১৩.

 সব কথা খুলে বলতে অনুরোধ করল কিশোর।

বলার তেমন কিছু নেই, কুপার বললেন। হঠাৎ একদিন এসে হাজির। খোঁচা খোঁচা দাড়ি। ময়লা কাপড়-চোপড়। যেন একটা ভূত। প্রথমে চাকরি দিতে চাইনি। কিন্তু খেপে যাওয়া একটা পনিকে যে ভাবে সামলাল, বুঝলাম ঘোড়ী চেনে, ঘোড়ার স্বভাব বোঝে। দিয়ে দিলাম চাকরি।

কোন সন্দেহ রইল না আর কিশোরের, নিক কোরাসনই মাটি লফার। জিজ্ঞেস করল, একা এসেছিল, না সঙ্গে অন্য কেউ ছিল?

 একাই এসেছিল, মাথা নাড়তে নাড়তে বললেন কুপার, কিন্তু রাখতে পারলাম না! শেটল্যাণ্ড পনির ব্যাপারে এত জ্ঞান আমি আর কারোর দেখিনি। লোক হিসেবেও ভাল। আমার খুব কাজে লাগত। কতভাবে চেষ্টা করলাম রাখার জন্যে, থাকল না। চেয়ার ঠেলে উঠে দাঁড়ালেন তিনি। দাঁড়াও, একটা জিনিস এনে দিচ্ছি। দেখো, কোন উপকার হয় কিনা তোমার। বাংকে ফেলে গিয়েছিল কোরাসন।

রসকে নিয়ে বেরিয়ে গেলেন কুপার।

রবিন বলল, কিশোর, কোন কারণে ব্রাউনের কাছ থেকে আলাদা হয়ে গেছে লফার। উত্তরে চলে গেছে।

মাথা ঝাঁকাল কিশোর। নামও গোপন করেছে। কারও কাছ থেকে ভাগছে মনে হয়। কাকে ভয় করছে?

আছে কোন শত্রু। সেই শত্রু তাকে খুঁজে বের করতে পারেনি। তাই আমাদের অনুসরণ করছে। ভাবছে, আমরা তাকে লফারের কাছে নিয়ে যাব।

তাহলে বুঝতে হবে ওদের হাত থেকে লফার ফসকেছে যে বেশিদিন হয়নি। নইলে আমাদের বাধা দিত না শত্রুরা। চুপচাপ থেকে বরং আমাদের পিছে পিছে আসত।

কিশোর, এটাই আমাদের সুযোগ। একটা ফাঁদ পাততে পারি।

এই সময় ঘরে ঢুকলেন কুপার। হাতে একটা সাধারণ পোস্ট কার্ড। বাড়িয়ে দিয়ে বললেন, দেখো, কিছু আছে কিনা।

মনযোগ দিয়ে কার্ডটা দেখল কিশোর। ঠিকানার লেখাগুলো কেমন জড়ানো। বলল, ডেনভার থেকে পোস্ট করা হয়েছে, নিক কোরাসনের নামে।

কি লেখা আছে? জানার জন্যে অস্থির হয়ে উঠেছে রবিন। কীকে সম্বোধন করে লিখেছে?

কার্ডটার দিকে তাকিয়ে আছে কিশোর। ডিয়ার মার্টি।

তারমানে লফারকেই লিখেছে! আর কি লিখেছে?

মাত্র তিনটে অক্ষর, কার্ডটা রবিনের দিকে কাত করে ধরল কিশোর।

রবিনও দেখতে পেল, ঘন কালো কালিতে লেখা রয়েছে শুধু: YES

আর কিছু নেই।

অবাক হয়ে বলল রবিন, মানে কি এর?

কুপারও একই প্রশ্ন করলেন। কি মানে?

কিশোর বলল, মনে হয় এই প্রশ্নটার জবাব আমি দিতে পারব। তবে তার আগে আমার একটা প্রশ্নের জবাব দিন, মিস্টার কুপার। এই কোরাসন ওরফে লফারকে সাহায্য করার চেষ্টা কি সত্যি আপনি করবেন?

করব না মানে? আমার দেখা সবচেয়ে বড় ঘোড়া বিশেষজ্ঞ। তাকে পেলে যে কোন র‍্যাঞ্চার বর্তে যাবে।

হাসল কিশোর। কিন্তু কাউবয় হিসেবে তাকে তো আপনি পাবেন না, মিস্টার কুপার। লস অ্যাঞ্জেলেসের বড় ব্যবসায়ী এই লোক। কারখানার মালিক। আমার সন্দেহ এখন জোরদার হচ্ছে, তাকে কিডন্যাপই করা। হয়েছিল। কিডন্যাপারদের হাত থেকে পালিয়েছে। কোন কারণে পুলিশের কাছে যায়নি। কিডন্যাপাররা তাকে হন্যে হয়ে খুঁজছে। ওদের ধরতে আপনি আমাদের সাহায্য করবেন?

করব, জবাব দিতে একটুও দ্বিধা করলেন না কুপার।

গুড। রবিন বলছে ফাঁদ পেতে ওদের ধরার চেষ্টা করলে কেমন হয়? আমিও তার সঙ্গে একমত। রবিন, কি ভাবে ফাঁদ পাতবে, ভেবেছ নাকি কিছু?

মাথা নাড়ল রবিন। না। তুমি একটা বুদ্ধি বের করো।

কুপরের দিকে তাকাল কিশোর। মিস্টার কুপরি, আপনার দুই সহকারীর সাহায্যও লাগবে আমাদের। রস আর চাককে আমাদের ছদ্মবেশ নিতে হবে। আমাদের পোশাকগুলো পরে অন্ধকারে গিয়ে বোটে উঠবে।

কিডন্যাপাররা ভাববে আমরাই উঠেছি, রবিন বলল। তারপর?

আমরা র‍্যাঞ্চের পোশাক পরে কাউবয় সেজে র‍্যাঞ্চের গাড়ি নিয়ে আগেই গিয়ে বসে থাকব। চোখ রাখব বোটের ওপর। দেখব, রস আর চাকের পেছনে কেউ লাগে কিনা। লাগলে তাকে ধরার চেষ্টা করব। কি মনে হয়, মিস্টার কুপার? কাজ হবে?

একটা কথাও না বলে উঠে দরজার কাছে চলে গেলেন কুপার। গলা চড়িয়ে ডাকলেন, কোরিন, রস আর চাককে আসতে বলো তো।

দুই কাউবয় এলে ওদেরকে তার পরিকল্পনার কথা বলল কিশোর। এক কথায় রাজি হয়ে গেল ওরা। লফারকে ওরাও পছন্দ করত। তা ছাড়া র‍্যাঞ্চের একঘেয়ে জীবনে উত্তেজনার খোরাক পেয়েছে।

এইবার বলো, কুপার বললেন, পোস্ট কার্ডের লেখাটার মানে কি?

কিশোর হাসল। নিজেকে লফারের জায়গায় কল্পনা করুন। মেকসিকো থেকে পালিয়ে এসেছে সে। পকেটে টাকা নেই, সাহায্য করার কেউ নেই, বাড়তি যন্ত্রণা হিসেবে কিডন্যাপাররা লেগে আছে পেছনে। শেটল্যাণ্ড পনির ব্যাপারে জ্ঞান আছে তার। সেই জ্ঞানকে পুঁজি করে র‍্যাঙ্কে চাকরি নিয়েছে, দুটো কারণে কিছু টাকা উপার্জন, এবং খাওয়া আর বিশ্রাম। কিন্তু এখানে থেকেও স্বস্তি পায়নি…

কেন?

বুঝে ফেলল রবিন। বলল, মেকসিকোর বেশি কাছাকাছি বলে। কিডন্যাপরির সহজেই তার খোঁজ পেয়ে যেতে পারে, এই ভয়ে।

হ্যাঁ, মাথা ঝাঁকাল কিশোর। আরও দূরে সরে যেতে চাইল সে। তখন ডেনভারের এক বন্ধুর কাছে সাহায্য চেয়ে চিঠি লিখল। সম্ভবত জানতে চেয়েছে তার কাছে কোন চাকরি আছে কিনা। সেই বন্ধু জবাব দিয়েছে। ইয়েস বলে। এ ভাবেই জবাব দেয়ার কথা চিঠিতে লিখে দিয়েছিল লফার। কিন্তু ভুল করে মার্টির নাম সম্বোধন করে ফেলেছে।

শিস দিয়ে উঠলেন কুপার। তারমানে ডেনভারে চাকরি করতে চলে গেছে! কি চাকরি?

যে ব্যাপারে সে বিশেষজ্ঞ, জবাব দিল কিশোর। শেটল্যাণ্ড পনি। আমি শিওর, ওখানকার কোন ঘোড়ার র‍্যাঞ্চেই পাওয়া যাবে তাকে।

ঠিক! তুড়ি বাজালেন কুপার। অতি সহজ এই ব্যাখ্যাটা আগে আমার মাথায় ঢুকল না কেন?

সূর্য ডোবার আগে আগে বেরিয়ে পড়ল রবিন আর কিশোরের পোশাক পরা দুই কাউবয়। ডকে এসে লাল-সাদা বোটটায় উঠল। তীরে কয়েকজন জেলে আর শ্রমিক ঘোরাঘুরি করছে। তাদেরকে শুনিয়ে শুনিয়ে বলল কিশোর বেশী চাক, সব ঠিক আছে তো, রবিন?

