‘ওর জ্ঞান ফিরছে।’

আওয়াজটা অস্পষ্ট, যেন পাশের কামরা থেকে ভেসে এলো রানার কানে। মিট-মিট করে চোখ খুলল, তবে দৃষ্টি পরিষ্কার হলো না। আবছা মত তিনটে মূর্তি দেখতে পেল নিজের চারপাশে।

‘হ্যাঁ, ঠিক আছে, চোখ খোলো।’

গলাটা চেনা। মারকাস কথা বলছে। শব্দের উৎসের দিকে ফিরে দেখার চেষ্টা করল রানা। ওর দৃষ্টিতে পরিষ্কার ফুটল চেহারাটা। খাড়া একটা পিলার। তার দু’পাশে দু’জন দাঁড়িয়ে আছে। একজনের বাম চোখে কালো পট্টি, চোখের জায়গায় হয়তো কুৎসিত গর্ত আছে। এই লোকটাকে মারকাসের ব্রাজিলিয়ান বডিগার্ড বলে ধরে নিল রানা। অপর লোকটার বয়স হবে ত্রিশ-বত্রিশ, পরনে সামরিক ইউনিফর্ম। রানা আন্দাজ করল, নিহত কমান্ডার গাম্বুসের পদটা সম্ভবত একেই দেয়া হয়েছে।

‘তো,’ তিক্তকণ্ঠে, চিবিয়ে চিবিয়ে বলল মারকাস, ‘তোমার কাজ তাহলে উইন্ডো ওয়াশ করা?’ গলার ভেতর হাসির মত অদ্ভুত একটা শব্দ তৈরি করল সে, ভেতরে যেন টগবগ করে পানি ফুটছে। ‘আসলে কে তুমি?’

‘ওটাই আমার আসল পরিচয়। ওয়াশার। আমি ধুই। ধোয়াই আমার কাজ।’ এত কথা বলে আসলে মাথাটাকে ঠিকমত চালু হবার প্রয়োজনীয় সময় দিতে চাইছে রানা। তারানার কথা মনে পড়ল ওর। সে-ও কি ওদের হাতে ধরা পড়েছে?

মারকাস পিছিয়ে গিয়ে হাতের উল্টোপিঠ দিয়ে রানার গালে মারল। এই প্রথম বুঝতে পারল রানা, ওকে একটা খাড়া চেয়ারে বসিয়ে রাখা হয়েছে। তারা ওকে বাঁধেনি, তবে পিস্তলটা নেই। জ্যাকেটের বোতাম খোলা, বগলের নিচে ছুরিটার অস্তিত্ব অনুভব করা যাচ্ছে। মারকাসের মার খেয়ে চেয়ার থেকে প্রায় পড়ে যাচ্ছিল ও।

ওর দিকে ঝুঁকল মারকাস, বাঘের মত গরগর আওয়াজ বেরুল গলা থেকে, ‘আমি দেখতে পাচ্ছি, আমাকে তুমি চেনোনি।’ রানা লক্ষ করল, আর্মি অফিসার মারকাসের দিকে দ্রুত একবার তাকাল। ‘তবে এখন তুমি হাড়ে হাড়ে টের পাবে আমি কে এবং কি।’

‘তুমি একটা সাইকো,’ তার মুখের ওপর বলে দিল রানা। ‘তুমি একটা শকুন।’

আরেকটা আঘাত আসছে ভেবে নিজেকে শক্ত করল রানা। মারকাস সিধে হলো, নিজের শার্টের সামনের দিকটা দু’হাতে খামচে ধরে নাটকীয় ভঙ্গিতে টান দিয়ে ছিঁড়ে ফেলল। গোটা বুক ও পেট জুড়ে শুকনো ক্ষত, সম্ভবত আগুনে পোড়ার দাগ। ঘুরে নিজের পিঠটাও দেখাল মারকাস, তারপর আবার রানার দিকে ফিরল।

‘দেখলে?’ খেঁকিয়ে উঠল, চোখ দুটোর উজ্জ্বলতা মোটেও স্বাভাবিক নয়। ‘খুব ছোটবেলায় আমাদের অ্যাপার্টমেন্টে আগুন ধরে যাওয়ায় এই অবস্থা হয় আমার। হাতে জ্বলন্ত সিগারেট নিয়ে বিছানায় উঠেছিল আমার বাবা। পরিবারের প্রতি অবহেলার এটা ছিল তার সর্বশেষ নমুনা। কিন্তু দেখতেই পাচ্ছ, আমি মারা যাইনি। ভেবো না সারা জীবন ধরে যা করছি তার জন্যে নরকে যাব আমি, কারণ সেখানে আমার আগেই থাকা হয়েছে।’

রানা ভাবছে। আগুনটা মারকাসের ভেতর কিছু একটা পুড়িয়ে দেয়। হয়তো তার আত্মাটাই পুড়ে গেছে, আদৌ আত্মা বলে যদি কিছু থেকে থাকে। সুস্থ একটা মানুষের মাথায় ও মনে যা যা থাকে-স্রষ্টার প্রতি কৃতজ্ঞতা বোধ, মানুষের প্রতি ভালবাসা, সৎ চিন্তা ও উদ্দেশ্য ইত্যাদি-মারকাসের মাথায় ও মনে তার বোধহয় কণামাত্রও নেই, সব ওই আগুনে পুড়ে ছাই হয়ে গেছে। সে যখন বোতামগুলো লাগাবার চেষ্টা করছে, রানা উপলব্ধি করল কেন লোকটাকে খাড়া পিলারের মত দেখায়। ক্ষতের কারণে চামড়ায় টান পড়ায় বুকটাকে চিতিয়ে রাখতে হয় তাকে।

‘এখন তুমি চিনলে আমাকে,’ হিসহিস করে উঠল মারকাস।

‘এবার বলো কে তুমি। আমার পিছু নিয়ে কেন এসেছ মাইকোনোসে?’

রানা নিরুত্তর।

‘তুমি কি সিআইএ?’ মারকাসের প্রকাণ্ড মুখ রানার চোখের সামনে চলে এল। গরম নিঃশ্বাস ফেলছে রানার গলায়। ‘তুমিই কি ডাফু সালজুনাসের নামে কমান্ডার গাম্বুসকে টেলিফোন করেছিলে?’

তারানার ওপর আস্থা আছে রানার, সে মুক্ত থাকলে ব্যাক আপ হিসেবে সাহায্য করতে আসবেই। কিন্তু সে কি জানে এখানে কি ঘটছে? না জানলে বোকার মত স্যুইটে ঢুকে পড়বে। তবে না, একজন ইন্টেলিজেন্স এজেন্ট অত বোকা হয় না। ‘আমি সিআই-এ নই, বিসিআই,’ মারকাসকে বলল রানা।

‘বিসিআই? মানে?’ মারকাস যেন আকাশ থেকে পড়ল।

‘বিসিআই মানে বাংলাদেশ কাউন্টার ইন্টেলিজেন্স,’ বলল রানা।

‘বাংলাদেশ? এই নামে কোন দেশ আছে, এটাই তো আমি জানি না!’ মারকাস হতভম্ব। ‘যে দেশকে আমি চিনি না সেই দেশের সঙ্গে আমার শত্রুতা থাকে কি করে? সে দেশের কাউন্টার ইন্টেলিজেন্স আমার পিছনে লাগে কেন?’

রানা হাসল। ‘তুমি তোমার হোমওঅর্ক করোনি, মারকাস। এমন কি বড় অপরাধী হতে হলেও এটার প্রয়োজন আছে।’ আসলে কথা বাড়িয়ে তারানার সুবিধে করে দিতে চাইছে ও।

‘হোমওঅর্ক করিনি তো কি হয়েছে, বাংলাদেশ বা বিসিআই আমার কি ছিঁড়তে পারছে?’

