১১.

 পরদিন সকালে ফায়ারের পিঠে চেপে সেভারনদের বাড়ি রওনা হলো মুসা।

সুন্দর সকাল। মাঠ আর ঝোপঝাড় থেকে ওঠা ভোরের কুয়াশায় সবে প্রবেশ করতে আরম্ভ করেছে সোনালি রোদের বর্শা। দৃপ্ত পায়ে হেঁটে চলেছে পেশীবহুল, খয়েরী রঙের ঘোড়াটা।

সামনে ঝুঁকে চকচকে গলাটায় চাপড়ে দিয়ে বলল মুসা, কতদিন ঠিকমত দৌড়াই না, নারে? জায়গাই নেই সেরকম। আজ পেয়েছি। মনের সুখে দৌড়ে নেব।

যেন মুসার কথা বুঝে সায় দিতেই মাথা ঝাড়ল ফায়ার।

কটেজের পাশ দিয়ে ওকে নিয়ে বনের দিকে এগোল মুসা। নেচে নেচে এগোচ্ছে ফায়ার। নাক উঁচু করে দুই ফুটো ছড়িয়ে তাজা বাতাস টানল বুক বেভরে, অস্থির ভঙ্গিতে মাথা ঝাড়ল আরেকবার

অত অস্থির হচ্ছিস কেন? আদর করে ওর গলায় হাত বুলিয়ে দিল মুসা, জায়গামত আসিনি এখনও। শক্ত করে জিনের ওপর চেপে বসল সে। লাগামটায় আঙুলের চাপ শক্ত করে পা টান টান করে দিল রেকাবে। দৌড়ানোর জন্যে তৈরি হচ্ছে।

গেট পেরিয়ে এসেই হাতে পেঁচিয়ে খাটো করে ফেলল লাগামটা। জোরে চলার ইঙ্গিত করল ফায়ারকে। মুসাদের বাড়ি থেকে হেঁটে এসে ইতিমধ্যেই গা গরম হয়ে গেছে ঘোড়াটার। মুহূর্তে দৌড়ানো শুরু করল।

দক্ষ ঘোড়সওয়ারের মত ওকে নিয়ন্ত্রণে রাখল মুসা। বেশি জোরেও ছুটল; বেশি আস্তেও না। হেসে বলল, ওভাবে পেশী ফোলাচ্ছিস কেন? উড়তে চাস? থাক, পঙ্খীরাজ হওয়ার দরকার নেই। যেভাবে বলছি সেভাবেই চল।

কিন্তু জোরে ছোটার জন্যে মরিয়া হয়ে উঠল ঘোড়াটা। শেষে রাশ খানিকটা ঢিল করে ওকে ছুটতে দিল মুসা। মুহূর্তে যেন উড়ে এসে বনের রাস্তায় ঢুকল ফায়ার। সামনে ঝুঁকে বসে রইল মুসা। রেকাবে আরও টান টান হয়ে গেছে পা। সে-ও ছোটার জন্যে প্রস্তুত। কিন্তু অচেনা পথে জোরে ছুটতে অস্বস্তি হতে লাগল তার। দৌড়ানো থামাল হায়ারের। দুলকি চালে চলল কয়েক মিনিট। শেষে আবার হাঁটাতে শুরু করল আগের মত। হাত লম্বা করে আস্তে চাপড়ে দিল ঘোড়াটার ঘামে ভেজা ঘাড়।

দারুণ ছুটতে পারিস তুই, ফায়ার! হাতের উল্টো পিঠ দিয়ে নিজের কপাল থেকেও ঘাম মুছল মুসা। সত্যি, প্রশংসা করার মত!

রেকাবে পায়ের ভর রেখে উঠে দাঁড়াল সে। পা দুটো ছড়ানোর জন্যে। চোখে পড়ল সাদা ভ্যানটা। আগের দিন যেখানে ছিল, ঠিক সেখানেই দাঁড়িয়ে আছে।

 এখানে কি করছে ও, এত সকালে! প্রথমেই এই ভাবনাটা এল মুসার মাথায়। নিশ্চয় উঁকিঝুঁকি মারতে এসেছে সেভারনদের বাড়িতে। আরও অঘটন দুটানোর তালে আছে।

ঘোড়া থেকে নামল সে। মাথার টুপিটা খুলে একটা গাছের ডালে ঝুলিয়ে রাখল। ফায়ারকে বাঁধল গাছের সঙ্গে। গলাটা চাপড়ে দিয়ে বলল, থাক এখানে, ফায়ার, ঘাস খা। আমি গিয়ে ভ্যানটা দেখে আসি। বেশিক্ষণ লাগবে না।

ঝোপের মধ্যে ঢুকে পড়ল সে। যতটা সম্ভব নিঃশব্দে এগোল গাড়িটার দিকে। পেছনে আঁকা সেই লোগো, এখন আর অপরিচিত নয়। জানালা দিয়ে ভেতরে দেখল। পেছন দিকে এসে হাতল ধরে মোচড় দিতেই খুলে গেল। দরজাটা।

খাইছে! আপনমনেই বলে উঠল সে, ভাগ্যটা ভালই আমার!

আশেপাশে কেউ আছে কিনা দেখে নিয়ে উঠে বসল ভ্যানের মধ্যে। লাগিয়ে দিল দরজাটা।

মেঝেতে পড়ে আছে একটা শটগান। পাশে রাখা এক বাক্স কার্তুজ। জান কি দেখবে, তবু সন্দেহ নিরসনের জন্যে ডালাটা খুলে দেখল। সেদিন এই কার্তুজ দিয়েই গুলি করা হয়েছিল। সন্দেহ নেই। দুটো কার্তুজ তুলে নিয়ে পকেটে রাখল। চোখ বোলাল আর কি আছে দেখার জন্যে। এক কোণে একটা প্লাস্টিকের কনটেইনার, গায়ে মড়ার খুলি আর ক্রসবোন আঁকা স্টিকার লাগানো। মুখটা খুলে গন্ধ শুকল। পোকা মারার বিষ। একই রকম গন্ধ পাওয়া গিয়েছিল সেভারনদের বাগানের পুকুরে।

হাসি ফুটল মুসার ঠোঁটে। ঘুরতে এসে শাজিনদের বিরুদ্ধে এ রকম জোরাল প্রমাণ পেয়ে যাবে আশা করেনি। ভ্যান-চালকের চেহারাটা এখন দেখা দরকার, চিনে নেয়া দরকার, তারপর নিশ্চিন্তে বাড়ি ফিরে যেতে পারে।

গাড়ি থেকে নামতে যাবে, এই সময় কানে এল পায়ের শব্দ। ঝট করে মাথা নামিয়ে ফেলল সে। ড্রাইভারের পাশের দরজা খুলে গেল। আতঙ্কিত হয়ে শুনতে পেল, ইগনিশনে চাবি ঢোকানোর শব্দ এবং তারপর ইঞ্জিনের গর্জে ওঠা। মুসা কোন কিছু করার আগেই চলতে শুরু করল গাড়ি। গতি বেড়ে গেল মুহর্তে। অসহায় হয়ে গুটিসুটি হয়ে পড়ে থাকা ছাড়া আর কোন উপায় নেই।

.

একভাবে পড়ে আছে মুসা। মাথা তুললেই আয়নায় তাকে দেখে ফেলবে। ড্রাইভার। ফলে লোকটার চেহারা দেখার জন্যেও মাথা তুলতে পারছে না।

মিনিট দশেক এক গতিতে গাড়ি চালিয়ে এসে ব্রেক কষে গাড়ি থামাল ড্রাইভার। দরজা খুলে নামল। দড়াম করে লাগিয়ে দিল। সরে যেতে লাগল পায়ের শব্দ।

 সব যখন চুপচাপ হয়ে গেল আবার, আস্তে মাথা তুলল মুসা। পেছনের জানালা দিয়ে তাকাল। রাস্তার ধারে বড় একটা বাড়ির সামনে থেমেছে গাড়িটা। রাস্তাটার দুই ধারেই গাছের সারি।

কোথায় এল সে? আশেপাশে তাকিয়ে চিনতে পারল না জায়গাটা। ড্রাইভারকে দেখা গেল না, তবে বাড়ির দোতলার জানালায় ছায়া নড়তে দেখল। জানালার কাছে দাঁড়িয়ে আছে কেউ।

আলো লাগছে চোখে। কপালের সামনে হাত এনে রোদ বাঁচিয়ে ভালমত তাকাল। জানালার সামনে দাঁড়িয়ে হাত-আয়নায় চেহারা দেখে ঠোঁটে লিপস্টিক লাগাচ্ছে এক মহিলা। লম্বা কালো চুল, মোমের মত সাদা চামড়া। শাজিনকে দেখেনি সে, রবিনের কাছে চেহারার বর্ণনা শুনেছে। মহিলাকে দেখেই এখন বুঝল, ও শাজিন ছাড়া আর কেউ নয়। ভ্যাম্পায়ারের কথা ভেবে কাঁটা দিল গায়ে। দিনের বেলা বেরোয় না ওই রক্তচোষা ভূত মনকে বুঝিয়ে জোর করে ভয় তাড়াল।

জানালার কাছ থেকে মহিলা সরে যেতেই দরজাটা খুলল সে। লাফ দিয়ে নামল। আবার লাগিয়ে দিল দরজা। কাঁধের ওপর দিয়ে ফিরে তাকিয়ে দেখল কেউ লক্ষ করছে কিনা। সরে এসে ভ্যানটাকে সামনে রেখে আড়াল করে বসে তাকাল আবার বাড়িটার দিকে।

চিৎকার শোনা গেল এই সময়। দেখল বাগানের রাস্তা ধরে তার দিকেই দৌড়ে আসছে মহিলা। বোঝা গেল, কোনভাবে দেখে ফেলেছে।

আর বসে থাকতে সাহস করল না মুসা। উঠেই দিল দৌড়।

এই এই, শোনো! চিৎকার করে ডাকল মহিলা।

 ফিরেও তাকাল না মুসা।

.

রাস্তার শেষ মাথায় দেখতে পেল একটা পাবলিক পার্কে ঢোকার লোহার গেট। ওর মধ্যে ঢুকে পড়তে পারলে গাছের আড়ালে বা অন্য কোথাও লুকাতে পারবে। ফিরে তাকাল কাঁধের ওপর দিয়ে। পেছন পেছন দৌড়ে আসছে মহিলা। কপালের ঘাম মুছতে মুছতে ভাবল মুসা, ফায়ার কাছাকাছি থাকলে লাফ দিয়ে গিয়ে এখন ওর পিঠে চড়ে বসতে পারত।

পার্কের মধ্যে এক জায়গায় ছুটাছুটি করে খেলছে বাচ্চারা। তাদের কাছে দৌড়ে এসে একটা স্লিপারের আড়ালে বসে পড়ল মুসা। আশা করল তাকে দেখতে পাবে না মহিলা।

কৌতূহলী দৃষ্টিতে তার দিকে তাকাতে লাগল কয়েকটা ছেলেমেয়ে। ওদের দিকে তাকিয়ে হাসল সে। ঠোঁটে আঙুল রেখে চুপ থাকতে ইশারা করল। আস্তে করে মাথা বের করে গেটের দিকে তাকিয়ে দেখল দ্বিধান্বিত হয়ে দাঁড়িয়ে আছে মহিলা। কয়েকটা অস্বস্তিকর মুহূর্ত। তারপর ঘুরে দাঁড়িয়ে যেদিক থেকে এসেছিল আবার সেদিকে হেঁটে চলল মহিলা।

হাপ ছাড়ল মুসা।

আরও কয়েক সেকেন্ড অপেক্ষা করে উঠে দাঁড়াল। রুমাল বের করে মুখের ঘাম মুহল। এদিক ওদিক তাকাতে লাগল। তাকে ঘিরে ভিড় জমাতে শুরু করেছে বাচ্চারা। একটু আগে যেটা স্বস্তির কারণ হত, সেটা এখন বিরাট অস্বস্তি। তাড়াতাড়ি হাঁটতে শুরু করল উল্টোদিকের গেটের দিকে। প্রথমে জানতে হবে কোন জায়গায় তাকে নিয়ে এলেছে শাজিন, তারপর যেতে হবে। ফায়ারকে আনতে।

 পার্ক থেকে বেরোতে গেটের ওপরের লেখা দেখে জানতে পারল, জায়গাটার নাম অগাস্টভিল।

ম্যানিলা রোডে পৌঁছে বনের ভেতর থেকে ফায়ারকে নিয়ে বেরিয়ে আসার সময় আরেক ঘটনা ঘটল। ঝোপের ভেতর থেকে হঠাৎ করে সামনে এসে দাঁড়াল সেই লোকটা, দূরবীন হাতে যাকে সেদিন সেভারনদের বাড়ির ওপর নজর রাখতে দেখা গিয়েছিল। এমন করে বেরোল, চমকে দিল ঘোড়াটাকে, ঘাবড়ে গিয়ে উধ্বশ্বাসে দৌড়াতে শুরু করল ওটা। কয়েকবার, পিঠ থেকে পড়তে পড়তে বাঁচল মুসা।

.

১২.

