ফিরে এসে ওরা দেখল হোটেল স্যুইটের সিটিংরূমে পায়চারি করছেন ডাফু সালজুনাস। পরিষ্কারই বোঝা গেল, দেরি হচ্ছে দেখে তিনি ধরে নিয়েছিলেন যে ওরা আর ফিরছে না। ‘জেনারেলরা সবাই ভাল আছেন?’ জিজ্ঞেস করলেন, চেহারায় স্বস্তির ছাপ।

‘হ্যাঁ, সবাই ভাল,’ বলল রানা।

‘আর অ্যালেক্সিস?’

‘তিনিও বহাল তবিয়তে আছেন,’ তারানা বলল। ‘আমাদেরকে আসলে ভাগ্য সাহায্য করেছে। কেউ খুন হইনি, এটাই আশ্চর্য।’ ‘ঈশ্বরকে ধন্যবাদ,’ বললেন সালজুনাস।

‘জেনারেল ভালটোনা সাহায্য করায় কাজটা আমাদের জন্যে অনেক সহজ হয়ে যায়,’ বলল রানা।

‘অ্যালেক্সিস ভাল একটা কাজে অংশগ্রহণ করায় আমি খুশি। আতাতায়ী যারা বেঁচে গেছে, তাদেরকে গ্রেফতার করা হয়েছে তো?’

‘তাদেরকে আটক করা হয়েছে, তবে অফিশিয়ালি গ্রেফতার করা হয়নি,’ বলল রানা। ‘জেনারেলদের কাছে চব্বিশ ঘণ্টা সময় চেয়েছি আমি। এই সময়ের মধ্যে আমরা যদি মারকাসকে ধরতে না পারি, ওঁরা নিজেরা যা করার করবেন।’

এক মুহূর্ত চুপ করে থেকে সালজুনাস বললেন, ‘আমি ঠিক এধরে নর গোপনীয়তা পছন্দ করি না। তবে আপনার ওপর পূর্ণ আস্থা আছে আমার, তাই আপত্তিও করছি না। ঠিক আছে, আমিও আগামী চব্বিশ ঘণ্টা মুখে কুলুপ এঁটে রাখব।’

‘ধন্যবাদ, মিস্টার সালজুনাস।’

‘কিন্তু মারকাসকে আপনি ধরবেন কিভাবে?’ জিজ্ঞেস করলেন ভদ্রলোক। ‘পেন্টহাউসে যাওয়া মানে তো আত্মহত্যা করা।’

‘হয়তো তাই,’ বলল রানা। ‘কিংবা হয়তো তা নয়-বিশেষ করে আমি আর আপনি যখন জায়গাটা সম্পর্কে প্রায় সবকিছুই জানি।’

‘কখন যেতে চান?’

‘আজ সন্ধ্যায়।’ তারানার দিকে একবার তাকাল রানা। ‘কি, রাজি তো?’

‘তুমি যা বলো, রানা।’

‘ইতিমধ্যে মারকাস ভাবতে শুরু করেছে তার পাঠানো লোকটা কোন খবর দিচ্ছে না কেন। এক সময় সে নিশ্চিত হবে, কিছু একটা গোলমাল হয়েছে বা ব্যাপারটা কেঁচে গেছে। এই নিশ্চিত না হওয়া পর্যন্ত পেন্টহাউসে থাকবে সে। কাজেই সন্ধ্যায় ওকে ওখানেই পাব আমরা।’

রানা থামতে বিলিওনেয়ার ব্যবসায়ী বললেন, ‘আপনি নিজেই আর্মি গার্ড দেখে এসেছেন। আমার সন্দেহ হচ্ছে করিডর পর্যন্ত পৌঁছাতে পারবেন কিনা।’

রানা হাসল। ‘অত চিন্তা করবেন না। আমরা পেন্টহাউসে ঢুকব ঠিকই, তবে অবশ্যই আত্মহত্যা করতে নয়।’

একটু যেন কৌতুক বোধ করলেন সালজুনাস। ‘আপনার কথা শুনে মনে হচ্ছে গুটানো আস্তিনে কিছু লুকানো আছে!’

