মৃত্যুঘড়ি – তিন গোয়েন্দা (৯৫)
প্রথম প্রকাশ: ১৯৯৬

০১.

ইয়ার্ডের গেট দিয়ে বেরোতে যাবে এই সময় কিশোরের সামনে এসে দাঁড়ালেন ভদ্রলোক। লম্বা, বেশ ভালো স্বাস্থ্য। রিমলেস চশমার ভেতর দিয়ে তাকালেন ওর দিকে।

বসে থাকতে ভাল লাগছিল না। তাই ঘুরতে বেরোচ্ছিল তিন গোয়েন্দা। সঙ্গে ওদের বন্ধু টমাস মার্টিন। পাহাড়ের দিকটীয় ঘুরতে যাওয়ার ইচ্ছে।

তুমি নিশ্চয় কিশোর পাশা? হাত বাড়িয়ে দিলেন ভদ্রলোক। আমি অ্যালেক্স ককার। ব্যাংকে কাজ করি। মিস্টার ভিকটর সাইমন তোমাদের কাছে পাঠিয়েছেন। কথা বলার সময় হবে?

হবে, আসুন।

অ্যালেক্স ককরিডেনাল কিশোর। বে? ছ ককারকে এনে ওঅর্কশপে বসাল কিশোর। in কোন রকম ভূমিকার মধ্যে গেলেন না তিনি। বললেন, একটা বিশেষ কাজে এসেছি। মিস্টার সাইমনের কাছে গিয়েছিলাম। তার সময় নেই। বললেন, তোমরা আমাকে সাহায্য করতে পারবে।

বলুন কি করতে পারি?

পোশাক দেখে তো মনে হচ্ছে ঘুরতে যাচ্ছি। কাউকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে ককার বললেন, এক কাজ করতে পারো, ম্যানিলা রোডের দিকে চলে যাও। বন্দর পেরিয়ে গিয়ে মোড় নিলেই ম্যানিলা রিভার। নদীর কিনার ধরে বনের মধ্যে ঢুকে যেয়ো।

কেন? কৌতূহলী হয়ে জানতে চাইল কিলোর।

রিভেরা হাউসটা পেয়ে যাবে। অনেক পুরানো বাড়ি। নাম শুনেছ?

শুনেছি, মাথা ঝাঁকাল রবিন। পাথরে তৈরি। টালির ছাত। মেইন রোড থেকে অনেকখানি ভেতরে। বহুদিন ধরে ওখানে কেউ বাস করে না।

কার কাছে শুনলে?

বাবার কাছে। আমার বাবা সাংবাদিক।

 ও। ঘুরতে গেলে ওদিকটায় একবার ঘুরে এসো।

কেন? আবার প্রশ্ন করল কিশোর।

একটা রহস্য দিতে পারব। আগে দেখে এসে। তারপর কথা। এখন যাই। পরে আসব আবার।

ওদেরকে একটা ধাঁধার মধ্যে রেখে বেরিয়ে গেলেন ককার। গেটের বাইরে গাড়ি রেখেছেন। তাতে চেপে চলে গেলেন।

গোয়েন্দারাও রওনা হলো আবার। বন্দর পার হয়ে এসে কিছুদূর এগোতে ম্যানিলা রিভারের ওপরের ব্রিজটা চোখে পড়ল। মোড় নিয়ে দ্রুত এগোল সেদিকে। নদীর ধার ধরে এগোতে এগোতে আইভি লতায় ছাওয়া পাথরের দেয়াল চোখে পড়ল। ঘন হয়ে জন্মানো ছোট ছোট গাছপালা প্রায় আড়াল করে রেখেছে দেয়ালটা। ফাঁক দিয়ে একআধটু চোখে পড়ে ছাতের টালি।

ওটাই রিভেরা হাউস, রবিন বলল।

যদ্দুর জানি, বাড়ির মালিক বুড়ো রিভেরা মারা যাওয়ার পর আর কেউ বাস করতে আসেনি, টম বলল। বুড়ো নাকি আজব লোক ছিল।

থমকে দাঁড়াল মুসা। আজব মানে? মরেটরে ভূত হয়নি তো আবার!

আরে দূর! হাত নেড়ে মুসার কথাকে উড়িয়ে দিল কিশোর। চলো, ঢুকে দেখি কি আছে? কেন আসতে বললেন ককার, জানতে হবে।

 মিনমিন করে আরেকবার আপত্তি জানাল মুসা। কিন্তু তিনজনের চাপে আপত্তি টিকল না তার।

মেইন গেটটা খোলা। অবাক লাগল ওদের। আরও অবাক হলো, যখন ড্রাইভওয়েতে গাড়ির চাকার দাগ দেখতে পেল।

সামনের বিশাল ধূসর অট্টালিকাটার দিকে তাকিয়ে সাবধানে ড্রাইভওয়ে ধরে এগোল চারজনে। দুই ধারে ঘন হয়ে জন্মেছে গাছ আর ঝোপঝাড়। নীরবতার মধ্যে হঠাৎ শোনা গেল ভারি গলায় ডাক, অ্যাই, দাঁড়াও!

পুলিশের পোশাক পরা এক লোক বেরিয়ে এল গাছের আড়াল থেকে। মাথার হেলমেট বলে দিল মোটর সাইকেল নিয়ে এসেছে, মোটর সাইকেল পেট্রলম্যান। চেনে ওকে ছেলেরা। রকি বীচ থানার অফিসার, মরিস ডুবয়।

কি ব্যাপার, ডুবয়, আপনি এখানে? জানতে চাইল রবিন।

চোর তাড়া করে এসেছি। বন্দরে ইদানীং বড় বেশি চোরের উৎপতি হচ্ছে। ম্যানিলা রোড ধরে যাচ্ছিলাম, হঠাৎ দেখি কালো রঙের বিরাট একটা লিমুজিন গাড়ি ছুটে আসছে। গতি না কমিয়ে এত জোরে মোড় ঘুরল, সন্দেহ হলো আমার। পিছু নিলাম।

ধরতে পারেননি?

না, পালাল।

ওদের সঙ্গে এগোল অফিসার ডুবয়। বাড়ির সদর দরজার সামনে মোটর সাইকেলটা রাখা। তাতে চেপে স্টার্ট দিল। বিকট গর্জন করে উঠল শক্তিশালী ইঞ্জিন। ফিরে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করল, তোমরা কি ভেবে এখানে?

ঘুরতে, জবাব দিল কিশোর।

কেস? হাসল অফিসার।

হতে পারে। এখনও জানি না। ফিরে গেলে বোঝা যাবে। বাড়িটী সম্পর্কে কিছু জানেন নাকি?

ক্লাচ চেপে গিয়ার দিল ডুবয়। তেমন কিছু না। অনেক দিন থেকে খালি পড়ে আছে, ব্যস, এটুকুই। গেটটা খোলা পেয়ে অবাকই লাগল। মনে হলো এ বাড়িতেই ঢুকে পড়ল কালো গাড়িটা। তবে কোথাও দেখতে পেলাম না। চোখের ভুল ছিল বোধহয়। চলি।

যান। গেট আমরা বন্ধ করে দিয়ে যাব।

ক্লাচ ছাড়তেই লাফ দিয়ে আগে বাড়ল মোটর বাইক। বেরিয়ে গেল ডুবয়। ধীরে ধীরে কমে গেল ইঞ্জিনের শব্দ। স্তব্ধ নীরবতা যেন গ্রাস করল ছেলেদের।

.

০২.

পরিত্যক্ত বাড়ির ড্রাইভওয়েতে দাঁড়িয়ে এদিক ওদিক তাকাতে তাকাতে টম বলল, বাড়িটার কিন্তু কোন বদনাম শুনিনি কখনও! আড়চোখে মুসার দিকে তাকাল সে। কক্ষনো কেউ বলেনি এখানে ভূতের উপদ্রব আছে!

মুসাকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে তাড়াতাড়ি কিশোর বলল, এসো, ঘুরে দেখি। ককারের কথায় মনে হলো অদ্ভুত কিছু ঘটছে এখানে। রবিন, তুমি আর টম দরজা-জানালাগুলো দেখো; বন্ধ, নাকি খোলা। আমি আর মুসা চারপাশটা দেখব।

 আলাদা হয়ে গেল ওরা। বিশাল বাড়িটার পেছনে চলে এল কিশোর আর মুসা।

নিচের দিকে চোখ পড়তে আচমকা থেমে গেল কিশোর। মুসা, দেখো!

কি? ঘন হয়ে জন্মানো ঘাসের দিকে তাকিয়ে কিছু দেখতে পেল না মুসা।

লম্বা ঘাসের ডগা সরিয়ে মাটি দেখাল কিশোর। এইবার দেখেছ? পায়ের ছাপ। কাল রাতে এসেছিল এখানে কেউ। হেঁটেছিল। দেখছ না, ঘাসের ডগা ভাঙা? শিশির পড়ে মাটি ভিজে নরম হয়ে গিয়েছিল তখন।

খাইছে, কিশোর, তোমার ওগুলো চোখ না, এক্স-রে মেশিন!

মুসার কথার জবাব না দিয়ে পায়ের ছাপ অনুসরণ করে এগোতে শুরু করল কিশোর। চত্বর পেরিয়ে চলে এল ঘন গাছের জটলার দিকে। নদীর দিকে চলে গেছে পায়ে চলা পথ। পায়ের ছাপ সেদিকেই গেছে।

মাছ ধরতে এসেছিল বোধহয় কেউ, অনুমান করল মুসা।

কি জানি! কথাটা ঠিক মেনে নিতে পারল না কিশোর।

ঘুরতে ঘুরতে এসে একখানে মিলিত হলো আবার চারজনে।

কিছু পেলে? রবিনকে জিজ্ঞেস করল কিশোর।

সমস্ত দরজা-জানালা বন্ধ। সামনের দরজার তালায় আঁচড়ের দাগ। দেখলাম। অন্ধকারে কেউ খোলার চেষ্টা করেছিল মনে হয়।

পায়ের ছাপের কথা জানাল কিশোর। মাথা নেড়ে বলল, তেমন কিছু পেলাম না। এতে বোধহয় সন্তুষ্ট করা যাবে না মিস্টার ককারকে।

আর কি দেখাতে চেয়েছিলেন তিনি? টমের প্রশ্ন।

বুড়ো রিভিয়েরার ভূত, হেসে বলল টম।

দূর, ওসব অলক্ষুণে কথা বোলো না তো! হাত নেড়ে বলল মুসা। আমি আর দাঁড়াতে পারছি না। খিদেয় পা কাঁপছে।

হেসে ফেলল সবাই।

পাথরের বাড়িটার দিকে তাকিয়ে আনমনে বিড়বিড় করল রবিন, এতবড় বাড়ি, এত পুরানো, খালি পড়ে আছে ভাবতে পারছি না। এই মুহূর্তে ভেতর থেকে কেউ গোপনে আমাদের দিকে তাকিয়ে আছে জানলেও অবাক হব না।

হ্যাঁ, একমত হলো কিশোর। পায়ের ছাপ আর তালায় আঁচড়ের দাগকে উড়িয়ে দিতে পারছি না। নিশ্চয় কোন মানে আছে এ সবের। ককারকে বলব। দেখি, কি বলেন।

মাথার ওপরের শূন্য, কালো জানালাটার দিকে তাকিয়ে অস্বস্তি দেখা দিল মুসার চোখে। দেখো, এ সব শুনতে একটুও ভাল লাগছে না আমার। আমি গেলাম!

গেটের দিকে হাঁটা দিল সে। হেসে তার পিছু নিল টম আর রবিন। কিশোরও চলল, তবে সে চিন্তিত। হাসিতে যোগ দিতে পারছে না। নিশ্চিত হয়ে গেছে, কোন রহস্য আছে বাড়িটীর। যত তাড়াতাড়ি সম্ভব এখন ককারের সঙ্গে কথা বলতে চায়। বাড়ি ফিরেই যোগাযোগ করতে হবে।

বাইরে এসে গেটটা লাগিয়ে দিল সে। চাবি নেই, তালা দিতে পারল না।

 ম্যানিলা রোডে ফিরে এল ওরা। ঝলমলে উজ্জ্বল রোদ।

ওরকম একটা পোড়ো বাড়ির প্রতি আগ্রহী হলেন কেন ককারের মত একজন ব্যাংকার? রবিনের মাথা থেকেও ভাবনাটা যাচ্ছে না।

বাবারে, ওসব কথা বাদ দাও না এখন! বাধা দিল মুসা। খাওয়ার জন্যে বসার জায়গা দেখো।

খোঁচা দিল টম, খাওয়ার পর ঘুমের জায়গা লাগবে না?