সকালবেলা এত কিছু করে ফিরে আসার পর সেদিন আর সেভারনদের বাড়িতে যেতে ইচ্ছে করল না তার। রবিনও কাজে ব্যস্ত, ফোনে কিশোরকে জানিয়ে দিল, সে-ও যেতে পারবে না।

বিকেল বেলা ইয়ার্ডে এসে সকালের সমস্ত ঘটনার কথা কিশোরকে খুলে বলল মুসা।

শনিবার সকালে নাস্তা সেরেই সেভারনদের বাড়িতে রওনা হলো তিন গোয়েন্দা। আগের দিন বিকেলে ফোনে যোগাযোগ করার অনেক চেষ্টা করেছে কিশোর। লাইন না পেয়ে শেষে অপারেটরকে জিজ্ঞেস করে জেনেছে, তাঁদের ফোন নষ্ট।

আজ নিশ্চয় মেরামত করে ফেলবে, সাইকেল চালাতে চালাতে দুই সহকারীকে বলল কিশোর।

কটেজে পৌঁছে দরজায় বার বার টোকা দিয়েও কোন সাড়া পেল না।

মিসেস সেভারন! চিৎকার করে ডাকল কিশোর। সিঁড়ির গোড়ায় পড়ে থাকতে দেখল দুধের দুটো খালি বোতল। একটাতে একটা ভাজ করা কাগজ রবারের ব্যান্ড দিয়ে আটকানো। জানালার দিকে তাকিয়ে আবার চিৎকার করে বলল সে, মিসেস সেভারন, আমি কিশোর!

কান পেতে অপেক্ষা করতে লাগল।

কই, কেউ তো জবাব দিচ্ছে না, মুসাও মোরগের মত ঘাড় বাকা করে কান পেতে রেখেছে।

ঘুম থেকে ওঠেননি হয়তো এখনও, হাতঘড়ি দেখল রবিন। এখনও অনেক সকাল। বেশি তাড়াতাড়ি চলে এসেছি।

দরজার সামনে দাঁড়িয়ে রইল তিনজনে। কি করবে বুঝতে পারছে না। গাড়ি নিয়ে হাজির হলো দুধওয়ালা। গাড়ি থেকে নেমে দুধের বোতলের খাঁচা হাতে শিস দিতে দিতে এগোল কটেজের দিকে।

হাই, তার দিকে তাকিয়ে বলল কিশোর।

হাই, কাছে এসে দাঁড়াল দুধওয়ালা। কৌতূহলী চোখে তিন গোয়েন্দার দিকে তাকাতে তাকাতে বলল, দেখা করতে এলে নাকি?

মাথা ঝাঁকাল কিশোর। দরজায় ধাক্কা দিচ্ছি, খুলছেন না।

এতক্ষণে তো রোজ উঠে পড়েন ঘুম থেকে। আরও জোরে ধাক্কা দাও। খাঁচাটা নামিয়ে রেখে খালি বোতলের গায়ে আটকানো কাগজটা খুলে নিয়ে পড়ল দুধওয়ালা। এক লিটার বেশি দিতে বলেছেন। আনমনে বিড়বিড় করল, মেহমান এসেছে নাকি! কখনোই তো আসে না। খাঁচা থেকে তিনটা বোতল বের করে সিঁড়িতে রাখল সে। খালি বোতল দুটো তুলে খাঁচার খোপে রাখল। কি মনে করে লেটার-বক্সটার দিকে তাকাল। খবরের কাগজটা নেই। তারমানে উঠে পড়েছেন তারা। গোয়েন্দাদের দিকে তাকিয়ে বলল, তোমাদের ডাক শুনতে পাননি। আরও জোরে ধাক্কা দাও। খাঁচাটা তুলে নিয়ে আবার শিস দিতে দিতে চলে গেল সে।

দাঁড়াও, মুসা বলল, পেছনে গিয়ে দেখে আসি বাগানে বেরোলেন কিনা।

বাড়ির পাশ ঘুরে এসে এগোতে এগোতে থমকে দাঁড়াল মুসা। বাড়ির ভেতর থেকে কথা কানে এসেছে। এত সকালে টিভি অন করে দিয়ে বসে আছেন নাকি? সেজন্যে ওদের ডাক শুনতে পাননি?

সামার-হাউসের দরজা খোলা। ওখানে নেই তো মিস্টার সেভারন? উঁকি দিয়ে দেখতে গেল।

কিন্তু সামার-হাউসটা খালি। জোরে নিঃশ্বাস ফেলল মুসা। ফিরে যাওয়ার জন্যে ঘুরতে গিয়েও ফিরে তাকাল আবার। কোথায় যেন অস্বাভাবিক কিছু রয়েছে। কোনটা অস্বাভাবিক লেগেছে, ধরতে সময় লাগল না। কার্পেটটা বিছানো নেই মেঝেতে, আগুন নেভানোর জন্যে রাতে ওরা বের করে নিয়ে যাওয়ার পর আর বিছানো হয়নি। বাইরেই ফেলে রেখেছে। কেমন ন্যাড়া ন্যাড়া লাগছে মেঝেটা।

কি ভেবে দরজাটা ঠেলে আরও ফাঁক করল সে। পুরানো কাঠের বাক্স আর জঞ্জালের গন্ধ। আপেল রাখার পুরানো কয়েকটা কাঠের বাক্স ফেলে রাখা। হয়েছে দেয়াল ঘেঁষে, আর গোটা দুই ভাঙা ডেকচেয়ার। ভুরু কুঁচকে জিনিসগুলোর দিকে তাকাতে লাগল সে।

ট্র্যাপ-ডোরটা চোখে পড়তে দম বন্ধ করে ফেলল। তাকিয়ে রইল স্থির দৃষ্টিতে। আগের বার যখন এসেছিল, কাঠের মেঝে ঢাকা ছিল কার্পেটটা দিয়ে। সেজন্যে দেখা যায়নি ওটা।

আচমকা ঘুরে দাঁড়িয়ে লাফ দিয়ে নামল বাগানে। উত্তেজনায় কাঁপছে। খবরটা বন্ধুদের জানানোর জন্যে ছুটল।

.

সামার-হাউসে ঢুকে দীর্ঘ একটা মুহূর্ত ট্র্যাপ-ডোরটার দিকে তাকিয়ে রইল তিনজনে।

কোথায় নেমেছে? বলে হাটু মুড়ে ওটার সামনে বসে পড়ল রবিন। চার হাত-পায়ে ভর দিয়ে ঝুঁকে তাকাল নিচের দিকে। মেঝে আর ট্র্যাপ-ডোরের মাঝের ফাঁকে আঙুল ঢোকানোর চেষ্টা করল। না পেরে বলল, কিছু একটা দরকার। চাড় মেরে তুলতে হবে।

ও, ভুলে গিয়েছিলাম, মুসা বলল, কটেজের মধ্যে কথার আওয়াজও শুনেছি। হয় টিভি চালানো হয়েছে, নয়তো কথা বলেছেন সেভারনরাই। বেশি ভেতরের দিকে রয়েছেন, নিজেদের মধ্যে আলাপে ব্যস্ত, সেজন্যেই আমাদের ডাক শুনতে পাননি।

কিংবা হয়তো ইচ্ছে করেই খুলছেন না কোন কারণে।

ঘরের চারদিকে তাকাচ্ছে কিশোর। একটা বাক্সের নিচে ডাল ছাঁটার পুরানো মরচে পড়া বড় একটা কাচি দেখে বের করে নিল সেটা। রবিনের পাশে গিয়ে বসল চাড় মেরে ট্র্যাপ-ডোরটা তুলতে ওকে সাহায্য করার জন্যে।

নড়ে উঠল ডোরটা। চাপ বহাল রেখে বলল কিশোর, উঠে যাবে। চাপ ছেড়ো না। আরও জোরে।

ক্যাঁচকোঁচ করে উঠল কজা। বিচিত্র শব্দে গোঙাল পাল্লাটা। হঠাৎ ওপরে উঠে গেল। চিত হয়ে পড়ে গেল কিশোর।

হেসে উঠল মুসা।

কিশোরও হাসল। উঠে বসে কাপড় থেকে ধুলো ঝাড়তে লাগল।

রবিন কাশছে। গর্তের চারপাশে জমে থাকা ধুলো উড়ছে। নাকে ঢুকে গেছে তার।

 দরজার বাইরে তাকিয়ে দেখল কিশোর, কেউ আসছে কিনা। প্রচুর হই চই হচ্ছে। হট্টগোল কানে গেলে দেখতে আসতে পারে।

গর্তের ভেতরে উঁকি দিল মুসা। বদ্ধ বাতাসের ভাপসা গন্ধ লাগল নাকে।

 কিছুই তো দেখা যাচ্ছে না, বলল সে। টর্চ আছে?

দিনের বেলা, তাই টর্চ আনার কথা ভাবিইনি, জবাব দিল কিশোর।

ছাউনিটাতে আছে কিনা দেখে আসি, বলে উঠে চলে গেল রবিন। ফিরে বেএসে জানাল, টর্চ নেই, তবে ম্যাচ পেয়েছি। এই যে।

বাক্সটা হাতে নিয়ে ঝাঁকি দিল কিশোর। ভরা নয়, অল্প কয়েকটা কাঠি। খস করে একটা কাঠি জ্বেলে জ্বলন্ত কাঠি সহ হাতটা নামিয়ে দিল নিচে।

ইটের তৈরি একটা সিঁড়ি নেমে গেছে।

কিশোরকে অবাক করে দিয়ে এক ঝলক ঠাণ্ডা বাতাস এসে ঝাঁপটা মেরে নিভিয়ে দিল আগুনটা। দুই সহকারীর দিকে ফিরল সে। সিঁড়ি আছে যখন, নামা যায়, কি বলো?

ভূতের ভয় থাকা সত্ত্বেও আমতা আমতা করে রাজি হয়ে গেল মুসা। রবিন তো আগেই রাজি।

সাবধানে খাড়া সিঁড়ির ধাপ বেয়ে নামতে শুরু করল ওরা। কাঠি মাত্র কয়েকটা, নিতান্ত প্রয়োজনের সময় ছাড়া জ্বালবে না ভেবে অন্ধকারেই অনুমানে নির্ভর করে নামছে কিশোর। পা ফসকাল মুসা। পড়ে যেতে যেতে কোনমতে সামলাল। গোড়ালি মচকে ফেলেছিল আরেকটু হলেই।

আরে কি করছ! চিৎকার করে উঠল কিশোর।

সরি! বিড়বিড় করল মুসা। আই কিশোর, আরেকটা কাঠি জ্বালো না। মনে তো হচ্ছে কবরের মধ্যে ঢুকেছি, বাপরে বাপ, যা অন্ধকার! কি জায়গারে এটা!

কি আর? এখানে দিনদুপুরেও ভ্যাম্পায়ারেরা ঘোরাফেরা করে, ফিসফিস করে বলল রবিন, ভয় পাওয়ার ভান করছে। আরেকটু সামনে এগোলেই হয়তো হোঁচট খাব ড্রাকুলার কফিনে…

দোহাই তোমার, রবিন, তেনাদের নিয়ে হেলাফেলা কোরো না…! কেঁপে উঠল মুসার গলা।

আরেকটা কাঠি জ্বালল কিশোর। নিচু ছাত। সাদা রঙ করা দেয়ালের বহু জায়গায় প্লাস্টার খসে গেছে, ছাতলা পড়া। আরেক ঝলক ঠাণ্ডা বাতাস এসে লাগল। গায়ে কাঁটা দিল কিশোরের। আগুন দেখে জাল বেয়ে তাড়াহুড়া করে সরে যেতে লাগল একটা মাকড়সা। আলোটা নিভে যাওয়ার আগের মুহূর্তে চোখে পড়ল ওদের, একদিকের দেয়াল ঘেঁষে দাঁড় করানো একটা ওয়াইন র‍্যাক, আরেক দিকে সম্ভবত কয়লার স্তূপ। সিঁড়িও আছে আরেকটা।

এটাই বোধহয় সেই সেলার, মুসা বলল, মিস্টার সেভারন যেটার কথা বলেছিলেন।

 আমি যে পুরানো প্ল্যানটা কপি করে এনেছি, রবিন বলল, তাতেও আছে। এটা।

 আরেকটা কাঠি জ্বালল কিশোর। দেখতে দেখতে বলল, জায়গাটা যেন কেমন। গা ছমছম করে, তাই না?

তুমিও বলছ এ কথা! জোরে বলতে ভয় পাচ্ছে মুসা। দেখা তো হলো? চলো, যাইগে…

আস্তে! থামিয়ে দিল ওকে কিশোর। কথা বলে কারা?

 মাথার ওপর থেকে আসছে চাপা কথার শব্দ।

মিস্টার সেভারন নাকি? বিড়বিড় করে নিজেকেই যেন প্রশ্ন করল কিশোর।

নিজেরা দুজন ছাড়াও আরও কেউ আছে, রবিন বলল। কে?

