তিন বিঘা – তিন গোয়েন্দা (১২৫)
প্রথম প্রকাশ: ১৯৯৯

০১.

ম্যানিলা রোডের শেষ বাড়িটার সামনে এসে গাড়ি থামালেন মিস কেলেট। বাড়ির দিকে তাকিয়ে মন্তব্য করল কিশোর, দারুণ কটেজ!

বন আর পাহাড়ের কোলে ছবির মত একটা বাড়ি। পুরানো পাথরের দেয়াল, টালির ছাত, পর্দা ঢাকা জানালা। বিরাট বাগানটাতে উজ্জ্বল রঙের ফুলের মেলা। ঝোপঝাড় আর বেডগুলো সব পুরানো ধাচে তৈরি।

ওল্ড-মেনস ভলান্টিয়ার সার্ভিসের একজন সদস্য মিস কেলেট। টীম প্রধানদের একজন। কিশোরও জুনিয়র মেম্বার। আজ ওর আসার কথা ছিল না; যার আসার কথা সে অসুস্থ থাকায় মিস কেলেটের অনুরোধে তাকে আসতে হয়েছে।

হ্যাঁ, কিশোরের হাসিটা ফিরিয়ে দিলেন মিস কেলেট। সেভারনরা এসেছেন এখানে বছরখানেক হলো। কণ্ঠস্বর খাদে নামিয়ে বললেন, বাড়িটাতে নাকি ভূতের উপদ্রব আছে।

আবার হাসল কিশোর। বুদ্ধিদীপ্ত সুন্দর চোখ দুটো ঝিক করে উঠল। যাহ, ঠাট্টা করছেন!

না, ঠাট্টা করছি না। আমার সামনেই স্ত্রীকে বকাবকি করেছেন মিস্টার সেভারন, ভয় পান বলে। অদ্ভুত সব শব্দ নাকি শুনতে পান মহিলা, ঘরের মধ্যে নাকি ঠাণ্ডা বাতাস বয়ে যায়। কারা নাকি হাসাহাসি করে। বেচারি!

 হু। ভূতের গল্প আমার ভাল লাগে। মিসেস সেভারনকে জিজ্ঞেস করে। সব জেনে নিতে হবে।

দেখো, সারাদিন ধাক্কিয়েও দরজা খোলাতে পারো নাকি, অস্বস্তিভরা কণ্ঠে বললেন মিস কেলেট। আজকাল অপরিচিত কাউকে দেখলে দরজাও খুলতে চান না ওঁরা।

কেন?

জানি না। কিছু হয়েছে কিনা জিজ্ঞেস করেছিলাম। কিন্তু স্বীকার করলেন না। পুরো ব্যাপারটাই কেমন রহস্যময়।

কান খাড়া হয়ে গেছে কিশোরের। ভাল কোন রহস্য পেলে আর কিছু চায় না সে।

 দেখো, মুখ খোলাতে পারে কিনা। বুড়োবুড়ি খুব ভাল মানুষ। বলেও ফেলতে পারেন।

যদি ঢুকতেই না দেন?

হাসলেন মিস কেলেট। যাও, আমি আছি এখানে। দরজা না খুললে পরে যাব। নাকি এখনই সঙ্গে যেতে বলছ?

গাড়ির দরজা খুলল কিশোর। না, আমিই যাই। লাঞ্চ নিয়ে গেছি দেখলে না খুলে পারবেন না। আধঘণ্টা পর এসে নিয়ে যাবেন আমাকে।

ঘুরে গাড়ির পেছনে চলে এল কিশোর। হীটেড ট্রলি থেকে গরম গরম দুই প্লেট রোস্ট বীফ আর এক প্লেট পুডিং বের করল। হাত নেড়ে মিস কেলেটকে চলে যেতে ইশারা করে পা বাড়াল কটেজের মরচে পড়া গেটটার দিকে।

নীল রঙ করা সামনের দরজায় টোকা দিল সে। চিৎকার করে বলল, ওল্ড মেনস ভলান্টিয়ার!

সাড়া নেই।

আবার টোকা দিল সে। জানালায় পর্দা টানা। ভেতরে কেউ আছে কিনা উঁকি দিয়ে দেখার উপায় নেই। দোতলার দিকে তাকাল। ওখানকার বেডরূমের জানালায়ও পর্দা টানা। বাড়ি আছেন তা সেভারনরা?

কি করবে ভাবছে কিশোর, এই সময় ফাঁক হয়ে গেল নিচতলার জানালার পর্দা। দেখা গেল একটা মুখ।

 ওল্ড-মেনস ভলান্টিয়ার! সঙ্গে সঙ্গে চিৎকার করে উঠল সে। আপনাদের লাঞ্চ নিয়ে এসেছি।

বন্ধ হয়ে গেল ফাঁকটা।

 দরজার শেকল খোলার শব্দ। ছিটকানি খুলল। দরজা খুলে দিলেন এক বৃদ্ধা। ছোটখাট মানুষ। মাথার চুল সব সাদা। সন্দেহভরা চোখে তাকিয়ে রইলেন কিশোরের দিকে।

মিসেস সেভারন?

মাথা ঝাঁকালেন বৃদ্ধা, হ্যাঁ।

আপনাদের লাঞ্চ নিয়ে এসেছি। জলদি নিন। ঠাণ্ডা হয়ে যাচ্ছে।

তোমাকে তো চিনি না। মিস কেলেট কোথায়?

আরেক বাড়িতে গেছেন। আমি তার সহকারী। একা পেরে ওঠেন না। তাই আমাকে নিয়ে এসেছেন। আমার নাম কিশোর পাশা।

তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে কিশোরের আপাদমস্তক দেখলেন বৃদ্ধা। মুখ ফিরিয়ে ডাকলেন, জন, লাও। কিশোরের দিকে ফিরে অস্বস্তিভরা হাসি হেসে শেকলটা খুলে দিয়ে সরে দাঁড়ালেন। এসো। কিছু মনে কোরো না। আজকাল অপরিচিত কাউকে ঢুকতে দিতে ভয় লাগে আমাদের।

হা, সাবধান থাকা ভাল। চোর-ডাকাতে ভরে গেছে দেশটা।

 কিশোর ঘরে ঢুকতেই দরজা লাগিয়ে ছিটকানি তুলে দিলেন বৃদ্ধা। তার হাত থেকে ট্রে-টা নিতে নিতে বললেন, তুমি কি একটু বসবে? আমরা লাঞ্চটা সেরে নিই?

সারুন, সারুন, কোন অসুবিধে নেই। আমি বসছি। মিস কেলেটের ফিরে আসতে সময় লাগবে।

রান্নাঘরে ট্রে-টা রেখে এলেন মিসেস সেভারন। কিশোরকে নিয়ে এলেন বসার ঘরে।

থ্যাংকস, পুরানো, আরামদায়ক একটা সোফায় বসে বলল কিশোর। ওক কাঠে তৈরি ছোট কফি টেবিলে রাখা দুটো ম্যাগাজিন আর একটা ছবির অ্যালবাম। অ্যালবামটা দেখি? মানুষের ছবি দেখতে ভাল লাগে আমার।

দেখো। তবে মানুষের ছবির চেয়ে এই কটেজের ছবিই বেশি।

সেভারনরা লাঞ্চ খেতে বসল। অ্যালবামের পাতা ওল্টাতে লাগল কিশোর। কটেজ আর বাগানটার সুন্দর সুন্দর ছবি। বাগানের ঠেলাগাড়িতে বসা এক বৃদ্ধের ছবি আছে। মিস্টার সেভারনের ছবি, অনুমান করল কিশোর।

প্রথম পাতায় রয়েছে এক যুবকের বেশ কয়েকটা ছবি। খাটো করে ছাটা চুল। লম্বা, সুগঠিত শরীর, ব্রোঞ্জ-রঙ চামড়া। পরনে জিনস আর কলেজ সোয়েটশার্ট। মিসেস সেভারনের সঙ্গে চেহারার অনেক মিল।

 অ্যালবাম থেকে মুখ তুলে ঘরের চারপাশে চোখ বোলাল কিশোর। ৫ ঘর। ওক কাঠের মোটা মোটা কড়িকাঠ। ম্যানটলপীসে রাখা মাউন্টে এ ছবি-অ্যালবামে যে যুবকের ছবি আছে তার। অ্যাথেনসের পারথেননের সামনে দাঁড়িয়ে তোলা। কড়া রোদ। পিঠে ঝোলানো ব্যাকপ্যাক। হাসিমুখে ক্যামেরার চোখের দিকে তাকিয়ে আছে।

দ্রুত অ্যালবামের বাকি পাতাগুলো দেখা শেষ করে একটা ম্যাগাজিন তুলে নিল কিশোর। টান লেগে ভেতর থেকে বেরিয়ে মেঝেতে পড়ে গেল একটা চিঠির খাম। ওপরে ছাপ মারা একটা লোগো-কোন কোম্পানির নামের আদ্যক্ষর যুক্ত করে তৈরি। সাধারণ জিনিস। কৌতূহল জাগাল না কিশোরের। খামটা আবার আগের জায়গায় ঢুকিয়ে রাখল সে।

স্বামীকে সঙ্গে নিয়ে ঘরে ঢুকলেন মিসেস সেভারন।

ও কিশোর পাশা, পরিচয় করিয়ে দিলেন বৃদ্ধা। ভলান্টিয়ার সার্ভিসের সদস্য।

সোফা থেকে উঠে গিয়ে মিস্টার সেভারনের সঙ্গে হাত মেলাল কিশোর, হালো, মিস্টার সেভারন। অ্যালবামটা খুব সুন্দর। ম্যানটল পীসের ছবিটা দেখিয়ে জিজ্ঞেস করল, ওটা কি আপনাদের ছেলের ছবি?

