প্রবন্ধ : নারীর মূল্য Chapter : 1 Page: 3
- Details
- Sarat Chandra Chattopadhyay ।। শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
- Category: কবিতার বিষয়
- Read Time: 1 min
- Hits: 249
পুরুষের এ সম্বন্ধে যে বিশেষ কোন বাধ্যবাধকতা ছিল, তাহা কোথাও খুঁজিয়া মেলে না, এবং এতবড় একটা প্রাচীন দেশে পুরুষের সম্বন্ধে একটা শব্দ পর্যন্ত যে নাই এ কথা খুলিয়া বলিলে হাতাহাতি বাধিবে, না হইলে বলিতাম। ইংরাজ বলে, ‘chastity,’ তবুও ইহার দ্বারা তাহারা নরনারী উভয়কেই নির্দেশ করে, কিন্তু এ দেশে ও কথাটার বাংলা করিলে ‘সতীত্ব’ দাঁড়ায়; সেটা নিছক নারীরই জন্য। শাস্ত্রকারেরা বনে-জঙ্গলে বাস করিতেন বটে, কিন্তু তাঁহারা সমাজ চিনিতেন। তাই একটা শব্দ তৈরি করিয়াও তাঁর জাত-ভাইকে অর্থাৎ পুরুষকে inconvenient করিয়া যান নাই। তাহার প্রবৃত্তি নারী-সম্বন্ধে যত-রকমে হাত-পা ছড়াইয়া খেলিতে পারে, তাহার জায়গা রাখিয়া গিয়াছেন। পৈশাচ বিবাহটাও বিবাহ। এমনি সহানুভূতি! এতই দয়া! আর এত দয়া না থাকিলে কি পুরুষ শাস্ত্রকারকে মানিত, না, আজ বিংশ শতাব্দীতেও বিধবা-বিবাহ উচিত কি না, জিজ্ঞাসা করিতে তাঁহার কাছে ছুটিয়া যাইত! কবে কোন্ যুগে সে-সব পুঁথিপত্র দরিয়ায় ভাসাইয়া দিয়া মনের মত শাস্ত্র বানাইয়া লইয়া ছাড়িত। যাহাই হউক, নারীর জন্য সতীত্ব! পুরুষের জন্য নয়। এ সতীত্বের চরম দাঁড়াইয়াছিল—সহমরণে। কবে এবং কি হইতে ইহার সূত্রপাত, সে কথা ইতিহাস লেখে না। রামায়ণে স্বামীর মৃত্যুতে কৌশল্যা বোধ করি একবার রাগ করিয়া সহমরণে যাইবেন বলিয়া ভয় দেখাইয়াছিলেন। কিন্তু, শেষে তাঁহার রাগ পড়িয়া গিয়াছিল। দশরথকে একাই দগ্ধ হইতে হইয়াছিল। এ গ্রন্থে এ-সম্বন্ধে আর কোন উচ্চবাচ্য শোনা যায় না। তাই অনুমান হয়, ব্যাপারটা লোকের জানা থাকিলেও কাজটা তেমন প্রচলিত হইয়া পড়ে নাই। মহাভারতে মাদ্রী ভিন্ন আর যে কেহ এ-কাজ করিয়াছিল তাহা বলিতে পারি না। কুরুক্ষেত্রের লড়াইয়ের পর কতক কতক ঘটিয়া থাকিলেও তাহা কম। অন্ততঃ, পুরুষ যে তখনও উঠিয়া পড়িয়া লাগে নাই, তাহা নিশ্চিত; অথচ দেখা যায়, অসভ্য জাতির মধ্যে এ প্রথার বেশ প্রচলন। দাক্ষিণাত্যে সতীর কীর্তিস্তম্ভ যথেষ্ট; এবং আফ্রিকায় ও ফিজি দ্বীপে ভাগ্যে কীর্তিস্তম্ভের বালাই নাই, না হইলে ও দেশগুলায় বোধ করি এতদিনে পা ফেলিবার স্থানটুকুও থাকিত না। এক একটা ডাহোমি সর্দারের মৃত্যু-উপলক্ষে তাহার শতাবধি বিধবাকে সমাধিস্থানের আশপাশে গাছের ডালে গলায় দড়ি দিয়া ঝুলাইয়া দেওয়া হইত; অর্থাৎ, পরলোকে সঙ্গে পাঠাইবার ব্যবস্থা করা হইত। পরলোকের ব্যাপারটা তেমন স্পষ্ট নয়, বলা যায় কি, যদি লোকাভাবে সেখানে কষ্ট হয়! সাবধানের বিনাশ নাই, তাই সময় থাকিতে একটু হুঁশিয়ার হওয়া! আমাদের এ দেশেও মূল কারণ বোধ করি, ইহাই। যাহারা অশোক রাজার রাজত্ব দেখিয়াছিল, তাহারা বলে, সে সময় বিধবাকে দগ্ধ করার প্রথাটা আর্যাবর্তে ছিল না, দাক্ষিণাত্যে ছিল। কিন্তু আর্যাবর্তের আর্যেরা যেই খবর পাইলেন, অসভ্যেরা অসভ্য হউক, যাই হউক, বড় মন্দ মতলব বাহির করে নাই—ঠিক ত! পরলোক যদি সত্যই কিছু থাকে ত সেখানে সেবা করে কে? অমনি উঠিয়া পড়িয়া লাগিয়া গেলেন, এবং এত বিধবা দগ্ধ করিলেন যে, স্পেনের ফিলিপেরও বোধ করি লোভ হইত।