‘কি ছিঁড়েছি বা ছিঁড়ব নিজেই টের পাবে, আমার মুখ থেকে শুনতে হবে না।’

‘আমার বিরুদ্ধে কি ষড়যন্ত্র পাকিয়েছ তোমরা? তোমার সঙ্গে আর কে কে আছে?’ উত্তেজনায় হাঁপাচ্ছে মারকাস।

কথা না বলে রানা শুধু মাথা নাড়ল। পিস্তলটা উল্টো করে ধরে রানার দিকে এগিয়ে আসছে মারকাসের বডিগার্ড।

‘থামো,’ ভারী গলায় বলল মারকাসের নতুন কমান্ডার। ‘গ্রীসে বন্দীদের কথা বলাবার সম্পূর্ণ নতুন কিছু কৌশল আবিষ্কার করেছি আমরা। কিন্তু এই ইন্টারোগেশন পদ্ধতির খারাপ দিক হলো, সাবজেক্ট ভীষণ চিৎকার আর পায়খানা-প্রস্রাব করে ফেলে। আমাদেরকে তো ক্যাম্পে ফিরতেই হবে, চলুন ওকেও সঙ্গে করে নিয়ে যাই।’

প্রস্তাবটা নিয়ে কয়েক সেকেন্ড চিন্তা করল মারকাস, তারপর বলল, ‘হ্যাঁ, সেই ভাল।’

রানাকে ধরে চেয়ার থেকে তোলা হলো। ও ভাবছে, তারানাটা গেল কোথায়! রিসেপশন ডেস্ক থেকে ফিরতে এতক্ষণ তো লাগার কথা নয়। নাকি তাকেও ধরেছে ওরা? কিন্তু জিজ্ঞেস করার তো উপায় নেই।

রাহমানিয়ার পার্কিং এরিয়াটা প্রবেশপথ থেকে অনেকটা দূরে, নির্জন একটা জায়গায়। ওখানে পৌঁছে ছুরির সাহায্য নিয়ে পালাবার চেষ্টা করবে রানা। তারা যদি ওকে ক্যাম্পে নিয়ে যেতে পারে, জ্যান্ত আর ফিরতে হবে না।

কিন্তু ছুরি ব্যবহারের কোনও সুযোগই পাওয়া গেল না। মারকাসের বডিগার্ড সারাক্ষণ ওর পাঁজরে পিস্তলের মাজল ঠেকিয়ে রাখল, এমনকি গাড়িতে ওঠার পরও। রানার অপর দিকে বসেছে মারকাস নিজে। ড্রাইভ করছে আর্মি অফিসার।

শহর থেকে বেরিয়ে পাহাড়ী রাস্তা ধরে ছুটল কার, রানা তারানার কথা ভুলতে পারছে না। মেয়েটার কি হলো বোঝা যাচ্ছে না। তার তো জানার কথা যে মারকাস ফিরছে দেখলে সঙ্গে সঙ্গে রানার পাশে চলে আসতে হবে।

শহর থেকে বেরিয়ে মাইলখানেক এগিয়েছে ওরা, অর্ধবৃত্তাকার একটা বাঁক ঘুরছে, হঠাৎ বিশ গজ দূরে একটা অচল গাড়িকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখা গেল সরু রাস্তার মাঝখানে। রানার মনে পড়ল, গাড়িটাকে হোটেলের সামনের দিকে কোথাও দেখেছে ও, হোটেল কর্তৃপক্ষই সম্ভবত ওটার মালিক। আর্মি অফিসার ব্রেকে চাপ দিল, মিলিটারি কার হড়কে এসে অচল গাড়িটার কাছ থেকে মাত্র কয়েক ফুট দূরে ঝাঁকি খেয়ে দাঁড়িয়ে পড়ল।

‘কি ঘটনা?’ জিজ্ঞেস করল মারকাস।

‘অচল একটা গাড়ি, নিশ্চয়ই যান্ত্রিক গোলযোগ,’ অফিসার বলল। ‘ড্রাইভার সম্ভবত মেকানিক আনতে গেছে।’

‘বুঝলাম তো,’ ক্ষিপ্ত দেখাচ্ছে মারকাসকে। ‘এবার পথ থেকে ওটাকে সরাবার ব্যবস্থা করুন।’

ওদের গাড়ির ডান দিকে গভীর খাদ, উল্টোদিকে প্রায় খাড়া পাথুরে ঢাল। অফিসার গাড়ি থেকে বাম দিকে নামল; সাবধানে পা ফেলে, ধীরে ধীরে দ্বিতীয় গাড়িটার দিকে এগোচ্ছে।

মারকাস বসে আছে রানার ডান দিকে। দরজা খুলে খাদের দিকে নামল সে, পেভমেন্টে দাঁড়িয়ে অফিসার কি করে দেখছে। গাড়ির ভেতর এখন রানা আর মারকাসের বডিগার্ড, বডিগার্ডের পিস্তল রানার পাঁজরে ঠেকে আছে।

ওদের গাড়ির পাশ থেকে মারকাস গলা চড়িয়ে নির্দেশ দিল, ‘ঠেলে খাদে ফেলে দিন ওটাকে!’

‘সে চেষ্টাই করব,’ অফিসারের জবাব ভেসে এল।

ওটাই তার শেষ কথা। দ্বিতীয় গাড়িটার পাশে যেই সে থেমেছে অমনি রানা দেখতে পেল খাদের কিনারা থেকে তারানার মাথা রাস্তার লেভেলে উঠে আসছে। বোঝাই যাচ্ছে যে হোটেল কামরার বাইরে থেকে ওদের কথা শুনছিল সে, রানাকে ক্যাম্পে নিয়ে যাওয়া হবে শুনে হোটেলের গাড়ি চুরি করে ওদের আগে এই রাস্তায় পৌঁছেছে। এ-ও বোঝা যাচ্ছে যে খাদের কিনারা থেকে কয়েক ফুট নিচে কার্নিস বা ওই রকম কিছু একটা আছে, যেখানে পা রেখে দাঁড়িয়ে থাকতে তারানার কোন অসুবিধেই হচ্ছে না। ‘সাবধান!’ অফিসারের উদ্দেশে চেঁচিয়ে উঠল মারকাস, দেখল তারানা লক্ষ্যস্থির করছে।

গ্রীক অফিসার ঘাড় ফিরিয়ে তাকাতে যাবে, এই সময় গর্জে উঠল তারানার অস্ত্র। অফিসারের কপালে ছোট্ট লাল একটা বেমানান টিপ দেখা গেল। পিছনদিকে ছিটকে অচল গাড়ির ওপর পড়ল সে, সেখান থেকে রাস্তায়। ইতিমধ্যে তারানার পিস্তল মারকাসের দিকে ঘুরে গেছে। মারকাসও নিজের পিস্তল বের করছে। অফিসারকে আগে টার্গেট করায় মনে মনে তারানার প্রশংসা করল রানা, কারণ জানে মারকাসকে মারার জন্যে কেমন অস্থির হয়ে আছে সে।

মারকাসকে হারিয়ে দিল তারানা; আবার গর্জে উঠল তার ছোট্ট আগেড়বয়াস্ত্র, মারকাসকে লাগাতেও পেরেছে।

