০৬.

শুনুন, শুনুন! চেঁচিয়ে বলল কিশোর।

আবার ফাঁক হলো দরজা। আগের চেয়ে কম। ভয় পেয়েছে মহিলা।

ভয় নেই, আমাদের ঢুকতে দিন, কিশোর বলল। আমরা মিসেস লফারের কাছ থেকে এসেছি।

দ্বিধা করল মহিলা। কি করে বিশ্বাস করব?

ফোন করুন। জিজ্ঞেস করুন কিশোর আর রবিন তাঁর কাছে গিয়েছিল কিনা?

দরজা বন্ধ হয়ে গেল আবার। অপেক্ষা করতে লাগল দুই গোয়েন্দা। খুলল পাঁচ মিনিট পর। ভয় চলে গেছে মহিলার। ডাকল, এসো।

 কিশোররা ঢুকতে আবার দরজা লাগিয়ে একেবারে তালা দিয়ে দিল সে। আর কেউ নেই ঘরে। ছোট ডেস্কে রাখা নেমপ্লেট দেখে জানা গেল মহিলা লফারের সেক্রেটারি, এবং তার নাম মিস পলী লয়েড।

কৈফিয়ত দেয়ার ভঙ্গিতে পলা বলল, তোমাদের দেখেই বুঝেছি, তোমরা খারাপ নও। কিন্তু সকালে এসেছিল দু-জন, মিস্টার লফারের ব্যাপারে জিজ্ঞেস করার জন্যে, ওরা ভয়ঙ্কর। কলজের পানি শুকিয়ে দিয়ে গিয়েছিল আমার। তারপর থেকে আর কাউকে বিশ্বাস করতে পারছি না। দরজায় তালা দিয়ে রাখি সারাক্ষণ।

কারা ওরা? জানতে চাইল রবিন, পুলিশ?

না। বিশালদেহী দু-জন লোক, রুক্ষ ব্যবহার। কাপড়-চোপড় ভাল না। ডাকাতের মত আচরণ করছিল। আগে জানলে ঢুকতে দিতাম না। এসে যখন বলল মিস্টার লফারের ব্যাপারে কথা বলতে চায়, ভাবলাম গোয়েন্দা টোয়েন্দা হবে।

চট করে পরস্পরের দিকে তাকাল দুই গোয়েন্দা।

কিশোর বলল, মিস্টার লফারের খোঁজ করছিল?

হ্যাঁ, করছিল, পল বলল। মিস্টার লফারের অফিসের ফাইল, রেকর্ড আর তাঁর কাছে আসা চিঠিপত্র দেখাতে আমাকে বাধ্য করল। কব্জি মুচড়ে ধরেছিল, কালশিটে পড়ে আছে, দেখাল সে।

হু, মাথা দোলাল রবিন, তারমানে বাজে লোকই ওরা। পুলিশকে জানিয়েছেন?

না, মাথা ঝাঁকাল পল। আমাকে হুমকি দিয়ে গেছে পুলিশকে জানালে আস্ত রাখবে না।

কিশোরের দিকে তাকাল রবিন, আমাদের যারা হুমকি দিয়েছে মনে হচ্ছে তাদের দলেরই লোক।

হতে পারে, চিন্তিত ভঙ্গিতে বলল কিশোর। তবে লফারের খোঁজখবর নিতে যখন এসেছে, ধরে নেয়া যায় ওরা তাকে বন্দি করেনি। তবে কি অন্য কোন দলের হাতে পড়েছে লফার?

সাদা হয়ে গেল পলের মুখ। কি বলছ তোমরা এ সব!

সবই আমাদের অনুমান। মিস লয়েড, মিস্টার লফার লোক হিসেবে। কেমন, বলুন তো? তাকে কি পছন্দ করেন আপনি?

ভুরু কাছাকাছি হয়ে গেল পলের। ইয়ে, বছরখানেক আগে প্রথম যখন এখানে চাকরিতে ঢুকি তখন তো খুবই ভাল মনে হত। হাসিখুশি, সদা ব্যস্ত একজন মানুষ। শীই শাঁই করে ব্যবসায়ে উন্নতি হচ্ছে। সংসারে অশান্তি নেই। পছন্দ করার মতই একজন মানুষ। তারপর হঠাৎ করে বদলে গেলেন তিনি।

কি রকম?

বদমেজাজী হয়ে গেলেন। চেয়ারে বসে বসে কি চিন্তা করতেন। কাউকে সহ্য করতে পারতেন না। কেউ কাজের কথা বলতে এলেও তাকে ধমকাতে শুরু করতেন। যারা মাল কিনতে আসত, তাদেরও যেন বিশ্বাস করতে পারতেন না। ভঙ্গি দেখে মনে হত, প্রতিটি লোক যেন তাকে ঠকানোর জন্যে উঠেপড়ে লেগেছে। সবাইকে সন্দেহ করতেন।

এ সব করার পেছনে কোন কারণ ছিল? জিজ্ঞেস করল রবিন।

ছিল। খুব উচ্চাকাঙ্ক্ষা ছিল তার। তার এক বন্ধুর সঙ্গে পার্টনারশিপে আরেকটা ব্যবসা শুরু করতে চেয়েছিলেন। কলেজে পড়ার সময় থেকে দু জনের বন্ধুত্ব। হঠাৎ করে সমস্ত টাকা মেরে দিয়ে ইয়োরোপে চলে গেল বন্ধুটি। মিসেস লফার এ সব খবর জানেন না। দুশ্চিন্তায় ভেঙে পড়বে বলে তাঁকে বলেননি মিস্টার লফার।

সেই বন্ধু ঠকিয়ে চলে যাওয়ার পর লুক ব্রাউনকে ছাড়া আর কাউকে বিশ্বাস করতেন না লফার। বলতেন, ব্রাউনের মত দুঃসাহসী বন্ধু হয় না। তারপর দু-জনেই গায়েব হয়ে গেলেন একদিন।

লুক ব্রাউন কি কাজ করতেন? জানতে চাইল কিশোর। ব্যবসা?

বলতে পারব না। তবে কোথায় থাকত, জানি। ঠিকানা দিচ্ছি, তোমরা পারলে খবর নাওগে।

নোটবুকে ঠিকানা লিখে নিল রবিন। জিজ্ঞেস করল, আচ্ছা, দুঃসাহসী বন্ধু বলে কি বোঝাতে চেয়েছেন, মিস্টার লফার?

মাথা নাড়ল সেক্রেটারি। তা তো বলতে পারব না।

কিশোর বলল, অনেক ধন্যবাদ আপনাকে, মিস লয়েড। এক কাজ করুন, পুলিশকে ফোন করে সব কথা বলুন। লোকগুলোর হুমকির পরোয়া করবেন না। আবার এসে গণ্ডগোল করতে পারে। পুলিশই আপনাকে নিরাপত্তা দিতে পারবে। মিস্টার লফারের ব্যাপারে আর কিছু বলতে পারবেন। আমাদের?

আর? তার হবির ব্যাপারে বলতে পারি।

বলুন?

ঘোড়ার প্রতি আগ্রহ ছিল তাঁর। শেটল্যাণ্ড পনি পুষতেন। এতে কোন কাজ হবে তোমাদের?

হতে পারে, বলা যায় না।

মহিলাকে আবারও ধন্যবাদ দিয়ে অফিস থেকে বেরিয়ে এল গোয়েন্দা।

হোটেলে ফিরে লিফট থেকে নেমে নিজেদের রুমের দিকে এগোল। করিডরের শেষ মাথায় একজন লোককে দেখা গেল। গায়ে খাটেী লাল জ্যাকেট। কোমরের বেল্টে চকচকে পালিশ করা তামার বকলেস।

লোকটাকে চেনা চেনা লাগল। চাবি দিয়ে দরজার তালা খুলতে খুলতে রবিনকে প্রশ্ন করল কিশোর, কে ও?

বেয়ারা-টেয়ারা হবে, জবাব দিল রবিন।

ঘরে ঢুকেই থমকে গেল কিশোর। মনে পড়েছে। চেঁচিয়ে বলল, আরে ওই লোকটাই তো! যার ছবি তুলেছে মুসা, জঞ্জালের আড়ালে ঘাপটি মেরে। ছিল! ওকে ধরতে হবে!

ছুটে বেরিয়ে এল দু-জনে।

কিন্তু নেই লোকটা। চলে গেছে।

লিফটের অপেক্ষা না করে দৌড়ে নিচে নামল ওরা। লোকটাকে দেখা গেল না। ডেস্কে বসা ক্লার্কের দিকে এগোল কিশোর। লোকটার ছবিটা মানিব্যাগে রেখেছে। বের করে কুর্কিকে দেখিয়ে জিজ্ঞেস করল, এই লোক কি আপনাদের এখানে চাকরি করে?

ভাল করে দেখে মাথা নাড়ল ক্লার্ক, না, কখনও দেখিইনি একে।

কিন্তু এইমাত্র আমাদের ঘরের করিডরে দেখে এলাম! হোটেলের বেয়ারার পোশাক পরা।

দাঁড়াও, দেখছি। খানিক দূরে দাঁড়িয়ে থাকা একজন পোর্টারকে ডাকল ক্লার্ক, ভিক, শোনো তো? পোর্টার কাছে এলে ছবিটা দেখিয়ে জিজ্ঞেস করল, একে হোটেলে ঢুকতে দেখেছ? ওপরতলায় নাকি উঠেছিল। আমাদের বেয়ারার পোশাক পরা।

অবাক হলো পোর্টার। কই, দেখিনি তো?

তাহলে পোশাক পেল কোথায়? রবিন বলল, নিশ্চয় চুরি করেছে। আপনাদের স্টোর থেকে।

তা করতে পারে, ক্লার্ক বলল। এই লোকটার বয়েস চল্লিশ হবে। আমাদের কোন বেয়ারাই এত না। দাঁড়াও, হাউস ডিটেকটিভকে বলছি।

ডিটেকটিভের সঙ্গে দুই গোয়েন্দাও লেগে রইল। কোনখান থেকে পোশাক চুরি করে কোথায় বদলেছে, বের করা হলো। সিঁড়ি, চিলেকোঠা, এবং মানুষ লুকিয়ে থাকা যায় এ রকম সবখানে খুঁজে দেখা হলো। কিন্তু পাওয়া গেল না লোকটাকে।

হতাশ হয়ে নিজেদের ঘরে ফিরে এল দুই গোয়েন্দা। সঙ্গে সঙ্গে এল ডিটেকটিভ। জিজ্ঞেস করল, লোকটা দেখতে কেমন?