মনে তো হয়, রাকস্যাকটা ডেকে ফেলে জবাব দিল রস।

ঘুরে তো দেখে এলাম। কি বুঝলে? ইয়োমার কোন হোটেলেই আছে। লফার, তাই না? চলো, ওখানেই যাব।

ডকের একপ্রান্তে নোঙর করা ছিল, অন্যপ্রান্তের দিকে চলতে শুরু করল বোট। কণ্ঠস্বর নামিয়ে রস বলল, কেমন করছি আমরা, চাক?

দারুণ! এক্কেবারে কিশোর পাশা আর রবিন।

ওদের ঘণ্টা দুই আগে কুপার র‍্যাঞ্চ থেকে একটা জীপ বেরিয়ে গেছে। ধুলোর মেঘ উড়িয়ে চলে গেছে ইয়োমার দিকে। বিশাল স্টেটসন হ্যাট আর ফ্রানেলের চেক শার্ট পরা চাক-বেশী কিশোর বসেছে চালকের আসনে। তার পাশে রসের ছদ্মবেশে রবিন। পায়ের ব্যথা অনেক কমেছে।

ইয়োমার পুলিশ হেডকোয়ার্টারে এসে ঢুকল দু-জনে। ডেস্কে বসে আছে সেই পুলিশ সার্জেন্ট, কয়েক দিন আগে যার সঙ্গে কথা বলেছিল ওরা। কিন্তু চিনতেই পারল না ওদেরকে। ভোঁতা গলায় জিজ্ঞেস করল, কি সাহায্য করতে পারি?

চীফের সঙ্গে দেখা করতে চাই, প্লীজ। বলবেন কিশোর পাশা আর রবিন মিলফোর্ড কথা বলতে এসেছে।

চমকে গেল সার্জেন্ট। বলল, আরে, তোমরা! চিনতেই পারিনি। কি হয়েছে?

ছোট্ট একটা ফাঁদ পেতেছি আমরা, সার্জেন্ট, কিশোর বলল।

কয়েক মিনিট পর সংক্ষেপে সব কথা চীফকে জানাল সে আর রবিন।

মাথা ঝাঁকিয়ে চীফ বললেন, প্ল্যানটা ভালই মনে হচ্ছে। তোমাদের সঙ্গে অফিসার স্যাডি রোভারকে দিচ্ছি। সাদা পোশাকে যাবে।

 লম্বা, পেশীবহুল মানুষ স্যাডি রোভার। কি করতে চায়, তাকে বুঝিয়ে বলল কিশোর।

ইয়োমা বোট ডকের কাছে একটা বালির ঢিবির আড়ালে লুকিয়ে বসল। তিনজনে। ছোট ছোট অনেক জলযান আসছে আর যাচ্ছে। ক্রমাগত ঢেউ তুলছে পানিতে। ডকে এমন কয়েকজনকে দেখা গেল, ভাবসাব দেখে মনে হলো ওদের নৌকা বাঁধা আছে জেটিতে।

স্যাডি জানাল, ওরা সন্ধ্যা হলে নৌকা ছাড়বে। তাদের মধ্যে একজন মেকসিকান দৃষ্টি আকর্ষণ করল কিশোরের। ডকে সে-ই একমাত্র লোক, কোন বিশেষ নৌকার প্রতি যার নজর নেই। এক জায়গায় বসে তাকিয়ে আছে অন্য পাড়ের দিকে।

ফিসফিস করে রবিন বলল, ওই যে, ওরা আসছে।

আবার ডকে ভিড়ল লাল-সাদা বোঁটা। নোঙর ফেলল। ডেকে দাঁড়ানো চাক আর রসের দিকে নজর এখন মেকসিকান লোকটার। ওরা দু-জন তীরে নেমে রাস্তা ধরে এগোল। উঠে দাঁড়াল লোকটা। কোন দিকে না তাকিয়ে রস আর চাকের পিছু নিল।

কিশোররাও উঠে দাঁড়াল। বেশ খানিকটা দূরত্ব রেখে মেকসিকান লোকটার পিছু নিল।

একটা হোটেলে ঢুকল চাক আর রস।

সাবধানে এগিয়ে গিয়ে হোটেলের জানালা দিয়ে ভেতরে উঁকি দিল মেকসিকান।

এই ব্যাটাই আমাদের লোক, নিচু স্বরে ঘোৎ-ঘোৎ করে বলল স্যাডি।

নিঃশব্দে পেছনে এসে দাঁড়াল তিনজন লোক, টেরই পেল না। মেকসিকান। খপ করে তার হাত চেপে ধরল স্যাডি। কঠিন স্বরে বলল, তোমাকে অ্যারেস্ট করা হলো!

হাত ছাড়ানোর জন্যে ধস্তাধস্তি শুরু করল লোকটা। ছুটতে পারল না। তার অন্য হাত চেপে ধরল কিশোর। হোটেল থেকে বেরিয়ে এল চাক আর রস।

থানায় নিয়ে আসা হলো মেকসিকান লোকটাকে।

তার পকেট থেকে কাগজপত্র বের করে দেখে বললেন চীফ, নাম পেকারি সোয়ানো। বেআইনী ভাবে ঢুকেছে। একজন সহকারীকে নির্দেশ দিলেন, হাজতে ভরো।

অভিযান সফল হওয়ায় খুব খুশি চাক আর রস। হাত মেলাল দুই গোয়েন্দার সঙ্গে। কিশোর ওদের ধন্যবাদ দিল।

চাক বলল, আমরা তাহলে জীপটা নিয়ে যাই। কি হয়েছে শোনার জন্যে নিশ্চয় অস্থির হয়ে আছেন বস।

বাকিটা আর তাহলে দেখতে পারলেন না, হেসে বলল কিশোর।

আরও কিছু বাকি আছে নাকি?

সবে তো শুরু। আমার বিশ্বাস, আমাদের এই বন্দীটি এখান থেকে বেরিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করবে। যাবেও। কি বলেন, চীফ?

হাসলেন চীফ। যাওয়াই উচিত। তাকে আমরা যেতে দিলে সোজা সে যাবে তার বন্ধুদের কাছে। হুশিয়ার করার জন্যে।

 পরিকল্পনাটা বুঝে গেল চাক। বলল, পুরোটী দেখতে পারলে ভালই হত। কিন্তু বস নিশ্চয় ওদিকে অস্থির হয়ে আছেন। বেশি দেরি করা ঠিক হবে না আমাদের।

বেরিয়ে গেল চাক আর রস। তার একটু পরেই একজন অফিসার এসে জানাল, মেকসিকনি লোকটা পালিয়েছে। হাজতের দরজায় তালা দিতে ভুলে গিয়েছিলাম।

লাফ দিয়ে উঠে দাঁড়াল স্যাডি। হোলস্টারে থাবা দিয়ে দুই গোয়েন্দার দিকে তাকিয়ে বলল, চলো!

বাইরে বেরিয়ে এল কিশোররা। একটা বাড়ির ছায়ায় হারিয়ে যেতে দেখা গেল পেকারিকে। স্যাডির সঙ্গে আরও তিনজন অফিসার রয়েছে। সবাই পিছু নিল লোকটার।

দ্রুত হাঁটছে পেকারি। কয়েকটা গলি পেরিয়ে একটা ছাউনির মধ্যে ঢুকল।

ছাউনিটা ঘিরে ফেলল সাদা পোশাকধারী পুলিশ।

খোলা দরজা দিয়ে উঁকি দিল কিশোর। পেকারি বাদেও আর দু-জন লোক আছে, ওরাও মেকসিকান।

.

১৪.

লোকগুলোকে ধরে থানায় নিয়ে আসা হলো। কিন্তু মুখ খোলানো গেল না ওদের। কিছুই বলল না। যতই প্রশ্ন করা হলো, কেবল জানি না, জানি না করল।

চীফ বললেন, মনে হচ্ছে এগুলো চুনোপুটি। আসলেই কিছু জানে না।

রাতটা কুপারের র‍্যাঞ্চে কাটিয়ে পরদিন সকালে বেরিয়ে পড়ল কিশোর আর রবিন। বোটে করে কলোরাডো নদী ধরে ফিরে এল ব্লাইদিতে। দুটো বাঁধ আর আঁকাবাঁকা নদীর বিপজ্জনক একশো মাইল পথ পেরোতে সারাটা দিনই প্রায় লেগে গেল।

ঘাটেই পাওয়া গেল বোটের মালিককে। ছুরি দিয়ে কেটে পুতুল। বানাচ্ছে।

ভাড়ার টাকা গুনে দিল কিশোর। পকেটে ভরতে ভরতে জিজ্ঞেস বলল লোকটা, ভ্রমণটা হয়তো ভালই হয়েছে?

কিশোর জবাব দিল, হয়তো।

মোটেলে ফেরার পথে রবিন বলল হেসে, আমরা যাওয়ার পর বসে বসে শুধু পুতুলই বানিয়েছে হয়তো?

