০৬.
কাঁপতে কাঁপতে উঠে দাঁড়াল কিশোর। তাকিয়ে আছে ভ্যানটার দিকে। গর্জন করে মোড়ের ওপাশে হারিয়ে যাচ্ছে ওটা। ফিরে তাকাল দুই সহকারীর দিকে। তোমাদের লেগেছে?
সামান্য, মুসা বলল। এই ভ্যানটাকেই জঙ্গলের মধ্যে দেখেছিলাম। হলো কি লোকটার? বনের মধ্যে গুলি করল, রাস্তায় বেরিয়ে চাপা দিতে চাইল! মাতাল নাকি? হাতের তালুর দিকে তাকাল সে। ঘষা লেগে ছড়ে গেছে।
উঁহু, মাথা নাড়ল কিশোর, আমার মনে হয় সেভারনদের বাড়ি থেকে আমাদের বেরোতে দেখেছে সে। কোন কারণে ভয় দেখাতে চাইছে আমাদের।
সাইকেলটা তুলল সে। ছিঁড়ে বেঁকে যাওয়া একটা স্পোক সোজা করল।
একই দিনে দুই দুইবার অল্পের জন্যে বাচলাম আজ, শুকনো কণ্ঠে মুসা। বলল। গোয়েন্দাগিরির কাজটা বড় বেশি বিপজ্জনক।
ছেড়ে দিতে চাও?
না না, ছাড়ার কথা বলছি না।
লোকটার চেহারা দেখেছ? শার্ট থেকে ময়লা ঝেড়ে ফেলল রবিন।
মাথা নাড়ল কিশোর, না। গাঢ় রঙের জ্যাকেটটা শুধু চোখে পড়েছে। সরেই তো সারতে পারছিলাম না, দেখব কখন?
আমিও পারিনি, মুসা বলল। এক পলকের জন্যে দেখলাম, খেপাটা স্টিয়ারিঙে হুমড়ি খেয়ে আছে।
তবে ভ্যানের পেছনের হলুদ লোগোটা দেখেছি। তোমরা দেখেছ?
রবিন আর মুসা দুজনেই মাথা নাড়ল।
আমারও তো তোমার অবস্থা, রবিন বলল। সরে বাঁচব, না দেখব? হাঁটু ডলল। জ্বালা করছে। ছড়ে গেছে মনে হয়। হাড়িতে লাগল কিনা কে জানে। সকালে উঠে আর হাঁটতে পারব না কাল।
লোগোটা আমার চেনা, বিড়বিড় করল কিশোর, খামের কোণায় যে লোগো দেখেছি, অবিকল সেরকম। হলুদ রঙের দুটো অক্ষর। এস আর এইচ অক্ষর দুটো পেঁচিয়ে পেঁচিয়ে একটার ভেতর আরেকটা ঢুকিয়ে লিখে তৈরি করেছে।
তবে ওই পেঁচানো অক্ষরের মালিক যারাই হোক, শুকনো গলায় মুসা বলল, তারা ড্রাইভারের পদে একটা পাগলকে চাকরি দিয়েছে, যে দিনে-দুপুরে গাড়িচাপা দিয়ে মানুষ মারতে চায়।
ব্যাপারটা কাকতালীয়ও হতে পারে, রবিন বলল।
আমার তা মনে হয় না।
আমারও না, কিশোর বলল। বনের মধ্যে গুলি করা, রাস্তায় গাড়িচাপা দেয়ার চেষ্টা, এবং একটা বিশেষ লোগো; সবই কাকতালীয় হতে পারে না। ওই লোগোটা কোন্ কোম্পানির, সেটা এখন খুঁজে বের করতে হবে। আমাদের।
কি করে? রবিনের প্রশ্ন।
জানি না। তবে উপায় একটা বেরিয়েই যাবে।
.
পুরানো জিনিস নিয়ে ঘাটাঘাটি করেন রাশেদ পাশা, পুরানো বহু বাড়ি থেকে বহুবার জিনিসপত্র কিনে এনেছেন তিনি। সামনে পেয়ে তাকেই প্রথম জিজ্ঞেস করে বসল কিশোর। হতাশ হতে হলো না। ম্যানিলা রোড চেনেন রাশেদ পাশা। দুদিন আগেও গিয়েছেন একটা বাড়িতে পুরানো মাল দেখে আসার জন্যে। আবারও যাবেন। যাই হোক, জায়গাটার আগের মালিক কারা ছিল, পরে কারা কিনেছেন, বলতে পারলেন। সেভারনরা যে কিনেছেন, জানেন তিনি। ভূতের গুজবটাও শুনেছেন। তবে লোগোটা কোন কোম্পানির বলতে পারলেন না। তা না পারলেও একটা মূল্যবান পরামর্শ দিলেন, পাবলিক লাইব্রেরিতে চলে গেলেই পারিস। কোম্পানিগুলোর ওপর একটা ডিরেক্টরি করেছে ওরা। ওতে পেয়ে যাবি। এক কোম্পানির লোগো কখনও আরেক কোম্পানি নকল করে না, দুটোর চেহারা অবিকল এক রকম হয় না। সহজেই। পেয়ে যাবি।
চাচাকে ধন্যবাদ দিয়ে তক্ষুণি সাইকেল নিয়ে রওনা হলো লাইব্রেরিতে।
লাইব্রেরির তথ্য বিভাগে ঢুকে তাকের দিকে এগোতে যাবে, কে যেন তার নাম ধরে ডাকল, হাই কিশোর!
ফিরে তাকিয়ে দেখে কেরি জনসন হাত নাড়ছে। তেতো হয়ে গেল, মনটা। শুরু করবে এখন খোঁচানো কথা। আসার আর সময় পেল না মেয়েটা!
না গেলে কথা বলার জন্যে উঠে আসবে কেরি, কোনভাবেই তার হাত থেকে মুক্তি নেই। নিজে গিয়ে বরং কিজন্যে ডাকছে শুনে আসা ভাল। এগিয়ে গেল কিশোর। হাসিটা ধরে রেখে জিজ্ঞেস করল, কেমন আছ, কেরি?
ভাল। তুমি এই অসময়ে?
পড়াশোনার কি আবার সময়-অসময় আছে নাকি?
জবাব দিতে না পেরে জিজ্ঞেস করল কেরি, তোমার লেখাটার কর? ফুটপাথ অ্যান্ড হাইওয়ে?
হয়নি এখনও। হয়ে যাবে।
ও ব্যাপারে পড়াশোনার জন্যেই এলে নাকি?
নাহ, বই ঘাটতে গেলে তাক দেখেই অনুমান করে ফেলবে কেরি, কি খুঁজতে এসেছে কিশোর। কৌতূহল বেড়ে গেলে উঠে চলেও আসতে পারে দেখার জন্যে। ঝামেলা এড়ানোর জন্যে সত্যি কথাটাই বলল সে, একটা সাদা ভ্যানে বিচিত্র একটা লোগো দেখলাম। এস আর এইচ পেঁচিয়ে আঁকা। ভ্যানটা আরেকটু হলেই চাপা দিচ্ছিল আমাকে। পালিয়ে চলে গেল ড্রাইভার। কমপ্লেন করব আমি ওর নামে। ডিরেক্টরি দেখে কোম্পানির নামটা খুঁজে বের করতে এসেছি।
লোগোটা কেমন, এঁকে দেখাও তো।
চেনো নাকি তুমি?
দেখাওই না।
কেরির সামনে নোটবুক আর পেন্সিল পড়ে আছে। একে দেখাল কিশোর।
ও, শাজিন-হ্যারিসন কোম্পানি। চিনি তো। আমার আঙ্কেল চাকরি করে ওখানে।
কি বললে?
অবাক হওয়ার কিছু নেই। কোম্পানি যখন, যে কেউ চাকরি করতে পারে ওখানে, তাই না? আমার আঙ্কেল হলেই বা কি।
দীর্ঘ একটা মুহূর্ত প্রায় কতজ্ঞ দৃষ্টিতে কেরির দিকে তাকিয়ে রইল কিশোর। যাকে এড়িয়ে যেতে চেয়েছিল, কাকতালীয়ভাবে সে-ই একটা মস্ত উপকার করে দিল; অবশ্য না জেনে, কিশোররা যে তদন্ত করছে এটা জানলে হয়তো এত সহজে বলত না।
তা তো বটেই, অবশেষে জবাব দিল কিশোর। কোম্পানিটা কিসের? মাছ বেচাকেনার নাকি?
হাসল কেরি। এ কথা মনে হলো কেন?
লোগোটা দেখে।
মাছের ধারেকাছেও না। জমি কেনাবেচার ব্যবসা করে ওরা। বাড়ি বানানোর কন্ট্রাক্ট নেয়।
জমি বেচাকেনা!
তোমার হলো কি আজ? কথায় কথায় অবাক হচ্ছ। কেন, জমি বেচাকেনা কি দোষের নাকি?
না না, তা নয়…এমনি…
বেশি কথা বলতে গেলে কি সন্দেহ করে বসে কেরি, এজন্যে তাড়াতাড়ি ওকে ধন্যবাদ দিয়ে লাইব্রেরি থেকে বেরিয়ে এল কিশোর। বাড়ি ফিরে চলল।
.
তারমানে…সত্যি সত্যি বলে দিল! বিশ্বাস করতে পারছে না রবিন।
বাড়ি ফিরেই ওকে ফোন করেছে কিশোর। হ্যাঁ। ভুল করে কি একখান উপকার করে ফেলেছে আমাদের, জানলে এখন নিজের হাত নিজেই কামড়ে খেয়ে ফেলবে।
মেজাজ-মর্জি বোধহয় খুব ভাল আছে আজ ওর। যাকগে, কি করবে। এখন?
যাব ওদের অফিসে। জমি বেচাকেনা করে যখন, সেভারনদের জমিটা নেয়ার চেষ্টা করাটা অস্বাভাবিক নয়। হতে পারে, জায়গাটা কেনার প্রস্তাব দিয়েছে ওরা, বেচতে রাজি হচ্ছেন না মিস্টার সেভারন, সেটা নিয়েই বিরোধ। জমিটা কোম্পানির নেহাত দরকার, তাই ভয় দেখিয়ে বা অন্য যে কোনভাবেই হোক, তাদেরকে তুলে দেয়ার চেষ্টা করছে ওরা।
হ্যাঁ, ঠিক বলেছ। এটাই কারণ। বাবার সঙ্গে কথা বলবে নাকি?
কেন?
জমিটা নিয়ে কোন বিরোধ থাকলে, কিংবা কোন অঘটন ঘটলে স্থানীয় পত্রিকায় ছোটখাট নিউজ ছাপা হওয়ার কথা। পুরানো পত্রপত্রিকা ঘাটলে…
আজ ঘুম ভেঙে পুণ্যবান কারও মুখ দেখেছিলাম! চতুর্দিক থেকে চমৎকার সব সাহায্য আসছে। এক্ষুণি চলে এসো ইয়ার্ডে। তুমি এলেই আঙ্কেলকে ফোন করব। আঙ্কেল অফিসে থাকলে এখনই যাব। চলে এসো। দেরি কোরো না।
.