ছেলের কথা উঠতেই আড়ষ্ট হয়ে গেলেন দুজনে। তাদের ভঙ্গি দেখেই বুঝে গেল কিশোর, কি যেন গোপন করতে চাইছেন। অবাক হলো সে।

ইয়ে… আমতা আমতা করে জবাব দিলেন মিসেস সেভারন, ছুটিতে থাকার সময় ওর কোন বন্ধু হয়তো তুলেছিল ছবিটা। হঠাৎ করেই একদিন। ডাকে এসে হাজির, ও…

ও, কি? কৌতূহল হলো কিশোরের।

ও…ও চলে যাবার পর। অ্যালবামটা তুলে নিয়ে গিয়ে একটা ড্রয়ারে রেখে দিলেন মিসেস সেভারন।

তারমানে এখানে থাকে না আপনাদের ছেলে?

মাথা নাড়লেন মিসেস সেভারন। না।

ফায়ারপ্লেসের সামনের একটা চেয়ারে গিয়ে বসলেন মিস্টার সেভারন। ভঙ্গি এখনও আড়ষ্ট।

তাহলে কোথায়…? জিজ্ঞেস করতে গেল কিশোর।

দূরে থাকে, আচমকা তীক্ষ্ণ হয়ে উঠল মিস্টার সেভারনের কণ্ঠ।

স্পষ্ট বোঝা গেল এই প্রসঙ্গে আর কথা বলতে চান না মিসেস সেভারনও। কোন স্কুলে পড়ো তুমি?

রকি বীচ হাই।

দুজনের আচরণে কৌতূহল বেড়ে গেছে কিশোরের। ছেলের সম্পর্কে কথা বলতে চান না কেন? বুড়ো মানুষেরা তো সাধারণত ছেলেমেয়ের প্রসঙ্গ উঠলেই খুশি হয় বেশি, যতটা পারে বকর বকর করে, কিন্তু এরা ঠিক উল্টো। ছেলের সঙ্গে ঝগড়া করেছেন নাকি?

কোথায় থাকো? জানতে চাইলেন মিস্টার সেভারন।

 ইয়ার্ডের ঠিকানা জানাল কিশোর।

রকি বীচে কতদিন? মিসেস সেভারন জিজ্ঞেস করলেন।

 বহু বছর। প্রায় জন্মের পর থেকে।

 ভাল লাগে?

 লাগে।

আমরাও আছি বলতে গেলে প্রায় সারাটা জীবনই। জ্যাকিও এখানেই জন্মেছে…

মিস্টার সেভারনের ভ্রূকুটি দেখে থেমে গেলেন মিসেস সেভারন। লক্ষ করল কিশোর।

এই কটেজটা কিনেছি মাত্র বছরখানেক আগে, আবার ছেলের প্রসঙ্গ চাপা দেয়ার চেষ্টা করলেন মিস্টার সেভারন। খুব ভাল লাগে জায়গাটা। শান্ত, নীরব; কোন গোলমাল ছিল না, কিন্তু…

অপেক্ষা করতে লাগল কিশোর। পুরো এক মিনিট চুপ করে থাকার পরও যখন মুখ খুললেন না মিস্টার সেভারন, না জিজ্ঞেস করে আর পারল না সে, কিন্তু কি, মিস্টার সেভারন? কিছু ঘটেছে মনে হচ্ছে,

তাড়াতাড়ি মাথা নাড়লেন মিস্টার সেভারন, না না, কি ঘটবে?

মিস কেলেট আমাকে বললেন বাড়িটাতে নাকি ভূতের উপদ্রব আছে।

অস্বস্তিভরা ভঙ্গিতে স্বামীর দিকে তাকাতে লাগলেন মিসেস সেভারন। সত্যি যেন ভূতের ভয়ে কাবু হয়ে আছেন।

হাসি ফুটল মিস্টার সেভারনের মুখে। অবাক করল কিশোরকে।

সব গাঁজা, বুঝলে। অতি কল্পনা। আমার স্ত্রী ভূতকে ভীষণ ভয় পায়।

সলজ্জ হাসি ফুটল মিসেসের মুখে। তুমিই তো ভয়ের গল্প শুনিয়ে শুনিয়ে ভয়টা বাড়াও আমার।

কিন্তু ঘর নাকি খুব ঠাণ্ডা হয়ে যায় মাঝে মাঝে, কিশোর বলল।

 ঘরে রোদ না ঢুকলে তো হবেই, জোর দিয়ে কথাটা বলতে পারলেন না মিসেস সেভারন। এমনিতেই জায়গাটা বড় বেশি নীরব; দুপুরবেলায়ও গা ছমছম করে, তার ওপর…

তার ওপর কি? কিশোরের মনে হলো জরুরী কোন কথা বলতে চেয়েছিলেন মিসেস সেভারন। বলতে দিলেন না মিস্টার সেভারন। বাদ দাও ওর কথা, চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ালেন তিনি। প্রসঙ্গটাকে হালকা করার জন্যে বললেন, আমার স্ত্রীর ভূতে আসর করা ঘরটা দেখবে নাকি?

দেখব না মানে! এক্ষুণি চলুন।

এসো, হাসলেন মিস্টার সেভারন। স্ত্রীর দিকে তাকিয়ে বললেন, আমি ওকে দেখিয়ে আনি। তুমি ততক্ষণে বাসনগুলো ধুয়ে ফেললো।

আপনাদের কষ্ট করার দরকার নেই, কিশোর বলল। ধোয়াধুয়িগুলোও আমরাই করব। আমাদের দায়িত্ব…

কোন অসুবিধে নেই, মিসেস সেভারন বললেন। বসেই তো থাকি। বরং কাজ করলে ভাল লাগবে। রান্না করে যে লাঞ্চ এনে খাওয়াচ্ছ, তাতেই আমরা কৃতজ্ঞ; কত কাজ আর ঝামেলা বাঁচাচ্ছ।

ধোও তুমি, আমরা যাচ্ছি, স্ত্রীকে বলে কিশোরের দিকে তাকালেন মিস্টার সেভারন। এসো।

এই সময় বাইরে গাড়ির হর্ন বাজল।

তাড়াতাড়ি গিয়ে জানালার পর্দা সরিয়ে তাকাল কিশোর। এহহে, মিস কেলেট চলে এসেছেন! আর কয়েক মিনিট দেরিতে এলে কি হত… নিরাশ ভঙ্গিতে মাথা নাড়তে লাগল সে। মিস্টার সেভারনের দিকে ফিরে জিজ্ঞেস করল, অন্য কোন সময় এলে কি ঘরটা দেখাবেন?

নিশ্চয় দেখাব। যখন ইচ্ছে চলে এসো। এলে খুশিই হব। কথা বলার লোক পাই না।

পকেট থেকে তিন গোয়েন্দার একটা কার্ড বের করল কিশোর। বাড়িয়ে দিয়ে বলল, নিন, রাখুন এটা। যদি কখনও কোন প্রয়োজন মনে করেন, ফোন করবেন।

কার্ডটা দেখলেন মিস্টার সেভারন। কিশোর গোয়েন্দা!…খুব ভাল। মুখ তুলে তাকালেন তিনি। কিন্তু প্রশ্নবোধকগুলো কেন? আত্মবিশ্বাসের অভাব?

এই প্রশ্নটা বহুবার বহুজনের মুখে শুনেছে কিশোর। দমল না। বলল, মোটেও না। বরং আত্মবিশ্বাস অনেক বেশি আমাদের। প্রশ্নবোধকগুলো বসানোর তিনটে কারণ। এক, রহস্যের ধ্রুবচিহ্ন এই প্রশ্নবোধক। যে কোন রহস্য সমাধানে আগ্রহী আমরা। ছিঁচকে চুরি থেকে শুরু করে ডাকাতি, রাহাজানি, খুন, এমনকি ভৌতিক রহস্যের তদন্তেও পিছপা নই। দুই, চিহ্নগুলো আমাদের ট্রেডমার্ক। আর তিন, যেহেতু দলে তিনজন, তাই তিনটে চিহ্ন দেয়া হয়েছে। একটু থেমে বলল, কারও কাজ করে দেয়ার জন্যে পয়সা নিই না আমরা। গোয়েন্দাগিরি করাটা আমাদের শখ।

.

০২.

তারমানে ঘরটা দেখতে পারলে না!

কিশোরের মতই নিরাশ হলো মুসাও। বেড়ায় হেলান দিল। তিন গোয়েন্দার ওঅর্কশপে বসে আছে ওরা।

আরেকবার গেলেই হয়, রবিন বলল। বলে তো এসেছই।

হ্যাঁ। যাব।

আঁতকে উঠল মুসা, ওই ভূতের ঘর দেখতে!

হাসল কিশোর, এইমাত্র না দেখে আসতে পারলাম না বলে দুঃখ করলে?

ঝটকা দিয়ে উঠে দাঁড়াল মুসা। আমি যাই। ফায়ারকে অনেকক্ষণ খাবার দেয়া হয়নি। খিদে পেলে চেঁচিয়ে, মাটিতে লাথি মেরে পাড়া মাত করবে। মা শেষে রেগে গিয়ে আমাকে সহ কানটি ধরে বের করে দেবে বাড়ি থেকে। পকেট থেকে একটা চকলেট বের করে মোড়ক খুলল সে। মট মট করে দুই টুকরো ভেঙে তুলে দিল দুজনের হাতে। বাকিটা মুখে পুরে কিশোরের দিকে তাকিয়ে ভুরু নাচাল, তাহলে যাচ্ছই ভূত দেখতে?

