নকশা – তিন গোয়েন্দা (৯৩) 
প্রথম প্রকাশ: ১৯৯৫

০১.

সন্ধ্যাবেলা ইয়ার্ডের ওঅকশপে বসে আড্ডা দিচ্ছে তিন গোয়েন্দা। ক্যামেরা নিয়ে। আলোচনা হচ্ছে, ইনফ্রারেড-ক্যামেরা। ওরকম একটা ক্যামেরা এই জন্মদিনে উপহার পেয়েছে মুসা। সামনের টেবিলে পড়ে আছে। কাজে লাগাতে পারছে না বলে তার খুব দুঃখ।

এই সময় ফোন বাজল। অলস ভঙ্গিতে হাত বাড়িয়ে রিসিভার তুলে কানে ঠেকাল কিশোর। হালো?

পাশা স্যালভিজ ইয়ার্ড?

হ্যাঁ।

কে, কিশোর? আমি ভিকটর সাইমন।

মুহূর্তে সজাগ হয়ে উঠল কিশোর। নিশ্চয় কোন কেস। ও, আপনি, স্যার? কি খবর?

ভাল। তোমাদের খবর কি? ব্যস্ত?

 নাহ। কাজকর্ম কিছু নেই। বসে বসে ঝিমুচ্ছি।

ভালই হলো। ওয়াল্ট ক্লিঙ্গলস্মিথ নামে এক ভদ্রলোক আমার সামনে। বসে আছেন। ব্যবসায়ী। কারখানার মালিক। একটা বিপদে পড়ে আমার কাছে এসেছেন। কিন্তু আমার এখন মোটেও সময় নেই। তোমাদের কাছে পাঠাচ্ছি। দেখো, কোন সাহায্য করতে পারো কিনা?

বিপদটা কি, স্যার?

 মিস্টার স্মিথকে পাঠাচ্ছি। তার কাছেই শুনো।

এখনই পাঠাবেন?

হ্যাঁ, এখনই।

আচ্ছা, পাঠান। আমরা তিনজনেই আছি।

দ্বিধা করে বললেন সাইমন, আরেকটা কথা, চোখ-কান একটু খোলা রেখো। ক্লিঙ্গলস্মিথের সন্দেহ, তার পেছনে লোক লেগে আছে। ইয়ার্ডেও গিয়ে হাজির হতে পারে ওরা। সাবধান থাকবে।

থাকব।

 কোন দরকার হলে আমাকে ফোন কোরো। বাড়িতেই আছি।

আচ্ছা।

রাখলাম?

আচ্ছা।

কিশোরকে ধন্যবাদ দিয়ে লাইন কেটে দিলেন সাইমন।

উৎসুক হয়ে কিশোরের দিকে তাকিয়ে আছে মুসা আর রবিন। সে রিসিভার রাখতেই মুসা জিজ্ঞেস করল, কি ব্যাপার? কোন কেস?

মাথা ঝাঁকাল কিশোর। আর আফসোস করা লাগবে না। তোমার ক্যামেরা ব্যবহারের সুযোগ এসে গেছে। বাইরে গিয়ে লুকিয়ে বসে থাকোগে। এখন থেকে যে ভেতরে ঢুকবে তারই ছবি তুলে নেবে। গোপনে। কিছু যেন টের না পায়। আমি গেট খুলে রাখছি।

 অবাক হয়ে কিশোরের মুখের দিকে তাকিয়ে আছে মুসা। কিছুই বুঝলাম না!

বুঝতে আমিও পারছি না। মিস্টার সাইমন বললেন চোখ-কান খোলা রাখতে। তা-ই রাখব। ইনফ্রারেড-ক্যামেরার চেয়ে কড়া নজর আর কোন চোখের নেই। লেন্সের সামনে পড়লে আর ফসকবে না। সুতরাং ওই চোখই ব্যবহার করতে বলছি।

আর কোন প্রশ্ন না করে টেবিলে রাখা ক্যামেরাটা তুলে নিয়ে বেরিয়ে গেল মুসা। কাজে লাগানোর জন্যে অস্থির হয়ে ছিল, সেই সুযোগ পেয়ে গেছে আজ।

জঞ্জালের আড়ালে লুকিয়ে বসল মুসা।

ইয়ার্ডের বেশির ভাগ আলোই নেভানো। বোরিস আর রোভারকে নিয়ে রাশেদ পাশা গেছেন পুরনো মালপত্র দেখতে। দোতলার ঘরে মেরিচাচী একা।

রাস্তায় গাড়ি চলাচল করছে। এ ছাড়া আর কোন শব্দ নেই। কয়েক মিনিট পর একটা মোটর সাইকেলের ইঞ্জিনের শব্দ শুনল মুসা। শক্তিশালী ইঞ্জিন। ইয়ার্ডের গেটের কাছে একবার থমকাল মনে হলো, তারপর চলে গেল।

 বসেই আছে মুসা, গেটের দিকে তাকিয়ে। হঠাৎ দেখতে পেল লোকটাকে। কেমন অনিশ্চিত ভঙ্গিতে ভেতরে ঢুকল। এগিয়ে আসতে লাগল। কিছুদূর এসে থমকে দাঁড়াল। তাকাল এদিক ওদিক। এমন ভঙ্গি করল, যেন ভুল করে ঢুকে পড়েছে। ঘুরে আবার এগিয়ে গেল গেটের দিকে। বেরিয়ে গেল।

ততক্ষণে ছবি তুলে ফেলেছে মুসা।

খানিক পর একটা গাড়ি এসে থামল গেটের সামনে। হর্ন বাজাল। ওঅর্কশপ থেকে বেরিয়ে গেল কিশোর আর রবিন। গাড়িটার কাছে গিয়ে দাঁড়াল। আরোহীর সঙ্গে কথা বলে সরে দাঁড়াল।-ভেতরে ঢুকল গাড়িটা। ইয়ার্ডের চত্বরে থামল।

গাড়ি থেকে নামলেন যিনি, তাঁর মাথা জুড়ে টাক, দীঘল শরীর, পরনে ধূসর রঙের পুরানো ছাঁটের স্যুট। হাত বাড়িয়ে দিলেন কিশোরের দিকে।

 ছবি তুলে ফেলল মুসা। শুনতে পেল, ভদ্রলোক বলছেন, আমি ওয়াল্ট ক্লিঙ্গলস্মিথ।

কিশোর পশিা, নিজের পরিচয় দিয়ে হাত বাড়িয়ে দিল গোয়েন্দাপ্রধান। ও রবিন। আমাদের আরেক বন্ধু মুসা আমান, একটা জরুরী কাজে বাইরে গেছে। চলে আসবে।

রবিনের সঙ্গেও হাত মেলালেন স্মিথ। তাঁকে নিয়ে ঘরের দিকে এগোল কিশোর আর রবিন। বারান্দায় উঠল। ঢুকে গেল ভেতরে। বসার ঘরে ঢুকেছে।

ক্যামেরা হাতে বসেই রইল মুসা।

বসার ঘরে ঢুকে স্মিথকে বসতে বলল কিশোর। নিজেও বসল। জিজ্ঞেস করল, চা-টা কিছু দেব?

না না, দরকার নেই, হাত নেড়ে বললেন ভদ্রলোক, মিস্টার সাইমনের বাড়ি থেকে কফি খেয়ে এসেছি। সাংঘাতিক প্রশংসা করলেন তোমাদের। তোমরা নাকি অনেক বড় গোয়েন্দা।

জবাবে শুধু হাসল কিশোর।

কেশে গলা পরিষ্কার করে নিলেন স্মিথ। বললেন, হ্যাঁ, যা বলতে এসেছি সেটাই বলি। আমার এক ভাগ্নেকে খুঁজে বের করে দেয়ার অনুরোধ করব তোমাদের। তার নাম মাটি লফার, সে-ও আমারই মত কারখানার মালিক। অল্প বয়েসেই লস অ্যাঞ্জেলেসের বড় ব্যবসায়ী হয়ে গেছে। মাস তিনেক আগে নিখোঁজ হয়েছে।

চুপ করে রইল কিশোর। অপেক্ষা করছে।

প্লেন নিয়ে বেরিয়েছিল, আবার বললেন স্মিথ। সঙ্গে ছিল তার এক বন্ধু, লুক ব্রাউন। অ্যারিজোনার মরুভূমিতে নেমে কলোরাডো নদীর কাছাকাছি হারিয়ে যায় ওরা। তাদের আর কোন খোঁজ পাওয়া যায়নি। বেমালুম গায়েব।

কিশোর জিজ্ঞেস করল, প্লেনটার কি হয়েছে?

ওটা পাওয়া গেছে। মরুভূমিতে ল্যাণ্ড করেছে। পাহাড়ের খাড়া একটা দেয়ালের কাছে। এর ষোলো মাইল উত্তরে ব্লাইদি নামে একটা শহর আছে।

প্লেনটার কোন ক্ষতি হয়নি? জানতে চাইল কৌতূহলী রবিন।

নাহ, কিছুই হয়নি। ট্যাংকে তেল কমে গিয়েছিল। তবে তার জন্যে মরুভূমিতে ল্যাণ্ড করার কোন প্রয়োজন ছিল না। ইচ্ছে করলে ব্লাইদির কাছে রিভারসাইড কাউন্টি এয়ারপোর্টে ফিরে যেতে পারত। ইঞ্জিনেরও কোন ক্ষতি হয়নি। এই ব্যাপারটাই সবচেয়ে বেশি অবাক করেছে আমাকে। যেন ইচ্ছে করেই নেমেছে লফার, হারিয়ে যাওয়ার জন্যে।

তারমানে মারা যায়নি? অনুমান করল রবিন। হেঁটে চলে গেছে কোথাও কোথায়?

জানি না। সামান্যতম সূত্রও পাওয়া যায়নি।

পুলিশ জানে? ভালমত খোঁজা হয়েছে?

তন্নতন্ন করে। দুই-দুইজন মানুষ, মরে গেছে না বেঁচে আছে, তারও কোন নমুনা নেই। পুলিশ তো খুঁজেছেই, এয়ার ফোর্সও রেসকিউ টিম পাঠিয়েছে, কোন লাভ হয়নি। গত হপ্তায় আমিও গিয়ে শেষ চেষ্টা করে এসেছি। কিচ্ছু পাইনি।

চুপ করে বসে আছে কিশোর। নিচের ঠোঁটে চিমটি কাটছে। কি যেন। একটা কথা মনে করার চেষ্টা করছে। হঠাৎ সোজা হয়ে বসল। কলোরাডো। নদীর কাছে নেমেছে বলছেন?

ভুরু কুঁচকে কিশোরের দিকে তাকালেন স্মিথ। হ্যাঁ। কেন?

ওড়ার সময় নিচে কি দেখেছেন, বলি?

বলো।

দেখেছেন কতগুলো দানবকে। একশো ফুট লম্বা একেকটা।

দানব! অবাক হয়ে কিশোরের দিকে তাকাল রবিন।

ঠিকই বলেছে ও, ওপরে-নিচে মাথা দোলালেন স্মিথ। কিশোরের দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলেন, কি করে জানলে তুমি?