হেসে ফেলল রানা। ‘আছেই তো। তৃতীয় একজন আমাদেরকে সাহায্য করবে। জেনারেল সেরাফের ওখানে যাবার আগে আমি আমার ইনভেস্টিগেটিভ ফার্মের সঙ্গে যোগাযোগ করেছিলাম। একজন অপারেটরের সাহায্য নিচ্ছি।’

‘কিন্তু তারপরও আপনারা মাত্র তিনজন,’ বললেন সালজুনাস। ‘ওদের তুলনায় তিনগুণ ছোট একটা ফোর্স।’

হেসে উঠে তারানা বলল, ‘তিনজন তো রীতিমত ভিড়! মিস্টার সালজুনাস, আপনি জানেন না-রানা সব সময় একা কাজ করতে পছন্দ করে। এবার কি ভাগ্যি আমাদের…’

রানাও হেসে উঠে বলল, ‘আমার একটা প্ল্যান আছে, তাতে সংখ্যায় আমরা চারজনও হতে পারি।’

‘চার?’ সালজুনাসকে বিব্রত দেখাল। ‘আপানি যদি আমার কথা ভেবে থাকেন, ভুলে যান। আমি এমনকি পিস্তল পর্যন্ত ছুঁড়তে জানি না।’

‘আপনি নন,’ বলল রানা। ‘এথেন্সে আসার পথে প্লেনে আপনি আমাকে একটা কথা বলেছিলেন, আমার মনে সেটা গেঁথে আছে।’

‘কি বলেছিলাম?’ সালজুনাস জিজ্ঞেস করলেন।

‘বলেছিলেন আপনার নিহত সেক্রেটারি গিলি ক্ল্যাসিকসের যমজ এক ভাই আছে, দুই ভাই হুবহু প্রায় একই রকম দেখতে।’

‘হ্যাঁ,’ বললেন সালজুনাস। ‘বেচারা ভোলি এখনও জানে না যে তার ভাই খুন হয়ে গেছে। দেখা-সাক্ষাৎ খুব কম হত, তবে যমজ বলেই বোধহয় পরস্পরের প্রতি খুব টান ছিল।’

‘দু’জনের চেহারা কতটুকু মেলে?’ জানতে চাইল রানা।

‘প্রায় সবটুকুই। গিলি মাত্র পাঁচ মিনিটের ছোট ছিল ভোলির চেয়ে। পার্থক্য? গিলি ছিল ভোলির চেয়ে এক ইঞ্চি বেশি লম্বা, সামান্য একটু মোটাও।’

‘ও-সব ঠিক করে নেব,’ আপনমনে বিড়বিড় করল রানা।

‘ভোলি ক্ল্যাসিকস কি এথেন্সে থাকে? ফোনে তার সঙ্গে যোগাযোগ করা সম্ভব?’

‘শহরের বাইরে, ছোট্ট এক গ্রামে।’ রানার দিকে একদৃষ্টে তাকিয়ে আছেন ভদ্রলোক। ‘তার পাশের বাড়িতে ফোন করে দেখতে পারি।’

‘যোগাযোগ করা সম্ভব হলে তাকে আপনি জানান যে গিলি ক্ল্যাসিকস খুন হয়েছে,’ বলল রানা। ‘তারপর জিজ্ঞেস করুন, সে ভ্রাতৃহত্যার প্রতিশোধ নিতে চায় কিনা।’

তারানা বলল, ‘রানা, তুমি কি…’

তাকে থামিয়ে দিল রানা। ‘মারকাস যদি নকল বা জাল লোক ব্যবহার করতে পারে, আমরা পারব না কেন? মরা মানুষের প্রতিনিধিত্ব একা শুধু ইউসুফিস জিয়ানিই করতে পারে?’

‘তারমানে তিন নম্বর গিলি ক্ল্যাসিকস?’ জিজ্ঞেস করল তারানা।

‘হ্যাঁ, তিন নম্বর। বলা যায় না, সত্যি বলা যায় না, সে হয়তো আমাদেরকে পেন্টহাউসে নিয়ে যেতে পারবে।’ সালজুনাসের দিকে ফিরল রানা, ‘চেষ্টা করে দেখবেন ফোনে তাকে পাওয়া যায় কিনা?’

এক মুহূর্ত ইতস্তত করে সালজুনাস মাথা ঝাঁকালেন। ‘হ্যাঁ, অবশ্যই। তাকে আমি সরাসরি এখানে চলে আসতে বলছি।’