মিসেস ড্রাকুলা চলে আসেনি তো সাতসকালে উঠে? মুসার প্রশ্ন।

দম বন্ধ করে, কান পেতে শুনতে লাগল তিনজনে। পাথরের মেঝেতে চেয়ারের পায়া ঘষার শব্দ শুনে বুঝল রান্নাঘরটা ওদের ওপরে কোথাও রয়েছে। কথা শোনা যাচ্ছে ওঘর থেকেই।

আরেকটা সিঁড়ি যে দেখলাম, সেটা দিয়ে উঠে দেখা যেতে পারে কোথায় উঠলাম, প্রস্তাব দিল কিশোর।

এখানে দাঁড়িয়ে থাকার চেয়ে সেটা বরং ভাল, সঙ্গে সঙ্গে বলল মুসা।

এখান থেকে পালাতে পারলে বাঁচে। তর সইছে না মুসার। আগে আগে উঠতে শুরু করল সে। তার পেছনে থেকে কাঠি জ্বেলে সামনের দিকে বাড়িয়ে ধরে রাখল কিশোর। সবার পেছনে রবিন।

সিঁড়ির মাথায় উঠে আরেকটা কাঠি জ্বালল কিশোর। ট্র্যাপ-ডোর দেখা গেল এখানেও।

এটা কি? ডোরের ফাঁক দিয়ে বেরিয়ে থাকা একটা জিনিস ধরে টান দিল রবিন। বের করে আনল।

কাঠির আলোয় দেখতে দেখতে বলল কিশোর, কাপড়। পোশাক থেকে ছিড়ে গেছে। দেখো, কি রকম পাতলা, ফিনফিনে…

শিউরে উঠল মুসা, খাইছে! তারমানে মিসেস সেভারন ভুল দেখেননি, সত্যি সত্যি ভূত আছে…

ফালতু কথা বাদ দিয়ে ঠেলা দাও, কিশোর বলল।

আরও দুই ধাপ উঠে ঘাড় বাঁকা করে, কাঁধ ঠেকিয়ে ঠেলতে আরম্ভ করল মুসা। নড়াতে পারল না পাল্লাটা। তাকে সাহায্য করল রবিন আর কিশোর। ফাঁক হতে শুরু করল পাল্লা। ঠিক এই সময় পা ফসকাল রবিনের। ছোট্ট একটা চিৎকার বেরিয়ে এল মুখ থেকে। গড়িয়ে পড়তে শুরু করল।

তাড়াতাড়ি নেমে এসে তাকে ধরে তুলল মুসা। ব্যথা পেয়েছ?

সিঁড়ি থেকে পড়লে ব্যথা আর না পায় কে! তিক্তকণ্ঠে জবাব দিল রবিন। তবে তেমন কিছু না।

এই, দেখে যাও, ফিসফিস করে ডাকল কিশোর। জলদি এসো!

ডালা আরও ফাঁক করে ফেলেছে সে। সেই ফাঁক দিয়ে চোখে পড়ছে লাল রঙের একটা জিনিস।

কার্পেটের কিনারটা না? দেখে বলল রবিন। ভূতের ঘরের নিচে রয়েছি। আমরা, কোন সন্দেহ নেই।

তারমানে জোয়ালিনের প্রেমিক চুরি করে এখান দিয়েই ঢুকত, মুসা বলল।

হয়তো, কিশোর বলল। পুরানো বাড়িটা তখন ছিল এখানে। সেলার থেকে সরাসরি এদিক দিয়েই ডাইনিং রূমে মদ নিয়ে যেত চাকর-বাকরেরা।

হ্যাঁ, রবিন বলল। সামার-হাউসের ভেতর দিয়ে এসে চোরও ঢুকেছিল সেদিন এপথেই।

দুই ধাপ নেমে এসে ডালাটা ছেড়ে দিল কিশোর। কিন্তু এটা যে আছে এখানে, জানল কি করে সে? জানার তো কথা নয়। সব সময় কার্পেটে ঢাকা থাকে।

 নিশ্চয় পুরানো প্ল্যানটা থেকে। আমি যেটা কপি করে এনেছি। শাজিনের তো জানাই আছে। যে লোকটাকে পাঠিয়েছে নকশা দেখিয়ে তাকে বুঝিয়ে দিয়েছে কোনখান দিয়ে ঢুকতে হবে…

আর সেজন্যেই, কিশোর বলল, কার্পেটটা অমন অগোছাল হয়ে ছিল। মিসেস সেভারন জানতেন পেরেক দিয়ে আটকানো ছিল..ঠিকই জানতেন; তার তো আর জানার কথা নয়, তথাকথিত ভূতটা সিঁড়ি বেয়ে উঠে এসে নিচ থেকে ঠেলে ট্র্যাপ-ডোর খুলেছে, ওপরে বিছানো কার্পেটটাও পেরেক থেকে ছুটে গেছে ঠেলা লেগে।

চমৎকার! ভূত রহস্যের সমাধান হয়ে গেল। চলো, সেভারনদের জানাইগে।

এদিক দিয়েই যাব?

দরকার কি ঠেলাঠেলি করার।

 সামার-হাউস দিয়ে আবার বাইরে বেরোল ওরা। উজ্জ্বল রোদে চোখ ধাধিয়ে গেল।

বাড়ির পাশ ঘুরে আসার আগেই একটা গাড়ির দরজা লাগানোর শব্দ হলো। স্টার্ট নিল এঞ্জিন। দৌড় দিল কিশোর। বাড়ির সামনের দিকটায় পৌঁছে দেখল মিস্টার সেভারনের গাড়িটা বেরিয়ে যাচ্ছে গেট দিয়ে।

কার সঙ্গে গেলেন? অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে মুসা।

ভ্রুকুটি করল কিশোর। গাল চুলকাল, সেটাই তো বুঝতে পারছি না…এমন কে এল, সাতসকালে বের করে নিয়ে যেতে পারল তাকে? গাড়িটাও নিশ্চয় ড্রাইভ করছে ওই লোকই।

আচ্ছা… কিশোরের মুখের দিকে তাকিয়ে থেমে গেল রবিন। চোখ বড় বড় হয়ে গেছে।

কি বলতে চাও?

মিসেস ড্রাকুলা লোক পাঠিয়ে কিডন্যাপ করাল না তো?

তা কি করে হয়… বলতে গেল মুসা।

কিন্তু সচকিত হয়ে উঠেছে কিশোর। জলদি এসো! মিসেস সেভারনের কি অবস্থা করেছে কে জানে!

জোরে জোরে সামনের দরজা ধাক্কাতে শুরু করল কিশোর।

তাকে অবাক করে দিয়ে খুলে গেল দরজাটা।

মিসেস সেভারনও অবাক, তোমরা! এই সাতসকালে তোমরা কোত্থেকে?

অনেক আগেই এসেছি আমরা, জবাব দিল কিশোর। কিন্তু আপনার স্বামী কোথায় গেলেন?

অস্বস্তি দেখা দিল মিসেস সেভারনের চোখে। গেছে..! দুধের বোতলগুলো তুলে নিলেন তিনি। এসো, ভেতরে এসো। তোমাদের এই ছিরি কেন? নর্দমায় নেমেছিলে নাকি?

নর্দমায় না, সেলারে। রাস্তার দিকে ফিরে তাকাল কিশোর। কার সঙ্গে গেলেন মিস্টার সেভারন? মিসেস সেভারন বলতে চাইছেন না কেন? তবে একটা ব্যাপারে নিশ্চিন্ত হওয়া গেল, কিডন্যাপ করা হয়নি সেভারনকে।

আবার মিসেস সেভারনের দিকে ঘুরল সে। কাল রাতে ফোন করার অনেক চেষ্টা করেছি। নষ্ট নাকি?

মাথা ঝাঁকালেন মিসেস সেভারন। হ্যাঁ। আজ ঠিক করে দেবে বলেছে।

.

সামার-হাউস দিয়ে ঢুকে কি পাওয়া গেছে শুনে স্তম্ভিত হয়ে গেলেন মিসেস সেভারন। বললেন, কিছুই জানতাম না আমরা। জানবই বা কি করে? কার্পেটটা কি কখনও তুলেছি।

এ বাড়ির পুরানো প্ল্যানটাও দেখেননি?

না। এ সব কাজ জ্যাকিই করত।

কিন্তু আসল দলিলগুলো নিশ্চয় আছে আপনাদের কাছে। সেদিন সেই। লোকটা ওগুলোই নিতে এসেছিল।

বোধহয় আছে। অনেক পুরানো কিছু দলিল নিয়ে ঘাঁটাঘাঁটি করতে দেখেছি জ্যাকিকে। বলত, এখানকার পুরানো ইতিহাস জানার চেষ্টা করছে। তবে সবই…সবই…. ওই ভয়ঙ্কর মেয়েমানুষটা এসে জ্বালানো শুরু করার আগে।

বার বার দেয়ালের ঘড়িটার দিকে তাকাচ্ছেন তিনি। চেহারায় উদ্বেগের ছাপ। ব্যাপারটা লক্ষ করল কিশোর। বৃদ্ধার দিকে ঝুঁকে বলল, আপনি সত্যি বলছেন মিসেস সেভারন, আপনার স্বামী কোন বিপদে পড়েননি?

লম্বা করে শ্বাস টানলেন মিসেস সেভারন। এবারেও জবাব দিলেন না কিশোরের প্রশ্নের। বড় চিন্তা হচ্ছে…হুট করে এভাবে চলে গেল…আবার না কোন বিপদে জড়ায়…

কোথায় গেলেন?

 মেয়েলোকটার অফিসে… বলেই চুপ হয়ে গেলেন মিসেস সেভারন। নাহ তোমাদের এ ভাবে বলে দেয়াটা ঠিক হচ্ছে না…

মিসেস শাজিনের অফিসে! কেন?

বিরক্তর চূড়ান্ত হয়ে গেছে। কত আর সহ্য করবে। আজ একটা হেস্তনেস্ত না করে ছাড়বে না বলেছে। দরকার হয় পুলিশের কাছেই যাবে। ওরা বিশ্বাস করবে না বলেই এতদিন যায়নি। …সহ্যের সীমা ছাড়িয়েছে ওই শয়তান বেটিটার অত্যাচার।

রুমাল বের করে নাক ঝাড়লেন মিসেস সেভারন। ওদের যেতে নিষেধ ন্ট করেছিলাম, কিন্তু পারলাম না। পুলিশ আগেও বিশ্বাস করেনি। আমাদের কথা, এখনও করবে না। শুধু শুধু আমাদের ছেলেটাকে… কান্নায় বুজে এল তাঁর কণ্ঠ।

ওদের মানে? আর কে আছেন মিস্টার সেভারনের সঙ্গে?

কিছুক্ষণ থেকেই ভারী একটা ইঞ্জিনের শব্দ কানে আসছিল। জোরাল হলো সেটা। উঠে দেখতে গেল মুসা। জানালার পর্দা সরিয়ে দেখেই চিৎকার করে উঠল, কিশোর, জলদি এসো!

দৌড়ে গেল রবিন। কিশোর গেল তার পেছনে।

গেটের বাইরে এসে দাঁড়িয়েছে একটা দৈত্যাকার জেসিবি ডিগার। ইচ্ছে করে ইঞ্জিনটাকে প্রচণ্ড গো-গো করাচ্ছে ড্রাইভার। এগজস্ট দিয়ে ভলকে ভলকে বেরোচ্ছে কালো ধোয়া। নীরব রাস্তাটার নীরবতা ভেঙে চুরমার করার বিকৃত আনন্দে মেতেছে যেন।

বার কয়েক গো-গোঁ করিয়ে ইঞ্জিনের গর্জন কমাল ডাইভার। পকেট থেকে একটা কাগজ বের করে তাকিয়ে রইল কয়েক সেকেন্ড। ঠিকানা ঠিক আছে কিনা দেখল বোধহয়। তারপর পিছাতে শুরু করল বিশাল যন্ত্রটাকে। কিছুদূর পিছিয়ে গিয়ে নাক ঘুরাল কটেজের দিকে। ধীরে ধীরে এগোতে শুরু করল।

খাইছে! বলে উঠল মুসা।

উদ্দেশ্যটা কি ওর বুঝতে পারলেও বিশ্বাস করতে পারছে না রবিন।

দেখছ না, ভাঙতে আসছে! গেট, বেড়া সব ভেঙে ঢুকে পড়বে বাগানে…

ঠেকানো দরকার ওকে! চেঁচিয়ে উঠল কিশোর। সচল হলো হঠাৎ। দরজার দিকে দৌড় দিল।

.

১৩.

 কামানের গোলার মত সামনের দরজা দিয়ে ছিটকে বেরোল যেন তিন। গোয়েন্দা। হাত নাড়তে নাড়তে গেটের দিকে ছুটল।

এই, থামুন, থামুন!

কিন্তু ওদের চিৎকার কানেই গেল না যেন ড্রাইভারের।

সামনের দরজায় এসে দাঁড়ালেন মিসেস সেভারন। মুখে হাতচাপা দিয়েছেন। সম্মোহিতের মত তাকিয়ে আছেন দানবটার দিকে। হঠাৎ মুখ থেকে বেরিয়ে এল ছোট্ট চিৎকার। বুড়ো পা দুটো যেন আর ধরে রাখতে পারল না। শরীরটাকে। হাঁটু ভাজ হয়ে বসে গেলেন দরজার গোড়ায়।

দৌড়ে ফিরে গেল তিন গোয়েন্দা। হাত ধরে টেনে সরাল তাঁকে। দরজার ফ্রেমে পিঠ লাগিয়ে যতটা সম্ভব আরাম করে বসিয়ে দিল।

মিসেস সেভারন, কি হয়েছে আপনার? উদ্বিগ্ন স্বরে জানতে চাইল রবিন।

ঘন ঘন কয়েকবার ভারী দম নিলেন মিসেস সেভারন। না না, আমার কিছু হয়নি।

শোবেন নাকি? নিয়ে যাব ভেতরে?

না, আমি এখানেই থাকব।

ওদিকে প্রচণ্ড গর্জন তুলে বেড়ার কাছে চলে এসেছে ডিগারটা। বেড়া ভাঙতে প্রস্তুত।

সত্যি সত্যি ভাঙবে! এখনও বিশ্বাস করতে পারছে না মুসা। পাগল হয়ে গেছে! না হুমকি দিয়ে ভয় দেখানোর চেষ্টা করছে?