ব্লাইদি নামটা চেনা চেনা লাগল। ভাবতে মনে পড়ে গেল, গত বছর মরুর ওই দানবগুলো সম্পর্কে পড়েছিলাম। মরুভূমির বুকে আঁকা অনেক বড় বড় ছবি। রেখাচিত্র। কয়েকশো বছর আগে নাকি ইনডিয়ানরা একেছিল ওগুলো। রাইদির কাছে কলোরাডো নদীর পাশে আঁকা ছবিগুলো সবচেয়ে বড়।

এতবড় ছবি আঁকল কি দিয়ে ওরা? রবিনের প্রশ্ন।

লাঙলের ফাল জাতীয় কোন যন্ত্র দিয়ে। ওপরের পাতলা বালি আর মাটির আস্তর কেটে গভীর দাগ করেছে নিচের পাথরের মত শক্ত হলদে রঙের মাটিতে। ফুটে উঠেছে দাগগুলো। ছবি হয়ে গেছে।

অবাক কাণ্ড! মরুভূমিতে একশো ফুট লম্বা ছবি আঁকতে গেল কেন ইনডিয়ানরা? মাটি থেকে দেখে যে পরে উপভোগ করবে, তারও উপায় নেই। কিছুই বোঝা যাবে না। অদ্ভুত কিছু রেখাই মনে হবে শুধু!

 অনেক দিনের রহস্য ওটা, স্মিথ বললেন। বিরাট রহস্য। অনেক চেষ্টা করেও এর বিশ্বাসযোগ্য ব্যাখ্যা দিতে পারেননি বিজ্ঞানীরা।

কিশোর বলল, আপনার কি ধারণা ওই দানবগুলোকে দেখেই কৌতূহল হয়েছিল লফার আর ব্রাউনের? আরও কাছে থেকে দেখার জন্যে নিচে নেমেছিল?

মাথা নাড়লেন স্মিথ। না, মনে হয় না। এতবড় ছবি মাটিতে দাঁড়িয়ে দেখে কিছু বোঝা যাবে না, এটুকু বোঝার বুদ্ধি ওদের আছে। সুতরাং নামার অন্য কোন কারণ ছিল। তবে কারণটার সঙ্গে এই ছবির কোন সম্পর্ক থাকাটী অস্বাভাবিক নয়।

আমিও ঠিক এই কথাটাই ভাবছি! কিশোর বলল।

সেই সম্পর্কটা কি? রবিনের প্রশ্ন।

সেটা জানলে তো অনেক প্রশ্নেরই জবাব জানা হয়ে যেত।

একটা মুহূর্ত নীরবে কিশোরের মুখের দিকে তাকিয়ে রইলেন স্মিথ। তারপর বললেন, তোমাদের ব্যাপারে মিস্টার সাইমনের অনেক উঁচু ধারণা। সেটা বিশ্বাস করতে আরম্ভ করেছি এখন। মানুষ চিনতে আমার ভুল হয় না। কি ঠিক করলে, কাজটা নেবে তোমরা? খরচাপাতির জন্যে ভেব না…

মাথা নাড়ল কিশোর। না, ভাবছি না। কাজটা করব আমরা।

ভাল করে ভেবে দেখো। তদন্ত করতে হলে ওই মরুভূমিতে যেতে হবে। তোমাদের…

প্রয়োজন হলে যাবে। অ্যারিজোনা তো হাতের কাছে। বরফের দেশ আইসল্যাণ্ডে গিয়েও রহস্যের তদন্ত করে এসেছি আমরা।

এই প্রথম হাসলেন স্মিথ। ঠিক আছে, করো তদন্ত। কিন্তু তোমাদের আরেক বন্ধু তো এখনও এল না। দেখা হলো না।

কিশোর বলল, ঠিকানা দিয়ে যান, হবে। আজ রাতটা ভেবে নিই, কাল দেখা করব আবার। কি ভাবে কি করব, জানাব তখন আপনাকে।

ঠিক আছে। পকেট থেকে কার্ড বের করে দিলেন স্মিথ। আমি তাহলে এখন যাই।

উঠে দাঁড়ালেন স্মিথ। তাঁকে এগিয়ে দিতে চলল কিশোর আর রবিন।

.

স্মিথকে নিয়ে কিশোররা ঘরে ঢুকে যাওয়ার পর আরও পনেরো মিনিট অপেক্ষা করল মুসা। কাউকে ঢুকতে দেখল না। ভাবল, আর বসে থেকে লাভ নেই। আর কেউ ঢুকবে না। তার চেয়ে বরং যে দুটো ছবি তুলেছে সেগুলো ডেভেলপ করে ফেলা ভাল। দেখাতে পারবে কিশোরকে। যে লোকটা ঢুকে আবার বেরিয়ে গেছে, তার আচরণ সন্দেহজনক। তার পরিচয় বের করা। দরকার।

জঞ্জালের নিচে মোবাইল হোমের ভেতর, তিন গোয়েন্দার হেডকোয়ার্টারে আছে ল্যাবরেটরি। দুটো ছবি ডেভেলপ করে, প্রিন্ট করল মুসা। চমৎকার উঠেছে, খুবই স্পষ্ট। প্রথম ছবিটাতে দেখা যাচ্ছে লোকটা তাকিয়ে আছে কিশোরদের বাড়িটার দিকে। দ্বিতীয় ছবিটার দিকে তাকিয়ে ভুরু কুঁচকে গেল মুসার, অস্ফুট শব্দ করে উঠল। ছবি দুটো নিয়ে লাফ দিয়ে উঠে দাঁড়াল। বেরিয়ে এল হেডকোয়ার্টার থেকে।

ওঅর্কশপটা অন্ধকার। যতদূর মনে পড়ে আলো জ্বেলেই ভেতরে ঢুকেছিল সে। কে নেভাল? কিশোররা কি বেরিয়ে এসেছে? না, তাহলে হেডকোয়ার্টারেই ঢুকত, কিংবা তাকে ডাকত।

মনটা খুঁতখুঁত করতে থাকল তার। তবে ছবির উত্তেজনায় তেমন মাথা ঘামাল না ব্যাপারটা নিয়ে। ওঅর্কশপের দরজায় বেরিয়ে এল।

খসখস শব্দ হলো পেছনে। ফিরে তাকাতে গেল সে। মাথায় যেন বজ্রাঘাত হলো। চোখের সামনে জ্বলে উঠল হাজার কয়েক রঙবেরঙের তারী।

ঢলে পড়ে গেল মুসা।

.

০২.

ওঅর্কশপে আলো নেই দেখে কিশোর আর রবিনও অবাক হয়েছে। ভাবল, কোন কারণে নিভিয়ে দিয়েছে মুসা। স্মিথ গাড়ি নিয়ে বেরিয়ে যাওয়ার পর গেট লাগিয়ে দিল কিশোর। রবিনকে নিয়ে এগোল ওঅর্কশপের দিকে।

মাটিতে বেহুশ হয়ে পড়ে থাকা মুসার গায়ে হোঁচট খেল কিশোর। চিৎকার করে উঠল, মুসা, কি হয়েছে তোমার?– মুসার ভারি দেহটা ধরাধরি করে বসার ঘরে নিয়ে এল সে আর রবিন। লম্বা সোফায় শুইয়ে দিল।

ইয়ার্ডের বেচাকেনার হিসেব নিয়ে বসেছিলেন মেরিচাচী, চেঁচামেচি শুনে। নেমে এলেন। বেহুশ মুসাকে দেখে জিজ্ঞেস করলেন, কি হয়েছে?

কিশোর বলল, কেউ বাড়ি মেরে বেহুশ করে ফেলে রেখে গেছে!

মরবি! এ ভাবেই মরবি তোর একদিন! বলে ছুট দিলেন চাচী। ভেজা তোয়ালে আর স্পিরিট অভ অ্যামোনিয়া নিয়ে এলেন। ততক্ষণে মুসার শার্টের বোতাম, কোমরের বেল্ট খুলে কাপড়-চোপড় ঢিল করে দিয়েছে কিশোর আর রবিন।

তুলোয় স্পিরিট অভ অ্যামোনিয়া ভিজিয়ে মুসার নাকের কাছে ধরলেন। মেরিচাচী। ভেজা তোয়ালে দিয়ে হাত-পায়ের তালু মুছে দিতে লাগল রবিন।

ঝাঁঝাল গন্ধ নাকে ঢুকতে গুঙিয়ে উঠল মুসা।

 কানের কাছে চেঁচিয়ে বলল কিশোর, মুসা, ওঠো! তাকাও! এই মুসা, শুনতে পাচ্ছ? তোমার চকলেট-কেক শেষ হয়ে গেল তো!

চোখ মেলল মুস, চকলেট-কেকের কথা বললে শুনলাম?

হাসি ফুটল মেরিচাচীর ঠোঁটে। হ্যাঁ, ওঠো। আস্তটাই রেখে দিয়েছি তোমার জন্যে।

কি ঘটেছিল, জানার জন্যে প্রশ্নের তুবড়ি ছোটাল কিশোর আর রবিন।

কে যে বাড়ি মারল, কিছুই বলতে পারব না, দুর্বল কণ্ঠে জানাল মুসা। অন্ধকারে দেখতে পাইনি।

তার জন্যে গরম দুধ আনতে চলে গেলেন মেরিচাচী।

কিন্তু বাড়িটা মারল কে? কেন মারল? রবিনের প্রশ্ন।

আন্দাজ করতে পারছি, মুসা বলল। একটা সাংঘাতিক আবিষ্কার করে ফেলেছিলাম। ছবি!

ছবি! দুই ভুরু কুঁচকে কাছাকাছি হয়ে গেল কিশোরের।

উঠে বসল মুসা। মাথা ঝাঁকাল। হ্যাঁ। দুটো ছবি তুলেছি। প্রথম ছবিটা যার তাকে চিনি না। মনে হলো ভুল করে ঢুকে পড়েছে। বুঝতে পেরে বেরিয়ে গেছে। দ্বিতীয় ছবিটা মিস্টার স্মিথের। তাকে দেখে অবাক হতাম না, হয়েছি তাঁর পেছনে আরেকজনকে দেখে। জঞ্জালের ওপাশে ঘাপটি মেরে ছিল। স্পষ্ট হয়ে উঠেছে চেহারা। ছবি দেখেই বোঝা যায় লুকিয়ে লুকিয়ে নজর রাখছে। এই লোকটাকেও চিনি না।

ছবিগুলো কোথায়! অধীর হয়ে জানতে চাইল কিশোর।

বেহুশ হওয়ার আগে পর্যন্ত তো হাতেই ছিল। হয়তো পড়ে গেছে। ওঅর্কশপের দরজায় খুঁজলে পাওয়া যাবে।

কিন্তু পাওয়া গেল না ছবিগুলো।

ওঅর্কশপের দরজায় একটুকরো কাগজ টেপ দিয়ে সটা। তাতে লেখা:

তিন গোয়েন্দা, সাবধান লেখার

নিচে আঁকা একটা রেখাচিত্র। ছবিতে একটা লোক, তার বুকের দিকে তীর তাক করা।

আঁকিয়ে হিসেবে সুবিধের না, রবিন বলল। কিশোর, কি বোঝাতে চেয়েছে?

বোঝাতে চেয়েছে, আমরা যেন সরে থাকি। নাহলে হৃৎপিণ্ড বরাবর তীর মারবে। তুড়ি বাজাল কিশোর, অর্থাৎ, খতম করে দেবে!

নেগেটিভগুলোর জন্যে ল্যাবরেটরিতে ঢুকল ওরা। ছবি ডেভেলপ করার জায়গাটায় জিনিসপত্র উলট-পালট হয়ে আছে। কেউ যে খুঁজে গেছে, বোঝা যায়।

বেশ কিছুক্ষণ খোঁজাখুঁজি করে; ছবি, নিগেটিভ, কিছুই না পেয়ে খালিহাতে ফিরে এল দুই গোয়েন্দা। জানাল কি ঘটেছে।

সব শুনে কিশোরের দিকে তাকিয়ে হাসল মুসা, কেবল নিজেকেই বড় গোয়েন্দা ভাব, তাই না? হঠাৎ করেই মনে হয়েছিল নেগেটিভগুলো মূল্যবান, কোথাও লুকিয়ে রাখা দরকার।

অধৈর্য হয়ে হাত নাড়ল কিশোর, কোথায় রেখেছ?