দু’ঘণ্টা পর সন্ধ্যার ঠিক আগে, ভোলি ক্ল্যাসিকস ওদের হোটেল স্যুইটে এসে হাজির হলো। নিরীহ, আত্মভোলা টাইপের মানুষ সে; তবে সালজুনাসের মুখে সব কথা শোনার পর ভ্রাতৃহত্যার প্রতিশোধ নেবে বলে দৃঢ় শপথ গ্রহণ করেছে। তাকে একজোড়া এলিভেটর শূ পরতে দিল রানা, শরীরের বিশেষ বিশেষ জায়গায় সাঁটার জন্যে কিছু স্পঞ্জের প্যাডও দিল, সবশেষে মেকআপ নিতে সাহায্য করল। যা-ও বা একটু পার্থক্য ছিল, এ-সবের পর তা-ও আর থাকল না-ভোলি অবশ্য হুবহু তার নিহত ভাই গিলির মত দেখতে হয়নি, হয়েছে পেন্টহাউসে রানার দেখা গিলির নকলটার মত। ভোলিকে ওই জাল লোকটার ভূমিকা নিতে হবে, ভাই গিলির ভূমিকা নয়। রানা চাইছে পেন্টহাউসের লোকেরা ভোলিকে যেন ইউসুফিস জিয়ানি হিসেবে গ্রহণ করে।

পিছিয়ে এসে সালজুনাসকে প্রশ্ন করল রানা, ‘কি মনে হচ্ছে?’

‘গিলির সঙ্গে খুবই মিল দেখছি, ফলে জিয়ানির সঙ্গেও,’ মন্ত ব্য করলেন সালজুনাস।

ওদের নিজস্ব নকল লোক চোখে-মুখে অনিশ্চিত একটা ভাব নিয়ে রানার দিকে তাকাল, একটু হেসে নার্ভাস ভঙ্গিতে বলল, ‘আপনি তো ভালই করেছেন, এখন আমি কেমন করি সেটাই হলো কথা।’ তার আর জিয়ানির কণ্ঠস্বর ও ইংরেজি উচ্চারণ প্রায় একই মানের।

‘শুধু মনোবলটা ধরে রাখবেন,’ পরামর্শ ও আশ্বাস দিয়ে বলল তারানা, ‘দেখবেন বাকি সব পানির মত সহজ হয়ে গেছে।’

এক ঘণ্টা পর কোলোসস বিল্ডিঙের কাছে গাড়ি থামাল ওরা। এথেন্সে এখন ডিনার খাওয়ার সময়, রাস্তায় যানবাহন খুবই কম। বিল্ডিংটা প্রায় অন্ধকার হয়ে আছে, শুধু লবি আর আকাশের কাছাকাছি পেন্টহাউসে কয়েকটা উৎস থেকে আলোর আভা ছড়াচ্ছে। রেন্ট-আ-কারের কালো মার্সিডিজে বসে অপেক্ষা করছে ওরা। দশ মিনিট পর বিল্ডিঙের কোণ ঘুরে এক দীর্ঘদেহী তরুণকে হেঁটে আসতে দেখা গেল। সরাসরি গাড়ির দিকে এলো সে, দরজা খুলে ফ্রন্ট সিটে রানার পাশে উঠে বসল। তারানা ও ভোলি ব্যাক সিটে বসেছে। সালজুনাসকে হোটেলে রেখে এসেছে ওরা।

‘ভাল আছেন, মাসুদ ভাই?’ সবিনয়ে প্রশ্ন করল দীর্ঘদেহী তরুণ, ঘাড় ফিরিয়ে তারানা আর ভোলিকে একবার দেখে নিল। রানা এজেন্সির এথেন্স শাখার প্রধান সে।

‘হ্যাঁ, ভাল। তুমি, বাবুল?’

‘ভাল, মাসুদ ভাই।’

‘কিছু ঘটছে?’ জিজ্ঞেস করল রানা।

‘না। আমি আসার পর থেকে কেউ ঢোকেওনি, কেউ বেরোয়ওনি।’ রানার নির্দেশে গত প্রায় তিন ঘণ্টা ধরে বাবুল চৌধুরী বিল্ডিংটার ওপর নজর রাখছিল-ঠিক বিল্ডিংটার ওপর নয়, কাঁচের ভেতর দিয়ে স্পেশাল এলিভেটরটার ওপর।

তারানা ও ভোলির সঙ্গে বাবুলের পরিচয় করিয়ে দিল রানা। তারপর বলল, ‘সার্ভিস ডোর দিয়ে লবিতে ঢুকব আমরা।’ মুঠো খুলে একটা চাবি দেখাল। ‘প্রথমে ঢুকবেন ভোলি। হাবভাব দেখে মনে হবে আমরাই যেন এই বিল্ডিঙের মালিক। ওপরে পৌঁছাতে পারলে কি করতে হবে আগেই বুঝিয়ে দিয়েছি। কারও কোন প্রশ্ন আছে?’