হ্যাঁ।

 কবে? কাল সকালে।

সকালে আমার গিটারের ক্লাস আছে, রবিন বলল। তারপর যাব লাইব্রেরিতে। দুপুরের পর হলে যেতে পারি।

ঠিক আছে। দুপুরের পরই যাব।

.

মুসা আর রবিন চলে যাওয়ার পর দুই সুড়ঙ্গ দিয়ে হেডকোয়ার্টারে ঢুকল কিশোর। ডেস্কের অন্য পাশে তার চেয়ারে এসে বসল। টেবিলে উপুড় করে ফেলে রাখা হয়েছে একটা বই, একটা রহস্য কাহিনী : দি মিস্টরি অভ দা রেড জুয়েলস। কিছুটা পড়ে ফেলে রেখে গিয়েছিল। তুলে নিয়ে পড়তে শুরু করল।

 শেষ হওয়ার বহু আগেই বুঝে ফেলল চোর কোন লোকটা। আর পড়ার কোন মানে হয় না। বিরক্ত হয়ে বইটা রেখে দিল। রহস্য কাহিনী পড়তে গেলেই এই অবস্থা হয় তার। আগেই বুঝে ফেলে। ব্যস, মজা শেষ।

জোরে একটা নিঃশ্বাস ফেলল সে। স্কুলের ম্যাগাজিনের জন্যে একটা আর্টিকেল লেখার কথা। হাতে সময় আছে। এখন বসতে পারে। কিন্তু লিখতে ইচ্ছে করছে না। একে তো ম্যাগাজিনের সম্পাদিকা কেরি জনসনের সঙ্গে বনাবনতি নেই, তার ওপর বিষয় যেটা ঠিক করে দেয়া হয়েছে সেটাও একেবারে পচা-শহুরে মানুষের ঘুরে বেড়ানোর প্রবণতা এবং ফুটপাথ সমস্যা। এ জিনিস নিয়ে যে কেউ ভাবতে পারে, ভাবলেও অবাক লাগে তার। তথ্য জানার জন্যে লাইব্রেরি থেকে খুঁজেপেতে একটা বই নিয়ে এসেছে সে। সঙ্গে রকি বীচের একটা ম্যাপ।

স্যারকে কথা যখন দিয়েছে লিখবে, লিখতেই হবে। খানিকক্ষণ উসখুস করে কাগজ-কলম টেনে নিল সে। এই সময় বাঁচিয়ে দিল তাকে টেলিফোন।

তুলে নিয়ে কানে ঠেকাল, হালো!

কিশোর?

মিসেস সেভারনের গলা। সঙ্গে সঙ্গে কান খাড়া হয়ে গেল কিশোরের। ঢিলেঢালা ভাবটা চলে গেল। হ্যাঁ, বলছি!

কিশোর, ফিসফিস করে বললেন বৃদ্ধা, জোরে বলতে ভয় পাচ্ছেন যেন, একটা কথা…

বলে ফেলুন! উত্তেজনায় টানটান হয়ে গেছে কিশোরের স্নায়ু।

দুপুরে… ভীত মনে হচ্ছে মিসেস সেভারনকে। আসলে…

 কথা শেষ করতে পারলেন না। একটা ধমক শুনতে পেল কিশোর।

এমন করছ কেন, জন! মিসেস সেভারনের কাতর কণ্ঠ শোনা গেল। কিশোরকে বললে ক্ষতি কি?

আবার শোনা গেল ধমক। মিস্টার সেভারন কি বললেন, রিসিভারে কান চেপে ধরেও বুঝতে পারল না কিশোর।

কিশোর, আবার লাইনে ফিরে এলেন মিসেস সেভারন, সরি, বিরক্ত করলাম। পরে কথা বলব…রাখি, গুডবাই।

দাঁড়ান দাঁড়ান, মিসেস সেভারন! চিৎকার করে উঠল কিশোর।

 কট করে শব্দ হলো। রিসিভার নামিয়ে রাখা হয়েছে অন্যপাশে।

একটা মুহূর্ত নিজের হাতে ধরা রিসিভারটার দিকে তাকিয়ে রইল কিশোর। তারপর আস্তে করে নামিয়ে রাখল। ম্যানিলা রোডের ওই বাড়িটাতে রহস্যময় কোন ঘটনা যে ঘটছে, তাতে কোন সন্দেহ নেই আর তার।

.

আরে এসো না, পায়ে জোর নেই নাকি তোমাদের! ফিরে তাকিয়ে বলল মুসা। সাইকেল থামিয়ে এক পা মাটিতে নামিয়ে দিয়েছে। সেভারনদের বাড়িতে চলেছে। আগের দিন বলেছিল যাবে না, কিন্তু রবিন আর কিশোর রওনা হতেই আর সঙ্গে না এসে পারেনি।

এত তাড়াতাড়ি চালাও কেন, বলো তো! কাছে এসে হাঁপাতে হাঁপাতে বলল রবিন। তোমার গায়ে নাহয় জোর বেশি, আমাদের তো আর নেই।

বেশ গরম পড়েছে। মুখ লাল হয়ে গেছে তার।

হাসল মুসা। সেজন্যেই তো বলি, ব্যায়ামের ক্লাসে যোগ দাও। শরীরটাকে ফিট করে ছেড়ে দেবে।

কে যায় এত কষ্ট করতে…

তাহলে শরীরও ফিট হবে না।

কি বকবক শুরু করলে! সময় নষ্ট, প্যাডালে চাপ দিল কিশোর। চলো।

ম্যানিলা রোডে সেভারনদের বাড়ির সামনে পৌঁছল ওরা। সামনের রাস্তাটা বাদেও বাড়ির পাশ দিয়ে ঘাসে ঢাকা আরেকটা মোটামুটি চওড়া রাস্তা চলে গেছে একটা ছোট আপেল বাগানে। গাছগুলোর ফাঁকে ফাঁকে আঙুরের ঝোপ। তার ওপাশে বুনো গাছপালার জঙ্গল। বাতাসে দুলছে ফুলে ভরা ডালগুলো।

কাঠের গেটের পাশে বেড়ার গায়ে সাইকেল ঠেস দিয়ে রাখল ওরা। বাগানের দিকের রাস্তাটা ধরে এগিয়ে গেল। সামনের দরজার কাছে এসে দাঁড়াল।

খুলবে বলে তো মনে হচ্ছে না, তৃতীয়বার দরজায় টোকা দেয়ার পরেও সাড়া না পেয়ে বলল কিশোর। ভুল হয়ে গেছে। আমরা যে আসছি, ফোন করে জানিয়ে আসা উচিত ছিল।

বাইরে বেরিয়ে যায়নি তো? একটা ফুলের বেডের পাশে পঁড়িয়ে জানালা দিয়ে ভেতরে দেখার চেষ্টা করল মুসা। পর্দা টানা থাকায় কিছুই দেখতে পেল না।

উঁহু, মাথা নাড়ল কিশোর, বাইরে যেতে পারে না বলেই খাবার দিয়ে যেতে হয় ওদের। বাইরে বেরোনোর সমস্যা আছে।

মুসার হাত ধরে টান দিল রবিন, সরে এসো। এভাবে তোমাকে উঁকিঝুঁকি মারতে দেখলে আরও ঘাবড়ে যাবে ওরা।

সরে এল মুসা। পেছন দিক দিয়ে গিয়ে দেখি আছে নাকি।

কিন্তু পেছনে এসেও কাউকে দেখতে পেল না সে। কয়লার বাঙ্কারের ওপর গলা বাড়িয়ে রান্নাঘরের জানালা দিয়ে দেখার চেষ্টা করল। খালি। বাগানের ছাউনির পাশ ঘুরে এসে দাঁড়াল সাদা রঙ করা সুন্দর একটা ভিকটোরিয়ান সামার-হাউসের সামনে। জানালা দিয়ে ভেতরে তাকাল। কয়েকটা সাধারণ টুকিটাকি জিনিস ছাড়া মেঝেতে বিছানো রয়েছে পোকায় কাটা একটা পুরানো কার্পেট, দুটো ধুলো পড়া পুরানো ডেকচেয়ার, আর আপেল রাখার কয়েকটা কাঠের বাক্স। বাক্সগুলো খালি। বহু বছর এখানে কেউ ঢুকেছে বলে মনে হলো না।

বাগানের শিশিরে ভেজা ঘাস মাড়িয়ে হেঁটে গেল সে। বেড়ার গায়ে ঠেস দিয়ে দাঁড়াল। তাকিয়ে রইল একপাশের সবুজ তৃণভূমির দিকে। রঙবেরঙের প্রজাপতি আর বড় বড় ভোমরা উড়ে বেড়াচ্ছে ফুল থেকে ফুলে। বাটারকাপ, অক্স-আই ডেইজির ছড়াছড়ি। আর রয়েছে লম্বা, ব্রোঞ্জ রঙের এক ধরনের বুনো গুল্ম। দারুণ জায়গা! ফায়ারকে এনে ছেড়ে দিলে মন মত চরে খেতে পারবে।

হঠাৎ একটা ঝিলিক দেখতে পেল মাঠের কিনারের বনের মধ্যে। ভুরু কুঁচকে তাকিয়ে রইল সে। কিসের আলো? টর্চ? মনে হয় না। বাচ্চারা হয়তো খেলা করছে। কোন ধাতব জিনিস বা কাঁচে প্রতিফলিত হয়েছে রোদ।

ভাবনাটা মাথা থেকে দূর করে দেবার আগেই গাছপালার আড়াল থেকে বেরিয়ে এল একজন লোক। গলায় ঝোলানো জিনিসটা দূর থেকেও চিনতে পারল মুসা। দূরবীন।

একটা মুহূর্ত দাঁড়িয়ে থাকল। বোধহয় মুসাকে দেখল। তারপর আবার চলে গেল গাছের আড়ালে। দূরবীনের কাঁচে লেগে ঝিক করে উঠল রোদ।

কে লোকটা? কটেজের ওপর চোখ রাখছিল কেন? ভাবতে ভাবতে কটেজের পাশ ঘুরে সামনের দিকে এগোল মুসা।

সিঁড়িতে দাঁড়িয়ে কথা বলছেন মিস্টার সেভারন। মুসাকে দেখেই চিৎকার করে উঠলেন, অ্যাই, ছেলে, কে তুমি?