উঠে দাঁড়াল মুসা। ঘুরে উঠল মাথা। আবার বসে পড়ল সে। খানিকক্ষণ পর একটু সুস্থ হয়ে কিশোর আর রবিনের সঙ্গে চলল ল্যাবরেটরিতে।

একটা উঁচু টুলের নিচে হাত ঢুকিয়ে নেগেটিভ দুটো বের করে আনল। টেপ দিয়ে আটকে রেখেছিল ওখানে।

 ছোঁ মেরে তার হাত থেকে ওগুলো নিয়ে ল্যাবরেটরিতে ঢুকে গেল রবিন। ছবি প্রিন্ট করতে দেরি হলো না। বেরিয়ে এল ভেজা ছবি হাতে। টেবিলে রাখল।

ছবির ওপর হুমড়ি খেয়ে পড়ল কিশোর। প্রথম যে লোকটার ছবি তোলা, হয়েছে, তার ছিপছিপে শরীর, মাথায় ধূসর চুল। আর স্মিথের পেছনে যে লোকটার ছবি উঠেছে, তার কালো চুল, পেশীবহুল দেহ।

তখুনি ফোন করে সাইমনকে সব কথা জানাল কিশোর। তার পরামর্শ চাইল।

পরদিন সকালে ছবিগুলো নিয়ে রকি বীচ পুলিশ স্টেশনে চলল তিন গোয়েন্দা। অফিসেই পাওয়া গেল পুলিশ চীফ ইয়ান ফ্লেচারকে। প্রথম ছবিটার ওপর টোকা দিয়ে গভীর ভঙ্গিতে মাথা নাড়তে নাড়তে বললেন, চিনি এঁকে। নাম মরিস ডুবয়। রকি বীচ সেভিংস ব্যাংকের ট্রাস্টি। ভদ্রলোক, তবে বড় বেশি খামখেয়ালি। পথ চলতে চলতে প্রায়ই নিজের বাড়ি ভেবে ভুল করে অন্যের বাড়িতে ঢুকে পড়েন। অনেকে রিপোর্ট করেছে পুলিশের কাছে। দ্বিতীয় ছবিটীয় টোকা দিয়ে বললেন, এর ব্যাপারে ফাইল না দেখে কিছু বলতে পারছি না।

কিন্তু অপরাধীদের রেকর্ড ফাইলে পাওয়া গেল না লোকটার নাম।

ক্যাপ্টেনকে ধন্যবাদ দিয়ে বেরিয়ে এল গোয়েন্দারা। স্মিথের অফিসে। তার সঙ্গে দেখা করতে চলল।

 মুসার সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিল কিশোর, মুসা, ইনি ওয়াল্ট ক্লিঙ্গলস্মিথ। মার্টি লফারের মামা।

মুসার মাথায় বাড়ি মেরে ছবি নিয়ে যাওয়ার কাহিনী শুনে উদ্বেগ্ন ফুটল ওয়াল্টের চেহারায়। বললেন, থাকগে, তোমাদের আর এর মধ্যে গিয়ে কাজ নেই। পুলিশকেই বলি বরং। দেখুক আরেকবার চেষ্টা করে।

কিশোর বলল, কিন্তু এটা এখন আমাদের চ্যালেঞ্জ হয়ে গেছে, মিস্টার স্মিথ। মুসাকে বাড়ি মারার প্রতিশোধ না নিয়ে ছাড়ব না। আপনি আমাদের কাছে আসায় লোকটা এত খেপে গেল কেন? নিশ্চয় লফারের ব্যাপারে কিছু জানে। এই লোককে খুঁজে বের করতে হবে এখন আমাদের। মনে হচ্ছে, কিডন্যাপ করা হয়েছে আপনার ভাগ্নেকে।

ছবিটা ভাল করে দেখলেন স্মিথ। চেনা চেনা লাগল। হঠাৎ বলে উঠলেন, আরে, এই লোককে তো কাল দেখেছি। আমি বাড়ি থেকে বেরোনোর পর মোটর সাইকেলে করে পিছু নিয়েছিল। মিস্টার সাইমনের বাড়ি পর্যন্ত পিছে পিছে গিয়েছিল। তাকে জানিয়েছি এ কথা।

মুসার মনে পড়ল, আগের সন্ধ্যায় ক্যামেরা নিয়ে যখন লুকিয়ে বসেছিল, তখন গেটের কাছে মুহূর্তের জন্যে থেমেছিল একটা মোটর সাইকেল। সে কথা জানাল সবাইকে।

কিশোরের অনুমান করতে কষ্ট হলো না, সাইমনের বাড়িতে নিশ্চয় জানালার নিচে আড়ি পেতে থেকে কথা শুনেছে মোটর সাইকেল আরোহী, পাশা স্যালভিজ ইয়ার্ডের নাম শুনেছে, বুঝতে পেরেছে এরপর এখানেই আসবেন স্মিথ। তিনি কি করেন, দেখার জন্যে তাই আগেই এসে লুকিয়ে থেকেছে জঞ্জালের আড়ালে। ইনফ্রারেড-ক্যামেরা হাতে মুসাকে ওঅর্কশপে ঢুকতে দেখে আন্দাজ করে ফেলেছে, কি কাজ করেছে মুসা। নিজের ছবি উঠেছে কিনা বুঝতে না পারলেও কোন ঝুঁকি নিতে চায়নি লোকটা। তর্কে তক্কে ছিল, সুযোগ বুঝে কেড়ে নিয়েছে ছবিগুলো। জানালায় আড়ি পেতে স্মিথের সঙ্গে কিশোরদের কি কথা হয়েছে, সেটাও নিশ্চয় শুনেছে। নাহলে ওঅর্কশপের দরজায় হুমকি দিয়ে নোট রেখে যেত না। তারমানে তদন্ত করতে গেলে এই লোকের ব্যাপারে সাবধান থাকতে হবে।

 জরুরী আলোচনার পর স্মিথের অফিস থেকে বেরিয়ে এল তিন গোয়েন্দা। ইয়ার্ডে ফিরল। মরুভূমিতে যাওয়ার জন্যে তৈরি হতে হবে।

সানগ্লাস নিতে হবে, রবিন বলল, আর চওড়া কানাওয়ালা হ্যাট। মরুভূমিতে ভয়াবহ গরম। পানির ক্যান্টিনও লাগবে। আমাদের বার্থ সার্টিফিকেটের কপিও সঙ্গে নেয়া ভাল। বাই চান্স যদি মেকসিকোতে যাওয়া লাগে।

গরম কাপড়-চোপড়ও নিতে হবে, কিশোর বলল। দিনে গরম হলে হবে কি, রাতে কনকনে ঠাণ্ডা।

আজব প্রকৃতি! মুসা বলল। এই মিয়ারা, মরুভূমিতে শুনেছি ভূতের খুব দাপট, ঠিক নাকি?

আরে দূর! হাত নাড়ল কিশোর। ওসব বানানো গপ্পেী।

তবে যে বইতে লেখে…

ও কি আর সত্যি কথা লেখে নাকি? ফ্যান্টাসি গল্প।

 ভরসা কতটা পেল মুসা, তার মুখ দেখে বোঝা গেল না।

তবে পরদিন সকালে মিস্টার সাইমনের বিমানটা দেখা মাত্র উজ্জ্বল হয়ে গেল তার মুখ। প্লেন চালাতে ভাল লাগে তার। এই প্লেনটা আগেও চালিয়েছে। সে, এবার অনেক বেশি সময় চালাতে পারবে, কারণ ওদের সঙ্গে যাচ্ছে না। সাইমনের পাইলট ল্যারি কংকলিন। প্লেনটা তিন গোয়েন্দার দায়িত্বে ছেড়ে দিয়েছেন সাইমন।

মালপত্র নিয়ে প্লেনে চড়ল ওরা। আকাশে উঠল নীল রঙের সুন্দর বিমানটা। প্রথম যাবে স্যান বারনাডিনোতে।

সুন্দর সকাল। নিচে সান্তা মনিকার পাহাড়ের মাথায় ঝলমলে রোদ। প্রশান্ত মহাসাগরকে লাগছে নীল চাদরের মত। গালে হাত দিয়ে প্রকৃতির অপরূপ শোভা প্রাণভরে উপভোগ করতে লাগল কিশোর। মনের সুখে গান ধরল রবিন।

সাগর পেছনে ফেলে উত্তর-পশ্চিম দিকে প্লেন চালাল মুসা।

স্যান বারনাডিনোতে পৌঁছে ল্যাণ্ড করার আগে বিমান বন্দরের ওপরের আকাশে বার দুই চক্কর মারল। টাওয়ারের অনুমতি নিয়ে নামতে শুরু করল। রানওয়েতে মাটি ছুঁয়েছে বিমানের চাকা, এই সময় রানওয়ের শেষ মাথায় একটা কাব বিমান চোখে পড়ল তার। তীব্র গতিতে ছুটে আসছে।

আঁতকে উঠল মুসা। খাইছে! অ্যাক্সিডেন্ট করবে তো!

ভীষণ বেকায়দা। ডানে-বাঁয়ে ঘোরানোর চেষ্টা করলে বিধ্বস্ত হবে বিমান। ব্রেক করলে হুমড়ি খেয়ে পড়বে। ওপরে তুলতে গেলে ধাক্কা লাগবে অন্য বিমানটার সঙ্গে। কি করা? গতি না কমিয়ে সামনে এগোনোর সিদ্ধান্ত নিল সে। আস্তে আস্তে ব্রেক করবে। আর কোন উপায় নেই।

 ব্যাপারটা কিশোর আর রবিনের চোখেও পড়েছে। হাঁ করে তাকিয়ে। আছে। ভয়ে হৃৎপিণ্ডটাও স্তব্ধ হয়ে গেছে যেন। মুসার ক্ষিপ্রতা আর উপস্থিত বুদ্ধিই কেবল এখন বাঁচাতে পারে ওদের।

ধাক্কা লাগে লাগে, শেষ মুহূর্তে নাক উঁচু করে আকাশে উড়ল কবি। ব্রেক কষল মুসা। ওদের মাথার ওপর দিয়ে বিমানের প্রায় পিঠ ছুঁয়ে গেল অন্য বিমানটার চাকা। স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলল সবাই।

বাচলাম! গলা কাঁপছে মুসার। প্রচণ্ড ভয় পেয়েছে।

প্লেন থামতে এগিয়ে এল একজন পাইলট। মুসা নামার সঙ্গে সঙ্গে হাত বাড়িয়ে দিল। দারুণ সামলেছ হে। খুব ভাল পাইলট তুমি। দোষ ওই গাধাটার। অফিসে গিয়ে একটা কমপ্লেন করে রাখো। বলা যায় না, তোমার দোষ দেখিয়ে রিপোর্ট করে বসতে পারে ও। আগেই তৈরি থাকো।

কিন্তু কবিটার রেজিস্ট্রেশন নম্বর লক্ষ করেনি কেউ। ওড়ার আগে টাওয়ারের অনুমতিও নেয়নি পাইলট।

 সেদিন আর মরুভূমিতে যাওয়ার ইচ্ছে হলো না গোয়েন্দাদের। বিমান বন্দর থেকে বেরিয়ে একটা হোটেলে উঠল।

পরদিন সকালে এল আবার। বিমান বন্দরের অফিসে খোঁজ নিয়ে জানা গেল, কাটা নিয়ে সেই পাইলট ফিরে আসেনি।

মরুভূমির উদ্দেশে রওনা হলো তিন গোয়েন্দা।

এঁকেবেঁকে এগিয়ে যাওয়া কলোরাডো নদীর রূপালী পানি চোখে পড়তে কিশোর বলল, মুসা, নিচে নামাও। ভালমত নজর রাখতে হবে। তার কোলের ওপর ক্যালিফোর্নিয়া, মরুভূমি আর অ্যারিজোনার তরাই অঞ্চলের একটা ম্যাপ বিছানো।

ওই দেখো! ডানে হাত তুলে হঠাৎ চেঁচিয়ে উঠল রবিন। একটা দানব!