অন্ধকার গাড়ির ভেতর কেউ কোন শব্দ করল না।

কালো মার্সিডিজ থেকে নেমে বিল্ডিংটার দিকে এগোল চারজন। মেইন গেটের বাম দিকে তালা দেয়া একটা গ−াস সার্ভিস ডোর রয়েছে, সেটার সামনে আঁটসাঁট হয়ে দাঁড়াল ওরা। সালজুনাসের কাছ থেকে পাওয়া চাবিটা রানার কাছ থেকে নিয়ে তালায় ঢোকাল ভোলি ক্ল্যাসিকস, তারপর ঘোরাল। লবিতে, এলিভেটরের পাশে, একটা টুলে বসা গার্ড ওদের দিকে তাকিয়ে হাঁ হয়ে গেল।

প্রথমে ভোলি ঢুকল, তার পিছু নিয়ে বাকি সবাই। রানা ভাবছে, সত্যি কি ওরা মারকাসকে বিস্ময়ের একটা ধাক্কা দিতে পারবে? এই মুহূর্তে মেঝেতে পায়চারি করার কথা তার, কর্নেল সেরাফের বাড়িতে কি ঘটেছে শোনার অপেক্ষায়। রানা আশা করছে নিজের একদল লোককে এত তাড়াতাড়ি ওখানে ইনভেস্টিগেট করতে পাঠাবে না সে। তবে গত দু’দিনে পারাকাটুতে যোগাযোগ করে থাকতে পারে। কেউ সাড়া না দেয়ায় মারকাস ধরে নেবে ওখানে খারাপ কিছু ঘটেছে।

এলিভেটরের কাছে গার্ডের সামনে পৌঁছাল ওরা। এখনও ভোলির দিকে হাঁ করে তাকিয়ে আছে সে।

‘কোথায় ছিলেন আপনি?’ অবশেষে বিস্ময়ের ঘোর কাটিয়ে জিজ্ঞেস করল গার্ড।

‘এঁরা জার্নালিস্ট,’ বলল ভোলি, শুরু হলো তার নতুন ভূমিকায় অভিনয়। ‘মাত্র কয়েক ঘণ্টা আগে ভয়ঙ্কর এক ঘটনা ঘটে গেছে বলে শুনেছেন। উপদেষ্টা জেনারেলরা নাকি খুন হয়ে গেছেন। এই খবর পুলিসই ওঁদেরকে জানিয়েছে। এ-ব্যাপারে মিস্টার ডাফু সালজুনাসের পঙতিক্রিয়া জানার জন্যে এসেছেন এঁরা। ওপরে নিয়ে গিয়ে কথা যা বলার আমিই বলব…’

ডান বগলের নিচে ছুরিটার অস্তিত্ব অনুভব করছে রানা, ভাবছে এখুনি ওটা ব্যবহার করতে হবে কিনা। গার্ড যদি বেশ খানিক আগে এখানে ডিউটি দিতে এসে থাকে, তার জানার কথা ইউসুফিস জিয়ানি বিল্ডিং ছেড়ে বেরোয়নি।

‘ঠিক আছে,’ বলল গার্ড। ‘এলিভেটর নামাচ্ছি।’

দেয়ালে আটকানো বোর্ডের দিকে হাত তুলল সে, একটা বোতামে চাপ দিতে পেন্টহাউস থেকে ধীরগতিতে নিচে নামতে শুরু করল এলিভেটর। গ্রাউন্ড ফ্লোরে পৌঁছাতে যেন প্রায় এক যুগ লেগে গেল। তবে একসময় দরজা খুলল। এর আগে যে অপারেটরকে পেয়েছিল রানা, আজও সে-ই ডিউটি দিচ্ছে। এলিভেটরে চড়ল ওরা। অপারেটর এমনভাবে ভোলির দিকে তাকিয়ে আছে যেন ভূত দেখছে। ওদের পিছনে দরজা বন্ধ হয়ে গেল, কিন্তু অপারেটর বোতাম টিপে ওদেরকে ওপরে নিয়ে যাচ্ছে না।

‘আমি জানতাম না যে আপনি বিল্ডিঙের বাইরে ছিলেন,’ বলল অপারেটর, গভীর মনোযোগের সঙ্গে খুঁটিয়ে দেখছে ভোলিকে।

‘এখন জানলে,’ গলায় বিরক্তি ফুটিয়ে বলল ভোলি। ‘এই জার্নালিস্টদের সঙ্গে দেখা করার জন্যে নিচে নামতে হয়েছিল। তাড়াতাড়ি ওপরে নিয়ে চলো। ওঁদেরকে একটা সাক্ষাৎকার দিচ্ছি আমি।’