আনমনে বিড়বিড় করল কিশোর, বা-বা, আসল কথাটা জিজ্ঞেস করছে এতক্ষণে। এই লোক আর কি ডিটেকটিভগিরি করবে! নীরবে ছবিটা বাড়িয়ে দিল সে।

দেখল ডিটেকটিভ। এই চেহারার কাউকে দেখতে পেলে গোয়েন্দাদের। জানাবে, কথা দিয়ে বেরিয়ে গেল সে।

পালাল কি করে ব্যাটা? কিশোরের দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন করল রবিন।

হয়তো কোন ঘরের ফায়ার-এসকেপ দিয়ে।

হাতমুখ ধুয়ে, খানিক বিশ্রাম নিয়ে, নাস্তা খেয়ে আবার বেরোল দুই গোয়েন্দা। পলার দেয়া ঠিকানা মোতাবেক লুক ব্রাউনের বাড়িতে যাবে।

নিজের বাড়ি নয়, একটা বোর্ডিং হাউসে ভাড়া থাকত ব্রাউন। হাউসের মালিক এক মহিলা, দরজা খুলে দিল। কথা বলে অতিরিক্ত। ভীষণ মোটা, বয়েস পঞ্চাশ পেরিয়েছে, পাক ধরতে শুরু করেছে চুলে। নাম মিসেস টোবারগট।

কিশোরদেরকে বসার ঘরে নিয়ে এল মহিলা। রান্নাঘর থেকে আসছে। খাবারের সুগন্ধ। নিশ্চয় রান্না করছিল মিসেস টোবারগট।

লুক ব্রাউনের ব্যাপারে জানতে চাইল কিশোর।

মিস্টার ব্রাউন? মহিলা বলল, ওর ব্যাপারে তো কত কথাই জানি। ভাল বোর্ডার ছিল। আমার রান্না খুব পছন্দ করত। তা শুধূমুখে তোমাদের সঙ্গে কথা বলছি কেন? এক কাপ চা অন্তত দেয়া উচিত।

বিনয়ের সঙ্গে চা খাওয়াটা এড়াতে চাইল কিশোর। কিন্তু কোনমতেই শুনল না মিসেস টোবারগট। চা তো আনলই, তার সঙ্গে নিজের তৈরি বিস্কুটও নিয়ে এল।

মানুষকে খাওয়াতে আমার খুব ভাল লাগে, মিসেস টোবারগট বলল। খাওয়ার জন্যে কত চাপাচাপি করেছি ব্রাউনকে, মোটা বানাতে চেয়েছি। কিন্তু যে হাড্ডি সেই হাড়ি। আমার দেয়া সব খাবার খেত, কিচ্ছু ফেলে রাখত না। কিন্তু তালপাতার সেপাই থেকে বিন্দুমাত্র উন্নতি হয়নি তার। অবাক কাণ্ড! আরি, খাচ্ছ না কেন? একটা বিস্কুটও ফেলে রাখা চলবে না। তোমাদের বয়েসী ছেলেদের অনেক বেশি খেতে হয়। নইলে শরীর টেকে না।

খাচ্ছি তো, আরেকটা বিস্কুট নিতে নিতে বলল কিশোর। খুব ভাল বানিয়েছেন। হ্যাঁ, ব্রাউনের কথা বলুন।

কি আর বলব, এক আজব লোক ছিল! সারাক্ষণই বাইরে যেত। ঘণ্টায় ঘণ্টায় বেরোত। আসত আর যেত, যেত আর আসত, একেবারে যেন চড়ুই পাখি। এত ঘোরাফেরা করত বলেই বোধহয় স্বাস্থ্য ভাল হত না। চুলও পাতলা হয়ে যাচ্ছিল।

কাজ করত কখন? জানতে চাইল রবিন। কিছু তো একটা নিশ্চয় করত। নইলে আপনার ঘর ভাড়া দিত কি করে?

কি জানি কি করে! সেটা আরেক আশ্চর্য! ভাড়াটেদের ব্যক্তিগত ব্যাপারে কখনও তাদের কাছে জানতে চাই না আমি। আরি, চুপ করে আছ কেন? বিস্কুটগুলো শেষ করো। খাও, খাও, লজ্জা নেই, আরও এনে দেব।

মূসাকে দরকার ছিল, তাহলে খাইয়ে শান্তি পেত মিসেস টোবারগট ভাবল রবিন।

কিশোর বলল, তাহলে বলছেন খুব ভাল বোর্ডার ছিল ব্রাউন?

ছিল। একটা পয়সা বাকি রাখেনি আমার। আর রাখবে কি, ছয় মাসের খাবারের খরচ সহ ভাড়া অগ্রিম দিয়ে দিয়েছিল। সে-ই বরং আমার কাছে পায়। টাকার বোধহয় কোন মায়া ছিল না তার।

বিস্কুটগুলো আপনার দারুণ! আরেকবার প্রশংসা করল কিশোর। হু, তা বাইরে যে যাচ্ছে, আপনাকে বলেছিল ব্রাউন?

হয়তো বলেছিল, আমার মনে নেই। থাকবে কি? এত বেরোয় যে লোক, সে বাইরে যাওয়ার কথা বললে কারও খেয়াল থাকে নাকি? মাঝে মাঝেই দীর্ঘদিনের জন্যে বেরিয়ে যেত।

 হঠাৎ দু-জনকে অবাক করে দিয়ে সামনে ঝুঁকল মিসেস টোবারগট। স্বর। নামিয়ে বলল, মনে হয় রাজনীতি বা কোন বিদ্রোহের সঙ্গে জড়িত ছিল সে! ওই যে ল্যাটিন-আমেরিকান দেশগুলো আছে না, ওসব দেশে তো সব সময়ই গণ্ডগোল লেগে থাকে। আমার ধারণা, ওখানকার কোন দলের সঙ্গে জড়িত। ছিল। আমি যে বললাম কাউকে বলে দিয়ো না আবার!

না, না, বলব না! সতর্ক হলো কিশোর। কি করে বুঝলেন?

তার ঘর পরিষ্কার করতে গিয়ে এমন সব ছবি দেখেছি, তাতেই মনে হয়েছে। প্লেনের মধ্যে তোলা তার ছবি, ওই প্লেনগুলো আবার ব্যবহার হয়। যুদ্ধের সময়। মাথায় ইয়াবড় হ্যাট তার, হ্যাঁটের কানা তো না, যেন গরুর গাড়ির চাকা। তার সঙ্গে আরও লোক আছে। সবার কোমরেই গুলির বেল্ট, খাপে ঝোলানো পিস্তল। আরি, বিস্কুট খাও না কেন?

 কই, খাচ্ছি তো! মহিলার কথা শুনতে শুনতে কৌতূহলে চিবানো থামিয়ে দিয়েছিল কিশোর, আবার কামড় বসাল হাতের বিস্কুটে।

হু, বোঝা গেছে। এই জন্যেই লফার বলত তার দুঃসাহসী বন্ধু, রবিন বলল।

নামটা চিনতে পারল মিসেস টোবারগট। বলল, হ্যাঁ, ওই ভদ্রলোককেও এখানে নিয়ে আসত ব্রাউন। মহিলার মুখ দেখে মনে হচ্ছে এ সব খবর বলতে পারায় তার খুশিই লাগছে। মিস্টার লফারই আমাকে বলেছে কি সাংঘাতিক যোদ্ধা তার বন্ধু লুক ব্রাউন, কি ভাবে বিদেশীদের হয়ে লড়াই করেছে। ব্রাউনের কাছে এ সব কাজ নাকি রোমাঞ্চকর অ্যাডভেঞ্চারের মত। বন্ধুর প্রশংসায় পঞ্চমুখ হয়ে যেত ভদ্রলোক।

 লড়াইটা কোন দেশে করেছে, আপনি জানেন, মিসেস টোবারগট? প্রশ্ন। করল কিশোর।

নাহ। মনে থাকে না। তবে একটা জিনিস দেখাতে পারি তোমাদের, দেখো কিছু আন্দাজ করতে পারো কিনা। বিস্কুটগুলো কিন্তু শেষ করতে হবে, নইলে দেখাব না, হুমকি দিয়ে, উঠে চলে গেল মিসেস টোবারগট।

মহিলা চলে যাওয়ার পর রবিন বলল, কত রকম মানুষ যে থাকে দুনিয়ায়। বেশির ভাগ মানুষই মানুষকে খেতে দিতে চায় না; কিন্তু জোর করে খাওয়াতে চায়, এমন মানুষ এই প্রথম দেখলাম। এত বিস্কুট, শেষ করি কি। করে? তুমি খেয়ে ফেলে।

আমি পারব না। হাত মুছতে দেয়া কাগজে বিস্কুটগুলো মুড়ে পকেটে রেখে দিয়ে হাসল। মুসার জন্যে নিয়ে নিলাম। মিসেস টোবারগট ভাববে। আমরাই খেয়ে ফেলেছি।

মুসাকে আনলে খুব ভাল হত। কত খেতে পারে দেখা যেত।

মিসেস টোবারগট ফিরে এল। খালি প্লেট দেখে বেজায় খুশি। বলল, বাহ, এই তো চাই! না খাওয়া মানুষদের আমার একদম পছন্দ না। নাও, জিনিসটা তোমাদের দিয়েই দিলাম।

কিশোরের তালুতে একটা তামার মুদ্রা ফেলে দিল সে। ঝাড়ু দিতে গিয়ে ব্রাউনের ড্রেসিং টেবিলে পেয়েছি এটা। মনে হলো বিদেশী জিনিস। খুব পছন্দ হলো আমার। স্যুভনির হিসেবে রাখতে চাইলাম। তাকে সে-কথা বলতেই দিয়ে দিল আমাকে।

মুদ্রার লেখা পড়ল কিশোর, রিপাবলিকা ডি মেকসিকো! মুখ তুলে বলল, অনেক ধন্যবাদ আপনাকে, মিসেস টোবারগট। আজ তাহলে উঠি।

হোটেলে ফিরে ওরা দেখল, মুসা এসে বসে আছে। মিসেস টোবারগটের বিস্কুট খাওয়ানোর কাহিনী শুনে তো কিশোরদের সঙ্গে গেল না বলে আফসোসেই বাঁচে না সে।

ব্রাউনের কথা সব শোনার পর বলল, খাইছে! বলো কি! মেসিকোয় বিদ্রোহীদের প্লেন চালিয়েছে ব্রাউন!

হ্যাঁ, কিশোর বলল। আর রিপ্লি শহরটা মেকসিকো থেকে দূরে নয়।

একটা ম্যাপ বের করে এনে মেঝেতে বিছাল সে। তিনজনেই কুঁকে এল তার ওপর। আঙুল রেখে দেখাল কিশোর, এই যে দেখো কলোরাডো নদী কোন দিকে বয়ে গেছে। আমার মনে হচ্ছে এই নদী দিয়েই বোটে করে। মেকসিকোতে চলে গেছে লফার আর ব্রাউন।

নতুন বিদ্রোহে জড়িয়ে পড়েনি তো ব্রাউন? রবিনের প্রশ্ন। কিংবা অন্য কোনো বেআইনী কাজে?

নিচের ঠোঁটে চিমটি কাটল কিশোর। সেটাই জানতে হবে আমাদের।

.

০৭.

