে।

চিৎকার করতে করতে গোয়েন্দারাও নেমে এল সিঁড়ি বেয়ে। বাইরে বেরোনোর সিঁড়িটা বেয়ে আবার উঠতে লাগল। বেরিয়ে এল সেলারের মুখে।

ওরাও বেরোল, এমন সময় জানালা দিয়ে লাফিয়ে পড়ল দুটো ছায়ামূর্তি। নদীর দিকে দৌড় দিল।

ধরো ব্যাটাদের! চেঁচিয়ে উঠল কিশোর।

ভূতের ভয়ের নামমাত্রও নেই আর মুসার মধ্যে। ছুটল লোকগুলোর পেছনে। তবে বনের ভেতরের পথ তার অচেনা, লোকগুলোর চেনা। ফলে গাছপালার আড়ালে ছোটার সময় ওরা সুবিধে বেশি পেল। পিছিয়ে পড়তে লাগল সে।

রবিনকে নিয়ে কিশোর ছুটল সোজা নদীর দিকে। বোটটেটি থাকলে সেটা আটকানোর ইচ্ছে। বন থেকে বেরিয়ে এসে দেখল পানির ধারে বাধা রয়েছে একটা মোটর বোট।

এখনও বেরোয়নি ওরা, কিশোর বলল। নেমে গিয়ে…

তার কথা শেষ হলো না। পেছন থেকে থাবা পড়ল হাতে। টর্চটী উড়ে গিয়ে পড়ল মাটিতে, নিভে গেল। বাল্ক ভেঙে গেছে বোধহয়। বাধা দেয়ার সুযোগ পেল না ওরা। কানের কাছে চেপে ধরা হলো পিস্তল। হাত-পা বেঁধে। মুখে কাপড় গুঁজে দেয়া হলো। তারপর বয়ে নিয়ে গিয়ে তোলা হলো বোটে।

ঘোঁৎ-ঘোৎ করে উঠল কে যেন। গর্জে উঠল ইঞ্জিন।

 চলতে শুরু করল বোট।

মুখ ঘুরিয়ে কিশোর আর রবিন দেখল, ডানে কালো তীরের সঙ্গে ওদের দূরত্ব বাড়ছে। বুঝতে পারল উজানের দিকে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে ওদের। দুজন লোক রয়েছে কাছাকাছি। এরাই ওদের ধরেছে। একজন লম্বা। অন্যজন বেটে, গাট্টাগোট্টা। হাল ধরেছে সে।

এদের নিয়ে গিয়ে কি করব? সঙ্গীকে জিজ্ঞেস করল লম্বা লোকটা।

দেব পানিতে ফেলে।

.

১৬.

হাত-পা বেঁধে বোটের তলায় ফেলে রাখা হয়েছে দুজনকে। অন্ধকার নদী ধরে যেন যুগ যুগ ধরে ছুটছে ওরা। রক্ত চলাচল ব্যাহত হওয়ায় অবশ হয়ে গেছে হাতের আঙুল। বোটের মাঝামাঝি অংশে একটা সীটে বসে ওদের পাহারা দিচ্ছে লম্বা লোকটা। তর্ক করছে বেটে সঙ্গীর সঙ্গে।

পানিতে ফেললে কি ঘটবে আন্দাজ করতে পারো? লম্বু বলল। কিডন্যাপ করাটাই বিরাট অপরাধ, ভিক, তারপর খুন…

থামো, ভীতু কোথাকার! খেঁকিয়ে উঠল বাটুল। ব্রুনো, তোমার যে কবুতরের কলজে, জানতাম না। এখানেই কোথাও ডোবাব ওদের। দেখি, নোঙরটা বের করো। ওটাতে বেঁধে ছেড়ে দেব।

শীতল শিহরণ বয়ে গেল রবিনের শিরদাঁড়া বেয়ে। লোকগুলো যে এতখানি সিরিয়াস, ভাবতে পারেনি এতক্ষণ। ভেবেছে কথার কথা বলছে। এখন দেখছে সত্যি সত্যি। তার মাথাটা রয়েছে বোটের একপাশ আর সীটের মাঝখানে। মুখ থেকে কাপড়টা ফেলার জন্যে বোটের গায়ে ঘষতে শুরু করল

দেখো, আমি এ সবের মধ্যে নেই! ব্রুনো বলল।

তাহলে বসে থাকো, ভিক বলল। আমিই যা করার করব।

 ইঞ্জিন নিউট্রাল করে বোট থামিয়ে দিয়ে উঠে এল বাঁটুল।

ইতিমধ্যে কাপড় খুলে ফেলেছে রবিন। আরেকটা ভারি ইঞ্জিনের শব্দ। কানে আসছে তার। এমনিতেও মরবে ওমনিতেও, পিস্তলের ভয় আর করল না। মরিয়া হয়ে গলা ফাটিয়ে চিৎকার শুরু করল, বাঁচাও! বাঁচাও!

লাফ দিয়ে তাকে থামাতে এগোল ব্রুনো।

জ্বলে উঠল সার্চলাইট। ছুটে আসতে লাগল একটা লঞ্চ। সাইরেন বেজে উঠল। বোটের ওপর এসে পড়ল তীব্র আলো।

রবিনকে ধরা বাদ দিয়ে লাফিয়ে গিয়ে আবার হালের কাছে বসে পড়ল। ভিক। ছুটতে শুরু করল বোট।

এ সব করে বাঁচতে পারবে না, চিৎকার করে বলল রবিন। ভয় পাচ্ছে, ওদেরকে পানিতে ফেলে দিয়ে না পেছনের লঞ্চটীকে ঠেকানোর চেষ্টা করে। ডাকাতগুলো। ওদের ফেলতে দেখলে নিশ্চয় থেমে যাবে লঞ্চ, খোঁজাখুজি। করবে। এই সুযোগে পালাবে দুই ডাকাত। তবু হাল ছাড়ল না সে। বলল, নদীটা নিশ্চয় চেনেন না। একটু পর পরই পুলিশের ঘাঁটি আছে। ধরা আপনাদের পড়তেই হবে।

জবাবে গতি আরও বাড়িয়ে দিল ভিক। স্পটলাইটের আলো থেকে বাঁচার জন্যে শাই করে একবার এদিকে হাল ঘোরাচ্ছে, একবার ওদিক। বার বার মোড় নিতে গিয়ে ভীষণ দুলতে আরম্ভ করেছে বোট।

আরে করছ কি! আতঙ্কে চিৎকার করে উঠল লম্বু বুকে ডুবিয়ে মারবে

ওর তো এই অভ্যাস আছেই, মোহনার কাছে আরেকটা বোটকে ডুবানোর কথা মনে পড়তে বলল রবিন। ভয় দেখানোর চেষ্টা করল, এই নদীর কোন কিছুই চেনেন না। নিচে যে কি মারাত্মক সব ডুবো পাথর আছে, জানেন না। তার ওপর অন্ধকার। সেবার তো তীরের কাছে ডুবেছিল বলে সাঁতরে উঠে জান বাঁচিয়েছেন। এবার রয়েছেন গভীর নদীতে। ডুবলে আর বাঁচতে পারবেন না।

তার সূরে সুর মিলিয়ে ব্রুনো বলল, ও ঠিকই বলেছে, ভিক, থামো তুমি! মরার চেয়ে পুলিশের হাতে পড়া ভাল!