কিশোরও হাসল, হয়তো। আলসে মানুষের অভাব নেই দুনিয়ায়।

মোটেলে ফিরে মুসাকে পাওয়া গেল না। ক্লার্ককে জিজ্ঞেস করে জানা গেল, ওয়ারনার বল নামে একজন লোকের সঙ্গে সারারাতের জন্যে বেরিয়েছে।

পরদিন সকালেও কিছুক্ষণ তার জন্যে অপেক্ষা করল কিশোর আর রবিন। শেষে দেরি হয়ে যাবে বুঝে বেরিয়ে পড়ল। এয়ারপোর্ট থেকে বিমানে করে ডেনভার রওনা হলো লফারকে খুঁজতে।

ডেনভার বিমান বন্দরের তথ্য কেন্দ্র থেকেই জানতে পারল কাছেই শোবারন পনি র‍্যাঞ্চ নামে একটা ঘোড়ার র‍্যাঞ্চ আছে, যেটাতে শেটল্যাণ্ড পনি উৎপাদন করা হয়। আশেপাশে বেশ কয়েক মাইলের মধ্যে ওই একটা ঘোড়ার র‍্যাঞ্চই আছে।

ট্যাক্সি নিল কিশোর। পাহাড়ী পথ ধরে কয়েক মিনিটেই পৌঁছে গেল র‍্যাঞ্চটায়।

রবিন বলল, বেশি সহজে হয়ে গেল না? পাব তো লফারকে?

সহজ হলো কোথায়? কিশোর জবাব দিল, কত ঘোরা ঘুরলাম। তারপর তো জানলাম। তাকে পাব কিনা এখনও শিওর না।

রাঞ্চের সীমানায় ঢুকে একটা বাড়ির পাশে এসে দাঁড়াল ট্যাক্সি।

নামতেই রবিনের চোখে পড়ল, একটা আস্তাবলে ঢুকছে লম্বা, চওড়া কাঁধওয়ালা একজন লোক। ইশারায় কিশোরকে আসতে বলে সেদিকে এগিয়ে গেল রবিন।

আস্তাবলে ঢুকল দু-জনে। দরজার কাছে দাঁড়িয়ে এদিক ওদিক তাকাল। একসারি চারকোণা স্টল, ঘোড়া রাখা হয় ওগুলোতে। সব খালি, একটা বাদে। ওটাতে বদমেজাজী একটা ঘোড়াকে শান্ত করার চেষ্টা করছে লম্বা লোকটা, রবিন যাকে দেখেছে।

পেছনে এসে দাঁড়াল গোয়েন্দারা।

রবিন জিজ্ঞেস করল, মিস্টার লফার?

ভীষণ চমকে ঝটকা দিয়ে ঘুরে তাকাল লোকটা। চোখে ভয়। বলল, আমার নাম নিক কেরিসন।

ভয় পাবেন না আমাদের, মিস্টার লফার, শান্তকণ্ঠে বলল কিশোর। আপনার মামা ওয়াল্ট ক্লিঙ্গলস্মিথ আপনার জন্যে অস্থির হয়ে উঠেছেন। আমাদের পাঠিয়েছেন আপনাকে খুঁজে বের করার জন্যে।

কে তোমরা?

আমরা গোয়েন্দা। আমি কিশোর পাশা, ও রবিন মিলফোর্ড। আপনাকে সাহায্য করতে এসেছি আমরা, মিস্টার লফার, বিশ্বাস করতে পারেন। বন্ধু হিসেবে নিতে পারেন আমাদের।

বিশ্বাস! বন্ধু! ফোঁস করে একটা নিঃশ্বাস ফেলল লফার। তিক্ত কণ্ঠে বলল, এই কথাগুলো আর বোলো না আমাকে! দুনিয়ায় বন্ধু বলে কিছু নেই, বিশ্বাসও নেই!

আপনার বন্ধু ব্রাউনের কি হয়েছে?

ও আমার বন্ধু নয়! আমিই হতে চেয়েছিলাম! গাধামির ফলও পেয়েছি হাতে হাতে! তিক্তকণ্ঠে বলল লফার। সমস্ত কিছুর পরও যাকে খানিকটা বিশ্বাস করেছিলাম, সে-ও আমাকে বোক পেয়ে ঠকাল। পটিয়ে-পাটিয়ে অ্যাডভেঞ্চারের লোভ দেখিয়ে বাড়ি থেকে বের করল, তারপর ধরে নিয়ে গেল মেকসিকোতে।

দু-জনে একসঙ্গে গিয়েছিলেন? জানতে চাইল রবিন।

মাথা ঝাঁকাল লফার। হ্যাঁ। রাতের বেলা, নৌকায় করে। আগেই খবর দিয়ে রাখা হয়েছিল। আমাদের জন্যে অপেক্ষা করছিল নৌকা। রাতে চুরি করে বর্ডার পার হয়ে মেকসিকোতে ঢুকেছি। ওখানে নিজের দলের সঙ্গে দেখা করেছে লফার।

শিস দিয়ে উঠল রবিন। মেকসিকান বিদ্রোহী?

না। ওই দল থেকে বেরিয়ে চলে এসেছে। নিজেই একটা দল গড়েছে। বেআইনী পথে টীকা কামানোর জন্যে।

তারমানে ব্রাউন ক্রিমিন্যাল।

 হ্যাঁ।

তারপর, বলুন, আপনাকে নিয়ে গিয়ে কি করল? জানতে চাইল কিশোর।

সারাক্ষণ পাহারা দিয়ে রাখত। হুমকি দিত আমি পালানোর চেষ্টা করলে, পালিয়ে গিয়ে পুলিশকে খবর দিলে, আমার পরিবারের ক্ষতি করবে। তারপরেও পালালাম ঠিকই, কিন্তু পুলিশের কাছে গেলাম না স্ত্রী-পুত্রের ক্ষতির ভয়ে। নিরুদ্দেশ হয়ে গেলাম। মালগাড়িতে করে বর্ডারে চলে গেলাম। ব্রাউনকে একটা চিঠি লিখে দিলাম, আমি পুলিশের কাছে যাইনি, আমার পরিবারের যেন ক্ষতি না করে। কিন্তু আমার পেছনে ঠিকই লাগল ওরা। ওদের ধারণা, অনেক বেশি জেনে ফেলেছি আমি। মুখ বন্ধ করে দেয়া দরকার।

কিন্তু আপনাকে বেরোতে রাজি করাল কি করে ব্রাউন?

সেটা বোঝাতে পারব না, হতাশ ভঙ্গিতে মাথা নাড়ল লফার। বার বার বন্ধুদের বিশ্বাস করেছি, বার বার ওরা আমার সঙ্গে বেঈমানী করেছে। ব্যবসায় মরি খেয়ে মাথাটা ঘোলা হয়ে গিয়েছিল। মনে করলাম, কোথাও বেরোলে হয়তো ভাল লাগবে। তাই ব্রাউন যখন বেড়াতে বেরোনোর কথা বলল, রাজি হয়ে গেলাম। প্লেন নিয়ে ওড়ার পর ব্রাউন বলল মরুভূমির দিকে যেতে, আমাকে নাকি একটা সারপ্রাইজ দেবে। ওখানে প্লেন রেখে আমাকে নিয়ে গিয়ে বোটে উঠল। আমি ভেবেছিলাম সে একজন দুঃসাহসী অ্যাডভেঞ্চারার। কিন্তু আমার ধারণা ভুল। সাধারণ একজন অপরাধী ছাড়া সে আর কিছুই নয়।

তাকে ধরে পুলিশের হাতে তুলে দেয়া উচিত, কিশোর বলল। সেই কাজটাই করব। আপনার সাহায্য লাগবে আমাদের, মিস্টার লফার। বেআইনী কি কাজ করছে ব্রাউন, বলুন তো?

ভয় ফুটল লফারের চোখে। মাথা নাড়তে নাড়তে বলল, না, এ সব কথা আমি বলতে পারব না! তাতে লাভও হবে না। মাঝখান থেকে আমার পরিবারের…

দেখুন, মিস্টার লফার, সারাজীবন পালিয়ে বেড়াতে পারবেন না আপনি। তাতে আপনার পরিবারেরও কোন লাভ হবে না। আপনার বাড়িতে গিয়েছিলাম। আপনার স্ত্রী আর ছেলেরা অস্থির হয়ে গেছে আপনার জন্যে।

চোখের কোণ ছলছল করে উঠল লফারের। কিন্তু কি করতে পারি আমি, বলো? বাড়ি তো যেতে পারব না!

কেন পারবেন না?

ব্রাউন আমাকে খুন করবে! আমার ছেলেদের মেরে ফেলবে!

অত সহজ না! জোর দিয়ে বলল রবিন। বলল, আর করে ফেলল। দেশে আইন-কানুন আছে। পুলিশের কাছে যান আপনি।

আবার নিরাশ ভঙ্গিতে মাথা নাড়ল লফার। পুলিশের কাছে আমি যেতে পারব না। কারণ আমিও অপরাধ করে বসে আছি।

মানে? জানতে চাইল বিস্মিত কিশোর।

ব্রাউনও জানে এটা। তাকে পুলিশের কাছে ধরিয়ে দিলে সে-ও আমাকে ধরিয়ে দেবে। আমার হাত দিয়ে বেশ কিছু জাল চেক এখানে ওখানে পাচার হয়ে গেছে।

চেক? কি ধরনের? আমেরিকান সরকারের চেক?

