নাদিয়াকে ময়মনসিংহ নিয়ে যেতে রশিদ এসেছে। নাদিয়া বলল, আমি একা যাওয়া আসা করতে পারি। কেন আমাকে নিতে আসেন।

রশিদ জবাব দিল না। মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে রইল। প্রশ্ন করলেই উত্তরে কিছু বলা রশিদের স্বভাবে নেই।

নাদিয়া বলল, আপনি ভালো সময়ে এসেছেন। ইউনিভার্সিটি সাত দিনের ছুটি হয়েছে। আয়ুব খান আসছেন এইজন্যে ছুটি। আমরা ছাত্ররা ঝামেলা করে ফেলতে পারি এটাই সরকারের ভয়।

রশিদ বলল, আম্মা, কখন রওনা দিবেন?

ট্রেন কখন?

আমি স্যারের গাড়ি নিয়া আসছি আম্মা। আপনি যখন রওনা দিতে চান তখন রওনা দিব। দুপুরের আগে রওনা দেওয়া ভালো। সইন্ধ্যায় সন্ধ্যায় পৌঁছব।

আমি গাড়িতে যাব না। ট্রেনে যাব। এবং একা যাব। আজ না, আগামীকাল। ‘রোমান হলিডে’ নামে একটা ছবি এসেছে। হলের অনেক মেয়ে ছবি দেখে কেঁদে বুক ভাসিয়েছে। আমি এখনো কাঁদতে পারিনি।

রশিদ বলল, আম্মা আপনারে না নিয়া গেলে স্যরি আমারে খুন করবে।

নাদিয়া বলল, বাবা আয়ুব খানের মতো। নানান প্যাঁচ খেলবে, খুন করবে। আপনি গাড়ি নিয়ে ফেরত যান। আমি এক থেকে তিন গুনব, আপনি এর মধ্যে বিদায় হবেন। এক-দুই-তিন।

ছুটি সাত দিনের, নাদিয়া জানে খুব কম করে তাকে দশ দিন থাকতে হবে। দাদি ছাড়বে না। ঢাকায় আসার জন্যে সে তৈরি হয়ে দাদিকে সালাম করতে যাবে। দাদি বলবেন, খারাপ খোয়াব দেখছি। খুবই খারাপ খোয়াব। আইজ যাওয়া বন। পরের দিন দাদি বলবেন, আইজ না শনিবার। শনিবারের যাত্রা! তোর মাথাটা কি খারাপ হইছে? তারপরের দিন দাদি অসুস্থ হয়ে পড়বেন। তার হাঁপানির টান উঠবে। অসুখ সত্যি না মিথ্যা কেউ ধরতে পারবে না।

দশ দিন মাথায় রেখে নাদিয়া বাড়ি যাওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছে। সে ঠিক করেছে পাঠ্যবই একটাও নিবে না। ছুটিতে গেলে কখনোই পড়া হয় না। শুধু শুধু বাক্সভর্তি বই নিয়ে যাওয়া।

গল্পের বই কিছু নিয়ে যেতে হবে। দিঘির ঘাটে বসে বই পড়ার আনন্দ তুলনাবিহীন। মার জন্যে কচি কলাপাতা রঙের শাড়ি কিনতে হবে। এই রঙের শাড়ি তার অসম্ভব পছন্দ। অনেকগুলি সবুজ শাড়ি তাঁর আছে। মজার ব্যাপার হলো, নাদিয়া তাকে কখনো সবুজ শাড়ি পরতে দেখে না। কোনো ঘটনা নিশ্চয়ই আছে। মাকে জিজ্ঞেস করতে হবে কী ঘটনা।

নাদিয়া নিউ মার্কেট থেকে তিনটা বই কিনল। ম্যাক্সিম গোর্কির আমার ছেলেবেলা এবং পৃথিবীর পাঠশালা। বেনিয়ত নামের এক লেখকের বই কিনল। নাম Snake inside the Apple, এই বইটা কিনল কভার দেখে। টুকটুকে লাল আপেলের ভেতর কুলি পাকিয়ে আছে সাপ। আপেলটা ঠিক যতটা সুন্দর, সাপটা