দেখা গেল একশো ফুট খাড়া উঠে যাওয়া একটা পাহাড়ের দেয়ালের কিনারে আঁকা হয়েছে বিশাল ছবিটা। দেয়ালের কাছে প্লেন নিয়ে গেল মুসা। চক্কর দিতে লাগল একজায়গায়। বলল, আরেকটা পা কি হলো দানবের? ভূতে খেয়ে ফেলল নাকি?

ক্ষয় হয়ে গেছে কোন কারণে, বিস্মিত হয়ে তাকিয়ে আছে কিশোর। ওটার পাশে দেখো আরেকটা ছোট মূর্তি। আশপাশের ওই রেখাগুলো কি?

বড় ছবিটার পাশে ওটার অর্ধেক বড় আরেকটী ছবি। রেখাগুলো তার বড় ভাইয়ের চেয়ে অনেক গভীর করে কাটা হয়েছে। তাই মুছেও যায়নি, ফুটেও উঠেছে অনেক স্পষ্ট হয়ে।

মাঝের ডিজাইনটা ক্রসের মত লাগছে, রবিন বলল।

একে বলে মালটিজ ক্রস, রেফারেন্স বইতে এ ধরনের রেখাচিত্রের ছবি দেখেছে কিশোর। পুরানো ইউরোপিয়ান ডিজাইন। নাইটস অভ মালটা নামে। একটা ক্রসেডর গ্রুপের স্মারকচিহ্ন এটা।

কিন্তু ইনডিয়ানরা নাকি এঁকেছে এই ছবি? প্রশ্ন করল মুসা।

সেটাও একটা ধারণা মাত্র, জবাব দিল রবিন। ইতিমধ্যে এই নকশী নিয়ে বেশ কিছু অধ্যায় পড়ে ফেলেছে সে। যদি তাই হয়ে থাকে, তাহলে এই চিহ্ন প্রমাণ করে প্রাচীন স্প্যানিশ ভ্রমণকারীদের সঙ্গে যোগাযোগ ঘটেছিল ইনডিয়ানদের। আসলে, কেউই ঠিক করে বলতে পারে না কারা একেছিল এই ডিজাইন, কেন এঁকেছিল। এরিক ফন দানিকেন নামে একজন সুইস পুরাতাত্ত্বিকের বিশ্বাস, মহাকাশ থেকে নেমে আসা ভিনগ্রহবাসীর এঁকেছে এই ছবি। কিংবা তাদের নির্দেশে ইনডিয়ানরা এঁকেছে। স্পেশশিপ নিয়ে নামার সময় এই চিহ্ন দেখে বুঝতে পারত প্রাচীন সেই ভিনগ্রহবাসীরা, কোথায় নামতে হবে। যেহেতু আকাশ থেকে আগুনের রথে চেপে নামত ওরা, ইনডিয়ানরা ভাবত দেবতা।

তারমানে ভূতের কথাটা একেবারে মিথ্যে বলিনি! কেঁপে উঠল মুসার গলা। আমার তো ধারণা ভূতে গাপ করে দিয়েছে লফার আর তার বন্ধুকে!

তোমার মাথা! অধৈর্য স্বরে বলল কিশেয়। যত্তসব অবাস্তব ধারণা!

নদীর এ পাড়ে আর কোন ছবি দেখা গেল না। অন্য পাড়ে প্লেন নিয়ে এল। মুসা। কয়েক মিনিটের মধ্যেই চোখে পড়ল আরেকটা দানব। আরও এগোতে বোঝা গেল, একটা দানবীয় কুকুরের ছবি আঁকা হয়েছে।

এখানেই প্লেন নামিয়েছিল লফার, কিশোর বলল।

আশ্চর্য! দেখতে দেখতে বলল রবিন। এত নিখুঁত, দানিকেনের কথাই বিশ্বাস করতে ইচ্ছে করে! মাটিতে দাঁড়িয়ে এই জিনিসের আকৃতি বুঝল কি করে শিল্পী? একমাত্র আকাশ থেকে দেখেই বোঝা সম্ভব!

খানিকটা এগিয়ে আরেকটা মানুষাকৃতির দানব আর ঘোড়ার ছবি দেখা গেল।

অনেকক্ষণ দেখেটেখে কিশোর বল, এবার ফিরে যাওয়া যায়।

ম্যাপে দেখা গেল, কাছাকাছি বিমান বন্দর রয়েছে রিভারসাইড কাউন্টিতে। সেখানে নেমে গাড়িতে করে ব্লাইদিতে যেতে হবে।

বিমান বন্দরের ওপরে এসে রেডিওতে নামার অনুমতি চাইল মুসা। অনুমতি পাওয়া গেল। নিখুঁত ভাবে ল্যাণ্ড করল সে। ট্যাক্সিইং করে এগিয়ে গেল হ্যাঁঙ্গারের দিকে। আগের দিনের মত কোন অঘটন ঘটল না।

প্লেন থেকে নেমে এসে একটা কেবিনে ঢুকল গোয়েন্দারা। চেয়ারে বসে হতি-পা ছড়িয়ে আরাম করছে, এই সময় এগিয়ে এল রুক্ষ চেহারার ছিপছিপে এক লোক। নিজেকে ফেডারেল অ্যাভিয়েশন এজেন্সির লোক বলে পরিচয় দিল। জিজ্ঞেস করল, তোমাদের মধ্যে পাইলট কে? কে প্লেনটা চালাচ্ছিলে?

অবাক হলো তিন গোয়েন্দা। মুসা জবাব দিল, আমি। কেন?

 লাইসেন্স দেখি?

বের করে দিল মুসা।

লাইসেন্সটা খুঁটিয়ে দেখল লোকটা। কোন খুঁত পেল বলে মনে হলো না। মাথা দুলিয়ে বলল, হু, তোমাকেই খুঁজছি। আচমকা কর্কশ হয়ে গেল কণ্ঠস্বর, তোমাকে আমার সঙ্গে যেতে হবে!

.

০৩.

ব্যাপার কি বলুন তো? জানতে চাইল রবিন।

জবাব দিল না বোকটী! মাথা নেড়ে মুসাকে তার সঙ্গে যেতে ইশারা করল। মুসা উঠছে না দেখে তার হাত চেপে ধরে টান দিল।

তাকে প্রায় টেনে নিয়ে চলল, লোকটা। রবিনকে মালপত্রের পাহারায় বসিয়ে রেখে পিছে পিছে চলল কিশোর।

কেবিন থেকে দূরে ছোট একটা বিল্ডিঙের একটা অফিস ঘরে মুসাকে নিয়ে এল লোকটা। কিশোরও ঢুকল সঙ্গে। ডেস্কের ওপাশে বসে আছেন। গোলগাল চেহারার এক ভদ্রলোক। একটা টাইপরাইটার নিয়ে যেন কুস্তি করছেন। রোলারের এ মাথার নব ধরে একবার টানছেন, ওমাথার নব ধরে একবার। নড়াতেও পারছেন না, সরাতেও পারছেন না।

হেসে এগিয়ে গেল কিশোর। বলল, মনে হয় এ জিনিস আর ব্যবহার করেননি? দিন, আমি ঠিক করে দিচ্ছি।

একটা লিভার টিপল সে। ফ্রী হয়ে গেল রোলার। সরাতে আর অসুবিধে হলো না।

বাহ, এত সহজ? ভারি গলায় বললেন ভদ্রলোক। থ্যাংক ইউ। মুসার দিকে তাকিয়ে ছিপছিপে লোকটাকে জিজ্ঞেস করল, ও কে?

স্যার, সেই প্লেনটার পাইলট। স্যান বারনাডিনোতে অ্যাক্সিডেন্ট করছিল। আরেকটু হলেই।

ইশারায় মুসা আর কিশোরকে বসতে বললেন চেয়ারে বসা ভদ্রলোক। মুসার দিকে তাকিয়ে সহানুভূতির সুরে বললেন, তোমার লাইসেন্স ক্যানসেল হয়ে যাবে। সরি, কিছু করার নেই। আকাশের নিরাপত্তার দিকে কড়া নজর রাখতে হয় আমাদের।

ভুরু কুঁচকে গেল মুসার। কিন্তু আমি তো কিছু করিনি..

কিশোর বলল, মনে হয় ভুল ইনফরমেশন পেয়েছেন আপনারা। দোষ ওর নয়, দোষ অন্য বিমানটার। স্যান বারনাডিনো থেকে নিশ্চয় ফোনে। যোগাযোগ হয় আপনাদের? লং ডিসট্যান্স কলে ভুল শোনা যেতেই পারে। দয়া করে আরেকবার যোগাযোগ করুন। টেলিটাইপ করে মেসেজ পাঠাতে অসুবিধে আছে?

না, নেই, মাথা নাড়লেন ভদ্রলোক। এখুনি করছি। আমি হারল্ড ডিক্সন, এই এয়ারপোর্টের ম্যানেজার। ছিপছিপে লোকটার দিকে তাকিয়ে বললেন, বিল, যাও তো, মেসেজ পাঠাও।

মাথা ঝাঁকিয়ে বেরিয়ে গেল বিল।

এখানে কেন এসেছে ওরা, জানাল কিশোর।

মার্টি লফারের নিখোঁজ সংবাদ ডিক্সনও জানেন। বললেন, জানি। মাস তিনেক আগে মরুভূমিতে হারিয়ে গেছে। অনেক খোঁজাখুঁজি হয়েছে, কোন চিহ্নই পাওয়া যায়নি। তোমরা কোন খোঁজ পেয়েছ?

না, মাথা নাড়ল কিশোর। এবং আমরা তার খোঁজ করি এটাও কেউ একজন চায় না। জঞ্জালের আড়ালে লুকিয়ে থাকা রহস্যময় লোকটার কথা। বলল সে। এমনও হতে পারে, লং ডিসট্যান্স কলের জন্যে গণ্ডগোল হয়নি, ফোনে আপনাদের দেয়াই হয়েছে ভুল খবর, যাতে লাইসেন্স কেড়ে নিয়ে আটকে দেন আমাদের। তদন্ত চালাতে না পারি।

খবর আসতে কতক্ষণ লাগবে, স্যার? অধৈর্য হয়ে পড়ল মুসা। পেট যে জ্বলে গেল খিদেয়! লাইসেন্স ক্যানসেলের সঙ্গে কি খাওয়াও ক্যানসেল করে দেয়া হবে নাকি?

হেসে ফেললেন ম্যানেজার। ভাল কথা মনে করেছ। আমারও খিদে পেয়েছে। একটু বসো, খবরটা শুনেই যাই। আমিও বেরোব। ইচ্ছে করলে আমার গাড়িতে একটা লিফট নিতে পারো। শহরে পৌঁছে দেব।

রবিনকে ডেকে আনতে গেল কিশোর।

মালপত্রের বোঝা নিয়ে ওরাও ঢুকল অফিসে, বিলও মেসেজ নিয়ে ফিরে এল। চেহারার কঠোর ভাবটা চলে গেছে তার। বলল, মুসার দোষ নয়, স্যার। ভুল তথ্য দেয়া হয়েছে আমাদের। এ রকম একটা শয়তানি কে করল বুঝতে পারছি না!

কে আর করবে! বিড়বিড় করল মুসা। যে আমার মাথায় বাড়ি মেরেছে…

পায়ে লাথি দিয়ে তাকে চুপ করিয়ে দিল কিশোর। বিলকে সব কথা শোনাতে চায় না। কার মনে কি আছে কে জানে!

