‘আমি কিন্তু ব্যাপারটা কিছুই বুঝতে পারছি না,’ বিশাল বাড়ির সুসজ্জিত হলরূমে ওদেরকে নিয়ে বসার পর বললেন জেনারেল ডোনাল্ডিস সেরাফ। ‘কাউরিস জানিয়েছে এটা একটা প্রাইভেট মীটিং হতে যাচ্ছে, জেনারেল ভালটোনা।’

আসার পথে জেনারেল ভালটোনাকে ট্যাক্সিতে তুলে নিয়েছে রানা, জানে তা না হলে জেনারেল সেরাফকে ষড়যন্ত্রটা বিশ্বাস করানো যাবে না। বিদেশী ও অচেনা দুই তরুণ-তরুণীর কথা তিনি শুনতেই বা রাজি হবেন কেন?

জেনারেল সেরাফ অত্যন্ত সুদর্শন পুরুষ, পঞ্চাশ বছর বয়সেও তরতাজা তরুণ। পরনে ইউনিফর্ম, রানার দিকে সন্দেহের চোখে তাকাচ্ছেন।

‘বাকি সবাই কি ইতিমধ্যে পৌঁছেছে, জেনারেল সেরাফ?’ জেনারেল ভালটোনা জিজ্ঞেস করলেন।

‘আশা করছি কিছুক্ষণের মধ্যে এসে পড়বেন তাঁরা।’

‘গুড। আপনি শুধু খানিকটা সময় দিন আমাদেরকে,’ বললেন ভালটোনা।

উত্তরে কিছু না বলে নিঃশব্দে ওদের তিনজনকে খুঁটিয়ে দেখছেন জেনারেল সেরাফ। ‘ঠিক আছে,’ অবশেষে নিস্তব্ধতা ভেঙে বললেন তিনি। ‘চলুন স্টাডিতে গিয়ে বসা যাক, প্লীজ।’

এক মিনিট পর প্রায় অন্ধকার একটা কামরায় ঢুকল ওরা। একজন আরদালি একদিকের পর্দা সরিয়ে দিতে আলোয় উদ্ভাসিত হয়ে উঠল স্টাডি। জেনারেল সেরাফ ভালটোনাকে ব্র্যান্ডি অফার করলেন, রানা ও তারানার জন্যে কফি এল।

‘জেনারেল,’ ভালটোনা বললেন, ‘আমি চাই মিস্টার রানা ও মিস তারানা আপনার বাড়িটা এখুনি একবার সার্চ করে দেখবেন। এখুনি মানে মীটিং শুরুর আগে…’

‘কি অদ্ভুত অনুরোধ,’ বাধা দিলেন সেরাফ। ‘কেন?’

‘যা বলছি, প্লীজ, বিশ্বাস করুন। এই মীটিং একটা ফাঁদ। সময়ে অনেক কিছু ব্যাখ্যা করা যাবে, এখন শুধু এটুকু জেনে রাখুন যে ইদানীং আপনার বিরুদ্ধে যে-সব অভিযোগ তোলা হচ্ছে তার উৎস ডাফু সালজুনাস নন। আকার্ডিয়া মারকাস নামে এক গ্রীকআে মরিকান ড্রাগ-সম্রাট সালজুনাসের নাম ব্যবহার করে সরকার ও সরকার সমর্থক সামরিক কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে জনগণকে খেপিয়ে তোলার চেষ্টা করছে। আপনি, ভিক্টর পাপাভক্সি ও গেইব্রিয়াল সেনটো আজ বিকেলে এই বাড়িতে খুন হবেন।’

শীতল ও কঠিন হয়ে উঠল অবয়ব, ভারী গলায় জেনারেল সেরাফ শুধু বললেন, ‘আই সী।’

‘আমার ধারণা, হ্যারি কাউরিসের গায়ে একটা আঁচড়ও লাগবে না,’ বললেন ভালটোনা। ‘আর সালজুনাস এখানে উপস্থিতই থাকবেন না, কারণ এ-সব কিছুর সঙ্গে কোনভাবেই তিনি জড়িত নন।’

দীর্ঘ কয়েক মুহূর্ত জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে থাকলেন জেনারেল সেরাফ। তারপর ঘাড় ফিরিয়ে জিজ্ঞেস করলেন, ‘এরা দু’জন?’