আপেলটা ঠিক যতটা সুন্দর, সাপটা ততটাই ভয়ঙ্কর।

নিউ মার্কেট থেকে সে গেল বলাকা সিনেমাহলে। রোমান হলিডে’ ছবির ম্যাটিনি শো’র দুটা টিকিট কাটল। একটা তার জন্যে আরেকটা বিদ্যুত স্যারের জন্যে। স্যারকে সে বলবে না যে পাশাপাশি দুটা টিকিট কেটেছে। স্যারকে সে আপেলের বইটা দেবে। বইয়ের ভেতর টিকিটটা থাকবে। তিনি যদি সত্যি ছবি দেখতে আসেন তাহলে দেখবেন যে পাশের সিটে নাদিয়া বসে আছে। তিনি অবশ্যই চমকে উঠবেন।

নাদিয়া ঘড়ি দেখল। এগারোটা দশ। ছবি শুরু হবে তিনটায়। হাতে এখনো অনেক সময়।

 

বিদ্যুত কান্তি তাঁর ঘরে বসে স্লাইড রুল দিয়ে জটিল হিসেব করছিলেন। নাদিয়া উঁকি দিয়ে বলল, স্যার আসব।

এসো।

স্যার আমি কাল ময়মনসিংহ চলে যাচ্ছি। আপনার সঙ্গে দেখা করতে এসেছি।

ভালো করেছ। চা খাবে?

জি স্যার।

ভেতরে এসে বসো আমি চায়ের কথা বলি। তুমি নিজেই বলে আসো ল্যাব অ্যাসিসটেন্ট কিসমতকে। অপটিক্স ল্যাবে আছে। দাড়িওয়ালা। চেনো না?

চিনি স্যার।

কিসমত চা দিয়ে গেছে। বিদ্যুত কান্তি স্লাইড রুল চালাতে চালাতেই কথা বলছেন।

আপনার জন্যে একটা বই এনেছি স্যার। Snake inside the Apple.

গল্পের বই?

জি স্যার।

বিখ্যাত কোনো বই নাকি?

জানি না স্যার। কভার দেখে পছন্দ হয়েছে বলে কিনে ফেলেছি।

বিদ্যুত হাত থেকে স্লাইড রুল নামিয়ে রাখতে রাখতে বললেন, মানব জাতির এটা একটা সাধারণ ত্রুটি। তারা শুধু যে কভারের রঙচঙ ছবি দেখে বই কিনে তা, মানুষও তার কভার অর্থাৎ রূপ দেখে পছন্দ করে। চলতি কথা-ই আছে—

পহেলা দর্শনদারি
তারপর গুণ বিচারি।

নাদিয়া বলল, এছাড়া উপায় কী স্যার? রূপ প্রথমেই চোখে পড়বে। গুণ পড়বে না।

বিদ্যুত বললেন, বইটায় তোমাদের ময়মনসিংহের বাড়ির ঠিকানাটা লিখে দাও। আমার এগ্রিকালচারাল ইউনিভার্সিটিতে কিছু কাজ আছে। হাতে সময় থাকলে তোমাদের বাড়িতে যাব। চা খেয়ে আসব।

নাদিয়া ঠিকানা লিখে দিল। হঠাৎ সে লক্ষ করল, ঠিকানা লেখার সময় হাত কাঁপছে। কেন এরকম হচ্ছে?

স্যার আমি উঠি।

আচ্ছা যাও ভালো থেকো।

আপনিও ভালো থাকবেন। ময়মনসিংহ যদি সত্যি সত্যি যান তাহলে আমাদের বাড়িতে থাকবেন। আমি খুব খুশি হব।

 

‘রোমান হলিডে’ ছবি শুরু হয়েছে। নাদিয়া ছবির দিকে মন দিতে পারছে না। তার মন পাশের খালি সিটের দিকে। সে নিশ্চিত স্যার এসে পাশের সিটে বসবেন।

বিশ মিনিট পার হবার পর নাদিয়ার পাশের সিটে এসে বসূল ল্যাব অ্যাসিসটেন্ট কিসমত। স্যার তার টিকিট কিসমতকে দিয়ে দিয়েছেন।

 

হাবীবের সামনে হাজি সাহেব একা বসা। চেম্বারে মানুষ মাত্র তিনজন। হাবীব, হাজি সাহেব, প্রণব। রশিদকে সরিয়ে দেওয়া হয়েছে। হাবীব প্রণবের দিকে তাকিয়ে বললেন, জর্দা ছাড়া আমাকে একটা পান দাও তো।

প্রণব পানের কৌটা খুলতে খুলতে হাজি সাহেবের দিকে তাকিয়ে বললেন, আপনাকেও কি একটা পান দিব?