পত্রিকার বিশাল বিল্ডিংটাতে ঢুকে সরাসরি মিস্টার মিলফোর্ডের অফিসে চলে এল দুজনে। খুব ব্যস্ত তিনি। ছেলেদের দেখে সরাসরি কাজের কথায় এলেন, বছরখানেক আগেই সম্ভবত ওদের নিয়ে একটা নিউজ ছাপা হয়েছে। বারো তেরো মাস আগের পত্রিকাগুলো ঘাটো, পেয়ে যাবে।
এ অফিসে বহুবার এসেছে কিশোর আর রবিন। পুরানো পত্রিকা কোথায় রাখা হয় জানে। চলে এল সেঘরে। তাক থেকে পত্রিকার বান্ডিল নামিয়ে টেবিলে ফেলল। তার ওপর হুমড়ি খেয়ে পড়ল দুজনে।
নিউজটা খুঁজে বের করতে পঁয়তাল্লিশ মিনিটের বেশি লাগল না। আধ। কলামের একটা লেখা বেরিয়েছিল শাজিন-হ্যারিসন কোম্পানির ওপর। কোম্পানির অফিসের একটা ছবি ছাপা হয়েছে। সাইনবোর্ডে বড় করে আঁকা লোগোটাও স্পষ্ট। লম্বা এক মহিলা দাঁড়ানো অফিসের সামনে। মূলত তাকে উদ্দেশ্য করেই ছবিটা ভোলা হয়েছে। ছবির নিচে ক্যাপশন : শাজিন-হ্যারিসন কোম্পানির বর্তমান মালকিন মিসেস অগাস্ট শাজিন।
প্রতিবেদন পড়ে জানা গেল কোম্পানির মূল মালিক ছিলেন মিস্টার হ্যারিসন। শাজিন তার স্ত্রী। বিয়ের বছর দুই পরেই ক্যান্সারে মারা গেলেন মিস্টার হ্যারিসন। শেষ দিকে বাজার খারাপ ছিল বলে প্রচুর ঋণ হয়ে গিয়েছিল কোম্পানির। ব্যাংক প্রস্তাব দিল নিলামে চড়ানোর। কিন্তু কোম্পানি বেচল না। শাজিন শক্ত হাতে হাল ধরল। ব্যাংকের ঋণ শোধ করে দিল সুদে-আসলে। কোম্পানিটা আবার দাঁড়িয়ে গেলেও অবস্থা এখনও ভাল নয়।
শাজিনের কথার উদ্ধৃতি দিয়ে পত্রিকা লিখেছে, মিসেস শাজিন হ্যারিসন এই শহরের পতিত জমিগুলোর একটা বিহিত করতে চান। অহেতুক পড়ে থাকার চেয়ে ওগুলোতে কারখানা বা বহুতল আবাসিক বাড়ি কিংবা মার্কেট গড়ে তুলতে পারলে শহরেরও উন্নতি হবে, লোকের কর্মসংস্থানও হবে। তিনি সেই চেষ্টাই করছেন। এ ভাবে নিজেরও উন্নতি করতে চান, শহরবাসীরও।
চেয়ারে হেলান দিল কিশোর। মগজের মধ্যে ঘুরপাক খাচ্ছে ভাবনা। কোন সন্দেহ নেই আর তার, অতিরিক্ত লাভ দেখতে পাচ্ছে বলেই সেভারনদের বাড়িটা কিনে নিতে চায় শাজিন। বিরাট জায়গা সেভারনদের, কিন্তু জংলা বলে বাজার দর তেমন হবে না। বিক্রি করতে তাদের কোনমতে রাজি করাতে পারলে অল্প পয়সায়ই কিনে নিতে পারবে। আর শাজিনের যা পরিকল্পনা, সেটা বাস্তবায়িত করতে পারলে কোটিপতি হতে দেরি হবে না।
শাজিন-হ্যারিসন কোম্পানির আর কোন নিউজ আছে কিনা দেখতে শুরু করল আবার দুজনে। পাওয়া গেল আরেকটা ছোট খবর। কোম্পানিরই জনৈক কর্মচারী তাদের বিরুদ্ধে মামলা ঠুকে দিয়েছিল ডিস্ট্রিক্ট কাউন্সিলের সঙ্গে ষড়যন্ত্র করে নিরীহ মানুষের জমি দখলের অভিযোগ এনে।
ইনটারেস্টিং! কিশোর বলল। গভীর মনোযোগে কয়েকবার করে খবরটা পড়ল সে। মামলাটা আদালতে বিচারের জন্যে ওঠেনি একবারও। ধামাচাপা পড়ে গেল। কিছুদিন পর সেই কর্মচারীকে অফিসের টাকা চুরির অপরাধে গ্রেপ্তার করল পুলিশ। নামটা গোপন করে গেছে পত্রিকা, কারণ এখনও বিচার শেষ হয়নি লোকটার, চোর প্রমাণ করতে পারেনি আদালত।
তারমানে রহস্যের চাবিকাঠি লুকিয়ে আছে শাজিন-হ্যারিসন কোম্পানিতে, নিচের ঠোঁটে চিমটি কাটতে কাটতে আনমনে বিড়বিড় করল কিশোর। যত শীঘ্র সম্ভব এখন গিয়ে হানা দিতে হবে ওদের অফিসে। কিন্তু তার আগে একবার সেভারনদের বাড়িতে যাওয়া দরকার।
কেন?
জবাব দিল না কিশোর। গভীর চিন্তায় ডুবে গেছে।
.
০৭.
বাড়ির কাছাকাছি আসতে রাস্তায় দেখা হয়ে গেল এক লোকের সঙ্গে, কুকুর নিয়ে হাঁটছে। সেভারনদের বাড়ির গেটে কিশোরদের থামতে দেখে এগিয়ে এসে বলল, সেভারনরা তো নেই।
কোথায় গেছেন? জানতে চাইল কিশোর।
ডে সেন্টারে। সকালে।
ও।
এতটা পথ অযথাই এলাম, কপালের ঘাম মুছতে মুছতে বলল রবিন। লোকটার চলে যাওয়ার অপেক্ষা করল। তারপর বলল, ভেতরে আছে নাকি দেখা দরকার। থেকেও তো দেখা দেন না অনেক সময়।
কিন্তু ডে সেন্টারে চলে গেছেন বলল। না দেখলে কি আর বলেছে।
ফিরেও তো আসতে পারেন। যেতে দেখেছে, ফিরতে দেখেনি।
ঢুকে দেখতে বলছ?
অসুবিধে কি?
এতটা এসে ফিরে যাওয়ার ইচ্ছে কিশোরেরও নেই। কটেজের পেছন দিকটায় এসে একটা জানালা খোলা দেখতে পেল। ভুরু কুঁচকে বলল, এ কি!
কি?
জানালা খোলা।
তাতে কি?
দরজা-জানালা বন্ধ রাখার ব্যাপারে অতিরিক্ত সাবধান ওঁরা। দেখা দরকার।
কি দেখতে এসেছ জানি না। যাই হোক, তুমি দেখতে থাকো, আমি ওই বনের দিকটায় একটু ঘুরে আসি।
চারপাশে তাকাতে লাগল কিশোর। সামার-হাউসের দরজা খোলা, কিন্তু কাউকে চোখে পড়ল না। কয়লা রাখার বাংকারটার ওপরে উঠে ফ্যানলাইট উইন্ডোর ফাঁক হয়ে থাকা পাল্লার ভেতর দিয়ে উঁকি দিল।
মাথার ওপর দিয়ে একটা প্লেন উড়ে যাচ্ছে। ওটা চলে যাওয়ার পর যখন শব্দ সরে গেল একটা ঠনঠন শব্দ কানে এল। হাতুড়ি দিয়ে ধাতব কিছু পিটাচ্ছে। কেউ। তারপর কটেজের ভেতরে আসবাব টানাটানি করার শব্দ। ভুরু কুঁচকে তাকাল সে। সেভারনরা যদি ডে সেন্টারেই চলে গিয়ে থাকেন, কে টানাটানি করছে?
মিস্টার সেভারন, মিস্টার সেভারন বলে ডাক দিল সে।
জবাব নেই।
ভেতরে ঢুকে দেখার সিদ্ধান্ত নিয়ে সামার-হাউসে ঢুকে পড়ল সে। পুরানো একটা গুটিয়ে রাখা কার্পেটের পাশে তারের তৈরি পুরানো দুটো কোটের হ্যাঁঙ্গার। একটা হ্যাঁঙ্গার নামিয়ে এনে তারের মাথা যেখানে জোড়া দেয়া, সেখানটা খুলে ফেলল। তারটা সোজা করল টেনে টেনে। মাথার কাছটা সামান্য বাঁকিয়ে নিল বঁড়শির মত করে। ফিরে এসে আবার চড়ল কোল বাংকারে। ছোট ফ্যানলাইট জানালার মধ্যে তারের বাঁকা মাথাটা ঢুকিয়ে ভেতরের হুড়কো খুলে ফেলল। মূল পাল্লাটা পুরো খুলে ফেলতে আর কোন, অসুবিধে হলো না। এবার ঢোকা যাবে ওপথে।
ভাবনা চলেছে ওর মাথায়। ভেতরে যদি কেউ থেকেই থাকে, তাহলে কোনদিক দিয়ে ঢুকল সে? যদি এ জানালাটা দিয়ে ঢুকত, তাহলে আর হুড়কো লাগাত না, ভোলা রাখত, যাতে তাড়াহুড়োর সময় দ্রুত বেরিয়ে যেতে পারে।
দুরুদুরু করছে বুকের মধ্যে। জানালা গলে ভেতরে ঢুকল কিশোর। আস্তে করে আবার লাগিয়ে দিল পাল্লা।
দম বন্ধ করে দাঁড়িয়ে রইল একটা মুহূর্ত। ঢোকার আগে রবিনকে ডেকে এনে পাহারা দেয়ার জন্যে বাইরে দাঁড় করিয়ে রাখলে ভাল হত। এখন আর ওসব ভেবে লাভ নেই।
হঠাৎ একটা জোরাল শব্দে চমকে গেল সে। ভূতে আসর করা ঘরটা থেকে আসছে।
আস্তে করে দরজা খুলে সরু হলওয়ে ধরে নিঃশব্দে এগিয়ে চলল কিশোর। ভূতের ঘরের ভারী ওক কাঠের দরজাটা বন্ধ। তাতে কান চেপে ধরল
ভেতর থেকে আসছে ঠোকাঠুকির শব্দ। বিড়বিড় করে আপনমনে কথা বলছে কেউ।
খুব সাবধানে পিতলের নবটা চেপে ধরে ঘোরানো শুরু করল কিশোর। পুরোটা ঘুরে যেতে ঠেলা দিল। খুলে গেল দরজা। ঠাণ্ডা বাতাস এসে ধাক্কা মারল যেন গালে।
কি… বলতে গেল সে।
কালো একটা মূর্তি ঝুঁকে রয়েছে আগুনের ধারে পাতা টেবিলে রাখা টিনের ট্রাংকটার ওপর। ঝট করে সোজা হয়ে ফিরে তাকাল। চমকে গেল কিশোরকে দেখে। পরনে কালো জিনস, গায়ে কালো কমব্যাট জ্যাকেট। মাথার ব্যালাক্লাভা ক্যাপ টেনে নামিয়ে মুখ ঢেকেছে। চোখের জায়গার দুটো ফুটো দিয়ে কালো একজোড়া চকচকে মণি দেখা যাচ্ছে। লোকটা বেশ লম্বা। কেমন ঝুলে পড়া মেয়েলী কাঁধ।
তালা ভেঙে খোলা হয়েছে ট্রাংকটা। কাছেই পড়ে আছে একটা হাতুড়ি। বাইরে থেকে এই তালা ভাঙার শব্দই কানে এসেছিল।
তাড়াতাড়ি ট্রাংকের ভেতর থেকে একমুঠো দলিল তুলে নিল লোকটা। ওগুলো বেধে রাখা লাল ফিতেটা ঢিল হয়ে আছে।
কে আপনি? জিজ্ঞেস করল কিশোর। কি করছেন?