গাড়ির ভেতর মারকাসের বডিগার্ড রানার দিকে পিস্তল ধরে আছে, জানে না এই চরম সংকটে প্রথমেই তার কি করা উচিত। মারকাসকে গুলি খেতে দেখে তার দ্বিধা কেটে গেল, সিদ্ধান্ত নিল প্রথমে রানাকে গুলি করবে, তারপর গাড়ি থেকে বেরিয়ে তারানার ব্যবস্থা। পিস্তলে পেঁচানো তার আঙুলের গিঁট সাদা হয়ে যাচ্ছে। ভাঁজ করা কনুই দিয়ে তার অস্ত্র ধরা হাতে গুঁতো মারল রানা। গুলি হলো, রানার পাশের জানালার কাঁচ ভেঙে বেরিয়ে গেল বুলেট। ওর অপর হাতে বেরিয়ে আসা ছুরি ঘ্যাঁচ করে সেঁধিয়ে গেল লোকটার পাঁজরের ভেতর। তার খেলার এখানেই সমাপ্তি।

গুলিটা মারকাসের কাঁধে লেগেছে, তবে হাড় ভাঙতে পারেনি; শুধু সামান্য চামড়া আর মাংস খামচে তুলে নিয়ে গেছে। পেভমেন্টে শুয়ে তারানার গুলির জবাবে সে-ও গুলি করছে। লাফ দিয়ে গাড়ি থেকে বেরিয়ে এলো রানা, মাথা নিচু করে আছে, গাড়িটাকে ব্যবহার করছে কাভার হিসেবে। হাতে পিস্তল নিয়ে দ্বিতীয় গাড়িটার দিকে যাচ্ছে ও। মারকাস ইতিমধ্যে তারানাকে খাদের নিচে লুকাতে বাধ্য করেছে।

দ্বিতীয় গাড়িটার কাছে পৌঁছাল রানা, এই সময় মারকাস দেখে ফেলল ওকে। পরপর দু’বার গর্জে উঠল তার পিস্তল, রানার পাশে রাস্তার ছাল গুঁড়ো হয়ে ছিটকাল। ডাইভ দিয়ে গাড়িটার আড়ালে চলে এলো রানা। ছুটে এসে মিলিটারি কারে উঠে পড়ল মারকাস। খাদের কিনারা থেকে আবার মাথা তুলল তারানা, গুলিও করল, কিন্তু মারকাসকে লাগাতে পারল না। মারকাস ড্রাইভিং সিটে উঠে বসেছে। এঞ্জিন গর্জে উঠল।

সিধে হয়ে মারকাসকে একটা গুলি করল রানা। হঠাৎ ঝাঁকি খেয়ে সামনে বাড়ল কার, সরাসরি রানার দিকে আসছে। আরেকটা গুলি করে ছুটে আসা কার-এর পথ থেকে ডাইভ দিয়ে সরে গেল। বিকট শব্দে দ্বিতীয় গাড়ির সঙ্গে ধাক্কা খেলো সেটা। সংঘর্ষের একেবারে কাছাকাছি শুয়ে আছে রানা, হাত দিয়ে মুখ ঢেকে প্রার্থনা করছে ছিনড়বভিনড়ব লোহা যেন ওর মাংস চিরে না দেয়। হুইল ঘুরিয়ে, রিভার্স গিয়ার দিয়ে, নিজের গাড়িটাকে আলাদা করল মারকাস, বাঁক নিয়ে শহরের দিকে ফিরে যাচ্ছে। আর এক সেকেন্ডের মধ্যে পালাবে সে; এটাই শেষ সুযোগ ধরে নিয়ে সাবধানে লক্ষ্যস্থির করল রানা, একটা চাকা ফাটিয়ে দিল। তারপরও গাড়ি নিয়ে ছুটছে মারকাস। তারানা পর পর দুটো গুলি করল। গাড়ির গায়ে শব্দ করল বুলেটগুলো, মারকাসকে লাগেনি।

সিধে হয়ে সদ্য তোবড়ানো গাড়িটার দরজা খুলল রানা। ওর হাত থেকে খসে পেভমেন্টে পড়ে গেল সেটা। ভেতরে ঢুকে স্টার্ট দেয়ার চেষ্টা করল ও। তিনবারের পর সাড়া দিল এঞ্জিন।

ছুটন্ত গাড়িতে লাফ দিয়ে উঠে পড়ল তারানা। শুরু হলো ধাওয়া। শহর পর্যন্ত ওদের দৃষ্টিসীমার ভেতরই থাকল মিলিটারি কার। তারপর হারিয়ে ফেললেও একটু খোঁজাখুঁজি করতেই আবার দেখতে পেল ওয়াটারফ্রন্টে। খালি গাড়ি, ভেতরে মারকাস নেই।

‘খুব বেশি দূর যেতে পারেনি,’ বলল তারানা। ‘আমি এদিকের কাফেগুলোয় দেখে আসি।’

‘ঠিক আছে,’ বলল রানা। ‘আমি দেখি বোটগুলো। সাবধানে, হ্যাঁ?’

‘তুমিও কিন্তু,’ মাথা ঝাঁকিয়ে বলল তারানা, হন হন করে কাফেগুলোর দিকে এগোল। ওদিকে লুকিয়ে থাকার মত জায়গার কোন অভাব নেই।

লম্বা একটা জেটি ধরে এগোল রানা। ট্যুরিস্টদের ছোটখাট একটা ভিড় রয়েছে এদিকে, বোট আসবে তার অপেক্ষায় দাঁড়িয়ে রয়েছে তারা। মারকাস সম্পর্কে প্রশ্ন করতে যাবে, এই সময় একটা মোটর লঞ্চের গর্জন শুনতে পেল ও। জেটির মাথায় ওই লঞ্চে মারকাসকে দেখা যাচ্ছে। এরই মধ্যে রওনা হয়ে গেছে সে। ছুটল রানা। যখন বুঝতে পারল লাফ দিয়েও লঞ্চে ওঠা যাবে না, পিস্তল তুলে লক্ষ্যস্থির করল। গুলি করতে গিয়েও করল না ও, কারণ দেখতে পেল ওর পাশেই পানিতে ছোট একটা বোট ভাসছে। লাফ দিয়ে বোটটায় নামল ও, হাঁ করে দাঁড়িয়ে থাকা মালিককে বলল, ‘স্টার্ট দাও!’

ওর হাতে পিস্তল রয়েছে, লোকটা প্রতিবাদ না করে স্টার্ট দিল বোট।

‘এবার নেমে যাও।’

‘কিন্তু…’

‘নামো বলছি!’ প্রায় খেপে উঠল রানা।

লোকটা বোট ছেড়ে নেমে যেতেই মারকাসের পিছু নিল রানা। পিছন ফিরে তাকাতে তারানাকে দেখতে পেল, ডকের শেষ মাথায় দাঁড়িয়ে চিৎকার করে ওর নাম ধরে ডাকছে। কিন্তু এখন আর ফিরে গিয়ে তাকে নিয়ে আসা সম্ভব নয়। হাত তুলে নাড়ল রানা। ‘সাবধানে!’ এঞ্জিনের আওয়াজকে ছাপিয়ে ওঠা তার চিৎকার শুনতে পেল রানা।

মারকাস যখন মারা যাবে, ওর সঙ্গে তারানা থাকবে না, ভাবতে খারাপই লাগছে রানার। বাকারাকে নিয়ে সে-ও তো প্রতিশোধ নিতেই এসেছে। কিন্তু নিয়তির বিধান হয়তো অন্যরকম। মারকাসকে প্রবেশমুখের ভেতর দিয়ে ইনার হারবারে ঢুকতে দেখল রানা, পিছনে মসৃণ জলপথ রেখে যাচ্ছে। এই সুরক্ষিত জলসীমার বাইরে ছোট অথচ চঞ্চল ঢেউ রয়েছে। রানার ছোট বোট ওখানে পৌঁছাতে লাগাম টানা ঘোড়ার মত উঁচু হলো বারবার, চোখে-মুখে লোনা পানির ছিটা লাগছে। ব্যাপারটা এখন পরিষ্কার, ডেলোস আইল্যান্ডের কাছাকাছি জনবসতিহীন একটা দ্বীপে পৌঁছাতে চাইছে মারকাস।