দেখো, ইয়ার্কি মেরো না। খাওয়া ছাড়া কেউ বাঁচতে পেরেছে? ঘুম ছাড়া কারও শরীরের ক্ষয় পূরণ হয়েছে?

তা হয়নি। তবে তোমার পূরণটা আজকাল একটু বেশিই হচ্ছে। বয়েসের তুলনায় দৈত্য।

জবাব দিল না মুসা। চারপাশে তাকিয়ে জায়গা খুঁজতে শুরু করেছে তার চোখ। রিভেরা এস্টেট পেছনে ফেলে এসেছে। ডানে উঠে গেছে ঘন বনে ছাওয়া পাহাড়ের ঢাল। বায়ে গমের খেত, শস্য কাটার পর খড়গুলো এখন রোদে শুকিয়ে বাদামী হয়ে গেছে। খেতের প্রান্তে বিশাল এক ওক গাছ ডালপালা ছড়িয়ে ছায়া ফেলেছে, লোভ দেখাচ্ছে যেন ওদের।

জায়গা পাওয়া গেছে, হতি তুলে দেখলি মুসা। প্রথমে খাওয়া, তারপর ঘুম।

মাথা নাড়ল টম, ওখানে হবে না।

কেন? ভুরু কোঁচকাল মুসা।

 পানি নেই।

তাই তো! সুতরাং পানির জন্যে আরও আধঘণ্টা হাঁটতে হলো ওদের। পাহাড় থেকে নেমে আসা ঝর্নাটা চোখে পড়ল মুসার। সবুজ তৃণভূমির মাঝখান দিয়ে বয়ে যাচ্ছে টলটলে পানির নহর।

আহ, দারুণ!

দারুণ তো বুঝলাম, রবিন বলল, বসবে কোথায়? ছায়ার তো চিহ্নও নেই এখানে।

 দুর! খালি বাগড়া দেয়! গুঙিয়ে উঠল মুসা। কিন্তু ছায়া না থাকলে যে বসা যাবে না, মনে মনে এ কথাটা সে-ও স্বীকার করল।

আবার হাঁটতে হলো। দুই ধারে চেপে আসতে শুরু করল বন। ছোট একটা খাড়ির ধার দিয়ে গেছে পথ। ওপর থেকে গর্তে ঝরে পড়ছে ঝর্না।

খুশি হলো মুসা। বসার এত চমৎকার জায়গা আর পাওয়া যাবে না। গাছের ছায়া আছে, রোদ আছে, পানিও আছে। আর কি চাই!

বসে পড়ল ওরা। ব্যাগ খুলে ডিম আর মুরগীর মাংসের পুর দেয়া স্যাণ্ডউইচ বের করল মুসা। আর আছে আপেলের জেলি, চকোলেট কেক এবং ফ্লাস্ক ভর্তি বরফ মেশানো দুধ।

খাওয়ার জন্যে মুসাই তাগাদা দিয়েছে বেশি। কিন্তু খেতে বসে আবিষ্কার করল অন্য তিনজন, ওদেরও খিদে পেয়েছে ভীষণ। দেখতে দেখতে সাবাড় করে ফেলল সমস্ত খাবার। ঝর্না থেকে পানি খেয়ে এসে গাছের ছায়ায় যার যে ভাবে ইচ্ছে শুয়ে পড়ল।

চিত হয়ে শুয়ে আকাশ দেখছে কিশোর। গাছের ডালে শিস দিচ্ছে একটা। নাম না জানা পাখি। আরেকটা ছোট আকারের সবুজ পাখি ডাল থেকে মাঝে মাঝেই শূন্যে ঝাঁপ দিয়ে পোকা শিকার করছে। ফড়িং উড়ছে নানা রঙের।

আহ্, এই তো জীবন! আবেশে চোখ মুদে এল তার।

.

০৩.

ঘুমিয়ে পড়েছিল বলে বাড়ি ফিরতে দেরি হয়ে গেল ওদের।

রকি বীচে ফিরে মুসা আর টম চলে গেল বেসবল প্র্যাকটিস করতে। রবিন আর কিশোর ইয়ার্ডে ফিরে এল।

মেরিচাচী জানালেন, মিস্টার ককার এসে বসে আছেন অনেকক্ষণ।

রবিন আর কিশোর বসার ঘরে ঢুকে দেখল অস্থির হয়ে পায়চারি করছেন তিনি। সাড়া পেয়ে ফিরে তাকালেন। এবারও কোন ভূমিকা না করে জিজ্ঞেস করলেন, কি দেখে এলে?

কিশোর বলল, গিয়ে দেখি গেট খোলা। চোর তাড়া করে ভেতরে ঢুকেছে একজন পুলিশ অফিসার। সে বেরিয়ে যাওয়ার পর পায়ের ছাপ দেখতে পেয়েছি…

পায়ের ছাপ! বাধা দিলেন ককার, কখন এসেছিল লোকটা?

রাতে কোন সময়, শিশির পড়ার পর।

কিন্তু গেট! কাল রাতে বেরোনোর সময় নিজের হাতে তালা লাগিয়েছি। আমি!

যেন বিদ্যুতের শক খেয়ে ঝট করে সোজা হয়ে বসল দুই গোয়েন্দা।

আপনি লাগিয়েছেন? প্রশ্ন করল অবাক রবিন।

 হ্যাঁ। কারণ বাড়িটার মালিক এখন আমি।

আপনি! আরও অবাক হলো রবিন।

হা। কাল অন্ধকার হওয়ার আগ পর্যন্ত ওখানে ছিলাম আমি। তোমাদের কথা শুনে বোঝা যাচ্ছে, আরও কেউ ছিল ওখানে। কিংবা আমি আসার পর ঢুকেছিল। আমার ওপর হামলা চালানোর জন্যেও হতে পারে।

মিস্টার কুকার, হাত তুলল কিশোর, আশা করি আমাদের ওপর। আপনার বিশ্বাস জন্মেছে?

ভুরু কোচকালেন ককার। অবিশ্বাস করেছি কি করে বুঝলে?

এটুকু না বুঝলে আর এতদিন গোয়েন্দাগিরি করতে পারতাম না, এত কেসের সমাধান করতে পারতাম না। আপনি আসলে ভিকটর সাইমনের কথা বিশ্বাস করে আমাদের ওপর আস্থা রাখতে পারেননি। সেজন্যে সকালে সব কথা না বলে শুধু বাড়িটা দেখে আসার কথা বলেছেন। বুঝতে চেয়েছেন, আমাদের দিয়ে আপনার কাজ হবে কিনা। পরীক্ষা তো করলেন, কি মনে হলো, হবে?

মাথা ঝাঁকালেন ককার, হবে।

তাহলে আর অন্ধকারে না রেখে সব খুলে বলুন।

সোফায় নড়েচড়ে আরাম করে বসলেন ককার। বললেন, খামখেয়ালী লোক ছিলেন ফ্রান্সিস রিভেরা, হয়তো জানেনা। রকি বীচ লাইব্রেরিকে দান করে গেছেন তার এস্টেট। লাইব্রেরির কাছ থেকে কিছুদিন আগে বাড়িটা কিনেছি আমি। কিছু মেরামত-টেরামত করিয়ে নিয়ে পরে বেশি দামে বিক্রি করে লাভ করার আশায়। কেনার পর বাড়িটা ভাল করে দেখতে গিয়ে একটা অদ্ভুত জিনিস লক্ষ করলাম।

সামনে গলা বাড়িয়ে দিল রবিন, কি?

তিনতলায় একটা গুপ্তঘর। বিল্ডিঙটার ঠিক মাঝামাঝি জায়গায় তৈরি। হয়েছে ওটা। রীতিমত একটা ব্যাংকের ভল্ট যেন। অগ্নিনিরোধক, কোন, জানালা নেই। গোপন ভেন্টিলেটরের সাহায্যে বাতাস চলাচলের ব্যবস্থা। একমাত্র দরজার পাল্লাটা তৈরি হয়েছে খুব ভারি করে ইস্পাত দিয়ে। বন্ধ করার জন্যে টাইম লক লাগানো আছে।

ওরকম একটা ঘর কি কাজে লাগত রিভেরার?

খামখেয়ালী, বললামই তো, মাথায় ছিট, মৃদু হাসলেন ব্যাংকার। ব্যাংককে বিশ্বাস করে না, এ রকম বহু লোক আছে, তিনিও তাদের একজন। দামী জিনিসপত্র ওই গুপ্তঘরে রাখতেন। নিজেকে লুকিয়ে রাখার জায়গা হিসেবেও ব্যবহার করতেন ঘরটাকে। দামী জিনিস লুকানো আছে কিনা। দেখার জন্যে অনেক খোঁজাখুজি করেছি আমি ওখানে, পাইনি। রিভেরার এক বিশ্বস্ত চাকর সমস্ত জিনিস তুলে দিয়েছে লাইব্রেরি কর্তৃপক্ষের হাতে।

তা দিক, আমার মাথাব্যথা নেই। আমি কেবল বাড়িটা কিনেছি। তা-ও বসবাসের জন্যে নয়, ব্যবসা করার জন্যে। তবে গুপ্তঘরটা খুব পছন্দ হয়েছে। আমার। রিভেরার মতই ওখানে গিয়ে মাঝে মাঝে নিজেকে লুকিয়ে ফেলি। নিশ্চিন্তে, নির্বিঘ্নে কাজ করার এত চমৎকার জায়গা আর হয় না। নিজের ব্যক্তিগত অফিস বানিয়েছি ঘরটাকে।

জটিল হিসেব-নিকেশের কাজ করতে হলে এখন ওখানে গিয়ে ঢুকি আমি। ছোট একটা টেবিল, একটা কম্পিউটার আর কিছু ফাইলপত্র রেখে দিয়েছি। ঘর থেকে বেরোনোর সময় টাইম লক সেট করে দিই। তারপর আর কেউই, এমনকি আমিও নির্দিষ্ট সময়ের আগে আর ঢুকতে পারি না। ঠিক যতটায় সময় সেট করা থাকে কাঁটায় কাঁটায় ততটীয় খোলে তালাটা, তার আগে কিছুতেই নয়।

জানি, এতক্ষণে কথা বলল কিশোর, টাইম লকের এটাই বিশেষত্ব। নির্দিষ্ট সময়ে তালা খুলে যাওয়ার আগে কেউ ঢুকতে পারে না।

তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে ওর দিকে তাকালেন ব্যাংকার। কিন্তু আমি যদি বলি আমার অনুপস্থিতিতে কেউ ওঘরে ঢুকেছিল, একবার নয়, একাধিকবার, তাহলে?

তালাটা নষ্ট না তো? রবিনের প্রশ্ন।

মোটেও না। একদম ঠিক। ভালমত পরীক্ষা করে দেখেছি আমি।

তারমানে আপনি চাইছেন, কিশোর বলল, ঘরটার তদন্ত করি আমরা? কি করে কে ঢুকল, বের করি?

মাথা ঝাঁকালেন ককার। হ্যাঁ। যখন-তখন ওবাড়ির যে কোন ঘরে ঢোকার জন্যে তোমাদের ডুপ্লিকেট চাবি বানিয়ে দেব… বলবেন কি বলবেন না, দ্বিধা করতে করতে বলেই ফেললেন, আরেকটা ব্যাপার, কতখানি গুরুত্ব দেব বুঝতে পারছি না…আমার প্রাণ নাশের হুমকিও দিতে আরম্ভ করেছে!