কাগজগুলো দ্রুত পকেটে ভরার চেষ্টা করল লোকটা। ঢোকাতে না পেরে হাত থেকে ছেড়ে দিল। তুলে নিল হাতুড়িটা।
সরো এখান থেকে! যাও! কিশোরের দিকে তাকিয়ে বিকৃত কণ্ঠে গর্জে উঠল সে। হাতুড়িটা ঝাঁকাতে লাগল বাড়ি মারার ভঙ্গিতে।
দ্রুত ভাবনা চলেছে কিশোরের মগজে। কি করা যায়? দৌড়ে বেরিয়ে গিয়ে যদি এখন দরজার তালাটা লাগিয়ে দিতে পারে, ঘরে আটকা পড়বে লোকটা। তারপর পুলিশকে ফোন করলে বাতিল করে দিল ভাবনাটা। ঘরে আটকে থাকবে না লোকটা। জানালা দিয়ে বেরিয়ে যাওয়ার সুযোগ আছে।
ভাবার সময় কম। কাছে চলে এসেছে লোকটা। লাফ দিয়ে পেছনে সরে। গিয়ে দরজাটা লাগিয়ে দিল কিশোর। দৌড় দিল সিঁড়ির দিকে।
কিছুদূর উঠে ফিরে তাকিয়ে দেখল সিঁড়ির গোড়ায় পৌঁছে গেছে লোকটা। দুই পা ফাঁক করে দাঁড়িয়ে তাকিয়ে আছে ওর দিকে। কালো চোখের তীক্ষ্ণ দৃষ্টি দিয়ে যেন সম্মোহিত করার চেষ্টা করছে ওকে।
বাইরে থেকে ডাক শোনা গেল এই সময়, কিশোর, কোথায় তুমি?
রবিন!
বুকের মধ্যে রক্ত ছলকে উঠল কিশোরের। চিৎকার করে বলল, রবিন, সাবধান!
গজগজ করে কি যেন বলল লোকটা। এদিক ওদিক তাকিয়ে পালানোর পথ খুঁজল। সোজা গিয়ে সামনের দরজার শেকল সরিয়ে, দরজা খুলে বেরিয়ে গেল।
রবিনের চিৎকার শোনা গেল, অ্যাই, অ্যাই!
দৌড়ে নেমে এল কিশোর। সামনের দরজার সামনে এসে দেখল, রাস্তাটার দিকে বোকা হয়ে তাকিয়ে আছে রবিন।
কিশোর, লোকটা কে? আমাকে প্রায় ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দৌড়ে চলে গেল।
চোর! চোর! চিৎকার করে উঠল কিশোর। লাফ দিয়ে রাস্তায় নেমে গেটের দিকে ছুটল। পলকের জন্যে দেখল মোড়ের ওপাশে চলে যাচ্ছে। লোকটা।
চোর! পেছনে প্রায় কানের কাছে শোনা গেল রবিনের চিৎকার। ঢুকল কি করে?
জানি না, মাথা নাড়তে নাড়তে বলল কিশোর।
কি নিতে এসেছিল? দামী গহনা-টহনা আছে নাকি?
দেখার সময় পাইনি। কতগুলো কাগজ ঘাটতে দেখলাম।
তাহলে দেখে ফেলো না।
এসো।
ভুতের ঘরটায় ফিরে এল ওরা। ট্রাংকের জিনিসগুলো ছড়িয়ে আছে মেঝেতে।
এটা কি? লাল ফিতেয় বাঁধা কাগজের বান্ডিলটা মেঝে থেকে তুলে নিতে নিতে বলল রবিন।
দেখি।
ফিতেটা খুলে কাগজগুলো দেখে গম্ভীর হয়ে মাথা ঝাঁকাল কিশোর, হু, বাড়ির পুরানো দলিল।
এগুলো নিতে চেয়েছিল কেন?
জানি না। হতে পারে, সেভারনদের মালিকানার প্রমাণ গায়েব করে দিতে চেয়েছে।
আমার মাথায় কিছু ঢুকছে না। নিলে লাভটা কি? ভূমি অফিস থেকে যে। কোন সময় দলিলের নকল জোগাড় করে নিতে পারবেন মিস্টার সেভারন। জানালার বাইরে চোখ পড়তে বলে উঠল, রবিন, ওই যে, সেভাররা আসছেন।
কিশোরও এসে দাঁড়াল রবিনের পাশে। স্ত্রীকে ধরে ধরে আনছেন মিস্টার সেভারন।
ঘরের মধ্যে দুই গোয়েন্দাকে দেখে চমকে গেলেন তারা।
কিশোর! কিছুই বুঝতে না পেরে চোখ মিটমিট করতে লাগলেন মিসেস সেভারন। কি করছ তোমরা এখানে? খুব ক্লান্ত লাগছে তাকে। কতরকণ্ঠে গুঙিয়ে উঠলেন।
কি হয়েছে মিসেস সেভারনের? জানতে চাইল কিশোর।
ধাক্কা দিয়ে ফেলে দিয়েছে, মিস্টার সেভারন বললেন। মোড়ের ওপাশে আমাদের নামিয়ে দিয়েছে মিনিবাসের ড্রাইভার, ডে সেন্টার থেকে এলাম আমরা। হেঁটে এগোচ্ছি, এই সময় মোড়ের ওপাশ থেকে দৌড়ে এসে ধাক্কা দিয়ে কোরিনকে মাটিতে ফেলে দিল একটা লোক, একেবারে উন্মাদ, পাগল ছাড়া কিছু তো মনে হয় না!
খামোকা ভয় পাচ্ছ তুমি, জন, মিসেস বললেন। আমার কিছু হয়নি। লাগেনি কোথাও। পড়ে গিয়ে চমকে গেছি, এ ছাড়া আর কিচ্ছ হয়নি।
চিনতেও পারলাম না লোকটাকে…
আমি জানি, কে, কিশোর বলল। যে লোক এ ঘরে ঢুকেছিল, সে-ই হধাক্কা দিয়ে ফেলে দিয়েছে মিসেস সেভারনকে।
এ ঘরে ঢুকেছিল! চোখ বড় বড় হয়ে গেল মিসেস সেভারনের। চিৎকার দিয়ে উঠতে গিয়ে, মুখে হাত চাপা দিলেন। কিন্তু তোমরাই বা ঢুকলে কি করে?।
কিভাবে ঢুকেছে জানাল কিশোর। শেষে বলল, আপনাদের না বলে ঢোকার জন্যে দুঃখিত। কিন্তু ঘরের মধ্যে শব্দ শুনে সন্দেহ হলো, ভাবলাম চোরটোর হবে, তাই…
বাধা দিয়ে মিসেস বললেন, জন, আমি ভেবেছি জানালাটা তুমি লাগিয়ে গেছিলে!
গম্ভীর হয়ে গেলেন মিস্টার সেভারন, মনে তো ছিল লাগিয়েছি…বাসটা এসে যেভাবে হর্ন দিতে শুরু করল, মাথার ঠিক থাকে নাকি কারও!
কিন্তু আমি বুঝতে পারছি না, কিশোর বলল, চোরটা ঢুকল কোন পথে? জানালা দিয়ে ঢোকেনি। বেরিয়ে গেল সামনের দরজা খুলে। একটা মুহূর্ত তাকিয়ে রইল দুজনের দিকে। তবে কিছু নিতে পারেনি।
আর থাকছি না আমি এখানে, অনেক হয়েছে? আচমকা তীক্ষ্ণ স্বরে। চেঁচিয়ে উঠলেন মিসেস সেভারন। তোমার বাড়ির মায়া ছাড়ো!
একটা চোরের ভয়ে বাড়ি ছেড়ে পালাব? মিস্টার সেভারন নরম হলেন না।
তাহলে কি পড়ে পড়ে মরব?
কে মারছে তোমাকে? অতি সাধারণ চোর। দুটো ছেলেকে দেখেই ভয়ে পালাল। ও কি করবে?
আমি একবার ভাবলাম, কিশোর বলল, ওকে আটকে ফেলে পুলিশকে ফোন করব…
করোনি তো? ভাল করেছ। পুলিশ-টুলিশ চাই না এখানে।
কিন্তু…
কোন কিন্তু নেই!
ধরে ধরে একটা চেয়ারে মিসেস সেভারনকে বসিয়ে দিল কিশোর আর রবিন।
রবিন, কিশোর বলল, এক কাপ চা বানিয়ে এনে দাও না মিসেস সেভারনকে।
যাচ্ছি, বলেই রান্নাঘরের দিকে চলে গেল রবিন।
তাকের ওপর কাপ-পিরিচ নাড়াচাড়ার শব্দ শোনা গেল। দুজনের দিকে তাকাল কিশোর। দেখুন, দয়া করে এবার সব বলুন এখানে কি ঘটছে। কিছু লুকাবেন না, প্লীজ। আমরা আপনাদের সাহায্য করতে চাইছি। আমার বিশ্বাস, কেউ একজন ভালমত পেছনে লেগেছে আপনাদের। বাড়ি থেকে না তাড়িয়ে ছাড়বে না।
নিজের হাতের দিকে তাকিয়ে রইলেন মিসেস সেভারন। তারপর মাথা ন্টতুলে তাকালেন স্বামীর দিকে। শান্তকণ্ঠে বললেন, বলো, জন।
জোরে একটা নিঃশ্বাস ফেললেন মিস্টার সেভারন। যত নষ্টের মূল একজন মহিলা।
অগাস্ট শাজিন?
ভুরু কুঁচকে গেল মিস্টার সেভারনের, তুমি জানলে কি করে?
তদন্ত করে।
দীর্ঘ একটা মুহর্ত কিশোরের দিকে তাকিয়ে রইলেন মিস্টার সেভারন। তদন্তটা কিভাবে করেছ, জানতে চাই না। তবে একটা কথা স্বীকার করছি, বয়েস কম হলে কি হবে, খুব ভাল গোয়েন্দা তোমরা। নাম যখন জানো, এটাও নিশ্চয় জানো, জমি কেনাবেচার ব্যবসা আছে তার।
মাথা ঝাঁকাল কিশোর। জানি। এটাও অনুমান করেছি, আপনাদের বাড়ি থেকে আপনাদের তাড়াতে চাইছে সে-ই। জোর করে কিনে নিতে চাইছে। যেহেতু আপনারা রাজি হচ্ছেন না, ভয় দেখিয়ে বিদেয় করতে চাইছে।
হ্যাঁ। বনের ওপাশে যে স্পোর্টস সেন্টার আর শপিং সেন্টার করেছে, ওগুলোর মালিক শাজিন কোম্পানি। আরও নানা রকম সেন্টার করতে চায় সে, এর জন্যে বড় জায়গা দরকার, আর সেকারণেই আমাদের জায়গাটা নেয়ার জন্যে পাগল হয়ে উঠেছে। বাজারদরের চেয়ে বেশি তো দিতেই চায়, অন্য জায়গায় একটা বাড়িও দেবে বলেছে। কিন্তু সাফ বলে দিয়েছি, বেচব না। বুড়ো বয়েসে একটু শান্তি দরকার, শান্তিতে বাস করতে চাই; নড়াচড়া এখন একদম সহ্য হবে না।
কিন্তু জন, জ্যাকি…
ওর কথা থাক।
ছেলের কথা উঠতে কাঁদতে শুরু করলেন মিসেস সেভারন।
মাথায় হাত বুলিয়ে তাকে সান্ত্বনা দিতে লাগলেন মিস্টার সেভারন।
অস্বস্তিতে পড়ে গেল কিশোর। উসখুস করে বলল, যাই, দেখি, রবিনের চা কদ্দূর হলো।
রান্নাঘরের দিকে যাওয়ার পথে হলঘরে চোখ পড়ল তার। টেবিলে পড়ে আছে এখনও চিঠিগুলো। কানে আসছে স্ত্রীর প্রতি মিস্টার সেভারনের সান্ত্বনাবাক্য।
এটাই সুযোগ! দ্রুত টেবিলটার কাছে চলে এল কিশোর। লস অ্যাঞ্জেলেস পোস্ট অফিসের ছাপ মারা চিঠিটা তুলে নিল। ঠিকানার হাতের লেখাটা দেখতে লাগল ভালমত। কোন সন্দেহ নেই। বইটাতে জ্যাকি সেভারনের লেখার সঙ্গে ঠিকানার হাতের লেখার হুবহু মিল রয়েছে।
কাঁপা হাতে চিঠিটা বের করল কিশোর। ওপরের দিকটায় শুধু তারিখ লেখা, কোনখান থেকে পাঠিয়েছে লেখেনি। নিরাশ ভঙ্গিতে মাটিতে পা ঠুকল সে। কিন্তু কাগজ উল্টে অন্যপাশটা দেখতেই চোখ স্থির হয়ে গেল তার। রবারের স্ট্যাম্প দিয়ে সীল মারা রয়েছে : পাড়। প্যাসিফিক কাউন্টি প্রিজন, প্যাসিফিক কাউন্টি, লস অ্যাঞ্জেলেস।
প্রিজন! মানে জেলখানা! নিজের অজান্তেই ভুরু কুঁচকে গেল কিশোরের। সেভারনদের ছেলে জেল খানায় বন্দি। সেজন্যেই তার সম্পর্কে কোন কথা বলতে চান না, এতক্ষণ পরিষ্কার হলো ব্যাপারটা।
জেলখানায় বন্দি, তারমানে অপরাধী। কিন্তু সেভারনদের মত ভালমানুষদের ছেলে অপরাধী এটা মেনে নিতে কষ্ট হলো তার। মনে পড়ল পত্রিকার নিউজটার কথা : শাজিন-হ্যারিসন কোম্পানির এক কর্মচারী কোম্পানির বিরুদ্ধে মামলা ঠুকে দিয়েছিল, পরে তাকেই চোর সাব্যস্ত করে পুলিশের হাতে তুলে দেয়া হয়েছে।
চিঠিটা আবার খামে ভরে টেবিলে আগের জায়গায় রেখে দিল কিশোর।
.