ও মুসা, মিস্টার সেভারন, তাড়াতাড়ি পরিচয় দিল কিশোর। আমাদের সঙ্গেই এসেছে। সামনের দরজায় সাড়া না পেয়ে পেছন দিক দিয়ে দেখতে গিয়েছিল।

ও, তুমিই মুসা। ধূসর চুলে আঙুল চালালেন তিনি। তিনজনেই এসেছ জানতাম না…

হেসে হাত বাড়িয়ে দিল মুসা। মিস্টার সেভরনের হাতটা ধরে রেখে চোখের ইশারায় চারপাশটা দেখিয়ে বলল, খুব সুন্দর জায়গা। ঘোড়দৌড়ের প্র্যাকটিস করার জন্যে এরচেয়ে ভাল আর হয় না।

মুসার হাতটা ছেড়ে দিয়ে মাথা ঝাঁকালেন মিস্টার সেভারন। হ্যাঁ। তবে ওখানে যেতে হলে, তৃণভূমিটা দেখিয়ে বললেন, আমার জায়গার ওপর দিয়ে ছাড়া যেতে পারবে না। ঘোড়া চলাচলের একটা রাস্তা আছে বনের ভেতর দিয়ে। রাইডিং স্কুলের ছেলেরা মাঝে মাঝেই আসে এখানে ঘোড়ায় চড়া প্র্যাকটিস করতে। মুসার দিকে তাকিয়ে ভুরু নাচালেন তিনি, ঘোড়ায় চড়তে ভাল লাগে মনে হয় তোমার?

মাথা ঝাঁকাল মুসা, লাগে। আমার নিজেরই একটা ঘোড়া আছে।

তাহলে তো ভালই। প্র্যাকটিস করতে ইচ্ছে হলে চলে এসো যে কোন সময়। আগাম অনুমতি দিয়ে রাখলাম।

থ্যাংকিউ, মিস্টার সেভারন।

চলো, রাস্তাটা দেখিয়ে আনি তোমাকে।…দাঁড়াও, এক মিনিট, আমার ছড়িটা নিয়ে আসি।…কিশোর, রবিন, তোমরা ঘরে গিয়ে বসো, আমার স্ত্রীর সঙ্গে কথা বলো। কথা বলার মানুষ পেলে খুশি হবে ও, তোমাদের মত শ্রোতা পেলে। …কাল রাতের ঘটনাটা খুব রসিয়ে রসিয়ে বলতে পারবে।

কাল রাতে আবার কি ঘটল আগ্রহী হয়ে উঠল কিশোর।

 সেটা তার কাছেই শুনো।

ছড়ি নিতে ঘরে ঢুকলেন মিস্টার সেভারন।

মুসার সঙ্গে বাগানের দিকে কিছুদূর এগিয়ে গেল কিশোর। সামার হাউসটা দেখে বলল, বাহ, খুব সুন্দর ভো। কাছে গিয়ে জানালা দিয়ে ভেতরে। তাকাল। কিন্তু কেউ থাকে বলে তো মনে হয় না।

কথাটা যেন মুসার কানেই গেল না। কিশোরের বাহু চেপে ধরল, কিশোর, একটা ঘটনা ঘটে গেছে।

কি?

বনের মধ্যে একটা লোক…

মানে?

কটেজের ওপর চোখ রাখছিল।

 ভ্রূকুটি করল কিশোর। তুমি শিওর?

হ্যাঁ। গলায় ঝোলানো একটা দূরবীন। আমাকে দেখেই লুকিয়ে পড়ল। সন্দেহ হলো সেজন্যেই।

কেমন দেখতে?

মাথা নাড়ল মুসা, মুখ দেখিনি। লোকটা বেশ লম্বা। মাথায় চওড়া কানাওয়ালা নরম হ্যাট। ওর কাজকারবার মোটেও ভাল লাগেনি আমার।

নিচের ঠোঁট কামড়াল কিশোর। হু! হাঁটতে গেলে এখন সাবধান থাকবে। বুঝতে পারছি না, সেভারনদের বাড়ির ওপর নজর রাখতে যাবে কে! তবে যদি রেখে থাকে, কোন কারণ নিশ্চয় আছে। তারমানে সেভারনদের যারা বন্ধু, তারা লোকটার শত্রু। আমাদের জন্যে বিপজ্জনক হয়ে উঠতে পারে। চোখকান খোলা রেখো।…ওই যে, মিস্টার সেভারন বেরিয়েছেন। তোমরা। যাও। আমি আর রবিন মিসেস সেভারনের সঙ্গে কথা বলিগে। শুনি, কাল রাতে কি ঘটেছে।

.

০৩.

কটেজের সামনের ঘরে রবিনকে বসতে দিলেন মিসেস সেভারন।

চাটা আমিই বানিয়ে নিয়ে আসি, মিসেস সেভারন, প্রস্তাব দিল রবিন।

রাজি হলেন না মিসেস সেভারন, না, আমিই পারব। অত দুর্বল ভেবো না। আমাকে। তোমরা আরাম করে বসো।

রান্নাঘরে চলে গেলেন তিনি।

কিন্তু বসে থাকতে ভাল লাগল না রবিনের। উঠে ম্যানটলপীসের দিকে এগিয়ে গেল জ্যাকি সেভারনের ছবিটা দেখার জন্যে। পর্দা টানা থাকায় ঘরে আলো কম। ভাল করে দেখার জন্যে নামিয়ে আনতে গেল। কাত হয়ে কার্ডবোর্ডের মাউন্ট থেকে খসে পড়ে গেল ওটা। তাড়াতাড়ি তুলে নিল আবার। আড়চোখে রান্নাঘরের দরজার দিকে তাকিয়ে বোঝার চেষ্টা করল মিসেস সেভারন দেখে ফেললেন কিনা।

ছবিটা আবার মাউন্টে ঢোকাতে গিয়ে ছবির নিচে প্রিন্ট করা তারিখটা চোখে পড়ল ওর। গত বছরের তারিখ : ১০ আগস্ট।

ঘরে ঢুকল কিশোর।

 ছবি রেখে তার কাছে সরে এল রবিন।

 মুসা কি দেখেছে, রবিনকে জানাল কিশোর।

 সাবধান করে দিলে না ওকে? দূরবীনধারী লোকটার কথা শুনে চিন্তিত হলো রবিন।

করেছি।

জানালার কাছে গিয়ে দাঁড়াল কিশোর। পর্দা ফাঁক করে তাকাল। মাঠের কিনারে পৌঁছে গেছে মুসা আর মিস্টার সেভারন। নিচু হয়ে একটা ঘাসের ডগা ছিঁড়ে নিয়ে দাতে কাটল মুসা। হাত নেড়ে তৃণভূমির অন্যপ্রান্তে কি যেন তাকে দেখাতে চাইছেন মিস্টার সেভারন।

গলাটাকে বকের মত পাশে লম্বা করে দিয়েও কিছু দেখতে পেল না কিশোর। বাইরে না গেলে দেখা যাবে না। হতাশ ভঙ্গিতে ফোঁস করে নিঃশ্বাস ফেলল সে।

ট্রে হাতে ঘরে ঢুকলেন মিসেস সেভারন। তাঁকে সাহায্য করতে উঠে গেল রবিন।

আগের দিনের সোফাটায় বসল কিশোর। এক কাপ চা এগিয়ে দিল রবিন। কফি টেবিলটায় সেটা রাখতে গিয়ে গোটা তিনেক চিঠি চোখে পড়ল কিশোরের। একটাতে সেই বিচিত্র লোগো ছাপ মারা। বাকি দুটোতে ডাক বিভাগের সীল দেখে বোঝা যায় লস অ্যাঞ্জেলেস থেকে এসেছে। ঠিকানায় মিসেস সেভারনের নাম। পেঁচানো হাতের লেখা।

হাত বাড়িয়ে একটা চিঠি তুলে নিতে গিয়েও থেমে গেল কিশোর। ন্টঅন্যের চিঠি দেখা ঠিক না। মিসেস সেভারন কিছু মনে করতে পারেন।

চায়ের কাপে চুমুক দিল সে। মুখ তুলে তাকাল বৃদ্ধার দিকে। কাল রাতে নাকি কি ঘটেছে, মিসেস সেভারন?

হ্যাঁ

শোনার জন্যে মনে মনে অস্থির হয়ে উঠেছে কিশোর। বলুন না, শুনি।

.

লম্বা ঘাস মাড়িয়ে তখন বনের কাছে পৌঁছে গেছে মুসা আর মিস্টার সেভারন। ঢুকে পড়ল বনের মধ্যে। রাস্তাটা দেখতে পেল মুসা। পুরানো ওকের জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে এঁকেবেঁকে এগিয়ে গিয়ে বেরিয়েছে একটা খোলা জায়গায়। পায়ের নিচে কার্পেটের মত বিছিয়ে আছে ঝরা পাতা।

কাটতে না কাটতে রাস্তায় উঠে আসে কাঁটালতা, দুদিনও যায় না, মিস্টার সেভারন বললেন। ছাত্ররাই কেটে কেটে পরিষ্কার করে রাখে।

কোন ঝোপের মধ্যে লুকিয়ে থেকে কুহু-কুহু করে উঠছে একটা কোকিল। ওটার মিষ্টি স্বরের সঙ্গে পাল্লা দিয়েই যেন কর্কশ স্বরে প্রতিবাদ জানাচ্ছে ওকের ডালে বসা একটা দাঁড়কাক।

মিস্টার সেভারন জানালেন বহু শত বছর ধরে আছে এখানে বনটা।

দারুণ জায়গা! ঘোড়া নিয়ে সত্যি আসতে পারব তো? কোন অসুবিধে হবে না?