মারকাসের চুরি করা লঞ্চের চেয়ে রানার বোটের স্পীড বেশি। ছোট বোটের কিনারা ধরে প্রায় ঝুলে বা শুয়ে আছে রানা, ধীরে ধীরে কমিয়ে আনছে দূরত্ব। এই সময় আবার তারানার কথা মনে পড়ল ওর। মাইকোনোসে বেশ ঝামেলা পোহাতে হবে বেচারিকে। যতই ব্যাখ্যা দিক, পুলিস হয়তো তা সত্যি বলে বিশ্বাস করতে চাইবে না। তবে জেনারেল সেরাফকে ফোন করলে কর্তৃপক্ষ তাদের সব প্রশেড়বরই উত্তর পেয়ে যাবেন। রানা মাইকোনোসে ফিরে হয়তো দেখতে পাবে তারানাকে মেডেল পরানো হচ্ছে। কপালে যদি ফেরা থাকে আর কি।

হঠাৎ করেই মারকাসকে শূটিং রেঞ্জের মধ্যে পেয়ে গেল রানা, তবে ওকে হারিয়ে দিয়ে মারকাসই আগে গুলি করল। পরপর দুটো, দুটোই উইন্ডশীল্ডে লেগে ফাইবার গ−াস ফাটিয়ে দিল। রানার ছোট বোট সারাক্ষণ লাফাচ্ছে, কাজেই কিছু একটায় লাগাতে পারাও দক্ষতার পরিচয় বহন করে। পিস্তল বের করে মারকাসের কাঠামোয় লক্ষ্যস্থির করল রানা। গুলিটা লাগল না। পিস্তলে আর মাত্র দুটো বুলেট আছে।

দ্বীপের ছোট্ট ও পরিত্যক্ত একটা এলাকার দিকে ছুটছে ওরা। এদিকের পানি শান্ত। উত্তপ্ত, রোদে ফাটা, ভগড়বপ্রায় একটা ডকের দিকে যাচ্ছে মারকাস। তাকে পিস্তলটা রিলোড করতে দেখল রানা। বাড়তি অ্যামুনিশনের সুবিধেটা সেই পাবে। ডকে লঞ্চ থামাবার ঠিক আগে রানার দিকে দুটো গুলি করল সে, উদ্দেশ্য দূরে সরিয়ে রাখা। বড় একটা বৃত্ত তৈরি করে এগোল রানা, মারকাসকে সহজে দ্বীপে উঠতে দিতে রাজি নয়। তবে গুলি করছে না ও। এখন বুলেট অপচয় করা যাবে না।

লঞ্চে ঝুঁকে রয়েছে মারকাস, কি যেন করছে। লঞ্চ এরই মধ্যে ডকে ভিড়েছে। রানা ভাবল, এটাই বোধহয় ওর সুযোগ। বোট একটু ঘুরিয়ে ডকে ঢুকতে যাচ্ছে। যেই পিস্তলের রেঞ্জে চলে এলো লঞ্চ, সিধে হয়ে দৃষ্টিপথে বেরুল মারকাস, কি যেন একটা ছুঁড়ে দিল রানার বোট লক্ষ্য করে।

জিনিসটা বোটের ককপিটে পড়ল। ফিউজ পুড়তে দেখে রানা বুঝল, লঞ্চ থেকে ডিনামাইট পেয়েছে মারকাস। মাইকোনোস দ্বীপের অন্য এক মাথায় পাহাড় কেটে রাস্তা তৈরি করার কাজে এই ডিনামাইট ব্যবহার করা হচ্ছে। তুলে বোটের বাইরে ফেলে দেবে, অত সময় নেই হাতে, ফিউজটা ছোট। পিস্তল বেল্টে গুঁজে বোট থেকে ডাইভ দিয়ে পানিতে পড়ল ও, তারপর দ্রুত সাঁতরাতে শুরু করল।

বিস্ফোরণের আওয়াজ কানের পর্দা ফাটিয়ে দেয়ার উপক্রম করল, ঝড় উঠল গরম বাতাসে, পানিতে তৈরি হলো বড় আকারের ঢেউ। রানার চারদিকে আবর্জনা ঝরে পড়ছে, তবে সাঁতরে বেরিয়ে আসতে পারল ও। ঘাড় ফিরিয়ে তাকাতে দেখল সারফেসে আগুন জ্বলছে, কুণ্ডলী পাকানো কালো ধোঁয়া উঠছে আকাশে।

ভাগ্যগুণে বেঁচে গেছে রানা। সাঁতরে ডকের পাশের সৈকতে পৌঁছাতে চাইছে ও। ওকে দেখতে পেয়ে আবার দুটো গুলি করল মারকাস। দু’হাত সামনের পানিতে ডাইভ দিল বুলেটগুলো। আরেকটা গুলি করল মারকাস। এবার লাগল।

বাম বাহুর ওপর দিকে চামড়া ছুঁয়ে বেরিয়ে গেছে বুলেটটা। মনে মনে ‘দাঁড়া শালা’ বলে গালি দিলেও একটা কথা ভেবে শঙ্কিত বোধ করল-তীরে যদি পৌঁছাতে পারেও, ওর কাছে হয়তো কোন অস্ত্র থাকবে না, কারণ পানিতে ভেজা পিস্তলের কার্তুজ কাজ নাও করতে পারে।

রানা এখনও তীরের দিকে আসছে দেখে ঘুরে আগাছা ভর্তি ডক থেকে ছুটল মারকাস। দ্বীপটার নিচু ও সমতল একটা এলাকার দিকে যাচ্ছে সে, ওদিকে বহুকাল আগে পরিত্যক্ত কিছু কুঁড়েঘর আছে জেলেদের। রানার জন্যে সম্ভবত ওখানেই ওত পেতে থাকবে সে।

ঢাল বেয়ে ধীরে ধীরে উঠল রানা। সামনের খোলা জায়গার কোথাও মারকাসকে দেখতে পাচ্ছে না। গরম রোদে গায়ের লোনা পানি শুকাতে শুরু করেছে। এখান থেকে প্রায় তিনশো গজ সামনে জমিন এদিকের চেয়ে নিচু, প্রায় সমতলই, তবে মাটি ফুঁড়ে বেরিয়ে আছে ছোটবড় পাথর। আলগা বোল্ডারও অসংখ্য। একসময় পাথর দিয়ে কিছু দালানও বানানো হয়েছিল, অনেক আগে ধসে পড়লেও নমুনা হিসেবে কিছু পিলার ও পাঁচিল এখনও দাঁড়িয়ে আছে। ওগুলোর পিছনে পাহাড়, ঢালগুলো খাড়াই বলা যায়, উঠে গেছে দ্বীপটার মধ্যবিন্দুর দিকে। ওই চূড়ায়, আকাশে, আরেকটা দালান দেখা যাচ্ছে। বাড়িটা দোতলা, ছাদ ও একদিকের দেয়ালের কোন অস্তিত্ব নেই।