সন্দেহের ওপর ভিত্তি করে এখন তদন্ত চালিয়ে যেতে হবে আমাদের, কিশোর বলল। প্রথমে ধরা যাক সেই পাথরটার কথা, মরুভূমিতে যেটা পেয়েছি। হয়তো দামী পাথরের খোঁজে মরুভূমিতে গিয়েছিল লফার আর ব্রাউন। সেখানে ডাকাতের কবলে পড়ে ওরা। আরেক হতে পারে, ব্রাউনের কথায় পটে গিয়ে তার সঙ্গে বোটে করে মেকসিকোতে চলে গেছে লফার।

সুতরাং আমাদের প্রথম কাজ হবে মরুভূমিতে গিয়ে আরও সূত্র খোঁজা। টিলার ওপরের ছবিটাতে কোনো ইঙ্গিত থাকতে পারে। ওখানে কিছু না পেলে একটা বোট নিয়ে কলোরাডো নদী ধরে আমরাও চলে যাব মেকসিকোতে।

গুড আইডিয়া! খুশি হয়ে বলল মুসা। শুনেছি কলোরাডো নদীর কৈ মাছ নাকি দারুণ টেস্ট। মাছ ধরার সরঞ্জাম নিয়ে যাব আমরা। তিনটে কাজ হৰে তীতে। মাছ শিকারের আনন্দ পাব, তাজা খাবারও পাব, আর লোকে দেখলে ভাববে আমরা মাছ ধরতে বেরিয়েছি।

হাততালি দিল রবিন। বহি, চমৎকার! বুদ্ধি খুলে যাচ্ছে দেখছি তোমার! কিশোরের দিকে তাকাল। কিন্তু কথা হলো, নদী ধরে গিয়ে লাভটা কি হবে আমাদের?

লাভ? কিশোর বলল, নদীপথে লফাররা গেলে অনেক সময় লেগেছে নিশ্চয়, কারও না কারও চোখে পড়েছে। যেখানেই লোকালয় দেখব, জিজ্ঞেস করতে করতে যাব আমরা। মেকসিকোতে ঢোকার জন্যে অনুমতি লাগবে। আমাদের। লস অ্যাঞ্জেলেস থেকেই নিতে সুবিধে।

বার্থ সার্টিফিকেট আর অন্যান্য কাগজপত্র নিয়ে মেকসিকান দূতাবাসে রওনা হলো তিন গোয়েন্দা। অনুমতি পেতে অসুবিধে হলো না। হোটেলে। ছেড়ে দিয়ে চলে এল এয়ারপোর্টে। বিমান নিয়ে আবার ফিরে চলল রিভারসাইড কাউন্টি এয়ারপোর্টে।

বিমান বন্দরে প্লেন রেখে ট্যাক্সিতে করে ব্লাইদিতে চলে এল। রবিন বলল, আগে থেকেই একটা বোট ভাড়া করে রাখলে হয় না?

ট্যাক্সিতে করেই নদীর ঘাটে চলে এল ওরা। নানা রকম বোট বাঁধা আছে। মুসা বলল, তোমরা নৌকা ঠিক করোগে। আমি খাবারের ব্যবস্থা করি। কতদিন বোটে থাকতে হবে, কে জানে। খাবার লাগবে।

সুপারমার্কেটের দিকে চলে গেল মুসা।

 ট্যাক্সি ছেড়ে দিয়ে অন্য দু-জন চলল বোট ভাড়া করতে।

লাল-সাদা রঙ করা একটা বোট পছন্দ হলো ওদের। দুই ইঞ্জিন বসানো। ওরা যে কাজে যাচ্ছে, তাতে বিপদের সম্ভাবনা আছে। বাড়তি একটা ইঞ্জিন অনেক কাজে দেবে।

পুরানো ধরনের আঁটো পোশাক পরা এক লোক ডেকে বসে ছুরি দিয়ে কাঠ ঠেছে একটা পুতুল বানাচ্ছে। একবার মুখ তুলে চেয়েই আবার নামিয়ে নিল। কাজ বন্ধ করল না।

বোটটা কি ভাড়া হবে? জিজ্ঞেস করল কিশোর।

হয়তো, জবাব দিল লোকটা।

যতদিন ইচ্ছে রাখতে পারব?

আবার জবাব, হয়তো।

 দিন দুয়েকের মধ্যে লাগবে। দেয়া যাবে?

হয়তো।

ঠিক আছে। তাহলে ওই কথাই রইল। দুদিন পর এসে নেব। ঠিকঠাক পাওয়া যাবে তো?

হয়তো।

বোট থেকে নেমে আসতে শুরু করল রবিন। হয়তো ছাড়া শকুনটী আর কোন শব্দ জানে না নাকি?

হয়তো, হেসে জবাব দিল কিশোর।

মুসার খোঁজে সুপার মার্কেটের দিকে এগোল ওরা। কিছুদূর এগোতে খাবারের নানা রকম প্যাকেটের বিশাল এক চলমান বোঝা চোখে পড়ল ওদের দিকে এগিয়ে আসছে। মুখ দেখা যাচ্ছে না, কেবল বোঝাটার ওপরে পরিচিত একটা সমব্রেরো হ্যাট বসানো। আরও কাছে এসে পরিচিত গলায় কথা বলে উঠল বোঝা, অ্যাই, কিশোর!

হঠাৎ করে বিস্ফোরিত হলো খাবারের বোঝ। প্যাকেট, টিন, ছিটকে পড়তে লাগল চারদিকে। বৃষ্টির মত এসে পড়ল রবিন আর কিশোরের কাঁধে। ওসবের আড়াল থেকে বেরিয়ে এল মুসা আমান। চোর! চোর! বলে চিৎকার করে দৌড় দিল রাস্তা দিয়ে।

কিন্তু চোরটা দৌড় দেয়ার কোন চেষ্টা করল না। সহজেই তাকে ধরে ফেলল মুসা। ছোটখাট একজন মানুষের কলার চেপে ধরে ঝাঁকাতে শুরু করল, চোর কোথাকার! আমার টাকা ফেরত দাও!

 রাস্তা থেকে যতটা সম্ভব খাবারের প্যাকেটগুলো কুড়িয়ে নিয়ে সেদিকে এগিয়ে গেল কিশোর আর রবিন। কাছে গেলে চিৎকার করে বলতে লাগল মুসা, এই ব্যাটাই সেদিন স্টুডিওতে চেক দিয়েছিল আমাকে! এর নামই ম্যাট উইন্ডসর!

কি বলছ তুমি, কিছুই তো বুঝতে পারছি না! বিমূঢ় হয়ে গেছে যেন ম্যাট।

আমাকে চিনতে পেরেছ, নাকি পারোনি?

পারব না কেন? স্টুডিওতে আমাকে টাকা দিয়েছিলে, আমি তোমাকে একটা চেক দিয়েছিলাম।

হ্যাঁ, মুখ বাঁকিয়ে ঝাঁঝাল কণ্ঠে মুসা বলল, সেই চেকটা ছিল জাল!

আরও অবাক হলো লোকটা। জাল! কিন্তু ও তো সরকারি চেক, জাল হয় কি করে?

সেটা তুমি জানো। চলো, পুলিশের কাছে চলো। অবাক হওয়ার ভানটা ওদের কাছেই করো। কলার ছাড়ল না মুসা। টেনে নিয়ে চলল। রাস্তা দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে বলল, একটা কথা বলো দেখি এখন, চাঁদ, আমি যেখানেই যাই সেখানেই হাজির হয়ে যাও কি করে? ব্লইদিতে কি করছ?

আমারও তো সেই একই প্রশ্ন, তুমি এখানে এলে কি করে? আমার থাকাটা স্বাভাবিক, কারণ এখানেই আমার বাড়ি।

বিশ্বাস করল না মুসা। ব্যঙ্গের সুরে বলল, তাই নাকি! বলে গিয়ে সে কথা পুলিশকে!

থানায় এসেও ম্যাটের সেই একই কথা–সে কোন অপরাধ করেনি।

ডেস্ক সার্জেন্ট বলল মুসাকে, এখানে তার বাড়ি হওয়া অসম্ভব না। ব্লাইদিতে বহুবার দেখছি তাকে।

তাহলে লস অ্যাঞ্জেলেসে কি করছিল?

দেখো, আমার মনে হয় কোথাও একটা ভুল হয়েছে, মুসার প্রশ্নের জবাবে ম্যাট বলল। অনেক দিন থেকে আমি অসুস্থ। সিনেমায় কাজ করার। কথা ছিল বলেই সেদিন না গিয়ে পারিনি। কাজ শেষ হতেই চলে এসেছি। চেকটা যে জাল এর কিছুই জানতাম না আমি। টাকার অভাবে একটা সোনার ঘড়ি বিক্রি করেছিলাম। যার কাছে করেছিলাম, সে নগদ টাকার পরিবর্তে ওই চেক দিয়েছে। ঠিক আছে, আমারই অন্যায়, তোমার টাকা আমি ফিরিয়ে দেব।

ঘড়িটা কি এখানে বিক্রি করেছেন? সতর্ক হয়ে উঠেছে সার্জেন্ট।

না, লস অ্যাঞ্জেলেসে।

 লোকটা দেখতে কেমন?

আমার চেয়ে লম্বা, বয়েসেও বড়। আমাকে বলল, কোন হোটেলে নাকি কাজ করে।

কি ভেবে পকেট থেকে মানিব্যাগ বের করল কিশোর। মুসার ভোলা ছবিটা বের করে দেখিয়ে জিজ্ঞেস করল, এই লোক?

জঞ্জালের আড়ালে ঘাপটি মেরে থাকা লোকটাকে ভাল করে দেখল ম্যাট। হ্যাঁ, এই লোকই! কিন্তু তোমরা এর ছবি পেলে কোথায়?

 সার্জেন্টও অবাক হলো। ড্রয়ার থেকে একটা চেক বের করে দেখাল, এ রকম চেক নিয়েছিলেন?

একই সঙ্গে বলে উঠল মুসা আর ম্যাট, হ্যাঁ, হ্যাঁ, এ রকম!

মাথা ঝাঁকাল সার্জেন্ট। গত হপ্তায় ব্লাইদি ব্যাংকে এটা ভাঙাতে এনেছিল এক লোক। তারমানে চেক জালিয়াতির একটা নতুন দল গজিয়েছে।

ম্যাটকে আরও কিছু প্রশ্ন করার পর নিশ্চিত হলো সার্জেন্ট, লোকটা সত্যি কথাই বলছে। সে অপরাধী নয়। মুসার মত সে-ও অপরাধের শিকার।

কি আর করা? থানা থেকে বেরিয়ে এল চারজনে।

মোটেলে ফিরল তিন গোয়েন্দা।

তদন্তের আলোচনা শুরু হলো। মুসা জিজ্ঞেস করল, মরুভূমিতে আবার কি খুঁজবে?

ছবিটা দেখব আরেকবার। হতে পারে, কিছু মিস করেছি আমরা।

কবে যাবে?

আজই।

.

০৮.