হাজি সাহেব বললেন, না।

প্রণব বললেন, পানের মধ্যে আছে সাতটা শিরা। সাত শিরার মধ্যে মধ্যমটা বিষ। বাকিগুলি অমৃত। মধ্যমটা বাদ দিয়ে পান খেলে শরীরের জন্যে ভালো। একটা খান?

হাজি সাহেব বললেন, না। আমি পান যে কোনোদিন খাই নাই তা না। পান খাওয়ার অভ্যাস ভালোই ছিল। আমার স্ত্রী নিজের হাতে পান বানায়ে আমার জন্যে সাজায়ে রাখতেন। তাঁর মৃত্যুর পর পান খাওয়া ছেড়ে দিয়েছি।

প্রণব বললেন, স্ত্রীর মৃত্যুর পর কেউ তাজমহল বানায়, আবার কেউ পান খাওয়া ছেড়ে দেয়।

হাবীব বললেন, প্রণব, তুমি মুখভর্তি করে পান নাও। পান চাবাতে থাকো, কথা বন্ধ। এই ফাঁকে আমি হাজি সাহেবকে অতি জরুরি কথাটা বলে শেষ করি। হাজি সাহেব, আরও কাছে আসেন। আমি নিচুগলায় কথা বলব।

হাজি সাহেব এগিয়ে এলেন। তাঁর চোখে সামান্য শঙ্কা। হাবীব বললেন, আপনার মামলা আমি কীভাবে সাজিয়েছি সেটা শুনেন—

আপনি আপনার ছেলের জন্যে একজন কেয়ারটেকার জাতীয় মানুষ রেখেছিলেন। যার দায়িত্ব সবসময় আপনার ছেলের সঙ্গে থাকা। হাওরে পাখি শিকার আপনার ছেলের শখ। সেই কেয়ারটেকার বন্দুক সঙ্গে নিয়ে আপনার ছেলের সঙ্গে হাওরেও যায়। সে বন্দুক চালাতে পারে। খুন সেই লোক করেছে। কোর্টে সে স্বীকার যাবে। ম্যাজিস্ট্রেটের কাছে জবানবন্দি দিবে।

হাজি সাহেব হতভম্ব হয়ে বললেন, আমার ছেলের হয়ে ওই লোক জেলে যাবে?

হ্যাঁ।

যদি তার ফাঁসি হয়?

হাবীব বললেন, ফাঁসি হলে ফাঁসিতে ঝুলবে। তবে ফাঁসি হবে না। মামলা এমনভাবে সাজানো হবে যে প্রত্যক্ষদর্শী নাই। তাছাড়া সে খুনের উদ্দেশ্যে খুন করে নাই। ভোরবেলা পাখি শিকারে যাবে বলে আপনার ছেলে তাকে বলেছে বন্দুক পরিষ্কার করতে। সে বলুক পরিষ্কার করার জন্যে বন্দুক নিয়ে বাইরে এসেছে। বন্দুকে গুলি ভরা ছিল, সে খেয়াল করে নাই। গুলি হয়ে গেছে। এক্সিডেন্টে মৃত্যু। সাজা দশ বছরের বেশি হবে না। জেলখানায় নয় মাসে বছর। আট বছরের মাথায় বের হয়ে আসবে।

হাজি সাহেব বললেন, এমন লোক আমি পাব কই?

হাবীব বললেন, আমি জোগাড় করে দিব।

আপনি কই পাবেন?

হাবীব বললেন, এই ধরনের কাজের জন্যে কিছু লোকজন আমি পুষি।পোষা একজনকে দিব। তার নাম ফরিদ। সে আপনার ছেলের হয়ে সাজা ভোগ করে আসবে। আপনি দুই লাখ টাকার জোগাড় দেখেন। আমি রাখব দেড়। ফরিদকে দিব পঞ্চাশ হাজার। এই টাকায় সে জমি কিনবে। ঘর তুলবে। ব্যবসা করবে। কিছুদিন জেল খাটবে।

হাজি সাহেব বিড়বিড় করে বললেন, যদি কোনো ঝামেলা হয়? যদি ওই লোকের ফাঁসি হয়ে যায়?