‘ওরা সাহায্য করতে এসেছেন,’ এর বেশি কিছু বললেন না ভালটোনা।

‘কি করে বুঝব আপনারাই আমাকে ফাঁদে ফেলতে আসেননি?’ জানতে চাইলেন সেরাফ।

ভালটোনা এই প্রথম গম্ভীর একটু হাসলেন। ‘জেনারেল সেরাফ,’ বললেন তিনি, ‘আপনাকে ফাঁদে ফেলে লাভ কি? লাভ খুন করলে। আর আমি যদি আপনাকে খুন করতে এসে থাকি, এখনও আপনি বেঁচে আছেন কি করে বা কেন?’

জেনারেল সেরাফ রানার চোখে তাকিয়ে যেন মাথার ভেতরটা দেখে নিচ্ছেন। ‘ঠিক আছে। আপনারা বাড়িটা সার্চ করতে পারেন। কিন্তু আমি নিশ্চিত, যে এমন কেউ ভেতরে ঢোকেনি যে আমার বা আমার বন্ধুদের কোন রকম ক্ষতি করতে চাইতে পারে।’

‘এ বাড়িতে কি বেইযমেন্ট আছে, জেনারেল?’ জানতে চাইল রানা।

‘আছে।’

‘আমরা ওখান থেকে শুরু করব,’ তারানাকে বলল রানা।

‘আপনি মিস্টার ভালটোনার সঙ্গে আলাপ করুন, জেনারেল। ওরা সবাই এসে পৌঁছানোর আগে কতটা সময় পাচ্ছি আমরা?’

‘আমার হিসাবে মিনিট পনেরো।’

‘যথেষ্ট সময়।’ তারানার দিকে ফিরল রানা। ‘চলো শুরু করা যাক।’

বড়সড় বেইযমেন্টটা দ্রুত সার্চ করে বোমা বা বিস্ফোরক কিছুই পেল না ওরা। বাড়ির বাকি অংশ চেক করেও কিছু পাওয়া গেল না। মীটিংটা বসবে স্টাডিতে, সেটায় তল্লাশী চালানো হলো সবশেষে। কোন বিস্ফোরক নেই, তবে একজোড়া ইলেকট্রনিক ছারপোকা পাওয়া গেল।

‘অবিশ্বাস্য,’ ডিভাইস দুটো দেখাতে রানাকে বললেন সেরাফ। ‘জানি না কখন এ কাজ করা হলো।’

‘ওরা প্রফেশন্যাল, জেনারেল,’ মন্তব্য করল রানা।

‘আর কিন্তু সময় নেই,’ তাগাদার সুরে বলল তারানা। ‘ওঁরা কি একসঙ্গে আসবেন?’

‘আজ সকালে ওরা যেহেতু উপদেষ্টা কমিটির হেডকোয়ার্টারে ছিলেন, একসঙ্গেও বেরুতে পারেন,’ বললেন জেনারেল সেরাফ। ‘এমনকি সঙ্গে কাউরিসও থাকতে পারে, যদিও ওঁরা কেউ তাকে একেবারেই পছন্দ করে না। আসলে এটা এক ধরনের সালিসি বৈঠক তো।’

দেখা গেল সেরাফের অনুমানই ঠিক। দশ মিনিট পর কালো একটা লিমাজিন পৌঁছাল জমিদারবাড়িতে, তিন জেনারেলই তাতে আছেন। ভিক্টর পাপাভক্সি ও গেইব্রিয়াল সেনটোর বয়স হয়েছে, পাক ধরেছে চুলে। কাউরিসের বয়স হবে চল্লিশ। তার চোখ-মুখ যেন কথা বলছে। অসম্ভব আঁটসাঁট ইউনিফর্ম পরেছে, অন্তত তিন সাইজ ছোট। সবার উদ্দেশে হাত নাড়ল সে, গলা চড়িয়ে অকারণে হাসল, যেচে পড়ে আশ্বাস দিয়ে বলছে সমস্যার একটা সুরাহা অবশ্যই করা হবে, এবং রানা তার ডান হাতে হ্যান্ডকাফ পরিয়ে দিতে বিস্ময়ে একেবারে বোবা বনে গেল।

তবে তা মাত্র দুই কি তিন সেকেন্ডের জন্যে। হাসিটা ফিরল না, তার বদলে ক্রোধ ফুটল মুখে। চোখে দেখা গেল বরফ শীতল কাঠিন্য। ‘কি করছ তুমি?’ চেঁচিয়ে উঠল সে।