টিলার খানিক দূরে আগের জায়গাতেই ল্যাণ্ড করল মুসা। হেঁটে এসে টিলাটাতে উঠল ওরা। আগে আগে রয়েছে কিশোর। তার এখনও বিশ্বাস, ছবিটাতে রয়েছে লফারের নিরুদ্দেশ-রহস্যের জবাব। খুঁজতে শুরু করল সে।

 মরুর পাথুরে কঠিন মাটি আয়তাকার ভাবে দেবে গেছে এক জায়গায়। আলগী হয়ে আছে মাটি। আগের বার লক্ষ করেনি এটা। কেন করেনি, সেটাও বুঝতে পারল না। তবে হয় এ রকম। প্রথমবারে অনেক সময় অনেক খুঁজেও একটা জিনিস চোখে পড়ে না, দ্বিতীয়বারে সেটা সহজেই চোখে পড়ে যায়।

কেউ খুঁড়েছিল! বলে উঠল রবিন।

তাই তো মনে হচ্ছে! চিন্তিত ভঙ্গিতে বলল কিশোর। খুঁড়ে আবার মাটি দিয়ে গর্তটা বুজিয়ে দিয়েছে।

কি আছে নিচে? মুসার প্রশ্ন।

না দেখলে কি করে বুঝব? মুসা, আবার আমাদের ব্লাইদিতে ফিরে যেতে হবে। মাটি খোঁড়ার যন্ত্রপাতি নিয়ে আসতে হবে। একটা শাবল পেলেই

সেটা আমি একাই আনতে পারব। তোমরা বরং ইতিমধ্যে যা দেখার দেখে নাও। তাতে সময় বাঁচবে।

 ঠিকই বলেছে মুসা। কিশোর আর রবিন রয়ে গেল। মুসা চলে গেল মাটি খোঁড়ার যন্ত্রপাতি কিনে আনতে।

টিলার ওপরে, নিচে, আতিপাতি করে খুঁজতে লাগল দু-জনে। নতুন কিছুই পেল না। ভয়ানক গরম। ওদের মনে হচ্ছে মাথায় হ্যাট না থাকলে মগজই গলে যেত। ছায়া বলতে কিছু নেই। ঘেমে নেয়ে গেল দেখতে দেখতে। আর কিছু না দেখে ছোট একটা ঝোপের পাশের সামান্য ছায়াতেই বিশ্রাম নিতে বসল ওরা।

কিশোর বলল, দানবের ছবির ওই ছড়ানো হাতের কোন অর্থ আছে।

কি?

বুঝতে পারছি না। বাঁ হাতটা যেদিকে নির্দেশ করছে সেদিকেই কিন্তু পাথরটা পাওয়া গেল।

আচ্ছা, পাথরটা কোন ধরনের নির্দেশক নয়তো? কোন কিছুর চিহ্ন? গুপ্তধন?

হতে পারে।

এক মুহূর্ত চুপ থেকে রবিন বলল, রাতে এসে ক্যাম্প করলে কেমন হয় এখানে? ব্রাউন আর লফার হয়তো পাহাড়ের কোন গুহায় লুকিয়ে আছে। রাতের বেলা গুপ্তধন খুজতে বেরোয়। নইলে ওই মাটি খুঁড়ল কে? কেনই বা খুঁড়ল? কি খুঁজেছে?

আল্লা মালুম! হাত ওল্টাল কিশোর।

এই গরমে অপেক্ষা করার মত কষ্ট আর হয় না। দু-জনেরই মনে হতে লাগল, যুগের পর যুগ পার হয়ে যাচ্ছে। অবশেষে ফিরে এল মুসা। প্লেনটা ল্যাণ্ড করতেই ছুটে গেল ওরা রবিন আর কিশোর। যন্ত্রপাতি নামাতে মুসাকে সাহায্য করতে।

মাথায় চওড়া কানওয়ালা হ্যাট, হাতে মাটি খোঁড়ার শাবল-কোদাল, সারি দিয়ে হাঁটা–মনে হচ্ছে যেন পুরানো আমলের প্রসপেক্টর, অর্থাৎ স্বর্ণ খুজিয়ের দল।

মুসা বলল, বাই চান্স যদি সোনা পেয়ে যাই, দারুণ হবে না!

হবে, কিশোর বলল, তবে অবাক হব না। অ্যারিজোনায় বেশ কিছু সোনার খনি আছে। স্প্যানিশরা যখন প্রথম এল এ দেশে তখন খুঁজে বের করেছিল। পরে হারিয়ে গেছে ওগুলো।

খনি কি আর হাঁটতে পারে নাকি যে কোথাও গিয়ে হারিয়ে যাবে? বুঝতে পারল না মুসা। হারায় কি করে?

 হেসে উঠল রবিন। এই সহজ কথাটা বুঝতে পারছ না। পুরানো আমলের প্রসপেক্টররা তাদের খনির কথা গোপন করে রাখত, অন্যে কেড়ে নেয়ার ভয়ে। কাউকে বলত না। শেষে দেখা গেল নিজেও আসতে পারল না সোনা খুঁড়ে তোলার জন্যে। কালক্রমে বালিতে ঢেকে কিংবা ভূমিকম্পে মাটি ধসে বন্ধ হয়ে গেল খনির মুখ হারিয়ে গেল মাটির নিচে।

গর্তটার কাছে পলি করে খুড়তে লাগল ওরা। ঘামে চুপচুপে হয়ে গেল দশ মিনিটেই। হাল ছেড়ে দিয়ে মুসা বলল, দূর, খামোকা কষ্ট। এখানে কিছু পাওয়া যাবে না।

রবিন বলল, হয়তো ছিল। মূল্যবান পাথর। তুলে নিয়ে গেছে।

আমার তা মনে হয় না, একমত হতে পারল না কিশোর। পাথর-টীতর হলে দু-এক টুকরো পড়ে থাকতই। একটা কণাও নেই কেন?

তাহলে কিসের জন্যে খুড়েছিল? ইনডিয়ানদের গুপ্তধন? মুসার প্রশ্ন।

তা হতে পারে। স্প্যানিশ ভ্রমণকারীদের গুপ্তধনও হতে পারে। এই দানবের ছবিটার মধ্যেই রয়েছে এর জবাব।

তোমার ধারণা লফাররা এই গুপ্তধন খুঁজতেই এসেছিল?

আসতেও পারে।

কিন্তু কে খুঁড়ল এই গর্ত? একটা পায়ের ছাপও নেই। ভূতুড়ে ব্যাপার না? এই দুপুর রোদেও গায়ে কাঁটা দিল মুসার।

না। যে খুঁড়েছে, সে খুব চালাক লোক। পায়ের ছাপ মুছে দিয়েছে, ইনডিয়ানদের মত, গাছের ডাল দিয়ে ডলে।

মরুকগে সব! হাতের কোদালটা মাটিতে ফেলে দিল মুসা। আমার খিদে পেয়েছে।

কোদাল তুলে নিল রবিন। গর্তের নিচে আলগা মাটি যা অবশিষ্ট আছে তুলে ফেলতে লাগল। কোদালের ফলায় লেগে উঠে এল একটুকরো কাপড়।

লাফিয়ে উঠে দাঁড়াল কিশোর। ওটা কি!

মুসাও উঠে এগিয়ে এল।

মাটির ভেতর থেকে বাদামী রঙের একটা রুমাল টেনে বের করল রবিন। মাটি ঝেড়ে পরিষ্কার করল। এক কোণে সুতো দিয়ে লেখা একটা অক্ষর: D.

কারও নামের আদ্যক্ষর, কিশোর বলল, যার বানানটী ডি দিয়ে শুরু।

তার মানে সেই লোক ব্রাউন কিংবা লফার নয়, রবিন বলল।

না

তারমানে, চেঁচিয়ে উঠল মুসা, মাটিও খুঁড়েছে অন্য লোকে! ভুল করে রুমাল ফেলে গেছে!

তাই তো মনে হচ্ছে।

সূত্র হিসেবে কাজে লাগতে পারে ভেবে রুমালটা পকেটে রেখে দিল রবিন।

সমস্ত আলগা মাটি তন্নতন্ন করে খুঁজেও আর কোন সূত্র পাওয়া গেল না। আবার বলল মুসা, আমার খিদে পেয়েছে।

কিশোর বলল, এখানে এই রোদে বসে তো খাওয়া যাবে না। ছায়া দরকার।

কোথায় পাব ছায়া? চারপাশে তাকাতে লাগল মুসা।

মরুভূমির কিনারে পর্বত শুরু হয়েছে। সেটা দেখিয়ে কিশোর বলল, চলো, ওখানে উড়ে যাই। ছায়াও মিলবে, ঠাণ্ডাও।

উত্তম প্রস্তাব, সঙ্গে সঙ্গে রাজি হয়ে গেল মুসা।

রবিন বলল, বলা যায় না, পর্বতের ঢালে জ্যাসপারও পাওয়া যেতে পারে।

প্লেনের কাছে ফিরে এল ওরা। দরজা খুলতেই যেন ধাক্কা মারল এসে গরম বাতাস, ঝলসে দিতে চাইল চোখ-মুখ। বদ্ধ থাকায় ভেতরের বাতাস তেতে আগুন হয়ে আছে। এয়ারকুলার চালিয়ে ভেতরটা ঠাণ্ডা করে নিতে হলো।

উড়ে এসে পাহাড়ের ঢালে নামতে বিশেষ সময় লাগল না। খাবারের টিন আর পানির বোতল নিয়ে নামল তিনজনে। পর্বতের ঢালে ছায়া খুঁজতে শুরু করল।

বড় বড় পাথরের চাঙড় পড়ে আছে। ছায়ার অভাব নেই এখানে। অনেক বড় একটা চাঙড়ের নিচে বড় গর্তের মত অনেকখানি-জায়গী। তাতে বসে খাওয়া সারল ওরা। মুসা:ওখানেই চিত হয়ে শুয়ে নাক ডাকানো শুরু করল। রবিন আর কিশোর উঠল খানিকটা জায়গা ঘুরে দেখতে।

ঢাল বেয়ে উঠতে উঠতে ওপর দিকে হাত তুলে কিশোর বলল, ওই দেখে, একটা গুহার মুখ। ঢুকে দেখব।

চল্লিশ ফুট ওপরে রয়েছে গুহাটা। ওটার কাছে এসে ভেতরে তাকাল দু জনে।

অন্ধকার। কিছু দেখা যায় না।

 পকেট থেকে টর্চ বের করল কিশোর। রবিনকে বলল, এসো, ঢুকব।

তার কথা শেষ হলো না; তীক্ষ্ণ, ভয়াবহ এক চিৎকার যেন চিরে দিল। পর্বতের নীরবতা। গুহামুখে বেরিয়ে এল একটা বিশাল জানোয়ার। গোয়েন্দাদের ওপর ঝাঁপ দেয়ার জন্যে তৈরি।

.

০৯.

হলদে চোখ মেলে তিন গোয়েন্দার দিকে তাকিয়ে আছে জানোয়ারটী। আমেরিকার একেক জায়গায় একেক নাম এর; কেউ বলে ওয়াইল্ড ক্যাট, কেউ বলে কুগার, আবার কেউ পার্বত্য সিংহ। ভয়ঙ্কর জীব। তামাটে চামড়ার নিচে থিরথির করে কাঁপছে অসাধারণ শক্তিশালী মাংসপেশী।

দৌড় দাও! চিৎকার করে বলল কিশোর।

চরকির মত পাক খেয়ে ঘুরে লাফিয়ে নামতে শুরু করল সে। পেছনে রবিন। পায়ে লেগে পাথর গড়িয়ে পড়ল। ওরাও কয়েকবার পিছলে পড়তে পড়তে বাঁচল।

চেঁচামেচিতে ঘুম ভেঙে গেল মুসার। বেরিয়ে এসে জানতে চাইল, কি হয়েছে।

জানল কিশোর।

কিশোরদের পেছনে কুগারটাকে দেখতে পেল না মুসা। পিছু নেয়নি ওটী। একবার হুঙ্কার ছেড়ে ভয় দেখিয়েই যথেষ্ট হয়েছে ভেবে ফিরে গেছে আবার গুহায়।

ধপ করে বসে পড়ল কিশোর। হাঁপাতে হাঁপাতে বলল, ওটা মেয়ে কুগার। নিশ্চয় বাচ্চা আছে গুহার মধ্যে। সেজন্যেই এত রাগ। ভেবেছে বাচ্চার ক্ষতি করতে গেছি।

গুহায় কি আছে তা তো জানলাম, রবিন বলল। আর ঢোকার দরকার নেই। ওখানে নেই ব্রাউন কিংবা লফার।

পর্বতের ঢালে বন আছে। সেটাতে ঢুকল তিন গোয়েন্দা। চোখ খোলা। রাখল সূত্রের সন্ধানে। একদিকে ধসে পড়া একটা ছাউনি দেখে এগিয়ে গেল। অনেক খোঁজাখুঁজি করেও সন্দেহজনক কিছু পেল না ভেতরে।

আচমকা, ভয় ধরিয়ে দেয়ার চেষ্টা করল মুসা, এই, প্লেনের কাছ থেকে এসেছি কতক্ষণ হয়েছে। পাক্কা দুই ঘন্টা!