ফাঁসি হয়ে গেলে হবে।

হাজি সাহেব বললেন, আমার ছেলে রাজি হবে না।

হাবীব বললেন, ছেলেকে রাজি করার দায়িত্ব আমার না। আপনার। তাকে আমি যা শিখিয়ে দিব, তা-ই সে কোর্টে বলবে। এর বাইরে একটা শব্দ বলবে। কোর্টে কোনো কারণে সে যদি কাশতে চায়, আমাকে জিজ্ঞেস করে কাশবে।

হাজি সাহেব বললেন, ফরিদ সাহেবের সঙ্গে আমি কি কথা বলতে পারি?

না।

টাকার জোগাড় কতদিনের মধ্যে করতে হবে?

যত তাড়াতাড়ি পারেন।

হাবীব উঠে দাঁড়ালেন। হাজি সাহেব ব্যাকুল গলায় বললেন, আপনি কি চলে যাচ্ছেন?

হাবীব বললেন, হ্যাঁ চলে যাচ্ছি। আপনার সঙ্গে কথা যা বলার বলা হয়েছে। বাকি কথা হবে টাকা হাতে পাওয়ার পর। অনেকদিন পর ঢাকা থেকে আমার মেয়ে এসেছে। মেয়েকে কিছু সময় দিব। আপনি যান, আপনার ছেলের সঙ্গে কথা বলুন। কোর্টে কীভাবে মামলা উঠবে তা বুঝিয়ে বলুন। আপনি বুঝিয়ে বলতে না পারলে প্রণবকে সঙ্গে নিন।

 

নাদিয়া তার দাদির ঘরে। হাজেরা বিবি যেভাবে পা লম্বা করে খাটে হেলান দিয়ে বসেছেন, নাদিয়াও সেভাবে বসেছে। দাদির পান ছেঁচনি তার হাতে। সে নিবিষ্ট মনে পান ছেঁচে যাচ্ছে।

নাদিয়া লম্বা রোগা একটি মেয়ে। তার চেহারার শান্ত স্নিগ্ধতা চোখে পড়ার মতো।

হাজেরা বিবি বললেন, তোর গায়ের রঙ তো আরও ময়লা হইছে।

নাদিয়া বলল, গায়ের রঙ ময়লা হলেও অসুবিধা নাই দাদি। আমার অন্তরের রঙ খুব পরিষ্কার। তুমি দুধের মতো ধবধবে সাদা একজন মানুষ। তোমার অন্তর কালো। কুচকুচে কালো।

হাজেরা বিবি বললেন, কথা সত্য বলেছিস। আমার অন্তরও তোর মতো সাদা ছিল। এই বাড়িতে সংসার করতে আইসা নানান প্যাচের মধ্যে পড়লাম। নিজে প্যাঁচ শিখলাম। অন্তর কালা হওয়া শুরু হইল। শেষমেষ একটা খুনও করলাম।

নাদিয়া অবাক হয়ে বলল, খুন করেছ মানে! কাকে খুন করেছ।

নিজের হাতে করি নাই। অন্যরে দিয়া করাইছি।

কাকে খুন করেছ সেটা বলো।

হাজেরা বিবি নির্বিকার গলায় বললেন, বেদানা নামের একটা নটি বেটি এই বাড়িতে থাকত। তার কইন্যা হয়েছিল। ধাইরে বললাম কইন্যার মুখে লবণ দিয়া দিতে। ধাই তাই করছে। এক চামচ লবণে কারবার শেষ।

নাদিয়া বলল, দাদি, তুমি কি সত্যি কথা বলছ?

হাজেরা বিবি বললেন, তুই পাগল হইছস? আমি কি পিশাচ? বেদানা মাগি মরা সন্তান প্রসব করছে। তিন তিনবার মরা সন্তানের জন্ম দিয়া তার মাথা হইছে খারাপ।

নাদিয়া বলল, দাদি, আমার গা ছুঁয়ে বলো লবণ বিষয়ে যা বলেছ সব মিথ্যা।

হাজেরা বিবি বললেন, অবশ্যই মিথ্যা। লতিফা সাক্ষি। তারে জিজ্ঞাস কর। সে বলবে। দে পান দে।