অবশেষে ছাড়া পেল মুসা। অফিস থেকে বেরোল ওরা। আটটা বাজে। আকাশের রঙ উজ্জ্বল নীল। মরুভূমির ওপরে শুকনো পর্বতের ঢালে বড় বড় ছায় নামছে। খানাখন্দগুলো অন্ধকার হয়ে গেছে ইতিমধ্যেই, কালচে-নীল দেখাচ্ছে। মনে হচ্ছে পর্বতের গায়ে কালি ঢেলে দিয়েছে যেন কেউ।

কি একখান আকাশ! মুগ্ধ হয়ে দেখতে দেখতে বলল রবিন। পর্বতটাকে এত বড় লাগছে কেন বলো তো?

বাতাস খুব পরিষ্কার বলে, জবাব দিল কিশোর।

মাখন রঙা একটা চকচকে কনভারটিবল গাড়ির কাছে ওদেরকে নিয়ে এলেন ডিক্সন। উঠতে বললেন।

সামনে বসল রবিন আর কিশোর। পেছনে ওদের মালপত্রের গাদার পাশে মুসা। শহরে রওনা হলেন ডিক্সন।

জানালা দিয়ে ঢুকছে উষ্ণ, অস্বাভাবিক কোমল বাতাস। গালে, মুখে লাগছে। তজ্জিব করে দিল গোয়েন্দাদের। সূর্যাস্তের সময়ও বাতাস বড় বেশি শুকননী, বিন্দুমাত্র আর্দ্রতা নেই। শিশিরের কোন লক্ষণই নেই বাতাসে।

আমি তো জানতাম মরুভূমিতে রাতে খুব ঠাণ্ডা পড়ে, ডিক্সনের দিকে তাকিয়ে বলল রবিন।

গরমকালে পড়ে না এখানে, জবাব দিলেন ম্যানেজার। বেডরোল ছাড়াই বাইরে ঘুমাতে পারবে, শীত লাগবে না। মরুভূমিতে ঘুমানোর কথা ভাবছ নাকি?

পরে, কিশোর বলল। আজ রাতে শহরেই থাকব। ভাল জায়গা আছে না?

আছে।

নতুন একটা মোটেলের ড্রাইভওয়েতে গাড়ি ঢোকালেন ডিক্সন। ঘোড়ার খুরের আকৃতিতে তৈরি বিল্ডিং। সাদা রঙ করা। সুইমিং পুলে গাঢ় নীল পানি। তীরে কয়েকজন লোক। ডাইভ দিয়ে পড়লেই পানি ছিটকে উঠছে।

পানি দেখে গা শিরশির করে উঠল মুসার, তখুনি ঝাঁপিয়ে পড়তে ইচ্ছে করল। চমৎকার একটা রেস্টুরেন্টও চোখে পড়ল তার।

নিচতলায় ঘর নিল ওরা। ব্যাগ-সুটকেসগুলো ওখানে রেখে দশ মিনিটের মধ্যে এসে ঝাঁপ দিল পুলের পানিতে। গোসল সেরে রেস্টুরেন্টে গিয়ে গলা পর্যন্ত গিলল।

পরদিন সকালে কিশোর বলল খবরের কাগজের অফিসে যাবে। ব্লাইদির একমাত্র কাগজ Daily Enterprise-এর অফিসে হানা দিল ওরা, লফারের নিখোঁজ হওয়ার খবরটা পড়ার জন্যে।

সাইমন বলেন: গোয়েন্দাদের বন্ধু খবরের কাগজ আর পুলিশ, প্রচুর উপকার পাওয়া যায় তাদের কাছে। প্রথমে খবরের কাগজের অফিসে এল তিন গোয়েন্দা।

পুরানো কাগজে লফার আর ব্রাউনের নিরুদ্দেশের খবর ছাপা হয়েছে, কিন্তু তাতে নতুন কিছু পেল না কিশোর, কেবল রিপ্লির কাছে বিশাল এক দানবের কাছে ওদের প্লেন ল্যাণ্ড করার খবরটা ছাড়া।

পুলিশের কাছে যাবে? জানতে চাইল রবিন।

যাব।

রাইদি পুলিশের কাছেও ভিকটর সাইমন নামটা অপরিচিত নয়, তার সুখ্যাতি তাদের কানেও পৌঁছেছে। তার ওপর তিন গোয়েন্দার কাছে রয়েছে। ইয়ান ফ্লেচারের দেয়া সার্টিফিকেট। সুতরাং রাইদির পুলিশ চীফের সঙ্গে যোগাযোগ করতে অসুবিধে হলো না।

তিনিও নতুন কোন তথ্য দিতে পারলেন না। বললেন, তোমরা যতটা জানো, আমিও ততটুকুই জানি। নতুন কিছু বলতে পারছি না।

হতাশ হয়ে থানা থেকে বেরিয়ে এল তিন গোয়েন্দা। রাইদির প্রধান রাস্তা হবসনওয়ে ধরে এগোল।

কিশোর, এক কাজ করা যাক, হঠাৎ বলে উঠল রবিন, মুসা হবে মার্টি লফার, তুমি আর আমি লুক ব্রাউন!

খাইছে! পাগল হয়ে গেলে নাকি? অবাক হয়ে তার দিকে তাকাল মুসা। মরুর ভূতে আসর করেনি তো

তার কথা এড়িয়ে গিয়ে উত্তেজিত স্বরে রবিন বলল, তুমি প্লেন চালাবে। আমি আর কিশোর হব যাত্রী…

তাই তো করছি। এতে আর নতুন কথা কি?

এবারও মুসার কথায় গুরুত্ব দিল না রবিন। লফাররা যে পথ ধরে উড়ে গেছে, আমরাও সেই পথ ধরে যাব। শেষবার রিভারসাইড কাউন্টি থেকে উড়েছিল ওরা। ডিক্সনের কাছে ওদের ফ্লাইট চার্ট পাওয়া যাবে। আকাশ থেকে একই জিনিস দেখব, একই জায়গায় ল্যাও করব। হয়তো কিছু বোঝা যাবে।

তা যাবে! বিড়বিড় করল মুসা। বুঝব, কি করে গায়েব হয় মানুষ। কারণ আমরাও তো হব!

কিশোর বলল, রবিন কিন্তু মন্দ বলেনি। গায়েব যদি হইই, তাহলে তো আরও ভাল। রহস্যের সমাধান হয়ে যাবে। বুঝে যাব কি ভাবে গায়েব হয়েছে। লফাররা।

তার জন্যে অত কষ্ট করার দরকার কি? আমাকে জিজ্ঞেস করো, বলে দিচ্ছি। ভিনগ্রহ থেকে স্পেসশিপ এসে তুলে নিয়ে গেছে ওদের। আমি বাবা পৃথিবীতেই ভাল আছি, অন্য কোন গ্রহে যেতে রাজি না। আল্লাহই জানে ওরা ওখানে কি খায় না খায়!

মোটেলে ফিরে তাড়াতাড়ি খাওয়া সেরে নিয়ে বেরিয়ে পড়ল আবার তিন গোয়েন্দা। ট্যাক্সি নিয়ে চলল রিভারসাইড কাউন্টি এয়ারপোর্টে।

কড়া রোদ বাড়িটার সাদা দেয়ালে পড়ে ঠিকরে আসছে, চোখে লাগে। দাঁড়িয়ে থাকা বিমানগুলোর ডানা চকচক করছে। চওড়া কানওয়ালা হ্যাট পরেছে কিশোর আর রবিন। মুসা মাথায় দিয়েছে খড়ের তৈরি একটা মেকসিকান সমরেরো হ্যাট।

বাপরে বাপ, কি গরম! বলল সে। একশো আট ডিগ্রি। এয়ারপোর্টের থার্মোমিটারে দেখলাম।

ও তো কিছুই না, রবিন বলল। গরমের দিনে দুপুরবেলা নাকি বালি তেতে একশো পঁয়ষট্টি ডিগ্রি হয়ে যায়। এর মধ্যে হাঁটা লাগলে বুঝবে। ঠেলা।

গুঙিয়ে উঠল মুসা। খাইছে! বলো কি! তাহলে বেরোলাম কেন? মোটেলের পুলই তো আরামের ছিল।

আরাম করতে তো আসিনি আমরা, মনে করিয়ে দিল কিশোর। এসেছি মাটি লফারের খোঁজে। মনে রেখো, খরচটা বহন করছেন তার মামা।

প্লেনের দরজা খুলে দিয়ে দাঁড়িয়ে রইল মুসা। ভেতরে বদ্ধ বাতাস আগুনের মত গরম হয়ে আছে। সেটা বেরিয়ে যাওয়ার সময় দিল।

প্রয়োজনীয় কাগজপত্র আনতে অফিসে গেল কিশোর।

কয়েক মিনিট পর আকাশে উড়ল নীল বিমানটা। এয়ারপোর্টের ওপর একবার চক্কর দিয়ে উত্তরে মরুভূমির দিকে নাক ঘোরাল মুসা।

মুগ্ধ হয়ে নিচের দৃশ্য দেখতে লাগল ওরা। আকাশের ছায়া পড়েছে। কলোরাডো নদীতে, আকাশের মতই নীল। তীরে অপূর্ব সুন্দর হলদে পাতাওয়ালা টামারিস্ক গাছের সারি। এক তীরে শস্য খেত, অন্য তীরে শুকনো টিলা-টক্কর, মালভূমি আর পাহাড়।

মরুভূমি শুনে আমি ভেবেছিলাম শুধু বালি আর পাথরের পাহাড় দেখতে পবি, রবিন বলল। কিন্তু এ কি দেখছি! এত সুন্দর!

বালিই ছিল এককালে, কিশোর বলল। ওই খালগুলো দেখছ না? নদী থেকে পানি নিয়ে যাওয়ার ব্যবস্থা করেছে ওগুলো দিয়ে। মাটি ভিজিয়ে ফসল ফলিয়েছে।

এক জায়গায় বড় একটা নিঃসঙ্গ দানব আঁকা আছে, আগের দিনই দেখে গেছে। সেটার কাছে এসে ভাল করে দেখার জন্যে নিচুতে বিমান নামিয়ে। আনল মুসা।

একটা টিলা আছে। প্রায় একশো ফুট উঁচু। একধারে খুবই খাড়া, আরেক ধীর ঢালু। ঢালু ধারটার কাছে সমতল জায়গায় বিমান নামানো সম্ভব। ল্যাণ্ড করল মুসা।

বিমান বন্দর থেকে আনা ফ্লাইট চার্ট দেখে রবিন বলল, এখানেই ল্যাণ্ড করেছিল লফাররা। তারপর কি করেছে?

 হয়তো গিয়ে ওই টিলাটার ওপর উঠেছে, কিশোর অনুমান করল, চারপাশটা দেখার জন্যে।

বিমান থেকে নেমে এসে টিলাটায় উঠল ওরা। ওপরটা সমতল, অনেকটা মালভূমির মত। রুক্ষ, কঠিন মাটি চারপাশে, তাতে বিছিয়ে আছে নুড়ি পাথর। এখানে ওখানে দু-চারটা ছোট ছোট শুকনো ঝোপ। বিরান প্রকৃতি।

দেখো, একটা রাস্তা, মুসা বলল, রাস্তাটা কি অদ্ভুত! মনে হয় কেউ যেন ঝড় দিয়ে নুড়ি সরিয়ে তৈরি করেছে।

রাস্তা না ওটা, রবিন বলল। একটা দানবের পা।

চিন্তিত ভঙ্গিতে তাকিয়ে আছে কিশোর। বলল, ভাবছি, এই টিলা মানুষের তৈরি নয়তো? প্রাচীন ইনডিয়ানরাই কি বানিয়েছিল চূড়ার ওপর ছবি আঁকার জন্যে?