রোদে দাঁড়িয়ে চোখ কুঁচকে মারকাসকে খুঁজছে রানা।

যেখানেই লুকিয়ে থাকুক, উঁকি-ঝুঁকি মারছে না। পিস্তল থেকে কার্তুজ বের করে একটা বোল্ডারের ওপর রাখল ও। সিলিন্ডার খুলে ব্যারেলের ভেতর তাকাল। মেটাল টিউবের গায়ে পানির ফোঁটা লেগে রয়েছে, প্রতিফলিত রোদের আভায় চকচক করছে। মুখের ভেতর মাজল পুরে পানি বের করার জন্যে ফুঁ দিল। এত সতর্কতার সঙ্গে বাঁচিয়ে রাখা কার্তুজ কাজের সময় মিসফায়ার করতে পারে। ওয়ালথারটা রয়ে গেছে হোটেলে আর মিলিটারি ক্যাম্পে যাবার পথে অস্ত্রবাজের পাঁজরে গাঁথা আছে ছুরিটা, কাজেই কুড়িয়ে পাওয়া এই পিস্তলটা ছাড়া ওর কাছে আর কোন অস্ত্র নেই। ওগুলো হয়তো উদ্ধার করবে তারানা, কিন্তু এখন তো কাজে লাগছে না।

তবে মারকাসের ভয় ছিল যে রানা গুলি করবে, তা না হলে ওভাবে পড়িমরি করে দৌড়াত না সে। কার্তুজ শুকিয়ে গেল। বুলেট দুটো পিস্তলে ভরে রওনা হলো রানা, ভেঙে পড়া দালানগুলোর দিকে যাচ্ছে।

চারদিকে লম্বা ঘাস। উঠান ও ভেঙে পড়া দেয়ালের ভেতর কামরাগুলোতেও আগাছা ভর্তি। উঁচু ঘাস বাতাসে দুলছে। দুনিয়ার যে-কোন জায়গার চেয়ে এখানকার রোদ কি বেশি গরম? হাসি পেল রানার, তবে জানে হাসির সময় এটা নয়। ঘাসের ভেতর দিয়ে সাবধানে এগোচ্ছে ও। দুটো গিরগিটি ডায়নোসরের মত দেখতে, ওর পথ ছেড়ে সরে গেল-দূরে থেমে ঘাড় বাঁকা করে দেখছে ওকে। গরম বাতাসে ভ্যাপসা একটা গন্ধ রয়েছে। আশপাশে কোথাও মাছি ভন ভন করছে। জুলহাস কায়সারের ক্ষতবিক্ষত লাশটা ফিরে এলো চোখের সামনে। এই সময় সামনের একটা দালানের কাছে কি যেন একটা নড়ল।

হাতের উল্টোপিঠ দিয়ে চোখ রগড়ে আবার তাকাল রানা। এখন আর কিছু নড়তে দেখা যাচ্ছে না। তবে অনুভব করল, ওদিকেই ঘাপটি মেরে আছে মারকাস।

দালানটার দিকে ছুটল রানা, ওকে আড়াল দিচ্ছে একটা বোল্ডার। ওটা বুক সমান উঁচু, পিছনে দাঁড়িয়ে কান পাতল। মাছি আর ঝিঁঝি পোকার ডাক সড়বায়ুতে যেন হাতুড়ির বাড়ি মারছে। বোল্ডারে হাত রাখল রানা, হাতটা পড়ল একটা গিরগিটির গায়ে। ওটা লাফিয়ে উঠে চমকে দিল রানাকে। আর ঠিক এই সময় দ্বিতীয় দালানের পিছন থেকে মাথা বের করে গুলি করল মারকাস।

রানার ডান হাতের কাছাকাছি বোল্ডারের পাথর গুঁড়ো করল বুলেটটা। প্রায় সঙ্গে সঙ্গে আরও একটা বুলেট ছুটে এসে ওই বোল্ডারেই লাগল, ছিটকে এসে গুঁড়ো পাথর লাগল রানার চোখে মুখে। চোখ পরিষ্কার করে আবার যখন তাকাল, মারকাস ততক্ষণে অদৃশ্য হয়ে গেছে। তবে ওর আরও কাছাকাছি লম্বা ঘাসগুলোকে নড়তে দেখল ও, প্রথম ও দ্বিতীয় দালানের মাঝখানে।

মারকাস ধরে নিয়েছে, রানা গুলি করতে চাইছে না। ফলে শিকার নয়, শিকারী হয়ে উঠেছে সে। সেই এখন রানাকে ধরতে আসছে।

স্থির হয়ে গেছে রানা। ঘাসের নড়াটাকে সন্দেহজনক মনে হওয়াটাই স্বাভাবিক, কিন্তু মারকাস ওখানে এখনও আছে বলে মনে হচ্ছে না ওর।

‘হাতে ওটা শো পীস, তাই না?’ প্রথম দালানের একটা ঘর থেকে মারকাসের হাসির শব্দ ভেসে এল। ‘গুলি নেই? নাকি ভিজে নষ্ট হয়ে গেছে?’

বোল্ডারের আড়াল ছেড়ে আগেই বেরিয়ে পড়েছে রানা, প্রথম দালানের তৃতীয় ঘরটাকে পাশ কাটিয়ে এল। শুকনো পাতায় পা ফেলছে না, ঘাস এড়িয়ে ভাঙা পাঁচিল আর দেয়ালের আড়ালে থাকার চেষ্টা করছে। কিন্তু কোথায় মারকাস। পাঁচ নম্বর ঘরেও সে নেই।

‘এবার?’

বন করে ঘুরতেই পিছনে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখল রানা মারকাসকে। কিভাবে ওদিকে গেল, একমাত্র সেই জানে। লোকটা শকুন হোক বা উন্মাদ, মাথার হলুদ ঘিলু এখনও তাকে বুদ্ধির যোগান দিয়ে যাচ্ছে। হাতের আগেড়বয়াস্ত্র তুলেই গুলি করল সে।

মারকাস যখন গুলি করতে যাচ্ছে, ডাইভ দিয়ে পড়ল রানা পাথরের একটা সতূপের পাশে। ওদের মাঝখানে এখন কোন বোল্ডার নেই। বুলেটটা রানার শার্টের আস্তিন ছিঁড়ে নিয়ে গেল, বেশ গভীর একটা আঁচড় কাটল বাম বাহুতে। মারকাস আবার গুলি করতে যাচ্ছে দেখে একটা গড়ান দিল ও। ওর পাশে বিস্ফোরিত হলো ধুলো। মরিয়া হয়ে পিস্তল ধরা হাতটা তার দিকে তুলল রানা, এই সময় তৃতীয়বার ট্রিগারে টান দিল মারকাস। খালি চেম্বারে বাড়ি মারল হ্যামার। রানা নিজের পিস্তলের ট্রিগার টানছে, ওর দিকে অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকল মারকাস। ক্লিক করল রানার পিস্তল, কোন বুলেট ছুটল না।

মারকাসের চেহারা বদলে গেল। ধীরে ধীরে উচ্চকিত হলো তার অট্টহাসির শব্দ। তারপর, হাসির দমকে প্রকাণ্ড ও আড়ষ্ট শরীরটা তখনও কাঁপছে, পিস্তলে একটা কার্তুজ ভরতে শুরু করল। হাতের অস্ত্র ফেলে দিল রানা, ধুলোয় পায়ের আঙুল ডোবাল, তারপর লাফ দিল শূন্যে।

পিস্তলটা ওর দিকে তুলছে, এই সময় তার গায়ে দু’পা দিয়ে নামল রানা। শূন্য থেকে সবেগে আসা জোড়া পায়ের লাথি বুকে লাগলে অন্য কোন লোক মারা যেতে বেশি সময় নিত না, কিন্তু ছিটকে মাটিতে পড়েই মারকাস সিপ্রঙের মত লাফ দিয়ে আবার সিধে হতে কোন সময় নিল না। পড়ে গিয়েছিল রানাও, তবে মারকাসের সঙ্গেই তাল মিলিয়ে উঠে দাঁড়িয়েছে-দেখল, শত্রুর হাতে অস্ত্রটা নেই।