না, ব্যক্তিগত চেক।

নানা ভাবে লফারকে বোঝাতে লাগল কিশোর আর রবিন। কিছুতেই বাড়ি ফিরে যেতে রাজি করাতে পারল না। তবে একটা কথা দিল–ওদেরকে না জানিয়ে শোবারন র‍্যাঞ্চ ছেড়ে আর পলিবে না।

হাইওয়ের ধারে একটা রেস্টুরেন্টে এসে খাওয়া সারল দুই গোয়েন্দা। ওখনি থেকে ফোন করল মুসাকে।

মূসা? কিশোর। ডেনভার থেকে বলছি। খবর আছে।

আমার কাছেও আছে! উত্তেজিত শোনাল মুসার কণ্ঠ। কিন্তু এত দেরিতে করলে? আমি তো ভেবেছিলাম আর করবেই না বুঝি! অনেক বড় একটা সূত্র পেয়েছি। আসো এখানে, বলব। ডেনভারে কি করছ তোমরা?

লফারকে খুঁজে বের করেছি।

 খাইছে! সত্যি?

হ্যাঁ। তবে খবরটা কারও কাছে ফাঁস কোরো না। কাল সকালের প্লেনে আসছি আমরা।

খাওয়ার পর আবার শোবারন র‍্যাঞ্চে ফিরে এল কিশোররা। সারাদিন কাজ করে এখন বিশ্রাম নিচ্ছে শ্রমিকেরা। কেউ অলস ভঙ্গিতে বসে আছে বারান্দায়, কেউ তাস খেলছে, কেউ গল্প করছে। সবার থেকে আলাদা বসে একটা জিন মেরামত করছে লফার। আগের চেয়ে অনেকটা শান্ত লাগছে তাকে।

কিশোরদের দেখে উঠে এল লফার।

 কিশোর বলল, লোকগুলো মনে হচ্ছে খুব ভাল।

হ্যাঁ, লফার বলল। ভাল লোক। আমার আসল নাম কেউ জানে না এখানে। এদের মাঝে ভালই কাটে।

হাঁটতে হাঁটতে মাঠের দিকে সরে গেল তিনজনে। সেখানে চরছে ঘোড়ার পাল।

কেন যে এখান থেকে বেরোতে চাইছেন না, কিশোর বলল, মাথায় ঢুকছে না আমার। জায়গাটা ভাল, আপনার জন্যে নিরাপদ, সবই বুঝলাম। কিন্তু এখানে থেকে তো জীবন কাটাতে পারবেন না। যদি কিছু মনে না করেন, আপনাকে একটা পরামর্শ দিতে পারি।

 কি? কিশোরের মুখোমুখি দাঁড়াল লফার। মনে হচ্ছে খানিকটা আত্মবিশ্বাস ফিরে পেয়েছে।

এখুনি লস অ্যাঞ্জেলেসে ফেরার দরকার নেই আপনার। আমাকে আর রবিনকে সাহায্য করতে পারেন। ব্রাউনকে ধরব আমরা। তাকে ধরে পুলিশের হাতে দেব। হয়তো এর জন্যে আপনার সামান্য অপরাধ মাপও হয়ে যেতে পারে। ব্রাউনের হাত থেকেও রেহাই পাবেন।

দ্বিধা করল লফার। আস্তে করে হাত বাড়িয়ে কিশোরের একটা হাত চেপে ধরল, ঠিক আছে, আমি রাজি। প্রথমে কোথায় যেতে হবে?

ব্লাইদি।

চমকে গেল লফার। কিন্তু ওখানে তো ব্রাউনের সম্পাইরা আছে। দেখলেই চিনে ফেলবে আমাকে!

চিনবে না। ছদ্মবেশ পরিয়ে নিয়ে যাব।

.

১৫.

পরদিন মাঝবয়েসী একজন প্রৌঢ় র‍্যাঞ্চারের ছদ্মবেশে কিশোর আর রবিনের সঙ্গে প্লেন থেকে নামল লফীর। সামান্য খুড়িয়ে হাঁটতে বলে দিয়েছে তাকে কিশোর। ভালই অভিনয় করছে সে।

মোটেলেই অছে মুসা। ওদের আসার অপেক্ষা করছে। লাফ দিয়ে উঠে এসে জড়িয়ে ধরল কিশোরকে। তারপর রবিনকে। হাত মেলাল। তাকলি লফারের দিকে।

পরিচয় করিয়ে দিল কিশোর। সব কথা জানাল। ব্রাউনকে ধরার প্ল্যান। করেছে যে বলল। তারপর জিজ্ঞেস করল, এবার তোমার দারুণ খবরটা বলে ফেলো! কি সূত্র পেয়েছ?

দুদিন আগে রাতের বেলা ওয়ারনার বলের সঙ্গে মরুভূমিতে গিয়েছিলাম কিছু নিশাচর জানোয়ারের ছবি তোলার জন্যে। একটা ছবিতে জানোয়ারের সঙ্গে কি উঠেছে জানো? একটা লোকের ছবি। নদীর কাছ থেকে কোথাও সরে যাচ্ছিল সে।

এতে অবাক হওয়ার এমন কি ঘটল? রাতের বেলা নদী থেকে মরুভূমিতে নামতে পারে লোকে। তোমরাও তো গিয়েছ।

আসল কথাটা শোনোই না। লোকটা কে জানো? রকি বীচে তোমাদের ইয়ার্ডে যে আড়ি পেতে ছিল।

বলো কি! এইবার অবাক হলো কিশোর। লস অ্যাঞ্জেলেসের সেই বেয়ারা! হ্যাঁ, এইটা একটা সূত্র বটে!

ওদের কথা বুঝতে পারছে না লফার। তাকে বুঝিয়ে দিল কিশোর। চেহারার বর্ণনা দিয়ে বলল, আমার ধারণা, ব্রাউনের দলের লোক ও। চিনতে পারছেন?

নাহ। আমাকে যারা ধরে নিয়ে গিয়েছিল, ওরা মেকসিকান। অন্য প্রসঙ্গে চলে গেল লফার, তা থাকব কোথায় আমি? এই মোটেলে?

অসুবিধে কি? রবিন বলল।

না, অসুবিধে নেই। রুম থেকে হাত-মুখ ধুয়ে এসে রেস্টুরেন্টে ঢুকল চারজনে। খাওয়ার পর কিশোর বলল, এবার কাজের কথায় আসা যাক। মরুভূমিতে যাওয়ার কথা ভাবছি। নকশাগুলোর কাছে। তা ছাড়া ওখানে যখন ছদ্মবেশী বেয়ারাকে দেখা গেছে, কিছু একটা ব্যাপার নিশ্চয় আছে। ওখানে মাটি খোঁড়া হয়েছে, দেখেছি। আরও কোথাও খুঁড়েছে কিনা দেখব।

যারা খুঁড়েছে তাদের সঙ্গে ব্রাউনের দলের সম্পর্ক আছে ভাবছ নাকি? রবিনের প্রশ্ন।

থাকতেও পারে। রিপ্লিতে নদীর ধারে একটা কেবিন ভাড়া নেব আমরা। ওখানে থাকব। বোট ভাড়া করব। তাতে যতবার খুশি নদী পেরিয়ে মরুভূমিতে যাতায়াত করতে পারব।

এই পরিকল্পনায় সবচেয়ে বেশি খুশি হলো লফার। কারণ লোকালয়, বিশেষ করে ব্লাইদি থেকে সরে যেতে পারবে।

বেশ, তাহলে ওই কথাই রইল, কিশোর বলল। সকালেই রওনা হব আমরা। কারও কোন কথা আছে?

এক কাজ কোরো, মুসা বলল, তোমরা তিনজন চলে যেয়ো। আমি বরং রাইদি থেকে বোট ভাড়া করে, বাজার করে নিয়ে যাব। খাবার তো লাগবে। সঙ্গে করে আমার বন্ধু ওয়ারনার বলকে নিতে চাই। ওকে পুরোপুরি বিশ্বাস করা যায়। দরকার পড়লে আমাদের সাহায্যও করতে পারবে।

মন্দ বলোনি। কেবিনটা বরং তার নামেই ভাড়া করব। তাতে খোঁজ খবর নিলেও আমাদের শত্রুরী কিছু সন্দেহ করতে পারবে না।

পরদিন দুপুরে রিপ্লিতে পৌঁছে একজন কৃষকের কাছ থেকে একটা কেবিন ভাড়া করল কিশোররা। কেবিনটা পড়েছে নদীর এপারে ক্যালিফোর্নিয়ার সীমানায়। বাড়ির পেছনে ছড়ানো বারান্দা। ওখানে দাঁড়ালে নদী ও নদীর অন্য পাড়ে অ্যারিজোনার বিশাল টিলা আর পাহাড়গুলো চোখে পড়ে, যেখানে রয়েছে দানবীয় সব নকশী। হলুদ রঙের সুন্দর টীমারিস্ক গাছ ঘিরে রেখেছে। কেবিনটীকে।