ও শয়তান মহিলাটার লোক হয়ে থাকলে, কিশোর বলল, সত্যিই ভাঙবে।

হাত নাড়তে নাড়তে আবার ছুটল সে। ড্রাইভারের চোখে পড়ল। ইঞ্জিন বন্ধ করে দিয়ে নেমে এল লোকটা। চিৎকার করে বলল, কি ব্যাপার? চাপা পড়ে মরার ইচ্ছে হলো নাকি?

জবাব না দিয়ে রাগত স্বরে প্রশ্ন করল কিশোর, আপনি কি করছেন?

দেখে বুঝতে পারছ না? মাথার হলুদ সেফটি হেলমেটটা ঠেলে পেছনে সরাল ড্রাইভার।

বুঝতে তো যা পারছি, বাগানটার সর্বনাশ করার ইচ্ছে হয়েছে আপনার।

 কিশোরের পাশে এসে দাঁড়াল মুসা আর রবিন।

ওদের দিকে একবার করে তাকিয়ে আবার কিশোরের দিকে নজর ফেরাল লোকটা, বুঝলেই ভাল। ঘুরে আবার ক্যাবে উঠতে গেল।

দৌড়ে এসে তার হাত চেপে ধরল কিশোর। কে করতে বলেছে আপনাকে?

যে-ই হোক, বলেছে। অর্ডার।

কে দিয়েছে, সেটাই তো জানতে চাইছি।

ওভারঅলের পকেট থেকে একটা কাগজ বের করল লোকটা। লোকাল কাউন্সিল।

দেখি তো? কাগজটা প্রায় ছিনিয়ে নিল কিশোর।

 মুসা আর রবিনও দেখার জন্যে পাশে সরে এল।

কাগজটা রাস্তা বাড়ানোর পার্মিট। রাস্তা চওড়া করার অনুমতি রয়েছে। তাতে।

এ কথা তো নতুন শুনলাম, মুসা বলল লোকটার দিকে তাকিয়ে। যাদের বাড়ি তাদের আগে জানানো হয়নি কেন?

জানাবে কি করে? ব্যঙ্গ করে বলল কিশোর। ভুয়া কাণ্ড তো! সেই ড্রাকুলা বেটির কাজ; দেখছ না, ভাঙা টাইপরাইটার, ও অক্ষরটা ক্যাপিটল লেটারে।

তাই তো!

এ সব ধাপ্পাবাজি ছাড়ন! কাগজটা লোকটার হাতে ফিরিয়ে দিতে দিতে বলল কিশোর। বিদেয় হোন এখান থেকে!

তাই নাকি? রাগল না লোকটা। কার হুকুমে?

হুকুমের কথা বলা হচ্ছে না। কাউন্সিলের বাপেরও সাধ্য নেই জায়গার মালিকের সঙ্গে কথা না বলে, তার অনুমতি না নিয়ে রাস্তা বাড়ানোর হুকুম দেয়।

ওসব আমার জানার দরকার নেই। আমাকে লিখিত অর্ডার দিয়েছে, পালন করতে আমি বাধ্য। তোমার মত একটা ছেলেমানুষের কথায় ফিরে যাব আমি ভাবলে কি করে?

ছেলেমানুষ কাকে বলছেন! রেগে উঠল মুসা।

হাত তুলে তাকে থামার ইঙ্গিত করে কিছুটা নরম হয়ে বলল কিশোর, ব্যাপারটা যে ধাপ্পাবাজি, আমি প্রমাণ করে দিতে পারি। যদি একটু সময় দেন।

পকেটে কাগজটা রেখে মাথা নাড়ল ড্রাইভার, সরি। আমার কাজ আমাকে করতেই হবে। এদিকের বেড়া আর গাছগুলোর আশা ছাড়ো, ক্যাবে উঠে ইঞ্জিন স্টার্ট দিল। সামনের দিকে একটা লিভার ঠেলে দিতেই বেড়ে গেল ইঞ্জিনের শব্দ।

কিশোর, ওকে থামানো দরকার! চিৎকার করে উঠল মুসা।

মাঝখানে দাঁড়িয়ে দুদিক থেকে দুজনের হাত চেপে ধরল রবিন। এসো, সামনে গিয়ে দাঁড়াই। দেখি, আমাদের মাড়িয়ে বেড়া ভাঙতে আসে কি করে।

গেটের বাইরে এসে বেড়ার সামনে হাত ধরাধরি করে দাঁড়িয়ে গেল ওরা।

পাশে ঝুঁকে মাথা বের করল ড্রাইভার, কি হলো, সরো! আরেকটা লিভার ঠেলে দিল সে। ধীরে ধীরে এগোতে শুরু করল ডিগার।

খাইছে! ঢোক গিলল মুসা। সত্যি সত্যি চাপা দেবে নাকি?

 ঠায় দাঁড়িয়ে থেকে মাথা নাড়ল কিশোর, এত সাহস হবে না।

দেখতে দেখতে যন্ত্রটা এত কাছে চলে এল, ওটার বনেটের মরচেগুলোও দেখতে পাচ্ছে ওরা। চোখ বন্ধ করে ফেলল কিশোর। কিন্তু জায়গা ছেড়ে নড়ল না। হাতের চাপ বাড়াল দুই বন্ধুর হাতে। ওরাও চাপ দিল একাত্মতা ঘোষণা করে।

বন্ধ হয়ে গেল ইঞ্জিন। আচমকা নীরবতা নেমে এল রাস্তা জুড়ে। চোখ মেলে দেখল কিশোর, ক্যাব থেকে নেমে আসছে ড্রাইভার। চোখমুখ ভয়ঙ্কর করে এগিয়ে এল ওদের দিকে।

সরো! রবিনের হাত চেপে ধরে হ্যাঁচকা টানে সরানোর চেষ্টা করল সে। মরতে চাও নাকি?

দেখুন, অনুরোধের সুরে বলল কিশোর, আমাদের কথা বিশ্বাস করুন, পুরো ব্যাপারটাই ধাপ্পাবাজি। নইলে কি আর এভাবে মেশিনের সামনে দাঁড়াতাম আমরা আমাদের প্রাণের ভয় নেই?

সেটাই তো বুঝতে পারছি না!

ইতিমধ্যে হই-হট্টগোল শুনে কি হয়েছে দেখার জন্যে বেরিয়ে আসতে শুরু করেছে সেভারনদের পড়শীরা।

শোনার পর একজন বলল, ঠিকই তো বলছে ছেলেগুলো। আপনি জোর করে ভাঙতে এসেছেন কেন? কে হুকুম দিল আপনাকে?

দ্বিধায় পড়ে গেছে ড্রাইভার। বলল, কাউন্সিল। আমার বস্ ডেকে বলল, ওপর থেকে ভাঙার নির্দেশ এসেছে। আমাকে পাঠাল ভাঙতে।

 ভাঙতে বললে ভাঙুন, আমরা তো মানা করছি না, কিশোর বলল। কিন্তু বলছি একটু সময় দিতে, যাতে আমরা প্রমাণ করে দিতে পারি আপনারা ভুল করছেন।

হাতঘড়ি দেখল ড্রাইভার। আমি পারব না। এখান থেকে সেরে গিয়ে আরেকটা কাজ করতে হবে। সময় নেই।

তাহলে ওখানের কাজটাই আগে সেরে আসুন না?

মাথা নাড়ল লোকটা, সরি। এটাই আগে করার হুকুম দিয়েছে।

 প্লীজ! অনুরোধ করল রবিন, আধঘণ্টা সময় দিন। তাতেই হয়ে যাবে।

হেলমেটটা খুলে মাথা চুলকাল ড্রাইভার। জোরে নিঃশ্বাস ফেলল। বেশ, দিলাম আধঘণ্টা, যাও। ততক্ষণে চা-নাস্তা খেয়ে নিই আমি। সকালে খবরের কাগজটাতেও চোখ বোলানো হয়নি। মনে থাকে যেন, আধঘণ্টা। তারপর আর সময় পাবে না…

আবার ক্যাবে উঠে গেল সে। লাঞ্চবক্স আর ফ্লাস্ক বের করল।

 একটা মুহূর্ত আর দেরি করল না কিশোর। দুই সহকারীকে আসতে বলে ছুটল।

দরজার সামনেই বসে আছেন মিসেস সেভারন। ফ্যাকাসে চেহারা। গায়ের কাঁপুনি যায়নি।

কি বলল ও? জানতে চাইলেন তিনি।

ওরা নাকি রাস্তা বাড়ানোর পরিকল্পনা করেছে, কিশোর বলল, আপনাদের বাগানের সামনের অংশটা যাবে।

ঝট করে হাত উঠে গেল মিসেস সেভারনের হাঁ হয়ে যাওয়া মুখে।

ভাববেন না, তাড়াতাড়ি তাকে আশ্বস্ত করতে চাইল কিশোর, আমরা জানি, এগুলো সব অগাস্ট শাজিনের শয়তানি। প্রমাণ জোগাড় করতে যাচ্ছি আমরা।

কিন্তু…

পরে বলব সব, এখন সময় নেই। আপনাকে শুধু বলে যাচ্ছি, চিন্তা করবেন না। এই, এসো তোমরা।

সাইকেল নিয়ে রাস্তায় বেরিয়ে এল ওরা। সাঁ সাঁ করে ছুটল। আধঘণ্টা সময়ও নেই হাতে। এর মধ্যে ওল্ড প্যাসিফিক স্ট্রীটে শাজিনের অফিসে যেতে হবে, প্রমাণ জোগাড় করে ফিরতে হবে আবার ম্যানিলা রোডে। অসম্ভব মনে হচ্ছে।

কিছুদূর এগিয়ে হঠাৎ খেয়াল করল কিশোর, রবিন নেই ওদের সঙ্গে। ফিরে চেয়ে দেখল অনেক পেছনে পড়েছে সে। তাড়াতাড়ি আসার জন্যে হাত নেড়ে ইশারা করে আবার সামনে তাকাল কিশোর।

পারব না! হাঁপাতে হাঁপাতে বলল মুসা, কোনমতেই পারব না এই সময়ের মধ্যে।

ফুস্ করে শব্দ হলো। কেঁপে উঠল মুসার হাত। হ্যান্ডেলটা বেয়াড়াপনা শুরু করল। সামনের চাকাটা রাস্তা থেকে নেমে গেল পথের পাশে। সামলাতে পারল না মুসা। উল্টে পড়ে গেল।

ব্রেক কষে দাঁড়িয়ে গেল কিশোর আর রবিন।

লাফ দিয়ে নেমে মুসার দিকে দৌড় দিল কিশোর, মুসা! কি হলো তোমার? ব্যথা পেয়েছ?

 কনুই ডলল মুসা। উঠে দাঁড়াল। এগিয়ে গিয়ে টান দিয়ে তুলল সাইকেলটা। সামনের চাকাটার দিকে তাকিয়ে মুখ বাঁকাল এমন করে যেন নিমফুল মুখে দিয়েছে, গেছে!

কি? জানতে চাইল কিশোর।

 পাংচার।

ঘড়ি দেখল রবিন, করবটা কি এখন?

তোমরা চলে যাও, মুসা বলল। আমি ফিরে গিয়ে মিসেস সেভারনকে পাহারা দিই।…যাও যাও, দাঁড়িয়ে থেকে সময় নষ্ট কোরো না। দুজনকে ঠেলা দিল সে। নাকি তোমাদের একজন থাকবে, আমি যাব?

মাথা নাড়ল কিশোর, না, তুমিই থাকো। আমরা যাই।

আবার সাইকেলে চাপল দুজনে। কাঁধের ওপর দিয়ে ফিরে তাকিয়ে মুসাকে বলল কিশোর, আমাদের দেরি হলে লোকটাকে ঠেকাবে, যে ভাবে পারো।

দুজনকে চলে যেতে দেখল মুসা। জোরে একটা নিঃশ্বাস ফেলে ঘুরে দাঁড়াল। চাকা বসে যাওয়া সাইকেলটাকে ঠেলে নিয়ে চলল কটেজের দিকে।

.

তীব্র গতিতে প্যাড়াল করে চলেছে কিশোর আর রবিন। বেপরোয়া। রাস্তার মোড়গুলোতেও গতি কমাচ্ছে না, জোড়গুলোতেও না। রেলওয়ে ক্রসিঙের দিকে চলেছে এখন।

গেটের দিকে এগোতে এগোতে দমে গেল। লাল আলোটা জ্বলছে নিভছে। ওয়ার্নিং বেল বাজছে। দূরে শোনা গেল ট্রেনের হুইসেল। ধীরে ধীরে বন্ধ হয়ে যেতে শুরু করল গেটটা।

বন্ধ হওয়ার আগে পেরোতে পারব? রবিনের প্রশ্ন।

না, ব্রেক কষে দাঁড়িয়ে গেল কিশোর। চেষ্টা করে লাভ হবে না। আমরা ন্টট্রেনে কাটা পড়ে মরলে কোন উপকার হবে না সেভারনদের।

ট্রেনটা চলে যাওয়ার অপেক্ষায় রইল দুজনে। অস্থির হয়ে বার বার ঘড়ি দেখছে রবিন।

কয়েক যুগ তো পার হয়ে গেল, গজগজ করতে লাগল সে, ট্রেন আসারও আর সময় পেল না! মুসা ঠিকই বলেছে, আধঘণ্টার মধ্যে কোনমতেই ফিরতে পারব না আমরা।

পারতেই হবে, দৃঢ়কণ্ঠে বলল কিশোর। না পারলে চলবে না!