হতে পারে, সমর্থন করল রবিন। আর দানবের অবস্থানটারও হয়তো কোন মানে আছে।

টিলাটার ওপর ঘুরে বেড়াতে লাগল ওরা। যত দিক থেকে সম্ভব দেখছে।

আচমকা দাঁড়িয়ে গিয়ে রবিন বলল, লফার যদি এখানে উঠে থাকে, কি পড়েছিল তার চোখে?

রবিনের পাশে দাঁড়িয়ে মুসাও দেখতে লাগল।

দানবের বাঁ হাতটীর ওপর দাঁড়িয়ে মরুভূমির দিকে তাকিয়ে আছে। কিশোর। হঠাৎ চিৎকার করে উঠল, ওই দেখো কি চকচক করছে।

ধাতব কিছু? রবিনের প্রশ্ন।

চলো না গিয়েই দেখি।

ঢাল বেয়ে নামতে শুরু করল কিশোর, পেছনে তার দুই সহকারী। ঢালের গোড়ায় পা দিয়েই থমকে দাঁড়াল সে। পরক্ষণে লাফ দিয়ে পিছিয়ে। এল। চিৎকার করে বলল, খবরদার!

.

০৪.

মাথা তুলল প্রায় দুই ফুট লম্বা একটা গিরগিটি। ভীষণ রাগে ফোঁস ফোঁস করছে। ধীরে ধীরে এগিয়ে আসছে কিশোরের দিকে। সাপের জিভের মত চেরা লাল একটা জিভ ভয়ানক ভঙ্গিতে বার বার বেরোচ্ছে মুখের ভেতর থেকে।

আরেকবার লাফ দিয়ে আরও পিছিয়ে এল কিশোর। মূসা আর রবিন দাঁড়িয়ে গেছে। তাকিয়ে আছে গিরগিটিটার দিকে। চামড়ার রঙ কালচে বেগুনী। তাতে হলুদ রঙের গোল গোল ছাপ। সারা শরীরে অসংখ্য আঁচিলের মত জিনিস কুৎসিত করে তুলেছে প্রাণীটাকে।

খাইছে! ঠিকরে বেরিয়ে আসবে যেন মুসার চোখ। কি এটা? কুমিরের বাচ্চার ব্যারাম হয়েছে?

হিলা মনস্টার, স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে কিশোর। জোরে দৌড়াতে পারে না বটে, তবে দাঁতের নাগালে পেলে সর্বনাশ করে দেবে। সাংঘাতিক বিষাক্ত।

থেমে গেল গিরগিটিটা। ঠাণ্ডা, কুৎসিত চোখ মেলে দেখছে গোয়েন্দাদেরকে।

আমাদের ভয় দেখানোর চেষ্টা করছে, হেসে বলল রবিন।

সার্থক হয়েছে তার চেষ্টা, মুসা বলল। ভয়ে কলজে শুকিয়ে গেছে। আমার। এমন ভূতুড়ে জানোয়ার জনমেও দেখিনি। দাঁড়িয়ে থাকব কতক্ষণ। নড়লেই তো মনে হচ্ছে নড়ে উঠবে!

উঠুক। না দেখে গায়ে পা দিয়ে ফেললে বিপদ, কামড়ে দিতে পারে, কিশোর বলল। দেখে যখন ফেলেছি, আর কিছু করতে পারবে না। দৌড়ে পারবে না আমাদের সঙ্গে। তবে সাবধান যে করে দিয়েছে, এ জন্যে একটা ধন্যবাদ ওর পাওনা। ওর জাতভাইরা আরও অনেক আছে এই অঞ্চলে। বালি আর ঝোপের মধ্যে চুপ করে পড়ে থাকলে চোখে পড়বে না। ভুল করে পা দিয়ে ফেললেই মরব। সুতরাং, সাবধান!

কয়েক মিনিট একভাবে দাঁড়িয়ে থেকে ফোঁস ফোঁস করল হিলা মনস্টার। বিপদের আশঙ্কা নেই দেখে ঘুরল। অলস ভঙ্গিতে হেলেদুলে আস্তে আস্তে গিয়ে ঢুকে পড়ল একটা ঝোপে।

আবার পা বাড়াল তিন গোয়েন্দী। এগিয়ে চলল চকচকে জিনিসটার দিকে। হাঁটছেই, হাঁটছেই, কিন্তু জিনিসটার কাছে পৌঁছতে পারার কোন লক্ষণ দেখতে পাচ্ছে না। আশ্চর্য!

পায়ে মোকাসিন পরেছে ওরা। তলা ফুড়ে যেন উঠে আসছে তপ্ত বালির ভয়ানক উত্তাপ।

রুমাল বের করে মুখ মুছতে মুছতে মুসা বলল, বাপরে বাপ, হিলা মনস্টারের বাচ্চা এই বালিতে হাঁটে কি করে! পায়ে কিসের চামড়া লাগানো!

কিসের আর, ওরই চামড়া, কিশোর বলল। গরম বালিতে চলার উপযোগী করেই বানিয়ে দিয়েছে প্রকৃতি।

কিন্তু ওই চকচকে জিনিসটা কাছে আসে না কেন? ভূতুড়ে কাণ্ড মনে হচ্ছে!

ভূতটা আসলে বাতাস। বেশি হালকা বলে এখানে অনেক দূরের জিনিসও কাছে মনে হয়।

অবশেষে পৌঁছল ওরা ওটার কাছে। গোল একটা জিনিস রোদে পড়ে চমকাচ্ছে।

তুলে নিল রবিন। বড় একটা পাথর, তাতে ছোট ছোট অন্য পাথর গাঁথা। কোনটী গাঢ় লাল, কোনটা বাদামী, কিছু আছে সবুজ। নাড়াচাড়ায় গায়ে রোদ পড়লেই ঝিক করে উঠছে পাথরগুলো।

কিশোরকে দেখিয়ে জিজ্ঞেস করল সে, কি এটা, বলো তো? কোন ধরনের স্ফটিকের সমষ্টি?

সম্ভবত জ্যাসপার।

 মুসা জানতে চাইল, দামী জিনিস? হীরার মত?

হীরার মত অত দাম না হলেও, দামী, তাতে কোন সন্দেহ নেই।

আশেপাশে খুঁজল ওরা। ওরকম পাথর আর একটাও পাওয়া গেল না।

অবাক কাণ্ড! রবিন বলল। এটী এখানে এল কোত্থেকে?

মাটির দিকে তাকিয়ে আছে কিশোর। তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে দেখতে দেখতে নিজেকেই প্রশ্ন করল, এর সঙ্গে লফারের নিখোঁজের কোন সম্পর্ক নেই তো?

বুঝতে পারল না মুসা। মানে?

এখানে জন্মালে এ রকম পাথর আশেপাশে আরও থাকার কথা। নেই কেন?

হয়তো ছিল, রবিন বলল। আকাশ থেকে চোখে পড়েছে লফার আর ব্রাউনের। এগুলোর জন্যেই নেমেছিল ওরা। তুলে নিয়েছিল।

মাথা ঝাঁকাল কিশোর। ঠিক এই কথাটাই বলতে চাচ্ছি আমি। সবই নিয়ে গেছে, কিন্তু এই একটা কোনভাবে রয়ে গেছে এখানে। হয়তো কাড়াকাড়ির সময় পড়ে গেছে। সেজন্যেই লফার আর ব্রাউন নিখোঁজ।

অস্বস্তি ফুটল মুসার চোখে। কিশোরের কথা এতক্ষণে বুঝেছে। আচ্ছা, বুঝলাম! ওদেরকে খুন করে পাথরগুলো ডাকাতেরা কেড়ে নিয়ে গেছে সন্দেহ করছ! মরুভূমিতে লাশ গুম করে ফেলেছে।

করলে অবাক হওয়ার কিছু নেই, রবিন বলল। দামী পাথরের জন্যে মানুষ খুন হওয়াটা নতুন কিছু নয়।

উফ, কি রোদরে বাবা! সিদ্ধ হয়ে গেলাম! মুখ দিয়ে বাতাস ছাড়ল কিশোর। এখানে আর দেখার কিছু নেই। চলো, প্লেনে গিয়ে বসি।

প্লেনের দিকে হাঁটতে লাগল ওরা। মনে হচ্ছে কাছে, অথচ যতই হাঁটে, পথ আর ফুরায় না।

ভারী পাথরটা নিয়ে হাঁটতে গিয়ে ঘেমে নেয়ে গেল রবিন। তা দেখে মুসা বলল, দেখি, দাও আমার কাছে।

পাথরটা মুসার হাতে তুলে দিয়ে বাঁচল রবিন।

কিছুদূর এগিয়ে মুসারও হাঁপ ধরে গেল। বলল, খাইছে! এটী পাথর না লোহারে বাবা! দশ টন ওজন হবে!

তার কথা শেষ হতে না হতেই চেঁচিয়ে উঠল রবিন, ওই দেখো, হিলা মনস্টার!

কই, কোথায়! এতটাই চমকে গেল মুসা, হাত থেকে ছুটে উড়ে গিয়ে পড়ল পাথরটা। লাফ দিয়ে সরে দাঁড়ল সে।

তবে অত চমকানোর কিছু ছিল না। বেশ দূরে রয়েছে গিরগিটিটা। ওদের দিকে তাকাল না। ধীর পায়ে হেঁটে গিয়ে ঢুকল একটা ঝোপের মধ্যে।

কিন্তু পাথরটা আর দেখতে পেল না ওরা। গেল কোথায়?

ওটাতে পড়ল না তো? একটা গর্ত দেখিয়ে বলল রবিন।

গর্ত না বলে সরু একটা ফাটল বলা উচিত। বেশ গভীর। দেখা গেল, তার মধ্যেই পড়েছে পাথরটা। তুলতে কষ্টই হলো। সাবধান থাকতে হলো হিলা মনস্টারের ব্যাপারে। গর্তে থাকলে কামড়ে দিতে পারে। আর কামড়ালে মরতে হবে।

মুসা কিছুক্ষণ বহন করার পর পাথরটার ভার নিল কিশোর। ভাগাভাগি করে বয়ে এনে প্লেনে তোলা হলো ওটাকে।

রিভারসাইড কাউন্টি এয়ারপোর্টে যখন পৌঁছল ওরা, বিকেল পাঁচটা বেজে গেছে।

পেটের মধ্যে নাড়িভূড়িও নেই আর আমার, ঘোষণা করল মুসা। এখন গিয়ে সুইমিং পুলে কয়েকটা ডুব, তারপর পেট ভরে গরুর শিককাবাব

ম্যানেজার হারল্ড ডিক্সনকে এগিয়ে আসতে দেখে থেমে গেল সে।

কাছে এসে জিজ্ঞেস করলেন তিনি, তারপর? কেমন কাটল? কি দেখে এলে?

হিলা মনস্টার, জবাব দিল মুসা।

হাসলেন ডিক্সন। ও আর এমন কি। কিছুদিন একটা মনস্টার পুষেছিলাম আমি। বাসন থেকে দুধ খেত ওটা। বেড়ালের মত এসে আমার কোলে উঠত।

বলেন কি! ঢোক গিলল মুসা। ওই কুৎসিত প্রাণীটাকে ধরতে খারাপ লাগত না আপনার?

না, লাগত না। ওটাকে শিস দিতে শিখিয়েছিলাম। বেশিদিন আটকে রাখিনি। ছেড়ে দিয়েছি মরুভূমিতে।

পাথরটা দেখাল তাঁকে রবিন। এটা পেয়েছি।

ডিক্সন বললেন। মরুভূমিতে গেলে এ সব পাথর অনেকেই পায়। আমরা। একে বলি চাইনিজ জেইড।

দামী?