বাসা পছন্দ হয়েছে? জিজ্ঞেস করল কৃষক।

 খুউব, জবাব দিল কিশোর।

তবে একটা ব্যাপারে সাবধান থাকবে।

কি? সতর্ক হয়ে উঠল কিশোর। ভাবল চোর-ডাকাতের কথা বলবে বুঝি।

সাপ। র‍্যাটল স্নেক।

কয়েক মিনিট পরই কৃষকের কথার প্রমাণ পাওয়া গেল। বাড়ির চারপাশটা ঘুরে দেখার জন্যে বারান্দা থেকে নেমেছিল লফার। কিন্তু কয়েক পা এগোতে না এগোতেই বালির মধ্যে থেকে ফোঁস করে উঠল সাপ। আরেকটু হলেই তার পায়ে কামড়ে দিয়েছিল। লাফ দিয়ে এসে আবার বারান্দায় উঠল সে।

রবিন আর কিশোর মিলে সাপটীকে মেরে ফেলল।

কাঁপতে কাঁপতে লফার বলল, র্যাটলের বিষ যে কি জিনিস, হাড়ে হাড়ে জানা আছে আমার। ছোটবেলায় একবার কামড় খেয়েছিলাম। নেহায়েত আয়ু। আছে, তাই বেঁচেছি।

কেবিনের ভেতরও সাপ থাকতে পারে ভেবে প্রতিটি ঘর ভালমত খুঁজে দেখল ওরা।

রবিন বলল, আর থাকতে পারছি না আমি। পেটের মধ্যে কিছু নেই। খাওয়া দরকার।

খাওয়ার কথায় মুসার কথা মনে পড়ল কিশোরের। বলল, মুসারা তো। এখনও আসছে না।

সঙ্গে করে স্যাণ্ডউইচ এনেছে ওরা। খেয়ে নিল।

ইতিমধ্যে গোয়েন্দাদের ওপর অনেকটা বিশ্বাস এসেছে লফারের। নিজে নিজেই বলল, জানলে সব বলতাম তোমাদের। কিন্তু আমিও তেমন কিছু জানি না।

কোন ব্যাপারে? জিজ্ঞেস করল কিশোর।

এই ব্রাউনের দলের ব্যাপারে।

যা জানেন তাই বলুন। তাতেও সাহায্য হবে।

আসলে কিছুই জানায়নি ওরা আমাকে। ওদের দলে যোগ দিতে রাজি হইনি। ওদের আস্থা অর্জন করতে পারিনি।

ওদের কাজটা কি, সেটা কি বলতে পারবেন?

শিওর না। অনুমান করতে পারি কেবল। গোড়া থেকেই বলি। বর্ডার পেরোনোর পর একটা বাড়িতে নিয়ে গিয়ে তুলল আমাকে ব্রাউন। আশেপাশে আর কোন বাড়িঘর নেই। বাড়িটায় তিনজন মেকসিকান আমার জন্যে অপেক্ষা করছিল। ওদের হাবভাব ভাল লাগল না। কেমন করে যেন। তাকাচ্ছিল আমার দিকে। সবার মুখেই খালি টাকার গল্প। কি করে অল্প সময়ে। বেশি টাকা হাতানো যায়। সন্দেহ জাগল আমার। বোকার মত সেটা ফাস করে দিলাম ওদের কাছে। বললাম, ওদের সঙ্গে থাকব না। কিন্তু আমাকে আটকে ফেলল ব্রাউন। বেরোতে দিল না।

দুই বার আমাকে শহরে নিয়ে গেছে সে। ভয় দেখিয়ে আমাকে দিয়ে তার জাল চেক খাবারের দোকান থেকে ভাঙাতে বাধ্য করেছে। একটা মেকসিকান ব্যাংকের নামে ওই চেকগুলো তৈরি হয়েছে। যার নামে করা হয়েছে, সেটাও ছদ্মনাম।

পালালেন কখন?

বলছি। ওদের বেআইনী কাজে আমাকে যোগ দেয়ার জন্যে চাপ দিয়ে চলল ব্রাউন। কিছুতেই আমাকে রাজি করাতে না পেরে লোক দিয়ে পাঠিয়ে দিল একটা নিরালা জায়গায়। ঘরে আটকে সারাক্ষণ আমাকে পাহারা দিয়ে রাখা হত, সে-কথা তো বলেইছি। ওদের কাজের ব্যাপারে আমার সামনে আর মুখ খুলত না। আড়ি পেতে থেকে কথা শোনার চেষ্টা করেছি। জিঙ্ক প্লেটের কথা বলতে শুনে অনুমান করলাম কোন কিছু জাল করার ব্যাপারে আলোচনা করছে ওরা।

কি জাল করছে? জিজ্ঞেস করল রবিন।

তা বলতে পারব না।

হঠাৎ বলে উঠল কিশোর, জবাবটা আমি বোধহয় দিতে পারব, মিস্টার লফার। কোন আমেরিকানের নাম ওদেরকে বলতে শুনেছেন?

শুনেছি। ডগলাস বার্ড।

চট করে পরস্পরের দিকে তাকাল কিশোর আর রবিন। মরুভূমির গর্তে পাওয়া রুমালটার কোণে লেখা ছিল D. এখন বুঝল ওটা ডগলাসের নামের আদ্যক্ষর।

চেঁচিয়ে উঠল রবিন, ডগলাস বার্ডই আমাদের ছদ্মবেশী বেয়ার!

লফার বলল, তার দু-জন সহকারী আছে। সিজার এবং মারফি।

তাই নাকি? কিশোর বলল, তাহলে আপনার অফিসে ওই দুজনই গিয়েছিল আপনার সেক্রেটারির কাছে খোঁজ নিতে। তাকে ভয় দেখিয়েছে। রাতের বেলা মরুভূমিতে বার্ডের ছবিই উঠে গেছে মুসার ক্যামেরায়। রকি বীচে তার মাথায় বাড়ি মেরে ছবি কেড়ে নিয়ে গেছে এই লোকই।

একটা ব্যাপার মেলাতে পারছি না, রবিন বলল।

 কি?

একটা পাথর। জ্যাসপার। মরুভূমিতে কুড়িয়ে পেয়েছি, আপনার প্লেনটী যেখানে পাওয়া গেছে, তার কাছে। মিস্টার লফার, দামী চোরাই পথিরেরও ব্যবসা করে নাকি ব্রাউনের দল? পাথর নিতেই হয়তো মরুভূমিতে গিয়েছিল বার্ড, মূসার ক্যামেরায় তার ছবি উঠে গেছে?

উঁহু! অবাক হয়ে মাথা নাড়ল লফার। আমার তা মনে হয় না। পাথর টারের কথা কখনও বলতে শুনিনি ওদের।

তাহলে অন্য কোন কারণে মরুভূমিতে গেছে বার্ড, কিশোর বলল। আবারও যেতে পারে। কখন যাবে জানি না। ওকে ধরতে হলে রাতের বেলা ওখানে হাজির থেকে পাহারা দিতে হবে আমাদের।

.

১৬.

ইঞ্জিনের মৃদু ফটফট শব্দ ভেসে এল নদীর দিক থেকে। বাড়ল শব্দটা। কথা থামিয়ে বারান্দায় বেরিয়ে এল কিশোর আর রবিন। বড় একটা মোটরবোট আসতে দেখল। তাঁতে দু-জন লোক।

মনে হয় মুসারা আসছে, রবিন বলল।

কাছে এল বোটটা। মুসাকে চিনতে অসুবিধে হলো না। হাত নেড়ে চিৎকার করে তাকে ডাকতে লাগল ওরা।

বোটের নাক ঘুরে গেল। এগিয়ে এসে কেবিনের নিচে নদীর ঢালে তৈরি জেটিতে ভিড়ল।

একজন সুদর্শন তরুণকে নিয়ে নেমে এল মুসা। বয়েস বাইশ-তেইশ হবে। রোদের মধ্যে থাকতে থাকতে লোকটার চামড়া উজ্জ্বল বাদামী হয়ে গেছে। মাথা ভর্তি চুলের আসল রঙ ছিল সোনালি, এখন সাদা হয়ে গেছে মরুভূমির কড়া রোদে ঘুরতে ঘুরতে।

কিশোর আর রবিনের সঙ্গে ওয়ারনার বলের পরিচয় করিয়ে দিল মুসা।

হতি মেলানো আর কুশল বিনিময়ের পালা শেষ হলে হাতে হাতে বোট থেকে খাবারের প্যাকেটগুলো নামিয়ে আনল ওরা। কেবিনে নিয়ে এল।

মার্টি লফারের সঙ্গে ও বলের পরিচয় করিয়ে দিল মুসা। হাসিখুশি লোকটাকে পছন্দ করল সবাই।

তিন গোয়েন্দার সব সদস্যই হাজির। রাতের বেলা কি ভাবে পাহারা দেবে, এই নিয়ে আলোচনায় বসল সবাই।

সিদ্ধান্ত হলো, বোটে করে অপর পারে চলে যাবে ওরা। টিলার ওপর উঠে লুকিয়ে থাকবে। ওখান থেকে আশপাশে বহুদূর চোখে পড়ে। কেউ এলে সহজেই দেখতে পাবে। বার্ড কিংবা তার সাঙ্গপাঙ্গরা এলে, তাঁদের ধরা হবে।

বিকেল হয়ে গেল। শুধু স্যাণ্ডউইচ খেয়ে আর কতক্ষণ থাকা যায়। খিদে পেয়ে গেল ওদের। রান্না চড়ানো দরকার। লফার বলল, ঘোড়া পোষা ছাড়া আরেকটা কাজ ভাল করতে পারি আমি। রান্না করতে দিয়েই দেখো।

কোন আপত্তি নেই কারও। সত্যি প্রমাণ করে দিল লফার, রান্নায়ও তার চমৎকার হাত। খেয়ে সবাই প্রশংসা করল।

বারান্দায় এসে বসল সবাই। গল্প করতে লাগল। সূর্য ডুবতে দেরি নেই। কেবিন ঘিরে রাখা গাছের জটলার দিকে তাকিয়ে চোখ বড় বড় হয়ে গেল মুসার। চিৎকার করে উঠল, খাইছে! দেখো, কে এসেছেন।

ফিরে তাকাল সবাই।

মুসার মতই অবাক হয়ে গেল কিশোর আর রবিনও।

মিস্টার সাইমন!