নাদিয়া দাদির হাতে পান দিল। লাইলী ঘরে ঢুকে বললেন, তোজলী! তোমার বাবা তোমাকে ডাকে।

লাইলী শাশুড়ির সামনে নামের বিষয়ে কখনো ভুল করেন না। আজও করলেন না।

 

হাবীব বসেছেন পূর্বদিকের বারান্দায়। এই বারান্দা তার শোবার ঘরের লাগোয়া। এখান থেকে দূরের মৃত ব্ৰহ্মপুত্র দেখা যায়। সারাক্ষণই একদল মানুষ ব্রহ্মপুত্রের মাটি কাটছে। হাবীবের শৈশবের স্বপ্ন ছিল একটা নদী কিনবেন। শৈশবের সব স্বপ্নই পরিণত বয়স পর্যন্ত থাকে। এখনো হাবীবের মনের এক গোপন স্থানে নদী কেনার বিষয়টা আছে। বারান্দায় বসলে কিছুক্ষণের জন্য হলেও মনে হয় ব্রহ্মপুত্র নদীটা তার কেনা। যারা মাটি কাটছে তারা অনুমতি না নিয়েই কাটছে।

বাবা, কেমন আছ?

নাদিয়া আয়োজন করে বসে বাবাকে কদমবুসি করল। হাবীব মেয়ের মাথায় হাত রেখে উঁচুগলায় বললেন, হাসবুনুল্লাহে নিয়ামুল ওয়াকিল ও নিয়ামুল মওলা ও নিয়ামুন নাসির।

নাদিয়া বলল, প্রশ্নের জবাব দিলে না তো বাবা। কেমন আছ?

ভালো আছি মা।

তোমার বুকের ব্যথাটা কি আরও হয়েছে?

হয় মাঝে মাঝে।

ডাক্তার কী বলে?

ডাক্তার কিছু বলে না। প্রেসার ট্রেসার মেপে চলে যায়।

নাদিয়া বলল, ভিজিট নিশ্চয়ই নেয় না।

হাবীব বললেন, নেয় না। নিজেদের ডাক্তার।

নাদিয়া বলল, নিজেদের ডাক্তার দিয়ে চিকিৎসা হয় না বাবা। অন্যদের ডাক্তার দিয়ে চিকিৎসা করাতে হয়।

হাবীব বললেন, তোর ইউনিভার্সিটির খবর কী?

নাদিয়া বলল, আন্দোলন চলছে। রোজই মিটিং মিছিল। একদলকে আরেকদল ধাওয়া করছে।

হাবীব বিরক্ত গলায় বললেন, এরা চায় কী?

নাদিয়া বলল, জানি না বাবা।

হাবীব বললেন, না জানাই ভালো। ছাত্ররা চায় নৈরাজ্য। আর কিছু না। তাদের উস্কে দেওয়ার লোক আছে মাওলানা ভাসানী। আজগুবি সব বিষয় নিয়ে আন্দোলনের ডাক। ভুখা মিছিল। অনশন। পারলে সে একাই কোদাল দিয়ে কুপিয়ে দেশটাকে বঙ্গোপসাগরে ফেলে দিয়ে আসে। তার চ্যালাটা বসে আছে জেলে। ফাঁসিতে ঝুলার অপেক্ষায়।

নাদিয়া বলল, উনার চ্যালা কে?

হাবীব তিক্ত গলায় বললেন, বাদাইম্যা সবাই তার চ্যালা। মূল চ্যালা শেখ মুজিব। ইন্ডিয়ার কাছে গোপনে দেশ বিক্রি করতে গিয়ে ধরা খেয়েছে। আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা। এখন ফাঁসিতে ঝুলে দোল খাও।

নাদিয়া বলল, তুমি এত রেগে যাচ্ছ কেন বাবা?