আছে। মোটামুটি।

আপনার কি মনে হয়, এই পাথরের জন্যে ডাকাতেরা মানুষ খুন করবে? আকাশ থেকে এ সব দেখেই হয়তো নেমেছিল লফার আর ব্রাউন। তারপর ওগুলোর জন্যে খুন হয়েছে। হতে পারে না?

 চাইনিজ জেইডের জন্যে মানুষ খুন হয়েছে এই এলাকায়, শুনিনি কখনও।

তাহলে হয়তো পাথর দেখে কৌতূহলী হয়ে নেমেছিল ওরী, মরুভূমিতে পথ হারিয়েছে। কিংবা জখম হয়ে পর্বতের মধ্যে আটকা পড়েছে।

শ্রাগ করলেন ডিক্সন। জখম হলে একজন হবে, দু-জন হওয়াটা অস্বাভাবিক। সেক্ষেত্রে আরেকজন প্লেন চালিয়ে নিয়ে আসতে পারত। আর পর্বতে গেলে টিলার কাছে প্লেন ফেলে যাবে কেন? মরুভূমিতে হাঁটীর চেয়ে। প্লেন নিয়ে যাওয়াই সহজ।

তা-ও বটে। চুপ হয়ে গেল রবিন।

কিশোর জানতে চাইল, লফারের প্লেনটা এখন কোথায়? জানেন?

আমাদের এখানেই, জবাব দিলেন ডিক্সন।

 একটু দেখা যাবে?

হেসে বললেন ডিক্সন, সূত্র খুঁজতে চাও তো? ওদিককার হ্যাঁঙ্গারে আছে। পকেট থেকে চাবি বের করে দিলেন। নাও। দেখা হয়ে গেলে ফেরত দিয়ে যেয়ো।

ম্যানেজারকে ধন্যবাদ দিল কিশোর। পাথরটা আবার প্লেনের ভেতরে রেখে এসে দরজা লাগিয়ে দিল। দুই সহকারীকে নিয়ে রওনা হলো হাঙ্গীরের দিকে।

লাল আর সাদা রঙের একটা সুন্দর বিমান লফারের। চার সীট। কেবিনের একদিকের দরজা হাঁ হয়ে খুলে আছে।

ব্যাপারটা অবাক করল রবিনকে। দরজা লাগায়নি কেন?

 তার প্রশ্নের জবাব দিতে পারল না কেউ।

ইনস্ট্রুমেন্ট প্যানেলে খুঁজতে লাগল কিশোর। মুসা গেল মালপত্র রাখার জায়গায়। গ্লীভ কম্পার্টমেন্টে হাত দিল রবিন। হলদে রঙের একটুকরো কাগজ পেল। পেন্সিলে লেখা নোটটার দিকে একনজর তাকিয়েই চিৎকার করে উঠল। সে, অ্যাই, দেখে যাও!

কাগজটাতে কবিতার মত করে লেখা:

তিন গোয়েন্দা সাবধান;

গোলাপের রঙ লাল,
ভায়োলেটের রঙ নীল,
লফারকে কবর দিয়েছি আমরা।
সময়মত না যদি সরো
সেথায় যাবে তোমরাও!

.

০৫.

শিস দিয়ে উঠল মুসা, কোন ব্যাটার কাজ!

হবে কোন বদমাশ! জবাব দিল রবিন।

রসিক বদমাশ, নিচের ঠোঁটে চিমটি কাটল কিশোর। এই নোটের কথা ডিক্সনকে বলার দরকার নেই। তবে দরজা খোলা পাওয়া গেছে, এটা জানাতে হবে তাকে। দরজা যে খুলেছে, নোটটা সে-ই রেখে গেছে।

কিন্তু কখন রাখল? নিশ্চয় রাতের বেলা এক ফাঁকে ঢুকে রেখে গেছে। জানত, কোন না কোন সময় বিমানটাতে তল্লাশি চালাতে আমরা আসবই।

তার মানে আমাদের গতিবিধির ওপর পুরো নজর আছে ওর। কাগজটা যত্ন করে পকেটে রেখে দিল কিশোর। মিস্টার সাইমনের সঙ্গে কথা বলা দরকার। চলে রেখে দিল কিশোর পর পুরো নজর আছে

ডিক্সনকে চাবি ফিরিয়ে দিল কিশোর। বিমানটাতে লোক ঢুকেছিল। জানাল। তারপর মোটেলে ফিরে ফোন করল রকি বীচে সাইমনের বাড়িতে।

ফোন ধরল কিম। জানাল, মিস্টার সাইমন বাড়িতে নেই। জরুরী কাজে বাইরে গেছেন। কোথায় গেছেন, তা-ও বলতে পারল না। তিন গোয়েন্দার জন্যে একটা মেসেজ রেখে গেছেন।

মেসেজটা কিমকে পড়তে অনুরোধ করল কিশোর।

কিম পড়ল, রাইদি থেকে চলে এসো। লস অ্যাঞ্জেলেসে এসে তদন্ত করো। হোটেলে থাকবে, বাড়ি ফেরার দরকার নেই। লফারের অফিস আর তার পরিবারের সঙ্গে যোগাযোগ করে খোঁজখবর নাও। আশা করছি, শীঘ্রি তোমাদের সঙ্গে দেখা হবে। ভিকটর সাইমন।

পরদিন সকালে মালপত্র গোছগাছ করে ঘর থেকে বেরিয়ে এল তিন। গোয়েন্দা।

মোটেলের ম্যানেজার বলল, এত তাড়াতাড়িই চলে যাচ্ছ?

হ্যাঁ, জবাব দিল কিশোর। জায়গাটা ভাল লাগল না। দেখার তেমন কিছু নেই।

সব ঠিকঠাক মত নিয়েছ? ফেলে যাওনি তো কিছু? গেলে দয়া করে আমাদের বাড়িতে পাঠিয়ে দেবেন। এই যে রইল, ঠিকানা।

ঠিক আছে।

প্লেনে করে লস অ্যাঞ্জেলেসে আসতে বেশি সময় লাগল না। বিমানটা এয়ারপোর্টে রেখে ট্যাক্সি করে এসে শহরের একটা পুরানো হোটেলে উঠল ওরা।

জানালা খুলে বাইরে মুখ বের করে দিল মুসা। বলল, ফায়ার-এসকেপ আছে। আগের দিনে যেমন বানাত লোকে।

থাকবেই, রবিন বলল। বাড়িটা বানানো হয়েছে অনেক দিন আগে।

গোসল সেরে খেয়ে নিল ওরা। মুসা জিজ্ঞেস করল, এবার কি করব? কিশোর, মিস্টার ক্রিস্টোফারের দেয়া সেই পাসগুলো তো কোনদিন কাজে লাগল না। এবার লাগালে কেমন হয়?

এক সময় তিনটে পাস দিয়েছিলেন, তিন গোয়েন্দাকে বিখ্যাত চিত্রপরিচালক মিস্টার ডেভিস ক্রিস্টোফার। ওগুলো দেখিয়ে যখন তখন হলিউড কিংবা লস অ্যাঞ্জেলেসের যে কোন স্টুডিওতে শূটিং দেখতে ঢুকতে পারবে ওরা। এবার বাড়ি থেকে বেরোনোর আগে কিশোরের মনে হয়েছিল, লফারের ব্যবসা যখন লস অ্যাঞ্জেলেসে, এদিকে তদন্তের জন্যে আসতেও হতে পারে। পাসগুলো ব্যবহারের সুযোগ মিলতে পারে তখন।

মন্দ হয় না, কিশোর বলল। কিন্তু যাব কখন? আমি তো ভাবছি পুলিশ হেডকোয়ার্টারে যাওয়ার কথা। লফারের খোঁজ নিতে।

তিনজন একসাথে গিয়ে কি করব? তুমি আর রবিন যাও। আমি বরং স্টুডিওতে চলে যাই।

হেসে বলল রবিন, খুব মনে হয় শূটিং দেখতে ইচ্ছে করছে?

হোটেল থেকে বেরিয়ে মুসা গেল শূটিং দেখতে। রবিন আর কিশোর চলল পুলিশ হেডকোয়ার্টারে।

কিন্তু নতুন কিছু জানতে পারল না। একজন পুলিশ সার্জেন্ট কথা বলল ওদের সঙ্গে। বলল, লফারের ব্যাপারটা সত্যি অবাক করে দিয়েছে আমাদের। কোনই হদিস নেই। লুক ব্রাউনের ব্যাপারেও কিছু জানি না। ব্লাইদি পুলিশও তেমন কিছু বলতে পারেনি।

আপনার কি মনে হয় মিসেস লফার আমাদের সঙ্গে দেখা করবে?

করবে। তার স্বামীর ব্যাপারে কেউ আগ্রহ দেখালে খুশি হয় সে। বেচারী: লফারের অফিসে তার সেক্রেটারির সঙ্গেও কথা বলতে পারো ইচ্ছে করলে।

সার্জেন্টের কাছ থেকে বিদায় নেয়ার আগে গোয়েন্দাদের সাবধান করে দিয়ে বলল সে, বিপদের আশঙ্কা দেখলেই আমাকে জানাবে। কোন রকম ঝুঁকি নিতে যেয়ো না। তার জন্যে পুলিশই আছে।

সার্জেন্টকে ধন্যবাদ দিয়ে বেরিয়ে এল কিশোররা। হোটেলে ফিরে এল। মুসা ফেরেনি।

রবিন বলল, অহেতুক ঘরে বসে না থেকে বরং চলো মুসা কি করছে দেখে আসি।

কিশোরের আপত্তি নেই।

কোন স্টুডিওতে যাবে মুসা বলেই গেছে। খুঁজে বের করতে মোটেও বেগ পেতে হলো না। পাস দেখিয়ে ভেতরে ঢুকল কিশোর আর রবিন। সেদিন একটা জায়গাতেই কেবল শুটিং চলছে। মেকসিকোর পটভূমিতে ওয়েস্টার্ন ছবির শুটিং। লোকজনের ভিড়ে মুসাকে কোথাও দেখতে পেল না ওরা।

সেটের মাঝখানে অনেক লোক জটলা করছে। সবাই বেশ লম্বা, মাথায়। চওড়া কানাওয়ালা মেকসিকৗন হ্যাট। কারও পরনে রঙচটা নীল জিনসের। প্যান্ট, গায়ে ডেনিম জ্যাকেট; কারও এমব্রয়ডারি করা পোশাক। কোমরে রূপার বাকলেসওয়ালা চকচকে চামড়ার বেল্ট, পায়ে চামড়ার বুটজুতো। মেয়েদের পরনে উজ্জ্বল রঙের পোশাক। একটা দৃশ্যের শূটিঙের জন্যে প্রস্তুত হয়েছে সবাই।

এককোণে দু-জন লোককে কথা বলতে দেখল রবিন। একটু পর সরে এল একজন। চিনতে পারল রবিন। আরি, ওই তো মুসা! মাথায় সমব্রেরো হ্যাট।

হাত নেড়ে ডাকল তাকে রবিন। নিজেও এগিয়ে গেল।

বন্ধুদের দেখে মুসও এগিয়ে এল। বাহ, তোমরাও এসে গেছ দেখছি।

লোকটা কে, মুসা? জানতে চাইল কিশোর। কোণের দিকে তাকিয়ে আর দেখতে পেল না-ওকে। অভিনেতাদের ভিড়ে মিশে গেছে।

এমন কেউ না, একজন এক্সট্রা, মুসা বলল। ডাকাত দলের একটা দৃশ্যে অভিনয় করতে এসেছিল। আমার মাথায় সমব্রেরো হ্যাট দেখে বলল চেষ্টা করলে আমিও এক্সট্রীর কাজ পেতে পারি। করেছি। পাইনি। নিরাশ ভঙ্গিতে মাথা নাড়ল সে। পরিচালক বললেন, হয়ে গেছে, আর লোক লাগবে না।