কোথায়? কখন? প্রায় চেঁচিয়ে উঠল রবিন।

গম্ভীর মুখে মানিব্যাগ থেকে ভাজ করে রাখা দুই টুকরো কাগজ বের করলেন ককার। একটা দিলেন রবিনকে, আরেকটা কিশোরকে।

রবিন আগে খুলল। পেন্সিলে লেখা রয়েছে:

চিরকালের জন্যে এই বাড়ি ছাড়ো,
নইলে কপালে মরণ আছে।

অন্য কাগজটা পড়ল কিশোর:

ঘড়ি যখন টিক টিক করবে,
তখন আসবে মরণ!

মুখ তুলে তাকাল সে, কি বলতে চায়?

সেটা জানার জন্যেই ভাল গোয়েন্দা দরকার আমার, ককার বললেন। কাগজগুলো কোথায় পেয়েছি আন্দাজ করতে পারো?

গুপ্তঘরে, সঙ্গে সঙ্গে জবাব দিল কিশোর।

অবাক হয়ে গেলেন ককার, কি করে বুঝলে?

স্রেফ অনুমান। ওখানে পেয়েছেন বলেই এতটা উদ্বিগ্ন হয়েছেন। তা ছাড়া বললেনই তো, আপনার অবর্তমানে লোক ঢুকেছে ওঘরে।

কখন পেয়েছেন এগুলো? জানতে চাইল রবিন।

তোমার হাতেরটা চারদিন আগে। আর অন্যটা কাল রাত আটটায়। সেজন্যেই এসেছিলাম আজ সকালে, ফ্যাকাসে হয়ে গেছে ব্যাংকারের চেহারা। বললে কাল রাতে বাড়িতে ঢুকেছিল কেউ, তারমানে আমাকে খুন করতে এসেছিল!

ভ্রূকুটি করল কিশোর। হু, যে লিখেছে সে সব জানে–আপনি কখন থাকেন না থাকেন। প্রতিশোধ নিতে চায় এমন কোন শত্রু আছে আপনার?

যদ্দুর জানি, নেই। শত্রু তৈরি হয় এমন কোন কাজ করি না আমি।

আগের প্রসঙ্গে এল রবিন, মিস্টার ককরি, ঘরে ঢোকার অন্য কোন পথ নেই তো? দেয়ালগুলো ভালমত দেখেছেন?

দেখেছি। কিছুই নেই। আমার জিনিসপত্র আর একটা ফায়ারপ্লেস বাদে ঘরে অন্য কোন জিনিসও নেই। চিমনির মুখে শিক লাগানো। তা ছাড়া চিমনির নলটী এত সরু, মানুষ ঢুকতে পারবে না।

কাগজ তো ফেলতে পারে?

মাথা নাড়লেন ককরি। তা পারে। তাহলে পাওয়া যেত চিমনির তলায়। কিন্তু পেয়েছি ঘরের মাঝখানে, কার্পেটের ওপর।

আপনি ছাড়া ঘরটার কথা আর কে জানে? জিজ্ঞেস করল কিশোর। তালাটা খুলতে জানে আর কেউ?

ঘরটার কথাই কাউকে বলিনি। সুতরাং তালার কথা জানার প্রশ্নই ওঠে না। রিভেরার চাকরও নেই যে সে বলে দেবে।

হু। আমরা আপনাকে সাহায্য করব। একটা কাজ করলে কি অসুবিধে হবে–আমরা আপনাকে ঢুকতে না বলা পর্যন্ত ওবাড়ি থেকে দূরে থাকতে পারবেন?

পারব। ঠিক আছে, আজ উঠি। চাবি তৈরি হয়ে গেলে তোমাদের জানাব।

ককার বেরিয়ে যাওয়ার পর ব্যাপারটা নিয়ে আলোচনা করতে লাগল দুই গোয়েন্দা।

রবিন বলল, আজব কাণ্ড! টাইম লক লাগানো থাকলে দরজা খোলা অসম্ভব। ঢুকল কোন পথে? নিশ্চয় অন্য কোন পথ আছে।

আজ রাতেই দেখতে যাব রিভেরা হাউসে। তুমি বাড়িতে ফোন করে দাও। বলো ফিরতে দেরি হবে।

.

০৪.

অন্ধকার নামলে বেরিয়ে পড়ল দুজনে। রবিনের ফোক্স ওয়াগেন গাড়িটা নিল। মুসাদের বাড়িতে পার্টি হচ্ছে। সে যেতে পারল না। পার্টিতে ওদের যেতে বলেছিল সে, কেন যাওয়া হবে না খুলে বলেছে কিশোর। আর কিছু বলেনি মুসা। চাপাচাপি করেনি। জানে, কিশোরের কাছে কেসের তদন্ত, সবার আগে, সেটা বাদ দিয়ে দাওয়তি খেতে যাবে না।

রিভেরা হাউস থেকে বেশ কিছুটা দূরে গাড়ি রাখল রবিন। বাকি পথ হেঁটে যাবে ওরা। ভেতরে কেউ থেকে থাকলে ইঞ্জিনের শব্দে যাতে সতর্ক হতে না পারে।

হেঁটে এগোল ওরা।

বিশাল গেটটা খোলা। আকাশে মেঘ করেছে। ঢাকা পড়েছে চাঁদ। বাতাস গরম, আঠা আঠা।

থমকে দাঁড়াল কিশোর। সকাল বেলা আমি লাগিয়ে গিয়েছিলাম। তারপর কেউ ঢুকেছে। হয়তো আছে এখনও।

ড্রাইভওয়ের দিকে নজর রাখতে পারে। অন্য কোনখান দিয়ে ঢেকি উচিত।

দেয়ালের ধার ধরে ঘুরে একটা ঘন জংলা জায়গায় চলে এল ওরা।

শক্ত একটা লতা ধরে টান দিয়ে কতটা শক্ত দেখতে দেখতে রবিন বলল, টপকানো কঠিন হবে না। বেয়ে উঠে যাওয়া যাবে।

নিরাশ করল তাকে কিশোর। দেয়ালের ওপর ভাঙা কাচ বসানো। সকালে দেখেছি। সহজে ঢোকার ব্যবস্থা রাখেননি ফ্রান্সিস রিভেরা।

তাহলে?

খুজতে হবে।

দেয়ালের ধার ঘেঁষে বড় গাছ তেমন নেই। খুঁজে খুঁজে অবশেষে পাওয়া গেল একটা। তার একটা ডাল দেয়ালের ওপর দিয়ে চলে গেছে অন্যপাশে, বাড়ির ভেতরে।

গাছে উঠে ডাল বেয়ে কাচ এড়িয়ে অন্যপাশে চলে আসতে পারল দুজনে। ডাল ধরে ঝুলে পড়ল। মাটি বেশি নিচে না। হাত ছেড়ে দিতে নিরাপদেই নামল মাটিতে।

বিদ্যুৎ চমকাল। গুড়গুড় শব্দ হলো আকাশে। গুঁড়ি মেরে বাড়ির সামনের খোলা জায়গায় চলে এল ওরা।

আবার বিদ্যুৎ চমকাল। বিকট শব্দে বাজ পড়ল। গাছের পাতায় প্রচণ্ড আলোড়ন তুলে বয়ে গেল এক ঝলক ঝোড়ো হাওয়া। ঝড় আসতে দেরি নেই।

খপ করে রবিনের হাত চেপে ধরল কিশোর। শুনছ! দৌড়ানোর শব্দ!

কান খাড়া করে রইল দুজনে। বাতাস, বজ্রপাত, গাছের পাতায় বৃষ্টির শব্দের মাঝেও পায়ের শব্দ কানে আসতে লাগল ওদের। ডালে পা পড়ে মট করে ভাঙল, জুতোতে ঠোকা লেগে গড়িয়ে সরে গেল একটা পাথর, শুনতে পেল ওরা।

বিদ্যুতের আলোয় লম্বা একজন মানুষকে বারান্দার দিকে ছুটে যেতে দেখা গেল। বারান্দায় উঠে সামান্য নুয়ে দরজার তালায় চাবি ঢোকাল। খোলার জন্যে।

ককরি! ফিসফিস করে বলল রবিন।

তুমি শিওর! তাকে তো আসতে মানা করেছিলাম।

দরজা খুলে ভেতরে ঢুকে গেল লোকটা।

বৃষ্টির বেগ বেড়েছে। গাছের নিচে দাঁড়িয়ে জানালার দিকে তাকিয়ে। আছে দুই গোয়েন্দা, আলো জ্বলার অপেক্ষায়।

কিন্তু জ্বলল না।

ককার হলে আলো জলছেন না কেন? অধৈর্য স্বরে বিড়বিড় করল রবিন। কারও দেখে ফেলার ভয়ে? বাড়িটা যদি তারই হয়, ভয় কিসের?

হয়তো ককার নয়।

তাঁর মতই তে লাগল। একই রকম শরীর-স্বাস্থ্য। গাড়ির শব্দ কিন্তু শুনলাম না। তারমানে আমরা আসার আগেই ঢুকেছেন।

গুপ্তঘরে চলে গেছেন হয়তো!

কিংবা তার কিছু হয়েছে। হুমকি দিয়ে নোট লিখেছে যে লোক, সে হয়তো ঘাপটি মেরে ছিল ভেতরে, তারই অপেক্ষায়।

চলো, দেখি।

দরজার দিকে দৌড় দিল দুজনে।

হঠাৎ দাঁড়িয়ে গেল কিশোর। দাঁড়াও! লোকটা ককার না-ও হতে পারে। অন্য কেউ হতে পারে। ঢোকার সময় লোকটাকে মোটেও অস্থির মনে হয়নি। অথচ ককরি যখন আমাদের সঙ্গে কথা বলেছেন, খুব নার্ভাস মনে হয়েছে তাকে। দাঁড়াও, দেখি আর কিছুক্ষণ।

ঝোপের ধারে লুকিয়ে অপেক্ষা করতে লাগল দুজনে। মুষলধারে বৃষ্টি পড়ছে। বিদ্যুতের আলোয় লাগছে রূপালী চাদরের মত।

রবিন বলল, আবার পায়ের শব্দ শুনলাম মনে হলো!

কান পেতে থাকতে থাকতে হঠাৎ একটা বড় ঘরের জানালায় আলো জ্বলতে দেখল ওরা।

এসো, দেখব, উঠে দাঁড়াল কিশোর।

মাথা নিচু করে একছুটে সামনের খোলা জায়গাটুকু পেরোল ওরা। মাথায় আর পিঠে আঘাত হানছে বড় বড় ফোঁটা। ভিজে চুপচুপে হয়ে গেছে।

জানালার কাছে পৌঁছে গেল দুজনে। এখানে গীয়ে বৃষ্টি লাগে না। ঘর থেকে কেউ দেখতেও পাবে না ওদের। আরেকটা ছোট জানালার কাছে সরে এল।

জানালাটা অনেক ওপরে। দুই হাতের আঙুলের ফাঁকে আঙুল ঢুকিয়ে পেটের ওপর রেখে মইয়ের ধাপ তৈরি করল কিশোর। তাতে পা রেখে উঠে দাঁড়াল রবিন। জানালা দিয়ে ভেতরে উঁকি দিল।

কি দেখছ? ফিসফিস করে জিজ্ঞেস করল কিশোর।

একটা লিভিং রুম। কাপড়ে মোড়া আসবাব, প্যানেল করা দেয়াল, ঝাড়বাতি। মানুষ নেই।

তাহলে আলো জ্বালল কে?

সুইচ হয়তো অন করাই ছিল। কারেন্ট চলে গিয়েছিল। আবীর এসেছে। আপনাআপনি জ্বলেছে আলোটা।

আর কি আছে?

ভারি দরজা। এককোণে অনেক বড় একটা ঘড়ি, গ্র্যাণ্ডফাদার কুক। সামনের দিকে পুরোটা কাঁচে ঢাকা। পিতলের বিরাট পেণ্ডুলাম। এখান থেকেও টিক টিক শুনতে পাচ্ছি।

টিক টিক? রবিনের ভারে আস্তে আস্তে সামনের দিকে ঝুঁকে যাচ্ছে। কিশোর। খালি বাড়িতে ঘড়ি চলছে!

রবিনেরও মনে পড়ে গেল নোটটার কথা:

ঘড়ি যখন টিক টিক করবে,
তখন আসবে মরণ!