বাজি রেখে বলতে পারি আমি, জ্যাকি অফিস থেকে টাকা চুরি করেনি। সব সাজানো ঘটনা। তাকে ফাঁদে ফেলার জন্যে।
বাড়ি ফেরার পথে সাইকেল চালাতে চালাতে বলল কিশোর।
কে ফাঁদে ফেলল? জানতে চাইল রবিন।
এখনও বুঝতে পারছ না? চলো, বাড়ি চলল। সব বলব।
.
০৮.
তারমানে তুমি বলতে চাইছ জ্যাকি নির্দোষ? বেড়ায় হেলান দিল টলে বসা মুসা। তিন গোয়েন্দার ওঅর্কশপে জরুরী আলোচনায় বসেছে ওরা।
হ্যাঁ, দৃঢ়কণ্ঠে বলল কিশোর। নিশ্চয় জ্যাকি বিপজ্জনক হয়ে উঠেছিল শাজিনের জন্যে, কায়দা করে তাই জেলে ঢুকিয়ে দিয়েছে। একই সাথে সেভারনদের মনোবলও ভেঙে দিতে চেয়েছে।
অফিসে চাকরি করত বলে নাহয় ছেলেটাকে জেলে ঢোকানোর সুযোগ পেয়েছে, রবিন বলল, কিন্তু তার বাবা-মাকে কি করে কটেজ থেকে সরাবে?
ওই যে, ভয় দেখাচ্ছে। সারাক্ষণ এ রকম স্নায়ুর ওপর চাপ দিতে থাকলে, এক সময় হাল ছেড়ে দিতে বাধ্য হবেন সেভারন। সেটা রুখতে হবে। আমাদের। ওই চোরটা কে, কোনখান থেকে এসেছে জানতে পারলে ভাল হত।
সেই লোকটা না তো, মুসা বলল, যে আমার ওপর গুলি চালিয়েছিল? আমাদের গাড়ি চাপা দিতে চেয়েছিল?
আমার তাই ধারণা, কিশোর বলল।
লোগোওয়ালা ভ্যানটা যেহেতু চালায়, তারমানে শাজিনের কোম্পানিতে চাকরি করে সে?
করতে পারে। কিংবা শাজিন ওকে বহালই করেছে সেভারনদের ভয় দেখানোর জন্যে। ভয় পেয়ে সরে গেলে তখন বাধ্য হয়ে কটেজ আর সমস্ত জায়গা শাজিনের কাছে বিক্রি করে দেবেন মিস্টার সেভারন, মহিলা নিশ্চয় সেটাই ভাবছে।
একটুক্ষণ চুপ করে থেকে মুসা বলল, এক কাজ করলে কেমন হয়, জ্যাকিকে একটা চিঠি লিখে দিতে পারি আমরা। ও এখন কোথায় আছে জানি।
কোন অসুবিধে নেই, ড্রয়ার থেকে কাগজ-কলম বের করল কিশোর। বরং ভাল হবে। বাবা-মাকে তখন চিঠি লিখে বাড়ি ছাড়তে নিষেধ করবে সে। হতাতে মনে জোর পাবেন সেভারনরা।
কি লিখবে? রবিনের প্রশ্ন।
লিখব, আমরা তার বাবা-মার তিনজন বন্ধু। লিখব, তাদের জন্যে আমরা উদ্বিগ্ন, কারণ অগাস্ট শাজিন… থেমে গেল কিশোর।
থামলে কেন? ভুরু নাচাল মুসা।
চিন্তিত ভঙ্গিতে নিচের ঠোঁট কামড়াল কিশোর। লিখব, তার বাবা-মাকে ভয় দেখানোর জন্যে তোক নিয়োগ করেছে শাজিন। ব্ল্যাকমেল করার চেষ্টা করছে।
তা লেখা যায়, মাথা দোলাল রবিন।
এখানে যা যা ঘটছে, সবই লিখব। ওর বাবা-মা যে পুলিশের কাছে যেতে চাইছেন না, এ কথাও জানাব।
আচ্ছা, অন্য প্রসঙ্গে গেল মুসা, শাজিন আর তার শয়তান গুণ্ডাটা কি বুঝতে পারছে আমরা তদন্ত করছি?
মাথা নাড়ল কিশোর, মনে হয় না। ও হয়তো ভেবেছে, আমরা সেভারনদের বন্ধু, কিংবা আত্মীয়; তাই ওঁদের সঙ্গে আমাদের যোগাযোগ বন্ধ করার জন্যে আমাদেরও ভয় দেখিয়েছে। ভেবেছে বন্দুক তুললে আর গাড়ি চাপা দেয়ার ভয় দেখালেই সুড়সুড় করে গর্তে ঢুকে পড়ব আমরা।
ব্যাটাকে হাতে পেলেই হয় একবার, ওর বন্দুক দেখানো আমি বের
জ্যাকিকে চিঠি একটা লিখেই ফেলল কিশোর।
রবিন বলল, আমার কাছে দাও। বাড়ি যাবার পথে পোস্ট করে দিয়ে যাব। আশা করি কালই চিঠিটা পেয়ে যাবে সে।
.
পরদিন সকালে মিসেস সেভারনের ফোন পেল কিশোর।
কিশোর, উদ্বিগ্ন কণ্ঠে বললেন তিনি, তোমরা কি একবার আসতে পারবে?
পারব। কেন, মিসেস সেভারন?
কাল রাতে অদ্ভুত ঘটনা ঘটেছে। তোমরা এসো। এলে তদন্ত করতে পারবে।
.
তিন গোয়েন্দা কটেজে পৌঁছে দেখল রাতের ঘটনায় মিসেস সেভারন গেছেন ভড়কে, মিস্টার সেভারন গেছেন রেগে।
দেখো, কি করেছে, মাড়িয়ে নষ্ট করে ফেলা ফুলের বেডগুলো দেখালেন। মিস্টার সেভারন। পাতাবাহারের বেড়াটা পুরো ধসিয়ে দিয়েছে। রাগে, ক্ষোভে হাতের মুঠো শক্ত হয়ে এল তার। গলাটা খসখসে শোনাল। আরও কি সর্বনাশ করেছে জানো? বাগানের পুকুরটার পানি নষ্ট করে দিয়েছে পোকা মারার বিষ ফেলে। গন্ধ পাচ্ছ? সমস্ত গোল্ডফিশগুলো মেরে ফেলেছে।
নাক উঁচু করে বাতাস শুঁকতে লাগল কিশোর। হ্যাঁ, পাচ্ছি। ফুল গাছের পোকা মারার জন্যে আমিও এ বিষ পানির সঙ্গে মিশিয়ে গাছে স্প্রে করেছি বহুবার।
নিচু হয়ে নষ্ট করে ফেলা ফুলের বেডগুলো পরীক্ষা করতে লাগল সে। জুতোর ছাপ চোখে পড়ল। রাবার সোলের জুতো। গোড়ালিতে গোল গোল চক্র, ভালমতই দাগ বসে গেছে। আপনাদের ভয় দেখিয়ে ভড়কে দেয়ার জন্যেই এ কাজ করেছে শয়তানটা। মুখ তুলে মিস্টার সেভারনের দিকে তাকাল সে, যাতে কটেজ বেচে দিয়ে চলে যান।
জানি, তিক্তকণ্ঠে বললেন মিস্টার সেভারন। চলল, ঘরে চলো। একটা জিনিস দেখাব তোমাকে।
.
ঘরে পা দিয়ে মিসেস সেভারনকে রবিন আর মুসার কাছে বলতে শুনল কিশোর, …কাল রাতে আবার শুনেছি সেই অদ্ভুত শব্দ।
কটার সময়? জানতে চাইল রবিন।
রাত বারোটার দিকে বারোটায় শুরু হলো, কয়েক ঘণ্টা ধরে চলল।
বাতাসের শব্দ নয়তো? মুসা জিজ্ঞেস করল, যদিও তার সন্দেহ নেই ভতে করেছে ওসব শয়তানি। সত্যি, রাতের বেলা শব্দগুলো ভয়ঙ্কর লাগে শুনতে। ফায়ার পর্যন্ত মাঝে মাঝে ঘাবড়ে গিয়ে অস্থির হয়ে ওঠে।
আমার মনে হয় না বাতাসের শব্দ, মিসেস সেভারন বললেন। শুধু কি তাই… কাঁপা হাতে কার্ডিগানের পকেট থেকে একটা চিঠি বের করে দিলেন। তিনি, দেখো!
মুসা বা রবিন ধরার আগেই এগিয়ে এসে চিঠিটা নিয়ে নিল কিশোর। খামের গায়ে নোংরা আঙুলের ছাপ। ভেতরে এক টুকরো কাগজ। তাতে টাইপ করে একটা লাইন লেখা। বাংলা করলে দাঁড়ায়:
কাল রাতে ঘুমাতে পেরেছ?
নীরবে কাগজটা রবিনের দিকে বাড়িয়ে দিল কিশোর, যাতে রবিন আর মুসা দুজনেই দেখতে পারে।
খাইছে! দেখেই বলে উঠল মুসা। মিসেস সেভারনের দিকে তাকাল। কখন পেলেন?
সকালে। ডাকবাক্সে, গলা কাঁপছে মিসেস সেভারনের। কি করব আমরা, বলো তো? এই অত্যাচার আর তো সহ্য করতে পারছি না!
নীরবে একে অন্যের দিকে তাকাতে লাগল তিন গোয়েন্দা।
সান্ত্বনা দেয়ার ভঙ্গিতে আস্তে করে তার বাহুতে হাত রাখল কিশোর। আজ রাতে এসে পাহারা দেব আমরা। কোনমতে যদি ধরতে পারি বাছাধনকে, জেলের ঘানি না টানিয়ে ছাড়ব না। কত্তবড় সেয়ানা লোক, দেখে নেব।
না না, এ কাজ করতে দেব না আমি তোমাদের! ওঁরা লোক ভাল না। বিপদ হতে পারে। খারাপ কিছু ঘটে গেলে কি জবাব দেব তোমাদের বাবা মার কাছে?