না, হবে না। যখন খুশি চলে এসো।

অদ্ভুত এই বনটার ভেতর দিয়ে ঘোড়া ছোটাতে কেমন লাগবে ভাবতেও রোমাঞ্চিত হলো মুসা।

মিস্টার সেভারন বলে চলেছেন, এই এলাকার সবচেয়ে পুরানো বন এটা। লোকে এখনও বেড়াতে এসে মজা পায় এখানে। তবে কদ্দিন পাবে আর জানি না। যে হারে কাটাকাটি শুরু হয়েছে…আমি যখন যুবক ছিলাম, তখনও অনেক বড় ছিল ওই বন। মাঠের ওপাশটাতেও ঘন বন ছিল। সব তো কেটে সাফ করেছে।

ওই যে নতুন স্পোর্টস সেন্টার আর শপিং সেন্টার খুলেছে ওটার কথা বলছেন?

হ্যাঁ, বিষণ্ণ হয়ে গেল মিস্টার সেভারনের দৃষ্টি। আর কিছুদিন পর খোলা জায়গা বলতে কিছু থাকবে না। সব বাড়িঘর দিয়ে ভরে ফেলবে।

গাছপালার ফাঁক দিয়ে একটা সরু রাস্তা চোখে পড়ছে। তাতে একটা সাদা রঙের ভ্যানগাড়ি দাঁড়িয়ে থাকতে দেখল মুসা।

কার গাড়ি? মিস্টার সেভারনও দেখেছেন। এ রকম জায়গায় তো গাড়ি পার্ক করে না কেউ।

একটু আগে একটা লোককে দেখেছি আমি। দূরবীন দিয়ে আপনাদের বাড়ির ওপর চোখ রাখছিল।

থমকে দাঁড়ালেন মিস্টার সেভারন। কি বলছ! চলো চলো, ফিরে যাই। মিসেস সেভারনকে একা ফেলে এসেছি!

তার উদ্বেগ দেখে অবাক হলো মুসা। একা কোথায়? কিশোর আর রবিন আছে। কেউ কিছু করতে পারবে না তার।

মুসার কথা শেষও হলো না, বনের মধ্যে গুলির শব্দ হলো। লাফিয়ে উঠল মুসা। এত কাছে কে গুলি করছে? শব্দ লক্ষ করে সে ঘুরতেই দেখতে পেল লোকটাকে। চোখের পলকে গাছের আড়ালে লুকিয়ে পড়ল ছায়ার মত।

এখানে কি শিকারের অনুমতি আছে? জানতে চাইল সে।

মাথা নাড়লেন মিস্টার সেভারন। ভুরু কোচকালেন। না। কে গুলি ছুড়ছে বুঝতে পারছি না। ওই ভ্যানে করেই এসেছে মনে হচ্ছে। ভ্যানের ছাতে চড়ে বেড়া ডিঙানো সম্ভব।

আবার গুলির শব্দ। হাই ভেলোসিটি শটগান থেকে ছোঁড়া হচ্ছে। অতিরিক্ত কাছে।

ভয় লাগছে মুসার। এখানে থাকাটা নিরাপদ মনে হচ্ছে না আমার। কোন্ সময় এসে গায়ে লাগে!

গাছের ফাঁকে আবার ছায়ামূর্তিটাকে চোখে পড়ল মুসার। কাঁটাঝোপের কাছে বাঁকা হয়ে দাঁড়িয়ে এদিকেই তাকিয়ে আছে। হাতের বন্দুকের নল এদিকে ফেরানো।

সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে কাঁধে বন্দুকের বাঁট ঠেকিয়ে নিশানা করল লোকটা।

মিস্টার সেভারনের হাত ধরে টান দিল মুসা, চলুন। লোকটার ভাবসাব সুবিধের লাগছে না আমার।

তৃতীয়বার গুলির শব্দ হলো। ওদের মাথার ওপরের ডালে ছরছর করে এসে লাগল ছররা। ঝট করে মাথা নিচু করে ফেলল দুজনে।

পাখি তো কই, উড়ছে না, ফিসফিস করে বলল মুসা। আমাদেরকেই নিশানা করছে না তো?

হাতটা ধরে রেখেই বুঝতে পারছে সে, মিস্টার সেভারন কাঁপতে শুরু করেছেন। মাথা নেড়ে কম্পিত গলায় বললেন, মনে হয় না!

চুপ করে থাকুন। তাহলে ও মনে করবে আমরা চলে গেছি। হয়তো আর গুলি করবে না।

ঝোপের মধ্যে ঘাপটি মেরে বসে রইল দুজনে। বুকের মধ্যে টিপ টিপ করছে মুসার হৃৎপিণ্ডটা। ভয় হতে লাগল, সেই শব্দও শুনে ফেলবে লোকটা। ঝোপঝাড় ভেঙে কে যেন এগিয়ে আসতে লাগল।

ওদের ঝোপটার কাছে এসে দাঁড়াল একজোড়া বুট। পা ফাঁক করে দাঁড়াল। পায়ের সামনে তেরছা ভাবে এসে পড়েছে সূর্যরশ্মি। পকেট থেকে আরও দুটো কার্তুজ বের করে বন্দুকে ভরল সে। ধীরে ধীরে বন্দুক তুলে। নিশানা করল ওদের দিকে।

.

০৪.

দম আটকে ফেলল মুসা। চারপাশটা বড় বেশি নীরব। পাতার ফাঁক দিয়ে তাকাল আবার লোকটার দিকে। এদিক ওদিক তাকাচ্ছে। খুজছে কাউকে।

 একটা পাথর তুলে নিয়ে ছুঁড়ে মারল মুসা। গাছের গায়ে লেগে ঝোপের মধ্যে গড়িয়ে পড়ল পাথরটা।

আবার ঝোপঝাড় ভেঙে সেদিকে ছুটল লোকটা। কাঁটাঝোপে পা বেধে হুমড়ি খেয়ে পড়ে গেল। চাপা গোঙানি শোনা গেল। হাঁচড়ে-পাঁচড়ে উঠে আবার দিল দৌড়।

লাফ দিয়ে উঠে দাঁড়িয়ে মিস্টার সেভারনকে হাত ধরে টেনে তুলল মুসা। যে পথে এসেছিল, তাঁকে নিয়ে সেই পথটা ধরে ছুটল কটেজের দিকে। ঝোপের ধারে দুটো কার্তুজের খোসা পড়ে থাকতে দেখে কুড়িয়ে নিল। এখনও গরম। পরে ভাল করে দেখবে ভেবে ঢুকিয়ে রাখল জিনসের পকেটে।

মিস্টার সেভারন, পুলিশকে জানানো দরকার এখনই। ওই লোকটা পাগল।

মুসাকে অবাক করে দিয়ে মাথা নাড়লেন মিস্টার সেভারন। না। আমি পুলিশের কাছে যাব না।

কিন্তু আরেকটু হলেই আমাদের খুন করে ফেলেছিল! ঘোড়ায় চড়ে আসাটা তো এখানে বিপজ্জনক। গুলির শব্দে ভয় পেয়ে গেলে পিঠ থেকে সওয়ারী উল্টে ফেলে পালানোর চেষ্টা করবে ঘোড়া। মারাত্মক অ্যাক্সিডেন্ট ঘটাবে। লোকটা ভীষণ বিপজ্জনক।

তার পরেও পুলিশের কাছে যেতে রাজি হলেন না মিস্টার সেভারন। জ্যাকেটে লেগে থাকা শুকনো পাতা ঝেড়ে ফেলে বললেন, লোকটা চলে গেছে এতক্ষণে। আমার ধারণা, ভুল করেছে সে। হরিণ-টরিণ বা ভালুক ভেবে আমাদের গুলি করেছে।

তাহলেও মস্ত অপরাধ করেছে সে, কারণ এখানে শিকার করা বেআইনী। তার ভুলের জন্যে মারাত্মক জখম হতে পারতাম আমরা। এ ভাবে যেখানে সেখানে গুলি চালানোর জন্যে তো আগ্নেয়াস্ত্রের লাইসেন্স দেয়া হয় না। পুলিশকে না জানালে এখন সেটা আমাদের অপরাধ বলে গণ্য হবে।

বন থেকে বেরিয়ে দেখল ওদের দিকে দৌড়ে আসছে রবিন।

কি হয়েছে? দূর থেকেই চেঁচিয়ে জিজ্ঞেস করল সে। গুলির শব্দ শুনলাম।

একটা উন্মাদ আমাদের ভয় দেখানোর চেষ্টা করছিল, জবাব দিল মুসা।

 কেন? কাছে চলে এসেছে রবিন।

ভুল করেছে, মুসাকে কথা বলতে দিলেন না মিস্টার সেভারন। শটগান থেকে গুলি ছোঁড়ার প্র্যাকটিস করছিল বোধহয়। দুই আঙুলে টিপে ধরে কাপড় থেকে আরেকটা পাতা তুলে ফেলে দিলেন তিনি। কোন ক্ষতি হয়নি আমাদের।

অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে মুসা। ঘটনাটাকে দুর্ঘটনা বলে চালাতে চাইছেন মিস্টার সেভারন।

ছড়িতে ভর দিয়ে দিয়ে দ্রুত বাড়ির দিকে এগিয়ে চললেন তিনি।

রবিনের হাত চেপে ধরল মুসা, রবিন, একটা লোক সত্যি সত্যি আমাদের ভয় দেখাতে চেয়েছিল।

তোমাকে নয় নিশ্চয়; ভয়টা আসলে দেখাতে চেয়েছে মিস্টার সেভারনকে, চিন্তিত ভঙ্গিতে তাঁর দিকে তাকিয়ে আছে রবিন। এমনিতেই তো যথেষ্ট ভয়ের মধ্যে আছেন তাঁরা, আর কত?