হাবীব বললেন, দেশটাকে ভালোবাসি বলে রেগে যাচ্ছি।

নাদিয়া বলল, বাবা, চা খাবে? আমি খুব ভালো চা বানানো শিখেছি। একটা কেরোসিনের চুলা কিনেছি। রুমে লুকানো আছে। হাউস টিউটররা যখন রাতের রোল কল শেষ করে চলে যান, তখন চা বানাই।

হাবীব বললেন, অনুমতি নাই এ ধরনের কাজ করা ঠিক না। একসময় ঘরে আগুন-টগুন লাগাবি। কেলেঙ্কারি হবে।

নাদিয়া হাসিমুখে বলল, একদিন আগুন লেগেছিল বাবা। বিছানার চাদরে আগুন ধরে গিয়েছিল। হাতের কাছে পানিভর্তি জগ থাকায় রক্ষা।

 

নাদিয়া চার কাপ চা বানিয়েছে। এক কাপ চা সে তার দাদিকে দিয়ে এসেছে। এক কাপ তার মা’কে। বাকি দুকাপ নিয়ে সে তার বাবার সঙ্গে বসেছে।

হাজেরা বিবি চায়ে চুমুক দিয়েই বললেন, নাতনি কী চা বানাইছে? চায়ের মধ্যে ‘পাদের গন্ধ।

লাইলী দুঃখিত গলায় বললেন, চা ভালো না লাগলে ফেলে দেন। আজেবাজে কথা কেন বলেন! তোজল্লী শুনলে মনে কষ্ট পাবে। নিজে আগ্রহ করে চা বানিয়েছে।

হাজেরা বিবি বললেন, পাদ দিয়া চা ক্যামনে বানাইছে এইটাই আমার জিজ্ঞাসা।

লাইলী হতাশ গলায় বললেন, চা খাওয়ার দরকার নাই মা। ফেলে দিন। ননাংরা কথাগুলি বলবেন না। চায়ে তোজলী সামান্য ওভালটিন দিয়েছে। আপনি ওভালটিনের গন্ধ পাচ্ছেন। আপনি চায়ের কাপটা দিন, আমি ফেলে দেই।

হাজেরা বিবি বললেন, ফেলবা কেন? খাইতে তো চমৎকার হইছে।

 

নাদিয়া তার বাবাকে বলল, চা খেতে কেমন হয়েছে বাবা?

হাবীব বললেন, ভালো হয়েছে।

আমি রোজ সন্ধ্যায় তোমাকে এক কাপ চা বানিয়ে খাওয়াব।

আচ্ছা।

ম্যাজিক দেখবে বাবা?

তুই ম্যাজিক জানিস না-কি?

অল্প কয়েকটা জানি। আমার ডান হাতে কী আছে দেখো তো। একটা কয়েন।

হুঁ।

এই কয়েনটা আমি ডান হাত থেকে বাম হাতে নিয়ে গেলাম। ঠিক কি না বলো?

হুঁ। ঠিক।

নাদিয়া বা হাত খুলে দেখাল হাত শূন্য। হাবীব বিস্মিত হয়ে বললেন, কীভাবে করলি?

নাদিয়া বলল, পামিং করে করেছি। কয়েনটা সবসময় আমার ডান হাতেই ছিল। তোমার মনে হয়েছে আমি বাঁ হাতে চালান করেছি। আসলে তা-না। একে বলে পামিং। হাতের তালুতে কোনো কিছু লুকিয়ে রাখার বিদ্যা। এখন আমি দিনরাত পামিং প্র্যাকটিস করি।

পড়াশোনা বাদ দিয়ে পামিং?

নাদিয়া বলল, আমি পড়াশোনার বিষয়ে খুব সিরিয়াস বাবা। পামিং প্র্যাকটিস করি পড়াশোনার ফাঁকে ফাঁকে।

হাবীব বললেন, হঠাৎ এইসব ধরলি কেন?

নাদিরা বলল, ম্যাজিকে হঠাৎ উৎসাহ কেন হয়েছে তোমাকে বলি। ক্লাসে গিয়েছি। বিদ্যুত স্যারের ক্লাস। বিদ্যুত কান্তি দে। উনি মধ্যাকর্ষণ সূত্র পড়াবেন। স্যার ক্লাসে ঢুকলেন হোমিওপ্যাথির ওষুধ রাখে এরকম ছোট্ট একটা শিশি নিয়ে। শিশিটা তিনি টেবিলে রাখলেন এবং বললেন, প্রিয় শিষ্যরা। এই বোতলটা কি আপনাআপনি শূন্যে ভাসবে?

আমরা সবাই বললাম, না।

তিনি বললেন, কেন আপনাআপনি শূন্যে ভাসবে না?