ঠা-ঠা-ঠা-ঠা করে গুলির শব্দ হলো। গর্জে উঠেছে মেশিনগান।

আর চালানোর সাহস করল না ভিক। ইঞ্জিন বন্ধ করে দিল। তীব্র উজ্জ্বল সাদা আলোর বন্যা যেন ভাসিয়ে দিল বোটটাকে। পুলিশের লঞ্চের ভারি খোল এসে ঘষা খেল বোটের গায়ে।

লঞ্চ থেকে লাফিয়ে নামল একটা ভারি শরীর।

মুসা! আনন্দে চিৎকার করে উঠল রবিন।-তুমি এখানে!

ভালই আছ তোমরা আনন্দে গলা কেঁপে উঠল মুসার। দ্রুতহাতে বাঁধন খুলতে শুরু করল।

দুই চোরের হাতে হাতকড়া পরিয়ে দিল পুলিশ। লঞ্চে টেনে তুলল। মোটর বোটটাকে বেঁধে নেয়া হলো লঞ্চের সঙ্গে।

রকি বীচে ফিরে চলল লঞ্চ।

হেলান দিয়ে বসে কিশোর বলল, একটা কাজের কাজ করেছ, মুসা। এমন সময় মত পুলিশ নিয়ে হাজির হলে কি করে?

তোমাদের তুলে নিয়ে বোটটাকে চলে যেতে দেখলাম। পাগলের মত ছুটলাম গাড়ির দিকে। চলে গেলাম কাছের পুলিশ ফাঁড়িতে। ওদেরকে জানাতেই ওয়্যারলেসে যোগাযোগ করল একটা টহল লঞ্চের সঙ্গে। ছুটে চলে গেলাম আবার নদীর ধারে। লঞ্চটা আমাকে তুলে নিল। উজানের দিকে যেতে বললাম ওদের। রবিনের চিৎকারটা কাজে লেগেছে। তাড়াতাড়ি পাওয়া গেছে তোমাদের।

ও চিৎকার না করলে আর পেতে কিনা সন্দেহ আছে, কব্জি ডলতে ডলতে বলল কিশোর। আমাদের ডুবিয়ে দিতে চাইছিল বাটুল শয়তানটা।

রিভেরা হাউসের কাছে এসে তিন গোয়েন্দাকে নামিয়ে দেয়ার সময় লঞ্চের ক্যাপ্টেন বললেন, হেডকোয়ার্টারে দেখা কোরো। কিডন্যাপার দুটোকে ওখানেই নিয়ে যাচ্ছি।

মুসার গাড়িতে করে রকি বীচ থানায় চলল ওরা। শহরে ঢুকে সে বলল, খিদে পেয়েছে। প্রস্তাবটা মন্দ না, কিশোর আর রবিনেরও মনে ধরল। একটা ফাস্ট ফুডের দোকান থেকে হট ডগ আর গরম দুধ খেয়ে নিল।

থানায় এসে দেখল, ব্রুনো আর ভিককেও নিয়ে আসা হয়েছে। আরও দুজন অফিসারকে নিয়ে ওদের জেরা করছেন চীফ ইয়ান ফ্লেচার। কোন কথাই স্বীকার করতে চাইছে না দুই চোর।

বন্দরে চুরি-ডাকাতির কথা কিছু জানি না আমরা। ফুঁসে উঠল ভিক। কোন প্রমাণ আছে আপনাদের হাতে? প্রমাণ ছাড়া চোর বলতে পারেন না আমাদের।

কিডন্যাপার তো বলতে পারি, চীফ বললেন। তাতেই চলবে।

অনিশ্চিত দৃষ্টি ফুটেছে ব্রুনোর চোখে। চুপ করে রইল।

 কিশোর বলল, স্যার, আমার মনে হয় রিভেরা হাউসে গেলেই জোরাল প্রমাণ পাওয়া যাবে। আমরা যাব নাকি দেখতে?

এক মুহূর্ত ভাবলেন চীফ। উজ্জ্বল হলো চোখ। ভাল বুদ্ধি। একজন। অফিসারের দিকে তাকিয়ে বললেন, মরিস, একটা পেট্রল কার নিয়ে তুমিও যাও সঙ্গে।

.

১৭.

সে-রাতে দ্বিতীয়বারের মত রিভেরা হাউসে চলল তিন গোয়েন্দা। এবারও রাস্তার ধারেই গাড়ি রাখল। মরিসকে নিয়ে এল সেই জানালাটার কাছে, যেটা দিয়ে লাফিয়ে পড়েছিল দুই চোর।

ওই জানালা পথেই ভেতরে ঢুকে গেল ওরা।

শীঘ্রি আলো জ্বলে উঠল পুরানো বাড়িটার ঘরে ঘরে। তিন গোয়েন্দাকে নিয়ে খুঁজতে শুরু করল পুলিশ।

ডাইনিং রুমের কোণের একটা আলমারির দরজা টান দিয়ে খুলল মুসা। ভেতরে অনেকগুলো মলাটের বাক্স। হাত নেড়ে ডাকল মরিসকে, দেখে যান, এদিকে আসুন!

ছুটে এল মরিস, রবিন আর কিশোর। একটা বাক্স বের করে এনে মেঝেতে রেখে খুলল। পানি নিরোধক কাগজে মোড়া দামী একটা পরি। ফুলদানি রয়েছে ভেতরে। কোন দেশে তৈরি, সেটাও খোদাই করে লেখা। রয়েছে নিচে। জিনিসটা বিদেশী।

চোরাই মাল কোন সন্দেহ নেই, মরিস বলল। আগের বারও দেখে গেছি এই আলমারি। তখন এগুলো ছিল না।

অন্য বাক্সগুলোও খুলে দেখা হলো। নানা রকমের জিনিসে বোঝাই। চীনা মাটির তৈরি ঘর সাজানোর জিনিস, দামী গহনা, হীরা বসানো সোনার আঙটি আর হার, আরও নানা জিনিস।

ভ্রুকুটি করল রবিন। ডুডলি হ্যারিসের জিনিসগুলো কই? আর ক্যাপ্টেন টমারের পান্নার হার?

আবার শুরু হলো খোঁজা। একতলা-দোতলা-তিনতলার ঘর, চিলেকোঠা, সেলার; কোন জায়গাই বাদ দিল না। কিন্তু পাওয়া গেল না ওগুলো।

অবশেষে মরিস বলল, যা পাওয়া গেছে চোর দুটোকে ফাঁসানোর জন্যে যথেষ্ট। ওরাই রেখে গেছে এ সব।

তা ঠিক, কিশোর বলল। তবে মনটা খুঁতখুঁত করছে তার। পান্নার জিনিসগুলো পাওয়া গেল না কেন? কোথায় আছে ওগুলো?