সব শুনে মুখ ফ্যাকাসে হয়ে গেল মিসেস সেভারনের।

আরও যে কত কি ঘটবে খোদাই জানে! দুই হাতে মাথা চেপে ধরলেন। তিনি। কাল রাতে এ রকম একটা ব্যাপার…তারপর এখন এই! টিকতে দেবে না।

কাল রাতে কি হয়েছিল? জানতে চাইল মুসা।

ভূতের উপদ্রব আছে যে ঘরটায়, জবাব দিল কিশোর, সেটাতে নাকি অদ্ভুত শব্দ শুনতে পেয়েছেন মিসেস সেভারন।

ভয়ানক শব্দ! মিসেস সেভারন বললেন। মনে হলো নাকি স্বরে কাঁদছে কেউ, তারপর আবার খিলখিল করে হাসছে। ইনিয়ে বিনিয়ে কি সব বলছে।

জিনিসপত্রও নাকি তছনছ করেছে, কিশোর বলল।

ছায়ামূর্তিটার কথা বাদ দিচ্ছ কেন? রবিন বলল।

স্ত্রীর দিকে তাকিয়ে অধৈর্য কণ্ঠে বললেন মিস্টার সেভারন, তারমানে বলে দিয়েছ ওদের! এ সব অতি কল্পনা…

না, কল্পনা নয়, রেগে উঠলেন মিসেস সেভারন, আমি দেখেছি ওটাকে! কোন ভুল ছিল না। ফিনফিনে পোশাক পরা কুয়াশার মত একটা ধূসর মূর্তি হালকা পায়ে ছুটে গেল লনের ওপর দিয়ে।

বোঝানোর চেষ্টা করলেন মিস্টার সেভারন, দেখো, কুয়াশার মধ্যে চাঁদের আলোয় অদ্ভুত সব আকৃতি তৈরি হয়, বাতাসে কুয়াশা উড়ে বেড়ানোর সময় মনে হয় মানুষ হাটছে…

জোরে জোরে মাথা নেড়ে মিসেস সেভারন বললেন, না, আমি যা দেখেছি ঠিকই দেখেছি। চাঁদের আলোয় কুয়াশায় কি হয় না হয় জানা আছে। আমার।

স্বামী-স্ত্রীর তর্কটা বন্ধ করার জন্যে কিশোর বলল, ঘরটা আমাদের দেখাবেন বলেছিলেন?

তা তো দেখাবই। নিশ্চয় দেখাব, মিসেস বললেন। তোমরা গোয়েন্দা। দেখো, কিছু বুঝতে পারো নাকি।

ওদের নিয়ে চললেন তিনি। ভূতুড়ে ঘরটা রয়েছে বাড়ির পেছন দিকে, রান্নাঘরের পরে।

বাড়ির সবচেয়ে পুরানো অংশ এটা, সঙ্গে সঙ্গে এসেছেন মিস্টার সেভারন। স্থানীয় একজন মিস্ত্রি বানিয়ে দিয়ে গিয়েছিল, মিস্টার জারভিস যখন থাকতেন। আমাদের আগের মালিক মিস্টার জারভিস, তাঁর কাছ থেকেই বাড়িটা কিনেছি। পেছনের এই দিকটা তেমন ব্যবহার করি না আমরা। জ্যাকি এ ঘরটাকে তার স্টাডি বানিয়েছিল। এখানকার জিনিসপত্র বেশির ভাগই তার। কিন্তু… থেমে গেলেন তিনি। তারপর বললেন, ভূত নিয়ে মাথাব্যথা ছিল না তার।

দরজা খুললেন মিসেস। সঙ্গে সঙ্গে এক ঝলক ঠাণ্ডা বাতাস এসে লাগল গোয়েন্দাদের গায়ে। শীতের বাতাসের মত।

খাইছে! চমকে গেল মুসা। কিশোরের হাত খামচে ধরল।

হাতটা ছাড়িয়ে নিল কিশোর। ভয় পাচ্ছ?

নীরবে মাথা নাড়ল মুসা।

এ ঘরে আসতে আমার ভাল লাগে না, কেঁপে উঠলেন মিসেস সেভারন। গায়ে কাঁটা দিল মনে হলো। জ্যাকি চলে যাওয়ার পর এটাকে সেলাইয়ের ঘর বানিয়েছিলাম আমি। কিন্তু এমন ঠাণ্ডার ঠাণ্ডা, হাড়ের মধ্যে ব্যথা শুরু হয়ে যায় আমার।

সাবধানে ঘরে পা রাখল তিন গোয়েন্দা। কেঁপে উঠল কিশোর। তার টি শার্ট আর সুতির প্যান্ট ঠাণ্ডা ঠেকাতে পারছে না। বাইরে কড়া রোদ থাকা সত্ত্বেও ঘরটার মধ্যে ডিসেম্বরের বিকেলের মত ঠাণ্ডা।

বাপরে! সত্যি ঠাণ্ডা! রবিন বলল।

রোদ লাগে না কোন দিক দিয়ে, মিস্টার সেভারন বললেন। ঘরের মধ্যে নেই কোন ধরনের হীটিং সিসটেম। শীতকালে যে আর্দ্রতা ঢেকে, সেটা আর বেরোতে পারে না। সারা বছর সেঁতসেঁতে হয়ে থাকে। গরম হবে। কোত্থেকে।

আগুন জ্বেলেও গরম করার চেষ্টা করে দেখেছি, মিসেস বললেন। কাজ হয়নি। যে ঠাণ্ডা সেই ঠাণ্ডা।

নিচে একটা পুরানো সেলার আছে, মিস্টার সেভারন বললেন। সেটাতে আছে চিমনি। সেই চিমনি দিয়ে নিচের ঠাণ্ডা ওপরে উঠে আসে।

আগের মালিক কিছু জিনিসপত্র ফেলে গেছেন, হাত তুলে দেখালেন মিসেস সেভারন। ওই যে কার্পেটটা, ওটা ছিল তাদের। নতুন বাড়ি করে চলে গেছেন, তাতে এ জিনিস মানাবে না-বেশি পুরানো আমলের, তাই ফেলে গেছেন। আর ওই বুকশেলফটাও…

 কিশোর দেখল, মেঝেতে ছড়িয়ে পড়ে আছে কতগুলো বই। দেয়াল থেকে খুলে পড়েছে একটা ছবি। কেউ ফেলে দিয়েছে মনে হচ্ছে। পুরানো কার্পেটটা মেঝের বেশির ভাগ অংশই ঢেকে রেখেছে, জায়গায় জায়গায় দুমড়ানো। টেনে সোজা করে দেয়ার জন্যে নিচু হলো সে।

অবাক কাণ্ড! কিশোরকে দোমড়ানো জায়গাগুলো সমান করতে দেখে মিসেস সেভারন বললেন, আমি তো ভেবেছিলাম, ওটা, পেরেক দিয়ে লাগানো। সোজা হবে না। কুঁচকালও, সোজাও হচ্ছে আবার।

মেঝেতে পড়ে থাকা জিনিসগুলো তুলে সেলাইয়ের জিনিসপত্র রাখার বাক্সে রাখল রবিন। কিশোরকে সাহায্য করার জন্যে কার্পেটের একদিক ধরে টান দিল। নড়ল না। মেঝের তক্তার সঙ্গে আটকানো রয়েছে এদিকটা। বাক্সটা দিল মিসেস সেভানের হাতে।

গির্জায় যারা বিয়ে করতে আসে, তাদের পোশাক বানাতাম আমি, মিসেস সেভারন বললেন। এখন আর পারি না। কাজ করতে গেলেই আঙুল কেমন আঁকড়ে আসে।

আশ্চর্য! ঘরের মধ্যে ঘুরতে ঘুরতে বলল কিশোর। দেয়ালের কাঠের রঙ গাঢ় বাদামী। চেহারাটা কেমন বিষণ করে দিয়েছে ঘরটার। দেখলে অবশ্য ভূতুড়েই মনে হয়।

তুমি বলছ এ কথা! নিজের কানকে বিশ্বাস করতে পারছে না মুসা।

ভূতুড়ে লাগলেই যে ভূত থাকতে হবে এমন কোন কথা নেই।

ভূতুড়ের মানে কি তাহলে?

 জবাব দিল না কিশোর।

জানালার কাছে একটা চেয়ারে বসে পড়লেন মিস্টার সেভারন। মিসেস দলে ভারী হয়ে যাচ্ছেন দেখে যেন হতাশ হয়েছেন।

আপনি বিশ্বাস করেন না এ সব? জিজ্ঞেস করল কিশোর।

না, মাথা নাড়লেন মিস্টার সেভারন।

 মেঝেতে জিনিসপত্র ছড়িয়ে পড়ল কি করে? কেউ তো নিশ্চয় ফেলেছে।

তার হয়ে জবাবটা দিয়ে দিল রবিন, ভূমিকম্পেও পড়তে পারে। ক্যালিফোর্নিয়ায় তো আর ভূমিকম্পের অভাব হয় না, যখন তখন কেপে ওঠে মাটি।

তাহলে বাকি ঘরগুলোর জিনিস মাটিতে পড়ল না কেন? প্রশ্ন করলেন মিসেস সেভারন।

শুকনো হাসি হাসলেন মিস্টার সেভারন। বিশ্বাসই যখন করো, আসল কথাটাই বলে দাও ওদের।

আসল কথা? ভুরু কুঁচকাল কিশোর। জোয়ালিন।

জোয়ালিন!