পরস্পরকে ঘিরে ঘুরছে ওরা। অকস্মাৎ ঝুঁকে মাটি থেকে কি যেন কুড়াল মারকাস। তারপর হিংস্র একটা হুঙ্কার ছেড়ে রানার দিকে ছুটে এল। এতক্ষণে তার হাতে উল্টো করে ধরা খালি পিস্তলটা দেখতে পেল রানা।

এক পাশে সরে তাকে ল্যাং মারার চেষ্টা ব্যর্থ হলো। রানা কোন দিকে সরবে বুঝতে পেরে সেদিকেই পিস্তলের বাড়িটা মারল সে, লাগল রানার মাথার একপাশে। ব্যথায় কাতরে উঠল রানা, ঢলে পড়ল ঘাসের ওপর। এখনই দাঁড়াও, রানার ভেতর থেকে কে যেন বলল, নয়তো এখনই মরো। মাথা ঘুরছে, বসতে গিয়ে কাত হয়ে পড়ে যাচ্ছে, তারপরও দাঁড়াতে চেষ্টা করল ও। চোখে দৃষ্টি ছিল না, ধীরে ধীরে ফিরে আসছে। মারকাস ঝাপসা একটা মূর্তি, ঢাল বেয়ে পাহাড় চূড়ায় উঠে যাচ্ছে। পিছু নিয়ে ওপরে তাকাল রানা। দু’তলা ধ্বংসাবশেষ এখান থেকে আরও বড় দেখাচ্ছে। পুরানো একটা কাঠের দরজা কব্জার সঙ্গে তির্যক ভঙ্গিতে ঝুলছে, বাতাসের ধাক্কায় ক্যাঁচ-ক্যাঁচ করছে সেটা। চৌকাঠ পেরিয়ে ভেতরে ঢুকল রানা। এই দরজা দিয়ে মারকাসকেও ঢুকতে দেখেছে ও।

ভাঙা ছাদ আর দেয়াল, আগাছা আর ঝোপ এড়িয়ে সাবধানে এগোচ্ছে রানা। বাইরের মত ভেতরেও প্রচুর ঘাস। কিছু ঘাস এখনও সিধে হতে পারেনি মারকাস মাড়িয়ে যাবার পর। রানার মনে পড়ল, কিশোর বয়স থেকে ধাওয়া খেয়ে আসছে এই লোক, এবং আজও বেঁচে আছে। ভাঙা একটা দেয়ালকে ঘুরে পা ফেলতেই বন্যপ্রাণীর হিংস্র চোখ সহ তার মুখটা পলকের জন্যে দেখতে পেল ও, পরমুহূর্তে অনুভব করল মরচে ধরা লোহার একটা রড ওর মাথার ওপর নেমে আসছে। ঝট করে নিচু হলো রানা, ওর চুলে বাতাস দিয়ে রডটা পাশের পাথুরে দেয়ালে লাগল। হাত বাড়িয়ে ওটা ধরার চেষ্টা করল ও, কিন্তু ভারসামা্য আগেই হারিয়ে ফেলেছে। হ্যাঁচকা টান দিয়ে রডটা ওর মুঠো থেকে বের করে নিল মারকাস। এক মুহূর্ত পর আবার সেটা তুলল সে মারার জন্যে।

রডটা সরাসরি রানার কপালে নেমে আসছে, লাগলে মাথার খুলি চুরমার হয়ে যাবে। গড়াল রানা। ডান কান ছুঁয়ে বেরিয়ে গেল রড, শক্ত মাটিতে আঘাত করল।

আবার সেটা ধরল রানা, টেনে ও মুচড়ে মারকাসের মুঠো থেকে বের করে আনছে। বঞ্চিত হলো দু’জনেই, দু’জোড়া হাত থেকে ছুটে গেল সেটা, লম্বা ঘাসের ভেতর কোথায় পড়ল কে জানে। ঘুরে পড়ো পড়ো এক প্রস্থ প্রাচীন পাথুরে সিঁড়ি বেয়ে ওপরে উঠে যাচ্ছে মারকাস। দোতলার প্রায় কিছুই নেই, অন্তত নিচে থেকে শুধু দোতলার মেঝের ভাঙা খানিকটা কিনারা দেখা যাচ্ছে। সিধে হবার পর রানা দেখল সরাসরি ওর মাথার ওপর, দোতলার মেঝের কিনারায় দাঁড়িয়ে রয়েছে মারকাস। ফুটবল আকৃতির একটা আলগা পাথর তুলে নিচে ফেলল সে। সরে গেল রানা, তারপরও পাথরটা ঘষা খেলো কাঁধে। ব্যথায় অবশ হয়ে এলো কাঁধ আর হাত।

সাবধানে, ধীরে ধীরে, সিঁড়ি বেয়ে উঠছে রানা। ভাবছে: ক্লান্ত, হ্যাঁ। কিন্তু যতই ক্লান্ত হই, আমি মাসুদ রানা আকার্ডিয়া মারকাসকে খালি হাতে খুন করে জুলহাস কায়সার হত্যাকাণ্ডের প্রতিশোধ নেবই।

দোতলায় ওঠার পর তুলনায় ছোট আরও একটা পাথর ছুটে এলো রানার দিকে। মাথাটা নিচু করে নিতে সিঁড়ির ধাপে পড়ে গড়াতে শুরু করল সেটা। সরু মেঝের শেষ দিকের কিনারায় দাঁড়িয়ে রয়েছে মারকাস। কাঠামোর খোলা দিকটা তার পিছনে। হিংস্র দৃষ্টিতে রানার দিকে তাকিয়ে আছে সে, চোখেমুখে মরিয়া ভাব। দালানটার পিছনে ক্রমশ উঁচু হয়ে উঠে যাওয়া ঢালটার দিকে তাকাল সে-পাথুরে সারফেস, চারদিকে বোল্ডারের ছড়াছড়ি। এক পলকের জন্যে ইতস্তত ভাব দেখা গেল, তারপর লাফ দিল সে। তাকে পাথরের ওপর পড়তে দেখল রানা, শরীরটাকে সঙ্গে সঙ্গে গড়িয়ে দিয়েছে। থেমে একটা গোড়ালি আঁকড়ে ধরল, ব্যথা আর রাগে মোচড় খাচ্ছে মুখ। হামাগুড়ি দিয়ে গোল একটা বোল্ডারের কাছে চলে এলো সে। একটা পাথরের কার্নিসের ওপর কেউ বলতে পারবে না কিভাবে বসে আছে ওটা। ডায়ামিটারে তিন ফুট হবে বোল্ডারটা, ওটার সামনের তলায় ছোট কিছু পাথর আটকে আছে, কার্নিস থেকে ওটার পড়ে না যাবার সেটাই বোধহয় একমাত্র কারণ। বোল্ডারটাকে আগাছা আর ঘাস প্রায় ঘিরে রেখেছে। ছোট পাথরগুলোর দিকে হাত বাড়াল মারকাস রানার দিকে ছুঁড়বে বলে।

লাফ দিয়ে তার পাশের মেঝেতে পড়ল রানা। পড়েই আছাড় খেলো, তবে দাঁড়াতে পারল সঙ্গে সঙ্গে, কোথাও তেমন ব্যথা পায়নি। বোল্ডারটার তলা থেকে এখনও একটা পাথর বের করার চেষ্টা করছে মারকাস; ফোঁস ফোঁস করে নিঃশ্বাস ফেলছে, নিঃশ্বাসের সঙ্গে খিস্তি করছে পাথরটাকে। তার দিকে ঘুরছে রানা, ছোট পাথরটা বোল্ডারের তলা থেকে বের করে আনল সে। তারপর সিধে হলো, চোখেমুখে বিজয়ীর হাসি; ওখানেই দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করছে, রানা নাগালের মধ্যে এলে পাথরটা ওর মাথায় ভাঙবে। ‘আয় শালা, তোর মগজ বের করি,’ হিসহিস করে বলল সে। ‘অনেক জ্বালিয়েছিস…’