আমরা বললাম, মধ্যাকর্ষণ বলের জন্যে শূন্যে ভাসবে না। পৃথিবী তাকে নিজের দিকে টেনে ধরে রাখবে।

স্যার তখন বোতলের দু’হাত ওপরে ব্ল্যাক বোর্ডের ডাস্টার ধরলেন। আমরা অবাক হয়ে দেখি বোতলটা টেবিল ছেড়ে শূন্যে ভেসে উঠল। স্যার বললেন, প্রিয় শিষ্যকুল। যা দেখেছ তাতে বিভ্রান্ত হয়ো না। এটা একটা সাধারণ ম্যাজিক। কারোরই ক্ষমতা নেই মধ্যাকর্ষণ বল অগ্রাহ্য করার। স্যার বললেন, তোমরা কি এই ম্যাজিক দেখে খুশি হয়েছ?

আমরা সবাই একসঙ্গে বললাম, জি স্যার।

তিনি বললেন, পৃথিবীর সবচেয়ে বড় ম্যাজিক হচ্ছে সায়েন্স। আমরা সেই ম্যাজিকে এখন ঢুকব। সায়েন্সের ম্যাজিক আমরা যতই জানব ততই আমরা অবাক হব। বিস্মিত হব, মুগ্ধ হব। এখন প্রিয় শিষ্যকুল হাততালি দাও, আমি বক্তৃতা শুরু করি।

আমরা হাততালি দিলাম।

স্যার বললেন, মহাকর্ষ বল যিনি প্রথম টের পেয়েছিলেন সেই মহাবিজ্ঞানী স্যার আইজাক নিউটনের প্রতি সম্মান দেখানোর জন্যে এক মিনিট standing ovation দিলে কেমন হয়!

আমরা সবাই উঠে দাঁড়ালাম। তারপর স্যার বক্তৃতা শুরু করলেন। আমরা মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে শুনলাম।

তোর এই স্যার ছাত্র-ছাত্রীদের শিষ্য ডাকেন?

হুঁ। প্রাচীন গ্রীসের শিক্ষকরা তাদের ছাত্রদের শিষ্য ডাকতেন। তিনিও তাই করেন।

তোর এই স্যার বিজলি না বিদ্যুত?

বিদ্যুত। বিদ্যুত কান্তি দে।

তিনিই তোকে ম্যাজিক শেখান? তিনি কি তোর ম্যাজিকেরও শিক্ষক?

আমি একদিন স্যারের কাছে গিয়েছিলাম বোতল কীভাবে শূন্যে ভাসে তা শেখার জন্যে। তখন স্যার পামিং-এর কৌশল শিখিয়েছিলেন।

হাবীব গম্ভীর গলায় বললেন, তুই কি একাই তার কাছে ম্যাজিক শিখিস? নাকি সব শিষ্যদেরই তিনি ম্যাজিক শেখান?

নাদিয়া বলল, বাবা, তুমি কি কোনো কারণে স্যারকে অপছন্দ করছ?

হাবীব বললেন, পছন্দ-অপছন্দের বিষয় না। একজন ফিজিক্সের শিক্ষক ছাত্রদের ফিজিক্স শেখাবেন। ম্যাজিক না।

নাদিয়া বলল, আইনস্টাইন ছিলেন ফিজিক্সের গ্র্যান্ডমাস্টার। তিনি বেহালা বাজাতেন।

হাবীব বলল, এই প্রসঙ্গটা থাক।

নাদিয়া বলল, বিদ্যুত স্যার একদিন ক্লাসে কী করেছিলেন সেই গল্পটা করি বাবা। তুমি খুব মজা পাবে।

হাবীব বললেন, তোর স্যারের প্রসঙ্গ নিয়ে এক দিনে অনেক আলাপ হয়ে গেছে। আজ আর না।

নাদিয়া বলল, স্যারের একটা কথা তোমাকে বলতেই হবে। তিনি একটা বিষয়ে তোমার সাহায্য চান।

হাবীব বিস্মিত হয়ে বললেন, আমার সাহায্য?