এ নিয়ে এক বিন্দু চিন্তাও আপনি করবেন না, অভয় দিল রবিন। বিপদে পড়লে কি করে উদ্ধার পেতে হয় জানা আছে আমাদের। শুনলে আমাদের আব্বা-আম্মা কিছু তো বলবেই না, বরং তারাও সাহায্য করতে চাইবে আপনাদের।
হ্যাঁ, রবিনের কথায় সুর মিলিয়ে বলল মুসা, কিছু চিন্তা করবেন না আপনারা।
হাসলেন মিসেস সেভারন। কিন্তু দ্বিধা যাচ্ছে না তাঁর। তবু, সাবধান থাকা উচিত তোমাদের।
তা তো থাকবই, জোর দিয়ে বলল কিশোর। আমাদের জন্যে চিন্তা করবেন না।
বিদায় নেয়ার আগে কিশোর জানতে চাইল, হুমকি দিয়ে লেখা নোটটা তার কাছে থাকলে কোন অসুবিধে আছে কিনা।
কি করবে এটা দিয়ে? জানতে চাইলেন মিস্টার সেভারন।
এখনও জানি না। তবে তদন্ত করতে গেলে কাজে লাগতে পারে।
বেশ, রাখো। কাজে লাগলে তো ভালই।
.
টাইপিঙের গোলমালটা চোখে পড়েছে তোমাদের? বাড়ি ফেরার সময় সাইকেল চালাতে চালাতে জিজ্ঞেস করল কিশোর।
হ্যাঁ, রবিন বলল, ও অক্ষরটা সবখানেই বড় হাতের, বাক্যের শুরুতেও, বাক্যের মাঝখানেও। মেশিনের ওই কী টা নষ্ট। টিপতে গেলে বার বার ক্যাপিটল লেটারটাই ওঠে।
সেজন্যেই চিঠিটা নিয়ে এলাম। এই সূত্র ধরেই লেখকের আস্তানা আর তার নামটা খুঁজে বের করে ফেলতে পারব। তারপরে রয়েছে খামের ওপর আঙুলের ছাপ। প্রমাণও করা যাবে কে লিখেছে চিঠিটা, কোনমতেই পার পাবে না। বাগান যে তছনছ করেছে, তাকেও ধরা কঠিন হবে না। চিঠির লেখক আর বাগান তছনছকারী একই লোক হলে তো আরও ভাল।
সেভারনদের ওখানে কটার সময় যেতে হবে? জানতে চাইল মুসা। দেখি।
এগারোটার আগে গিয়ে বোধহয় লাভ হবে না।
.
উষ্ণ রাত। গা আঠা করা গরম। বাতাসে ঝড়ের সঙ্কেত। ওঅকশপের বেড়ায় হেলান দিয়ে রাখা সাইকেল তিনটা যখন সরিয়ে এনে চেপে বসল তিন গোয়েন্দা, এক টুকরো ঘন কালো মেঘ ঢেকে দিয়েছে চাঁদ।
ঝড় আসবে, আকাশের দিকে তাকিয়ে উদ্বিগ্ন স্বরে বলল রবিন।
নৈশ অভিযানের ষোলোকলা পূর্ণ হবে তাহলে, শুকনো গলায় বলল মুসা।
কি আর হবে, শান্ত রয়েছে কিশোর, উত্তেজনাটা বাড়বে আরকি।.
সাইকেলের আলোটা জ্বেলে দিল সে। সামনের জঞ্জালের ওপর ছড়িয়ে পড়ল আলো। প্যাডালে চাপ দিয়ে বলল, চলো, যাই।
.
সেভারনদের বাড়িতে বনের কিনারে একটা ওক গাছের নিচে বসে আছে তিনজনে। মাথার ওপর বাতাসে মড়মড়, সরসর, কটকট করছে গাছের ডালপাতা। কালো মেঘের আড়াল থেকে মুহূর্তের জন্যে বেরিয়ে আবার ঢুকে গেল চাঁদটা। দূর থেকে ভেসে এল বস্ত্রের চাপা গুমগুম শব্দ। পৃথিবীটাকে গুঁড়িয়ে দেবার হুমকি দিচ্ছে যেন।
ব্যাপারটা মোটেও পছন্দ হচ্ছে না আমার, পকেট থেকে চকলেট বের করে মোড়ক খুলতে শুরু করল মুসা। শুধু চোর-ডাকাত হলে এক কথা ছিল, মানুষকে আমি কেয়ার করি না, কিন্তু…
একটা পেঁচা ডাকল ওকের ডালে। কাঁপা, কর্কশ, ভুতুড়ে ডাক ছড়িয়ে পড়ল চতুর্দিকে। সেই সঙ্গে বাতাসের ক্রুদ্ধ ফিসফিসানি মিলে এক ভয়ানক পরিবেশ সৃষ্টি করল। গায়ে কাঁটা দিল মুসার। সরে এসে গা ঘেঁসে বসল দুই সঙ্গীর মাঝখানে।
অন্ধকারে মুচকি হাসল রবিন। ফিসফিস করে বলল, এমন রাতেই ভ্যাম্পায়ারেরা বেরোয়। সেই সিনেমাটাতে দেখোনি, দুটো টিনএজার ছেলেমেয়ে কিভাবে রক্ত খেতে বেরিয়েছিল রাত দুপুরে…
আহ, কি সব অলক্ষুণে কথা শুরু করলে…
চুপ! চাপা গলায় সাবধান করল কিশোর। ওই দেখো!
কি-কি… ভীষণ চমকে গিয়ে তোতলাতে শুরু করল মুসা।
আরে, দেখছ না? ওই যে, ওদিকে।
রবিন আর মুসাও দেখল, পা টিপে টিপে সেভারনদের কটেজের দিকে এগিয়ে চলেছে একটা ছায়ামূর্তি। হাতে ঝুলিয়ে কোন ভারী জিনিস বয়ে নিচ্ছে।
এল কোত্থেকে ও? অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে রবিন। মাটি খুঁড়ে উদয় হলো নাকি?
ভ্যা-ভ্যা-ভ্যাম্পায়াররা যে কোনওখান থেকে…
আমি শিওর, রাস্তায় কোনখানে গাড়িটা রেখে এসেছে ও, মুসাকে থামিয়ে দিয়ে বলল কিশোর। এবং কি গাড়ি, তা-ও বলে দিতে পারি।
হঠাৎ দশদিক আলোকিত করে দিল বিদ্যুতের তীব্র নীল শিখা। ক্ষণিকের জন্যে স্পষ্ট দেখা গেল লোকটাকে। মাথায় ব্যালাক্লাভা ক্যাপ, গায়ে গাঢ় রঙের পোশাক।
সেই লোকটাই! উত্তেজিত হয়ে উঠল কিশোর।
খাইছে! আপনাআপনি মুসার মুখ থেকে বেরিয়ে গেল শব্দটা।
একদৌড়ে ঘাসে ঢাকা সবুজ জমি পেরিয়ে বাগানে ঢুকে পড়ল লোকটা।
আবার বিদ্যুৎ চমকাল। সেই সঙ্গে বিকট শব্দে বাজ পড়ল। মুখ তুলে তাকাল তিনজনেই। ওকের বড় একটা ডালে আঘাত হেনেছে বজ্র। ফুলিঙ্গ আর আগুনের কণা লাফ দিয়ে উঠে গেল কালচে ধোয়াটে আকাশে। আতঙ্কিত চিৎকার করে উড়ে গেল একঝাঁক পাখি।
ভয় পেয়েছে গোয়েন্দারাও। বিমূঢ়ের মত তাকিয়ে দেখল ভেঙে পড়ছে ডালটা।
সবার আগে সামলে নিল মুসা। এক চিৎকার দিয়ে উঠে দাঁড়াল। সামনে ছুটে গিয়ে ডাইভ দিয়ে পড়ল বনের মধ্যে, আরও ঘন গাছপালার আড়ালে। দেখাদেখি অন্য দুজনও তা-ই করল। কানফাটা শব্দ করে ভেঙে পড়ল ডালটা, একটু আগে ওরা যেখানে ছিল ঠিক সেখানে। বড় বাঁচা বেঁচেছে।
ঘাসের মধ্যে উবু হয়ে বসে আছে মুসা। কিশোর আর রবিন বসলে। জিজ্ঞেস করল, লাগেটাগেনি তো?
না, হাঁপাতে হাঁপাতে বলল কিশোর।
রবিনও জানাল লাগেনি।
আবার গা ঘেঁষাঘেঁষি করে বসল তিনজুনে।
যা চেঁচামেচি করলাম, তিক্তকণ্ঠে বলল কিশোর, আশেপাশের দশ মাইলের মধ্যে সবাই জেনে গেছে। বসে থেকে কোন লাভ হলো না। লোকটা নিশ্চয় চলে গেছে।
না, যায়নি, মুসা বলল। ওই যে।
সেভারনদের বাগানেই আছে এখনও লোকটা। বজ্রপাত, ডাল ভেঙে পড়া আর বাতাসের শব্দে বোধহয় চেঁচামেচি কানে যায়নি তার, কিংবা গেলেও মানুষের চিৎকারটা আলাদা করে বুঝতে পারেনি। হাতের ভারী জিনিসটা দেখা যাচ্ছে না। ঝুঁকে আছে ছাউনিটার ধারে। আগুন জ্বলে উঠল। একটা মুহূর্ত আলোকিত করে রাখল লোকটার মাথা।
কি করছে? বাতাসের শব্দকে ছাপিয়ে ফিসফিস করে বলল রবিন।
বুঝতে পারছি না, মুসা বলল। তবে ভঙ্গিতে মনে হচ্ছে না ভাল কিছু।
আবার জ্বলে উঠল আগুন। তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে ছিল এতক্ষণ কিশোর। চিৎকার করে উঠল, সর্বনাশ! ছাউনিতে আগুন ধরিয়ে দিচ্ছে!
.
০৯.
ঝট করে সোজা হলো লোকটা। চারপাশে তাকিয়ে দেখার চেষ্টা করল কে কথা বলেছে। মোরগের মত ঘাড় কাত করে রেখেছে শোনার জন্যে।
শুনে ফেলেছে! কণ্ঠস্বর যতটা সম্ভব খাদে নামিয়ে রেখে রবিন বলল।
কেরোসিন বা পেট্রলে ভেজানো কাপড়ের টুকরোয় আগুন ধরিয়ে ছাউনির ওপর ছুঁড়ে মারল লোকটা। লাফ দিয়ে সরে দাঁড়াল লোকটা। এক মুহূর্ত তাকিয়ে দেখল আগুনটা ধরছে কিনা। তারপর ঘুরে দৌড় মারল সামনের গেটের দিকে। চোখের পলকে গেট পেরিয়ে রাস্তায় চলে গেল।
আবার আলোকিত হয়ে গেল বাগানের একটা ধার। বিদ্যুতের আলোয় নয় এবার, আগুনের। দাউ দাউ করে ধরে যাচ্ছে।
লাফিয়ে উঠে দাঁড়াল কিশোর। জলদি চলো! লম্বা ঘাস মাড়িয়ে ছুটল ছাউনির দিকে।
হোসটা ওদিকে! কাছে পৌঁছে চিৎকার করে বলল সে। পেছনের দরজার ওপাশে আছে, সকালে দেখেছি। বুঝতে পারছে তাড়াতাড়ি নেভাতে না পারলে সামার-হাউসটাতেও ধরে যাবে। রবিন, ট্যাপটা ছেড়ে দিয়ে এসো।
ট্যাপ ছাড়তে গেল রবিন। কিশোর আর রবিন মিলে দ্রুত হোসপাইপটা খুলে ফেলতে শুরু করল। পানি বেরোনোর সঙ্গে সঙ্গে আগুনের দিকে পাইপের মুখ ঘুরিয়ে দিল কিশোর। কিন্তু কমার কোন লক্ষণ নেই আগুনের। ছড়িয়ে পড়ছে দ্রুত। কেরোসিন নয়, পেট্রল ছিটিয়েছে লোকটা। শুধু পানি দিয়ে এ আগুন নেভানো যাবে না। উপায়?