বাইরে বেরিয়ে এল ওরা।

মরিসকে বলল কিশোর, আপনি যান। আমার টর্চটা পড়ে গেছে নদীর ধারে। ওটা নিয়ে আসি।

ঠিক আছে, যাও, বলে আরেকটা টর্চ কিশোরের হাতে ধরিয়ে দিয়ে পেট্রল কারের দিকে চলে গেল মরিস।

দুই সহকারীকে নিয়ে কিশোর রওনা হলো নদীর পাড়ে। টর্চটা খুঁজে পেল সহজেই। বাল্ক ভাঙেনি। ঝাঁকুনিতে নিভে গিয়েছিল। সুইচ টিপে হাতের তালুতে দুচারটা বাড়ি দিতেই জ্বলে উঠল।

ড্রাইভওয়েতে ফিরে এল আবার ওরা।

মুসা বলল, আবার সেই অনুভূতিটা ফিরে এসেছে আমার। ভয় ভয় লাগছে। মনে হচ্ছে কেউ যেন নজর রাখছে আমাদের ওপর।

হেসে বলল রবিন, উত্তেজনা কেটে গেছে তো, অনুভূতি ফিরে আসবেই। তোমার ভয়ের অনুভূতি মানে তো ভূতের ভয়।

জবাব না দিয়ে গাড়ির দিকে এগোল মুসা।

তিনজনেই চড়ে বসল। পকেটে হাত দিয়ে চাবি খুঁজছে মুসা, এই সময় কানে এল ইঞ্জিনের শব্দ। আরেকটা গাড়ি আসছে। আলো নিভিয়ে আসছে। ঝোপের আড়ালে থাকায় মুসার গাড়িটাকে দেখতে পেল না। সোজা এগিয়ে। গেল রিভেরা হাউসের গেটের দিকে। গাড়ি থামিয়ে নেমে গেল ড্রাইভার, গেটের পাল্লা খুলে দিয়ে ফিরে এসে গাড়িতে উঠল। গাড়ি নিয়ে ঢুকে পড়ল ভেতরে।

যাবে নাকি? জিজ্ঞেস করল রবিন।

মুসাকে বলল কিশোর, যাও।

হেডলাইট জ্বেলে দিল মুসা। খোলা গেটের দিকে এগোল সে-ও। ঢুকে পড়ল ভেতরে। গাড়িটা দেখতে পেল না।

ড্রাইভওয়েটা ঘুরে গিয়ে বাড়ির পেছনে যেখানে শেষ হয়েছে, সেখানে এনে গাড়ি রাখল মুসা।

নেমে পড়ল ওরাও। সামনে ঘন ঝোপঝাড়। চারাগাছকে নির্ভর করে ঘন হয়ে উঠে গেছে আঙুর লতা। বাড়ির অনেকখানিই দেখা যায় না এর জন্যে।

টর্চের আলোয় মাটি পরীক্ষা করতে লাগল কিশোর। অবাক হয়ে দেখল, চাকার দগি সোজা চলে গেছে বিল্ডিঙের দিকে।

লতানো ঝোপের দিকে এগোল রবিন। লতাপাতা ধরে টেনে ফাঁক করে বাড়িটা দেখার চেষ্টা করল। অবাক হয়ে দেখল একটা রাস্তা চলে গেছে গাছের জটলার ভেতর দিয়ে।

খাইছে! গুপ্তপথ! কাঁধের কাছে বলে উঠল মুসা।

রহস্যময় গুপ্তপথটা ধরে এগিয়ে চলল ওরা। মাথার ওপরে পাতার চাঁদোয়া। ফাঁক-ফোকর দিয়ে আকাশ চোখে পড়ে এক-আধটু। তবে অন্ধকারই বেশি। অনেকটা গাছের সুড়ঙ্গের মতই মনে হচ্ছে। কোন রকম সাড়াশব্দ না পেয়ে টর্চ জ্বালার সিদ্ধান্ত নিল কিশোর।

মরিসের দেয়া টর্চটা হাতে নিয়েছে রবিন।

ধসে পড়া একটা গোলাঘর ফুটে উঠল টর্চের আলোয়। মাটিতে চাকার দাগ। এগিয়ে গেছে ঘরটার দিকে।

ঘরে ঢুকে পড়ল ওরা। সামনের অর্ধেকটা একেবারে খালি। সামনের দিকে চালার আড়া বেঁকে গেছে, বেশি চাপ পড়লে ভেঙে যাবে। পেছনের অর্ধেক খড়ে বোঝাই। সামনের দিকটায় ওপর থেকে ঝুলে আছে খড়গুলো, যেন উপচে পড়তে চাইছে।

কবেকার খড়! মুসা বলল। মনে তো হয় রিভেরাই রেখে গিয়েছিল এগুলো।

তাহলে এই খড় সরানোর কাটাটা নতুন কেন? কাঠের হাতল লাগানো লোহার তিনটে বড় কাটাওয়ালা যন্ত্রটা দেখাল রবিন। খড়ের গাদার কাছে মাটিতে পড়ে আছে।

এবং গাড়িটাই বা কোথায়? কিশোরের প্রশ্ন।

সামনের দিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকতে থাকতে আচমকা নড়ে উঠল সে। এগিয়ে গেল খড়গুলোর দিকে। কাঁটাটা তুলে নিয়ে খোঁচা দিল খড়ে। কাঠে লাগার শব্দ হলো। কাটা ফেলে খড় ফাঁক করে দেখল। ভেতরে প্লাইউডের বোর্ড একটা হাতল লাগানো আছে।

হাতল ধরে টানতেই দরজার পাল্লার মত করে সরে এল প্লাইউড।

খাইছে! হাঁ করে তাকিয়ে আছে মুসা।

রবিনও হাঁ হয়ে গেছে।

খড়ের গাদার নিচে গোপন গ্যারেজ তৈরি করা হয়েছে। তার মধ্যে যেন আরাম করে ঘুমিয়ে আছে লেটেস্ট মডেলের একটা কালো রঙের মেটিওর স্পেশাল গাড়ি।

গাড়িটার দুই পাশেই জায়গা আছে। একদিক দিয়ে ঢুকে গেল কিশোর। বনেটে হাত রেখে বলল, ইঞ্জিন এখনও গরম। একটু আগে ঢোকানো হয়েছে।

রবিন আর মুসাও এগিয়ে এল। একমত হলো কিশোরের সঙ্গে।

 শব্দ শুনতে পেল মুসা। ফিসফিস করে বলল, শুনছ? গোঙানি!