তাতে কি? সামনে এগিয়ে যাওয়ার ইচ্ছে কিশোরের। দরজায় তালা দেয়া আছে।

তা বটে। কিশোরের সঙ্গে এগোল মুসা, কিন্তু ভয়টা তাড়াতে পারল নী মন থেকে। খুঁতখুঁত করছে। বলল, বাপরে, বনের মধ্যেও এত গরম!

কয়েক গজ এগিয়ে আবার দাঁড়িয়ে গেল মুসা। দেখো, আমার ভাল্লাগছে। না! কেমন জানি লাগছে। প্লেনটার যদি ক্ষতি করে কেউ?

এইবার আর না শুনে পারল না কিশোর। ভয়টা তার মধ্যেও সংক্রমিত হয়েছে। ফিরে চলল ওরা।

আধঘণ্টা লাগল বন থেকে বেরোতে। প্লেনটা চোখে পড়ল। ঠিকই আছে। বিরক্ত হয়ে কিশোর বলল, খামোক নিয়ে এলে! আরেকটু দেখতে চেয়েছিলাম…

বাধা দিয়ে বলে উঠল রবিন, ওই, দেখো!

মুসার ষষ্ঠ ইন্দ্রিয় ঠিকই সাবধান করেছে। গা শিউরানো অদ্ভুত এক দৃশ্য। শাঙ্কুব আকৃতির বিশাল একটা কি যেন মরুর বুক থেকে উঠে গেছে। আকাশের অনেক ওপরে। আগে কখনও না দেখলেও ওটা কি মুহূর্তে বুঝে ফেলল কিশোর। বালির ঘূর্ণি। ওদের দিকেই ধেয়ে আসছে।

কি-কি ওটা! চিনতে পারল না মুসা।

বালি-ঝড়! ভয় পেয়েছে কিশোর, গলা কাঁপছে। এই এলাকার লোকে বলে শয়তানের ঘূর্ণি! ঠিকই বলে, শয়তান ভর করে থাকে যেন বালির এই ঘূর্ণির মধ্যে। টর্নেডোর চেয়ে কম ভয়ঙ্কর না। প্লেনের ওপর দিয়ে বয়ে গেলে কিচ্ছু রাখবে না, ভর্তা বানিয়ে ফেলবে! জলদি সরাতে হবে! এসো!

ছুটল ওরা। ঝড় আসার আগে পৌঁছতে পারবে তো?

আরও জোরে! চেঁচিয়ে উঠল মুসা। রবিন আর কিশোরকে অনেক পেছনে ফেলে দিয়েছে।

প্লেনের কাছে পৌঁছল ওরা। ঝড়টা একশো গজ দূরে। এগিয়ে আসছে দ্রুত। দু-দিকের দুই ডানা চেপে ধরল কিশোর আর রবিন, মুসা ধরল লেজ।

তিনজনে মিলে ঠেলতে শুরু করল। নড়ে উঠল প্লেন। চাকায় ভর দিয়ে গড়িয়ে সরে যেতে শুরু করল। আরও জোরে ঠেলা দিল ওরা। গতি বাড়তে লাগল প্লেনের। সরে গেল অনেকখানি। বেকায়দা ভঙ্গিতে একটা পাথরে পা দিয়ে গোড়ালি মচকাল মুসা।

তবে প্লেনটাকে বাঁচাতে পারল ওরা। সামনে দিয়ে চলে গেল বালির ঘূর্ণি।

মাটিতে বসে গোড়ালি চেপে ধরে গোঙাচ্ছে মুসা।

ব্যথাটা কতখানি দেখার জন্যে তার পায়ে হাত দিতে গেল কিশোর।

চাপ লাগতে আরও জোরে চেঁচিয়ে উঠল মুসা। এমন অবস্থা, প্লেনও চালাতে পারবে না সে। তাকে এখন ফেলে রেখে তদন্ত চালানো সম্ভব নয়। অবশ্য দেখার আর নেইও কিছু।

মুসাকে প্লেনে উঠতে সাহায্য করল কিশোর আর রবিন। পাইলটের আসনে বসল এবার রবিন। রিভারসাইড কাউন্টি এয়ারপোর্টে ফিরে এল নিরাপদে।

ব্লাইদিতে মোটেলে ফিরে সবার আগে ডাক্তার ডাকা হলো।

মুসার পা ব্যান্ডেজ করে আর বেশ কিছু ট্যাবলেট গিলিয়ে দিয়ে ডাক্তার বললেন, কয়েক দিন বিছানায় শুয়ে থাকতে হবে। ভালমতই মচকেছে।

রাতে ম্যাপ নিয়ে বসল কিশোর। ঠিক হলো মুসার জন্যে অপেক্ষা করবে না ওরা। সে আর রবিন বোটে করে এগিয়ে যাবে কলোরাডো নদী ধরে। ব্লাইদিতে থাকবে মুসা। জরুরী দরকার পড়লে ফোনে তার সঙ্গে যোগাযোগ করবে কিশোররী। পা ততদিনে ভাল হয়ে গেলে এবং প্লেনটীর প্রয়োজন পড়লে ওটা নিয়ে ওদের কাছে চলে যাবে মুসা।

ম্যাপের দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করল রবিন, মেকসিকোতে যেতে কত সময় লাগবে?

এমনিতে দূর তো খুব বেশি না, জবাব দিল কিশোর। একশো মাইল। কিন্তু পথ ভাল না। নদীটার দিকে তাকিয়ে দেখো–দ্বীপ আর পানির নিচে বালির চরার অভাব নেই। তার ওপর রয়েছে তিন তিনটে বাধ। অনেক সময় নষ্ট করবে।

ম্যাপ দেখে জানা গেল প্রথম বাঁধটার নাম ইমপেরিয়াল ড্যাম। ব্লাইদি থেকে আশি মাইল দূরে। দ্বিতীয়টা ল্যাওনা ড্যামি। আর তৃতীয়টা রয়েছে সীমান্ত ঘেঁষে, মেকসিকোর ভেতরে পড়েছে–মরিলস ড্যাম।

পরদিন ভোরবেলা উঠে মুসার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে বেরিয়ে পড়ল রবিন আর কিশোর। ঘাটে এসে দেখল, বোট তৈরি। এর মালিক কথার বেলা হয়তো হয়তো যতই করুক, কাজের বেলা ঠিক।

বোট ছাড়ল দুই গোয়েন্দা। প্রথমে হাল ধরল রবিন। নদীর পানির রঙ এখন বাদামী, ওপরটা আয়নার মত স্থির আর চকচকে। বেলা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে রঙ বদলাবে। মরুভূমির অস্বাভাবিক নীরবতার মাঝে ইঞ্জিনের শব্দ বেশি করে কানে বাজছে।

দূ-তীরের একঘেয়ে দৃশ্য দেখতে দেখতে খুব শিগগিরই চোখ পচে গেল কিশোরের। সময় কাটানোর জন্যে বঁড়শি দিয়ে মাছ ধরতে বসল।

কয়েকটা বালির চরার পাশ কাটাল ওরা। ব্লাইদি থেকে একটা রাস্তা নদী পার হয়ে চলে গেছে, নদীর ওপরে ব্রিজ। সেটার নিচ দিয়ে পার হয়ে এল। বোট। ইতিমধ্যে বেশ কয়েকটা বিশাল আকারের কৈ মাছ ধরে ফেলল কিশোর।

দূরে দেখা গেল রিপ্লির পাহাড় চূড়া। টিলাও চোখে পড়ল। চিনতে পারল। ওখানেই রয়েছে দানবীয় নকশাগুলো।

দুপুরের আগে তীরে বোট ভেড়াল রবিন। মাছগুলো নিয়ে নেমে পড়ল দু জনে। আগুন জ্বেলে রান্না করে খেতে বসল।

ইমপেরিয়াল ড্যাম আর বেশি দূরে নেই, রবিন বলল। পাঁচ ঘণ্টার বেশি তো চললাম।

খাওয়ার পর আবার বোট ছাড়ল ওর। কিছুক্ষণ পরেই বাঁধটা চোখে পড়ল। কাছে এসে ডকে বোট ভেড়াল। এই প্রথম একটা বড় ধরনের লোকালয় পাওয়া গেল। মানুষজন যা আছে, বেশির ভাগই জেলে, ডক শ্রমিক, ট্রাক ড্রাইভার।

এক ড্রাইভারের সঙ্গে খাতির করে ফেলল কিশোর। লফার আর ব্রাউনের চেহারার বর্ণনা দিয়ে জানতে চাইল ওদের দেখেছে কিনা।

ড্রাইভার বলল, দেখেনি। ওরা অনেক দূর থেকে খুঁজতে এসেছে শুনে আরও কয়েকজন ড্রাইভারের সঙ্গে আলাপ করল সে। কেউ কিছু বলতে পারল না।

ওদেরকে ধন্যবাদ দিয়ে বোটে ফিরে এল দুই গোয়েন্দা। আবার বোট ছাড়ল। হাল ধরল কিশোর। আধমাইল মত যাওয়ার পর হঠাৎ একটা বালির টিবির দিকে তাকিয়ে চেঁচিয়ে উঠল রবিন, দেখো, দেখো, সেই বেয়ারাটী!

.

১০.

শাই করে সেদিকে বোটের নাক ঘুরিয়ে দিল কিশোর। মাঝনদীতে রয়েছে। ওরী। কিনারে পৌঁছে বোট ভিড়িয়ে ডাঙায় নামতে নামতে অনেক সময় লাগিল। ঢিবির ওপারে আর দেখা গেল না লোকটাকে। বড় বড় পাথর আর পাহাড় রয়েছে ওখানে। কোথায় লুকিয়েছে কি করে খুঁজে বের করবে?