নড়ে ওঠাটা দু’জন একই সময়ে দেখল। ওর কাছের বোল্ডার, ঠেকো হিসেবে তলার পাথরটা সরিয়ে নেয়ায়, পাথুরে কার্নিসের ঢালু মেঝে থেকে গড়িয়ে নামতে শুরু করেছে। মারকাসের মাথা থেকে ঠিক এক ফুট ওপরে কার্নিসটা। বোল্ডারটা নড়ছে দেখে তাকাল মারকাস। তাকিয়েই থাকল। ওটা যেন ওকে সম্মোহিত করে ফেলেছে। মাত্র সিকি সেকেন্ড সময় পেতে পারত মারকাস। ওইটুকু সময় ইতস্তত করল ওটা, তারপর কার্নিসের কিনারা থেকে গড়িয়ে মারকাসের দিকে পড়তে শুরু করল।

একে তো হাতে ভারী পাথর, তার ওপর গোড়ালি ভাঙা, মারকাস যথেষ্ট দ্রুত সরে যেতে পারল না। এগোতে গিয়েও প্রযোজন নেই বুঝতে পেরে থেমে গেল রানা। বোল্ডারটা তার নাগাল পেতে যাচ্ছে দেখে আতঙ্কে মারকাসের চেহারা সম্পূর্ণ বদলে গেল।

বোল্ডারটা যখন নাগালের মধ্যে পেল, দু’হাত বাড়িয়ে দিল মারকাস-যেন ওটার নেমে আসা ঠেকাতে চাইছে সে। কিন্তু ইতিমধ্যে কার্নিসের কিনারা থেকে এত বেশি নেমে এসেছে, ওটার অধোগতি ঠেকাবার সাধ্য এখন কারও নেই। প্রকাণ্ড পাথরটা ধীর গতিতে গড়িয়ে মারকাসের বুকে চড়ল, এক মুহূর্ত টলমল করল, তারপর থেকে গেল ওখানেই। ওটা যখন প্রথম ছুঁলো তাকে-তীক্ষ্ন, কর্কশ, রোমহর্ষক চিৎকার বেরিয়ে এলো মারকাসের গলা চিরে। তারপর হঠাৎ থেমে গেল আওয়াজটা, যেন কেউ নব ঘুরিয়ে একটা রেডিও বন্ধ করে দিল।

রানা গম্ভীর; ঘুরে আরেক দিকে চলে এল, বোল্ডারটার এদিকের তলা থেকে মারকাসের মাথা আর কাঁধ বেরিয়ে আছে। তার চোখ খোলা, তবে দৃষ্টি নেই; তাকিয়ে আছে সাদা, উত্তপ্ত আকাশের দিকে। একটা হাত ঝাঁকি খেলো, তারপর স্থির হয়ে গেল গোটা শরীর। তাকে রানার খুন করতে হয়নি, প্রতিশোধ প্রকৃতিই নিল।

ডাফু সালজুনাসকে নিয়ে বহুরঙা চাঁদোয়ার নিচে, একটা ওয়াটারফ্রন্ট কাফেতে বসে, নীল সাগরে ভেসে যেতে দেখছে রানা জেলে নৌকার বহরগুলোকে। শান্ত ও সিড়বগ্ধ সকাল, সময়টা উপভোগ করছে ওরা।

‘আমি ও জেনারেল সেরাফ গোটা ব্যাপারটা কর্তৃপক্ষকে ব্যাখ্যা করেছি, এবং আপনার ও মিস তারানার প্রতি তারা সত্যি খুব কৃতজ্ঞ। এখানে কর্তৃপক্ষ বলতে বোঝাতে চাইছি প্রেসিডেন্ট কন্সটানডিনস স্টেফানোপাউলস ও প্রধানমন্ত্রী কন্সটানটাইন সিমিটিসকে।’

কয়েক মিনিটের জন্যে ওদেরকে ছেড়ে গেছে তারানা। দূরে কোথাও যাবে না, একটা ইংরেজি কাগজ নিয়ে ফিরে আসবে।

‘গেনাডি গাম্বুসের জন্যে সত্যি আমি দুঃখিত,’ বলল রানা।

‘মারকাসের বিরুদ্ধে দাঁড়ান তিনি বৈরি একটা সময়ে।’

‘সব যুদ্ধেই, ছোট হোক আর বড়, কিছু হতাহত হবেই,’ বললেন সালজুনাস, কফির কাপে চুমুক দিয়ে একটা হাভানা চুরুট ধরালেন। রানাকে সাধলেন না, কারণ আগেই জেনেছেন যে ধূমপান ছেড়ে দিয়েছে ও। ‘মারকাসের সঙ্গে হাত মিলিয়ে যে-সব সামরিক অফিসার ক্যু ঘটাতে যাচ্ছিল, জেনারেল কাউরিসের কাছ থেকে তাদের একটা তালিকা পাওয়া গেছে। ইতিমধ্যে সবাইকে গ্রেফতারও করা হয়েছে।’ একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললেন তিনি। ‘মারকাস হাজার হাজার, এমনকি সম্ভবত লাখ লাখ মানুষকে নরক যন্ত্রণায় ভোগাত আপনি যদি তাকে না থামাতেন। সেজন্যে মাইকোনোসে উড়ে এসেছি আমি আপনাকে ব্যক্তিগতভাবে ধন্যবাদ জানাতে। জেনারেলরাও আপনাকে ধন্যবাদ জানাবেন, তবে সেটা এথেন্সে-জনগণের তরফ থেকে সংবর্ধনা আর সরকারের তরফ থেকে আপনাদের দু’জনকে গ্রীসের সবচেয়ে বড় সম্মানিত পদক দিয়ে…’

মাথা নাড়ল রানা। ‘আমার তরফ থেকে ধন্যবাদ দেবেন তাঁকে,’ বলল ও। ‘তবে আমাদের পেশায় পদক-টদক গ্রহণ করার কোন উপায় নেই।’

‘ঠিক আছে, সংবর্ধনা বাদ,’ বললেন সালজুনাস, ‘কিন্তু পদক নিতে অসুবিধে কি, ওগুলো তো শুধুই রিবন! আপনাদেরকে কোথাও যেতেও হবে না, সরকারই পাঠিয়ে দেবে…’

হেসে ফেলল রানা। ‘ঠিক আছে, তাতে আমার কোন আপত্তি নেই।’ তারপর প্রসঙ্গ পাল্টে জানতে চাইল, ‘আপনি কি এখন পেন্টহাউসে ফিরে যাবেন?’

‘ওই জায়গা থেকে সরে যাচ্ছি আমি,’ বিলিওনেয়ার শিপিং ম্যাগনেট বললেন। ‘যা ঘটে গেল তা থেকে আমি এই শিক্ষাই পেয়েছি যে বাইরের জগৎ থেকে নিজেকে লুকিয়ে রাখাটা কোন মানুষেরই উচিত নয়। দেশকে এখনও বোধহয় অনেক কিছু দেয়ার আছে আমার।’ গাঢ় চোখে রানাকে কয়েক মুহূর্ত দেখলেন, তারপর অনুনয়ের সুরে বললেন, আপনার কাছে আমার একটা ছোট্ট অনুরোধ আছে, মিস্টার রানা।’

‘অনুরোধ? বলুন?’

‘এটা সম্পূর্ণ ব্যক্তিগত একটা ব্যাপার। আপনি ‘না’ বলতে পারবেন না।’

‘না শুনে হ্যাঁ-ই বা বলি কি করে!’