হাসিমুখে এগিয়ে এলেন ডিটেকটিভ। তাঁকে এখানে দেখতে পাবে বল্পনাই করেনি তিন গোয়েন্দা। লাফ দিয়ে উঠে গেল এগিয়ে আনার জন্যে।

কেন এসেছেন, জানা গেল শিগগিরই। হাত-মুখ ধুয়ে, খেয়েদেয়ে সবার সঙ্গে বারান্দায় এসে বসলেন সাইমন। হেসে বললেন, কিশোর, কয়েক দিন ধরে তোমার আর রবিনের পিছে লেগে রয়েছি আমি। কলোরাডো নদী ধরে গেলে তোমরা, ফিরেও এলে। খুঁজতে খুঁজতে মিস্টার লফারের বন্ধু কুপারের র‍্যাঞ্চে গিয়ে হাজির হলে। আমিও গিয়েছি। মিস্টার কুপৗর আমাকে সব বলেছেন।

রবিন বলল, কিছুই বুঝতে পারছি না আমি, স্যার। গোড়া থেকে বলুন। আমাদের পিছু নিলেন কেন?

দীর্ঘ একটা মুহূর্ত নদীর পানির দিকে তাকিয়ে রইলেন সাইমন। কোনখান থেকে শুরু করছেন ভাবছেন যেন। বললেন, মিস্টার লফারকে খুঁজে বের করার দায়িত্বটা তোমাদের দেয়ার আগেই আরেকটা কেস পেয়েছিলাম আমি, একটা চেক জালিয়াতির কেস। সরকারি চেক জাল করা হচ্ছে। পুলিশ কোন কিনারা করতে পারছিল না।

চেক জালিয়াতি! মুসা বলে উঠল। কিশোর, আমি যেটা পেয়েছিলাম, ওটাও একই দলের কাজ নয়তো?

মুসা কি ভাবে চেক পেয়েছিল, সাইমনকে জানাল কিশোর।

মানিব্যাগ থেকে একটা চেক বের করলেন তিনি। মুসার দিকে বাড়িয়ে দিয়ে জিজ্ঞেস করলেন, দেখো তো এটার মত কিনা?

একবার দেখেই মাথা ঝাঁকাল মুসা, হা হা, ঠিক এই জিনিস। তবে ওটীতে টাকার অঙ্ক খুব কম ছিল।

তাহলে আর কোন সন্দেহ নেই, চেকটা আবার মানিব্যাগে ভরতে ভরতে হাসলেন সাইমন। তোমরা আর আমি একই কেসে কাজ করছি।

আপনি মেকসিকোতেও গিয়েছিলেন, না? জানতে চাইল কিশোর।

হ্যাঁ। জালিয়াতদের ছাপাখানাটা খুঁজে বের করার জন্যে। মেকসিকান পুলিশের সহায়তায় বেরও করেছি, কিন্তু পালের গোদাটাকে ধরতে পারিনি। পালিয়েছে। আমার বিশ্বাস, আমেরিকায় ঢুকে পড়েছে ওরা।

ওখানে পুলিশের হাত থেকে আপনিই ছাড়িয়েছেন আমাদের।

হাসলেন ডিটেকটিভ। মাথা ঝাঁকালেন।

আমরা মেকসিকোতে আছি, পুলিশের হাতে ধরা পড়েছি, জানলেন কি করে? জিজ্ঞেস করল রবিন।

তোমাদের সেই স্টেশন মাস্টার কাপারিলো তোমাদেরকে ট্রেনে তুলে দিয়েই পুলিশের সঙ্গে যোগাযোগ করেছে। পুলিশ আমাকে জানিয়েছে। একজন আমেরিকানের পেছনে আরও দু-জন আমেরিকান লেগেছে শুনে অবাক হয়েছিল ওরা। সন্দেহ হয়েছিল, আমি হয়তো কিছু জানতে পারি। তাই জানিয়েছে। চেহারার বর্ণনা শুনেই বুঝে গেলাম, তোমরা ছাড়া আর কেউ নয়। পুলিশকে নিয়ে ছুটলাম সেই নির্জন স্টেশনে। মরুভূমির মধ্যে খুঁজতে খুঁজতে নিতান্ত ভাগ্যক্রমেই আবিষ্কার করে ফেললাম জালিয়াতদের ছাপাখানা।

তারমানে না জেনেই আপনার কেসের সমাধানটাও আমরাই করে। দিলাম, হেসে বলল রবিন।

হা, অনেক সাহায্য করেছ তোমরা, স্বীকার করলেন সাইমন। মালগাড়িতে করে তোমাদের পিছু নেয়ার ব্যাপারটাও একটা সূত্র দিয়েছিল অমিৗকে। ভাবলাম, জালিয়াতদের সর্দারও ওই পথেই সীমান্ত পেরোনোর চেষ্টা করবে না তো? তক্ষুণি পুলিশকে সতর্ক করে দিলাম। বললাম, সীমান্তের কাছে যত ট্রেন থামে সব চেক করতে।

আপনি জানতেন, তাতে আমরাও ধরা পড়ব। বলে দিলেন, আমাদের ধরলেও যাতে ছেড়ে দেয়া হয়, তাই না?

আবার মাথা ঝাঁকালেন ডিটেকটিভ। ঠিকই আন্দাজ করেছ। বুঝে গিয়েছিলাম, মিস্টার লফারের খোঁজ তোমরা পেয়ে গেছ। তাঁর চিহ্ন অনুসরণ করেই এগিয়ে যাচ্ছ। তাই আমিও তোমাদের পিছু নিলাম। আমার সন্দেহ হয়েছিল, জালিয়াতদের সঙ্গে তাঁর কোন যোগাযোগ আছে। তোমরা তাঁকে খুঁজে বের করতে পারলে তিনি তখন আমাকে তাদের কাছে যাওয়ার পথ। দেখাতে পারবেন।

প্রেসটার ওপর নজর রেখেছে পুলিশ। কাউকে এখনও গ্রেপ্তার করেনি। জালিয়াতদের বুঝতেই দেয়া হয়নি যে ওটী আবিষ্কার হয়ে গেছে। জানলে সতর্ক হয়ে গা ঢাকা দিতে পারে রাঘব বোয়ালগুলো। ওদেরকে আগে ধরতে পারলে চুনোপুঁটিগুলোকে ধরা কিছু না। খবর পেয়েছি, আজ রাতে নতুন ছাপা অনেক জাল চেক আসবে একটা বিশেষ জায়গায়। সেখান থেকে ছড়িয়ে দেয়া হবে সারা আমেরিকায়।

বিশেষ জায়গাটা কোথায়, বোধহয় আন্দাজ করতে পারছি, কিশোর। বলল। নদীর ওপারে টিলার কাছে, যেখানে দানবীয় নকশা আঁকা আছে। ওখানে প্লেন থেকে ফেলে দেয়া হয় জাল চেকের বাণ্ডিল, নিচে লোক থাকে, তারা, ওগুলো নিয়ে নদীপথে ছড়িয়ে পড়ে, তুলে দেয় বিভিন্ন শহরের এজেন্টদের কাছে। তাই তো?

আমিও ঠিক একই অনুমান করেছি, সাইমন বললেন।

আজ রাতে ওদের ওপর হামলা চালানোর কথা ভাবছেন?

হ্যাঁ।

আপনি আসায় ভালই হলো। আমরাও আজ রাতে ওখানে গিয়ে পাহারা দেয়ার প্ল্যান করেছিলাম। কি ঘটছে জানতাম না। জানা থাকায় এখন সুবিধে হবে।

তাহলে আর বসে আছি কেন? উত্তেজিত হয়ে বলল মুসা। আমরা ছয়জন। লোক কম না। দু-চারজন হলে সহজেই কাবু করে ফেলতে পারব। নাকি পুলিশ নিয়ে যাওয়ার কথা ভাবছেন?

না, মাথা নাড়লেন সাইমন। বেশি লোকের আনাগোনা হলে টের পেয়ে যাবে ডাকাতেরা। প্লেন থেকে চোখেও পড়ে যেতে পারে। চেকগুলো হয়তো তখন ফেলবেই না।

.

১৭.