মরিয়া হয়ে সামার-হাউসের দিকে তাকাল কিশোর। দরজাটা খোলা। একদৌড়ে ঢুকে পড়ল সে। গুটিয়ে রাখা পুরানো কার্পেটটা ধরে টান দিল। নড়ে উঠল ওটা। কিন্তু একা একা টেনে বের করা খুব কঠিন কাজ।
এই, এসো তো, ধরো আমার সঙ্গে!
বাইরে বের করে কার্পেট দিয়ে আগুন লাগা জায়গাগুলো ঢেকে দেয়ার চেষ্টা করল ওরা। সেটা আরও কঠিন কাজ। পুরানো আমলের কার্পেট, বেজায় ভারী। আগুনের ওপর ছুঁড়ে মেরে ছড়িয়ে দেয়া সহজ কথা নয়।
নাহ, হবে না! আশা ছেড়ে দিয়ে হাঁপাতে হাঁপাতে বলল রবিন। কিন্তু কাজ বন্ধ করল না। ওপরে ছড়াতে না পেরে কম্বলের কোণা আর ধার দিয়ে বাড়ি মারতে লাগল বেড়ার গায়ে। সেই সঙ্গে চলছে হোস দিয়ে পানি ছিটানো।
আগুনের আঁচে মুখের চামড়া আর চুল পুড়ে যাবার জোগাড় ওদের। ধোয়া বাড়ছে। ঘন হচ্ছে ক্রমে।
কমছে, কমছে! চিৎকার করে উঠল কিশোর। থেমো না। চালিয়ে যাও।
অবশেষে নিভে এল আগুন। বাতাসে ধোয়া, পেট্রল আর কম্বল পোড়া উলের তীব্র গন্ধ। কম্বলটা আগুনের ওপর ফেলে রাখলে নতুন করে অগ্নিকান্দ্রে সৃষ্টি হতে পারে। টেনে সরিয়ে এনে পা দিয়ে মাড়িয়ে পোড়া জায়গাগুলো নিভিয়ে দিতে লাগল মুসা আর কিশোর। ছাউনির যেসব জায়গায় এখনও আগুন জ্বলছে, সেসব জায়গা লক্ষ্য করে সমানে পানি ছিটিয়ে চলল রবিন। পানি লাগলেই ছাঁৎ করে ওঠে আগুন, গলগল করে ধোয়া বেরোতে শুরু করে।
ভাগ্যিস কার্পেটটার কথা মনে পড়েছিল তোমার, স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলল রবিন। ধপ করে বসে কপালে হাত বোলাতে লাগল। শুধু পানি দিয়ে এই আগুন কোনমতেই নেভানো যেত না।
মুসা আর কিশোরও এসে বসল ওর পাশে। দুজনেই ক্লান্ত।
আমরা না এলে আজ এখানে কি ঘটত কে জানে, গম্ভীর স্বরে বলল কিশোর।
দেখো, কি পেয়েছি, হলুদ রঙের একটা ট্রেল ক্যান তুলে দেখাল মুসা। কোল বাঙ্কারের ওপাশে ফেলে দিয়েছিল। ঝাঁকি দিয়ে দেখিয়ে বলল, অর্ধেক ভরা এখনও। সুযোগ পেলে সারা বাড়িই পুড়িয়ে দিত আজ।
হু, মাথা দোলাল কিশোর, কটেজেও লাগাত।
আঁতকে উঠল রবিন। ভেতরে মানুষ আছে জানা সত্ত্বেও!
জানা সত্ত্বেও। বড় ভয়ঙ্কর শক্র সেভারনদের। স্বার্থ উদ্ধারের জন্যে মানুষ খুন করতেও দ্বিধা করবে না, স্পষ্টই বোঝা যাচ্ছে এখন।
চুপ করে ভাবতে লাগল তিনজনেই।
কটেজের পেছনের দরজা খুলে গেল হঠাৎ। বেরিয়ে এলেন মিস্টার আর মিসেস সেভারন। দুজনের পরনেই শোবার পোশাক। আতঙ্কিত ভাবভঙ্গি। ঘরের ভেতর থেকে আগুন লাগাটা নিশ্চয় দেখেছেন তাঁরা। সাহস করে বেরোতে বেরোতে দেরি হয়ে গেছে।
কি ঘটেছে তাদেরকে জানাল তিন গোয়েন্দা।
টর্চ জ্বেলে ছাউনির পোড়া জায়গাগুলো দেখাতে লাগল কিশোর। মাটিতে পড়ে থাকা একটা জিনিসের ওপর চোখ পড়তেই এগিয়ে গিয়ে নিচু হয়ে তুলে নিল। একটা ব্যাজ। জ্যাকেটে লাগানো ছিল। খসে পড়ে গেছে। পরে ভালমত দেখবে ভেবে পকেটে রেখে দিল ওটা সে।
ঝড় থেমে গেছে। কিন্তু আকাশের রঙ এখনও কালির মত কালো। সকাল বেলা আবার আসতে হবে, মনে মনে বলল কিশোর; এত অন্ধকারে রাতের বেলা আর কোন সূত্র খুঁজে পাওয়ার ভরসা কম।
.
কি বলে যে ধন্যবাদ দেব তোমাদের! মিসেস সেভারন বললেন। তিন গোয়েন্দাকে নিয়ে রান্নাঘরে ঢুকেছেন।
আপনাদের কার্পেটটা গেল, প্রশংসা-পর্বটা ধামাচাপা দেয়ার জন্যে বলল রবিন।
যায় যাক, মিস্টার সেভারন বললেন। পড়েই তো ছিল, বরং একটা জরুরী কাজে লাগল।
এখন তো পুলিশকে অবশ্যই জানানো দরকার, গরম চকলেটের মগে চুমুক দিতে দিতে বলল মুসা। ব্যাপারটা এখন বিপজ্জনক হয়ে গেছে। বেপরোয়া হয়ে উঠেছে ওরা। এখনও সাবধান না হলে শেষে মারাত্মক কিছু ঘটে যেতে পারে।
না, পুলিশকে জানাতে এখনও আপত্তি আছে মিস্টার সেভারনের, নিজেরাই সামলাতে পারব আমরা। তোমরা আমাদের সাহায্য করছ, এতেই হবে, পুলিশকে আর দরকার নেই।
ভুরু তুলে দুই সহকারীর দিকে তাকাল কিশোর। অসহায় ভঙ্গি করল মুসা। সেভারনদের অনুমতি ছাড়া পুলিশের কাছে যেতে পারছে না ওরা।
হাত ধোয়ার ছুতো করে বেরিয়ে গেল কিশোর। বাথরূম থেকে ফেরার পথে হলে ঢুকে টেবিলটার সামনে গিয়ে দাঁড়াল। চিঠিগুলো এখনও আগের জায়গাতেই আছে। সেভারনদের ব্ল্যাকমেল করার মাধ্যম যদি চিঠি হয়ে থাকে, অর্থাৎ চিঠি দিয়ে যদি তাদের সঙ্গে যোগাযোগ করে থাকে অগাস্ট শাজিন, তাহলে প্রমাণ জোগাড় করা সহজ হবে। তার দৃঢ় বিশ্বাস, টেলিফোন এবং চিঠি, দুভাবেই হুমকি দিয়ে সেভারনদের জ্বালাতন করছে মহিলা।
খুঁজতে শুরু করল কিশোর।
রান্নাঘরে কথা শোনা যাচ্ছে। বেরোনোর আগে রবিনকে চোখ টিপে বেরিয়েছিল কিশোর। ইঙ্গিতটা বোধহয় বুঝতে পেরেছে রবিন, বুড়োবুড়িকে কথা বলে ব্যস্ত রেখেছে। সুযোগটা কাজে লাগাল কিশোর।
প্রয়োজনীয় জিনিসটা খুঁজে পেতে সময় লাগল না। শাজিন-হ্যারিসন কোম্পানির লোগো ছাপ মারা একটা খাম। তুলে নেয়ার জন্যে হাত বাড়াল কিশোর। উত্তেজনায় কাঁপছে হাতটা।
দ্রুতহাতে খামটা খুলে চিঠি বের করে তাতে চোখ বোলাল। লিখেছে : এটাই তোমাদের শেষ সুযোগ। আমাদের প্রস্তাবে রাজি না হলে সোজা পুলিশকে গিয়ে বলব শাজিন-হ্যারিসন কোম্পানির অফিস থেকে টাকা চুরি করে সেই টাকা দিয়েই কটেজটা কিনেছে তোমাদের ছেলে জ্যাকি, টাকাগুলো সেজন্যেই পাওয়া যায়নি। কটেজটা তোমরা এমনিতেও রাখতে পারবে না, যেভাবেই হোক দখল করে নেয়া হবে; জেদ করে অহেতুক বিপদ আর ঝামেলা বাড়াবে শুধু শুধু। তারচেয়ে আমাদের প্রস্তাবে রাজি হয়ে যাওয়াই তোমাদের জন্যে সবদিক থেকে উত্তম।
তাহলে এই ব্যাপার! ভাল বুদ্ধি বের করেছে শাজিন। নিজের অজান্তেই মৃদু শিস দিয়ে উঠল কিশোর। পুলিশ যদি বিশ্বাস করে বসে চোরাই টাকা দিয়ে কটেজ কেনা হয়েছে, বাজেয়াপ্ত করবে বাড়িটা। তারপর নীলামে বেচে দেবে কোম্পানির টাকা পরিশোধ করার জন্যে। কোম্পানিই তখন কিনে নেবে কটেজ আর আশেপাশের সমস্ত জায়গা।
উত্তেজনায় বুকের মধ্যে কাঁপুনি শুরু হয়েছে কিশোরের। চিঠিটা আবার খামে ভরে রেখে দিল আগের জায়গায়।
পেছনে খুট করে শব্দ হতেই চরকির মত পাক খেয়ে ঘুরে তাকাল সে। ন্টমিক্টার সেভারন দাঁড়িয়ে আছেন। তাকিয়ে আছেন তার দিকে।
চোখে চোখ পড়তেই রাগত স্বরে বললেন, এখানে কি করছ? ব্যক্তিগত চিঠি পড়ছিলে কেন? আমাদের মুখ থেকে শুনে কি বিশ্বাস হচ্ছিল না?
সরি… পেছন থেকে বলে উঠল রবিন। সে-ও এসে দাঁড়িয়েছে দরজায়। ওপরতলায় আমি হাত ধুতে যাওয়ার সময় ধাক্কা লেগে উল্টে পড়েছিল টেবিলটা। তুলে সোজা করে রেখেছিলাম বটে, তবে চিঠিপত্রগুলো সব মেঝে থেকে তোলা হয়নি। তাড়াহুড়োয় তখনকার মত বেরিয়ে গিয়েছিলাম। কিশোরকে বলেছি ঠিক করে সাজিয়ে রাখতে।
আটকে রাখা দমটা সশব্দে ছাড়ল কিশোর। কৃতজ্ঞ দৃষ্টিতে তাকাল রবিনের দিকে। বুদ্ধি করে বাঁচিয়ে দিল।
সন্দেহের দৃষ্টিতে তাকাতে লাগলেন মিস্টার সেভারন। সত্যি বলছ, চিঠিগুলো পড়োনি?