কানফাটা শব্দ তুলে পার হয়ে গেল ট্রেন খুলে যেতে শুরু করল গেট। প্যাডালে চাপ দিল ওরা। লাইন পেরিয়ে আসতেই পেছন থেকে শোনা গেল গাড়ির হর্ন। সামান্য ভাঙা ভাঙা। পরিচিত মনে হলো কিশোরের। ফিরে তাকাতেই দুলে উঠল বুক। ইয়ার্ডের পিকআপটা। গাড়ি চালাচ্ছেন রাশেদ পাশা। পাশে বসে আছে ডন।

হাত তুলল কিশোর।

আগেই দেখতে পেয়েছেন রাশেদ পাশা। রাস্তার পাশে থামালেন।

পিকআপের পেছনে মুসাকে দেখে অবাক হলো কিশোর। কিন্তু প্রশ্ন করার সময় নেই এখন। গাড়ি থামতেই পাশে ঝুঁকে হাত বাড়িয়ে দিল মুসা, সাইকেলগুলো দাও, তুলে ফেলি।

সাইকেল দুটো তুলে রবিন আর কিশোরের উঠে বসতে মিনিটখানেকও লাগল না। পাশ দিয়ে মুখ বাড়িয়ে বলল কিশোর, চাচা, যাও। ওল্ড প্যাসিফিক স্ট্রীটের মাথায় আমাদের নামিয়ে দিলেই চলবে।

গাড়ি চলল। মুসার দিকে তাকাল কিশোর, তুমি চাচাকে পেলে কোথায়?

কাকতালীয় ঘটনা প্রচুর ঘটে পৃথিবীতে, কৃত্রিম গাম্ভীর্য দেখিয়ে দার্শনিকের ভঙ্গিতে জবাব দিল মুসা। চাকা ফুটো হওয়াতে হাজারটা গাল দিয়েছি সাইকেলটাকে। ঠেলে নিয়ে প্রায় পৌঁছে গেছি সেভারনদের বাড়ির গেটে, এই সময় পাশের আরেকটা রাস্তা থেকে বেরিয়ে পেছন থেকে আমার পাশে এসে দাঁড়াল পিকআপটা। ডন আমাকে সাইকেল ঠেলে নিয়ে যেতে দেখে রাশেদ আঙ্কেলকে বলেছে। আমার সাহায্য লাগতে পারে ভেবে তিনি দাঁড়িয়েছিলেন। তোমরা কোথায় গেছ তাঁকে জানালাম। ওল্ড প্যাসিফিক স্ট্রীটে দিয়ে আসতে অনুরোধ করলাম।

হু, একেই বলে ভাগ্য, মাথা দোলাল কিশোর। ম্যানিলা রোডের এক বাড়িতে মালের দরদাম করতে যাওয়ার কথা ছিল চাচার। তোমার চাকাটা ফুটো হলো বলেই দেখাটা হলো, নইলে এখন গাড়িটা পেতাম না।

মেঘ দেখে কেউ করিসনে ভয়, আড়ালে তার সূর্য হাসে… কিশোরের কাছ থেকে শেখা বাংলা কবিতাটা এই সুযোগে ঝেড়ে দিল রবিন।

 যে ঝরঝরে পিকআপটা নিয়ে অনেক ব্যঙ্গ আর হাসাহাসি কিশোরও করে, চাচাকে মিউজিয়ামে দিয়ে আসতে বলে, সেটাই এখন বিরাট উপকার করল। সাইকেলের চেয়ে অনেক দ্রুত পৌঁছে দিল ওল্ড স্ট্রীটের মাথায়।

চিৎকার করে চাচাকে বলল কিশোর, রাখো এখানেই।

তিন গোয়েন্দা নেমে গেলে জিজ্ঞেস করলেন রাশেদ পাশা, দাঁড়াব এখানে?

না, লাগবে না, কিশোর বলল, চলে যাও। সাইকেলগুলো নিয়ে যাও। মিস্টার সেভারনকে পেলে তাঁর গাড়িতেই ফিরতে পারবে ম্যানিলা রোডে। সাইকেলগুলো রাখলে ঝামেলা হবে তখন, তাই দিয়ে দিল।

নতুন কোন কেস নাকি তোদের?

হ্যাঁ। পরে বলব সব। যদি সফল হতে পারি কাগজেও দেখতে পাবে।

ডন নামতে চাইল। নামতে দিলেন না রাশেদ পাশা। মুখটাকে পেঁচা বানিয়ে বসে রইল সে। কিশোর ওর দিকে তাকাতেই জিভ বের করে ভেঙচি কাটল। হেসে ফেলল কিশোর। মুসা আর রবিনও হাসতে লাগল।

পিকআপটা, চলতে শুরু করার আগেই রওনা হয়ে গেল তিনজনে। ঢুকে পড়ল কানাগলিটায়, যেটাতে রয়েছে শাজিন-হ্যারিসনের অফিস।

পুরানো বিল্ডিংটার সামনে সেভারনদের সবুজ গাড়িটা দাঁড়িয়ে থাকতে দেখা গেল।

থামল কিশোর। বলল, গাড়িটা আছে, তারমানে মিস্টার সেভারন এখনও শাজিনের অফিসেই রয়েছেন।

কি করে জানলে? মুসার প্রশ্ন।

তা ছাড়া আর কোথায় থাকবেন? চল, ঢুকে পড়ি।

কিন্তু ঢুকতে গিয়ে হতাশ হতে হলো। বিল্ডিঙে ঢোকার মূল দরজাটা বন্ধ। ঠেলা দিয়ে দেখল রবিন। নব ধরে মোচড় দিল। ভেতর থেকে তালা লাগানো।

তালা দেয়া! কিশোরের দিকে তাকাল সে, কি করা যায়?

আর কোন পথ নেই?

না। কিন্তু মিস্টার সেভারন ঢুকলেন কিভাবে?

কি করে বলব? পাল্লায় কাঁধ লাগিয়ে ধাক্কা দিতে শুরু করল কিশোর। হাল ছেড়ে দিয়ে মাথা নাড়ল, নাহ, খোলা যাবে না। শনিবারে কি কেউ কাজ করে না নাকি এখানে? রবিনের দিকে তাকাল আবার সে, ঢোকার আর কোন পথই কি নেই?

এক মুহূর্ত ভাবল রবিন, আছে, তবে দস্যু সাইমন টেম্পলার হওয়া লাগবে আমাদের।

মানে?

 একটা ফায়ার এসকে আছে। ওটা বেয়ে উঠতে পারলে…

রবিনকে কথা শেষ করতে দিল না মুসা। দেখাও ওটা, সাইমন টেম্পলারই হব আজ। কোনদিকে?

বাড়ির পাশ দিয়ে দৌড় দিল রবিন। পেছনে চলল মুসা আর কিশোর।

ফায়ার এসকেপটার নিচে দাঁড়িয়ে ওপর দিকে তাকাল কিশোর। চিন্তিত। বিড়বিড় করে বলল, কিন্তু ওটা বেয়ে ওঠা…সত্যি সত্যি সাইমন টেম্পলারকে দরকার…আমরা কি পারব!

তোমাদের দুজনের পারা লাগবে না, নির্দ্বিধায় বলে দিল মুসা, আমি উঠে যাচ্ছি। জানালা দিয়ে ঢুকে নেমে এসে সামনের দরজা খুলে দেব।…রবিন, বলো তো, কোন কোন দিক দিয়ে গিয়ে কিভাবে আসতে হবে?

নড়বড়ে, মরচে পড়া লোহার ধাপগুলো বেয়ে উঠে যেতে লাগল মুসা। কোনভাবে যদি পা পিছলায়, কিংবা কোন একটা ধাপ বসে যায়, নিচে পড়ে যে ছাতু হয়ে যেতে হবে জানে, সেজন্যেই ভয়ে নিচের দিকে তাকাচ্ছে না।

সাবধান, মুসা! ধাপগুলোর গোঙানি আর কচমচ শব্দ বুকের মধ্যে বাড়ি মারছে যেন কিশোরের। অসুবিধে হলে নেমে এসো, অন্য উপায় বের করব।

কিন্তু জানালার কাছাকাছি চলে গেছে ততক্ষণে মুসা। পাশে হাত বাড়িয়ে একটা জানালার চৌকাঠের নিচটা ধরে ফেলল। স্কুলে পড়ল একহাতের ওপর। দ্বিতীয় হাতটাও বাড়িয়ে দিয়ে ধরে ফেলল। নিজেকে টেনে তুলল চৌকাঠের ওপর। ঢুকে গেল ভেতরে। গলা বের করে নিচের দিকে তাকিয়ে হাসল। হাত নেড়ে সামনের দরজার কাছে চলে যেতে ইশারা করল কিশোর আর রবিনকে।

ঠিক দেড় মিনিটের মাথায় দরজাটা খুলে দিল মুসা।

 ভেতরে ঢুকে গেল কিশোর আর রবিন।

সিঁড়ি বেয়ে দৌড়ে উঠতে শুরু করল তিনজনে। তিনতলায় শাজিন হ্যারিসনের অফিসের সামনে আসতে কথা শোনা গেল ভেতর থেকে। চাপা স্বরে কথা বলছে দুজন লোক।

মিস্টার সেভারনের গলা মনে হচ্ছে না? ফিসফিস করে বলল রবিন।

তাই তো, মুসা বলল।

শিওর হওয়ার একটাই উপায়, নিচের ঠোঁট কামড়াল কিশোর, ভেতরে ঢুকে পড়া।

.

অবাক হয়ে তিন গোয়েন্দার দিকে তাকালেন মিস্টার সেভারন আর তার সঙ্গী।

তোমরা!…তোমরা এখানে! মিস্টার সেভারন বললেন।

জবাব না দিয়ে কিশোর তাকিয়ে আছে তার সঙ্গীর দিকে।

 আপনি জ্যাকি না? কিশোর বলল। কি করে এলেন?

হাসল জ্যাকুয়েল সেভারন যার ডাকনাম জ্যাকি। তাহলে তোমরাই তামাকে চিঠি লিখেছিলে।

কিন্তু এখানে এলেন… আবার জিজ্ঞেস করতে যাচ্ছিল কিশোর।

মাথা নেড়ে তাকে থামিয়ে দিল জ্যাকি, সব বলার সময় নেই। একটা থাই বলি, তোমাদের চিঠি পেয়ে মনে হলো এখানে কি ঘটছে দেখে যাওয়া দরকার। বাবার দিকে ফিরল সে, বাবা, তোমাকে বলিনি, ওরা আমাকে শাজিনের শয়তানির কথা চিঠি লিখে জানিয়েছে।

ও, বাড়ি আসার তোর এটাই আসল কারণ। আমি তো ভেবেছি প্যারোলে ছাড়া পেয়ে আমাদের দেখতেই এসেছিস, বাবার কণ্ঠে মৃদু অভিমান।

দুটো কাজই করতে এসেছি, হাসল ছেলে। তিন গোয়েন্দার দিকে ফিরে বলল, আমার হাতে বেশি সময় নেই। আজকেই সন্ধ্যার আগে গিয়ে রিপোর্ট করতে হবে।

আপনারা ঢুকলেন কি করে এখানে? জানতে চাইল মুসা। সামনের দরজায় তো তালা লাগানো ছিল।

আবার হাসল জ্যাকি। এখানে চাকরি করতাম যে ভুলে গেলে? ডুপ্লিকেট একটা চাবি এখনও আছে আমার কাছে।

কিন্তু তোমরা এখানে কেন? আবার সেই প্রথম প্রশ্নটাই করলেন মিস্টার সেভারন। ঢুকলেই বা কি করে? আমাদের বাড়িতে গিয়েছিলে নাকি? জ্যাকির মা ভাল আছে? কিছু ঘটেছে?

কি ঘটেছে, জানাল কিশোর।

রক্ত সরে গেল বৃদ্ধের মুখ থেকে। ডেস্কের কিনার খামচে ধরলেন তিনি। এখনি যাওয়া দরকার।

যেতে তো হবেই, তার আগে কিছু তথ্য-প্রমাণ জোগাড় করে নিই। ও অক্ষর নষ্ট হওয়া ওই টাইপরাইটার দিয়ে একটা চিঠিও লিখতে হবে, ড্রাইভারকে বোঝানোর জন্যে যে সে একটা মস্ত ভুল করতে যাচ্ছে।

ঘড়ির দিকে তাকিয়ে মুসা বলল, মাত্র দশ মিনিট সময় আছে আমাদের

 এখনও দশ মিনিট আছে! বিশ্বাস হচ্ছে না রবিনের। আমার তো মনে হচ্ছে দশ হাজার বছর পার করে দিয়েছি। তবে সময় নিয়ে ভাবছি না, হেসে পকেটে হাত ঢোকাল সে। একটা চাবি বের করে দেখিয়ে বলল, ডিগারের ইগনিশন কী। চুরি করেছি।

ও, এ জন্যেই পেছনে পড়ে গিয়েছিলে তখন, হাসি ফুটল কিশোরের মুখেও। খবর লুকিয়ে রাখার দেখি তুমিও ওস্তাদ। যাকগে, কাজের কাজই করেছ একটা।

ড্রাইভারকে যে নির্দেশটা দেয়া হয়েছে, জ্যাকি বলল, তার একটা কপি নিশ্চয় এখানে আছে কোনখানে। যদিও অতটা অসাবধান ভাবতে পারছি না শাজিনকে। ধরা পড়ার মত প্রমাণ রেখে কাজ করার বান্দা নয় ও। আমি আর বাবা এতক্ষণ ধরে স্টেটমেন্ট খুঁজে বেড়াচ্ছিলাম।

স্টেটমেন্ট? বুঝতে পারল না কিশোর।

হ্যাঁ, জমা-খরচের স্টেটমেন্ট। ইনকাম ট্যাক্স অফিসকে দিতে হয় যেটা। দেখতে চাইছিলাম, আমি যে সময় যে টাকাটা চুরি করেছি বলেছে শাজিন, সেই অঙ্কের টাকা সেই সময়ে অন্য কোন খাতে খরচ করেছে কিনা সে। ব্যাংক থেকে তখন কত টাকা তুলেছে, সেটা স্টেটমেন্টের সঙ্গে মিলিয়ে নিলেই প্রমাণ করে দেয়া যাবে সে-ই খরচ করেছে টাকাটা, আমি চুরি করিনি।

যদি সে সেই টাকার হিসেবটা স্টেটমেন্টে দেখিয়ে থাকে,তবে। অত কাঁচা কাজ করবে বলে মনে হয় না।

নিজের অ্যাকাউন্টের হিসেব রাখার জন্যে ব্যক্তিগত আরেকটা স্টেটমেন্ট বানাতে পারে, যাতে আসল হিসেবটা রাখবে।

তা পারে। কিন্তু সেটা কোথায়?