নাদিয়া বলল, ঠিক তোমার সাহায্য না। মোনায়েম চাচার সাহায্য। স্যরি কমনওয়েলথ স্কলারশিপ পেয়েছেন। উনি হিন্দু তো, শেষ মুহূর্তে তাঁকে বাদ দেওয়া হবে। মোনায়েম চাচাকে তুমি বলে দিলেই স্যারের সমস্যার সমাধান হবে।

হাবীব বললেন, কোনো হিন্দুকে স্কলারশিপ দিয়ে বাইরে পাঠানোর বিষয়ে আমার মত নেই। কারণ তারা Ph.D. শেষ করে কখনো পাকিস্তানে ফেরে না। হয় ওই দেশেই থেকে যায়, কিংবা ইন্ডিয়াতে চলে যায়।

নাদিয়া বলল, বিদ্যুত স্যার সেরকম মানুষ না।

তুই তার সঙ্গে কতটুক মিশেছিস যে বলে ফেললি তিনি সেরকম মানুষ না? সারা জীবন পাশাপাশি থেকেও একজন মানুষ অন্য একজনকে বুঝতে পারে না। তোর মা কি আমাকে বুঝতে পারে? পারে না। আমিও তাকে বুঝতে পারি না।

নাদিয়া কিছুক্ষণ চুপচাপ থেকে নিচুগলায় বলল, বাবা, তুমি স্যারের কাজটা করে দেবে?

হাবীব দীর্ঘ সময় মেয়ের মুখের দিকে তাকিয়ে রইলেন। নাদিয়া মাথা নিচু করে আছে। তার চোখ ছলছল করছে। হাবীব বললেন, তোর স্যারের কাজটা আমি কারে দেব।

নাদিয়া বলল, থ্যাংক য়ু বাবা!

হাবীব বললেন, তোর চোখে পানি কেন?

নাদিয়া বলল, তুমি স্যারের কাজটা করে দেবে না এই ভেবে দুঃখে আমার চোখে পানি এসেছে।

হাবীব বললেন, এত দুঃখ পাওয়ার কি কিছু আছে?

নাদিয়া জবাব দিল না।

হাবীব বললেন, আমি আরেক কাপ চা খাব। যা চা বানিয়ে আন।

হাজেরা বিবি ডাকছেন, হাবু হাবু! হাবুরে! ও হাবু!

হাবীব বিরক্ত মুখে উঠে গেলেন। মা’র ঘরে ঢুকলেন। হাজেরা বিবি পাশে বসার জন্যে ইশারা করলেন। তিনি পাশে বসলেন না।

হাজেরা বিবি বললেন, কাছে বোস। তোরে একটা গোপন কথা বলব।

হাবীব অনিচ্ছায় পাশে বসলেন।

হাজেরা বিবি বললেন, গোপন কথা বলার আগে তোরে একটা শিলুক ভাঙানি দেই। শিলুক ভাঙাইতে পারলে গোপন কথা বলব। না পারলে বলব না। শিলুকটা হইল—

কাটলে ‘লউ’ নাই
না কাটলে ‘লউ’
দিনেরবেলা লেংটা ঘুরে
মুক্তারপাড়ার বউ।

হাবু! ক’ দেখি জিনিসটা কী?

হাবীব কোনো জবাব না দিয়ে ঘর থেকে বের হয়ে গেলেন।

 

ঘুমুতে যাবার আগে রাতের শেষ খবর শুনে হাবীব অত্যন্ত বিরক্ত হলেন। আয়ুব খানকে নজরুল একাডেমী বিশাল সংবর্ধনা দিয়েছে। সেখানে আয়ুব খান বলেছেন একদিন দেশের সকল ভাষার সংমিশ্রণে একটি পাকিস্তানি ভাষা হবে।

হাবীবের মনে হলো জগাখিচুড়ি ভাষার দরকার কী? আয়ুব খান সবাইকে খুশি করতে চাচ্ছেন। সেটা সম্ভব না। সবাইকে খুশি রাখা যায় না। আয়ুব খান নরম ভাব ধরেছেন। কাউকে নরম দেখলে বাঙালি আক্কা গরম হয়ে যায়। সাপের মতো ফোঁসফাস শুরু করে।

আয়ুব খানকে নরম না হয়ে কঠিন গরম হতে হবে। তখনই সব সাপ গর্তে ঢুকবে। গর্তে আঁকাবাঁকা হয়ে ঢোকার বুদ্ধি নেই। গর্তে সোজা হয়ে ঢুকতে হয়। বাঙালি জাতির সোজা হয়ে গর্তে ঢোকার সময় হয়ে গেছে।

<

Humayun Ahmed ।। হুমায়ূন আহমেদ