পরস্পরের দিকে তাকাতে লাগল তিন গোয়েন্দা। মিস্টার সেভারনকে জিজ্ঞেস করল কিশোর, জোয়ালিনটা কে?

এক এক করে তিনজনের দিকে তাকালেন মিস্টার সেভারন। লম্বা দম ছাড়লেন। তারপর বললেন, ভূত!

.

০৫.

আবার দৃষ্টি বিনিময় করল গোয়েন্দারা।

মুসা ভাবছে, সত্যি সত্যি তাহলে বাড়িটাতে ভূতের উপদ্রব আছে! একটা মেয়ের ভূত রাত দুপুরে সত্যি ঘুরে বেড়ায় বাড়িময়।

ওদের দিকে তাকিয়ে কোনমতে মুখে হাসি ফোঁটালেন মিসেস সেভারন। তারপর ফিরলেন স্বামীর দিকে। গল্পটা শুনিয়েই দাও না ওদের।

চেয়ারে হেলান দিলেন মিস্টার সেভারন। এই কটেজটা এক সময় অনেক বড় ছিল। আঠারোশো শতকে তৈরি করা একটা দুর্গের অংশ এটা। এই ঘরটা ছিল বিশাল ডাইনিং রূমের অংশ। মালিক ছিল ওয়ারনার নামে এক ধনী লোক। ওদের একমাত্র মেয়ে জোয়ালিন। অপূর্ব সুন্দরী। জন্মেছিল নববর্ষের দিনে। মা-বাবার চোখের মণি।

ভূতে ধরল কি করে তাকে? ফিসফিস করে বলল মুসা। ভয়ও পাচ্ছে, কৌতূহলও দমন করতে পারছে না।

শোনোই না! রবিন বলল।

এক জিপসি যুবকের প্রেমে পড়েছিল সে, মিস্টার সেভারন বললেন।

চেপে রাখা দুমটা আস্তে করে ছাড়ল রবিন। বাহ বেশ রোমান্টিক তো!

গুঙিয়ে উঠল মুসা। রোমান্টিক দেখলে কোথায়? এ তো ডবল ভূতের আলামত!

মিস্টার সেভারন বললেন, তার বাবার ধারণা ছিল, ওদের টাকা-পয়সা দেখেই মেয়ের দিকে হাত বাড়িয়েছে যুবক। ওসবের লোভে। তা ছাড়া সামান্য এক জিপসি যুবককেও পছন্দ করতে পারছিল না সে। অনেক বুঝিয়ে-শুনিয়েও মেয়েকে ফেরাতে না পেরে শেষে ঘরে তালা দিয়ে রাখল।

সেই পুরানো কাহিনী! কিড়বিড় করল কিশোর। বড়লোক বাপ তার মেয়েকে কোনমতেই এক ছন্নছাড়ার হাতে তুলে দিতে চায় না। অতএব দুর্ঘটনা! তাই তো?

মাথা ঝাঁকালেন মিস্টার সেভারন। বাপের ওপর অভিমান করে মেয়ে কোন খাবারই স্পর্শ করল না; না খেয়ে খেয়ে মারা গেল।

 এই ঘরের মধ্যে! আঁতকে উঠল মুসা। চারপাশে তাকাতে লাগল এমন ভঙ্গিতে, যেন এখনই ভূতটা বেরিয়ে এসে ঘাড়ে চাপবে ওর।

না, এখানে না, অন্য আরেকটা ঘরে; বহু আগেই আগুনে পুড়ে ছারখার হয়ে গেছে ওটা। দুর্গে আগুন লেগেছিল। তবে, এ ঘরে না মরলেও, ওদের দিকে তাকিয়ে নাটকীয় ভঙ্গিতে হেসে বললেন মিস্টার সেভারন, এখানে রাতের বেলা চুরি করে জোয়ালিনের সঙ্গে দেখা করতে আসত যুবক।

খাইছে! মুসার ভঙ্গি দেখে মনে হলো সময় থাকতে উঠে চলে যাবে। কিনা ভাবছে।

জোয়ালিনের আর কোন ভাই-বোন ছিল না। তার মৃত্যুর পর খুব বেশিদিন আর বাঁচেনি তার বাবা-মা। পুরো পরিবারটাই নিশ্চিহ্ন হয়ে গেল। লোকে বলে, জোয়ালিন এখনও তার প্রেমিকের অপেক্ষায় আছে। রাতের বেলা নাকি বেরিয়ে পড়ে তারই খোঁজে।

গল্প শেষ হওয়ার পরে দীর্ঘ একটা মুহূর্ত চুপ করে রইল তিন গোয়েন্দা।

ঘোরের মধ্যে থেকে যেন বলে উঠল রবিন, বেচারি!

কি সব মানুষ! বিরক্ত হয়ে বলল মুসা, খাবার নিয়ে আবার কেউ গোসসা করে নাকি? মরার যেন আর কোন উপায় খুঁজে পেল না!

না খেয়েই নাহয় মরল, মিস্টার সেভারন বললেন, কিন্তু তাতেই কি ভূত হয়ে যেতে হবে নাকি? আসলে এ রকম ইমোশনাল গল্প ভালবাসে লোকে, সেজন্যেই তৈরি করে।

তবে, কিশোর বলল, মিসেস সেভারন যদি রাতের বেলা কিছু দেখেই থাকেন, তার কোন একটা বাস্তব ব্যাখ্যা নিশ্চয় রয়েছে।

রবিন বলল, আপনাদের কেউ ভয় দেখাতে চেয়েছে।

চট করে পরস্পরের চোখের দিকে দৃষ্টি চলে গেল বুড়ো-বুড়ির, কিশোরের চোখ এড়াল না সেটা।

এস্টেট থেকে আসা পোলাপানগুলো হতে পারে, মিস্টার সেভারন বললেন। ওদেরকে এদিকে ঘোরাফেরা করতে দেখেছি আমি। নিশ্চয় ভূতের গুজবটা ওরা শুনেছে। রাতে ভয় দেখাতে এসেছে আমাদের।

মেঝেতে পড়ে থাকা একটা বই তুলে নিল কিশোর। মলাট ওল্টাল। সাদা পাতাটায় পেঁচানো অক্ষরে লেখা রয়েছে একটা নাম-জ্যাকুয়েল সেভারন। চিঠির ঠিকানার হাতের লেখা আর এই লেখার সঙ্গে মিল রয়েছে। অন্যমনস্ক ভঙ্গিতে মাথা দুলিয়ে বলল, তারমানে ওরা ভাল ছেলে না। ভাল হলে রাতের বেলা অন্যের বাড়িতে ঢুকে ভয় দেখানোর চেষ্টা করত না। ওরা আরও খারাপ কিছু করতে পারে। চুরিদারি, কিংবা যা খুশি। সাবধান থাকতে হবে আপনাদের। জানালায়ও তালা লাগাতে হবে। পুরানো আমলে তৈরি এ সব জানালা সহজেই বাইরে থেকে খুলে ফেলা যায়।

হ্যাঁ, কিশোরের সঙ্গে একমত হলেন মিস্টার সেভারন।

ঘর দেখা হয়েছে। সারি বেধে বেরোনোর সময় জিজ্ঞেস করল কিশোর, গুজবটা কি সবাই জানে নাকি এদিকের?।

জানে, মাথা আঁকালেন মিস্টার সেভারন। আগের মালিক তো তার বাড়িতে যে ভূত আছে এটা নিয়ে গর্বই করত। আমরা বাড়িটা কেনার আগে জ্যাকি যখন দেখতে এসেছিল, সব বলেছিল তাকে জারভিস। জ্যাকি গিয়ে সবখানে গপ মেরে ছড়িয়েছে, তার বাবা একটা ভূতুড়ে বাড়ি কিনতে যাচ্ছে। বলেছে হয়তো মজা করার জন্যেই, কিন্তু…।

এই সময় বাড়ির বাইরে থেকে ডাক দিল কে যেন। জানালার পর্দা সরাতে দেখা গেল ডাক পিয়ন। দরজার নিচ দিয়ে কয়েকটা চিঠি ঠেলে দিয়ে চলে গেল সে।

তুলে নিলেন মিস্টার সেভারন। ঠিকানাগুলো পড়তে লাগলেন। উদ্বিগ্ন মনে হলো তাকে।

কৌতূহলী হয়ে গলা বাড়িয়ে দিল কিশোর। একটা চিঠিতে দেখল সেই একই রকম লোগো। এস আর এইচ অক্ষর দুটো একটার সঙ্গে আরেকটা পেঁচিয়ে লিখে তৈরি করা হয়েছে লোগোটা।

ওদের চিঠিও আছে?

কাদের চিঠি, নামটা ইচ্ছে করেই যেন চেপে গেলেন মিসেস সেভারন।

মিস্টার সেভারনও একই রকম চেপে যাওয়া ভঙ্গিতে মাথা নেড়ে গম্ভীর স্বরে বললেন, হ্যাঁ।

চিঠিগুলো হলের টেবিলে রেখে দিলেন তিনি।

ও আমাদের ছাড়বে না! বিড়বিড় করে বললেন মিসেস সেভারন।

.