কিছুক্ষণ খোঁজাখুঁজি করে লোকটাকে না পেয়ে আবার বোটে ফিরে এল ওরা। টিবিটীর কাছে পানিতে একটা সবুজ ঘোট মোটরবোট নোঙর করা। রবিন বলল, এই বোটে করেই হয়তো এসেছে ব্যাটা। খানিকটা এগিয়ে বসে থাকি চুপচাপ। এক সময় না এক সময় আসতেই হবে তাকে।

আবার নদীর মাঝখানে এসে নোঙর ফেলে মাছ ধরার ভান করতে লাগল দু-জনে। বেশিক্ষণ অপেক্ষা করতে হলো না। একটা লোক এসে বোটে উঠল। গায়ে নীল শার্ট। কিন্তু সে বেয়ারা নয়। তবে যে ভাবে ওদের বোটটার দিকে তাকাচ্ছে, সেটা সন্দেহজনক।

বোট ছাড়ল সে। মেকসিকোর দিকে যেতে লাগল। কোথায় যায়, দেখার জন্যে পিছু নিল গোয়েন্দারা। ওদের ধারণা হলো, সামনে কোথাও গিয়ে অপেক্ষা করবে বেয়ারার ছদ্মবেশী লোকটা। নীল শার্ট পরা লোকটা বোট তীরে ভিড়িয়ে তাকে তুলে নেবে।

আধ মাইল এগোনোর পর যেন ওদের ওপর বিরক্ত হয়ে উঠল লোকটা। বার বার পেছনে ফিরে তাকাচ্ছে। শেষে ইঞ্জিন বন্ধ করে দিয়ে ভেসে রইল। ওরা কাছাকাছি হলে হাত নেড়ে ডাকল।

বোট কাছে নিয়ে গেল কিশোর।

ককশ স্বরে জিজ্ঞেস করল লোকটা, আমার পেছনে লেগেছ কেন?

নিরীহ স্বরে কিশোর জবাব দিল, কই? আপনি যেদিকে যাচ্ছেন আমরাও সেদিকে যাচ্ছি।

দীর্ঘ একটা মুহূর্ত কিশোরের দিকে কড়া চোখে তাকিয়ে রইল লোকটা। আবার বোট ছাড়ল। আগের মতই পেছনে লেগে রইল গোয়েন্দারা।

ল্যাশুনা ড্যাম দেখা গেল। রিজারভয়েরের ভেতরে ঢুকে আবার ইঞ্জিন বন্ধ করে দিল লোকটা। কিশোরদের ডেকে বলল, এবার কিন্তু আমি পুলিশ ডাকব!

ডাকুন না, জবাব দিল কিশোর। অন্যায় কিছু করিনি আমরা।

রবিন বলল, আপনার আর ডাকার দরকার হবে না। ওই যে পুলিশ আসছে।

পুলিশের লঞ্চ দেখেই ঘাবড়ে গেল লোকটা। গতি বাড়িয়ে ছুটতে শুরু করল। বাধা পেরিয়ে গিয়ে তীরে ভেড়াল নৌকা। লাফিয়ে ডাঙায় নেমে ছুটতে ছুটতে অদৃশ্য হয়ে গেল।

দূরবীন চোখে লাগিয়ে বোটটাকে দেখছে একজন অফিসার। কাছাকাছি বোট নিয়ে গেল কিশোর। জিজ্ঞেস করল, কিছু হয়েছে, অফিসার?  বোটটা চুরি করে এনেছে ও, অফিসার জবাব দিল। সকালে রিপোর্ট করা হয়েছে আমাদের কাছে। তোমরা মনে হলো ওটার পিছু লেগেছিলে? কেন?

অল্প কথায় বুঝিয়ে বলল কিশোর, ওরা গোয়েন্দা। নিখোঁজ একজন মানুষকে খুঁজতে বেরিয়েছে। বেয়ারার ছদ্মবেশী লোকটা অদৃশ্য হয়ে যাবার পর কি করে সবুজ বোটের পেছনে লেগেছে বলল।

কিশোররা মেকসিকোতে যাচ্ছে শুনে অফিসার বলল, নোকটাকে ধরতে যাচ্ছি আমরা। কি করতে পারলাম জানার ইচ্ছে থাকলে ইয়োমাতে গিয়ে থানায় খোঁজ কোরো। মেসেজ দিয়ে রাখব।

গতি বাড়িয়ে চলে গেল লঞ্চটা।

কিশোররাও এগোতে থাকল। পথে যেখানেই মানুষ-জন দেখতে পেল, জেলে নৌকা দেখল, থামিয়ে লফার আর ব্রাউনের খোঁজ নিল। কিন্তু ওরকম কাউকে দেখেছে বলে কেউ বলতে পারল না।

কেটে গেল দিনটা। সূর্য ডুবল। সন্ধ্যার অন্ধকার গাঢ় হতে লাগল। নদীর কিনারে আর পানির ওপর পোকা খুঁজতে বেরোনো পাখিগুলোকে অস্পষ্ট লাগছে। আকাশের পটভূমিতে বাদুড়ের দলকে লাগছে কেমন অপার্থিব।

থামার সময় হয়েছে, কিশোর বলল।

নদীর মাঝে একটা বালির চরার ধারে নোঙর ফেলল ওরা। খাবারের টিন আর স্লীপিং ব্যাগ নিয়ে নামল। ওখানেই ক্যাম্প করে রাত কাটানোর ইচ্ছে।

আগুন জেলে রান্না করতে বসল রবিন। হাত-পা ছড়িয়ে পাশে বসে রইল কিশোর। বাতাসে ছড়িয়ে পড়ল মাংস ভাজার সুগন্ধ। মাখন মাখানো পাউরুটি, ভাজা মাংস, পনির, আপেলের সস, আর টিনে করে আনা সেদ্ধ বাঁধাকপি দিয়ে খাওয়া সারল ওরা। ঢুকে পড়ল স্লীপিং ব্যাগের মধ্যে।

আকাশে তারার মেলা। নীরব রাত। মরুভূমির মধ্যে দিয়ে বয়ে যাওয়া নদীর মাঝে নির্জন বালির চরায় শুয়ে থাকা। সে এক বিচিত্র অনুভূতি। খুব ভাল লাগছে কিশোরের। এই মুহূর্তে মনে হচ্ছে, জন্মটা সার্থক।

নিরাপদে রাত কাটল। পরদিন ভোরে রওনা হলো আবার ওরা। ঘণ্টা দুয়েকের মধ্যে ইয়োমাতে পৌঁছে থানায় খোঁজ নিতে চলল। ওদেরকে স্বাগত জানাল ডিউটি অফিসার। নাম শুনে চিনতে পারল। লঞ্চ থেকে মেসেজ পাঠানো হয়েছে তার কাছে, বোঝা গেল।

তবে গোয়েন্দাদের নিরাশ করল অফিসার। বোট চোরকে ধরা যায়নি। পুলিশের হাত ফসকে পালিয়ে গেছে লোকটা। তার পরিচয়ও জানতে পারেনি পুলিশ।

থানা থেকে বেরিয়ে বোটে এসে উঠল দু-জনে। তারপর আবার এগিয়ে চলী।

.

১১.

 দুপুরের পর সীমান্ত পেরিয়ে মেকসিকোর সোনোরা রাজ্যে ঢুকল ওরা। চেকপোস্টে খুব কড়াকড়ি। ডিউটি অফিসার ওদের জানাল, চোরাচালানি আর অবৈধ অনুপ্রবেশকারীরা নাকি ইদানীং খুব যন্ত্রণা দিচ্ছে। লফার আর ব্রাউনের কথা অফিসারকে জিজ্ঞেস করল কিশোর। কিন্তু কিছু বলতে পারল না অফিসার।

বিকেলের ভয়ানক কড়া রোদের মধ্যে এগিয়ে চলল বোট।

বেশ কয়েক মাইল এগোনোর পর নদীর তীরে কয়েকটা ঝোপের ধারে পাঁচ-ছয়টা ছেলেমেয়েকে জটলা করতে দেখা গেল। নদীতে গোসল করতে এসেছে ওরা। সীমান্ত পেরিয়ে আসার পর এই প্রথম মানুষ দেখতে পেল। গোয়েন্দারা। বচ্চিাগুলোর দিকে এগিয়ে গেল ওরা।

ওরাও বোট দেখে এগিয়ে এল। কৌতূহলী হয়ে দেখতে লাগল। স্থানীয় ইনডিয়ানদের ছেলেমেয়ে।

হাত নেড়ে ডাকল কিশোর। কিন্তু কাছে এল না ওরা। ভয় পাচ্ছে। শেষে এক বুদ্ধি করল সে। বোট থেকে মাটিতে নেমে পকেট থেকে চিউয়িং গাম বের করল। এইবার গুটিগুটি এগিয়ে এল ছেলেমেয়েগুলো।

সহজেই ভয় কাটিয়ে দিল ওদের কিশোর আর রবিন। ইংরেজি জানে না ওরা, তবে স্প্যানিশ বোঝে। ভাঙা ভাঙা স্প্যানিশে ওদের কাছে জানতে চাইল, কোন বিদেশীকে এদিক দিয়ে যেতে দেখেছে কিনা।

একটা ছেলে জবাব দিল, দেখেছে। এই প্রথম হ্যাঁ-বাচক জবাব পেয়ে সতর্ক হলো গোয়েন্দারা। ছেলেটার বাড়ি কোথায়, জিজ্ঞেস করল। হাত তুলে পাহাড়ের দিকে দেখিয়ে দিল ছেলেটা।

বোট ঘাটে রেখে ছেলেটার সঙ্গে ওদের বাড়িতে চলল দুই গোয়েন্দা, তার বাবার সঙ্গে দেখা করার জন্যে। দল বেঁধে ওদের সঙ্গে চলল বাকি ছেলেমেয়েগুলো। চিউয়িং গাম পেয়ে খুব খুশি ওরা। যে কোন সাহায্য করতে রাজি।

পাহাড়ের কোলে ওদের বাড়িঘর। যে ছেলেটী বিদেশী লোক দেখেছে বলেছে, তার বাবা কৃষক। ছেলের কথা সমর্থন করল। বলল, আমি দেখিনি, তবে শুনেছি। রিটার দিকে গেছে। আমেরিকান।

কি করে গেছে, জানতে চাইল কিশোর।

কৃষক জানাল, মরুভূমি দিয়ে এসেছিল লোকটা। কয়েক মাইল দূরে রেলস্টেশন আছে, রেলগাড়ি চলাচল করে। লোকটা লাইন ধরে হেঁটে গেছে সভবত স্টেশনে, তারপর গাড়িতে করে গেছে, ঠিক জানে না কৃষক।

কোন দিকে কি ভাবে যেতে হবে, জেনে নিল কিশোর। রবিনের সঙ্গে আলোচনা করে ঠিক করল, ওরাও ওই পথেই যাবে। তাহলে হয়তো আরও খোঁজ মিলতে পারে। ঘাটে বোট রেখে যাবে। কৃষককে অনুরোধ করে বলল, সে বোটটা দেখেশুনে রাখতে রাজি হলে তাকে টাকা দেয়া হবে।

রাজি হলো কৃষক। অতএব আর কোন দ্বিধা নয়। রেললাইনের দিকে হাঁটা শুরু করে দিল দুই গোয়েন্দা।

কয়েকশ গজ এগোতেই চোখে পড়ল রেললাইন।

ঘড়ি দেখল কিশোর। ছটা বাজে। রেললাইন ধরে এগোলে রাতের আগে পৌঁছে যেতে পারবে স্টেশনে।

স্লীপার আর লাইনে ফেলে রাখা পাথর মাড়িয়ে এগিয়ে চলল ওরা।

ঘণ্টাখানেক চলার পর লাইনের ধারে ছোট একটা বাড়ি দেখা গেল। ওটাই স্টেশন। সেখানে এসে দেখা গেল একজন মাত্র লোক স্টেশনটা চালাচ্ছে। স্টেশন মাস্টার থেকে লাইনম্যান–সব সে একাই। তার নাম কাপারিলো। বিদেশী এবং আমেরিকা থেকে এসেছে শুনে বিশেষ খাতির করতে লাগল। ওরা গোয়েন্দা শুনে খাতিরের পরিমাণ আরও বেড়ে গেল।

জানা গেল, কিছুক্ষণ পরই একটা মালগাড়ি আসবে, উত্তরে মেক্সিকালিতে যাবে। কিশোররা যেতে চাইলে তাতে ওদেরকে তুলে দেয়া সম্ভব হবে, এবং ওরা গোয়েন্দা বলেই এই কাজটা করতে রাজি আছে কাপারিলো। তবে যেহেতু মালগাড়িতে করে যাবে, টিকেট দিতে পারবে না। মালগাড়ি যাত্রী বহন করে না, সুতরাং টিকেট দেয়ারও নিয়ম নেই।

 কথায় কথায় কিশোর জানতে চাইল, আচ্ছা, কিছুদিনের মধ্যে আর কোন আমেরিকানকে এ স্টেশনে আসতে দেখেছেন? গত দু-তিন মাসের মধ্যে?

