না-ই যদি হয় নাই হলো আহা ভারতের স্বাধীনতা
হুঙ্কার ছাড়ি’ তর্জনী নাড়ি’ নাই মুছালেম ব্যথা !
             নাই মুছালেম ভিজে আঁখিপাতা
             হাহুতাশভরা রচি’ বীর গাথা
ইনায়ে বিনায়ে কবে মান্ধাতা কারে জিনেছিল কোথা
বৃথা মোরে ডাকো আমি পারি নাকো হেন ঘোর রসিকতা !
                      আমি ক্ষণজীবী কবি
আয়ু কই, সখি, মহারথীদের মহাযশ যাব লভি !

ভীরু বলে তুমি ফিরাবে নয়ন মূঢ় বলে দিবে গালি
বাঁকা হাসি হেসে তালে তালে তালে বাজাইবে করতালি |
             সেও সই, তবু পারি না কিছুতে
             সাধ্য যা নয় তাহারি পিছুতে
ছুটিয়া ছুটিয়া মরীচিকা ছুঁতে শ্বাসটুকু দিতে ঢালি’
বৃথা দাও লাজ আছে আরো কাজ তারি লাগি প্রাণ জ্বালি |
                       আমি ক্ষণজীবী কবি
যুগ যুগ ধরে যে পাবক জ্বলে কেন হব তার হবি ?

যে রূপবহ্নি নয়নে জ্বলিছে যে রসবিন্দু বুকে
যে মায়াবহ্নি কল্পনা মোর রাঙাইছে কৌতুকে
              সেই অনলের কয়েকটি কণা
              লয়ে বিরচিব নব আল্ পনা
বসে বসে তাই চলে জল্পনা বিরহবিরস মুখে
বহে যায় বেলা নীরবে একেলা নিষ্ফলতার দুখে |
                     আমি দিনেকের কবি
নভ অঙ্গনে আল্ পনা আঁকি’ নিভে যাবে মোর রবি |

আপনারে লয়ে ফিরি অহরহ নামাতে না পারি ব্যথা
ভ্রূণ লয়ে কাঁদে গরভিণী নারী কুঁড়ি লয়ে কাঁদে লতা |
               সৃজনবেদনা জাগে অনিবার
               কত কী যে মোর রয়েছে দিবার
ফাগুন থাকিতে তাই তো আমার ফুটিবার ব্যাকুলতা
বলিবার যত কবে তা বলিব মনে থেকে যায় কথা |
                       আমি অস্ফুট কবি
ফুটিলেই মোর ব্যথা যাবে, সখি, না ফুটিলে যাবে সবি |

আমারে পাবে না জগতের কাজে আমি চির পলাতকা
বচন বিনাতে নাহি জানে যারা আমিই তাদের সখা |
            প্রণয়ীরা মোরে ডাকি’ লয়ে যায়
             বাসরঘরের চোরা ঝরোকায়
আমি লিখে লই আপন ভাষায় ওদের প্রলাপ বকা
আমি দিই ছেপে যত চাপা হাসি যতেক মিছে চমকা |
                       আমি বাণীচোরা কবি
বাচাল জনার যত কথাভার উতারিয়া লই সবি |

তরুণ ছেড়েছে তরুণীর মায়া দীক্ষা লয়েছে একা
জনমের মতো করেছে বরণ জাগিয়া স্বপন দেখা
              শ্রবণে বেজেছে মা’র হাহাকার
              উতলা হয়েছে খাপে তরবার
তবু ভাঙিবে না ধৈর্য তাহার আগে চাই রণশেখা
কথাটি বলে না নিজেরে ছলে না ললটে নিষ্ঠা লেখা |
                      আমি বিমুগ্ধ কবি
মরণে কী শোক তার জয় হোক, আঁকি’ লব তার ছবি |

হেম শৃঙ্খল কাটি’ কোন জন কোথায় নিরুদ্দেশ
কেহ নাহি জানে বাজে তার প্রাণে সকলের সব ক্লেশ |
              সৃষ্টির আদি অন্ত বুঝিতে
              জরা মরণের ওষধি খুঁজিতে
মারের সঙ্গে নিত্য যুঝিতে আয়ু তার নিঃশেষ
সাধনা না সাধি’ সাধক মরিল কেহ না জানিল লেশ |
                     আমি বিনম্র কবি
সেই অজানার তর্পণ করি’ পরম পূণ্য লভি |

ঘরে ঘরে পাই গৌরীর দেখা তপোনির্মল রূপ
সে বর অঙ্গ রঙ্গে বিলোকি’ অনঙ্গ মানে চুপ |
              কল্যাণী যায় গৃহ কাজ করি’
              পূর্ণা চলিছে অন্ন বিতরি’
সম্মুখে তার হাত পাতে ডরি’ আপনি ভুবন ভূপ
কোলে দোলে শিশু ভয় পরিহরি’ এ যে অতি অপরূপ |
                      আমি কুতূহলী কবি
রহস্য এর নাহি পেয়ে টের রসনা রয় নীরবি’ |
তাই বলি মোর কোথা অবসর যোগ দেব কোনো কাজে
দৃশ্য নেহারি’ ঠাঁই ঠাঁই ফিরি মিলি সকলের মাঝে |
              দেখি আর লিখি যখন যা আসে
              কখন কে কাঁদে কখন কে হাসে
খেয়ালীর মতো ঘুরি আশে পাশে ভাববিলাসীর সাজে
রণভেরী শুনে সরে না চরণ মনে মনে মরি লাজে |
                       আমি দর্শক কবি
নাটবেদী পরে যেতে ভয় বাসি, দূর হতে অনুভবি |

আমার এ কাজে কে করিবে আজ আমি যদি যাই রণে
কবে জানিবে কে যাহা গেল থেকে শুধু আমারি এ মনে ?
              কোটি কোটি পথ একটি জীবন
              তাও দুটি দিনে হবে সমাপন
আপনারি পথে চলি সে কারণ নিজেরি অনুসরণে
কভু চলে নাই কভু চলিবে না এ পথে অপর জনে |
                       আমি যে তোমারি কবি
তোমারি আলোকে আলোকিত আমি, তব তরে এ পদবী |

Annada Shankar Ray ।। অন্নদাশঙ্কর রায়