পাইনি। টাকা যে আমি চুরি করিনি, প্রমাণ করার আর কোন উপায় দেখতে পাচ্ছি না।

এখান থেকে চলে যাওয়া দরকার, মিস্টার সেভারন বললেন। শাজিন এসে যদি দেখে ফেলে আমাদের, সাংঘাতিক বিপদে পড়ব।

যা হয় হবে, জ্যাকি বলল, আবার খুঁজব। ওর বিরুদ্ধে প্রমাণ না নিয়ে আজ আমি বেরোচ্ছি না এখান থেকে।

.

১৪.

 জ্যাকির কথামত প্রথমে ফাইলিং কেবিনেটগুলোতে খুঁজতে আরম্ভ করল ওরা।

সেক্রেটারির মেশিনে টাইপ করা যে কাগজ পাও, সব দেখো, কিশোর বলল। ভাঙা কী দিয়ে লেখা হয়েছে, এমন কোন না কোন চিঠি নিশ্চয় পাবে। নিয়ে নেবে সেটা প্রমাণ হিসেবে কাজে লাগবে। তোমরা এদিকটায় দেখতে থাকো। আমি ওদিকটায় দেখছি।

কয়েক মিনিট পর হাসিমুখে বেরিয়ে এল কিশোর। হাতে একটা শর্টহ্যান্ড নোটপ্যাড আর দুই তা কাগজ। দুমড়ে ফেলে দেয়া হয়েছিল নিশ্চয় ময়লা ফেলার ঝুড়িতে, তুলে চেপেচুপে সোজা করে নিয়েছে।

সেক্রেটারির টেবিল থেকে একটা পেন্সিল তুলে নিল সে। আলতো করে প্যাডের একজায়গায় দাগ দিয়ে রবিনকে দেখিয়ে বলল, এই যে, রাস্তা চওড়া করার অর্ভারের খসড়া। দুমড়ানো একটা কাগজ দেখিয়ে বলল, আর এটা টাইপ করা অর্ডারের কপি। ভুল হয়েছিল বলে ফেলে দিয়েছে। টাইপরাইটারটা দিয়ে টাইপ করে দেখেছি, ও অক্ষরটা কোনমতেই ছোট হাতের করা যায় না, কী-টা নষ্ট, মারলেই ক্যাপিটল লেটারটা পড়ে…

এটা কিন্তু হঠাৎ বলে উঠল মুসা। একটা ফাইলিং কেবিনেটের একেবারে পেছনে লুকানো সবুজ একটা ফাইল বের করে আনল সে। খুলল।

অ্যাই, জ্যাকি, দেখে যান! ডাক দিল সে। আপনার বাবাকে লেখা চিঠির কপি …একটা নিউজপেপার কাটিংও আছে। আদালতে আপনার কেসের রিপোর্ট।

এগুলো রেখেছে কেন? অবাক হলো রবিন।

 দেখি? এগিয়ে এল জ্যাকি।

কিশোরও দেখার জন্যে মুসার পাশে এসে দাঁড়াল। রিপোর্টটা পড়ে বলল, পনেরোই অগাস্ট টাকাটা ফান্ড থেকে চুরি গেছে বলে লিখেছে কাগজওলারা।

হ্যাঁ, তাই তো দেখছি, মাথা ঝাঁকাল জ্যাকি। একটা ভুয়া ব্যবসা। প্রতিষ্ঠানের নামে জাল দলিল সই করার অপরাধে অভিযুক্ত করেছে আমাকে শাজিন। চেকটা লেখা হয়েছে দশ তারিখে। কেউ আমার সই জাল করে স্বাক্ষর দিয়েছে ওটাতে। কে, নিশ্চয় বুঝতে পারছ।

কিন্তু ওই তারিখে তো আপনি ছিলেন না এখানে।

 জানি। আমি তখন গ্রীসে। কিন্তু কোন সাক্ষী নেই আমার, যে সেটা প্রমাণ করবে।

আছে, কিশোরের কালো চোখের তারা উত্তেজনায় চকচক করছে।

 ভ্রূকুটি করল জ্যাকি, কে?

আপনার ছবি…আপনাদের বাড়ির বসার ঘরের ম্যান্টলপীসে যেটা রাখা আছে।

মাথা নাড়তে লাগল জ্যাকি, কি বলছ বুঝতে পারছি না। বসার ঘরে ঢুকি না অনেকদিন।

তুই জেলে যাবার পর ডাকে এসেছে ছবিটা, মিস্টার সেভারন বললেন। অ্যাথেনসে তোলা হয়েছে।

অ্যাথেনসে?

হ্যাঁ, মাথা ঝাঁকাল কিশোর, পারথেননের সামনে দাঁড়ানো।

নাক-চোখ কুঁচকে ভাবতে লাগল জ্যাকি, মনে করার চেষ্টা করছে। উজ্জ্বল হলো মুখ। হা হা, মনে পড়েছে; একটা আমেরিকান মেয়ে তুলে দিয়েছিল ছবিটা। বাড়ির ঠিকানা দিয়েছিলাম ওকে। ভাবিইনি ছবিটা পাঠাবে সে।

আর তাতে… উত্তেজনায় গলা কাঁপছে কিশোরের, ছবির নিচে তারিখটা ছাপা হয়ে গেছে, ১০ অগাস্ট। আপনি জানেন, কিছু কিছু ক্যামেরায় ছবি তোলার তারিখটা ছাপা হয়ে যায়।

কিন্তু আমি তো কোন তারিখ দেখলাম না, মিস্টার সেভারন বললেন।

আছে, জবাবটা দিল এবার রবিন, ভালমত খেয়াল করেননি, তাই দেখেননি। আমি হাতে নিয়ে দেখছিলাম সেদিন, মাউন্ট থেকে পড়ে গেল; তুলে নিয়ে আবার বসানোর সময় দেখেছি একেবারে নিচে তারিখ ছাপা রয়েছে। কিশোরও জানে। তখন অবশ্য তারিখটা নিয়ে কোন কথা ভাবিনি আমরা। ছবিতে তারিখ ছাপা থাকতেই পারে, সেটা স্বাভাবিক ব্যাপার।

স্বাভাবিক ব্যাপারটাই কাজে লেগে গেল এখন, কিশোর বলল। জোরাল সাক্ষী হয়ে দাঁড়াল।

হাসি ফুটল জ্যাকির মুখে। রবিনের কাঁধ চাপড়ে দিতে দিতে বলল, ভাগ্যিস হাত থেকে ফেলে দিয়েছিলে।

 কিন্তু কথা হলো, মুসা বলল, মিসেস শাজিন এভাবে ফাসাতে গেল কেন আপনাকে?

প্রথম কথা, আমার ওপর একটা আক্রোশ আছে তার। একজন ডিস্ট্রিক্ট কাউন্সিলরকে ঘুষ সেধেছে সে, সেই লোক আবার আমার বন্ধু। কয়েকটা বিল্ডিঙের প্ল্যান পাস করে দিলে তাকে অনেক টাকা ঘুষ দেবে বলেছে।

পুলিশকে জানাল না কেন আপনার বন্ধু?

কাঁধ ঝাঁকাল জ্যাকি। তাকে ব্ল্যাকমেল করছিল শাজিন। অল্প বয়েসে একটা অপরাধ করে ফেলেছিল-তেমন কিছু না, তবু বন্ধুটির সেটা নিয়ে মাথাব্যথার অন্ত নেই। সেটা জেনে গিয়েছিল শাজিন; ওই কথা মনে করিয়ে দিয়ে, পুলিশকে বলে দেবার ভয় দেখিয়ে দেখিয়ে তার কাছ থেকে কাজ আদায় করেছে। আমার বন্ধুটি জেলে যাবার ভয়ে শাজিনের কথা মানতে বাধ্য হয়েছে। বউ-বাচ্চা আছে তার… রেগে গেল জ্যাকি। তিক্তকণ্ঠে বলল, মহিলাটা এতই শয়তান, নিজের স্বার্থসিদ্ধির জন্যে হেন দুষ্কর্ম নেই যা সে করতে পারে না। আমি যখন জেনে ফেললাম এসব খবর, আমাকে ঘুষ দিয়ে মুখ বন্ধ রাখতে চাইল সে। আমি ঘুষ নিতে রাজি না হওয়াতে গেল খেপে। শেষে আমাকেই দিল ফাঁসিয়ে।

আস্তে, সচকিত মনে হলো মিস্টার সেভারনকে, কে যেন আসছে!

সবাই শুনতে পেল সিঁড়িতে পায়ের শব্দ।

মিসেস শাজিন না তো! তাড়াতাড়ি দুই সহকারীকে নির্দেশ দিল কিশোর, আই, পেছনের অফিসটায় লুকিয়ে পড়া। আপনারাও আসুন।

দ্রুত পেছনের অফিসটায় চলে এল সবাই। ফাইলিং কেবিনেটের আশেপাশে ঘাপটি মেরে রইল। নিঃশ্বাস ফেলতেও ভয় পাচ্ছে। বাইরের ঘরে ঢুকল কেউ। হেঁটে গেল শাজিনের অফিসের দিকে। দরজা খুলল। সুইচবোর্ড অন করার শব্দ। রিসিভার তুলে নিয়ে ডায়াল করতে লাগল কেউ।

কে; দেখে আসি, ফিসফিস করে বলল কিশোর। আপনারা সব এখানেই থাকুন। আমি না ডাকলে নড়বেন না।

মাথা নুইয়ে পা টিপে টিপে সেক্রেটারির অফিসের দিকে এগোল সে। ডেস্কের ভেতরের দিকটায় এসে বসে পড়ল। দরজার কাচের ভেতর দিয়ে দেখা যাচ্ছে, শাজিনের অফিসে ডেস্কের এককোণে ঝুঁকে রয়েছে কালো পোশাক পরা একটা মূর্তি। মুখটা উল্টোদিকে ফেরানো।

আস্তে হাত বাড়িয়ে সেক্রেটারির ডেস্কে রাখা ইনটারকমের সুইচটা অন করে দিল কিশোর। সঙ্গে সঙ্গে কানে এল ভারী নিঃশ্বাস আর অস্থির ভঙ্গিতে টেবিলে অধৈর্য আঙুল ঠোকার শব্দ।

দ্রুত ভাবনা চলেছে কিশোরে মগজে। বসে থেকেই টান দিয়ে ড্রয়ারটা খুলল। ডিকটেশন মেশিনটা পাওয়া গেল। সারিয়ে নিয়ে এসেছে। ভাল। কাজ হবে এখন। ইনটারকমের পাশে সেটা রেখে রেকর্ড লেখা বোতামটা টিপে দিল।

খিলখিল হাসির শব্দ।

আরে হ্যাঁ…হ্যাঁ, কথা শুনতে পাচ্ছে কিশোর, আজ সকালেই গিয়েছে। এতক্ষণে নিশ্চয় ওদের অত সাধের বাগানটার অর্ধেকটাই নেই আর, বারোটা বাজিয়ে দিয়েছে…কৈফিয়ত? কোন সমস্যা নেই। স্রেফ বলে দেব, ড্রাইভার ভুল করেছে। ক্ষমাটমা চাওয়া যেতে পারে পরে, কিন্তু তাতে লাভ কিছু হবে না, বাগান আর ফেরত আসবে না… আবার হাসি। এ রকম ভুল হতেই পারে, তাই না?

মনে মনে রাগে জ্বলে উঠল কিশোর। মহিলাটা মানুষ না, আসলেই ড্রাকুলা!

ভ্যানটা দেয়ার জন্যে ধন্যবাদ, শাজিন বলছে। পেছনে রাখা জিনিসগুলো জলদি ফেলে দিয়ে আসুন।…হা হা, পাবেন টাকা, যা বলেছি পাবেন। কাজটা আগে হয়ে যাক..তবে মুখ বন্ধ রাখতে হবে আপনাকে। খুললে আপনিও বিপদে পড়বেন। আপনি আমাকে সহায়তা করেছেন, অস্বীকার করতে পারবেন। না। প্রমাণ করে দিতে পারব আমি। বন্দুকটার লাইসেন্সও আপনার নামে। পুলিশ জানতে পারলে আমাকে যেমন ছাড়বে না, আপনাকেও ছাড়বে না।

আস্তে মাথা তুলে তাকাল আবার কিশোর। এখনও এদিকে পেছন ফিরে আগের মতই দাঁড়িয়ে আছে শাজিন। দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে কথা বলছে।

ইনটারকমে আবার ভেসে এল তার কণ্ঠ। হ্যাঁ, মিস্টার সেভারন জায়গাটা বেচতে রাজি হয়ে গেলেই কাজ শুরু করে দিতে পারব আমরা। আবার টাকা আসতে আরম্ভ করবে। এখনকার টানাটানি আর থাকবে না।…কি বললেন? আবার হাসি। ঠিকই আছে, বুড়োটার উপযুক্ত শাস্তি…ভালভাবে বলেছিলাম, কানে তোলেনি…

পেছনে খুট করে শব্দ হতে ফিরে তাকাল কিশোর। দরজায় এসে দাঁড়িয়েছেন মিস্টার সেভারন। ছড়িটা তুলে ধরেছেন। রাগে লাল হয়ে গেছে চোখমুখ।

আরে করছেন কি! তাড়াতাড়ি বলল কিশোর, বসে পড়ুন, বসে পড়ুন! দেখে ফেলবে তো!