‘না, ঠাট্টা নয়, অনুরোধটা আমি সিরিয়াসলি করছি।’

‘বলুন।’

‘আমি যে এখনও বেঁচে আছি, কৃতিত্বটা আপনার,’ বললেন সালজুনাস। ‘আমি আপনার এই ঋণ কোনদিনই শোধ করতে পারব না। তাই আপনাকে ছোট্ট একটা উপহার দিতে চাই। ইজিয়ান সাগরে আমার কেনা একটা দ্বীপ আছে। এয়ারস্ট্রিপ, ফাইভস্টার হোটেল, সীবীচ রিসর্ট, পাঁচটা জেটি ইত্যাদি সব একেবারে তৈরি অবস্থায় আছে। ওটা আপনাকে আমি প্রেজেন্ট করতে চাই। সমস্ত কাগজ-পত্র তৈরি করে আমি পাঁচ-সাত দিনের মধ্যে পাঠিয়ে দেব…’

‘কিন্তু…’

‘আপনি এই উপহার প্রত্যাখ্যান করলে সত্যি কষ্ট পাব আমি,’ রানাকে থামিয়ে দিয়ে বললেন সালজুনাস।

‘আমি প্রত্যাখ্যান করছি না, মিস্টার সালজুনাস। আপনার উপহার আমি কৃতজ্ঞচিত্তে গ্রহণ করে আপনার হাতেই ফেরত দিচ্ছি। আমি এমন একটা পেশায় আছি, যাতে কারও কোনও উপহার গ্রহণ করা সম্ভব নয়। আজ আমি হয়তো আমার দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে আপনার কিছুটা উপকার করে ফেলেছি, কিন্তু আগামীকাল, কে জানে, কর্তব্য পালন করতে গিয়ে ক্ষতিও তো করতে পারি।’

মুখটা কালো হয়ে গেল শিপিং ম্যাগনেটের। খানিকক্ষণ চুপ করে থেকে বললেন, ‘আপনি বিশাল সাউল শিপিং লাইনসের অধিপতি…’

‘হয়তো দেখায় সেরকম, কিন্তু সাউল থেকে একটি পয়সা আমি গ্রহণ করি না। আমার নামে চলছে রানা ইনভেস্টিগেশন এজেন্সি, কোটি কোটি টাকা রোজগার করছে এ প্রতিষ্ঠান, কিন্তু এর একটি পয়সাও আসে না আমার পকেটে।’

‘তাই নাকি?’ অবাক চোখে রানাকে দেখলেন সালজুনাস। ‘তাহলে আপনার চলে কি করে?’

‘বেতনের টাকায়। আমি সামান্য একজন বেতনভুক সরকারী কর্মচারী।’

‘তাহলে…?’ হতাশ ভঙ্গিতে জানতে চাইলেন সালজুনাস, ‘আমি কি আমার কৃতজ্ঞতা জানাবার কোনও…’

‘আছে,’ মিষ্টি হাসি ফুটল রানার মুখে। ‘আমার দেশ গড়ার কাজে আপনি কোন অবদান রাখলে আমি কৃতার্থ বোধ করব।’

মাথা ঝাঁকালেন শিপিং ম্যাগনেট, শ্রদ্ধা ফুটল তাঁর দৃষ্টিতে। ‘বুঝলাম। ঠিক আছে, নতুন একটা অফিসে গুছিয়ে বসে নিই, আগামী মাসেই ঢাকায় একটা প্রতিনিধি দল পাঠাচ্ছি আমি বিনিয়োগ চুক্তিটা চূড়ান্ত করার জন্যে।’

‘তাহলে আমার চেয়ে খুশি আর কেউ হবে না,’ বলল রানা মৃদুকণ্ঠে।

‘আর একটা কথা, প্লীজ! মিস তারানার জন্যে এই হীরের নেকলেসটা…’ ব্রিফকেস থেকে বের করে একটা গহনার বাক্স খুললেন তিনি। ‘উনিও কি আমাকে প্রত্যাখ্যান করবেন?’ রানা দেখেই আন্দাজ করতে পারল, অসম্ভব দামী একটা উপহার, রাজকীয় ঐশ্বর্যই বলা যায়।

‘সেটা ও-ই বলতে পারবে। তবে ওরা সৌন্দর্যের পূজারি, আমার মনে হয় গহনা জিনিসটা মেয়েদের পক্ষে ফিরিয়ে দেয়া কঠিন। দিয়ে দেখতে পারেন।’

‘ধন্যবাদ, মিস্টার রানা। আপনাকে অসংখ্য ধন্যবাদ।’ নেকলেসটা বাক্সে ভরে ব্রিফকেসে রেখে দিলেন সালজুনাস। ‘এটা একটা সারপ্রাইজ গিফট হতে যাচ্ছে, চার-পাঁচ দিন পর কুরিয়ার সার্ভিসে পাঠাব।’ হঠাৎ ভুরু কোঁচকালেন ভদ্রলোক। ‘আচ্ছা, বলতে পারেন, মিস তারানা তখন ঠিক কোথায় থাকবেন?’

‘আমার ধারণা রাহমানিয়া ইন্টারন্যাশনালে,’ বলল রানা। ‘তবে, ওই তো আসছে ও, ওকেই জিজ্ঞেস করে জেনে নিন।’ কয়েক সেকেন্ড পর ওদের টেবিলের পাশে এসে দাঁড়াল তারানা, হাতে লন্ডনের একটা খবরের কাগজ। ‘প্রতিদিন এই পেপার প্লেনে করে এখানে পাঠানো হয়, তারপরও মাত্র কয়েক ড্র্যাকমার কিভাবে বিক্রি করে বুঝলাম না,’ বলল সে।

‘মারকাসের কথা কিছু লিখেছে?’

কাগজটা টেবিলে মেলে ধরল তারানা, ওরা যাতে পড়তে পারে। বড় হরফে হেডলাইন করা হয়েছে খবরটা: গ্রীসে সামরিক অভ্যুত্থানের চেষ্টা ব্যর্থ। খবরের পাশে মিস্টার সালজুনাসের একটা ছবিও ছাপা হয়েছে।

‘এই খবর হয়তো আপনার কোম্পানির শেয়ার দর বাড়িয়ে দেবে,’ বলল রানা, হাসছে। চেয়ার ছেড়ে তারানার কোমরে একটা হাত রাখল ও। ‘মিস্টার সালজুনাস জানতে চাইছিলেন আগামী পাঁচ-সাতদিন কোথায় পাওয়া যাবে তোমাকে।’

‘কেন, এই দ্বীপে। রাহমানিয়ায়। এত দৌড় ঝাঁপের পর কম পক্ষে একটা হপ্তা ছুটি তো পেতেই পারি আমরা, তাই না?’

‘আমরা হোটেলের দিকে যাচ্ছি,’ সালজুনাসকে বলল রানা। ‘আপনিও কি আমাদের সঙ্গে হাঁটবেন?’

মাথা নাড়লেন ভদ্রলোক। ‘আমি জানি দু’জন মানুষ কখন একা হতে চায়। ফ্লাইটের সময় না হওয়া পর্যন্ত এখানে বসে ঠাণ্ডা বিয়ার খাব-ধন্যবাদ-আর তাকিয়ে দেখব ওই বিশাল ক্রুজ শিপটা কিভাবে হারবারে ঢোকে। সুন্দর একটা জাহাজের হারবারে ঢোকা দেখতে সত্যি দারুণ ভাল লাগে আমার।’

‘সেক্ষেত্রে গুডবাই, মিস্টার সালজুনাস,’ বলল রানা। ‘আবার হয়তো ভাল কোন পরিবেশে দেখা হবে আমাদের।’

‘হ্যাঁ, হতেই পারে,’ বলে হাসলেন তিনি। হাত নেড়ে বিদায় জানালেন ওদের।

***

Super User