জেনারেল ভালটোনা আর জেনারেল সেরাফ মৌনব্রত অবলম্বন করলেন। কাউরিসকে ধরে গায়ের জোরে ঘোরাল, তারপর হাত দুটো পিছনে এনে এক করল রানা।

‘এর মানে কি?’ গর্জে উঠল কাউরিস, রানা ও জেনারেলদের দিকে পালা করে তাকাচ্ছে। মৌনব্রত ভেঙে সেরাফ ঠাণ্ডা সুরে বললেন, ‘মিস্টার রানা বলছেন, এ-বাড়িতে আপনি আমাদেরকে খুন করতে এসেছেন।’

বাকি দুই নবাগত জেনারেল বিস্মিত ও শঙ্কিত দৃষ্টি বিনিময় করলেন। ‘কথাটা কি সত্যি, ডোনাল্ডিস?’ জানতে চাইলেন সেনটো।

‘এ সত্যি নয়! এ বানানো!’ কাউরিস চিৎকার করছে। ‘আমি জানতে চাই, কে এই লোক?’ জেনারেল সেরাফের দিকে ফিরল সে, সাংকেতিক ভাষায় হড়বড় করে কি সব বলছে আর বারবার তাকাচ্ছে রানার দিকে।

সে থামতে জেনারেল সেরাফ অবশেষে বললেন, ‘আমরা দেখব, কাউরিস।’

কাউরিসের বাহু ধরে জোরে টান দিল রানা, বলল, ‘বেশ কিছুটা সময় স্টাডিতে থাকতে হবে তোমাকে। ওখানে হয়তো সত্যি কোন সারপ্রাইজ আছে, আমাদের চোখে ধরা পড়েনি।’ মাথা তুলে জেনারেল সেরাফের দিকে তাকাল ও। ‘তারানা বাদে আপনারা সবাই হলরূমের পাশের কামরায় চলে যান, পি−জ। আমি না বলা পর্যন্ত ওখান থেকে কেউ বেরুবেন না।’

‘বেশ,’ বললেন সেরাফ।

জেনারেলরা পাশের রূমে ঢুকে পড়লেন। রানা ও তারানা স্টাডিতে নিয়ে এসে চেয়ারের সঙ্গে বাঁধল কাউরিসকে, তারপর মুখে টেপ লাগিয়ে দিল। তার কোমর থেকে পিস্তলটা টেনে নিয়ে বেল্টে গুঁজল রানা, তারানাকে নিয়ে আবার হলরূম হয়ে অ্যান্টিরূমে বেরিয়ে এল।

‘এখন অপেক্ষা?’ জিজ্ঞেস করল তারানা।

তার দিকে তাকাল রানা। চুল খোঁপা করা হয়েছে, বেল-বটম প্যান্টস সুটে মানিয়েওছে ভাল। পার্স থেকে বেলজিয়ান অস্ত্রটা বের করে অ্যামুনিশন চেক করছে সে। ‘হ্যাঁ,’ বলল রানা। ‘আমরা অপেক্ষা করব।’ হেঁটে এসে সদর দরজাটা খুলে বাইরে তাকাল ও। দীর্ঘ ড্রাইভওয়ের দু’পাশের লম্বা পপলার গাছের সারি আকাশ ছুঁয়েছে। পথটা প্রায় এক মাইল এগিয়ে প্রধান রাস্তায় মিশেছে, জমিদারবাড়ির কাছাকাছি ওই একটাই রাস্তা। একসঙ্গে কয়েকজনকে হত্যা করার জন্যে আদর্শ একটা জায়গা। প্রশ্ন হলো, মারকাসের বিকৃত মস্তিষ্ক ঠিক কি পদ্ধতির কথা ভেবেছে? কাউরিসকে ইন্টারোগেট করা যায়, কিন্তু সময় নেই। তাছাড়া লোকটার চেহারা দেখে বোঝা যায়, মারকাসকে সাংঘাতিক ভয় পায় সে।

পিছনে এসে রানার পিঠে শরীরটা ঠেকাল তারানা।

‘নিজেদেরকে আমরা খুব কমই সময় দিতে পারলাম, রানা,’ নিচু গলায় বলল সে।

‘জানি,’ বলল রানা। ‘তুমি চাইলে আর আমি ছুটি পেলে মেক্সিকোয় কিংবা মালদ্বীপে বেড়াতে যেতে পারি।’