তাহলে আর বসে আছ কেন? চলো, যাই।

হ্যাঁ, চলো। ব্যাংকেও যেতে হবে, বন্ধ হয়ে যাওয়ার আগেই।

 ব্যাংকে? ভুরু কোঁচকাল কিশোর।

যে লোকটা এক্সট্রা সেজেছে সে একটা চেক দিয়েছে। কাজ ফেলে বেরোতে পারবে না। তাই আমাকে অনুরোধ করল, একটা চেক দেবে; সেটা নিয়ে আমি যেন তাকে নগদ টাকা দিই। সে বেরোতে বেরোতে ব্যাংক বন্ধ। হয়ে যাবে। কিন্তু টাকাটা তার আজই দরকার। পকেটে যা ছিল দিয়ে দিলাম। সে আমাকে চেক সই করে দিল।

বোকামি করোনি তো? রবিন বলল। আজকাল কত রকম অসুবিধে হচ্ছে। প্রায়ই চেক জাল হয়।

 কি করব, এমন করে ধরল। তবে এটা হবে না, সরকারি চেক। দেখো, ইউনাইটেড স্টেটস গভর্নমেন্ট ছাপ দেয়া।

বেরোল ওরা। একটা ব্যাংক দেখে দুজনকে দাঁড়াতে বলে ভেতরে চলে গেল মুসা। কয়েক মিনিট পর ব্যাংকের একজন দারোয়ান বেরিয়ে এসে জিজ্ঞেস করল, তোমাদের নাম কিশোর আর রবিন?।

হ্যাঁ, কেন? জবাব দিল কিশোর।

ভেতরে আসতে হবে। বিপদে পড়েছে তোমাদের বন্ধু। তোমাদের নাম বলল।

ক্যাশিয়ারের সামনে দাঁড়িয়ে আছে মুসা। ওদের দেখেই উত্তেজিত স্বরে বলল, আমাকে চেক নিতে দেখেছ না তোমরা! ক্যাশিয়ার সাহেব বিশ্বাস করছে না, তাকে বলো!

রবিন বলল, তখনই সন্দেহ হয়েছিল আমার, বোকামি করেছ!

কার কাছ থেকে কি ভাবে চেকটা নিয়েছে ক্যাশিয়ারকে বুঝিয়ে বলল সে আর কিশোর।

বিশ্বাস করল ক্যাশিয়ার। দারোয়ানকে বলল মুসাকে ছেড়ে দিতে।

কিশোর জানতে চাইল, চেকটাতে কি গোলমাল?

জাল, আরকি। ইদানীং বেশ কিছু জাল চেক পেয়েছি আমরা। সে জন্যেই সাবধান থাকতে হচ্ছে। যাই হোক, ট্রেজারি ডিপার্টমেন্টের কাছে এটা পাঠিয়ে দেব।

কিন্তু আমার টাকার কি হবে? ককিয়ে উঠল মুসা। পকেট তো খালি করে দিয়ে দিয়েছি।

কি আর করবে, কপাল খারাপ তোমার। বোকামির ফল, সহানুভূতির সুরে বলল ক্যাশিয়ার। তোমাদের কথা বিশ্বাস করে যে ছেড়ে দিলাম, বরং সেইটা ভাব। পুলিশের কাছে তুলে দেয়াটাই স্বাভাবিক ছিল না?

কিশোর বলল মুসাকে, জলদি চলে! লোকটাকে ধরতে হবে।

চলো, রাগ করে বলল মুসা, ব্যাটার কপালে দুঃখ আছে! ধরতে পারলেই হয়! আমি করলাম ভালমানুষী, আর আমাকে এমন করে ঠকাল!

 রাস্তায় বেরিয়ে দৌড় দিল তিনজনে। স্টুডিওর গেটে ওদের কাছে পাস চাইতে গেল দারোয়ান, পাত্তাই দিল না ওরা। ধাক্কা দিয়ে তাকে সরিয়ে ঢুকে গেল। সোজা চলে এল সেটের কাছে, যেখানে ছবির শুটিং হচ্ছে।

গায়ে গায়ে লেগে থাকা ভিড়ের জন্যে লোকটাকে চোখে পড়ল না মুসার। ভাবল ভেতরেই কোথাও আছে। ধাক্কা দিয়ে লোক সরিয়ে ভেতরে ঢোকার চেষ্টা করল সে। চিৎকার করে উঠল এক মহিলা। কনুইয়ের তো খেয়ে পড়ে যেতে যেতে বাঁচল দু-জন লোক। রাগে, বিস্ময়ে চেঁচিয়ে উঠল ওরা। কয়েকজনের হাতে পিস্তল, ওপর দিকে তুলে ফাঁকা গুলি করতে শুরু করল, মজা করার জন্যে। বেড়ে গেল চিৎকার-চেঁচামেচি। শিস দিয়ে উঠল কে যেন।

ভিড় থেকে সামান্য দূরে দাঁড়িয়ে আছেন নীল ব্যারেট ক্যাপ পরী ছোটখাট একজন মানুষ। গলা ফাটিয়ে চিৎকার করে উঠলেন, কাট! কাট! কাট!

একজন বিশালদেহী অভিনেতাকে নিয়ে মাটিতে গড়াগড়ি খেতে শুরু করেছে মুসা। ভিড়ের মধ্যে তাকে ঢুকতে বাধা দিয়েছিল লোকটা। অনেক টানা-হাচড়া করে দু-জনকে আলাদা করা হলো।

এগিয়ে এলেন নীল টুপি পরা ভদ্রলোক। চোখের তারা উজ্জল। দেখেই চিনে ফেলল মুসা। বিড়বিড় করল আনমনে, খাইছে! পরিচালক! এইবার বারোটা বাজাবেন আমার!

ঠকা খেয়ে মাথা গরম হয়ে গিয়েছিল তার, সেজন্যেই এ রকম একটা কাণ্ড ঘটাতে পেরেছে।

মুসার সামনে দাঁড়িয়ে তার পা থেকে মাথা পর্যন্ত চোখ বোলালেন পরিচালক। মুসাকে বিমূঢ় করে দিয়ে আচমকা তার কাঁধ চাপড়ে দিয়ে বললেন, দারুণ! দুর্দান্ত অভিনয়, ইয়াং ম্যনি! এই জিনিসই চাচ্ছিলাম আমি! ভিড়ের মধ্যে গণ্ডগোল! একেবারে বাস্তব হয়েছে দৃশ্যটা!

 তোতলাতে শুরু করল মুসা, কি-কি-কিন্তু আমি তো অভিনয় করিনি! ম্যাট উইণ্ডসর নামে একটা লোককে খুঁজতে ঢুকেছিলাম। আমাকে ঢুকতে বাধা দিল ওরা, তাই খেপে গিয়েছিলাম।

সেটের চারপাশে চোখ বোলালেন পরিচালক। বোধহয় চলে গেছে। তুমি আসার একটু আগে শটটা নেয়া শেষ করেছি, যেটাতে ম্যাট অভিনয়। করছিল। শেষ হতেই চলে গেছে।

মুসার চেহারা দেখে মনে হলো ধসে পড়বে সে। ফোঁস করে নিঃশ্বাস ফেলে বলল, ডাকাতি করে নিয়ে গেছে আমার সব টাকা! ক্যামেরাটা বিক্রি করা ছাড়া আর কোন উপায় নেই এখন।

এগিয়ে এল কিশোর। মুসার হাত ধরে টান দিল, পাগল হয়ে গেলে নাকি? এসো।

ভিড়ের কাছ থেকে সরিয়ে নিয়ে গিয়ে বলল, টাকার জন্যে ক্যামেরা বিক্রি করতে হবে কেন তোমার? আমরা আছি?

রবিন যোগ করল, তা ছাড়া এই কেসের জন্যে ওরকম একটা ক্যামেরা আমাদের দরকার হতে পারে।

কিশোর বলল, একটু দাঁড়াও। আমি পরিচালকের সঙ্গে কয়েকটা কথা বলে আসি।

পরিচালককে জিজ্ঞেস করল কিশোর, ম্যাট উইণ্ডসর কোথায় থাকে জানেন?

না। অফিসে খোঁজ করতে পারো। হয়তো ওদের কাছে ঠিকানা আছে।

কিন্তু অফিসের ওরাও কিছু বলতে পারল না। লোকটা ভবঘুরে টাইপের। মাঝে মাঝে এসে উদয় হয়। অভিনয়ের কাজ পেলে করে। নগদ টাকায় পাওনা বুঝে নিয়ে চলে যায়।

মুসরি টাকাটা উদ্ধারের আর কোন উপায় দেখল না কিশোর। স্টুডিও থেকে বেরিয়ে এল ওরা।

হোটেলে ফিরে খাওয়া-দাওয়ার পর অনেকটা শান্ত হলো মুসৗ। টাকার শোকের চেয়ে ঠকা খাওয়ার শোকটাই তার বেশি। বলল, লস অ্যাঞ্জেলেসে তার এক চাচা থাকেন, তার সঙ্গে দেখা করতে যাবে।

মুসা চলে গেল চাচার বাড়িতে, রবিন আর কিশোর চলল মিসেস লফারের সঙ্গে দেখা করতে।

পরিচয় পেয়ে গোয়েন্দাদের স্বাগত জানিয়ে বসার ঘরে নিয়ে এল মিসেস লফার। বেশ সুন্দরী। বয়েস কম। স্বামীর জন্যে খুবই চিন্তিত। চোখের কোণে কালি পড়ে গেছে।

 নয় বছরের একটা ছেলে ঢুকল ঘরে। বাদামী চুল। মুখ ভর্তি তিল। অস্বস্তি নিয়ে তাকাতে লাগল কিশোর আর রবিনের দিকে।

তা আরও একটা ছেলে ঢুকল, তার বয়েস সাত। বোঝা গেল বড় ছেলেটার ভাই।

বড়টার নাম পল, ছোটটা নেল, গোয়েন্দাদের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিল ওদের মা। আদর করে বলল, তোমরা একটু ওঘরে যাও। আমি কথা বলে আসি।

ছেলে দুটো চলে গেলে করুণ সুরে মিসেস লফার বলল, বাপের জন্যে অস্থির হয়ে উঠেছে ওরা। বুঝতেই পারছি না কি ঘটল! তোমরা তার খোঁজ এনে দিতে পারলে চির কৃতজ্ঞ থাকব তোমাদের কাছে!

আমাদের সাধ্যমত চেষ্টা করব আমরা, কিশোর বলল।

মিসেস লফারের কাছেও নতুন কিছু জানতে পারল না ওরা। কেবল একটা ব্যাপার সঙ্গে করে বাড়তি কাপড় নেয়নি লফার। তারমানে বাইরে কোথাও থাকার উদ্দেশ্য নিয়ে যায়নি সে।

লফারের বাড়ি থেকে বেরিয়ে তার অফিসে চলে এল কিশোররা। দোতলার একটা দরজায় দেখা গেল নেমপ্লেট। টোকা দিল কিশোর।

সোনালি চুল এক মহিলা দরজা ফাঁক করল। বয়েসে তরুণী, সাতাশ আটাশ হবে। লফারের সেক্রেটারি, আন্দাজ করল কিশোর।

কি চাই? জানতে চাইল মহিলা।

দেখুন, আমরা মিস্টার লফারের ব্যাপারে কয়েকটা কথা জানতে এসেছি।

কিশোরের কথা শেষ হওয়ার আগেই দড়াম করে দরজা লাগিয়ে দিল সেক্রেটারি।

Super User