আলো ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে দেখতে শুরু করল কিশোর। গ্যারেজের মেঝেতে কেউ নেই। গাড়ির পেছনের সীটের নিচে আলো পড়তেই চমকে উঠল।

মেঝেতে পড়ে আছে একজন মানুষ। হাত-পা বাঁধা। মুখে কাপড় গোঁজা।

ঢোঁক গিলল মুসা।

কে-কেউ ওকে বেঁধে ফেলে গেছে!

আলো ধরে রাখল কিশোর আর রবিন। দরজা খুলে ভেতরে গিয়ে লোকটার বাঁধন কেটে দিল মুসা।

ধীরে ধীরে উঠে বসল লোকটা। কব্জি আর গোড়ালি ডলে রক্ত চলাচল স্বাভাবিক করতে গিয়ে গুঙিয়ে উঠল আবার।

.

১৮.

তার সঙ্গে কথা শুরু করল রবিন, আপনাকে কোথাও দেখেছি মনে হয়?

কোথায় দেখেছে মনে পড়ল। হ্যারিসের বাড়িতে আড়ি পেতে থাকা লোকটাকে যখন তাড়া করেছিল কিশোর, তখন রাস্তায় দাঁড়িয়ে ছিল যে নীল জ্যাকেট পরী লোকটা, এ সেই। উদ্ধার পেয়েছে এর জন্যে কৃতজ্ঞ হবে, তা না, জ্বলন্ত চোখে ওদের দিকে তাকাল সে। কপালের ঘাম মোছার জন্যে পকেট থেকে রুমাল টেনে বের করতে গেল। টান লেগে কি যেন একটা পড়ল পকেট থেকে।

দেখে ফেলল রবিন। নিচু হয়ে তুলে নিল। একটা নকল দাড়ি।

বুঝে ফেলল কিশোর। বলল, তার মানে আপনিই আড়ি পেতে শুনছিলেন হ্যারিসের বাড়িতে। এখন বলে ফেলুন তো, ছদ্মবেশ নিয়েছিলেন কেন? খেলাটা কি আপনার?

জবাব দিল না লোকটা। আরেক দিকে মুখ ফেরাল।

 মুসা বলল, না বললে আবার বেঁধে এই গাড়িতে ফেলে যাব আপনাকে। নিশ্চয় বুঝতে পারছেন আমাদের তিনজনের সঙ্গে পারবেন না।

অগত্যা হার স্বীকার করে নিল লোকটা। বলল, হ্যাঁ, আড়ি পেতে আমি শুনেছি। তবে তাতে লাভের লাভ কিছুই হয়নি। এই জ্যাকেটটাও মাত্র একবার কাজ দিয়েছে। গায়ের জ্যাকেটটা খুলে উল্টে দেখাল সে। ভেতরের দিকটা বাদামী। তারমানে দুই দিকেই পরা যায়। এক পিঠের রঙ নীল, আরেক পিঠ বাদামী। তোমরা যখন আমাকে তাড়া করলে, এক ফাঁকে দাড়ি খুলে নিলাম। জ্যাকেটটা খুলে উল্টে নিয়ে পরে ফেললাম।

এবং আমাদের ধোকা দিলেন, রবিন বলল। ঠিক আছে, বলে যান।

 আমি একজন প্রাইভেট ডিটেকটিভ। এতদিন এ কাজে গর্ব বোধ করতাম। তবে এবার ঘেন্না ধরে গেছে। আর না। এই পেশা ছেড়ে দেব ঠিক করেছি।

দ্রুত ভাবনা চলেছে কিশোরের মাথায়। প্রাইভেট ডিটেকটিভ? নিশ্চয় বীমা কোম্পানির। আপনার নাম মিলার প্যাটোলি?

মাথা ঝাঁকাল লোকটা। আমার আসল নাম প্যাট ব্রিংহ্যাম। ক্যাপ্টেন টমারের চুরি যাওয়া হার খুঁজে বের করার দায়িত্ব দেয়া হয়েছে আমাকে। আমি শুনলাম, তার সঙ্গে দেখা করতে গিয়েছিলে তোমরা। তাই আড়ি পেতে শুনতে গিয়েছিলাম, তোমরা কতটা জানো। সেখানে শুনলাম, বুড়ো হ্যারিসও পান্নার জিনিস হারিয়েছে। আমি জানি কে নিয়েছে। বিশালদেহী ওই লোকটা, চশমা পরে যে–উইক শিপরিজ-সে নিয়েছে। এটা আমি বের করে ফেলেছি।

উইক শিপরিজ? রবিনের দিকে তাকাল কিশোর। নামটা এই প্রথম শুনল ওরা। ভাবছে, ওই লোকই অ্যালেক্স ককারের নকল নয় তো?

হ্যাঁ, জবাব দিল প্যাট, উইক শিপরিজ। সারা শহরে তার পেছনে ঘুরে বেড়িয়েছি আমি। শেষে তার গাড়িতে উঠে পেছনে লুকিয়ে থেকেছি। ভেবেছি, টমারের হারটার কাছে আমাকে নিয়ে যাবে সে। কিন্তু সর্বনাশ করে দিল। হতচ্ছাড়া হাঁচি! নাক এত সুড়সুড় করতে লাগল কিছুতেই হাঁচি না দিয়ে পারলাম না। তারপর আর কি। মাথায় বাড়ি মেরে আমাকে বেহুশ করে ফেলল উইক। হুঁশ ফিরলে দেখি অন্ধকারে হাত-পা বাঁধা অবস্থায় গাড়ির মেঝেতে পড়ে আছি। উফ, কি যে কষ্ট! গোয়েন্দাগিরি মানুষে করে নাকি!

মানুষেই করে, মুচকি হেসে বলল কিশোর, সবাই সহ্য করতে পারে না, এই আর কি। যাকগে। ভাল তথ্য দিলেন। সবাই মিলে এখন উইককে খুঁজতে যাব। আপনি যাবেন?।

একটু আগের প্রতিজ্ঞার কথা বেমালুম ভুলে গেল প্যাট। উজ্জ্বল হয়ে উঠল মুখ। নিশ্চয় যাব!