তুমি নামো, আমি দেখি, কিশোর বলল।

 লাফ দিয়ে নামল রবিন।

একই ভাবে তার হাতে ভর দিয়ে উঠে গেল কিশোর।

কে চালাল ঘড়িটা? দেখতে দেখতে বলল সে। নিজের হাতঘড়ির সঙ্গে সময় মিলিয়ে নিল। একেবারে সঠিক সময়।

দপ করে ঘরের আলো নিভে গেল। আবার ঢেকে গেল অন্ধকারে। ঠিক একই সময়ে ঝিলিক দিয়ে উঠল তীব্র আলো। বজ্রপাতের বিকট শব্দ হলো।

পরক্ষণে শোনা গেল রক্ত-হিম-করা তীক্ষ্ণ চিৎকার।

.

০৫.

চিৎকার থামতেই কাঠের বারান্দায় শোনা গেল পদশব্দ। পলকের জন্যে দেখা গেল একটা ছায়ামূর্তিকে। লাফ দিয়ে বাগানে নেমে লাফাতে লাফাতে চলে গেল ড্রাইভওয়ের দিকে।

ধরো! ধরো! বলে চিৎকার দিয়েই পিছু নিল কিশোর।

সে ড্রাইভওয়েতে ওঠার আগেই গাছের আড়ালে হারিয়ে গেল মূর্তিটা। তার জুতোর শব্দ কানে আসছে।

কিশোরকে ছাড়িয়ে এগিয়ে গেছে রবিন। লোকটাকে দেখতে পেল আবার। গতি বাড়াল সে।

ক্লান্ত হয়ে পড়েছে সামনের লোকটা। ছুটতে পারছে না আর তেমন। ধরে ফেলল রবিন।

আবার বিদ্যুৎ চমকাল।

ভীত-সন্ত্রস্ত, পরিচিত মুখটা দেখে বিস্ময়ের সীমা রইল না ওদের।

এ কি! ডুডলি হ্যারিস! মস্ত ধনী। দামী ছবি আর শিল্পকর্ম সংগ্রহের বাতিক আছে। পগিলাটে স্বভাবের জন্যে রকি বীচে অনেকেই চেনে তাকে। তিন গোয়েন্দার সঙ্গে ভাল খাতির। এই লোক এখানে কি করছে?

রবিন আর কিশোরকে চিনতে পারলেন তিনিও। স্বস্তিতে ঢিল করে দিলেন শরীর। তোমরা!

আপনি এখানে কি করছেন, মিস্টার হ্যারিস? জিজ্ঞেস করল রবিন।

প্রশ্নের জবাব না দিয়ে হ্যারিস বললেন, কিশোর, আমাকে বাড়ি নিয়ে চলো, প্লীজ! থরথর করে কেঁপে উঠলেন তিনি। পরিশ্রম, উত্তেজনা এবং এই বৃষ্টিতে ভেজা সইতে পারছেন না আর বুড়ো শরীরে। উফ, কি সাংঘাতিক…কি জঘন্য চিৎকার…।

ধরে ধরে তাকে নিয়ে চলল কিশোর আর রবিন।

গাড়িটা কোথায়, দেখিয়ে দিলেন হ্যারিস। ম্যানিলা রিভার রোডের ধারে একটা বড় ঝোপের আড়ালে লুকিয়ে রেখেছেন। পুরানো মডেলের বিরাট গাড়ি। কাঁপা হাতে দরজা খোলার চেষ্টা করলেন।

বাধা দিল কিশোর, মিস্টার হ্যারিস, কি হয়েছে না বলেই চলে যাবেন? বললে হয়তো কিছু করতে পারতাম।

অসাধু কোন কিছুতে জড়িত নন হ্যারিস, এ ব্যাপারে নিশ্চিত সে।

কিন্তু প্রলাপের মত বকেই চললেন তিনি, কি সাংঘাতিক…বাপরে বাপ…আসা একেবারেই উচিত হয়নি আমার বাড়ি থেকে বেরিয়ে ভুল করেছি…আসলে পান্নাগুলো চুরি হয়ে গেল তো…

কিশোরের দিকে ঝুঁকে নিচু স্বরে বলল রবিন, নিশ্চয় তার পান্নার জিনিসগুলোর কিছু হয়েছে। কিন্তু এখানে দাঁড়িয়ে বলার মত অবস্থাই নেই তাঁর।

গাড়ি চালাতে পারবেন কিনা তাতেও সন্দেহ আছে।

চিৎকার কে করেছে সেটাও কিন্তু জানা হয়নি, মনে করিয়ে দিল রবিন। মিস্টার ককার এখনও বাড়ির ভেতরে।

আমি যাচ্ছি দেখতে। এক কাজ করো, তুমি গাড়ি চালিয়ে তাকে নিয়ে আমাদের বাড়িতে চলে যাও। দেখছ না কি রকম কাঁপছেন। সেবা দরকার। চাচী আছে, চিন্তা নেই। আমি বাড়ির ভেতরটা দেখে তোমার গাড়িটা নিয়ে চলে আসব।

প্রায় চ্যাংদোলা করে হ্যারিসকে গাড়িতে তুলে দিল দুজনে। ইঞ্জিন স্টার্ট দিল রবিন। ততক্ষণে প্রবল বৃষ্টির মধ্যেই বাড়ির সদর দরজার দিকে দৌড়াতে আরম্ভ করেছে কিশোর।

ঘরগুলো সব অন্ধকার। সামনের দিকের একটা জানালায় দাঁড়িয়ে ভেতরে উঁকি দিল। কিছু দেখা যায় না। সদর দরজার পিতলের ঘণ্টাটা। বাজাল। কেউ সাড়া দিল না।

দরজায় থাবা দিয়ে ককৗরের নাম ধরে ডাকল।

 জবাব নেই।

 নব ঘুরিয়ে খুলতে গিয়ে দেখল, ঘোরে না। তালা লাগানো।

দ্রুত হেঁটে ঘুরে বাড়ির পেছন দিকে চলে এল সে। পেছনের দরজা বন্ধ, সেলারের দরজা বন্ধ। কোনখান দিয়ে ঢোকার উপায় নেই। চিৎকার করে বার বার ককারের নাম ধরে ডেকেও সাড়া পেল না। বাড়িটা তেমনি অন্ধকার, নীরব হয়ে আছে।

 কাজ হবে না। ঢুকতে পারবে না যে, বুঝতে পারল কিশোর। কি আর করা। নিরাশ হয়ে গাড়ির দিকে ফিরে চলল সে।

রবিন ওদিকে গাড়ির স্পীড তুলতে ভয় পাচ্ছে। হ্যারিস ধনী হলে হবে কি, ভীষণ কিপটে, গাড়িটাই তার প্রমাণ। পুরানো গাড়ি। গতি বাড়াতে গেলেই প্রতিবাদ শুরু করে ইঞ্জিন। বাধ্য হয়ে গতি কম রাখতে হলো তাকে।

অবশেষে ইয়ার্ডে পৌঁছল সে। নিচতলার ঘরগুলোতে আলো জ্বলছে। তারমানে জেগে আছেন মেরিচাচা, এবং নিচেই আছেন।

গাড়ির শব্দে দরজা খুলে বারান্দায় বেরিয়ে এলেন চাচী। বিধ্বস্ত হ্যারিসকে নিয়ে রবিনকে নামতে দেখে আঁতকে উঠলেন, মাই গড! তাড়াতাড়ি সিঁড়ি বেয়ে নেমে এলেন সাহায্য করার জন্যে।

রাশেদ পাশা ওপরের বেডরুমে চলে গেছেন। তাঁকে ডাকার প্রয়োজন হলো না। রবিন আর মেরিচাচীই ধরে ধরে হ্যারিসকে রান্নাঘরে নিয়ে এল। চেয়ারে বসিয়ে দেয়া হলো।

বড় তোয়ালে আর রাশেদ পাশার শার্ট-পাজামা এনে দিলেন রবিনের হাতে চাচী। বললেন, তুমি গা মুছে দাও। আমি কফি বানাচ্ছি।

চুলায় কেটলির পানি ফুটতে আরম্ভ করলে রবিনের দিকে ফিরে তাকালেন তিনি, কিশোর কোথায়? দুজনে তো দেখলাম একসঙ্গে বেরোলে।

যেন তার কথার জবাব দিতেই ঝটকা দিয়ে খুলে গেল দরজা। ভেতরে এসে দাঁড়াল কিশোর। টপটপ করে পানি পড়ছে ভেজা শার্ট থেকে।

চলে এসেছ! কিশোরকে এত তাড়াতাড়ি আশা করেনি রবিন।

হ্যাঁ। ঢুকতে পারলাম না। অনেক ডাকাডাকি করলাম, জবাবও দিল না কেউ। অহেতুক থেকে আর কি করব।

ঝড়ের গতিতে গাড়ি চালিয়েছ নিশ্চয়। আমি অবশ্য জোরে চালাতে পারছিলাম না, আড়চোখে হ্যারিসের দিকে তাকাল রবিন। শুকনো পোশাক পরে চেয়ারে গা এলিয়ে দিয়েছেন তিনি।

দীর্ঘ একটা মুহূর্ত একবার রবিন, একবার কিশোরের মুখের দিকে তাকাতে লাগলেন মেরিচাচী। হঠাৎ করেই যেন মনে পড়ল, ওহহো, ভুলেই গিয়েছিলাম। মিস্টার ককৗর এসে বসে আছেন তোদের জন্যে।

হাঁ হয়ে গেল দুই গোয়েন্দা। ভুরু কুঁচকে গেল কিশোরের। হ্যারিসের দায়িত্ব চাচীর ওপর দিয়ে বসার ঘরে এসে ঢুকল ওরা।

.

০৬.

মিস্টার ককার, রবিন জিজ্ঞেস করল, আপনি ভাল আছেন!

আছি। কেন, না থাকার কোন কারণ ঘটেছে? প্রশ্ন করলেন ব্যাংকার।

আসলে জানতে চাইছিলাম, এত তাড়াতাড়ি এলেন কি করে এখানে, কিশোর বলল।

কি বলছ বুঝতে পারছি না! তাড়াহুড়া করতে যাব কেন? তাড়াহুড়া করা আমার স্বভাব নয়। যা করি ধীরেসুস্থেই করি। এমনকি জরুরী অবস্থায়ও তাড়াহুড়া করি না।

আপনাকে কিন্তু রিভেরা হাউস থেকে বেরোতে দেখিনি। পথেও আপনার গাড়ি আমাদের গাড়িকে ওভারটেক করতে দেখিনি। এলেন কি করে?

রিভেরা হাউস! ভুরু কোঁচকালেন ককার। ওখানে যাব কেন? গত দেড়টি ঘণ্টা ধরে তোমাদের অপেক্ষায় বসে থেকে থেকে বিরক্ত হয়ে গেছি। মিসেস পাশা বলতে পারলেন না তোমরা কোথায় গেছ। ওদের ভেজা কাপড়ের দিকে তাকিয়ে দৃষ্টি তীক্ষ্ণ হয়ে উঠল তার, এত ভিজলে কি করে?

আপনার কেসের তদন্ত করতে গিয়ে, ককারের রুক্ষ ব্যবহার রাগিয়ে দিল রবিনকে। সেটা প্রকাশ করল না। রিভেরা হাউসে ঢুকেছিলাম। অন্ধকারে অবিকল আপনার মত দেখতে একজনকে ঢুকতে দেখলাম। একটু পর একটা আলো জ্বলে উঠে কিছুক্ষণ থেকে নিভে গেল। পরক্ষণেই কে যেন চিৎকার করে উঠল। আমরা ভাবলাম আপনাকে খুন করে ফেলা হচ্ছে। একজন লোক ছুটে বেরোল। তাকে তাড়া করলাম। ধরে নিয়ে এসেছি এখানে।

হাঁ হয়ে গেছেন ব্যাংকার। দীর্ঘক্ষণ বসে থাকার রাগ বেমালুম উবে গেল। নরম হয়ে বললেন, আমি যাইনি তো। তোমরা না বললে ওবাড়ি থেকে দূরে থাকতে। তাই তো রয়েছি।

আপনি তাহলে এলেন কোত্থেকে?