রাত আরেকটু বাড়তে তৈরি হয়ে বেরিয়ে পড়ল সবাই। মুসার নিয়ে আসা বোটটায় চড়ল।

নদীর ওপারে তারাখচিত আকাশের পটভূমিতে মাথা তুলে রেখেছে টিলার চূড়া। কালো, কেমন ভূতুড়ে দেখাচ্ছে।

বোটের হাল ধরেছে বল। ইঞ্জিনের শব্দ শুনলে ডাকাতরা হুঁশিয়ার হয়ে যেতে পারে এই ভয়ে সরাসরি না গিয়ে প্রথমে খানিকটা উজানে নিয়ে এল বোট। তারপর ইঞ্জিন বন্ধ করে দিল। স্রোতের টানে ভাটির দিকে আপনাআপনি ভেসে চলল বোট। টিলার কাছাকাছি আসার পর নোঙর করল সে।

নিঃশব্দে মাটিতে নামল সবাই। পাড়ের ওপর উঠে এগিয়ে চলল সারি দিয়ে। বালি পার হয়ে এসে দাঁড়াল একশো ফুট উঁচু টিলার গোড়ায়। ঢাল বেয়ে উঠতে শুরু করল ওপরে।

এদিকের মরুভূমি বলের অতি পরিচিত। রাতে চলতেও অসুবিধে হয় না। তাই নেতৃত্বটা সে-ই নিল। আগে আগে চলল।

এদিকের ঢাল বড় বেশি খাড়া। তার ওপর রয়েছে আলগা পাথর। পা, পড়লে আর রক্ষা নেই। পিছলে পড়তে হবে। কোন রকম শব্দও করা চলবে না, শত্রুদের কানে চলে যেতে পারে। সুতরাং গতি হয়ে গেল খুবই ধীর।

তবে অবশেষে চূড়র কাছে পৌঁছাল দলটা। মাথা তুলেই ঝট করে নামিয়ে ফেলল বল। ফিসফিস করে জানাল, চারটে ছায়ামূর্তিকে চোখে পড়েছে।

সাইমন বললেন, ভাগাভাগি হয়ে এগোতে হবে এবার।

কিশোর আর রবিন ডানে সরে গেল। সাবধানে উঠে এল মালভূমির মত সমতল চূড়াটায়। ঝোপের আড়ালে লুকিয়ে বসল।

কিশোরের কাঁধে হাত রেখে আলতো চাপ দিল রবিন। নীরবে হাত তুলে দেখাল। তারার আলোতেও ঝোপের পাশের গুহামুখটা নজরে পড়ছে। আগের বার দিনের বেলা কেন নজরে পড়েনি বুঝতে অসুবিধে হলো না। মুখের অর্ধেকটা ঝোপের আড়ালে থাকে। বাকি অর্ধেকটীয় পাথর চাপা দিয়ে রাখলে সহজে কারও চোখে পড়বে না। চোরাই মাল কিংবা জাল চেক লুকিয়ে রাখার চমৎকার জায়গী।

বেশিক্ষণ অপেক্ষা করতে হলো না। একটা প্লেনের ইঞ্জিনের গুঞ্জন শোনা গেল।

একসঙ্গে জ্বলে উঠল অনেকগুলো আলো। আচমকা আলোকিত করে ফেলা হলো চুড়ার একাংশ। বৈদ্যুতিক লণ্ঠন জ্বেলে দানবীয় নকশাটার বাঁ হাতের ওপর দাঁড়িয়ে গেছে চারজন লোক। আকাশের দিকে তাকিয়ে আছে। একজনকে চিনতে পারল কিশোর–ডগলাস বর্ড, অন্য তিনজন অপরিচিত। না না, আরও একজনকে চেনা গেল। সবুজ মোটরবোট চুরি করেছিল যে লোকটা, পুলিশকে ফাঁকি দিয়ে পালিয়েছিল, এ সেই লোক।

উড়ে এল প্লেনটী। একটা আলোও জ্বালেনি। টিলার মাথায় চক্কর দিল দু বার। কালো আকাশের পটভূমিতে ভালমতই চোখে পড়ছে ওটাকে। হঠাৎ সাদাটে একখণ্ড ধোঁয়ার মত কি যেন ছিটকে বেরোল ওটা থেকে।

চিনে ফেলল কিশোর। প্যারাশুট!

সরে যেতে লাগল প্লেনটা। তারমানে ওটার কাজ শেষ, চলে যাচ্ছে এখন

নেমে আসছে প্যারাশুট। কোন মানুষ নেই। দড়িতে বাধা বড় প্যাকেটের মত একটা জিনিস ঝুলছে। দানবের গায়ের ওপর নামল ওটা। দোল খেয়ে বিশাল এক ছাতার মত ধসে পড়ল প্যারাশুটটা। ঘিরে ফেলল চার লণ্ঠনধারী। আলো নিভিয়ে ফেলেছে। প্যারাশুট থেকে প্যাকেটটা খুলতে ব্যস্ত হলো। আক্রমণ করার এটাই উপযুক্ত সুযোগ।

রবিনকে নিয়ে উঠে দৌড় দিল কিশোর। চোখের কোণ দিয়ে দেখল, আরও চারটে ছায়ামূর্তি বিভিন্ন দিক থেকে ছুটে আসছে।

এ রকম কোন পরিস্থিতির জন্যে তৈরি ছিল না ডাকাতেরা। চমকে গেল। ওরা আঘাত হানার আগেই ওদের ওপর এসে পড়ল আঘাত। পাল্টা আঘাত হানার সুযোগ পেল না তেমন। যোদ্ধা হিসেবেও ওরা ভাল না। কারাত জানা চার গোয়েন্দা, সেই সঙ্গে বাড়তি আরও দু-জন লোক, এতজনের সঙ্গে এঁটে উঠতে পারল না। তাছাড়া সাইমনের কাছে রয়েছে পিস্তল।

কাবু করে ফেলা হলো চার ডাকাতকে।

হঠাৎ পাথর গড়ানোর শব্দ হলো। ঝট করে ঘুরে তাকাল মুসা। চোখে পড়ল দ্রুত ঢালের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে আরেকটা ছায়ামূর্তি। ডাকাতদের আরেকজন। ধরো, ধরো ব্যাটাকে! চিৎকার করে দৌড় দিল সে।

পালাতে পারল না লোকটা। ডাইভ দিয়ে তাকে নিয়ে মাটিতে পরল মুসা।

লোকটার মুখে টর্চের আলো ফেলতেই চমকে উঠল লফার, ব্রাউন!

হ্যাঁ, এই লোকটাই পালের গোদা, মিস্টার সাইমন বললেন। আপনার বন্ধু।

চারজনকে কাজে লাগিয়ে দিয়ে ঝোপের আড়ালে লুকিয়ে ছিল সে। প্লেনের দিকে নজর ছিল বলে প্রথমে আমাদের কাউকে চোখে পড়েনি। দলের চারজন লোককে আক্রান্ত হতে দেখে দিশেহারা হয়ে গিয়েছিল সে। ওরা ধরা পড়ার পর পালাতে চেয়েছিল। কিন্তু সর্বনাশ করে দিল পাথরটা। ওটাতে লাথি লেগে শব্দ হয়ে গিয়েছিল। দেখে ফেলেছিল মুসা।

দড়ির অভাব নেই। প্যারাশুট থেকে দড়ি কেটে নিয়ে পাঁচজনকে শক্ত করে বেঁধে ফেলা হলো। ঝোপ আর পাথরের আড়ালে খুঁজে দেখা হলো আর কেউ লুকিয়ে আছে কিনা। না, আর কেউ নেই।

প্যারাশুটে করে নামিয়ে দেয়া প্যাকেটটা খুললেন সাইমন। বেরিয়ে পড়ল। নিখুঁত ভাবে বাণ্ডিল করা হাজার হাজার জাল চেক। ইউনাইটেড স্টেটস গভর্নমেন্টের নামে ছাপা।

যাক, প্রমাণ সহ হাতেনাতে ধরা পড়ল, সন্তুষ্ট হয়ে বললেন সাইমন। অস্বীকার আর করতে পারবে না কিছু।

একটা টর্চ হাতে উঠে দাঁড়াল কিশোর। বলল, আমার সঙ্গে আসুন। একটা জিনিস দেখাব।

ঝোপের ধারে গুহামুখটার কাছে সবাইকে নিয়ে এল সে। আলো ফেলে দেখে বোঝা গেল, গুহা নয়, বড় গর্ত। ভেতরে পাওয়া গেল দড়ির বাণ্ডিল, মাটি খোঁড়ার যন্ত্রপাতি, আর আরও এক বস্তা জাল চেক।

আঁতকে গেল মুসা। বাপরে বাপ, কত! সব বাজারে ছাড়তে পারলে সর্বনাশ হয়ে যেত!