অপারেটর এখনও ভোলির দিকে একদৃষ্টে তাকিয়ে আছে, চোখে সন্দেহ। ‘তার আগে ওপরতলার সঙ্গে একটু কথা বলে নিই আমি।’

‘মানে? কি বলতে চাও তুমি?’ রেগে উঠল ভোলি।

কিন্তু তার রাগ গ্রাহ্য না করে কার-এর পাশে বসানো কমিউনিকেশন প্যানেল-এর দিকে ঘুরে গেল অপারেটর। বাবুলের উদ্দেশ্যে মাথা ঝাঁকাল রানা। সঙ্গে সঙ্গে তার হাতে একটা ল্যুগার বেরিয়ে এল। অপারেটর তার নড়াচড়া দেখে ফেলে ঘুরতে যাচ্ছে, কপালে ল্যুগারের শক্ত বাড়ি খেয়ে জ্ঞান হারিয়ে ঢলে পড়ল।

কন্ট্রোল-এর দিকে পা বাড়াল তারানা।

‘তাড়াতাড়ি!’ তাগাদা দিল রানা।

পেন্টহাউসে ওঠার সময় অপারেটরের অসাড় দেহটা এলিভেটরের এক কোণে সরিয়ে রাখল ওরা, দরজা খুলে চারজন বেরিয়ে যাবার সময় কেউ তাকালে লোকটাকে যাতে তখুনি দেখতে না পায়। কয়েক সেকেন্ড পর পেন্টহাউস করিডরে পৌঁছে এলিভেটরের দরজা খুলে গেল।

রানা যেমন সন্দেহ করেছে, আজও দু’জন লোক ডিউটি দিচ্ছে। একজনের চুল সোনালি, তাকে রানা আগে দেখেছে। এরা পেশাদার অস্ত্রবাজ, বেশি ঝুঁকি নিতে রাজি নয় রানা। ডেস্কটা পেন্টহাউসে ঢোকার মুখে, চেয়ার ছেড়ে দাঁড়াচ্ছে সোনালি চুল। তার সঙ্গী বসে থাকল, দু’জনেই ভোলির দিকে অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে।

‘ব্যাপারটা কি…’ সোনালি চুল অবাক গলায় বলল। ‘এখানে কি ঘটছে?’

ভোলি সোনালি চুলের মনোযোগ ধরে রেখেছে, ওদিকে ডেস্কে বসা কালো চুল লোকটার দিকে এগোল বাবুল। লোকটা ধীরে ধীরে দাঁড়িয়ে বাবুলের মুখোমুখি হলো।

‘এঁদেরকে একটা সাক্ষাৎকার নেয়ার অনুমতি দিয়েছি আমি,’ বলল ভোলি।

‘কিন্তু পেন্টহাউস থেকে আপনি বেরুলেন কখন?’ সোনালি চুল ঝাঁকিয়ে জিজ্ঞেস করল প্রথম লোকটা।

ভোলি যখন জবাব দিচ্ছে, রানা তখন লোকটার পাশে চলে আসছে। ওদিকে বাবুলও ডেস্কে বসা লোকটার খুব কাছে রয়েছে। ওদের দু’জনকে কাভার দিচ্ছে তারানা, পার্সের পিছনে লুকানো বেলজিয়ান রিভলভার নিয়ে।

‘তুমি আমাকে বেরিয়ে যেতে দেখলে না!’ ভোলি বিস্ময় ও বিরক্তিতে প্রায় চেঁচিয়ে উঠল। ‘এই তো মাত্র এক ঘণ্টা আগের কথা। আমি না তোমাকে বললাম…’

ব্যাখ্যা করার আর কোন প্রয়োজন নেই। রানার তালুতে নিঃশব্দে বেরিয়ে এলো ছুরিটা। লম্বা সোনালি চুল বাম মুঠোয় ধরে নিজের দিকে টান দিল লোকটাকে, তারপর ছুরি ধরা হাতটা দ্রুত তার গলার ওপর দিয়ে টেনে আনল। ভোলির সাদা শার্ট আর বাদামী জ্যাকেট লাল হয়ে গেল চোখের পলকে।