‘আমি এখনই তোমাকে বুক করে রাখলাম…’

‘চুপ!’ সাবধান করল রানা। এঞ্জিনের আওয়াজ পাচ্ছে ও। দূরের বাঁকে বেরিয়ে এলো কালো একটা সেডান, তীরেবেগে ছুটে আসছে। গাড়িটার মাথায় আলোর আয়োজন দেখা যাচ্ছে।

‘পুলিস!’ বলল তারানা।

‘হ্যাঁ,’ ধীরে ধীরে নিঃশ্বাস ছাড়ল রানা। ‘তোমার কি ধারণা, মারকাস একজন পুলিস কর্মকর্তাকে কিনে নিয়েছে?’

‘অসম্ভব কি।’

‘তবে পুলিসের সঙ্গে নিজের দু’একজন লোককেও নিশ্চয় পাঠিয়েছে মারকাস।’

এক ছুটে জেনারেলদের কাছে ফিরে এলো ওরা। ‘পুলিসের একটা গাড়ি আসছে,’ দ্রুত তাঁদেরকে জানাল রানা। ‘এটা মারকাসের একটা চাল হতে পারে। আপনারা সবাই সশস্ত্র তো?’

জেনারেল ভালটোনা বাদে সবাই মাথা ঝাঁকালেন। কাউরিসের পিস্তলটা তাঁর হাতে ধরিয়ে দিল রানা। ‘যতটা সম্ভব স্বাভাবিক থাকুন, ভাব দেখান এখানে বসে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে আলোচনা করছেন। তবে চোখের আড়ালে অস্ত্র তৈরি রাখবেন। তারানা, তুমি ওই দেয়াল-আলমিরার ভেতর ঢুকে পড়ো।’ সঙ্গে সঙ্গে সেদিকে পা বাড়াল তারানা।

‘আমি এই ফ্রেঞ্চ ডোর-এর ঠিক বাইরে থাকছি,’ আবার বলল রানা। ‘ওরা সবাই কামরায় ঢোকার পর আমরা অস্ত্র বের করে সারেন্ডার করতে বলব।’ এক মুহূর্ত বিরতি নিল ও। ‘এখন যদি কেউ আপনারা এখানে থাকতে না চান, পিছনের দরজা দিয়ে চলে যেতে পারেন।’

অফিসারদের চেহারা থমথম করছে। কেউ তাঁর চেয়ার ছেড়ে লড়লেন না।

‘ঠিক আছে,’ বলল রানা। ‘আমরা চেষ্টা করব যাতে গোলাগুলি না হয়। তবে আমার ইঙ্গিত পেলে গুলি করতে ইতস্তত করবেন না।’

ফ্রেঞ্চ ডোর দিয়ে বেরিয়ে যাচ্ছে রানা, দড়াম করে সদর দরজা খোলার আওয়াজ ভেসে এল। একজন আরদালি পুলিসকে বাধা দেয়ার চেষ্টা করল, কড়া ধমক দিয়ে সরিয়ে দেয়া হলো তাকে। তালাবদ্ধ স্টাডি রূমের দরজায় ঘুসি ও লাথি মারার আওয়াজ পেল রানা, ওখানে মুখে টেপ লাগিয়ে চেয়ারের সঙ্গে বেঁধে রাখা হয়েছে হ্যারি কাউরিসকে। তারপর আবার আরদালির গলা ভেসে এল। তার সঙ্গে কথা বলছে কয়েকজন লোক। এক মুহূর্ত পরই তাদেরকে পরিষ্কার দেখতে পেল রানা। ঝড়ের বেগে কামরাটায় ঢুকল তারা। সব মিলিয়ে ছ’জন-পাঁচজনের পরনে ইউনিফর্ম, একজন সিভিল ড্রেসে। উর্দি পরা সবার বেল্টে পিস্তল আছে।

‘এ-সবের মানে কি?’ জেনারেল ডোনাল্ডিস সেরাফ প্রশ্ন করলেন; দাঁড়াচ্ছেন ঠিকই, তবে হাতের অস্ত্র পিছনে লুকিয়ে রেখেছেন।