একটা মুহূর্ত নীরব থেকে মনে করার চেষ্টা করল যেন কাপারিলো। বলল, দেখেছি। ছোট্ট স্টেশন, যাত্রী খুব কম আসে। বিদেশী তে আরও কম। সে জন্যেই মনে আছে। কয়েক হপ্তা আগে একজন ঠিক এ রকম সময়েই হেঁটে এসে হাজির। স্টেশনে মালগাড়ি থামলে আমরা মাল খালাস করছি, এমন সময় দেখি চুরি করে একটা বগিতে উঠে পড়ল লোকটা।

হবে হয়তো কোন ভবঘুরে, রবিন বলল। টাকা ছিল না, তাই চুরি করে উঠেছে।

আমিও তাই ভেবেছি। গিয়ে ধরলাম। কাকুতি-মিনতি শুরু করল। লোকটা। বলল, আমেরিকা থেকে এসেছে। গাড়িতে থাকতে দিতে বলল। কারা নাকি তাকে তাড়া করেছে।

পুলিশ? বেআইনী ভাবে মেকসিকোতে ঢুকেছে লোকটা?

কাঁধ ঝাঁকাল লোকটা। তা তো জানি না। মরুভূমির ওপর দিয়ে অনেক পথ হেঁটে এসেছে। ওর অবস্থা দেখে দুঃখই লাগল। হঠাৎ মরুভূমির রাস্তায় হেডলাইট দেখলাম। একটা গাড়ি আসছিল। দেখেই লোকটা বলল, তাকে ধরতে আসছে ওরা। ট্রেনটা তখন ছাড়ার সময় হয়েছে। ভাবলাম, থাকগে, যকি। সত্যি হয়তো বিপদে পড়েছে লোকটা।

ট্রেন ছেড়ে যাওয়ার পর স্টেশনে পৌঁছল গাড়িটা। লাফিয়ে নামল দু-জন লোক, আমেরিকান বলে মনে হলো। আমাকে জিজ্ঞেস করল কোন ভবঘুরেকে এদিক দিয়ে যেতে দেখেছি কিনা। লোকটা নাকি অপরাধী। কিন্তু আমার কাছে তাকে ওরকম মনে হয়নি।

তারপর? জানতে চাইল কিশোর। বুকের মধ্যে একধরনের চাপা উত্তেজনা শুরু হয়েছে। মনে হচ্ছে, এতদিনে আসল খবরটা পাওয়া গেছে।

ভ্রূকুটি করল কাপারিলো। বরং ওই লোকগুলোকেই খারাপ মনে হলো আমার। অনেক দিন আমেরিকায় ছিলাম আমি। ওখানকার অপরাধী দেখেছি। কি রকম অচিরণ করে জানি। বিশ্রী ভাষায় কথা বলে, গাল দেয়। বিশালদেহী, রুক্ষ চেহারার ওই দু-জনও এ রকমই করছিল।

উত্তেজনা আর চেপে রাখতে পারল না রবিন। কিশোরের দিকে তাকিয়ে বাংলায় বলল যাতে কাপারিলো বুঝতে না পারে, ওই ভবঘুরেই নিশ্চয় লফার! আর লোকগুলো মনে হয় সেই দু-জন, যারা তার অফিসে গিয়ে তার সেক্রেটারিকে হুমকি দিয়েছে!

মাথা ঝাঁকাল কিশোর। মনে হয়।

কাপারিলোর দিকে তাকাল রবিন। জিজ্ঞেস করল, ভবঘুরে লোকটা লম্বা, না খাটো? দেখতে কেমন?

লম্বা। হালকা-পাতলা। মনে হলো অনেক পথ হেঁটে এসেছে। ভীষণ ক্লান্ত।

হু, মাথা দোলাল কিশোর। উত্তরে, সীমান্তের দিকে।

তাহলে, নিজেকেই যেন প্রশ্ন করল কিশোর, লফার এখনও বাড়ি পৌঁছল না কেন?

 হয়তো ধরা পড়েছে, রবিন বলল। যারা তার পিছে লেগেছিল, তারা ধরে ফেলেছে। কিংবা হয়তো তার বাড়ির ওপর নজর রাখা হয়েছে ভেবে ভয়ে বাড়িতে ঢুকছে না। অথবা এমনও হতে পারে, কোন বিপদে পড়েছে তার বন্ধু ব্রাউন, তাকে উদ্ধার করার জন্যে মেকসিকোতে রয়ে গেছে সে।

এইটা হতে পারে। ব্রাউনের কথা ভুলেই গিয়েছিলাম। নিজেদের মধ্যে। কথাগুলো বাংলায় চালিয়ে যাচ্ছে কিশোররা। কিন্তু সে লফারের সঙ্গে ছিল না কেন? মরুভূমি পেরিয়ে লফার একা এল কেন?

এই সময় ট্রেনের হুইসেল শোনা গেল। দেখা গেল হেডলাইট।

কাপারিলো বলল, ওই যে, ট্রেন আসছে।

পতাকা দেখিয়ে ট্রেন থামাল সে। একটা বক্সকার দেখিয়ে তাতে উঠে যেতে বলল ছেলেদের।

কাপারিলোর সাহায্যের জন্যে তাকে অনেক ধন্যবাদ দিল কিশোর আর রবিন। হাত মেলাল। অন্ধকারে গা ঢেকে উঠে পড়ল বক্সকারে।

কয়েকটা মালের বাক্স গার্ডের গাড়িতে তুলে দিল কাপারিলো। আবার চলতে শুরু করল ট্রেন।

.

১২.

বক্সকারের বিশাল খোলা দরজার পাশে হাঁটু মুড়ে বসেছে কিশোর আর রবিন। ভেতরে আলো নেই। বাইরে চাঁদের আলো। মরুভূমির মধ্যে দিয়ে চলে গেছে রেললাইন। সীমাহীন বালির রাজত্বে ছোট ছোট ঝোপঝাড় আছে। কোথাও মাথা তুলেছে পাথরের পাহাড়। মাঝে মাঝে চোখে পড়ে বুনো জানোয়ার। আর কচিত-কদাচিত চোখে পড়ে একআধটা নিঃসঙ্গ মাটির তৈরি বাড়ি, এই এলাকায় অ্যাডবি নামে পরিচিত। এত রাতে আলো দেখা গেল না। কোন বাড়ির জানালায়।

এরপর কি করব আমরা? জিজ্ঞেস করল রবিন।

ট্রেনটা যতদূর যায়, যাব। লফার নিশ্চয় এইই করেছিল। গিয়ে দেখি, কি ঘটে?

 অহেতুক বসে থেকে লাভ কি? একটু ঘুমিয়ে নিই। গুটিসুটি হয়ে শুয়ে পড়ল রবিন। বাপরে বাপ, যা ঝাঁকি! ঘুমানো লাগবে না!

কিশোরও শুয়ে পড়ল তার পাশে।

ঝাঁকি বন্ধ হয়ে যাওয়াতে ঘুম ভাঙল ওদের। ট্রেন থেমে গেছে। লোকের কথা শোনা গেল। একটা মুখ উঁকি দিল বক্সকারের দরজায়। হাসি হাসি একটা কণ্ঠ বলল, ওঠো, উঠে পড়ো। আমেরিকায় যাওয়া আর তোমাদের হলো না।

ইউনিফর্ম দেখেই চিনে ফেলল কিশোর। বিড়বিড় করল, মেকসিকান পুলিশ!

হ্যাঁ, মাথা ঝাঁকাল লোকটা। বর্ডার পুলিশ। মেকসিকোতে এটা শেষ স্টেশন। অবৈধ যাত্রীকে দেখলেই আমরা এখানে নামিয়ে নিই।

তারমানে মেকসিকালিতে এসে গেছি?

হ্যাঁ, এসেছ। নামো তো এবার, আরও অনেকে অপেক্ষা করছে। দেরি দেখলে বিরক্ত হয়ে যাবে, ব্যঙ্গের সুরে বলল পুলিশ অফিসার।

বক্সকার থেকে নামিয়ে ট্রেনের সামনের দিকে নিয়ে যাওয়া হলো কিশোরদের। ইঞ্জিনের কাছাকাছি দাঁড় করিয়ে রাখা হয়েছে আরও কয়েকজনকে। সবার পরনেই ময়লা, মলিন পোশক। দরিদ্র কৃষক কিংবা শ্রমিক শ্রেণীর লোক সবাই।

কারা ওরা? রবিনের প্রশ্ন।

কিশোর জবাব দিল, হবে হয়তো আমাদেরই মত টিকেট ছাড়া যাত্রী। বেআইনী ভাবে বর্ডার পার হতে চেয়েছিল, আটকে দিয়েছে পুলিশ।

বড় একটা লরির পেছনে তোলা হলো ওদের।

কোথায় নিয়ে যাচ্ছে আমাদের? আবার প্রশ্ন করল রবিন।

জেলে হবে, আর কোথায়!

কিন্তু আমাদের জেলে নেবে কেন? আমরা তো অবৈধ ভাবে সীমান্ত পার হতে চাইনি!

চলতে শুরু করল লরি।

কিছুক্ষণ পর থানার শান বাঁধানো চত্বরে এসে ঢুকল। এগিয়ে এল কয়েকজন অস্ত্রধারী গার্ড। বন্দিদের নামিয়ে লাইন দিয়ে দাঁড় করানো হলো।

কিশোর আর রবিনকে লাইন থেকে বের করে দিল একজন অফিসার। আবার লরিতে ওঠানো হলো ওদের, তবে পেছনে নয়, সামনে, ড্রাইভারের পাশে। আবার পথে বেরিয়ে এল লরি। শহরের দিকে চলল।

অবাক হয়ে জানতে চাইল কিশোর, কি ব্যপিরি? আমাদের কোথায় নিচ্ছেন?

চোরাচালানি ধরার চেষ্টা করছে পুলিশ, জবাব দিল ড্রাইভার। তাই ট্রেন থেকে নোক নামিয়ে ধরে এনেছে। তোমরা নিশ্চয় তিন গোয়েন্দার লোক? শহরে নিয়ে গিয়ে তোমাদেরকে ছেড়ে দেয়ার নির্দেশ দেয়া হয়েছে। আমাকে। সেটাই করছি।

আশ্চর্য! রবিন বলল। আমাদের নাম জানল কি করে?