অপর লোকটা পিস্তল ছুঁতে গেল, কিন্তু তার জন্যে আগে থেকেই তৈরি ছিল বাবুল। কুৎসিতদর্শন একটা গ্যারট বেরুল ওর পকেট থেকে, লূপ বানিয়ে ঝট করে লোকটার গলায় পরাল, তারপর তারের দুই প্রান্তের দুটো হাতল ধরে টান দিল দু’দিকে। লোকটার হাত পিস্তল ছুঁতে পারল না। চোখ বিস্ফারিত হলো, মুখ বিশাল গহ্বর। মাংস, চর্বি, শিরা-উপশিরা ইত্যাদির ভেতর ডেবে গিয়ে হাড় পর্যন্ত পৌঁছে গেল তার। ওদের পায়ের সামনে কার্পেটে আরও খানিকটা রক্ত ছিটাল-বাবুল ধরে রাখা সত্ত্বেও লোকটা লাফ দিচ্ছে ও মোচড় খাচ্ছে। তারপর মেঝেতে তার সঙ্গীর পাশে ঢলে পড়ল।

আগেড়বয়াস্ত্রের ট্রিগারে পেঁচিয়ে থাকা তারানার আঙুলে ঢিল পড়ল এতক্ষণে। লাশ দুটোর দিকে ঘৃণাভরে তাকাল সে, তারপর দেখল একটা লাশের শার্টে ছুরির ফলা মুছছে রানা।

রানার দিকে ফিরে মাথা ঝাঁকাল বাবুল, দ্বিতীয় লাশের গলা থেকে গ্যারটটা উদ্ধার না করেই পেন্টহাউসের দরজার দিকে এগোল। তার হাতে স্পেশাল একটা পিস্তল বেরিয়ে এল-এয়ার গান, বর্শা ছোঁড়ে। বর্শার ডগায় কিউরারি বিষ মেশানো আছে, দ্রুত কাজ করে; এই বিষ বিসিআই সংগ্রহ করেছে, কলাম্বিয়ান ইন্ডিয়ানদের কাছ থেকে।

ভোলি ক্ল্যাসিকসকে এখনও শক্ত ও আত্মবিশ্বাসী দেখাচ্ছে, সালজুনাসের কাছ থেকে পাওয়া আরেকটা চাবি বের করে পেন্টহাউসের তালায় ঢোকাল সে। চাবি ঘোরাতেই তালা খুলে গেল। ধাক্কা দিতে নিঃশব্দে ফাঁক হলো ভারী কবাট। একপাশে সরে দাঁড়াল ভোলি, কারণ পেন্টহাউসের ভেতরে তাকে ঢুকতে হবে না। হানা দেয়ার এই পর্যায়ে তার কোন ভূমিকা নেই।

ভেতরে ঢুকে ওরা তিনজন ছড়িয়ে পড়ল। তারানার অস্ত্র ধরা হাত লম্বা হয়ে আছে, গুলি করার জন্যে তৈরি।

মারকাসকে বড়সড় লিভিংরূমটায় পেলে সবচেয়ে ভাল হত, প্রতিশোধের আগুন নেভাতে বেশি সময় লাগত না। কিন্তু মারকাসকে নয়, তার বদলে লম্বা একটা সোফায় ওদের দিকে পিছন ফিরে মাঙ্কিকে বসে থাকতে দেখল ওরা, হাতের গ−াসে ব্র্যান্ডি। দূর থেকেও তার হোলস্টারের স্ট্র্যাপ দেখতে পেল রানা। বিপজ্জনক লোক, সব সময় সশস্ত্র থাকে।

ভেতরের হলওয়েতে কারও সাড়া-শব্দ নেই, ওই পথ বেডরূমগুলোর দিকে চলে গেছে। তবে আলোকিত অফিস কামরা থেকে কথাবার্তার আওয়াজ ভেসে আসছে। রানা মাঙ্কির পিঠ লক্ষ্য করে এগোতে যাবে, এই সময় অফিস কামরা থেকে দু’জন লোক লিভিংরূমে বেরিয়ে এল। একজন বডিবিল্ডার, শোল্ডার হোলস্টারে পিস্তল; দ্বিতীয় লোকটা ইউসুফিস জিলানি, নকল গিলি ক্ল্যাসিকস।

ওদেরকে দেখে নয়, দরজায় দাঁড়ানো ভোলিকে দেখে থমকে দাঁড়িয়ে পড়ল তারা। দু’জোড়া চোখ পিরিচের মত বড় হয়ে উঠছে, তাকিয়ে আছে ভোলির দিকে। দুই জাল লোক পরস্পরের দিকে মাত্র দুই কি তিন সেকেন্ড তাকিয়ে থাকল, এই সময় সোফা থেকে ঘাড় ফেরাতে নিজের লোক দু’জনের হতবিহ্বল চেহারা দেখতে পেল মাঙ্কি। এবার জিয়ানির সঙ্গী গুণ্ডার হাতে অস্ত্র বেরিয়ে আসবে।