সাদা পোশাক সামনে বাড়ল, ইউনিফর্ম পরা একজন লেফটেন্যান্ট তার পাশে থাকল। সাদা পোশাক মারকাসের পোষা লোক, তাকে রানা পেন্টহাউসে দেখেছে। লেফটেন্যান্ট সম্ভবত মারকাসের কোন পুলিস সদস্য। ব্যাপারটায় বিশ্বাসযোগ্যতা আনতে হলে আসল পুলিস দরকার। সাজানো ঘটনা, বিশেষ করে সেজন্যেই কোনও খুঁত রাখা যাবে না-অন্তত প্রেসকে ঠিকমত গেলাতে হবে।

‘আমরা আপনাকে এখানে আশা করিনি, জেনারেল ভালটোনা,’ লেফটেন্যান্ট বলল। কামরার চারদিকে তাকাল সে, সম্ভবত জেনারেল কাউরিসের খোঁজে। ‘রাষ্ট্রদ্রোহিতার অভিযোগে আপনাকে গ্রেফতার করা হলো। আমাদের কাছে প্রমাণ আছে এখানে আপনারা কয়েকটা বিদেশী কোম্পানির পাঠানো একজন প্রতিনিধির সঙ্গে দেশের সমস্ত খনিজ সম্পদ বিক্রি করার ষড়যন্ত্র চূড়ান্ত করতে বসেছেন।’ মুখে যাই বলুক, অত্যন্ত নার্ভাস দেখাচ্ছে তাকে। ‘সংক্ষেপে, কি পরিমাণ ঘুষ পেলে সরকারকে সমর্থন করবেন, তারই আলোচনা চলছে এখানে।’

‘এ সম্ভব নয়,’ বললেন জেনারেল সেরাফ।

‘আপনারা সবাই বেঈমান,’ চিৎকার করে বলল লেফটেন্যান্ট।

‘আর বেঈমানদের একটাই শাস্তি-মৃত্যুদণ্ড।’ দরজার আড়াল থেকে তাকে পিস্তল বের করতে দেখছে রানা।

মারকাসের পোষা লোকটার ঠোঁটে টান টান হাসি, যেন আর টেনেও রাবার বড় করা যাচ্ছে না। ‘এবং মৃত্যুদণ্ড কার্যকরী করা হবে এখানেই,’ ইংরেজিতে বলল সে, ‘যখন আপনারা গ্রেফতার হতে বাধা দেবেন।’

‘কই, না! আমরা তো কেউ গ্রেফতার হতে বাধা দিচ্ছি না,’ তরুণ লেফটেন্যান্টকে বললেন জেনারেল সেরাফ।

‘বাধা দিচ্ছেন না?’ মারকাসের গুণ্ডা হাসল। ‘তাতে কি? বাধা না দিলেও পুলিসের রিপোর্টে লেখা হবে বাধা দিয়েছেন। রেডিওটিভিে ত দেশের লোক শুনবেও তাই, গ্রেফতার এড়াতে বাধা দেয়ায় পুলিসের গুলি খেয়ে মারা গেছেন আপনারা।’

লেফটেন্যান্ট তার পিস্তল জেনারেল সেরাফের দিকে তাক করল। রানা ধারণা করল, আর এক মুহূর্তের মধ্যে তার সংকেত পেয়ে বাকি পুলিস অস্ত্র বের করবে। মারকাসের প্রতিনিধি জ্যাকেটের ভেতর হাত ভরে লেফটেন্যান্টের উদ্দেশে মাথা ঝাঁকাল। নিজের লোকদের দিকে ঘুরল লেফটেন্যান্ট। দ্রুত চওড়া দরজার মাঝখানে এসে দাঁড়াল রানা, হাতের ওয়ালথারটা সোজা লেফটেন্যান্টের বুকে তাক করা।

‘ফ্রিজ!’ কঠিন নিরেট নিস্তব্ধতা যেন ফাটিয়ে দিল একটি মাত্র তীক্ষ্ন শব্দ। তারপরই গুরুগম্ভীর আদেশ, ‘কেউ নড়বে না!’ রানাকে দেখে হতচকিত, বিহ্বল হয়ে পড়েছে লেফটেন্যান্ট।

মারকাসের লোকটা তার অস্ত্র এখনও ঠিকমত ধরতে পারেনি, আর পুলিসদের মধ্যে মাত্র দু’জন হোলস্টারের কাছাকাছি হাত নিয়ে যেতে পেরেছে। সবাই স্থির হয়ে আছে। সবগুলো চোখ রানার ওপর।