সোজা ব্যাংক থেকে। বেশি কাজ থাকলে অফিস আওয়ারের পরেও কাজ করি আমি।

এইবার গোয়েন্দাদের অবাক হওয়ার পালা। পরস্পরের দিকে তাকাল ওরা।

এই সময় হ্যারিসকে নিয়ে ঘরে ঢুকলেন মেরিচাচী। অনেকখানি সুস্থ হয়ে উঠেছেন ভদ্রলোক।

ককারকে দেখেই চটে উঠলেন হ্যারিস। তুমি! বলেই লাফ দিয়ে এগিয়ে গেলেন বিস্মিত ব্যাংকারের গলা টিপে ধরতে। চোর কোথাকার! আমার পান্নাগুলো কি করেছ! জলদি ফেরত দাও!

তাকে আটকে ফেলল কিশোর আর রবিন।

আবার রেগে গেলেন ককার। ভারি গলায় বললেন, আপনি যে-ই হোন, শান্ত হোন। কথাবার্তা সাবধানে বলবেন। মানহানীর কেস করে দিলে বিপদে পড়বেন কিন্তু।

এত সুন্দর জিনিসগুলো চুরি হয়ে গেল আমার! পান্না কেটে তৈরি করা এত সুন্দর সুন্দর পুতুল! রবিন আর কিশোরের দিকে তাকিয়ে ককিয়ে উঠলেন হ্যারিস। ফেরত দিতে বলো ওকে।

 আপনার পুতুল আমি নিতে যাব কেন? গর্জে উঠলেন ককার। আর একবার এ কথা উচ্চারণ করলে পুলিশকে ফোন করব আমি!

আহ্, কি পাগলামি শুরু করলেন আপনি, হ্যারিস! কঠিন হয়ে উঠল মেরিচাচীর দৃষ্টি। শান্ত হয়ে বসুন। কি হয়েছে, খুলে বলুন সব।

চেয়ারে বসলেন হ্যারিস। ককারকে দেখিয়ে বললেন, এর মত দেখতে একজন লোক এসে হাজির বাড়িতে। পান্নার তৈরি আমার দুর্লভ সংগ্রহগুলো দেখতে চাইল। বলল, তার কাছেও কিছু জিনিস আছে। আমারগুলো দেখলে নাকি বলতে পারবে ওগুলো আমি কিনতে আগ্রহী হব কিনা। বের করে আনলাম। আমি তখন বাড়িতে একা…

ম্যাগি কোথায়? জিজ্ঞেস করলেন চাচী। ম্যাগি হলো হ্যারিসের বোন। মেরিচাচীর বান্ধবী।

বেড়াতে গেছে, জানালেন হ্যারিস। লোকটা আমার জিনিসগুলো দেখার পর জানতে চাইল আর আছে কিনা। গিয়ে আলমারি খুলে সবচেয়ে দামী জিনিসটা বের করলাম, পান্নার তৈরি একটা দাবার বোর্ড, অনেক টাকা দাম। ওটা নিয়ে ফিরে এসে দেখি লোকটাও নেই, আমার পুতুলগুলোও গায়েব!

ছুটে বেরোলাম। দেখি, একটা বড় গাড়িতে উঠছে সে। আমার গাড়িটা ড্রাইভওয়েতেই ছিল। তাড়াতাড়ি নেমে গিয়ে তার পিছু নিলাম। কিন্তু তার গাড়ির সঙ্গে তাল রাখতে পারলাম না। ম্যানিলা রিভার রোডে গাড়িটা ঢুকতে দেখলাম। তারপর দেখলাম একটা বাড়ির বিরাট গেট দিয়ে ঢুকে যেতে। ঝোপের আড়ালে গাড়ি রেখে কয়েক মিনিট অপেক্ষা করে আমিও ঢুকলাম সেই বাড়িতে। গাড়িটী দেখলাম না, তবে একটু পর লোকটাকে দেখলাম ঘরে ঢুকতে। তার পেছন পেছন আমিও ঢুকে পড়লাম ভেতরে।

সাংঘাতিক ঝুঁকি নিয়েছিলেন, কিশোর বলল, বুঝতে পারেননি!

বুঝব না কেন? আসলে এতটা রেগে গিয়েছিলাম চোরের ওপর, হিতাহিত জ্ঞান ছিল না। তা ছাড়া জিনিসগুলো ফেরত নেয়ার জন্যে মরিয়া হয়ে উঠেছিলাম। যাই হোক, একটা হলঘরে ঢুকলাম। সামনের একটা ঘরে আলো জ্বলছিল। চুপিসারে এগোলাম সেদিকে। হঠাৎ আলো নিভে গেল। ঠিক আমার পেছনে হলো চিৎকারটা!

সে-কথা মনে পড়তেই কেঁপে উঠলেন হ্যারিস। এক মুহূর্ত চুপ করে থেকে বললেন, আর দাঁড়ানোর সাহস হলো না, ঝেড়ে দৌড় মারলাম। কোন দিকে যাচ্ছি তা-ও খেয়াল ছিল না। পেছনে পায়ের শব্দ শুনে মনে করলাম খুনীটা আমারই পিছু নিয়েছে। আরও জোরে দৌড়াতে লাগলাম। ধরা পড়ার পর দেখলাম, খুনীটা নয়, তোমরা।

ব্যাংকারের দিকে তাকাল কিশোর। মিস্টার ককার, মনে হচ্ছে, আপনার মত একই চেহারার আরও একজন আছে, যে মিস্টার হ্যারিসের পান্নাগুলো চুরি করে নিয়ে গেছে। লোকটার চেহারা ভালমত দেখেছেন?

না, স্পষ্ট দেখতে পারিনি। মাথায় বড় হ্যাট পরেছিল। এখন বুঝতে পারছি, ইচ্ছে করে মুখের ওপর হ্যাট টেনে দিয়ে ছায়া ফেলে রেখেছিল। আমার দিকে তাকায়নি ঠিক মত। চেহারা দেখতে দিচ্ছিল না।

এর অর্থ, মিস্টার ককারের শরীরের সঙ্গে তার মিল দেখে চালাকি করে নিজেকে ককার বলে চালিয়ে দিতে চাইছে। রিভেরা হাউসে লোকে ঢুকতে দেখলে মনে করবে মিস্টার ককারই ঢুকছেন। সন্দেহ করে কিছু জিজ্ঞেস করতে আসবে না।

শুনতে একটুও ভাল লাগছে না আমার! মাথা নাড়তে নাড়তে বললেন। ককার, বিপদে ফেলে দেবে দেখছি আমাকে! আজ হ্যারিস আমাকে দেখে চোর ভেবেছেন, আরেকদিন আরেকজনে ভুল করবে না, একটা ব্যবস্থা করা দরকার।

পুলিশকে জানাচ্ছি, টেলিফোন করতে উঠল কিশোর।

লাফ দিয়ে উঠে দাঁড়ালেন ককার। বাধা দিলেন, না না, আমার কেসের ব্যাপারটা গোপন রাখতে চাই!

আপনার রহস্যের কথা কিছু বলব না। কেবল মিস্টার হ্যারিসের বাড়িতে চুরির কথাটা জানাব।

কয়েক মিনিট পর রিসিভার রেখে ফিরে এসে জানাল কিশোর, পুলিশ চীফ ক্যাপ্টেন ইয়ান ফ্লেচারকেই পেয়েছে। তিনি বলেছেন রিভেরা হাউসে লোক পাঠাবেন তদন্ত করতে। প্রয়োজনে রাতে পাহারার ব্যবস্থাও করবেন।

কিশোরকে হ্যারিসের কাছ থেকে দূরে একপাশে সরিয়ে নিয়ে গিয়ে ককার বললেন, তদন্ত করে কি উন্নতি হয়েছে জানতে এসেছিলাম। কাল বিকেল পাঁচটায় রিভেরা হাউসে দেখা কোরো। গুপ্তঘরের দরজার টাইম লক তখন তোমাদের সামনে সেট করে দেব।

যাব।

কথা শেষ করে ব্যাংকার বেরিয়ে যেতেই হ্যারিস বললেন বাড়ি যাবেন। এখনও দুর্বল। একা যেতে পারবেন না বলে সন্দেহ হলো মেরিচাচীর। কিশোর আর রবিনকে বললেন বাড়ি পৌঁছে দিয়ে আসতে।

আপত্তি তো নেইই ওদের, বরং যেতে উৎসাহী, দেখে আসতে পারবে। কোনখান থেকে কি ভাবে পান্নাগুলো নিয়ে গেছে চোর।

হ্যারিসের গাড়িটা চালাল রবিন। পাহাড়ের কোলে পাথরের তৈরি হ্যারিসের বাড়িটা চেনে সে।

কিশোরও চেনে। রবিনের ফোক্স ওয়াগেন নিয়ে সে আসছে পেছন পেছন। হ্যারিসকে পৌঁছে দিয়ে ফেরত যেতে হবে ওদেরকে, গাড়িটা লাগবে তখন।

গেট দিয়ে ড্রাইভওয়েতে ঢুকতে চোখে পড়ল রবিনের, সদর দরজা হাঁ হয়ে খুলে আছে। আলো জ্বলছে ভেতরে।

আরি! চমকে উঠলেন হ্যারিস। খোলা রেখেই চলে গিয়েছিলাম! তাড়াহুড়োয় দরজা আটকে যেতেও মনে ছিল না!

রবিন গাড়ি থামাতেই দরজা খুলে নেমে পড়লেন তিনি। টলোমলো পায়ে যতটা সম্ভব দ্রুত এগিয়ে গেলেন দরজার দিকে।

গাড়ি রেখে কিশোর আর রবিনও তার পিছু নিল।

লাইব্রেরিতে ঢুকেই থমকে দাঁড়ালেন হ্যারিস। চিৎকার করে উঠলেন, হায় হায়, আমার দাবার বোর্ডটাও নেই! বুক চেপে ধরলেন তিনি। টেবিলেই ছিল! গেছে ওটাও!

.

০৭.

 ধরে তাকে চেয়ারে বসিয়ে দিল রবিন। গেলাসে করে পানি এনে দিল। কিশোর গেল ডাক্তারকে ফোন করতে।

ডাক্তার আসতে আসতে তদন্তটা সেরে ফেলতে চাইল সে। হ্যারিসের কাছে রবিনকে বসিয়ে রেখে যে ঘরে আলমারিটা আছে সে-ঘরে এসে ঢুকল। দেখা শেষ করে ফিরে আসতে কয়েক মিনিটের বেশি লাগল না।

চোখ বুজে আছেন হ্যারিস। খুললেন না। কিশোরের সাড়া পেয়ে বললেন, পান্নার বাকি জিনিসগুলো আলমারিতে আছে।

রবিনের দিকে তাকিয়ে নীরবে মাথা ঝাঁকাল কিশোর। ইঙ্গিতে বুঝিয়ে দিল, কিছুই নেই আলমারিতে। সাফ করে নিয়ে গেছে। রবিনকে সরিয়ে এনে ফিসফিস করে বলল, চুপ থাকো। ডাক্তার আসার আগে হ্যারিসকে বলার দরকার নেই।

আবার ফোন করতে গেল কিশোর। এবার থানায়। ইয়ান ফ্লেচারকেই পাওয়া গেল।

আমার মনে হয় দ্বিতীয় চুরিটাও প্রথমটার ওপর ভিত্তি করেই হয়েছে, কিশোর বলল। সাজানো ঘটনা। প্ল্যান করে চুরি করতে এসেছিল চোর। মিথ্যে কথা বলে ভজিয়ে-ভাজিয়ে মিস্টার হ্যারিসকে দিয়ে আলমারির তালা খোলায়। প্রথমে কয়েকটা পুতুল নিয়ে আসেন তিনি। সেগুলো দেখার পর তাকে দাবার বোর্ডটা আনতে পাঠায় চোর। তিনি সেটা আনতে গেলে পুতুলগুলো নিয়ে সে বেরিয়ে যায়। সে জানত, মিস্টার হ্যারিস পিছু নেবেন। চালাকি করে তাঁকে টেনে নিয়ে যায় রিভেরা হাউসে। মিস্টার হ্যারিসের বাড়ি তখন পুরোপুরি খালি। সেই সুযোগে চোরের কোন সহযোগী এসে দাবার। বোর্ড আর আলমারিতে রাখা অন্যান্য জিনিস নিয়ে কেটে পড়ে।

চীফ বললেন, আমার বিশ্বাস, যারা বন্দরে উৎপাত করছে, এটাও সেই চোরদেরই কাজ। কদিন ধরে খুব জ্বালাচ্ছে ওরা। জেটিতে ভেড়ানো জাহাজ, বন্দরের গুদাম, যেখানেই সুযোগ পাচ্ছে, চুরি করছে। কোনমতেই ধরা যাচ্ছে না ব্যাটাদের। একটা কালো গাড়িতে করে চলাফেরা করত ওরা। পুলিশ জেনে ফেলেছে বুঝে সেটীও আর ব্যবহার করছে না।

মাল সরাচ্ছে কোথায়?