এয়ারগান তাক করে ট্রিগার টেনে দিল বাবুল। পপ্‌ করে ভোঁতা একটা শব্দ হলো। কালো ধাতব খুদে বর্শাটা গলায় বিঁধল, কণ্ঠার ঠিক পাশে। সঙ্গীর গলায় বেঁধা কালো জিনিসটার দিকে আতংকিত দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে জিয়ানি। গুণ্ডার চোয়াল অদ্ভুত সব ভঙ্গিতে নড়াচড়া করছে, অথচ মুখ থেকে কোন শব্দ বেরুচ্ছে না। বিড়ালের ক্ষিপ্রতা দেখা গেল মাঙ্কির নড়ে ওঠায়; একই সঙ্গে ঘুরছে সে, পিস্তলও বের করছে।

প্রথমে রানাকে দেখতে পেল সে, আর রানা দেখল তার হাত হোলস্টারে গোঁজা পিস্তলে পৌঁছে গেছে। এক হাঁটু মেঝেতে গাড়ল, কব্জি ঝাঁকিয়ে ছুরিটা তালুতে আনল রানা; কব্জিরই আরেক ঝাঁকি খেয়ে ছুটল ছুরি, আলো লেগে ঝিক করে উঠল ফলা, সাপের মত নিঃশব্দে ছোবল মারল মাঙ্কির বুকে, হৃৎপিণ্ডের ঠিক পাশে। থ্যাচ্‌ শব্দ তুলে ভেতরে ঢুকেছে ফলা, গেঁথেছে হাতলের কিনারা পর্যন্ত।

মাঙ্কির চোখে বিস্ময় ও অবিশ্বাস, যেন ভাবছে এত দ্রুত এটা কিভাবে সম্ভব হলো। চোখ নামিয়ে ছুরিটা দেখল সে, রক্তের ধারা শার্ট ভিজিয়ে দিচ্ছে। ছুরির হাতলটা ধরল, যেন টেনে বের করতে যাচ্ছে। তারপর অপর হাতটা তুলে রানার দিকে পিস্তল তাক করল। কিন্তু ট্রিগার টিপতে পারল না, মারা গেল তখনি। মুখ থুবড়ে সোফার ওপর পড়ে গেল।

গলায় বর্শা নিয়ে গুণ্ডা স্থির হয়ে গেছে মেঝেতে। জিয়ানি ঘুরে অফিসের দিকে ছুটল। বাবুলের আরেকটা বর্শা টার্গেট করল তাকে। পিঠের ওপর দিকে হাত তুলে সদ্য গাঁথা বর্শাটা টেনে বের করতে চাইছে সে। পারল না, মেঝেতে ঢলে পড়ে মৃত্যু যন্ত্রণায় ছটফট করতে লাগল।

‘ওকে জ্যান্ত ধরতে পারলে ভাল হত,’ শান্ত সুরে বাবুলকে বলল রানা। অফিসের দরজায় পৌঁছে উঁকি দিল ও। ভেতরে কেউ নেই। ইঙ্গিতে করিডরটা দেখাল। বেডরূমগুলো ওদিকেই। গোটা পেন্টহাউস সার্চ করল ওরা। কিচেনে একজন অস্ত্রবাজকে পাওয়া গেল, স্যান্ডউইচ খাচ্ছে। বাবুলকে দেখেই পিস্তল ধরতে গেল সে, কিন্তু বাবুলের তৃতীয় বর্শাটা লোকটার কাঁধে বিঁধল।

লোকটা চেয়ার থেকে পড়ে গেলেও, চোখ খোলা রয়েছে, মারা যাবার কোন লক্ষণও দেখা যাচ্ছে না। এ লোক একটা দুর্লভ কেস, নির্দিষ্ট কিছু টক্সিক কেমিকেল এর শরীরের কোন ক্ষতি করতে পারবে না, বা করলেও ধীরে ধীরে করবে। এ লোকটা মারা যাচ্ছে, তবে প্রচুর সময় নিয়ে।

কিচেনে ঢুকল তারানা। ‘মারকাস এখানে নেই।’

লোকটার পাশে হাঁটু গেড়ে বসল রানা, শার্টের কলার ধরে ঝাঁকাল। ‘মারকাস কোথায়?’