 মিস্টার সাইমনের হাত নেই তো এতে? কিশোরের প্রশ্ন।

কি জানি? তবে কি তিনি আশেপাশেই কোথাও আছেন? লফারের। কেসটা নিজেই নিয়েছেন?

খোদাই জানে। ড্রাইভারকে জিজ্ঞেস করল কিশোর, আমাদের কোথায় নিয়ে যাচ্ছেন?

আলগোডোনেসে।

তাহলে আমাদের বোটটার কি হবে? আনব কি করে ওটা? প্রশ্নটা অবশ্য ড্রাইভারকে করল না কিশোর, নিজেকে করল।

তোমরা গোয়েন্দা, তাই না? পুলিশের হয়ে কাজ করছ?

হ্যাঁ। একজন আমেরিকান ভদ্রলোককে খুঁজছি। মেকসিকোতে এসে হারিয়ে গেছে।

তোমাদের বোটের কথা কি যেন বললে? কোথায় ওটা?

 কোথায় আছে জানাল কিশোর।

ড্রাইভার বলল, পুলিশ তোমাদের সাহায্য করবে। তোমরা হোটেলে উঠে বিশ্রাম নাও। বোটটা আনানোর ব্যবস্থা করব আমরা।

এক কাপড়ে চলে এসেছে। ঘণ্টাখানেক পর আলগোডোনেসের একটা দোকানে ঢুকল কিশোররা কিছু কাপড়-চোপড় কেনার জন্যে। খাঁটি মেকসিকান পোশাক কিনে পরল। মাথায় চাপাল উজ্জ্বল রঙের ব্যানডানা হ্যাট। উঁচু হিলওয়ালা মেকসিকান বুট কিনে পায়ে দিল।

শহরের সবচেয়ে বড় হোটেলটায় এসে রুম নিল ওরা। দুষ্টবুদ্ধি খেলে গেল কিশোরের মাথায়। নিজের নামকে স্প্যানিশ বানিয়ে লিখল, কিশোরীস্কো প্যাশোয়ে। আর রবিনের নাম রবিনাস্কো মিলফোর্ডো।

নাম দেখে মাথা দুলিয়ে ক্লার্ক বলল, বাহ, চমৎকার নাম। এক্কেবারে নতুন, আর কখনও শুনিনি।

হাসতে শুরু করল রবিন। বাংলায় জিজ্ঞেস করল, মানে কি এই নামের?

আমি কি জানি! আমেরিকার ফ্র্যাঙ্ক যদি মেকসিকোতে এসে ফ্রান্সিস্কো হয়ে যায়, কিশোরের কিশোরাস্কো হতে দোষ কি?

অকাট্য যুক্তি। চুপ হয়ে গেল রবিন।

ক্লার্ককে অনুরোধ করল কিশোর, আপনাদের গেস্ট বুকটা একটু দেখতে পারি? আমাদের দুজন বন্ধু আসার কথা। দেখি নাম আছে নাকি?

তোমাদের বন্ধুরা কি জেলে?

না, তবে নৌকা নিয়ে ভ্রমণে বেরিয়েছিল। আমদের চেয়ে বয়েস অনেক বেশি, চল্লিশের কাছাকাছি। দু-জনেরই হালকা-পাতলা শরীর, একজন বেশি লম্বা। নাম লফার।

মাথা নাড়ল ক্লার্ক। ওরকম কেউ ওঠেনি হোটেলে।

রেজিস্টার ঘেঁটে কিশোরও কিছু বের করতে পারল না। খাতাটা ঠেলে দিয়ে বলল, হয়তো অন্য কোন হোটেলে উঠেছে আমাদের বন্ধু। একজনের অবশ্য ঘোড়র প্রতি আকর্ষণ আছে। কাছাকাছি কোন ঘোড়ার রঞ্চি থাকলে, আর শেটল্যাণ্ড পনি থাকলে সেখানে উঠেও যেতে পারে।

তাহলে তো এদিকে তার আসারই কথা নয়, হাসিমুখে বলল ক্লার্ক। বর্ডারের কাছে একটা পনি ব্যাঙ্ক আছে ইয়োমা আর আড্রাডির মাঝামাঝি। নাম কুপার র‍্যাঞ্চ।

থ্যাংকস, হেসে বলল কিশোর। মনে হচ্ছে ওখান থেকেই বের করে আনতে হবে ওকে।

ঘরে ঢুকেই রবিন জিজ্ঞেস করল, কুপার রাঞ্চে যাওয়ার ইচ্ছে আছে নাকি?

সূত্র যখন একটা পাওয়া গেছে, গিয়ে দেখাই উচিত।

তা-ও বটে। হাত-মুখ ধুয়ে খাওয়ার জন্যে রেস্টুরেন্টে নেমে এল ওরা। ওখান থেকে ফোন করল ব্লাইদিতে, মুসার কাছে।

ভেসে এল মুসার হাসিখুশি কণ্ঠ, বেঁচে তাহলে আছ?

না, হেসে জবাব দিল রবিন, পরপরি থেকে করছি। তবে বেহেশতেই আছি বলতে পারো। দোজখে যাইনি। তারপর খবর বলল।

আমি ভালই আছি। পায়ের ব্যথা সেরেছে। লফারের খোঁজ পেয়েছ?

পেয়েছি। তবে ঠিক কোথায় আছে বলতে পারছি না।

ও। আমিও এখানে বসে নেই। পা একটু ভাল হতেই প্লেন নিয়ে বেরিয়েছিলাম। মরুভূমির ছবি তুলে এনেছি। রাতের মরুভূমি যা দারুণ লাগে।

রাতের বেলা মরুভূমিতে গিয়েছিলে তুমি! ভূতের ভয় করেনি?

আমি একা যাইনি। একজন বন্ধু জুটে গেছে। একটা প্রাইভেট প্লেনের পাইলট, নাম ওয়ারনার বল। আমার ইনফ্রারেড ক্যামেরাটার ভক্ত হয়ে গেছে।

হু। কিশোর বলছে, প্রতিদিন এ সময় তোমাকে মোটেলে থাকতে। ফোনে যোগাযোগ করব। গুড বাই।

লাইন কেটে দিল রবিন। কিশোরকে খবর জানাল।

পরদিন সকালে শহরে লফার আর ব্রাউনের খোঁজ নিতে বেরেলি দু জনে। দোকানপাট, পেট্রোল স্টেশন, রেস্টুরেন্ট-সমস্ত জায়গায় ঘুরল। কোন লাভ হলো না। দুপুর নাগাদ ক্লান্ত হয়ে হোটেলে ফিরে এল।

বিকেলে ওদের খোঁজ নিতে এল পুলিশের সেই ড্রাইভার। জানাল, ডকে নিয়ে আসা হয়েছে ওদের বোটটী।

হোটেল ছেড়ে দিল কিশোর। ডকে চলল।

 ঘণ্টাখানেক পরই আবার বোটে করে নদীপথে ইয়োমার দিকে ফিরে চলল দুই গোয়েন্দা। বিকেলের উত্তপ্ত রোদ থাকতে থাকতেই আরেকবার সীমান্ত অতিক্রম করল। আরও কিছুক্ষণ পর চোখে পড়ল ইয়োমা ডক।

ডকে এসে বোট বাঁধল ওর। লোকজনকে জিজ্ঞেস করে জেনে নিল কিশোর, কুপার ব্ল্যাঞ্চটা কোথায়। জানল, ওখান থেকে মাইল দুয়েকও হবে না।

দু-জনে দুটো রাকস্যাক বেঁধে নিয়ে নেমে পড়ল বোট থেকে। হেঁটে চলল মরুভূমির ভেতর দিয়ে চলে যাওয়া একটা সরু পথ ধরে।

চোখে পড়ল র‍্যাঞ্চের নিচু ছাতওয়ালা বাড়ি, আর ঘোড়া রাখার কোরাল।

রবিন বলল, জুতো না খুলে আর পারছি না। উফ, বাপরে বাপ, ফোঁসকা পরে গেছে। নতুন জুতো পরে আসাই বোকামি হয়ে গেছে!

বসে পড়ল সে। জুতো খুলে বিশ্রাম দিল পা দুটোকে। আবার পায়ে দিয়েই উঁক করে উঠল।

কি হয়েছে? উদ্বিগ্ন হয়ে জানতে চাইল কিশোর।

কি জানি মনে হলো বঁড়শি বিঁধেছে!

জুতোর মধ্যে বঁড়শি আসবে কোত্থেকে? ভুল করে একআধটা ভেতরে ফেলেনি তো?

নাহ, দেখার জন্যে আবার জুতোটা খুলে নিয়ে উপুড় করতেই টুপ করে পড়ল একটা ছোট, খড় রঙের জীব। কাঁকড়ার মত দাঁড়া, আর টিকটিকির মত লেজ। লেজটা ওপর দিকে বাঁকানো। মাথাটা সুচের মত চোখ।

সর্বনাশ! চেঁচিয়ে উঠল কিশোর। কাকড়া বিছে! সাংঘাতিক বিষাক্ত! বিষ বেশি ঢুকে থাকলে বারোটা বাজিয়ে দেবে!

বিছেটাকে জুতো দিয়ে পিষে মেরে ফেলে, তাড়াতাড়ি কাপড় ছিঁড়ে রবিনের পায়ে টনিকেট বেঁধে দিল কিশোর, যাতে রক্তবাহিত হয়ে বিষ হৃৎপিণ্ডে পৌঁছতে না পারে। ওখানে পৌঁছলে সারা শরীরে ছড়িয়ে পড়বে বিষ। জিজ্ঞেস করল, হাঁটতে পারবে?

মাথা কাত করল রবিন, পারব।

কিশোরের কাঁধে ভর দিয়ে খোঁড়াতে খোঁড়াতে এগেল সে।

ওদেরকে আসতে দেখল দু-জন কাউবয়। রবিনের অবস্থা দেখে এগিয়ে এল। একজনের নাম রস ডুগান, আরেকজন চাক হারপার।

রবিনকে র‍্যাঞ্চে নিয়ে যেতে সাহায্য করল ওর।

হই-চই শুনে র‍্যাঞ্চের মালিক মিস্টার কুপারও বেরিয়ে এলেন। ভেতরে নিয়ে গেলেন রবিনকে। বরফ আনতে বললেন।

দৌড়ে গিয়ে ফ্রিজ থেকে বরফের টুকরো বের করে আনল চাক হারপার।

ইতিমধ্যে বিষ-নিরোধক একটা ইঞ্জেকশন দিয়েছেন রবিনকে কুপার। আহত জায়গায় বরফ ডলে দিতে লাগলেন। বললেন, ভাগ্যিস র‍্যাঞ্চের কাছে এসে কামড় খেয়েছ। সঙ্গে সঙ্গে চিকিৎসা করা না হলে মারাও যেতে পারতে! তা যাচ্ছিলে কোথায়?

আপনার এখানেই আসছিলাম, জবাব দিল কিশোর। একজন লোকের খোঁজে। লফারের চেহারার বর্ণনা দিল সে।

নিক কোরাসনের কথা বলছে না তো! বলে উঠল রস ডুগান।

নিক কোরাসন! বিড়বিড় করল কিশোর, নাম বানিয়ে বলেছে হয়তো। কুপারের দিকে তাকাল আবার, তারমানে ওরকম চেহারার একজন লোক আছে আপনাদের এখানে?

ছিল। এখন নেই। দুই হপ্তা চাকরি করেছে আমার এখানে।

Super User