কিন্তু কানেও তুললেন না মিস্টার সেভারন। চিৎকার করে উঠলেন, শয়তান বেটি! আরেকটু হলেই বাড়িটা হাতছাড়া হয়ে যাচ্ছিল আমার…শয়তানি করে করে আমার স্ত্রীকে ভয় দেখিয়েছিস, আমার জায়গা তছনছ করেছিস, তোকে আমি ছাড়ব না!

গটমট করে গিয়ে এক ধাক্কায় দরজাটা খুলে ফেললেন তিনি। এত জোরে ধাক্কা দিলেন, দেয়ালের সঙ্গে বাড়ি খেয়ে ঝনঝন করে ভেঙে পড়ল কাচ। পায়ের কাছে ছড়িয়ে পড়ল। লাগলে যে কেটে যেতে পারে, তোয়াক্কাই করলেন না। লাঠিটা নাড়তে নাড়তে গিয়ে ঢুকলেন শাজিনের অফিসে, শয়তান…

লাফিয়ে উঠে দৌড় দিল কিশোর, মিস্টার সেভারন!

পেছনের অফিস থেকে বেরিয়ে এসেছে জ্যাকি। কিশোরের আগেই গিয়ে বাবার হাত চেপে ধরল। বাবা, কি করছ! থামো না!

ঘুরে দাঁড়িয়েছে অগাস্ট শাজিন। গায়ে কালো জ্যাকেট, পরনে কালো। জিনস। লম্বা কালো চুল ছড়িয়ে পড়েছে কাঁধে। ঠোঁটে টকটকে লাল লিপস্টিক। ফাঁক দিয়ে দেখা যাচ্ছে সাদা দাঁত। মনে হচ্ছে, যে কোন সময় বেরিয়ে আসবে। জানোয়ারের মত শ্বদন্ত-ড্রাকুলার যে রকম থাকে।

জ্যাকির ওপর চোখ পড়তে সরু হয়ে এল চোখের পাতা। ধমকে উঠল, এখানে কি? তোমার তো জেলে থাকার কথা। পেছনে তিন গোয়েন্দাকে দেখে বিস্ময়ে বড় বড় হয়ে গেল চোখ, সরু হলো আবার; মোমের মত ফ্যাকাসে চেহারায় কালো ছাপ পড়ল। হচ্ছেটা কি?

 আপনি যে একটা মিথ্যুক, সেই প্রমাণ জোগাড় হয়ে গেছে আমাদের, রাগত স্বরে বলল জ্যাকি।

কিশোরের বগলে চেপে রাখা ফাইলের দিকে তাকিয়ে কালো চোখের মণি জ্বলে উঠল শাজিনের। পুলিশকে যখন বলব, চুরি করে আমার অফিসে ঢুকে কাগজপত্র তছনছ করেছ তোমরা, শীতল কণ্ঠে বলল সে, কে কার কথা বিশ্বাস করে, কে সত্যিকার বিপদে পড়ে, দেখা যাবে তখন।

 এবার আর আপনাকে বিশ্বাস করছে না ওরা, কঠিন কণ্ঠে জবাব দিল কিশোর, আপনার বিরুদ্ধে অনেক প্রমাণ আছে আমাদের হাতে। সেভারনদের বাগান নষ্ট করতে ডিগার পাঠিয়েছেন, ওঁদের শান্তি নষ্ট করেছেন, নানা ভাবে যন্ত্রণা দিয়েছেন ওঁদের, ব্ল্যাকমেল করেছেন; অভিযোগের অন্ত নেই, কটা অস্বীকার করবেন? ফাইলটা নাড়ল সে। আপনার শয়তানির সমস্ত প্রমাণ রয়েছে এর মধ্যে।

হঠাৎ ডাইভ দিয়ে পড়ল শাজিন। ড্রয়ার খোলার শব্দ। আবার যখন উঠে দাঁড়াল সে, হাতে উদ্যত ছোট একটা পিস্তল। কিশোরের দিকে হাত বাড়াল। ফাইলটা দাও!

জ্বী-না! ফাইল সহ হাতটা পেছনে নিয়ে গেল কিশোর, আপনার কথা আর শোনা হচ্ছে না।

দেখো, বোকামি কোরো না! বরফের মত শীতল শাজিনের কণ্ঠ, ভাল। চাও তো, দাও বলছি!

দিয়ে দাও, কিশোর, মৃদুস্বরে বলল জ্যাকি। ওকে বিশ্বাস নেই। সত্যি সত্যি গুলি করে বসবে।

অনিচ্ছাসত্ত্বেও ফাইলটা দিয়ে দিল কিশোর।

ও-কে, ফাইলটা গোল করে পকেটে ঢুকিয়ে, এগিয়ে এসে মিস্টার সেভারনের হাত চেপে ধরল শাজিন। বুড়োটাকে সঙ্গে নিয়ে যাচ্ছি আমি। কেউ আমার পিছে পিছে আসার চেষ্টা করলে..

নিতে যদি না দিই? মুসা বলল।  

বাধা দিয়ে দেখো খালি, ঠোঁটজোড়া ফাঁক হয়ে গেল শাজিনের। ভয়ঙ্কর লাগছে দেখতে।

মিস্টার সেভারনের হাতটা বাঁকিয়ে পিঠের ওপর নিয়ে এল শাজিন। পিস্তলটা অন্যদের দিকে নিশানা করে ঠেলতে ঠেলতে নিয়ে চলল তাঁকে।

যেতে দিচ্ছ কেন! চিৎকার করে উঠল রবিন।

মাথা নেড়ে জ্যাকি বলল, কিছু করার নেই। বাধা দিলে যা বলছে তাই করবে। বরং অপেক্ষা করাই ভাল। বাইরে নিয়ে বাবাকে ছেড়ে দেবে।

মিস্টার সেভারনকে নিয়ে বেরিয়ে গেল শাজিন।

ডিকটেশন মেশিনটার কাছে এসে টেপের ক্যাসেটটা বের করে নিল কিশোর। পকেটে রেখে দিল।

ওটাতে কি আছে বুঝতে পারল জ্যাকি। নীরবে মাথা ঝাঁকাল।

কিন্তু বাইরে নিয়ে গিয়ে আপনার বাবাকে যদি কিছু করে! রবিন বলল।

এই সময় সিঁড়ি থেকে ভেসে এল গুলির শব্দ।

সর্বনাশ! বলেই দৌড় দিল জ্যাকি।

তিন গোয়েন্দাও ছুটল পেছনে।

দোতলার ল্যান্ডিং ফ্লোরে বসে আছেন মিস্টার সেভারন। বিমূঢ়ের মত তাকাচ্ছেন। হাতে শাজিনের পিস্তলটা। ছেলেদের দেখে বললেন, ল্যাং মেরে, ফেলে দিয়েছি। পিস্তলটা মাটিতে পড়ে আপনাআপনি গুলি বেরিয়ে গেল।

তার ছেলে জিজ্ঞেস করল, ওর গায়ে লেগেছে?

মাথা নাড়লেন বৃদ্ধ, না। নিচে গড়িয়ে পড়েই লাফ দিয়ে উঠে দৌড় দিল। তাড়াতাড়ি গেলে এখনও ধরতে পারবে…

 হুড়মুড় করে সিঁড়ি বেয়ে নামতে শুরু করল ওরা। নিচতলায় নামতেই কানে এল পুলিশের সাইরেন। পরক্ষণে ব্রেকের শব্দ।

পুলিশ! ভুরু কুঁচকে ফেলল কিশোর, ওরা জানল কি করে?

এক মুহূর্ত পরেই সদর দরজা দিয়ে ঢুকতে লাগল পুলিশের লোক, জোড়ায় জোড়ায়। সিঁড়ির দিকে ছুটল।

কি হয়েছে? জানতে চাইল একজন। তিন গোয়েন্দা আর জ্যাকিকে দেখছে। তারপর তাকাল মিস্টার সেভারনের দিকে। তিনিও নেমে আসছেন। আপনি কি মিস্টার সেভারন? আপনার পড়শী ফোন করেছে থানায়। বলেছে, আপনার স্ত্রী আপনার জন্যে অস্থির হয়ে পড়েছেন…?

একজন মহিলাকে যেতে দেখেছেন? জানতে চাইল কিশোর।

অবাক হয়ে মাথা নাড়ল অফিসার, কই, না তো!

পরস্পরের দিকে তাকাতে লাগল তিন গোয়েন্দা। ওরাও অবাক।

আমি জানি কোনখান দিয়ে গেছে! আচমকা চেঁচিয়ে উঠল রবিন। সাইরেন শুনে আর সামনের দিকে যায়নি, ফায়ার এসকেপ দিয়ে পালিয়েছে!

জলদি! লাফিয়ে উঠে দৌড় দিল কিশোর। ধরতে হবে!

জ্যাকি আর তার বাবা পুলিশের প্রশ্নের জবাব দেয়ার জন্যে রয়ে গেল, তিন গোয়েন্দা ছুটল শাজিনকে ধরার জন্যে। মুসা যে জানালাটা দিয়ে ঢুকেছিল, সেটার কাছে এসে দেখল, ফায়ার এসকেপ থেকে নেমে পড়েছে শাজিন। বাধানো চত্বর দিয়ে দৌড়ে চলেছে। আঙিনার সীমানায় গিয়ে একটা দরজার ওপাশে অদৃশ্য হয়ে গেল।

ঘুরে দাঁড়াল কিশোর। সামনের দরজা দিয়ে বেরিয়ে ধরার চেষ্টা করতে হবে, বলেই ছুটল আবার।

ওদেরকে দরজার দিকে ছুটে যেতে দেখে চিৎকার করে উঠল অফিসার, অ্যাই, অ্যাই, কোথায় যাচ্ছ?

কিন্তু কে শোনে কার কথা। চোখের পলকে আঙিনায় বেরিয়ে এল ওরা। কাঠের দরজাটার দিকে ছুটল।

 দরজার ওপাশে একটা অন্ধগলি। উঁচু দালানের জন্যে ঠিকমত আলো ঢুকতে পারে না বলে আবছা অন্ধকার। দুদিকের দেয়ালেই আগাছা জন্মেছে। রাতের কুয়াশা পানি হয়ে জমে আছে এখনও। ফোঁটা ফোঁটা ঝরছে। রাস্তায়। আবর্জনার ছড়াছড়ি। পানি আর মদের বোতল স্তূপ হয়ে আছে এখানে ওখানে।

আরি! আগে আগে ছুটতে ছুটতে থমকে দাঁড়িয়ে গেল কিশোর। নিচু হয়ে তুলে নিল কি যেন। ওই কাগজগুলো!…ঘটনাটা কি?

রবিন আর মুসাও দেখল দেয়ালের গায়ে সেঁটে থেকে বাতাসে বাড়ি খেতে খেতে নিচে পড়ছে কয়েকটা কাগজ।

খাইছে! কাগজ কুড়াতে শুরু করল মুসাও। ফেলে দিল কেন?

হয়তো আমাদের ঠেকানোর জন্যে, রবিন বলল। কাগজ দেখলে কুড়ানো শুরু করব আমরা, থামব, এই সুযোগে সে পালাবে।

চালাক কত! পালাতে দিচ্ছি না আজ শয়তানটাকে, বলেই দৌড় দিল মুসা।

গলির শেষ মাথায় বেরিয়ে দেখল একটা ছোট পার্কিং লট। কয়েকটা গাড়ি দাঁড়িয়ে আছে। আবার শাজিনকে চোখে পড়ল তিন গোয়েন্দার। কুকুর নিয়ে হাঁটতে বেরোনো একটা লোককে প্রায় ধাক্কা দিয়ে ফেলতে ফেলতে তার পাশ কেটে ছুটে চলে গেল। একপাশে জেটি। পার্কিং লটের কাছ থেকে শখানেক গজ দূরে বাধা রয়েছে কয়েকটা মোটর ক্রুজার।

হাত তুলল কিশোর, ওই যে! জেটির দিকে যাচ্ছে।

 দাঁড়িয়ে গেল সে।

মুসাও দাঁড়াল, কি হলো?