ওকে নিয়ে বেরিয়ে এল তিন গোয়েন্দা।

রিভেরা হাউসের জানালাটা এখনও ভোলা। সেটা দিয়ে ঢুকে পড়ল। চারজনেই। কিন্তু অনেক খোঁজাখুঁজি করেও উইককে পাওয়া গেল না। কোথাও।

ঘরে নেই, হাল ছেড়ে দিয়ে বলল কিশোর। বাইরে জঙ্গলের মধ্যে থেকে থাকলে ওকে আজ রাতে পাওয়ার আশা ছাড়তে হবে। পুলিশকে জানানো দরকার।

মুসার গাড়িতে করে শহরে ফিরে এল ওরা।

আমাকে আমার মোটেলে নামিয়ে দাও, অনুরোধ করল প্যাট। আজ রাতে আর কুটোটিও সরাতে পারব না। গোয়েন্দাগিরি অনেক হয়েছে।

ওকে নামিয়ে দিয়ে থানায় চলে এল তিন গোয়েন্দা। অফিসেই আছেন ফ্লেচার। কয়েকজন পুলিশ অফিসার আছে ঘরে। ব্রুনো আর ভিককে জেরা করা বোধহয় শেষ হয়েছে। ওরাও বসে আছে। আগের তেজ আর নেই ভিকের। বুকের ওপর ঝুলে পড়েছে মাথা। পুলিশের একজন ক্লার্ক কাগজ আর পেন্সিল নিয়ে ওদের জবানবন্দি নিতে তৈরি।

তিন গোয়েন্দাকে ঢুকতে দেখে হেসে বলল অফিসার মরিস, আমি চোরাই মাল নিয়ে আসার পরও বহুত উঁটি দেখিয়েছে। স্বীকার করতে চায়নি। একটু আগে সব বলতে রাজি হয়েছে। বাটুলটার নাম ভিক বারগার। আর লম্বুটা ব্রুনো বেকিং।

চেয়ার টেনে বসল ছেলেরা।

ব্রুনো বলল, হ্যাঁ, মোটর বোটটা আমরা চুরি করে এনেছি। বন্দরে অনেকের বোট বাঁধা আছে। রাতে কোন একটা চুরি করে নিয়ে কাজে বেরোতাম। মাস্টার কী ছিল আমাদের কাছে। ইঞ্জিন স্টার্ট দিতে অসুবিধে হত না। কাজ শেষ হলে নিয়ে গিয়ে আবার বোট রেখে দিতাম আগের জায়গায়। জাহাজের গায়ে বোট ঠেকিয়ে উঠে জাহাজ থেকেও জিনিস চুরি করেছি আমরা।

কি জিনিস? প্রশ্ন করলেন চীফ।

অনেক কিছু।

পান্নার তৈরি জিনিসও নিশ্চয়? জিজ্ঞেস করল কিশোর। চোখ গরম করে ওর দিকে তাকাল ভিক। তুমি জিজ্ঞেস করার কে! ধমক দিয়ে বললেন ফ্লেচার, জবাব দাও ওর কথার! চোখের আগুন নিভল না ভিকের। আরেক দিকে মুখ ফেরাল। ব্রুনো জবাব দিল, হ্যাঁ। তোমাদের দলপতি কে? রবিন জানতে চাইল।

দলপতি নেই, ব্রুনো জবাব দেয়ার আগেই তাড়াতাড়ি বলে উঠল ভিক, আমরা দুজনই–আমি আর ব্রুনো।

ব্রুনোর মত একজন মাথামোটা ভীতু লোককে নিয়ে তুমি লক্ষ লক্ষ ডলারের জিনিস চুরি করে গাপ করে দিয়েছ, এ কথা বিশ্বাস করতে বলো আমাদের? ব্যাঙ্গের হাসি হাসল রবিন, হাসালে। তোমাদের বস উইক শিপরিজের কথা আমরা জেনে গেছি।

এমন চমকে গেল দুই চোর, যেন বোলতায় হুল ফুটিয়েছে।

 তু-তুমি কি করে জানলে… বলতে গিয়ে বাধা পেল ব্রুনো।

ধমকে উঠল ভিক, চুপ, গাধা কোথাকার! থামো!

চেয়ারে এলিয়ে পড়ল ব্রুনো।

কিশোর বলল, আর অস্বীকার করে লাভ নেই। উইক আর পান্নার জিনিসগুলো কোথায়, বলে ফেলো এখন।

নিজেরাই গিয়ে বের করে নাও না! দাঁতে দাঁত ঘষল ভিক।

তেজ দেখাবে না বলে দিলাম! কঠিন গলায় ধমক দিলেন চীফ। ভাল চাও তো, যা জিজ্ঞেস করে, জবাব দাও।

ভিকের দিকে তাকাল ব্রুনো, সবই তো বলে দিলাম। আর গোপন রেখে লাভ কি? ছেলেদের দিকে ফিরল সে। কি জানতে চাও?

রবিন জিজ্ঞেস করল, মিস্টার হ্যারিসের জিনিসগুলো কে চুরি করেছে?

টমারের হারটা আমরা নিয়েছি। হ্যারিসেরগুলো করেছে উইক আর কুপার। প্রথমে হ্যারিসের বাড়িতে গিয়ে কৌশলে তাকে দিয়ে পান্নার কিছু জিনিস বের করায় উইক। তারপর হ্যারিসকে দাবার বোর্ড আনতে পাঠিয়ে জিনিসগুলো নিয়ে বেরিয়ে যায়। বাড়ি খালি ফেলে তার পিছু নেয় হ্যারিস। ওই সময় বাড়িতে ঢুকে বাকি জিনিসগুলো নিয়ে আসার কথা ছিল কুপারের। কিন্তু সময়ের হেরফের করে গোলমাল করে দিয়েছিল সে। বাধ্য হয়ে তখন উইককে আবার যেতে হয়। তোমরা তখন হ্যারিসকে তার বাড়িতে পৌঁছে দিতে গেছ। আমাদের সঙ্গে বন্দরে দেখা করার কথা ছিল কুপারের। সেটাও সে করেনি। একটা বোট নিয়ে রিভেরা হাউসে তাকে পৌঁছে দেয়ার জন্যে তৈরি হয়ে বসেছিলাম আমি আর ভিক।

 মাথা ঝাঁকাল কিশোর। ওই বাড়িতে উইকের সঙ্গে দেখা হলো তোমাদের। সে নিয়ে গেছে পান্নার জিনিসগুলো, আর তোমরা অন্যান্য চোরাই মাল।

হ্যাঁ

লোকের বোট চুরি করে কাজ সারার ফন্দিটা কার মাথা থেকে বেরিয়েছিল? জিজ্ঞেস করলেন চীফ।

উইক। গাড়ির ওপর চোখ পড়ে গিয়েছিল পুলিশের গাড়ি আর নিরাপদ ছিল না। তাই বোট চুরি করতে শুরু করলাম, যাতে মালিকরাও কিছু বুঝতে না পারে। তবু সামাল দেয়া কঠিন হয়ে পড়ল। পুলিশ তো আছেই, এই ছেলেগুলোর উৎপাতে অতিষ্ঠ হয়ে উঠেছিলাম, তিন গোয়েন্দাকে দেখাল সে। আজ রাতে সেলারে গিয়ে দরজা বন্ধ দেখে, ঘরে ঢুকতে না পেরে চেঁচাতে শুরু করল। আমরা তো ভাবলাম পুলিশ এসে ঘিরে ফেলেছে। জানালা টপকেই পালালাম।

প্রথম হাসল মুসা। হাসিটা সংক্রামিত হলো রবিন আর কিশোরের মাঝে। মুচকি হাসলেন ফ্লেচার। মরিসও হেসে ফেলল।

মুখটাকে বিষণ্ণ করে রাখল ব্রুনো।

ভিকের চেহারা থমথমে।

হাসতে হাসতে ছেলেদের দিকে ফিরলেন চীফ। জিজ্ঞেস করলেন, হ্যাঁ, এইবার বলো, উইকের কথা জানলে কি করে?