আসল কাজ শেষ। এবার বন্দিদের নিয়ে যেতে হবে। সেটা একটা বড় সমস্যা। সমাধান দিল মুসা। সে আর বল বোট নিয়ে যাবে পুলিশকে খবর দিতে। অন্যেরা ততক্ষণ ওখানেই বসে পাহারা দেবে বন্দিদের।

মুসা আর বল চলে গেল।

লণ্ঠন জেলে বন্দিদের কাছে বসে রইল অন্য চারজন।

আমাকে পুলিশে দিলে লফারও বাঁচতে পারবে না, আচমকা পাতলা, নাকি গলায় বলে উঠল ব্রাউন। সে-ও আমাদের দলে ছিল।

না, ছিল না, জোর প্রতিবাদ করলেন সাইমন। তোমাদের ভয়ে বহুদিন ধরে পালিয়ে বেড়াচ্ছে সে।

তাতে কি? আমাদের সঙ্গে কাজ করার পর পালিয়েছে। আমার কাছ থেকে জাল চেক নিয়ে বাজারে ছেড়েছে। বিশ্বাস না হলে জিজ্ঞেস করে দেখুন।

বিষণ্ণ স্বরে জবাব দিল লফার, ও ঠিক কথাই বলেছে। আদালতে দোষ স্বীকার করতে রাজি আছি আমি।

তা কেন করবেন? কিশোর বলল। আপনি তো আর ইচ্ছে করে। করেননি। প্রাণের ভয় দেখিয়ে আপনাকে করতে বাধ্য করা হয়েছে।

সেটা প্রমাণ করতে পারবে না সে, খিকখিক করে হাসল ব্রাউন। তবে জাল চেক দিয়ে যে জিনিস কিনেছে আমি প্রমাণ করতে পারব। কোন কোন দোকানে চেক ভাঙিয়েছে সে, মনে আছে আমার। ওরা সাক্ষ্য দেবে, চেকগুলো ব্রাউন ওদের দিয়েছে। পুলিশ আমার কিছুই করতে পারবে না। কারণ একটা চেকও আমি নিজের হাতে ভাঙাইনি। মরলে আর সবাই মরবে। আমার কিছুই হবে না।

খেপা কুকুরের মত দাঁত খিচাল বার্ড। ভীষণ রাগে চেঁচিয়ে উঠল, শয়তান! বদমাশ! তুমি নিজে ভাল থেকে আমাদের বিপদে ঠেলে দেয়ার ফন্দি করেছিলে! দাঁড়াও, আমিও ছাড়ব না! আমি সাক্ষ্য দেব, লফার নির্দোষ, তুমি। জোর করে ওকে দিয়ে বেআইনী কাজ করিয়েছ!

গুড, মাথা দোলালেন সাইমন, তাতে তোমার ভালই হবে। শাস্তির পরিমাণ কমবে। কি কি জানো তুমি, বলো তো?

বার্ড বলল, মাস চারেক আগে মরুভূমির ওপর দিয়ে প্লেনে করে ওড়ার সময় দানবীয় নকশাগুলো চোখে পড়ে আমাদের। একটা গুজব কানে এনেছিল ব্রাউনের, কোন একটা টিলার ওপরের একটা দানবের হাত গুপ্তধনের খনির দিকে নির্দেশ করে আছে। এই টিলার ওপরে দানবটা দেখতে পেয়ে সেই কথাই মনে পড়ল তার। আমাকে বলল সে-কথা। দুজনে মিলে তখন নানা জায়গায় খুঁড়তে আরম্ভ করলাম। তারপর সত্যি সত্যিই পেয়ে গেলাম লুকিয়ে রাখা সোনা।

সোনা! প্রতিধ্বনি করল যেন কিশোর। কোথায়? কোনখানে?

যে গর্তটা তোমরা দেখেছ একটু আগে। দানবের হাত নয়, একটা পা। নির্দেশ করছে গর্তটা।

কি ধরনের সোনা? জানতে চাইলেন সাইমন।

ইনডিয়ানদের সোনা। জানাজানি হলে খোয়াতে হতে পারে। তাই আমেরিকায় বিক্রি করার সাহস পেলাম না। নিয়ে গেলাম মেকসিকোয়। টাকাটা দু-জনে ভাগ করে নিতে চেয়েছিলাম। কিন্তু ব্রাউনের মাথায় একটা শয়তানি বুদ্ধি এল। সে বলল, এই টাকা খাঁটিয়ে আরও অনেক অনেক বেশি টাকা আমরা আয় করতে পারি।

বুদ্ধিটা কি?

সে বলল, একটা ছাপাখানা করতে পারি আমরা। সেটীতে জাল নোট আর চেক ছাপতে পারি। সারা আমেরিকায় সে-সব ছড়িয়ে দিয়ে কোটি কোটি টাকা আয় করব। রাজি হয়ে গেলাম। ছাপাখানা বসল। জাল চেক ছাপা হতে লাগল। প্লেনে করে সেগুলো বর্ডার পার করে এনে এই টিলায় নামানোর ব্যবস্থা হলো। নির্জন জায়গা এটা। রাতে তো দূরের কথা, দিনেও সাধারণত আসে না এখানে লোকে। ঠিক হলো, এখানে এনে জমা করে রাখা হবে চেকগুলো। তারপর ধীরে ধীরে চালান করে দেয়া হবে বিভিন্ন শহরে। বাতিগুলোসহ প্রয়োজনীয় সমস্ত জিনিস ওই গর্তে লুকিয়ে রাখতাম আমরা।

বুঝলাম, মাথা ঝাঁকাল কিশোর। কিন্তু লফার এর মধ্যে এলেন কি করে?

সেটাও ব্রাউনের আরেকটা কুবুদ্ধি, ঘৃণায় মুখ বাকলি বার্ড। তার ওপর যাতে পুলিশের নজর না পড়ে সেজন্যে একজন সৎ, ভাল মানুষকে সামনে রাখতে চেয়েছিল। ভেবেছিল, ব্যবসায় মার খেয়েছে লফার, এই সুযোগে ভুলিয়ে-ভালিয়ে তাকে দলে টানতে পারবে। পারল না। জোর করে তাকে দিয়ে কাজ করানোর চেষ্টা করল। কিন্তু কিছুই করতে পারল না। পালিয়ে গেল লফার। অনেক কিছু জেনে ফেলেছে ততদিনে সে। সুতরাং তার মুখ বন্ধ করাটা জরুরী। আমাকে পাঠাল রকি বীচে। ব্রাউন ভেবেছিল লফার তার মামার বাড়িতেই গিয়ে উঠেছে। গিয়ে জানলাম তার মামা ডিটেকটিভ ভিকটর সাইমনের সঙ্গে যোগাযোগ করেছে তার ভাগ্নেকে খুঁজে বের করে দেয়ার জন্যে। মোটর সাইকেল নিয়ে মিস্টার স্মিথের পিছে পিছে গেলাম সেখানে। সেখান থেকে স্যালভিজ ইয়ার্ডে।

মুসার মাথায় বাড়ি মেরেছিল কে? আপনি?

গম্ভীর হয়ে বলল বার্ড, হ্যাঁ। তাকে বেহুশ না করে ছবিগুলো আনা যেত না তার কাছ থেকে। ওঅর্কশপের দরজায় নোটটাও আমি রেখেছি। বললাম যখন, সব কথাই বলি। রকি বীচ থেকে একটা ভাড়া করা প্লেনে তোমাদের অনুসরণ করলাম আমি। স্যান বারনাডিনোতে ওই প্লেনটাই ধাক্কা মারতে যাচ্ছিল তোমাদের। পাইলটটা একটা গাধা। মদ খেয়ে মাতাল হয়ে থাকে। প্রথমে বুঝতে পারিনি, তাহলে তাকে নিতাম না। আরেকটু হলেই তোমাদেরও মেরেছিল, আমাকেও। যাই হোক, ব্লইদিতেও লফারের প্লেনে তোমাদের হুমকি দিয়ে নোট আমিই রেখেছিলাম। রাতের বেলা চুরি করে ঢুকেছিলাম হ্যাঁঙ্গারে।

নোট লিখতে গিয়ে তো রীতিমত কাণ্ড করেছেন। একবার আর্টিস্ট, একবার কবি! রবিন বলল। এ সব করতে গেলেন কেন?

ভাবলাম, খানিকটা অন্য রকম করে দিলে হুমকির গুরুত্ব বাড়বে।

তা বেড়েছে বটে, স্বীকার করল কিশোর। জানতে চাইল, তিন মেকসিকানকে আমাদের পেছনে আপনারাই লাগিয়েছিলেন, তাই না?

হ্যাঁ। আফসোস করে বলল বার্ড, ইস্, সোনাগুলো পাওয়ার পর ব্রাউনের কথা কেন যে শুনলাম! অত লোভ না করে আমার ভাগের টাকাটা নিয়ে নিলেই হত…।

আচ্ছা, আরেকটা কথা। মরুভূমিতে একটা দামী পাথর কুড়িয়ে পেয়েছি। আমরা। ওটা সম্পর্কে কিছু জানেন নাকি?

দীর্ঘ একটা মুহূর্ত কিশোরের দিকে তাকিয়ে রইল বার্ড। ধীরে ধীরে মাথা নাড়ল। নাহ্, পাথরের ব্যাপারে কিছু জানি না আমরা। তবে পর্বতের ওদিকে পাথর খুঁজতে যায় অনেকে। নিয়ে আসার সময় হয়তো ওদেরই কারও কাছ থেকে কোনভাবে পড়ে গেছে ওটা।

হু, বিড়বিড় করল কিশোর, তাই হবে!

পুলিশ নিয়ে মুসাদের ফিরতে অনেক সময় লাগল।

বন্দিদের নিয়ে চলে গেল পুলিশ। তাদের সঙ্গে গেলেন সাইমন। লফারও গেল। সমস্যা মিটে যেতেই বাড়ি যাওয়ার জন্যে অস্থির হয়ে উঠেছে।

কেবিনে ফিরে চলল তিন গোয়েন্দা। সঙ্গে ওয়ারনার বল।

 রাত আর বেশি বাকি নেই।

Super User