বুঝতে পারছি না। কড়া নজর রেখেছি আমরা। চোরাই মাল বাজারে এলেই খপ করে ধরব। কিন্তু আসছে না। তারমানে নিয়ে গিয়ে লুকিয়ে ফেলছে ওরা। পরে পরিস্থিতি ঠাণ্ডা হলে বের করবে।

জরুরী কিছু জানতে পারলে চীফকে জানাবে, কথা দিয়ে রিসিভার রেখে দিল কিশোর।

ডাক্তার এলেন। হ্যারিসকে দেখেটেখে বললেন, চিন্তার কিছু নেই। কয়েক দিন বিশ্রাম নিলেই সেরে যাবেন। বেশি উত্তেজনায় এমন হয়েছে। তোমাদের আর থাকার দরকার নেই। বাড়ি যেতে পারো।

ওষুধ দিয়ে ডাক্তার চলে গেলেন।

আলমারিও যে ফাঁকা করে দিয়ে গেছে চোর, এ কথা আর হ্যারিসকে বলল না কিশোর। শুনলে আবার কি করে বসেন ঠিক নেই। ওষুধ দেয়া হয়েছে। ঘুমাক। সকালে উঠে নিজেই যা দেখার দেখবেন।

রবিনকে নিয়ে বেরিয়ে এল কিশোর। বাড়ি ফিরে চলল।

অনেক রাত হয়েছে। ইয়ার্ডে ওদের বাড়িতেই রবিনকে থেকে যেতে বলল কিশোর। রবিনও রাজি হয়ে গেল। বাড়িতে ফোন করে দিলেই হবে, মা আর চিন্তা করবেন না।

পরদিন সকালে নাস্তা সেরেই বেরিয়ে পড়ল দুই গোয়েন্দা। প্রথমে যাবে। থানায়। আগের রাতে রিভেরা হাউসে পুলিশ কিছু পেল কিনা জানার জন্যে।

অফিসেই পাওয়া গেল ফ্লেচারকে। জানালেন, রিভেরা হাউসে নতুন কিছু পাওয়া যায়নি। তবে বন্দরে বেশ কয়েকটা ঘটনা ঘটেছে। একটা স্পীড বোটের মালিক জানিয়েছে, তার বোটটা চুরি করে কেউ ব্যবহার করেছে। ঘাটে রেখে যাবার সময় ওটার পেট্রল ট্যাংক ভরা ছিল, ফিরে এসে দেখে প্রায় খালি। বোটের ইঞ্জিনও গরম। অথচ বহুক্ষণ ওটা চালায়নি সে। তারমানে কেউ চালিয়েছে।

দ্বিতীয় ঘটনাটা হলো, হিরন নামে আরেকটা মোটর বোট চুরি করে নিয়ে। পালাচ্ছিল দুজন লোক। একজন বেটে, আরেকজন লম্বা। কোস্ট গার্ডের নজরে পড়ে যায় সেটা। তাড়া করে। ম্যানিলা রিভারের মুখের কাছে গিয়ে ডুবো পাথরে ঘষা লেগে ডুবে যায় বোটটা। সাঁতরে তীরে উঠে জঙ্গলে ঢুকে পড়ে দুই চোর। আর ওদেরকে ধরা যায়নি।

আর তৃতীয় ঘটনাটা হলো, সী কিং নামে একটা জাহাজে ক্যাপ্টেনের কেবিনে চোর ঢুকেছিল। জাহাজটার মালিক স্টার লাইট শিপ কোম্পানি।

কি নিয়েছে? জানতে চাইল কিশোর।

মৃদু হাসলেন চীফ। শুনলে চমকে যাবে। একটা পান্না বসানো দামী হার। স্ত্রীর জন্যে কিনে রেখেছিলেন ক্যাপ্টেন টমার।

সত্যিই চমকাল দুই গোয়েন্দা। খবরটা হজম করতে সময় লাগল ওদের। তারপর কিশোর বলল, মিলে যাচ্ছে। ডুডলি হ্যারিসের বাড়ি থেকেও পান্নার তৈরি জিনিসই চুরি গেছে।

মাথা ঝাঁকালেন চীফ, কয়েক ঘণ্টার মধ্যে দুই দুইটা চুরি। পান্নার ওপরই লোভ ওদের। একই দলের কাজ বলেই মনে হয়।

ক্যাপ্টেন টমার এখন কোথায়? তাঁর সঙ্গে কথা বলা যাবে?

লস অ্যাঞ্জেলেসে গেছেন। কোম্পানির হেড অফিসে, কথা বলতে। কাল নাগাদ ফিরে আসবেন।

একটার সঙ্গে আরেকটার যোগসূত্র দেখতে পাচ্ছি, চিন্তিত ভঙ্গিতে বলল রবিন। বন্দরের চোরদের সঙ্গে মিস্টার হ্যারিসের বাড়িতে চুরির মিল, আবার মিস্টার হ্যারিসের সঙ্গে রিভের হাউসের যোগাযোগ। সব যেন একই সুতোয় বাঁধা।

আবার মাথা ঝাঁকালেন চীফ, সে-রকমই মনে হচ্ছে।

কিশোর বলল, বোট ব্যবহার করে শুনে মনে হচ্ছে, জলপথে পালায় চোরেরা। রিভেরা হাউসের পেছন দিয়েই বইছে ম্যানিলা নদী। বন্দর থেকে চোরাই মাল নিয়ে বোটে করে সোজা চলে যায় রিভেরা এস্টেটে। সেখানে কোনখান থেকে গাড়িতে পাচার করে দেয় মাল।

ঠিক! উত্তেজিত হয়ে উঠল রবিন। সেজন্যেই হদিস করতে পারছে না পুলিশ!

চীফের দিকে তাকাল কিশোর, আজ বিকেল পাঁচটায় রিভেরা হাউসে যাব আমি আর রবিন। জরুরী কিছু পেলে আপনাকে জানাব।

.

০৮.

সাড়ে চারটায় রওনা হলো দুজনে। বাড়িতে কাজ থাকায় সেদিনও ওদের সঙ্গে যেতে পারল না মুসা।

এস্টেটে পৌঁছে রাস্তার ধারে একটা ঝোপের পাশে গাড়ি রাখল রবিন। আগের রাতে ডুডলি হ্যারিসও এখানেই রেখেছিল।

ভারি কাঠের গেটটার কাছে এসে শিস দিয়ে উঠল কিশোর। কাল রাতে খোলা দেখে গিয়েছিলাম..

এখন খোলা, এই তো? রবিন বলল, কাল রাতে তুমি চুরির কথা বলার। পর পুলিশ এসেছিল হয়তো, ওরাই লাগিয়ে রেখে গেছে।

কিন্তু সন্তুষ্ট হতে পারল না কিশোর।

সাবধানে ভেতরে ঢুকল দুজনে।

বাড়ির পেছনের পায়ের ছাপগুলো আরেকবার দেখব, কিশোর বলল। এই গেটের ব্যাপারটা ভাল্লাগছে না আমার। খোলা রেখে গেলে দেখি লাগানো, লাগানো দেখলে থাকে বন্ধ। নিশ্চয় কারও যাতায়াত আছে।

প্রথমবার যেখানে পায়ের ছাপগুলো দেখেছিল, সেখানে চলে এল সে। মাটির দিকে তাকাল।

দেখো, নতুন ছাপ। অনেকগুলো। এই কটা দেখো, বেশি দেবেছে। তারমানে লোকটার ওজন বেশি।

এগুলো কালকেরগুলো না বলছ? রবিনের প্রশ্ন।

রাতে অনেক বৃষ্টি হয়েছে। আগের ছাপ থাকার কথা নয়। বৃষ্টির পরে পড়েছে এগুলো।

ছাপ অনুসরণ করে নদীর ধারে চলে এল ওরা। এখানে নদীটা বেশ চওড়া।

মিনিটখানেক পর ড্রাইভওয়েতে একটা গাড়ি ঢোকার শব্দ শোনা গেল।

মনে হয় ককার এসেছেন, রবিন বলল। অন্য কেউও হতে পারে। লুকিয়ে পড়া দরকার।

ঘন গাছপালার আড়ালে আড়ালে এগোল ওরা। কিছুদূর এগোনোর পর বাড়ির বারান্দাটা চোখে পড়ল।

লম্বা, হালকা রঙের স্যুট পরা এক ভদ্রলোক দাঁড়িয়ে আছেন। অধৈর্য ভঙ্গিতে এদিক ওদিক তাকাচ্ছেন। কয়েকবার তাকালেন ওরা যেদিকে রয়েছে সেদিকে, কিন্তু গাছের আড়ালে থাকায় ওদের দেখতে পেলেন না।

ককারই তো? রবিনের কণ্ঠে সন্দেহ, নাকি তার নকল?

ওদের দিকে পিঠ দিয়ে উল্টো দিকে ঘুরলেন ভদ্রলোক। নিঃশব্দে এক ছুটে তার কাছে চলে এল ওরা। আস্তে কাঁধে হাত ছোঁয়াল রবিন।

কে! ভীষণ চমকে গিয়ে চরকির মত পাক খেয়ে ঘুরে দাঁড়ালেন ভদ্রলোক।

সরি! আপনি আসলেই মিস্টার ককার কিনা, সন্দেহ ছিল আমাদের…

খুব চমকে দিয়েছ, গম্ভীর হয়ে আছেন ব্যাংকার। তোমাদের গাড়ি দেখলাম না, ভাবলাম আসোনি বুঝি। এসো। একটা মিনিট নষ্ট করা যাবে না। কাটায় কাটায় পাঁচটায় সেট করা আছে টাইম লক। এখনই যেতে হবে। নইলে আর ঢুকতে পারব না।

চাবি দিয়ে সামনের দরজার তালা খুললেন ককার। লিভিং রুমে ঢুকে চট করে একবার তাকালেন গণ্ডিফাদার কুকটার দিকে। তারপর গোয়েন্দাদের নিয়ে চললেন ওপরতলায়।

বড় একটা ঘরে ঢুকে ফ্রেমে বাঁধা একটা ফটোগ্রাফ সরাতে একটা ছোট ছিদ্র দেখা গেল। তাতে আঙুল ঢুকিয়ে বোধহয় চাপই দিলেন। খুব ছোট গোল একটা দরজা খুলে গেল। বেরিয়ে পড়ল টাইম লকের ডায়াল।

ডায়ালগুলোকে কিছুক্ষণ এপাশ ওপাশ ঘোরালেন তিনি।

তাকিয়ে আছে দুই গোয়েন্দা। দেয়ালের যে জায়গাটায় এতক্ষণ। কাগজের জোড়া আছে ভেবেছিল, সেখানে একটা চির দেখা দিল। বড় হতে লাগল ফাটলটা। অবশেষে খুলে গেল দরজা।

গুপ্তঘরে ঢোকার পথ।

 গোয়েন্দাদের নিয়ে একটা ছোট, জানালাশূন্য ঘরে ঢুকলেন ককার।

ঘরের মাঝখানে পড়ে থাকা সাদা কাগজটা সবার আগে রবিনের চোখে পড়ল। এগিয়ে গিয়ে তুলে নিল ওটা।

তাতে লেখা:

ঘড়ি যখন টিক টিক করবে,
তখন আসবে মরণ!
এবং এটাই শেষ হুশিয়ারি!

দীর্ঘ একটা মুহূর্ত স্তব্ধ হয়ে রইল তিনজনে। তারপর হাত বাড়াল। কিশোর, দেখি?