বলল রবিন। গোপন গ্যারেজ আর বন্দি ডিটেকটিভের কথা শুনে ভুরু কুঁচকে গেল চীফের।

 চাবির রিঙটা বের করে দিল কিশোর, এটা পাওয়াতে অনেক সুবিধে হয়েছে আমাদের।

হু, মাথা দোলালেন চীফ। মনে হচ্ছে, শেষ হয়ে এসেছে কেসটা। অফিসারদের প্রয়োজনীয় নির্দেশ দিলেন তিনি, সকাল হলেই দলবল নিয়ে চলে যাবে রিভেরা হাউসে। তন্ন তন্ন করে খুজবে বাড়িটা। উইক আর কুপারকে সহ পান্নার জিনিসগুলো বের করার চেষ্টা করবে। গোলাঘর থেকে মেটিওর গাড়িটা বের করে নিয়ে আসবে।

ব্রুনো আর ভিকের ধরা পড়ার খবর নিশ্চয় পেয়ে যাবে ওরা, মরিস। বলল। যদি তল্পি গুটিয়ে পালানোর চেষ্টা করে?

শহর থেকে বেরোনো সমস্ত পথ ওদের জন্যে বন্ধ করে দিতে হবে। সব জায়গায় নজর রাখতে হবে। বিশেষ করে রাস্তাগুলো আর বন্দর। কড়া পাহারা বসিয়ে দাওগে ওসব জায়গায়। কিছুতেই যাতে বেরোতে না পারে। রিভেরা হাউসের চারপাশেও পাহারার ব্যবস্থা করবে।

কিশোর বলল, কিন্তু পুলিশ দেখলে তো সতর্ক হয়ে যাবে উইক। বাড়িতে ঢুকবে না।

জানি। সেজন্যেই এমন করে লুকিয়ে থেকে পাহারা দিতে হবে, যাতে উইক দেখতে না পায়। সে মনে করে, কেউ নেই, আগের মতই নির্জন। যেই ঢুকবে, অমনি ধরে ফেলা হবে।

নির্দেশ মত কাজ করার জন্যে তাড়াহুড়ো করে বেরিয়ে গেল। অফিসারেরা।

তিন গোয়েন্দার দিকে তাকালেন চীফ, আবার পুলিশকে বিরাট সাহায্য করলে তোমরা। অনেক ধন্যবাদ। যাও, বাড়ি যাও। বিকেলে ফোন করে আমাকে। খবর জেনে নিয়ো।

.

১৯.

 রাত অনেক হয়েছে। ঘুমন্ত শহরের পথ দিয়ে গাড়ি চালাচ্ছে মুসা। পেছনের সীটে বসা কিশোর বলল রবিনকে, বুঝতে পারছি না কি ঘটবে! উইক আর কুপার এখনও মুক্ত। পান্নাগুলোও খুঁজে পাওয়া যায়নি।

 একমত হয়ে রবিন বলল, মিস্টার ককারকে হুমকি দিয়ে লেখা নোট রহস্যেরও কিনারা হলো না। সেদিন রাতে অমন ভয়াবহ চিৎকারই বা দিয়েছিল কে?

হু! আনমনে নিচের ঠোঁটে একবার চিমটি কাটল কিশোর। কেসটা শেষ হয়নি এখনও। অনেক কিছু বাকি?

আগে গিয়ে ভালমত ঘুমিয়ে নাও, সকালে ভাবনা-চিন্তা কোরো, হাই তুলল মুসা। ব্রেক কষল। বাড়ি এসেছে। নামো।

পরদিন সকালে ডিরেক্টরি ঘেটে ককারের বাড়ির ফোন নম্বর বের করে ফোন করল কিশোর। রিভেরা হাউসে নয়, তাঁর আসল বাড়িতে, যেখানে বাস করেন। আগের রাতে রিভেরা হাউসে যে চোর ধরা পড়েছে, জানানোর জন্যে। ফোন ধরল না কেউ।

তখন ব্যাংকে ফোন করল কিশোর।

সরি, স্যার, ব্যাংক থেকে জবাব দিল একজন, মিস্টার ককার এখনও আসেননি। তিনি কোথায়, তা-ও বলতে পারব না। বলে যাননি।

কিছুক্ষণ পর রবিন এল। তাকে খবরটা জানাল কিশোর। সারাটা সকাল ওঅর্কশপে বসে রইল দুজনে। খানিক পর পরই ককারের বাড়িতে ফোন করল কিশোর। একবারও ফোন তুলল না কেউ।

দুপুরে খাওয়ার পর আর বসে থাকতে পারল না কিশোর। রবিনকে নিয়ে থানীয় রওনা হলো।

অফিসে আছেন চীফ। চোখের কোণে কালি। চোখ লাল। সারারাত ঘুমাননি। সকাল থেকেও নিশ্চয় বিছানায় পিঠ লাগানোর সুযোগ মেলেনি। জানালেন, পাশের শহরের এক মোটেল থেকে কুপারকে ধরে আনা হয়েছে।

রিভেরা হাউসের প্রতিটি ইঞ্চি খুঁজে দেখা হয়েছে, বললেন তিনি। মেটিওরটা নিয়ে এসেছে মরিস। কিন্তু উইক কিংবা পান্নাগুলোর কোন খোঁজ, মেলেনি। রিভেরা হাউসে নেই। নিশ্চয় অন্য কোনখানে লুকিয়েছে।

থানা থেকে বেরিয়ে একটা পাবলিক টেলিফোন বুঁদ থেকে আবার। ককারের বাড়িতে ফোন করল কিশোর। সেই একই অবস্থা। জবাব নেই। আবার ব্যাংকে ফোন করল সে। ব্যাংকেরও একই জবাব, আসেননি। কোন খোঁজ পাওয়া যাচ্ছে না।

বুদ থেকে বেরিয়ে এসে রবিনকে বলল সে, ব্যাপারটা ভাল মনে হচ্ছে না আমার। তাঁর বাড়িতে যাওয়া দরকার।

শহরের একধারে ককারের বাড়িতে এসে ঢুকল দুই গোয়েন্দা। সদরদরজার ঘণ্টা বাজিয়ে, অনেক ধাক্কাধাক্কি করেও সাড়া না পেয়ে সন্দেহ চরমে উঠল। শেষে আবিষ্কার করল, দরজায় তালা দেয়া।

পুলিশকে জানানো দরকার, গম্ভীর হয়ে বলল কিশোর। শিওর, খারাপ কিছু হয়েছে ককারের।

আধঘণ্টা পর থানা থেকে কয়েকজন পুলিশ নিয়ে এসে আবার ককারের বাড়িতে ঢুকল ওরা।

তালা ভেঙে ঘরে ঢুকল পুলিশ। সুন্দর করে সাজানো রয়েছে ঘরগুলো। সবই ঠিক আছে, কেবল ককার নেই।