অ্যাঁ… সরাসরি মিথ্যে বলতে বাধছে, একটা জবাব খুঁজে বেড়াচ্ছে। কিশোর যেটা বললে প্রশ্নটা এড়ানো যাবে, আবার মিথ্যেও বলা হবে না।
এবার বাঁচাল মুসা। হলঘরের কথা সে শুনেছে কিনা বোঝা গেল না, রবিনের পাশে এসে দাঁড়িয়ে বলল, কিশোর, কটা বাজল খেয়াল আছে? রাত তিনটে। মা কোন কারণে আমার ঘরে আমার খোঁজ করতে গিয়ে যদি না দেখে, সারা বাড়ি মাথায় করবে…
অ্যাঁ! হাতঘড়ি দেখে আঁতকে ওঠার ভঙ্গি করল কিশোর। সেভারনের দিকে তাকিয়ে বলল, চিঠিগুলোর জন্যে আমি দুঃখিত, মিস্টার সেভারন।
ঠিক আছে, ঠিক আছে। টেবিল থেকে চিঠির বান্ডিল তুলে নিলেন মিস্টার সেভারন। হলুদ লোগোওয়ালা চিঠিটা বের করে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলেন সেটার দিকে। বোধহয় বোঝার চেষ্টা করলেন খোলা হয়েছে কিনা। নীরস কণ্ঠে বললেন, যতবারই আসা যাওয়া করি এখান দিয়ে, চিঠিগুলো চোখে পড়ে, দেখতে দেখতে বিরক্ত হয়ে গেছি…
গটমট করে গিয়ে রান্নাঘরে ঢুকলেন। কয়লার চুলার ঢাকনা খোলার শব্দ শুনল তিন গোয়েন্দা, তারপর সশব্দে বন্ধ হলো আবার।
পুড়িয়ে ফেললেন! চোখের চারপাশ কুঁচকে গেছে রবিনের।
নিরাশ ভঙ্গিতে মাথা নাড়তে নাড়তে কিশোর বলল, বোকার মত প্রমাণগুলোকে নষ্ট করলেন। দাঁড়িয়ে থেকে লাভ নেই আমাদের। চলল, যাই।
ওরা বেরোনোর সময় সামনের দরজা লাগিয়ে দিতে এলেন মিসেস সেভারন। কিশোর বলল, যোগাযোগ রাখবেন। সাহায্যের প্রয়োজন মনে করলে খবর দেবেন আমাদের।
.
রাস্তায় বেরিয়ে জিজ্ঞেস করল রবিন, চিঠিটাতে কি লেখা ছিল?
জানাল কিশোর।
খাইছে! আঁতকে উঠল মুসা। এত্তবড় শয়তান মহিলা তো আর দেখিনি! আমরা এখন কি করব?
ওই মহিলার বিরুদ্ধে প্রমাণ জোগাড় করব। জ্যাকিকে যে ফাসানো হয়েছে, এটা প্রমাণ করতে পারলে ওকে তো বের করা যাবেই, মহিলাকেও জেলের ভাত খাওয়ানো যাবে। তাতে সেভারনদের বাড়িটাও বাঁচবে।
কিন্তু কিভাবে সেটা সম্ভব?
শাজিন-হ্যারিসন কোম্পানির অফিসে গিয়ে তদন্ত করা ছাড়া তো আর কোন উপায় দেখছি না।
গেলেই কি আর তদন্ত করতে দেবে নাকি?
না, দেবে না। গোপনে করতে হবে কাজটা।
কিন্তু ঢোকার জন্যেও তো একটা ছুতো দরকার, রবিন বলল। এই, এক কাজ করলে কেমন হয়? স্কুলের প্রোজেক্টের কাজ নিয়ে গেছি বলব। বলব, রকি বীচের উন্নয়ন নিয়ে বিল্ডিং কোম্পানিগুলো কি ভাবনা-চিন্তা করছে সেটা জানতে গেছি। সুযোগ দিলে অগাস্ট শাজিনের একটা সাক্ষাঙ্কারও নেব।
বুদ্ধিটা ভালই। কিন্তু…
কিন্তু কি?
ব্যালাক্লাভা পরে এসেছিল যে লোকটা, সে তখন অফিসে থাকলে আমাদের চিনে ফেলবে।
মুসাকে সঙ্গে সঙ্গে চিনবে, এটা ঠিক। আমাদের দুজনকে না-ও চিনতে পারে। ওকে নেব না, তাইলেই হবে। কিংবা আরও এক কাজ করা যায়, আমি একাই যাব। রাস্তায় গাড়িটা ছুটে আসার সময় তুমি সামনে ছিলে, তোমাকে দেখার সম্ভাবনা বেশি; আমাকে কম, তাই আমি একা…
তারপরেও ঝুঁকি থেকে যায়…
গোয়েন্দাগিরিতে ঝুঁকি থাকবেই, তাই বলে কি পিছিয়ে যেতে হবে? বহুবার বলা কিশোরের কথাটাই কিশোরকে ফিরিয়ে দিল রবিন।
হেসে ফেলল কিশোর, নিলে একচোট। ঠিকই বলেছ, ঝুঁকির ভয়ে পিছিয়ে গেলে গোয়েন্দাগিরি ছেড়ে দেয়া উচিত।
তাহলে কখন যাচ্ছি?
কাল সকালেই যাও।
.
১০.
পরদিন সকালে ওল্ড প্যাসিফিক স্ট্রীটের এক কানাগলিতে ঢুকল রবিন। ঠিকানা দেখে বাড়িটা খুঁজে বের করতে সময় লাগল না। বাড়ির পেছনে নদী। কিংবা বলা যায় নদীর পাড়ে বাড়িটা, মুখটা অবশ্য রাস্তার দিকে ফেরানো। সামনের দরজায় একটা নোটিশ টানানো, তাতে বলা হয়েছে লিফট নষ্ট। পড়তে গিয়ে একটা জিনিস চোখে পড়ল রবিনের। ইংরেজিতে টাইপ করা লেখাগুলোর ও অক্ষরটা সবখানেই ক্যাপিটাল লেটারে! সেভারনদের বাড়িতে পাওয়া চিঠির লেখার মত! কাজে লাগতে পারে ভেবে নোটিশটা ছিঁড়ে নিয়ে পকেটে রেখে দিল সে।
সাবধানে ঠেলা দিল দরজায়। কাচকোচ করে খুলে গেল পাল্লা। ভেতরে ঢুকল সে। স্লান আলোকিত একটা হলওয়ে।
সামনে ঘোরানো সিঁড়ি উঠে গেছে। সিঁড়ির রেলিঙের বার্নিশ নষ্ট হয়ে গেছে, চটা উঠে গেছে কাঠের। লিফটের দরজায় আরেকটা নোটিশ : লিফট অচল।
নাক কুঁচকাল রবিন। বহুকাল ধরে পরিষ্কার না করলে, অযত্ন অবহেলায় ফেলে রাখলে এ রকম গন্ধ হয়।
সিঁড়ির পাশে দেয়ালে প্লাস্টিকের ফলকে লেখা রয়েছে, শাজিন-হ্যারিসন কোম্পানির অফিসটা তিনতলায়।
সিঁড়ি বেয়ে উঠতে শুরু করল সে। পেছনে পায়ের শব্দ শোনা গেল। ফিরে তাকিয়ে কাউকে দেখল না। একটা দরজা বন্ধ হবার শব্দ হলো। তারপর চুপচাপ।
নিচতলা কিংবা দোতলার অন্য কোন অফিসে ঢুকেছে লোকটা। চেপে রাখা নিঃশ্বাসটা ফেলে আবার উঠতে শুরু করল সে।
তিনতলায় উঠে সামনে একটা দরজা দেখতে পেল। দ্বিধা করে ঠেলা দিল। পাল্লায়। খুলে যেতে ভেতরে পা রাখল।
অফিস নয়, ঢুকেছে একটা ছোট রান্নাঘরে। আসবাবপত্র নেই বললেই চলে। এখানেও অযত্নের ছাপ। নোংরা। একদিকের দেয়াল ঘেঁষে সিংক। ছোট একটা টেবিলে রাখা একটা কালি লাগা কেটলি, পাশে চা-পাতার ব্যাগ। গোটা তিনেক কাপ-পিরিচ আছে।
মেঝেতে চোখ পড়ল ওর। আটকে গেল দৃষ্টি। ধুলোয় ঢাকা ময়লা। মেঝেতে জুতোর ছাপগুলো চেনা চেনা লাগল। কোথায় দেখেছে? মনে পড়ল। সেভারনদের বাগানে। জুতোর সোল অবিকল এক রকম। গোড়ালিতে গোল গোল চক্র। রাতের বেলা চুরি করে যে লোক বাগানে ঢুকেছিল সে এসেছিল এ ঘরে! বিশ্বাস করতে ইচ্ছে হচ্ছে না। তবু চোখের সামনে দেখতে পাচ্ছে অকাট্য প্রমাণ। একই ডিজাইনের জুতো অনেকেই পরতে পারে ভেবে উড়িয়ে দেবার চেষ্টা করল সম্ভাবনাটা, কিন্তু খুঁতখুতি গেল না মন থেকে। এককোণে। একটা কাঠের আলমারি দেখে এগিয়ে গিয়ে দরজা খুলল। ভেতরে হুক থেকে ঝুলছে একটা কালো রঙের জ্যাকেট। ঘরের একমাত্র জানালাটায় উঁকি দিয়ে বাইরে একটা ফায়ার এসকেপ দেখতে পেল।
এ ঘরে আর কিছু দেখার নেই। তবে যা দেখেছে, অনেক। বেরিয়ে এল রান্নাঘর থেকে। পাশে দুটো দরজার পরে আরেকটা দরজা দেখল, পাল্লার গায়ে লেখা রয়েছে অফিস।
দম নিয়ে আস্তে করে টোকা দিল দরজায়। সাড়া এল ভেতর থেকে, আসুন।
পাল্লাটা ফাঁক করে মাথা ঢুকিয়ে দিয়ে বলল সে, হাই।
টেলিফোনের রিসিভার কানে ঠেকিয়ে বসে আছে এক তরুণী, রিসিপশনিস্ট। রবিনের দিকে তাকিয়ে নীরবে হাসল, চেয়ার দেখিয়ে বসতে ইশারা করল।
হাতের ফাইলটা কোলের ওপর রেখে নিরীহ ভঙ্গিতে বসে পড়ল রবিন। চারপাশে তাকাতে গিয়ে চোখ পড়ল পাশের একটা দরজার ওপর, তাতে নেমপ্লেটে লেখা অগাস্ট শাজিন-এর নাম। সামান্য ফাঁক হয়ে আছে পাল্লাটা। টেবিলে রাখা একটা টাইপরাইটারের খানিকটা দেখা যাচ্ছে।
হ্যাঁ হ্যাঁ, ফোনে কথা বলছে তরুণী। কাল রেডি হবে? হবে তো?…ঠিক আছে, আমি নিজেই আসব নিতে…না ভাই, তাড়াতাড়ি দরকার। বড় অসুবিধার মধ্যে আছি। শর্টহ্যান্ডে ডিকটেশন নিতে নিতে আর ভাঙা টাইপরাইটার দিয়ে টাইপ করতে করতে জান শেষ হয়ে গেল।
ডেস্কে রাখা কতগুলো কাগজ দেখতে পেল রবিন। শর্টহ্যান্ডে কি সব লেখা।
ধন্যবাদ, বলে ফোনটা নামিয়ে রাখল তরুণী। রবিনের দিকে তাকাল, বলো?