প্রথম যে দুটো মেসেজ পাঠানো হয়েছিল, সেগুলোর মত একই হাতের লেখা।

 কিছু মনে না করলে এটা আমরা রেখে দিচ্ছি, মিস্টার ককার, বলল সে। সূত্র হিসেবে কাজে লাগতে পারে।

থমথম করছে ব্যাংকারের মুখ। মাথা ঝাঁকালেন। রাখো।… ওদের হুমকিকে আমি ভয় করি না। ভাবছি এতটা ঘৃণা আমাকে কে করে যে খুনই করতে চায়!

রবিন বলল, জিনিস খোয়া গেছে নাকি দেখেন তো?

টেবিলে রাখা কাগজপত্র আর ফাইলিং কেবিনেটটা দ্রুত একবার দেখে নিলেন ককার। না, সব ঠিক আছে। আগের বারের মতই। ঘরের মেঝেতে রহস্যময় একটা নোট। কোন জিনিস খোয়া যায়নি। কিছুতে হাতও দেয়নি।

বর্গাকার ঘরটাতে চোখ বোলাল কিশোর। দরজা ছাড়াও ঢেকিার আরও পথ আছে, সেটা বের করতে হবে। মিস্টার ককার, দরজাটা লাগিয়ে দিন। খুজব।

 সুইচ টিপে মাথার ওপরের একটা আলো জ্বাললেন ককরি। তারপর। ইস্পাতের ভারি দরজাটা লাগিয়ে দিলেন।

কাজে লেগে গেল দুই গোয়েন্দা।

ফায়ারপ্লেসে মাথা ঢুকিয়ে চিমনির ভেতর দিয়ে ওপরে তাকাল কিশোর।

ককার ঠিকই বলেছেন, ওপরের খোলা মুখটীয় শিক লাগানো। কেউ ওপথে ঢুকতে হলে শিকগুলো খুলে ফেলে দিতে হবে আগে। তা ছাড়া খুললেও এত সরু চিমনি দিয়ে কোন বাচ্চা ছেলেও ঢুকতে পারবে না। না, এ পথে করিও ঢোকা একেবারেই অসম্ভব।

কাজে লাগতে পারে ভেবে ছোট একটা হাতুড়ি নিয়ে এসেছে রবিন। সেটা দিয়ে দেয়াল ঠুকে দেখতে লাগল ফাপা আওয়াজ বেরোয় কিনা।

 কার্পেট উল্টে দেখতে শুরু করল কিশোর। নিচের মেঝেতে ট্র্যাপিডোর কিংবা আলগা তক্তা কোন কিছুই নেই, যেটা সরিয়ে ঢোকা যায়। চিমনি আর দরজাটা বাদে কোথাও এমন ফাঁক-ফোকর নেই, যেখান দিয়ে মানুষ তো দূরের কথা, একটা ইঁদুর ঢুকতে পারে।

বুঝতে পারছি না! রীতিমত অবাক হয়েছে কিশোর। কেউ তো একজন নিশ্চয় ঢুকেছে। নইলে নোট রেখে গেল কি ভাবে?

সাধে কি আর ডাকতে গেছি তোমাদের! ফোঁস করে একটা নিঃশ্বাস ফেলে চেয়ারে বসে পড়লেন ককার।

আরেকটা সম্ভাবনা আছে অবশ্য, হঠাৎ বলে উঠল কিশোর। পকেট থেকে ফিতে বের করে ঘরটা মাপতে শুরু করল। তারপর বলল, মিস্টার ককরি, দরজা খুলুন।

দরজার চৌকাঠের দুই পাশে দুই পা দিয়ে দাঁড়াল সে। দেয়াল কতটা পুরু, মাপল।

এ ঘরে আর কাজ নেই। বেরিয়ে এল সবাই। দরজা লাগিয়ে, টাইম লক সেট করে, দেয়ালের ছিদ্রের ওপর আবার ছবিটা ঝুলিয়ে দিলেন ককার।

ততক্ষণে সীটিং রুমের দেয়াল মাপতে আরম্ভ করেছে কিশোর। তারপর হলঘরে ঢুকে সেটার দেয়ালও মাপল।

ব্যাপারটা কি? কি করছ? জানতে চাইলেন ব্যাংকার।

দেখলাম গুপ্তঘরের দেয়ালে কোন কারসাজি আছে কিনা। এ সব পুরানো আমলের বাড়িতে অনেক সময় ফলস ওয়াল তৈরি করা হয়, আনমনে বলল কিশোর। কিন্তু এটার দেয়াল ফলস বলে মনে হয় না। মাপ ঠিক, কোন গণ্ডগোল নেই।

তাজ্জব ব্যাপার! রবিন বলল। হুমকিটীকে সিরিয়াসলি নেবেন, মিস্টার ককার। সাবধানে থাকবেন।

চওড়া সিঁড়িটা বেয়ে নিচে নেমে এল তিনজনে।

নীরব বাড়িটাতে একটাই মাত্র শব্দ শোনা যাচ্ছে এখন। বিরাট ঘড়িটার শব্দ:

টিক-টক! টিক-টক! টিক-টক!

বিড়বিড় করল রবিন, ঘড়ি যখন টিক টিক করবে, তখন আসবে মরণ!

লিভিং রুমের দিকে এগোল সে। গ্র্যাণ্ড ফাদার কুকটার সামনে দাঁড়াল। একতালে দুলছে পেণ্ডুলাম। শব্দ করছে টিক-টক, টিক-টক।

কপাল ভাঁজ করে ফেললেন ককার, একবারও দম দিইনি আমি ঘড়িতে! চলে কি করে?

নিশ্চয় দেয় কেউ, রবিন বলল। কাল রাতেও দেখে গেছি চলছে। যে লোক নোট রেখে যায়, হতে পারে সে-ই চাবিও দিয়ে যায়। সে বলছে, ঘড়ি টিক টিক করলে মরণ আসবে, হয়তো এই ঘড়িটার কথাই বলেছে।

ঘড়ির নিচে পেণ্ডুলাম রয়েছে যে খুপড়িটায়, তার কাচের দরজাটার দিকে তাকাল সে। ভেতরে অন্য কিছু নেই। ওপরের দরজাটী সাবধানে খুলে। ভেতরটা দেখল।

এখানেও কিছু নেই।

নিচের ঠোঁটে চিমটি কাটছে কিশোর। গভীর চিন্তায় মগ্ন। কি যেন মনে করার চেষ্টা করছে। বলল, মিস্টার ককার, আমাদের ডুপ্লিকেট চাবির খবর

হায় হায়, তাই তো! এত কাজের চাপ, চাবির কথা ভুলেই গিয়েছিলাম। ঠিক আছে, কাল সকালে আগে চাবিওয়ালার কাছে যাব, তারপর অন্য কাজ।

.

০৯.

ইয়ার্ডে ফিরে মুসার পুরানো জেলপি গাড়িটাকে চতুরে দাঁড়ানো দেখল ওরা। মুসা বসে আছে ওঅর্কশপে। ওদের অপেক্ষায়।

তদন্তের কতখানি অগ্রগতি হয়েছে, কিছুই জানে না সে। শুনতে চাইল।

সব তাকে খুলে বলতে লাগল রবিন আর কিশোর। বদ্ধ ঘরে নোট পাওয়া গেছে শুনে গম্ভীর হয়ে গেল মুসা। মাথা দুলিয়ে বলল, বুঝলাম!

কি বুঝলে? ভুরু কোঁচকাল রবিন।

 কে ওখানে নোট ফেলে এসেছে।

কে? রবিন অবাক।

 ভূতে। বদ্ধ ঘরে ঢুকতেও কোন অসুবিধে হয় না ওদের।

তোমার মাথা! ভূত না ছাই! মানুষই ঢুকেছে। কি ভাবে, সেটাই বুঝতে পারছি না!

সেটা বুঝতে হলে বাড়িটার ওপর নজর রাখতে হবে আমাদের। ভাবছি, আজ রাতেই আবার যাব। কেউ ঢোকে কিনা দেখব। ঢুকলে তাকে ধরার চেষ্টা করব। মুসা, বাড়িতে তোমার কাজ শেষ হয়েছে?

পুরোপুরি হয়নি। তবে আজ রাতে না করলেও চলবে।

তাহলে যেতে পারবে আমাদের সঙ্গে?

পারব।

ভূত আছে তো পোড়োবাড়িতে, হেসে বলল রবিন, ভয় লাগবে না? যদি চেপে ধরে?

দোয়া-দরূদ পড়তে পড়তে যাব, হাত নেড়ে মুসা বলল, তাহলেই আর কাছে ভিড়তে পারবে না ভূত।

রাত নামার অপেক্ষা করল ওরা। তারপর তৈরি হয়ে বেরিয়ে পড়ল। ইঞ্জিনের আওয়াজ শুনলে পালিয়ে যেতে পারে চোরেরা, তাই গাড়ি নিল না। হেঁটে চলল। টর্চ আছে সঙ্গে, জ্বালানোর প্রয়োজন পড়ল না। চমৎকার চাঁদের আলো।

শহর ছেড়ে এসে নদীর পাড়ের পথ ধরল। এ পথে যানবাহন খুব কম। দুএকটা গাড়ি আসছে যাচ্ছে। রিভেরা এস্টেটের দিকে কোন গাড়ি যেতে দেখলেই পথের পাশের পপি কিংবা গাছের আড়ালে লুকিয়ে পড়ছে ওরা। বলা যায় না, গাড়িটা চোরেরও হতে পারে। চিনে ফেলতে পারে ওদের।

রিভেরা হাউসের গেটে এসে ফিরে তাকাল মুসা। কেউ পিছু নিয়েছে। কিনা দেখল। চাঁদের ফ্যাকাসে আলোয় রাস্তাটা পরিষ্কার দেখা যায়। নির্জন। গেটের পাশে গাছের জটলা আর দেয়ালে লম্বা লম্বা আইভি লতা রহস্যময় ছায়া সৃষ্টি করেছে। নিজের অজান্তেই গায়ে কাটা দিল তার।

গেট বন্ধ। ডিঙাতে অসুবিধে হলো না। ভেতরে ঢুকে বাড়িটার কাছাকাছি। এসে ঝোপে লুকিয়ে বসল। এখান থেকে সামনে-পেছনে দুদিকের দরজার ওপরই নজর রাখা যায়। চাঁদের আলোয় চকচক করছে বাড়ির প্লেট পাথরের টালি।

বসে আছে তো আছেই ওরা। কেউ আর আসে না। উসখুস শুরু করল মুসা। উঠে চলে যাওয়ার কথা বলতে যাবে কিশোরকে এই সময় তার গায়ে। কনুইয়ের তো মেরে ফিসফিস করে রবিন বলল, ওই দেখো!