আপাতত আর কিছু করার নেই। নতুন কিছু জানতে পারলে জানাবে, কিশোরকে কথা দিয়ে দলবল নিয়ে চলে গেল আফিসার মরিস।

নিজেদের গাড়িতে চড়ল দুই গোয়েন্দা।

চিন্তিত ভঙ্গিতে কিশোর বলল, আমার ধারণা, রিভেরা হাউসে গিয়েছিলেন ককার। বিপদে পড়েছেন। ওখানেই চলো।

বিকেলের মাঝামাঝি। কিন্তু সেই তুলনায় আলো কম। পশ্চিম আকাশে। মেঘ জমছে। চলতে চলতে হঠাৎই কোন রকম জানান না দিয়ে কেশে উঠে বন্ধ হয়ে গেল ফোক্স ওয়াগেনের ইঞ্জিন।

অনেক চেষ্টা করেও গোলমালটা ধরতে পারল না রবিন। কোন মতেই স্টার্ট করতে না পেরে বিরক্ত হয়ে গাড়িটাকে ঠেলে রাস্তার পাশে নামাল দুজনে। তেতো গলায় কিশোর বলল, আর কোন উপায় নেই, হেঁটেই যেতে হবে।

অনেক সময় খেয়ে নিয়েছে গাড়িটা। বিকেল শেষ। গোধূলিও শেষ হয়ে গেল দ্রুত। ঘণ্টাখানেক একনাগাড়ে হাঁটার পর ম্যানিলা রোডের মোড়ে এসে পৌঁছল ওরা। রিভেরা হাউসে যখন ঢুকল, অন্ধকার হয়ে গেছে। ঢুকতে বাধা দিল না ওদের কেউ, কোন পুলিশম্যানকে দেখা গেল না আশেপাশে।

সোজা সেলারে ঢোকার মুখের দিকে এগোল কিশোর। ভাগ্যিস, চাবিটা ছিল সঙ্গে।

আকাশে গুড়গুড় করে মেঘ ডাকল। ঢাকনার তালায় চাবি ঢোকাল সে। সেলারে নেমে অন্য সিঁড়িটী বেয়ে রবিনকে নিয়ে ওপরে উঠতে শুরু করল। ভেবেছিল দরজায় তালা লাগানো দেখতে পাবে। ভেঙে কিংবা অন্য কোন ভাবে খুলতে হবে। কিন্তু অবাক হলো। দরজাটা ভোলা।

ভালই হলো। পরিশ্রম বাঁচল। ভেতরে ঢুকে পড়ল ওরা।

অন্ধকারে পা টিপে টিপে লিভিং রুমের দিকে এগোল। কিছুদূর যেতে না যেতেই কিশোরকে চেপে ধরল অসাধারণ শক্তিমান দুটো হাত। ফেলে দিল মেঝেতে। আরেকটী দেহ পড়ার শব্দ কানে এল তার। নিশ্চয় রবিনকেও ফেলেছে।

দীর্ঘ পথ হেঁটে এসে ক্লান্ত হয়ে পড়েছে ওরা। তবু বাধা দেয়ার চেষ্টা করল। টিকতে পারল না। মাথায় কঠিন কিছুর বাড়ি খেয়ে আধাবেহুশ হয়ে গেল কিশোর। টেনে এনে তাকে একটা চেয়ারে বসিয়ে হাতল আর পায়ার সঙ্গে হাত-পা বেঁধে ফেলা হলো। রুক্ষ হাতে মুখে ঠেসে দেয়া হলো কাপড়। একপাশে ধস্তাধস্তির আওয়াজ শুনে বুঝতে পারল, রবিনকেও কাবু করে ফেলা হচ্ছে।

তারপর নীরবতা। কানে আসতে লাগল এ্যাণ্ডফাদার কুকটার একটানা। একঘেয়ে শব্দ:

টিক-টক। টিক-টক! টিক-টক!

মাথার মধ্যে এখনও কেমন করছে তার, ঘোর পুরোপুরি কাটেনি। এরই মধ্যে ভাবল, রবিন কি এ ঘরেই আছে? না অন্য কোথাও নিয়ে যাওয়া হয়েছে। তাকে?

.

২০.

 কানে এল পা টেনে টেনে হাঁটার আওয়াজ। ভারি নিঃশ্বাস ফেলছে কেউ। জ্বলে উঠল একটা মান আলো। পুরো দৃশ্যটা দেখতে পেল কিশোর।

লিভিং রুমে রয়েছে সে। জানালার ভারি পর্দাগুলো টেনে দেয়া হয়েছে। এককোণে টিক টিক করে চলছে গ্র্যাণ্ডফাদার কুক। রবিনকেও তারই মত বেধে বসিয়ে রাখা হয়েছে পুরানো আমলের একটা পিঠ উঁচু চেয়ারে।

ওদের সামনে দাঁড়ানো লম্বা, বিশালদেহী একজন লোক। চোখে চশমা। ককারের মতই দেখতে অনেকটা, তবে ককার নয় সে। নিজের পরিচয় দিল উইক শিপরিজ বলে।

তাহলে এই লোকই সেই লোক, বন্দর-চোরদের দলপতি! ভাবল রবিন। মাথায় বাড়ি মেরে আমাদের কাবু করে চেয়ারে এনে বেঁধেছে। শয়তান কোথাকার!

একবার এর দিকে, একবার ওর দিকে তাকাতে লাগল উইক। বাঁকা হাসি হেসে বলল, অবাক হয়েছ, না? অন্যের কাজে নাক গলানোর শাস্তি এবার পাবে তোমরা।

রাগ চেপে চুপ করে রইল রবিন।

আজকের সন্ধ্যায় তোমাদের জন্যে অনেকগুলো চমকের ব্যবস্থা করেছি। আমি। তোমাদের বন্ধু অ্যাক্সে ককারও সে-সব উপভোগ করবে। গোয়েন্দাদের দিকে তাকিয়ে ঠাট্টা করে চোখ টিপল সে। তোমরা ভেবেছিলে, দুনিয়ায় একমাত্র তোমরাই চালাক। বোকা আর কাকে বলে। তোমরা কি জানো, যতবার এখানে এসেছ তোমরা, পুলিশ এসেছে, তোমাদের ওপর চোখ রাখা হয়েছে?

যদিও ভয় যে পেয়েছে এটা বুঝতে দিল না কিশোর কিংবা রবিন, বুঝতে পারল সাংঘাতিক চালাক এক খেপা অপরাধীর পাল্লায় পড়েছে এবার। ভেবে অবাক হলো, তাদের ওপর নজর রাখার কাজটা কে করেছে?