‘বলব, যদি আমাকে বাঁচতে দেন,’ বিড়বিড় করল লোকটা।

‘একজন ডাক্তারকে ডাকব,’ কথা দিল রানা। ‘কোথায় সে?’

‘আমি কি সত্যি বাঁচব?’ বিষক্রিয়ায় তার জিভ আড়ষ্ট হয়ে আসছে, জড়িয়ে যাচ্ছে কথাগুলো।

‘সেটা ডাক্তারই শুধু বলতে পারবে।’ পিস্তল বের করল রানা।

‘হয় বলো, নয়তো গুলি খেয়ে মরো।’

‘তিনি মাইকোনোসে গেছেন।’

তারানার সঙ্গে দৃষ্টি বিনিময় করল রানা। দু’জায়গায় ট্রেনিং দিয়ে নিজস্ব একটা বাহিনী গড়ে তুলছে মারকাস, তার মধ্যে মাইকোনোস দ্বীপ একটা। ‘আরেকটা প্রশ্ন।’ পিস্তলের মাজল লোকটার পাঁজরে চেপে ধরল ও। ‘মারকাস কি জেনারেলদের খবর পেয়েছে?’

লোকটা জড়ানো গলায় বলল, ‘জিয়ানি জেনারেল সেরাফের বাড়িতে ফোন করেছিল। রিসিভার তোলে একজন পুলিস। সে জানিয়েছে, লেফটেন্যান্ট সহ তারা সবাই ভাল আছে। আর জেনারেলরা কেউ বেঁচে নেই।’

‘হোয়াট! এ আবার কি শুনছি!’ বাবুল অবাক।

কিন্তু রানা বিস্মিত নয়। কি ঘটেছে কল্পনায় ধরতে পারছে ও। ফোন বেজে ওঠার পর জেনারেল সেরাফ দ্রুত সিদ্ধান্ত নিয়ে একজন পুলিসকে রিসিভার তুলতে বলেন। তিনি বুঝতে পারেন, পেন্টহাউসে মিথ্যে খবর না পাঠালে মারকাস দলবল নিয়ে নিজেই চলে আসবে তাঁর বাড়িতে। রানার সঙ্গে পরামর্শ করার সময় ছিল না, ফলে নিজের বিবেচনায় যা ভাল মনে হয়েছে তাই করেছেন। এতে বুদ্ধিমত্তারই প্রকাশ ঘটেছে, কিন্তু জেনারেলের জানার কোন উপায় ছিল না যে পিস্তলের মুখে পুলিসকে দিয়ে তিনি যা বলাচ্ছেন তা শুনে রানা ওর দলবল নিয়ে হাজির হবার আগেই মারকাস পেন্টহাউস ত্যাগ করার তাগাদা অনুভব করবে। ‘মারসাক মাইকোনোসে গেছে কেন?’ মৃত্যুপথযাত্রী অস্ত্রবাজকে তিক্তকণ্ঠে জিজ্ঞেস করল রানা। ‘ট্রূপস্‌ পরিদর্শনের জন্যে?’

লোকটার খিঁচুনি শুরু হয়েছে। ‘আমার জন্যে ডাক্তার ডাকবেন বলেছেন…’

‘আগে উত্তর দাও।’

তার গলা থেকে এখন অস্পষ্ট আওয়াজ বেরুচ্ছে। ‘দুই ক্যাম্পেই ফোন করেন তিনি। নির্দেশ দিলেন, এথেন্সে ট্রূপস্‌ পাঠাও। সালজুনাস না বললে ট্রূপস মুভ করানো যাবে না, মাইকোনোসের কমান্ডার এ-ধরনের কিছু একটা বলতে চাইলেন। বস্‌, মানে মিস্টার মারকাস খেপে আগুন। ওখানে তিনি গেছেন নিজের কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠিত করার জন্যে।’ লোকটা হাঁ করে বাতাস টানতে চেষ্টা করে ব্যর্থ হলো। মুখটা ইতিমধ্যেই নীল হয়ে গেছে। এখুনি মারা যাবে সে।

বাবুল চৌধুরীকে পেন্টহাউসে রেখে তারানাকে নিয়ে পাঁচ মিনিটের মধ্যে বাইরে বেরিয়ে এলো রানা। ভোলি ক্ল্যাসিকসকে একটা ট্যাক্সিতে তুলে বাড়িতে পাঠিয়ে দিল ও। তারপর আরেকটা ট্যাক্সির জন্যে হাত তুলল, নিচু গলায় বলল, ‘চলো, তারানা, শকুন মেরে আসি।’

Super User