জঙ্গলের ভেতর থেকে বেরিয়ে এসেছে সাদা শার্ট পরা খাটেীমত এক লোক। বাড়িটার দিকে এগোল। হাঁটার ভঙ্গি দেখেই বোঝা যায় পথ ওর চেনা।

ধরতে হবে, কিশোর বলল। এসো।

নিঃশব্দে এগোল ওরা। আরেকটু হলেই পেছন থেকে গিয়ে লোকটাকে ধরে ফেলতে পারত। কিন্তু গোলমাল করে ফেলল মুসা। শুকনো ডালে পা। দিয়ে বসল। মট করে ভাঙল ওটা।

পাঁই করে ঘুরে দাঁড়াল লোকটা। তিন গোয়েন্দাকে দেখে একটা মুহূর্ত দেরি করল না। নদীর দিকে দৌড় দিল।

পিছু নিল তিন গোয়েন্দা।

সাংঘাতিক দৌড়াতে পারে লোকটা। বনের মধ্যে ঢুকে অদৃশ্য হয়ে গেল চোখের পলকে।

ওর কাছে পিস্তল থাকতে পারে এই ভয়ে টর্চ জ্বালতে সাহস করল না গোয়েন্দারা। চাঁদের আলো থাকা সত্ত্বেও বনের মধ্যেটা অন্ধকার। দেখা গেল না লোকটাকে।

খানিক পর একটা মোটর বোটের ইঞ্জিন গর্জে উঠল। নীরব রাতে অনেক বেশি করে কানে বাজল শব্দটী। নদীর দিকে ছুটল ওরা।

দেরি করে ফেলেছে। নদীর পাড়ে এসে দেখল, চলতে আরম্ভ করেছে। ছোট একটা স্পীড বোট। হুইল ধরে বসেছে লোকটা।

হতাশ চৌখে বোটটার দিকে তাকিয়ে রইল গোয়েন্দারা। নিজের ভুলের জন্যে ধরতে পারল না বলে আফসোস করতে লাগল মুসা। নদীর মোহনার দিকে যাচ্ছে বোট। দেখতে দেখতে হারিয়ে গেল বাকের আড়ালে।

কিশোর বলল, কাল রাতে দুজন লোককে তাড়া করেছিল পুলিশ। বেট ডুবে যাওয়ার পর পালিয়েছিল ওরা। একজন লম্বা, আরেকজন বেটে। মনে হয় সেই বেঁটে লোকটাই এই লোক।

রিভেরা হাউসে কি করতে এসেছিল? রবিনের প্রশ্ন।

সেটাই তো বুঝতে পারছি না। আসলে বোকামি করে ফেলেছি। ধরার চেষ্টা না করে তার পিছু নেয়া উচিত ছিল। কোথায় যায়, কি করে, দেখতাম। অনেকগুলো প্রশ্নের জবাব পেয়ে যেতাম তাহলে।

আবার বাড়ির কাছে ফিরে এল ওরা। আর এখানে থাকার কোন মানে নেই। সন্দেহজনক যাকে আশা করেছিল কিশোর, সে এসে চলে গেছে। এ রাতে আর কেউ আসবে বলে মনে হয় না।

অহেতুক বসে না থেকে দুই সহকারীকে নিয়ে বাড়ি ফিরে চলল কিশোর।

.

১০.

পরদিন সকালে নাস্তার পর স্টার-লাইট শিপ কোম্পানির অফিসে রওনা হলো কিশোর আর রবিন। মুসাকে ফোন করেছিল কিশোর। আসতে পারবে না বলে দিয়েছে মুসা। কাজে ব্যস্ত। মা তাকে আটকে ফেলেছেন।

অফিসটা খুঁজে বের করল সহজেই। রিসিপশন ডেস্কে বসা সেক্রেটারি বলল, ক্যাপ্টেন টমার? হ্যাঁ, আছেন। কিন্তু ব্যস্ত। দেখা করতে পারবেন বলে মনে হয় না।

বলুনগে পান্নার হারের ব্যাপারে কথা বলতে এসেছি অমিরা, কিশোর বলল। অবশ্যই দেখা করবেন তিনি।

অবাক হয়ে তার মুখের দিকে দীর্ঘ একটা মুহূর্ত তাকিয়ে রইল সেক্রেটারি। তবে আর কিছু বলল না। উঠে চলে গেল ভেতরের দিকের একটা অফিসে। গেল আর এল। অফিসের দরজা দেখিয়ে ওদেরকে যেতে বলল।

ক্যাপ্টেনের ইউনিফর্ম পরা লাল-চুল, লম্বা একজন মানুষ বসে আছেন সেগুন কাঠের ভারি ডেস্কের ওপাশে। গমগমে গলায় জিজ্ঞেস করলেন, হারটা সম্পর্কে কি জানো?

এখনও কিছু জানি না, স্যার, বিনীত ভঙ্গিতে বলল কিশোর। আশা করছি, চুরির ব্যাপারে আমাদের কিছু বলবেন আপনি।

কেন বলব? তোমরা কে তা-ই তো জানি না।

 তাড়াতাড়ি পকেট থেকে কার্ড বের করে দিয়ে নিজেদের পরিচয় দিল কিশোর।

তাতে মুখের ভাবের কোন পরিবর্তন হলো না ক্যাপ্টেনের। ওদের গুরুত্ব বাড়ল না তাঁর কাছে। সেটা বুঝে পকেট থেকে একটা কাগজ বের করে দিল কিশোর। ওদেরকে দেয়া রকি বীচের পুলিশ চীফ ক্যাপ্টেন ইয়ান ফ্লেচারের প্রশংসা পত্র।

নিরাসক্ত ভঙ্গিতে সেটা দেখলেন ক্যাপ্টেন। হাত বাড়ালেন ফোনের দিকে। চীফকে ফোন করলেন।

ওপাশের কথা শুনতে শুনতে আস্তে আস্তে ভাবের পরিবর্তন হলো তাঁর। রিসিভার নামিয়ে রেখে এই প্রথম হাসলেন। ক্যাপ্টেন ফ্লেচার অনেক প্রশংসা করলেন তোমাদের।

কিশোর বলল, তাই।

ঘড়ি দেখলেন ক্যাপ্টেন। বলল, কি জানতে চাও। আমার সময় কম।

হারটা সম্পর্কে বলুন।

বলার তেমন কিছু নেই। লস অ্যাঞ্জেলেসের একটা দোকান থেকে কিনেছিলাম, বাড়ি নিয়ে যাওয়ার জন্যে। ভাগ্যিস বীমা করিয়ে রাখার পরামর্শ দিয়েছিল দোকানদার। চুরি হয়েছে জানানোর সঙ্গে সঙ্গে বীমা কোম্পানি একজন প্রাইভেট ডিটেকটিভকে নিয়োগ করেছে হারটা খুঁজে বের করার জন্যে। কিশোরের দিকে তাকালেন তিনি, তোমরা কি চুরির তদন্ত করছ নাকি?

হ্যাঁ। আমাদের এক পরিচিত ভদ্রলোকের অনেকগুলো দামী জিনিস কাল রাতে চুরি গেছে, সব পান্নার তৈরি। ধারণা করছি সেগুলোর চোর আর আপনার হার চৌর একই লোক। চোরটাকে দেখেছেন?

নাহ, দেখলে কি আর পালাতে দিই। রাতের ওই সময়টায় খুব বেশি ব্যস্ত ছিলাম। জাহাজ থেকে দামী মাল খালাস করা হচ্ছিল। আমি ছিলাম সেখানে। কাজ করার জন্যে কয়েকজন নতুন শ্রমিককে নেয়া হয়েছিল। শ্রমিকের ছদ্মবেশে চৌরটাও উঠে থাকতে পারে জাহাজে।

তা পারে। তাদের নাম-ঠিকানা লেখার ব্যবস্থা আছে আপনার জাহাজের রেজিস্টারে? খোঁজ নেয়া যাবে?

না। বেশি প্রয়োজন হলে বাইরের শ্রমিক ভাড়া করি আমরা। কাজ শেষ হলে পাওনা চুকিয়ে বিদেয় করে দিই। নাম-ঠিকানা লিখে রাখার প্রয়োজন পড়ে না।

নতুন কোন তথ্য দিতে পারলেন না ক্যাপ্টেন। সাহায্য হলো না গোয়েন্দাদের। তাকে ধন্যবাদ দিয়ে অফিস থেকে বেরিয়ে এল ওরা।

রকি বীচে ফিরে শিল্পকর্ম আর গহনার দোকানগুলোতে খোঁজ নিতে লাগল কিশোর, কেউ পান্নার কোন জিনিস বিক্রি করতে এনেছিল কিনা। দুই মাসের মধ্যে আনেনি কেউ, জানাল দোকানদারেরা। তবে ওদের একজন পরিচিত দোকানদার বলল, চোরাই মাল হলে ওদের কাছে আনার আগে অন্য একজনের কাছে যাবে চোর। তার নাম হব ডিকসন। এটা গোপন তথ্য। বলার আগে অবশ্যই ওদের কাছ থেকে কথা আদায় করে নিল দোকানি, এ খবর যাতে কারও কাছে ফাস না করে ওরা।

শহরের একধারে হব ডিকসনের অ্যানটিক শপ। ইট বের হওয়া পুরানো বিল্ডিংটার সামনে গাড়ি রাখল রবিন। বাড়িটার নিচতলা রাস্তার সমতল থেকে অনেক নিচে। সিঁড়ি বেয়ে নামতে হয়।

নেমে এসে দোকানের সামনে দাঁড়াল দুই গোয়েন্দা। উইণ্ডোতে নানা রকম অদ্ভুত জিনিস রাখা। কোনটা দামী, কোনটা সাধারণ। বোঝানো হয়েছে, সব ধরনের অ্যানটিকই পাওয়া যায় এখানে।

 ওরা ঢুকতে কাঠের কাউন্টারের ওপাশ থেকে মুখ তুলল একজন ছোটখাটো মানুষ। ধূসর-চুল, চোখে স্টীল-রিমড চশমা। হাসিমুখে স্বাগত জানাল, হাল্লো, বয়েজ, কি করতে পারি তোমাদের জন্যে?

আপনি মিস্টার হব ডিকসন?

 মাথা ঝাঁকাল লোকটা। হ্যাঁ। অ্যানটিক চাই? কি জিনিস?

কিছু কিনতে আসিনি, মিস্টার ডিকসন, ভূমিকা না করে সরাসরি কাজের কথায় এল কিশোর। জানতে এলাম, কেউ কি পান্নার তৈরি কোন জিনিস বিক্রি করতে এনেছিল?

হাসি মুছে গেল লোকটার। সেই সঙ্গে বিস্ময়ও ফুটল চেহারায়। চমকে গেছে। ঢোক গিলে সামলে নিল। জিজ্ঞেস করল, কে তোমরা?

কার্ড বের করে দেখাল কিশোর। পরিচয় দিল।

বলবে কি বলবে না, দ্বিধা করতে লাগল হব। শেষে কি মনে করে বলেই ফেলল, দামী একটা দাবার বোর্ড আর একটা হার বিক্রি করতে এসেছিল একজন।

সামনে গলা বাড়িয়ে দিল রবিন, কিনেছেন?

না, পাগল ভেবেছ আমাকে! এত দাম চাইল, কিনে বেচব কততে? লাভ করব কি? লোকটা বলল, তার নাকি টাকার খুব ঠেকা। নইলে শখের জিনিস বেচত না।

লোকটা দেখতে কেমন, মিস্টার ডিকসন? জিজ্ঞেস করল কিশোর।

ভেবে বলল হব, লম্বা, মধ্যবয়েসী, চোখে রিমলেস গ্লাস। হালকা রঙের স্যুট পরেছিল, মাথায় ঐ হ্যাট।

রবিনের দিকে তাকিয়ে বলল কিশোর, মিস্টার ককারের মত মনে হচ্ছে না!

ও, চেনো তাকে? হব বলল। ভালই হলো। পকেটে হাত ঢোকাল সে।

ছোট চেন লাগানো একটা চাবির রিঙ বের করে কাউন্টারে রাখল সে। তাতে তিনটে চাবি। ফেলে গিয়েছিল। ফেরত দিতে পারবে?

প্রায় ছোঁ মেরে রিঙটা তুলে নিয়ে পকেটে ফেলল কিশোর। পারব।

দোকানিকে ধন্যবাদ দিয়ে বেরিয়ে এল দুই গোয়েন্দা। গাড়িতে এসে উঠল।

জিনিস বেচতে ককরি আসেননি, রবিন বলল, নিশ্চয় তার মত দেখতে সেই লোকটা। পান্নার বোর্ড আর হার যখন নিয়ে এসেছে, আমাদের সন্দেহই ঠিক, চুরিটা একই লোকের কাজ।

ইঞ্জিন স্টার্ট দিল সে।

পকেট থেকে রিঙটা বের করল কিশোর। চাবি তিনটা দেখতে দেখতে বলল, দুটো চাবি ইগনিশনের। কিসের ইগনিশন, বলো তো? গাড়ি, নাকি বোটের?

মনে তো হচ্ছে স্পীড বোটের।

একটা গাড়ির। অন্যটা স্পীড বোটের হওয়ার সম্ভাবনাই বেশি। তবে এটা মাস্টার কী-র মত লাগছে। যে কোন বোটের ইগনিশনে ঢোকানো যাবে। সূতরাং কোন নির্দিষ্ট বোটের খবর নিয়ে লাভ নেই। তবে গাড়িটার খোঁজ করা যেতে পারে। তার জন্যে ক্যাপ্টেন ফ্লেচারের সাহায্য দরকার।

এখনই যাব?

না, পরে। আগে বাড়ি যাও।

Super User