ঘড়ির দিক থেকে একটা চি-চি স্বর শোনা গেল। ঘুরে তাকলি উইক, গোরো, বেরিয়ে আসুন। মেহমান এসেছে।

তাজ্জব হয়ে দেখল দুই গোয়েন্দা ঘড়িটী তার পেছনের দেয়ালের খানিকটা অংশ নিয়ে পাশে সরতে আরম্ভ করেছে।

দরজা! চাপা গলায় নিজেকেই যেন বলল কিশোর, ঘড়ি দিয়ে আড়াল করা ছিল! নিশ্চয় দরজা খোলার গোপন সুইচ আছে!

বেরিয়ে এল সাদা-চুল এক বৃদ্ধ। নিখুঁত করে দাড়ি কামানো, নীল চোখ। এগিয়ে এসে ছেলেদের সামনে দাঁড়াল। অনিশ্চিত কণ্ঠে বলল, মিস্টার শিপরিজ, মেহমান হলে ওদের বেঁধে রাখা হয়েছে কেন? আপনি তো বলতেন বিরক্ত করার জন্যে এখানে ঢোকে ওরা। ক্ষতির ভয়েই তো কড়া নজর রাখতাম  

অবাক লাগল কিশোরের। রবিনের দিকে তাকিয়ে দেখল সে-ও অবাক হয়েছে। উইকের দলে কাজ করে এই লোক? ঠিক মানায় না।

সময় হলেই সব বুঝবে, গোরো, উইক বলল। গোয়েন্দাদের অবাক হয়ে বুড়োর দিকে তাকিয়ে থাকতে দেখে মুচকি হাসল। ওহ, পরিচয় করানো হয়নি। ওর নাম গোরো কিনডার। একজন আবিষ্কারক। খুব বুদ্ধিমান।

আস্তে মাথা ঝাঁকাল গোরো। উইক, আপনি বলেছেন এরা আপনার পরিকল্পনা ভণ্ডুল করে দিতে চায়। কিন্তু আমার কাছে তো নিরীহ ছেলে বলেই মনে হচ্ছে। আমার মনে হয় না…

আপনার মনে হওয়া নিয়ে আমার কোন মাথাব্যথা নেই! কর্কশ গলায় বলল উইক। কাজটা শেষ হয়েছে?

হয়েছে হয়েছে, তাড়াতাড়ি বলল গোরো, শেষ হয়ে গেছে। অত উত্তেজিত হওয়ার কিছু নেই।

কে উত্তেজিত হচ্ছে! খেঁকিয়ে উঠল উইক। যান, নিয়ে আসুন।

 তাড়াহুড়ো করে গুপ্তপথ দিয়ে ভেতরে ঢুকে গেল গোরো।

ছেলেদের দিকে ফিরল উইক। খুব চমকে গেছ, না? এ বাড়িতে একটা নয়, দুটো গোপন ঘর আছে, সেটা নিশ্চয় জানা ছিল না তোমাদের। তোমরা যখন পুলিশকে সঙ্গে নিয়ে খোঁজাখুজি করে গেলে, তখন আমি চুপ করে বসেছিলাম ওই ঘড়ির পেছনের ঘরে। আজ সকালে যখন পুলিশ এল, তখনও ছিলাম।

নিজের মাথা ভাঙতে ইচ্ছে করল কিশোরের। ঘড়িটা দেখে তার সন্দেহ হয়েছিল, যতবার ওটার দিকে চোখ পড়েছে, ততবারই মনে হয়েছে কোন একটা রহস্য আছে ওটীর। তারপরেও ভাল করে পরীক্ষা করে দেখল না কেন!

রবিন ভাবছে অন্য কথা, উইকই কি ককারকে হুমকি দিয়ে নোট রেখে এসেছিল? এ কাজে তাকে সাহায্য করেছে গোরো? কিন্তু বুড়ো মানুষটীকে দেখে মনে হয় না সে কারও ক্ষতি করতে পারে।

ফিরে এল গোরো। হাতে একটা ভারি জিনিস। কালো বাক্সের মত দেখতে, এদিক ওদিক থেকে কয়েকটা অ্যান্টেনার মত বেরিয়ে আছে।

গুড! দুই হাত ডলতে ডলতে বলল উইক। কালো বাক্সটা দেখিয়ে গোয়েন্দাদের জিজ্ঞেস করল, এটা কি চিনতে পারছ?

টাইম বম্ব! বিড়বিড় করল কিশোর।

বাহ, বুদ্ধিমান ছেলে। বুঝে ফেলেছ, খিকখিক করে হাসল উইক। বোমা তৈরিতে একজন বিশেষজ্ঞ গোরো। বুড়োর দিকে তাকাল সে। যে ভাবে করতে বলেছি, করেছেন তো?

নিশ্চয়। আমার ভুল হয় না। ইলেকট্রনিক পদ্ধতিতে…

আপনার পদ্ধতির কথা কে জানতে চায়! কর্কশ গলায় নিতান্ত অভদ্রের মত বাধা দিল উইক। মাল ঠিকঠাক মত ভরেছেন কিনা, সেটা বলুন। এ বাড়িটাকে নেই করে দিতে পারবে তো?

 ধড়াস করে এক লাফ মারল কিশোরের হৃৎপিণ্ড। ওদের সহ উড়িয়ে দেয়ার কথা ভাবছে না তো খেপা লোকটা। গোরোর দিকে তাকিয়ে দেখল, তার চেহারাও ফ্যাকাসে হয়ে গেছে। স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে আছে বুড়ো। বোমাটার গায়ে চেপে বসা আঙুলগুলো সাদা হয়ে গেছে।

কি বলছেন আপনি, মিস্টার শিপরিজ? কাঁপা গলায় বলল সে। আপনি আমাকে বলেছেন কনস্ট্রাকশনের কাজে বোমাটা ব্যবহার করবেন। এখন বলছেন…আমি তো কিছুই বুঝতে পারছি না…

 পারবেন। খুব শীঘ্রি। বোমাটা ওই টেবিলে রাখুন। আর কিছু করতে হবে না আপনার। যা করার আমিই করব।

কিন্তু নির্দেশ মানল না আর গোরো। পিছিয়ে গেল এক পী। না না, মিস্টার শিপরিজ! আমি বুঝতে পারছি অন্য কোন মতলব আছে অপিনার, খারাপ মতলব। মিথ্যে কথা বলেছেন আপনি আমাকে। ছেলেগুলোর কথা মিথ্যে বলেছেন। ওরা আপনার মেহমান নয়, বন্দি। আসলে প্রতিটি কথাই মিথ্যে বলেছেন আমার সঙ্গে। আমার নতুন আবিষ্কার বাজারজাত করে আমাকে সাহায্য করার কোন ইচ্ছেই আপনার কোনদিন ছিল না। মিথ্যে আশা দিয়েছিলেন আমাকে।

লাফ দিয়ে এগিয়ে গিয়ে টান মেরে গোরোর হাত থেকে বোমাটা কেড়ে নিল উইক। প্রচণ্ড এক থাবা মেরে মেঝেতে ফেলে দিল বেচারা বুড়ো মানুষটাকে। পড়ে রইল গোরো। ওঠার সামর্থ্যও হলো না।

Super User