‘পিস্তল ফেলে দাও,’ লেফটেন্যান্টকে নির্দেশ দিল রানা। ‘আর তুমি, জ্যাকেটের ভেতর থেকে ধীরে ধীরে হাতটা বের করো।’ রানার নির্দেশ কেউ মানল না। তারা হিসাব কষছে ওকে গুলি করলে কতটা মাসুল গুনতে হবে। তাদের বাঁ দিক থেকে দেয়াল- আলমারির দরজা খুলে গেল, হাতে বেলজিয়ান রিভলভার নিয়ে বাইরে বেরুল তারানা-সাদা পোশাকের মাথার দিকে তাক করা।

‘বোকামি কোরো না,’ কঠিন সুরে বলল সে। ‘ও যা বলছে শোনো।’

মারকাসের গুণ্ডা আর পুলিস লেফটেন্যান্ট তারানার দিকে তাকিয়ে আছে, রাগ ও হতাশা প্রায় পাল্লা দিয়ে দখল করে নিচ্ছে দু’জনের চেহারা। তাদের দিকে তীক্ষ্নদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে রানা, বোঝার চেষ্টা করছে কি করতে চায় তারা। এই সময় ঘরের ভেতর যেন নরক ভেঙে পড়ল।

হাতের অস্ত্র ফেলল না, তার বদলে রানার বুকে তাক করল, লেফটেন্যান্টের ট্রিগারে জড়ানো আঙুলটা টান-টান শক্ত হয়ে উঠছে। অকস্মাৎ ট্রিগার টেনে দিতে যাচ্ছে, বুঝতে পেরে মেঝেতে ঢলে পড়তে শুরু করল রানা। তার হাতে কামানের মত গর্জে উঠল পিস্তলটা, সেই সঙ্গে তীব্র জ্বালা ও প্রচণ্ড গরম ছ্যাঁকা খাওয়ার অনুভূতি হলো রানার বাম বাহুতে। ওকে ছুঁয়ে ফ্রেঞ্চ ডোর-এর কাঁচ চুরমার করে দিল বুলেটটা। মেঝেতে পড়ে গড়িয়ে একটা চেয়ারের পিছনে চলে এলো রানা, লেফটেন্যান্টের দ্বিতীয় বুলেট চেয়ারটার একটা পায়ায় লাগল।

‘কিল হিম!’ চিৎকার করছে লেফটেন্যান্ট। ‘কিল দেম অল!’ লেফটেন্যান্ট যখন রানাকে গুলি করছে, মারকাসের লোকটার হাতে কালো চকচকে একটা পিস্তল বেরিয়ে এল; সে লক্ষ্যস্থির করল সরাসরি তারানার মাথায়। তারানাই আগে গুলি করল, কিন্তু লোকটা মেঝেতে একটা হাঁটু ঠেকিয়ে নিচু হওয়ায় বুলেটটা তাকে লাগল না, লাগল তার পিছনে দাঁড়িয়ে থাকা এক পুলিসের উরুতে। উরুর হাড় গুঁড়িয়ে গেছে, অন্তত চিৎকার শুনে তাই মনে হলো। মেঝেতে পড়ে গড়াগড়ি খাচ্ছে সে।

বাকি দুই পুলিস কুঁজো হয়ে আছে, অস্ত্র পুরোপুরি বের করতে পারেনি। আহত লোকটার সঙ্গে একজন পুলিসও শরীরটাকে গড়িয়ে দিয়ে হালকা কিছু ফার্নিচারের আড়ালে চলে গেল। জেনারেল ভালটোনা আর আমন্ত্রিত দুই জেনারেল এখনও স্থির মূর্তির মত দাঁড়িয়ে আছেন, তবে জেনারেল সেরাফ এখন লুকানো পিস্তল সামনে এনে লেফটেন্যান্টকে গুলি করলেন। পায়ে যেন চাকা গজিয়েছে, পাক খেয়ে পড়ে গেল লেফটেন্যান্ট সঙ্গে একটা টেবিলকে নিয়ে।