কাশি দিয়ে গলা পরিষ্কার করল রবিন। মনে মনে গুছিয়ে নিল কথাগুলো। বলল, আমার নাম রবিন মিলফোর্ড। স্কুলের একটা প্রোজেক্টের জন্যে তথ্য জোগাড় করতে এসেছি আমি। স্থানীয় কন্ট্রাক্টর আর বিল্ডাররা আগামীতে শহরটাকে উন্নত করার জন্যে কি কি প্ল্যান করেছে সে-সম্পর্কে জানতে চাই। আগামী দশ বছরে কি কি করছে তারা।
রবিনের কথা শুনে খুশি মনে হলো রিসিপশনিস্টকে। অনেক কাজই করবে, অন্তত আমাদের কোম্পানি। শহরের পশ্চিম ধারে বড় বড় কতগুলো শপিং সেন্টার আর হাউজিং এস্টেট বানানোর পরিকল্পনা আছে আমাদের। কিন্তু সমস্যা হয়েছে জায়গা নিয়ে। কিছু কিছু বাসিন্দা তাদের জায়গা বিক্রি করতে নারাজ। কোনমতেই তাদের বোঝানো যাচ্ছে না।
তাই নাকি? ভুরু উঁচু করল রবিন। তাইলে তো আর হচ্ছে না।
দ্বিধা করল রিসিপশনিস্ট। অবশ্য, মিসেস শাজিন চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন। একবার যেটা ধরেন সেটা শেষ না করে তিনি ছাড়েন না। ম্যানিলা রোডের ধারে যে বন আছে, ম্যানিলা উড, সেটা পরিষ্কার করে একটা ইন্ডাস্ট্রিয়াল পার্ক বানানোরও ইচ্ছে আছে তাঁর। সবচেয়ে ঝামেলাটা হচ্ছে ওখানকার জমি নিয়েই।
কান খাড়া করে ফেলল রবিন। কি ধরনের ঝামেলা?
এক বুড়োর অনেকখানি জায়গা আছে ওখানে। সে ওটা ছাড়তে চাইছে না। এদিকে ভূমি অফিস থেকে নোটিশ দিয়ে দিয়েছে আগামী তিন দিনের মধ্যে যদি মালিকানার দলিল দাখিল করতে না পারেন মিসেস শাজিন, ওই জায়গার মালিক আর হতে পারবেন না। অনুমতিপত্র বাতিল করতে হবে। আবার নতুন করে দরখাস্ত করতে হবে তাকে।
হু, নিজের জায়গা না হলে ঝামেলাই। অন্যের জায়গার ওপর কিছু করার চিন্তা করে আগে থেকেই প্ল্যান করে বসে থাকার কোন মানে হয় না।
তা ঠিক, নড়েচড়ে উঠল রিসিপশনিস্ট। তোমার বোধহয় আরও কিছু জানা বাকি আছে? এক কাজ করো, পেছনের অফিসটায় চলে যাও। অনেক পরিকল্পনার নীলনকশা আর তথ্য লেখা কাগজ দেয়ালে সাটানো আছে, ওগুলো দেখে জেনে নাওগে। আমার জরুরী কাজ আছে। ডেস্কে রাখা কাগজগুলো দেখিয়ে বলল, এ চিঠিগুলো টাইপ করতে হবে। মিসেস শাজিন এসে ঠিকমত না পেলে রেগে যাবেন।
অনেক ধন্যবাদ আপনাকে, উত্তেজনা চেপে রাখার যথাসাধ্য চেষ্টা করছে রবিন। এ ভাবে তাকে ঢালাও সুযোগ দিয়ে দেবে রিসিপশনিস্ট, ভাবতে ন্টপারেনি।
ইচ্ছে করলে ফটোকপিও করে নিতে পারো, তরুণী বলল। পুরানো প্ল্যানের কপিও পাবে তাকে রাখা ফাইলে। সেগুলোও দেখতে পারো। ফাইলিং কেবিনেটের পাশেই পাবে ফটোকপির মেশিন।
রিসিপশনিস্টকে আরও একবার ধন্যবাদ দিল রবিন।
পেছনের ঘরে এসে ঢুকল। কাগজপত্র দেখে দেখে দ্রুত কিছু নোট নিল। যদি রিসিপশনিস্ট দেখতে চায় যাতে দেখাতে পারে। কোন নোটই না নিলে সন্দেহ করে বসতে পারে। এখান থেকেই শুনতে পেল টেলিফোন বাজছে। রিসিপশনিস্টের কথা কানে এল।
ডেড ফাইলস লেখা কেবিনেটটা টান দিয়ে খুলল রবিন। কাগজপত্র ঘাটতে শুরু করল। গায়ে জারভিস লিখে রাখা একটা ফাইল দৃষ্টি আকর্ষণ করল। মনে পড়ল সেভারনদের আগে কটেজটার মালিক ছিল জারভিস নামে এক লোক।
ফাইলটা বের করে এনে খুলল সে। সেভারনদের জায়গাটাতে কি করা হবে, তার দুটো প্ল্যান পাওয়া গেল। মেশিনে ঢুকিয়ে দুটো প্ল্যানেরই একটা করে কপি করে নিল সে। আরও কিছু কাগজপত্রের কপি করে নিল, যাতে রিসিপশনিস্ট দেখলেও বুঝতে না পারে ঠিক কোন কাগজগুলোতে রবিনের আগ্রহ। ফাইলগুলো আবার ঢুকিয়ে রাখল আগের জায়গায়। রাখতে গিয়েই নজরে পড়ল আরেকটা সবুজ ফাইল। কৌতূহলী হয়ে বের করে আনতে যাবে এই সময় অফিসরুমে কথা শোনা গেল।
চলে এসেছেন, রিসিপশনিস্ট বলল। এত সকালে আসবেন তা তো বলেননি।
হ্যাঁ, ডরোথি, আসতে হলো, শোনা গেল অস্বাভাবিক তীক্ষ্ণ একটা কণ্ঠ। জরুরী আরও কয়েকটা চিঠি লিখতে হবে। ডিকটেশন মেশিন আর কম্পিউটারটা এসেছে?
না, রেডি হয়নি এখনও। কাল গিয়ে আনতে বলেছে।
তাই নাকি। তাহলে তো মুশকিল হয়ে গেল…
নিশ্চয় অগাস্ট শাজিন। দেখার জন্যে দরজা ফাঁক করে উঁকি দিল রবিন। কালো জিনস আর কালো শার্ট পরা লম্বা এক মহিলা দাঁড়িয়ে আছে শাজিনের অফিসের সামনে। একটা হাত দরজার নবে। কুচকুচে কালো চুল। চোখও তেমনি কালো। গায়ের রঙ মোমের মত সাদা। ঠোঁটে টুকটুকে লাল লিপস্টিক। হরর ছবির ভ্যাম্পায়ারের কথা মনে পড়িয়ে দেয়-ড্রাকুলার স্ত্রী।
মাথার চুল সরানোর জন্যে হাত তুলল শাজিন। হাতের তালুতে প্লাস্টার। দেখতে পেল রবিন। যখম-টখম হলে এ রকম প্লাস্টার লাগায়।
ডরোথি, এক কাপ কফি দেবে? আর আগের চিঠিগুলো নিয়ে এসো তো। একটু আমার অফিসে। কিছু অদল-বদল দরকার।
অফিসে ঢুকে দরজা লাগিয়ে দিল শাজিন। আর দেরি করল না রবিন। বেরিয়ে এল পেছনের ঘর থেকে।
পেয়েছ? হেসে জিজ্ঞেস করল ডরোথি।
হ্যাঁ, নিচুস্বরে জবাব দিল রবিন। অনেক ধন্যবাদ আপনাকে। কয়েকটা কাগজের কপিও করে নিয়েছি। দেখতে চান?
ডরোথি দেখতে না চাইলেই খুশি হয় রবিন। ভয় পাচ্ছে, কোন সময় বেরিয়ে চলে আসে শাজিন, দেখে ফেলে তাকে। আপাতত ওর সামনে পড়তে চায় না। মহিলাকে দেখেই ওর সামনে যাওয়ার চিন্তাটা বাদ দিয়ে দিয়েছে সে। থাক তো সাক্ষাৎকার নেয়া।
হাত নাড়ল ডরোথি, লাগবে না। নিয়ে যাও।
আরও একবার ধন্যবাদ আর সেই সঙ্গে গুডবাই জানিয়ে তাড়াতাড়ি অফিস থেকে বেরিয়ে এল রবিন। দ্রুতপায়ে নিচে নামতে শুরু করল।
বাইরে বেরিয়ে ঘড়ি দেখল। অনেকক্ষণ লাগিয়ে দিয়েছে। চিন্তায় পড়ে গেছে নিশ্চয় মুসা আর কিশোর।
.
ম্যানিলা রোডে উন্নয়নের প্ল্যানটা পাওনি? জানতে চাইল কিশোর। তিন গোয়েন্দার ওঅর্কশপে বসেছে ওরা।
না, মাথা নাড়ল রবিন। ডিস্ট্রিক্ট কাউন্সিলের অফিসেই রয়ে গেছে হয়তো এখনও। রিসিপশনিস্ট বলল, তিনদিনের মধ্যে জমির মালিকানার দলিল জমা দিতে না পারলে ওদের অনুমতিপত্র বাতিল হয়ে যাবে।
এ জন্যেই মরিয়া হয়ে উঠেছে ড্রাকুলাটা, মুসা বলল। রবিনের মুখে শাজিনের বর্ণনা শুনে প্রথমে তার সন্দেহ হয়েছিল, মহিলাটা আসল ড্রাকুলাই নয় তো? তবে পরে মনে পড়েছে, আসল ভ্যাম্পায়াররা দিনের আলোয় বেরোতে পারে না। শাজিন বেরিয়েছে, তারমানে সে আসল ভ্যাম্পায়ার নয়, মানুষরূপী ভ্যাম্পায়ার-নইলে সেভারনদের মত এত নিরীহ বুড়ো মানুষকে অত্যাচার করতে পারে! তবে তার মতে আসল ভ্যাম্পায়ারের চেয়ে মানুষ-ভ্যাম্পায়াররা অনেক বেশি খারাপ।
ছিড়ে আনা নোটিশটা দেখল কিশোর। সেভারনদের হুমকি দিয়ে লেখা নোটটা বের করল। দুটোতেই ও অক্ষরটা অবিকল এক রকম।
শাজিনের টেবিলে একটা পুরানো টাইপরাইটার দেখেছি, রবিন জানাল, নিশ্চয় ওটা দিয়ে টাইপ করেছে। ওদের কম্পিউটার বোধহয় খারাপ হয়ে গেছে বা কোন কিছু, পচা টাইপরাইটার দিয়ে তাই চিঠি টাইপ করেছে।
হু! মাথা দোলাল কিশোর। তাহলে রান্নঘরের মেঝেতে জুতোর ছাপও দেখেছ?
হ্যাঁ। যে লোক রাতে এসে সেভারনদের বাগান তছনছ করেছে, সেই লোক ঢুকেছিল শাজিনের অফিসের রান্নাঘরে, জ্যাকেট লুকিয়ে রেখেছে আলমারিতে।
এক মুহূর্ত চুপচাপ নিচের ঠোঁটে চিমটি কাটার পর হঠাৎ জিজ্ঞেস করল কিশোর, সেভারনদের কটেজের নকশাটা কপি করে এনেছ কেন?
কৌতূহল হলো, তাই। ভাবলাম, নকশা দেখে সেলার আর ভূতুড়ে ঘরটায় খোঁজাখুঁজি করতে সুবিধে হবে।
হু! চিন্তিত ভঙ্গিতে নিচের ঠোঁটে চিমটি কাটল কিশোর। মুহূর্তে অন্যমনস্ক হয়ে পড়েছে, হারিয়ে গেছে গভীর চিন্তায়।