দরজার বাইরে দাঁড়িয়ে তিন গোয়েন্দাকে বিদায় জানালেন দুজনে।

রাস্তা দিয়ে কয়েকশো গজ এসে দাঁড়িয়ে গেল কিশোর। সাইকেল থেকে নেমে সাইকেলটা ঠেস দিয়ে রাখল একটা দেয়ালে। দুই সহকারীকে জিজ্ঞেস করল, তারপর? কে কি সূত্র পেলে?

আমি পেয়েছি, রাগত স্বরে বলল মুসা, একটা খুনীকে! বনের মধ্যে। আরেকটু হলেই ফুটো করে দিয়েছিল আমাকে। পকেট থেকে কার্তুজের ন্টখোসা দুটো বের করল মুসা। এই দেখো। তুলে নিলাম যখন, তখনও গরম ছিল।

একটা খোসা হাতে নিয়ে দেখতে দেখতে বলল কিশোর, একটু অন্য রকম।

মানে? কিশোরের হাত থেকে খোসাটা নিয়ে রবিনও দেখতে লাগল।

চাচা একবার একটা পুরানো বন্দুক কিনে এনেছিল, কয়েক বাক্স পুরানো গুলি সহ, কিশোর বলল। গুলিগুলো এ রকম ছিল। চাচা বলেছে, ঘরে বানানো গুলি ছিল ওগুলো।

কিশোরের হাতে খোসাটা ফিরিয়ে দিল রবিন। এ রকম গুলি কখনও দেখিনি আমি। কোন মন্তব্য করতে পারব না।

আমিও দেখিনি,মুসা বলল।

হু, ওর দিকে তাকাল কিশোর। একটা লোক ভয় দেখিয়ে তাড়াতে চাইল, দুটো গুলির খোসা পেলে; এ ছাড়া আর কিছু?

মাথা নাড়ল মুসা। না। লোকটার চেহারা দেখতে পারলে ভাল হত। পাতার জন্যে ওপরটা দেখা যাচ্ছিল না। কাছে এসে যখন দাঁড়াল, চোখে পড়ল শুধু গাঢ় রঙের জ্যাকেটের নিচের অংশ। জিনসের প্যান্ট ছিল পরনে। পায়ে বুট। আর দশজন সাধারণ মানুষের মত।

দূরবীন দিয়ে চোখ রাখছিল যে লোকটা, সে-ই তাহলে?

কাঁধ ঝাঁকাল মুসা, আর কে হবে।

ইস, আল্লাহ বাঁচিয়েছে! ওর কাঁধে হাত রাখল কিশোর, গুলি যে লাগেনি তোমার গায়ে! সর্বনাশ হয়ে যেত!

হ্যাঁ, আমি মারা যেতাম, কৃত্রিম গাম্ভীর্য নিয়ে বলল মুসা। এতিম হয়ে যেতে তোমরা।

হাসল কিশোর।

ওকে জিজ্ঞেস করল রবিন। তুমি কি জেনেছ?

কিছু চিঠি দেখেছি, তার মধ্যে দুটো চিঠি এসেছে কোন একটা কোম্পানি থেকে। লোগো দুটো এক। আরেকটা জিনিস অনুমান করছি-কেউ একজন। হুমকি দিচ্ছে সেভারনদের?

হুমকি; তারমানে ব্ল্যাকমেল?

জানি না। মিসেস সেভারন কি বললেন শুনলে না? ও আমাদের ছাড়বে না। এই ও-টা কে?

রবিন কোন জবাব দিতে পারল না। জিজ্ঞেস করল, লোগোটা দেখতে কেমন?

নোটবুক বের করে কলম দিয়ে তাতে এস এবং এইচ অক্ষর পেঁচিয়ে একটা ছবি আঁকল কিশোর। সেটা দেখিয়ে বলল, এই যে, এই রকম। দেখেছ কখনও?

মাথা নাড়ল রবিন।

মুসাও মাথা নেড়ে বলল, না। কি এঁকেছ, মাথামুণ্ড কিছুই বুঝতে পারছি না।

বোঝা যাবে, পরে, নোটবুকটা পকেটে রাখতে রাখতে বলল কিশোর, এ সব ছাড়াও ওবাড়িতে আছে একটা ভূতুড়ে ঘর। সারা ঘরে জিনিসপত্র ছড়িয়ে রেখে যাওয়ার ব্যাপারটা ইঙ্গিত করে, ওদের ভয় দেখাতে চাইছে কেউ। ঘরটা ভূতুড়ে হলেও কাজটা ভূতের নয়, এটা ঠিক।

জোয়ালিনের গল্প তুমি বিশ্বাস করছ না তাহলে? ভুরু কোঁচকাল মুসা।

গল্প গল্পই। তবে ঘটনা যা ঘটছে, তাতে ভূতের হাত নেই, আছে জলজ্যান্ত মানুষের হাত। কেউ ঘরে ঢুকে জিনিসপত্রগুলো ছড়িয়ে ফেলে গেছে, কোন সন্দেহ নেই আমার তাতে।

তাহলে আমাদের জানতে হবে এখন, রবিন বলল, সেই শয়তান। লোকটা কে এবং কেন এই উৎপাত করছে।

ঠিক, মুসা বলল।

কিন্তু জানা যাবে কি করে?

সেকথায় পরে আসছি। তার আগে আরেকটা কথা বলে নিই-লোগো। ছাড়াও আরও কয়েকটা চিঠি দেখেছি আমি। ঠিকানার ওপর যে রকম হাতের লেখা, জ্যাকির বইতেও একই রকম লেখা দেখেছি। তারমানে…

চিঠিগুলো জ্যাকির কাছ থেকে এসেছে। কথাটা শেষ করে দিল রবিন। উত্তেজিত মনে হলো তাকে।

মাথা ঝাঁকাল কিশোর। হ্যাঁ। পোস্টমার্কও দেখেছি। যেখান থেকে চিঠিগুলো এসেছে সেখানকার পোস্টমার্ক।

কোনখান থেকে?

লস অ্যাঞ্জেলেস।

 লস অ্যাঞ্জেলেসের কোনখান থেকে?

 তা কি করে বলব?

নিরাশ হলো রবিন। তাহলে আর লাভটা কি হলো! ঠিকানা না জানলে কিছু বের করা যাবে না।

জানব। শুরুতেই হাল ছেড়ে দিচ্ছ কেন? সবে তো তথ্য পেতে আরম্ভ করেছি আমরা।

পকেট থেকে চকলেট বের করে মোড়ক ছাড়াল মুসা। শান্ত থাকতে হলে চকলেটের বিকল্প নেই। একটা টুকরো ভেঙে রবিনকে দিল সে। আরেকটা কিশোরকে। বাকিটা নিজের মুখে ফেলে চিবাতে শুরু করল।

চকলেট মুখে দিয়ে হাসি ফুটল রবিনের মুখে।

হেসে মাথা ঝাঁকাল মুসা, দেখলে তো, মগজটা কেমন হালকা হয়ে। গেল? চকলেটের বিকল্প নেই।

চকলেট গালে ফেলে কিশোর বলল, বাড়ি যাওয়া দরকার। ওই পচা প্রবন্ধটা শেষ করে ফেলতে হবে। যত তাড়াতাড়ি ঘাড় থেকে নামানো যায় ততই মঙ্গল। হুহ, আর কাজ পেল না, পথিকদের নিয়ে প্রবন্ধ। নামটাও বাজে-ফুটপাথ এবং পথচারী!

সত্যি, মুখ বাঁকাল মুসা, পচা সাবজেক্টই। তুমি না নিলেই পারতে।

কি করব না নিয়ে যে ভাবে চাপাচাপি শুরু করল…

তা ঠিক। মিস্টার গোবরেডকে এড়ানোই মুশকিল। বাচলাম। আমি এ সব লেখালেখির মধ্যেও নেই, আমাকে গছাতেও পারবে না…

সাইকেলটা রাস্তায় এনে উঠে বসল কিশোর। রবিন আর মুসাও চড়ল যার যারটায়। এগিয়ে চলল আবার।

পথের মোড়ে হঠাৎ দেখা গেল সাদা একটা ভ্যান। টায়ারের আর্তনাদ তুলে তীব্র গতিতে ছুটে আসছে।

খাইছে! বলেই ব্রেক কষে গতি কমিয়ে ফেলল মুসা। ভ্যানটাকে দেখেছি!

কোথায়? কৌতূহলী হয়ে জানতে চাইল কিশোর।

বনের মধ্যে রাস্তায় দাঁড়িয়ে ছিল। আমি আর মিস্টার সেভারন দুজনেই দেখেছি।

সাবধান হয়ে গেল কিশোর। মুসার কথা শুনে নয়, গাড়িটাকে অস্বাভাবিক দ্রুত ছুটে আসতে দেখে। সরু রাস্তায় আরও যে যানবাহন আছে কেয়ারই করছে না যেন গাড়িটা। গতি বাড়াচ্ছে বরং। কিছু বলতে যাচ্ছিল সে, এঞ্জিনের শব্দে চাপা পড়ে গেল।

সরে যাবার চেষ্টা করল। বেধে গেল মুসার সাইকেলে। হ্যান্ডেলবারটা ছাড়িয়ে আনার জন্যে টানাটানি শুরু করল কিশোর।

ছাড়ো, ছাড়ো! চিৎকার করে উঠল মুসা। লাফ দিয়ে নেমে কিশোরের হাত ধরে হ্যাঁচকা টানে সরিয়ে নিয়ে এল রাস্তার পাশে। আছড়ে পড়ল সাইকেল দুটো।

আরে! চিৎকার করে উঠল রবিন, ইচ্ছে করে চাপা দিতে চাইছে!

Super User