একসঙ্গে কয়েকটা অস্ত্র গর্জে উঠল। জেনারেল সেরাফ পুলিসদের একজনকে ফেলে দিলেন। মারকাসের প্রতিনিধি তারানাকে গুলি করতে যাচ্ছে দেখে মেঝেতে বসতে চেষ্টা করছে রানা; পর পর দুটো গুলি করে লোকটার কপাল আর গলা ফুটো করে দিল তারানা। রানার ওয়ালথার ঘুরে গিয়ে দু’বার গর্জে উঠল। দু’জন পুলিস বিদায় নিল দুনিয়া থেকে।

আহত লেফটেন্যান্ট হাঁটুর ওপর সিধে হয়ে জেনারেল সেরাফকে গুলি করতে যাচ্ছে দেখে লাফ দিয়ে সিধে হলো রানা, বলল, ‘খবরদার!’

লেফটেন্যান্টের দেখাদেখি বাকি পুলিস অস্ত্র ফেলে দিয়ে মাথার ওপর হাত তুলল। পড়ে থাকা লাশগুলোর ওপর চোখ বুলিয়ে রানার দিকে তাকাল লেফটেন্যান্ট। ‘এ একটা বীভৎস হত্যাযজ্ঞ!’ কর্কশ, বেসুরো গলায় চিৎকার করছে সে। ‘পুলিসকে বৈধ আইন প্রয়োগের কাজে বাধা দিয়েছ তুমি, কর্তব্য পালনরত অবস্থায় পুলিস সদস্যদের খুন করেছ। ভেবো না তুমি এর শাস্তি এড়াতে পারবে…’

উত্তরে তার মাথায় পিস্তলের প্রচণ্ড এক বাড়ি মারল রানা। লোকটা পড়ে যেতে একটা লাথি কষল পাঁজরে। ‘শালা, আইন শেখাও, না?’

বাকি দুই পুলিসের হাতে হ্যান্ডকাফ পরিয়ে দিলেন আমন্ত্রিত দুই জেনারেল। লেফটেন্যান্টের হাতে ওটা পরালেন জেনারেল সেরাফ। তারানা দেয়ালে হেলান দিয়ে একটু জোরে জোরে নিঃশ্বাস ফেলছে। ‘তারানা?’ ডাকল রানা।

একটা হাত তুলে আশ্বস্ত করল তারানা। ‘আমি ঠিক আছি, রানা।’

‘আপনাকে বিশ্বাস করায় আমি খুশি, মিস্টার রানা,’ এগিয়ে এসে বললেন জেনারেল সেরাফ, হাতটা বাড়িয়ে দিলেন হ্যান্ডশেক করার জন্যে। ‘আমরা সবাই আপনার প্রতি চিরঋণী হয়ে থাকলাম।’

‘প্রাণে তো বাঁচলামই,’ বললেন জেনারেল পাপাভক্সি, ‘কে কি ষড়যন্ত্র করেছিল তাও পরিষ্কার জানতে পারলাম।’

‘পুলিস কমিশনারের সঙ্গে যোগাযোগ করছি আমি,’ বললেন জেনারেল সেরাফ। ‘দেখা যাক সব শুনে তাঁর কি পঙতিক্রিয়া হয়।’

‘আপনাদের কাছে আমি চব্বিশ ঘণ্টা সময় চাই, জেনারেল সেরাফ,’ বলল রানা। ‘তারপর যার সঙ্গে খুশি যোগাযোগ করবেন। অক্টোপাসের মাথাটা এখনও জ্যান্ত, ঘুরে বেড়াচ্ছে। তাকে আমরা কাবু না করা পর্যন্ত আপনারা পুরোপুরি নিরাপদ নন। আর আপনাদের নিরাপত্তা না থাকলে সরকারেরও কোন নিরাপত্তা নেই।’

জেনারেল ভালটোনার দিকে তাকালেন জেনারেল সেরাফ। ভালটোনা ছোট্ট করে মাথা ঝাঁকালেন। রানার দিকে ফিরে সেরাফ বললেন, ‘ঠিক আছে। চব্বিশ ঘণ্টা, তার বেশি নয়, কেমন? তারপর আমাদের যা করার আমরা তা করব।’

‘ফেয়ার এনাফ,’ বলল রানা। ‘কাল এই সময়ের মধ্যে আমরা যদি মারকাসকে না পাই, নিজস্ব পদ্ধতিতে এগোবেন আপনারা।’

‘গুড লাক।’ আরও একবার হ্যান্ডশেক করলেন জেনারেল সেরাফ।

Super User