 বুঝেছি! এসো! আবার ছুটল কিশোর।

জেটির কাছে পৌঁছে দাঁড়িয়ে গেল শাজিন। দ্রুতহাতে একটা বোটের দড়ি খুলে ছুঁড়ে ফেলল ডেকে। কিন্তু ডেকে না পড়ে পানিতে পড়ল ওটা।

বোটে ওঠার আগেই পেছন থেকে গিয়ে তার জ্যাকেট খামচে ধরল মুসা। কিন্তু রাখতে পারল না। আশ্চর্য শক্তি শাজিনের শরীরে। ভূতই মনে হলো মুসার। ক্ষণিকের জন্যে দ্বিধায় পড়ে গেল। ঝাড়া দিয়ে ওর হাত থেকে জ্যাকেটটা ছাড়িয়ে নিয়েই এক লাফে গিয়ে ছোট মোটর বোটটায় উঠে পড়ল শাজিন।

নামতে গিয়ে পিছলে পড়ে গেল মুসা। চিত হয়ে পড়ল শান বাঁধানো ঘাটে। ব্যথা পেল পিঠে। রবিন আর কিশোর পৌঁছতে দেরি করে ফেলল। ততক্ষণে স্টার্ট দিয়ে ফেলেছে শাজিন। অসহায় হয়ে দেখতে লাগল তিন গোয়েন্দা, ঘাট থেকে সরে যেতে শুরু করেছে বোটটা।

নড়ে উঠল রবিন। পানিতে ঝাঁপিয়ে পড়তে গেল। খপ করে তার হাত ধরে ফেলল কিশোর। মরার দরকার নেই।

কিন্তু চলে যাচ্ছে তো! রাগে মাটিতে পা ঠুকল রবিন।

স্পীড বোটের সঙ্গে সাঁতরে পারবে না।

দেখো এটা কি? হাতে নিয়ে উঠে দাঁড়াল মুসা। ব্যালাক্লাভা। শাজিনের পকেট থেকে পড়েছে।

আজ আর বাঁচতে পারবে না, সেজন্যেই ভাগ্য তার প্রতি বিরূপ; প্রমাণের পর প্রমাণ ফেলে যাচ্ছে, কিশোর বলল। এটা মাথায় দিয়ে সে নিজেই যেত সেভারনদের বাড়িতে। নানা রকম পোশাক পরে বিভিন্ন সাজে সমস্ত শয়তানিগুলো সে একাই করেছে, কেউ তার দোসর ছিল না।

তারমানে তুমি বলতে চাইছ, সেভারনদের বাড়িতে কোন পুরুষ লোক ঢোকেনি? মুসা অবাক।

না

কিন্তু ধরতে না পারলে কিছুই করা যাবে না, রবিন বলল। দেখো দেখো, লকটার দিকে যাচ্ছে। আগেই গিয়ে গেটটা বন্ধ করে দিতে পারলে…

বলে আর দাঁড়াল না সে। গেটের দিকে ছুটল প্রাণপণে।

মুসা আর কিশোরও তার পিছু নিতে যাচ্ছিল, এই সময় পাশে এসে থামল একটা পুলিশের গাড়ি। জ্যাকি আর তার বাবা বসে আছেন ওতে। টপাটপ লাফিয়ে নামল একজন পুলিশ অফিসার আর জ্যাকি।

শাজিন কোথায়? জিজ্ঞেস করল জ্যাকি।

হাত তুলে দেখাল কিশোর।

পালালই শেষ পর্যন্ত?

এখনও বলা যাচ্ছে না। রবিন গেছে গেটটা বন্ধ করতে। শাজিন বেরিয়ে যাবার আগেই যদি বন্ধ করে দিতে পারে…

কথা শেষ করার আগেই আবার গিয়ে গাড়িতে বসল অফিসার। জ্যাকিও উঠল। সরে জায়গা করে দিল মুসা আর কিশোরকে। কিশোর দরজা লাগানোর আগেই চলতে শুরু করল গাড়িটা।

গেটের কাছে পৌঁছে দেখা গেল পাগলের মত হাতলটা ঘোরাচ্ছে রবিন, বন্ধ করে দেয়ার জন্যে। গাড়ি থেকে লাফিয়ে নেমে তাকে সাহায্য করতে ছুটে গেল জ্যাকি। গেট বন্ধ হয়ে যাচ্ছে দেখে আবার বোটের নাক ঘুরিয়ে দিতে গেল শাজিন। কোন কারণে কেশে উঠে বন্ধ হয়ে গেল ইঞ্জিনটা। মরিয়া হয়ে বার বার দড়ি টেনে স্টার্ট দেয়ার চেষ্টা করতে লাগল সে।

এ সুযোগ হাতছাড়া করতে চাইল না মুসা। কোনদিকে না তাকিয়ে গিয়ে পানিতে ঝাঁপ দিয়ে পড়ল। তীব্র স্রোতকে অগ্রাহ্য করে সাঁতরে এগোল বোটের দিকে। ধরে ফেলল পানিতে পড়ে থাকা বোট বাঁধার দড়িটা। ঘুরে গিয়ে টেনে নিয়ে সাঁতরে চলল তীরের দিকে।

দড়িটা টান দিয়ে ছাড়িয়ে নেয়ার আপ্রাণ চেষ্টা করতে লাগল শাজিন। কিন্তু ছাড়বে না আর, পণ করে ফেলেছে মুসা। একবার হাত থেকে জ্যাকেট ছুটিয়েছে বটে, কিন্তু দ্বিতীয়বার আর দড়ি ছুটাতে দেবে না।

 পানিতে ঝাঁপ দিতে গিয়েও থেমে গেল শাজিন। তীরে দাঁড়ানো পুলিশের দলকে নজরে পড়েছে। বুঝতে পারল, পানিতে পড়েও বাঁচতে পারবে না আজ। খুব শীঘ্রি তাকে টেনে তুলবে পুলিশ। অহেতুক পানিতে পড়ে ভেজার কষ্ট করার চেয়ে হাল ছেড়ে দিয়ে বোটের সীটে বসে পড়াটাই বুদ্ধিমানের কাজ।

তীরে পৌঁছতে অনেকগুলো আগ্রহী হাত এগিয়ে এল মুসার দিকে। কেউ দড়িটা নিয়ে নিল তার কাছ থেকে, কেউ চেপে ধরল দুই হাত। তুলে আনল তাকে পানি থেকে।

বাপরে বাপ! ঝাড়া দিয়ে গা থেকে পানি ফেলতে ফেলতে বলল মুসা, যা ঠাণ্ডা! বরফও এরচেয়ে ভাল!

বোট থেকে নামানো হলো শাজিনকে। গাড়িতে তুলল তাকে পুলিশ।

.

কখন সন্দেহ করলে এ সব শাজিনের শয়তানি? ফুলস্পীডে গাড়ি চালিয়ে ম্যানিলা রোডে যাওয়ার পথে জিজ্ঞেস করল জ্যাকি।

লোগোটা দেখে।

তারপর?

 তদন্ত চালিয়ে গেলাম। কেন সে এসব করছে, বুঝতে সময় লাগল না।

কি যে উপকার করলে তোমরা, কৃতজ্ঞ স্বরে বললেন মিস্টার সেভারন। বলে বোঝাতে পারব না!

প্রশংসা-পর্বটা এড়ানোর জন্যে আগের কথার খেই ধরে কিশোর বলল, তবে আজকের আগে বুঝতে পারিনি, সব কাজ সে একাই করেছে। আমরা ভেবেছিলাম, তার একজন পুরুষ সহকারীও আছে। সেদিন বনের মধ্যে বন্দুক দিয়ে গুলি করে মুসাদের ভয় দেখিয়েছিল সে নিজেই। কাঁটাঝোপের ওপর পড়ে গিয়ে হাত ছিলে ফেলেছিল, হাতের প্লাস্টার সেটাই প্রমাণ করে…।

বাড়ির কাছে পৌঁছে দেখা গেল, সামনের রাস্তায় তেমনি দাঁড়িয়ে আছে ডিগারটা। গেটের কাছে একজন পুলিশ অফিসারকে নিয়ে ড্রাইভারের সঙ্গে কথা বলছেন মিসেস সেভারন।

অফিসার আমাকে বলেছে, রেডিওতে থানায় জানিয়ে দিয়েছে, মিস্টার সেভারন বললেন। এত তাড়াতাড়ি লোক পাঠিয়ে দেবে থানা থেকে, ভাবিনি। ভালই হলো। ড্রাইভারের সঙ্গে আর ঝগড়া করা লাগল না।

আরও একজন লোক দাঁড়িয়ে আছে মিসেস সেভারনের পাশে। চিনতে পারল মুসা। এই লোকটাকেই দূরবীন নিয়ে ঘোরাফেরা করতে দেখেছে বনের ভেতর।

গাড়ি থামাল জ্যাকি। তিন গোয়েন্দাকে বলল, নামো তোমরা। মা তোমাদের চা না খাইয়ে ছাড়বে না।

চিন্তিত ভঙ্গিতে মুসা বলল, তদন্ত এখনও শেষ হয়নি। দূরবীনওয়ালা লোকটার ব্যাপারে খোঁজ-খবর নিতে হবে, শাজিনের সঙ্গে কিভাবে জড়িত ছিল।

ভুরু কোঁচকাল জ্যাকি, জড়িত ছিল মানে?

লোকটাকে কোথায়, কিভাবে দেখেছে জানাল মুসা।

হেসে উঠল জ্যাকি। আরে ও তো আমাদের রবার্ট লিওনেল। শখের পক্ষী-বিজ্ঞানী। সারাক্ষণ বনে বনে ঘুরে বেড়ায় আর পাখি দেখে।

ও, তাই! দুই বন্ধুর দিকে তাকিয়ে হেসে ফেলল মুসা।

গাড়ি থেকে নামল ওরা।

জ্যাকির কাছে সব শুনে এগিয়ে এলেন লিওনেল। মুসার দিকে তাকিয়ে বললেন, সেদিন বনের মধ্যে তোমার ঘোড়াটাকে ভয় পাইয়ে দেয়ার জন্যে দুঃখিত।

 না না, ঠিক আছে, বলতে যাচ্ছিল মুসা, বলা হলো না, টেলিফোন কোম্পানির একটা গাড়ি এসে থামল।

গাড়ি থেকে নেমে এগিয়ে এল একজন লোক। আপনাদের তারে কোনখানে গণ্ডগোল হয়েছে, সেজন্যেই লাইন পাচ্ছেন না। খুঁজে বের করে এখুনি ঠিক করে দিচ্ছি…

কিশোর অনুমান করল, শাজিনই তারটা ছিঁড়েটিড়ে দিয়ে থাকবে কোন জায়গায়, সেভারনদের বিচ্ছিন্ন করে রাখার জন্যে, যাতে ডিগার নিয়ে বাগান ভাঙতে এলে তারা থানায় যোগাযোগ করতে না পারেন।

.

আমাকে নিয়ে তো খুব হাসাহাসি করা হয়েছে, রান্নাঘরের টেবিলে কাপে চা ঢালতে ঢালতে হেসে বললেন মিসেস সেভারন, আড়চোখে স্বামীর দিকে তাকিয়ে, ভূতের কথাটা কি ভুল বলেছি?

ভূত নয়, মানুষ। ফিনফিনে পোশাক পরে শাজিনই ভূত সেজেছিল।

সে যা-ই হোক, দেখেছি তো ঠিকই, চোখের ভুল ছিল না।

মাথা ঝাঁকাল কিশোর। হ্যাঁ। ওর পোশাকের কাপড়ই ছিঁড়ে আটকে গিয়েছিল সেলারে নামার ট্র্যাপ-ডোরে।

ফোঁস করে নিঃশ্বাস ফেলে মুসা বলল, আসল ভূত হলে সত্যি খুব মজা হত। শাজিন আসল ড্রাকুলা না হওয়ায় নিরাশই মনে হচ্ছে ওকে।

সেলারে আরেকবার চোখ বোলাতে চাই আমি, কিশোর বলল। কে জানে, নতুন আর কোন রহস্য পেয়ে যাই কিনা?

হেসে উঠল জ্যাকি, তোমরা মনেপ্রাণে গোয়েন্দা। রহস্যের খোঁজে থাকো সব সময়, রহস্য না হলে বাঁচো না। যোগ্য লোক পাওয়া গেছে এতদিনে। চলল, আমিও তোমাদের সঙ্গে যাব। জোয়ালিনের ভূতের রহস্য সমাধানের ইচ্ছে আমারও অনেক দিনের।

তাই নাকি? চলুন! সঙ্গে সঙ্গে উৎসাহিত হয়ে উঠল কিশোর। দারুণ হবে! বলা যায় না, ভূত খুঁজতে গিয়ে ওয়ারনার পরিবারের গুপ্তধনের নকশাও পেয়ে যেতে পারি।

ও, তাই বলো, গুপ্তধন, হাসল রবিন। আমি ভাবছিলাম ভূত খুঁজতে যাওয়ার এত আগ্রহ কেন তোমার?

গুপ্তধনের কথা আবার কার কাছে শুনলে? চোখ বড় বড় করে তাকাল মুসা। তার ওঠার কোন ইচ্ছে দেখা গেল না। আয়েশ করে ফ্রটকেক চিবুচ্ছে।

শুনিনি, অনুমান। এত বড়লোক ছিল যখন, গুপ্তধন তো থাকতেই পারে, তাই না?

তা পারে! রবিনও উত্তেজিত হয়ে উঠেছে।

 কিন্তু মুসার মধ্যে তেমন উত্তেজনা নেই। হাত নেড়ে বলল, গুপ্তধন উদ্ধারে আমার কোন আপত্তি নেই। কিন্তু দেড়শো বছরের পুরানো সেলারে জোয়ালিনের ভূতও থাকতে পারে। ওর বাবার ধনরত্ন লুট করতে যাচ্ছি দেখলে ঘাড়টা ধরে মটকে দিতে পারে। মিসেস সেভারন, আপনার কোন আপত্তি না থাকলে এই ফুটকেকটা আমি পুরোটাই খাব। বলা যায় না, জীবনের শেষ খাওয়াও হতে পারে এটা।

Super User